একা একা – ৩

০৩.

রিনির চুল বাঁধা শেষ হয়ে এসেছিল; লম্বা বিনুনিটা বুকের ওপর টেনে নিয়ে সাদা রিবনের ফাঁস জড়াতে জড়াতে বারান্দায় এসেছিল, বেসিনে গিয়ে হাতটা একটু ধুয়ে নেবে, হেয়ার ক্রিমে হাত চটচট করছে। আচমকা ভেতর থেকে হাসি শুনল। বারান্দায় হাসবার মতন কেউ নেই। সরলাদি রান্নাঘরের দিকে কী একটা কাজ করছে, নারান নীচে। বেসিনের কাছে দাঁড়িয়ে রিনি হাসির শব্দটা কান পেতে শুনল। মার ঘনশ্যাম হাসছে। তার ঘরে বসে বসে হাসছে। হেসে যেন গড়িয়ে পড়ছে। রিনির মাথায় এল না, নেহাত পাগল ছাড়া একলা ঘরে বসে কে আর হাসতে পারে! ছেলেটার মাথাও খারাপ নাকি?

হাত ধুয়ে, রিনি তনুর ঘরে গিয়ে দাঁড়াল। তনু জানলার কাছে দাঁড়িয়ে। রাস্তা দেখছে। কিংবা চিলড্রেন পার্কে বাচ্চাকাচ্চাদের খেলাধুলো দেখছে হয়তো। রাস্তায় কিছু দেখে তনুর হাসি পেয়েছে নিশ্চয়।

রিনি সাড়া দিল।

তনু ফিরে তাকাল। এখন আর তার চোখে সেই দিনের বেলার চশমা নেই। রঙিন, চোখ-ঢাকা চশমার বদলে তার চোখে পুরু কাচের সাধারণ চশমা। তনুর চোখ দেখা যাচ্ছিল।

রিনি এমন চোখ করে তাকিয়ে থাকল, যেন জিজ্ঞেস করছিল, ব্যাপার কী? এত হাসির কী হয়েছে?

 তনু নিজের থেকেই বলল, কলকাতায় বহুত মজা আছে।

এবার রিনির নিজেরই হাসি পেল: শ্যামের কথাতেও মজা কম নয়। রিনি ভুরু তুলে যেন তনুশ্যামের মাথার মাপটা, কিংবা মগজের পরিমাপটা অনুমান করতে করতে বলল, মজাটা হল কোথায়? সে মজার স্থান কাল-পাত্র জানতে চাইছিল।

তনু জানলা দিয়ে বাইরের দিকটা দেখাল।

রিনি এগিয়ে গিয়ে বাইরে তাকাতে তেমন কিছু দেখতে পেল না। হঠাৎ সে পাখি-ডাকের শব্দ শুনল, তীব্র ডাক। রিনি যেন সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। চিলড্রেন্স পার্কের গেটের সামনে একটা আধ-পাগলা ছেলে মাঝে মাঝে এসে বসে; মুখের সামনে মুঠো পাকিয়ে নানা ধরনের পশুপাখির ডাক ডাকে, রাজ্যের বাচ্চাকাচ্চা তাকে ঘিরে জটলা পাকায়, কেউ বলে, ঘুঘু ডাকো, কেউ বলে, কোকিল ডাকো। ঘুঘু, কোকিল, টিয়া, ময়না, কুকুর, বেড়াল, শেয়াল ডাকতে ডাকতে ছেলেটার দম ফুরিয়ে গেলে সে চুপ করে বসে বসে বিড়ি খায়। বাচ্চাগুলোও অদ্ভুত। তাদের যার যা থাকে, চিনেবাদাম, ডালমুট, চুইং গাম, লেবু লজেন্স–ছেলেটাকে উদার হাতে বিতরণ করে দেয়। দু-চারজন যে জ্বালাতন না করে তাও নয়, তবে সেটা তেমন কিছু না। ওই পাগলা ছেলেটা নাকি শীতকালে সার্কাসের দলে কাজ করেছে।

রিনি বুঝতে পারল, সেই পাগলা ছেলেটার চারপাশে বাচ্চাকাচ্চার ভিড় আর ছেলেটার বিচিত্র সব ডাক শুনে তনুর হাসি পেয়েছে। এতে হাসির যে কী আছে রিনি বুঝল না।

রিনি বলল, ও আধ-পাগলা। জীবজন্তুর ডাক ডাকে।

তনু বলল, পাগলরা খুব ট্যালেন্টেড হয়।

 রিনি প্রথমে অবাক হল, তারপর আড়চোখে তনুর দিকে তাকিয়ে থাকল। তার হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু হেসে ফেললে তনুকে খোঁচা মেরে ঠাট্টা করা যাবে না বলে হাসিটা চেপে কী বলবে কী বলবে ভাবছিল।

তনু নিজেই বলল, আমাদের ওখানে একটা পাগলা আছে, ফার্স্ট ক্লাস ডিজাইনার।

ডিজাইনার? কী ডিজাইন করে?

সব। তনু কথার শেষে বেশ একটা জোর দিল শব্দে, রিনিরা ঠিক এভাবে সব বলে না। আমাদের কলেজে আগে মালী ছিল বানোয়ারি; এখন পাগলা হয়ে গেছে। গার্ডেনের ডিজাইন করে, গেট ডিজাইন করে, প্যাণ্ডেল বানাতে পারে, দেওয়ালিতে দীপ সাজায়…ভেরি ট্যালেন্টেড।

রিনি চোখ বাঁকা করে খোঁচা মেরে বলল, তোমার ডিজাইনও ও করেছে?

তনু কেমন থমকে গেল। তারপর হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, এ ম্যান ইজ ডিজাইনড অ্যান্ড ডেস্টিনড বাই গড।

রিনি আর হাসতে পারল না। তার অমন ঠাট্টাটা মাঠে মারা যাওয়ায় যেন বিশ্রী লাগছিল।

তনুর সঙ্গে রিনির আলাপ-সালাপ হয়ে গিয়েছে আগেই, নীহার যেমন ওপরে গিয়েছিলেন শরদিন্দুর জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার ফাঁকা করে দিতে তেমন মেয়েকে ভার দিয়েছিলেন তনুর জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরটাকে পরিষ্কার করার। অবশ্য নিজেই তিনি মেয়েকে দিয়ে খানিকটা খানিকটা গুছিয়ে দিয়েছিলেন, বাকিটা রিনি সেরে ফেলেছে। তনুর ঘরে লটবহর কমই জমা ছিল।

তনু আর রিনির মধ্যে আলাপটা তখনই ঘটে যায়। তারপর চায়ের সময় রিনি নিজের হাতে চা ঢেলে তনুকে নিয়েছে, দুজনে এক সঙ্গে বসে বসে চা খেয়েছে, গল্প করেছে।

রিনি তনুর চোখের দিকে তাকাল। চা খাবার সময়ই তনু চশমা বদল করে ফেলেছিল; রোদের আলোর ঝাঁঝ কমে গেলে রঙিন চশমাটা পরার কিংবা চোখ ঢেকে রাখার দরকার তার হয় না। তনুর চোখের চারপাশ তার গায়ের রঙের চেয়ে ফরসা। চোখ আড়াল রেখে রেখে এরকম হয়েছে। চামড়াটা পাতলা দেখায় চোখের পাশে, কেমন দুর্বল, বড় বড় চোখ করে সমস্ত পাতা মেলে তনু তাকাতে পারে না, চোখ ছোট করে তাকায়। রিনি লক্ষ করেছে তনুর চোখের পাতা যেন অনেকটা আধবোজা হয়ে থাকে, পলক পড়ে তাড়াতাড়ি। চোখের মণি খানিকটা কটা রঙের। আশ্চর্য লাগে কিন্তু চোখ দুটির দিকে তাকালে-কেমন যেন নরম, সরল, নিরীহ, সকৌতুক। পুরু কাচের চশমার আড়াল থেকেও ওর বিস্ময়, হর্ষ, ছেলেমানুষি স্পষ্ট ধরা পড়ে।

রিনি তনুর চোখ দেখতে দেখতে এবার বলল, বিদ্যের জাহাজ!

 জাহাজ?

যা বড় বড় কথা শুনছি।

বড় কথা কেন! বইয়ে এমন কথা পড়তে হয়। কোথাও পড়েছি

থাক, আর শিক্ষা দিতে হবে না। রিনি মজার ভঙ্গি করে হাত নেড়ে বলল, পড়াশোনার কথা শুনলে, আমার জ্বর হয়।

মগর, তুমি কলেজে পড়।

আমি কলেজে যাই বেড়াতে, হুল্লোড় করতে, ফুচকা খেতে।

তনু ছেলেমানুষের মতন কৌতুক বোধ করে হাসছিল। তোমাদের কলেজ কোথায়?

 রিনি ঠাট্টা করে বলল, কমনরুমে, গড়িয়াহাটার মোড়ে, চায়ের দোকানে…

 তনু কিছু বুঝল, কিছু বুঝল না। হাসতে লাগল।

কী ভেবে রিনি হঠাৎ সদয় হল, বলল, আমাদের কলেজটা কোথায় তুমি বুঝবে না। কলকাতার কী চেন তুমি? এখান থেকে কলেজ খানিকটা দূরে।

তনু বলল, আমাদের কলেজ আর কোয়ার্টার্স পাশাপাশি। আমাদের কলেজের কম্পাউন্ড খুব বড়। পাশেই প্রফেসরদের কোয়ার্টার্স।

বুঝতে পারছি, রিনি এবার বিনুনিটা হাতের ঝাঁপটায় পিঠের দিকে ঠেলে দিল, ঘাড় নাড়ল। সামান্য, ঠাট্টা করে বললে, নয়তো গায়ে অত বিদ্যের গন্ধ থাকত না।

তনু হাসিমুখে রিনিকে দেখছিল; কোনও কথা বলল না।

রিনি ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়েই বুঝতে পারছিল, বিকেল শেষ হয়ে যাচ্ছে, বাইরে আর রোদ-টোদ নেই; ছায়া জমেছে। রাস্তায় বোধহয় বাতি জ্বলে ওঠার সময় হয়ে গেল।

কী মনে করে রিনি বলল, আমি একটু বাইরে যাব। যাবে?

সঙ্গে সঙ্গে তনু মাথা নেড়ে সায় দিল। রিনি বলল, ঠিক আছে; যাবার সময় ডাকব।

রিনি ঘর ছেড়ে চলে এল। নিজের ঘরে আসতে আসতে রিনির হাসি পাচ্ছিল। মার শ্যাম বা শ্যামচাঁদ বেশ ক্যাবলা; হাঁদা টাইপের।

এমন বোকা, গণেশ মার্কা ছেলে, বাবা আর দেখা যায় না। কলকাতার ছেলেদের পাশে একেবারে অচল, গেঁয়ো। তনুকে যদি একবার রিনিদের কলেজের কমনরুমে নিয়ে যাওয়া যায়–মেয়েরা ওকে ঠুকরে ঠুকরেই শেষ করে দেবে। হেনা তো প্রথমেই বলবে, কোথাকার ডেসপ্যাঁচ রে রিনি, অ্যাস আইল্যান্ড থেকে? হেনাটা যেমন ফাজিল, তেমনই চতুর। মেয়েদেরই যা পেছনে লাগে, কাঁদিয়ে ছাড়ে, তা ছেলে! হেনা অদ্ভুত অদ্ভুত কথা তৈরি করে। তার মতন ঠোঁট কাটা মেয়েও বাবা দুটি নেই।

রিনি তাড়াতাড়ি শাড়ি জামাটা বদলে নিতে লাগল। তাকে একবার দোকানে যেতে হবে। মনিহারি দোকানে। কয়েকটা জিনিস আনতে হবে। মা বলেছে। রিনিরও দু একটা জিনিস রয়েছে নিজের। কটা ক্লিপ দরকার, এক ডজন জামার হুক, গরমে ঘাড়ের কাছে ঘামাচি হচ্ছে, বোরেটেড পাউডার নিতে হবে। রিনি একটা ফোন করবে মাধুকে।

শরদিন্দুমামার ছেলেটি বোকাসোকা, হাঁদা যাই হোক এমনিতে কিন্তু বেশ। খুব সরল। রিনির সঙ্গে ভাব হবার পর গড়গড় করে নিজের কথা বলে গেল। তার চোখ ছেলেবেলা থেকেই খারাপ। স্বাস্থ্যও ছিল রোগা। আগে মাথা ধরত খুব, তারপর দূরের জিনিস দেখতে পেত না। আট ন বছর বয়স থেকেই চশমা উঠেছে চোখে। চশমার পাওয়ার বছর বছর এত বেড়ে চলল, সেই সঙ্গে আরও নানা উপসর্গ এমন হয়ে দেখা দিল যে তনুকে হরদম চোখের ডাক্তারের কাছে ছুটতে হত। তার শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে মামাও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সাধারণ স্বাস্থ্যের জন্যে অনেক ওষুধপত্র খেয়েছে তনু; তাতে শরীরে উপকার হলেও চোখের কিছু হয়নি। এক এক ডাক্তার এক এক রকম বলে, চিকিৎসা করে, শেষে চোখ দুটোর যায়-যায় অবস্থা। বাবার সঙ্গে তনু নানা জায়গায় চিকিৎসা করাতে গেছে। কিছু উপকার হয়নি। এক সময় তনুর এমন হয়েছিল যে, বই পর্যন্ত ছোঁয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকতে হত। তারপর একজন ডাক্তার সন্দেহ করলেন, উলটোপালটা চিকিৎসার জন্যে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। পুরনো সব চিকিৎসা বন্ধ করতে হবে। করে দেখতে হবে চোখ আবার কতটা স্বাভাবিক হয়। তিনি কয়েকটা সাধারণ স্বাস্থ্যের ওষুধ দিলেন, আর চোখের কয়েকটা একসারসাইজ শিখিয়ে দিলেন। তাতে সত্যিই খানিকটা উন্নতি হল। লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল তনুকে; আবার সে কলেজ যাতায়াত, পড়াশোনা শুরু করল। কিন্তু তার চোখের ব্যাধিটা যাচ্ছে না, নানারকম কষ্ট হয়, উপসর্গ দেখা দেয়। চোখের দৃষ্টিশক্তি আরও ক্ষীণ হয়ে আসছে। চশমার পাওয়ার বাড়িয়ে আর কতকাল চলবে! বাবা তাই কলকাতায় নিয়ে এসেছেন বড় ডাক্তার-টাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাবেন।

রিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে আলতো করে পাউডার বুলিয়ে গায়ের কাপড়টা ঠিক করে নিল। সে এমন কোথাও যাচ্ছে না, যাবে পাড়ার দোকানে, সাজসজ্জায় ঘটা করল না। এমনিতেও সে সাজগোজের ঘটা বড় একটা করে না। তার ভাল লাগে না তেমন। রিনি ঘরের বাইরে এসে তেতলার সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেল, মার কাছে। কথা বলে নীচে নেমে এসে আবার মার ঘরে গেল, টাকা পয়সা নিয়ে বাইরে আসতে আসতে ডাকল তনুকে। নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে দোলাতে দোলাতে বাইরে এসে দেখে তনু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে।

সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে রিনি হেসে বলল, মা বলল, তোমায় সব সময় চোখে চোখে রাখতে, হাত ধরে নিয়ে যেতে। রিনি একটু বাড়িয়ে বলল অবশ্য।

তনু বলল, কেন?

 কলকাতার রাস্তা, গাড়িঘোড়ার ভিড়, কে জানে কোন বিপদ বাধিয়ে বসো৷

কথাটা তনু হালকাভাবেই নিল, বলল, না না, আমি ঠিক আছি।

নীচে নার্সারি স্কুলের ঘরগুলো বন্ধ। সিঁড়িতে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে রিনি৷ নার্সারির পাশে এক চিলতে জমি, একটা দোলনা ঝোলানো রয়েছে। দশ পনেরো পা হেঁটে এসে ছোট কাঠের গেট। তারপর রাস্তা।

রাস্তায় এসে রিনি বলল, আমাদের পাড়াটা কিন্তু এখনও অন্য জায়গার চেয়ে ফাঁকা। খুব হইচই নেই। ফুটপাথ ধরে রিনি হাঁটতে লাগল।

তনু পাশে পাশে হাঁটছিল। বলল, এখানকার বাড়িগুলো খুব ডিসেন্ট। কত উঁচু-উঁচু। আমাদের শহরে ওল্ড টাউনে বিলকুল পুরনো বাড়ি। নিউ টাউনে বিশ-পঁচিশটা ভাল বাড়ি হয়েছে। আমরা থাকি টাউনের ওয়েস্ট সাইডে কলেজ এরিয়ায়। আমাদের দিকটা লোনলি।

রিনি শুধোল, খুব ফাঁকা?

বহুত ফাঁকা। পিচ রোড। দুপাশে গাছ। একটা পুরনো চার্চ আছে। চার্চটার খুব বিউটি। পাহাড়ের মতন উঁচু জমিতে চার্চ, চারদিকে গাছ, নীচে চার্চের তলায় ক্রিসমাসে ফিয়েস্টা হয়। …

ফিয়েস্টা?

 মেলা, তনু রিনির দিকে তাকাল, কোনও সেন্টস ডে সেলিব্রেট করাকে ফিয়েস্টা বলে। খুব আমোদ আহ্লাদ নাচগান করে ফিয়েস্টা হত। স্পেন-টেনে এখনও হয়। আরও অনেক জায়গায় হয়। ওটা একরকম ফেস্টিভ্যাল। আমাদের ওখানে মেলার মতন হয়, বহুত লোক আসে।

রিনি ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, তোমাদের ক্রিশ্চান কলেজ তো?

হ্যাঁ; ওদিকে অনেক জায়গায় মিশনারি স্কুল কলেজ আছে। আমাদেরটা মেথডিস্ট চার্চের হাতে। ছোট কলেজ, মেনলি রেসিডেনসিয়াল।

রিনি আর কিছু বলল না। রাস্তায় মানুষজন কম নয়, সন্ধে হয়ে এল, বাতি-টাতি জ্বলে উঠেছে চারপাশে। আজ গরমটা মাঝামাঝি, তবু পিচের রাস্তার একটা ভাপ যেন অনুভব করা যাচ্ছে এখনও। বাতাসে ধুলোর গন্ধ। শুকনো বকুল গাছটার তলায় ফুটপাথ ঘেঁষে একজোড়া ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। সেজেগুজে মেয়েরা এসে উঠছে, বিয়ে বাড়ি-টাড়িতে যাবে হয়ত।

তনুকে মোটামুটি নজরে রেখে রিনি ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল। তনু অন্ধ নয়, তবু অন্ধেরই মতন। একেই তো হাঁদার মতন হাঁটছে, তার চোখ যে কোনদিকে তা খেয়াল করতে পারছে না রিনি। তনু রাস্তাঘাট, আলল, দোকান, বাড়ি, মানুষ কখন যে কোনটা দেখছে, দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে পড়ছে, এর তার গায়ে গিয়ে পড়ে সামলে নিচ্ছে–রিনি বুঝে উঠতে পারছিল না। দু-চারবার রিনিকে ডাকতে হল, সাবধান করতে হল। এরকম মানুষ নিয়ে পথ হাঁটা মুশকিল। তাও তো এই রাস্তায় বাস-টাস চলে না, নয়তো রিনিকে সত্যিসত্যিই তনুর হাত ধরে নিয়ে হাঁটতে হত।

তনু আর একটু হলেই খোঁড়া রাস্তার গর্তে পা ফেলত। রিনি বাঁচিয়ে দিল। তারপর ধমকের গলায় বলল, রাস্তা দেখে হাঁটো। এ তোমার এতোয়ারপুর নয়।

তনু রাস্তা দেখে হাঁটতে লাগল।

এখানটায় জাদা ভিড়।

ভিড় হবে না! সন্ধেবেলায় লোকে বাইরে বেরিয়েছে, মানুষজন অফিস-টফিস থেকে ফিরছে, এখন তো ভিড় হবেই।

সামনেই রিনিদের মনিহারি দোকান। রিনি দোকানের দিকে এগুল না। তনুকে ট্রামরাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যাবে বেড়াতে, তারপর ফিরবে। সোজা হাঁটতে লাগল রিনি। রাস্তায় নানা ধরনের জটলা। মোড়ের মাথায় এলে একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ছে সে তনুকে নিয়ে, তারপর দুপাশ ভাল করে দেখে রাস্তা পেরোচ্ছে।

একটা আইসক্রিমের দোকান হয়েছে নতুন, সেখানে মেয়েদের খুব ভিড়। যত রাজ্যের পাড়ার মেয়ে বউ ভিড় করে আইসক্রিম খায়। তনুকে কলকাতার একটা আইসক্রিম খাওয়াতে ইচ্ছে হল রিনির। নিজেরও লোভ রয়েছে। কিন্তু ওই মেয়েলি ভিড়ে তনুকে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করল না। রিনি তফাত থেকেই চেনা মুখ দেখতে পাচ্ছিল। কেউ ডেকে ফেলতে পারে ভেবে রিনি অন্যমনস্কর ভান করে জায়গাটা পেরিয়ে গেল।

ট্রামরাস্তার কাছাকাছি এসে রিনি সেই ছোঁড়াদের জটলাটাকে দেখতে পেল। চায়ের দোকানের সামনে এই জটলা রিনি তার বাচ্চা বয়স থেকেই দেখছে। কিছু কিছু মুখ অদল বদল হয়েছে এইমাত্র, নয়তো সেই একই ধরনের জটলা। এক দঙ্গল ছেলে নানা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, এ ওর গলাটলা জড়িয়ে সারাটা সন্ধে এখানে আড্ডা মারে। রিনি এদের কাউকে কাউকে চেনে, এই পাড়ারই ছেলে, ছেলেবেলায় এক সঙ্গে খেলাধুলোও করেছে। এখনও ওই ছেলেগুলোর বাড়িতে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে রিনিদের যেতে হয় সামাজিকতা রাখতে। রাস্তায় কিন্তু পরস্পরের মধ্যে ব্যবহারটা অচেনার মতন। রিনি ওদিকে খুব কমই তাকায় না তাকিয়েও বুঝতে পারে কারা কারা আছে। ওই দলের মধ্যে একজনকে শুধু পছন্দ করে রিনি, শঙ্করদা। লম্বা চওড়া চেহারা, বছরে তিনবার চুল কাটে, হপ্তায় বার দুই দাড়ি কামায়, গলার আওয়াজ গমগম করছে, রাস্তা কাঁপিয়ে হাসে। আজকাল আবার হাতে বালা পরে, হিপিদের মতন জামা-টামা গায়ে চাপায়। রিনিকে মাঝেমধ্যে ডাকে শঙ্করদা। তবে জটলার মধ্যে ঠিক নয় এই রিনি বলে ডেকে নিজেই বন্ধুদের ভিড় থেকে এগিয়ে আসে, কাছাকাছি এসে দু-চারটে কথা বলে, খবরাখবর নেয়, তারপর অক্লেশে পঁচিশটা পয়সা চেয়ে বসে। রিনি দিয়ে দেয়। আসলে পঁচিশটা পয়সা সেই মুহূর্তে সিগারেট কেনার জন্যে দরকার, বন্ধুদের চা সিগারেট খাইয়ে, কাউকে আবার ট্রামভাড়া বাসভাড়া দিয়ে শঙ্করদার পকেট ফাঁকা। আপাতত রিনির পঁচিশ পয়সায় কটা চারমিনার হবে। তারপর আবার কাউকে ধরবে রাস্তায়। চেনা অচেনা বড় একটা গ্রাহ্য করে না। দিব্যি আছে শঙ্করদা। বলে, বুঝলি রিনি, আমার হচ্ছে মডেস্ট লাইফ, এ মংক ইন মডার্ন সোসাইটি। রিনি ভেঙিয়ে বলে মংকস লাইফ না আর কিছু! তার সাহস হয় না যে বলবে, এ তোমার মাংকিস লাইফ।

জটলাটাকে রিনি তফাতে রেখে চলে যেতে যেতে আড়চোখে একবার দেখে নিল। রিনি এবং তনুকে ওরা দেখছে। কে একজন আর-একজনকে হঠাৎ এমনভাবে তাড়া করলে যে তাড়া-খাওয়া ছোঁড়াটা ছুটে এসে প্রায় রিনিদের পাক খেয়ে আবার ফিরে গেল। এই রগড় বা ইতরামির অর্থ রিনি জানে। শঙ্করদা নিশ্চয় ওখানে নেই, থাকলে ওদের এই সাহস হত না।

বিরক্ত বোধ করে রিনি একটু তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল। সামান্য এগিয়েই যমুনার সঙ্গে দেখা। যমুনা মুখ নিচু করে একপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ মুখ তুলতেই রিনির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কী রে? রিনি বলল।

 রিনি।

কোথায় গিয়েছিলি?

এই একটু কাজে– যমুনা বলল, তাকে কেমন চঞ্চল, বিব্রত দেখাচ্ছিল। রিনিকে এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে।

রিনি যমুনার এই বিব্রতভাব বুঝতে পারছিল না। অথচ ওটা এমনই যে চোখে না পড়ে যায় না। যমুনার সাজপোশাকটাও রিনির কাছে দৃষ্টিকটু লাগছিল। গলায় পাথরের মালা, হাতে একগাদা প্লাস্টিকের চুড়ি, চোখে বড় করে পেনসিল টেনেছে, মাথার চুলে ফোলানো খোঁপা। শাড়িটাও খুব বাহারে।

যমুনার সঙ্গে দু-একটা কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও তার হাবভাব দেখে রিনি কিছু বলতে পারছিল না।

আমি যাই রে যমুনা পাশ কাটাবার জন্যে ব্যস্ত হল খুব। তারপর জবাবের জন্যে দাঁড়াল না, চলে গেল।

রিনি বেশ অবাক হল। যমুনাকে দেড় মাসের মধ্যে আর দেখেনি রিনি। মিল্ক বুথে চাকরি করত যমুনা, ছেড়ে দিয়েছে। কলেজ তো অনেক আগেই ছেড়েছে। ওর বাড়িতে নানারকম গোলমাল যাচ্ছিল রিনি শুনেছে। কিন্তু যমুনাকে আজ যেরকম মনে হল, বাড়ির গোলমালের জন্যে সেরকম হবার কথা নয়।

তনুকে ঘাড় ফিরিয়ে ডাকতে গিয়ে রিনি দেখে তনু নেই। আশেপাশে তাকিয়েও সে তনুকে দেখতে পেল না। আরে! দু পা পিছিয়ে গেল রিনি, ভাল করে দেখল, না, তনুকে দেখা যাচ্ছে না। এখানে এমন কিছু মানুষজনের ভিড় নেই যে, তনুকে দেখা যাবে না। কোথায় গেল তনু? কী আশ্চর্য। আচমকা কেমন এক উদ্বেগ বোধ করল রিনি। পেছনের দিকে না এগিয়ে রিনি তাড়াতাড়ি সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। অদ্ভুত ছেলে তো! এরকম মাথা খারাপ ছেলে সে আর দেখেনি, বাবা। এই পেছনে পেছনে আসছিল, পলকের মধ্যে বেপাত্তা! গেল কোথায়? রিনি চারদিকে খুঁজতে খুঁজতে সামনে এগিয়ে চলল, যতদূর সম্ভব দ্রুত পায়ে। তনু যেভাবে রাস্তা হাঁটে তাতে ভরসা করা যায় না। সামনে ট্রামরাস্তা, ডবলডেকার বাস ছুটছে সবসময়, আরও হাজার রকম গাড়িঘোড়া। একটা বিপদ না বাধিয়ে বসে। বিপদের কথা মনে আসতেই রিনির বুক ধক করে উঠল। ট্রামরাস্তার দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল রিনি৷

হঠাৎ রিনির নজরে পড়ল, বড় রাস্তার মোড়ে, আদ্যিকালের পাকুড়গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে তনু খুব বিমুগ্ধচিত্তে কলকাতার সন্ধে দেখছে। ট্রামের আসাযাওয়া, তার চাকার শব্দ, ঘন্টি, ডবলডেকার বাসের আকাশ কাঁপানো গর্জন, প্রাইভেট বাসগুলোর গায়ে কন্ডাক্টরদের দামামা বাজাবার আওয়াজ, মানুষজন, রিকশা–সমস্ত যেন তনুকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। ট্রামের মাথায় ফুলকি জ্বলে উঠল, আলো ঝলসে গেল, বাসের পেছনে কালো ধোঁয়া উড়ে রাস্তা অন্ধকার করে দিল, নীলচে রঙের টিউব আলোর বিজ্ঞাপনটা জ্বলে উঠেছে–তনু সবই কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করছে।

রিনি একেবারে তনুর গায়ের পাশে গিয়ে ডাকল, এই! ডাকবার সময় তার খেয়াল ছিল না যে, সে তনুকে বেশ একটু ঠেলা মেরে দিয়েছে।

তনু তাকাল।

 রিনি খানিকটা ধমকের গলায় বলল, বাঃ, অদ্ভুত ছেলে তো! আমি দাঁড়িয়ে আছি, আর তুমি দিব্যি হন হন করে এগিয়ে এলে? আমি এক্কেবারে বোকা। এদিক খুঁজছি, ওদিকে খুঁজছি। আশ্চর্য।

তনু বলল, আমি এইটুকু এগিয়ে এসে দাঁড়ালাম।

এইটুকু? রিনি পাশ ফিরে তারা যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই দূরত্বটা হাতের ইশারায় দেখাল।

 তনু বলল, কতটুকু আর?

রিনি ধমক দিল, কতটুকু আর! খুব মজা পেয়েছ। …একটা কিছু হলে তোমার নীহারপিসি আমার গলা কুপিয়ে দিত। খুব হয়েছে, আর বেড়িয়ে দরকার নেই। চলো।

তনু হেসে বললে, আমি সামনের রাস্তা পেরোইনি। তোমার জন্যে দাঁড়িয়েছিলাম।

 রিনি তার অভিভাবকত্বর মর্যাদা রেখে বলল, বেশ করেছিলে, এখন ফিরে চলো।

তনুকে নিয়ে রিনি আবার ফিরতে লাগল। তনু মাঝে মাঝে কথা বলছিল। রিনি জবাব দিচ্ছিল না। তেমন। তনুর কথার জবাব তার জানা ছিল না। যেমন, ট্রামের চাকা কতগুলো? ডিজেল ইঞ্জিনের এই ধোঁয়া শহরের বাতাস নষ্ট করছে কেমন করে ইত্যাদি ইত্যাদি।

হাঁটতে হাঁটতে রিনি তাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে মনিহারি দোকানটার সামনে থামল। তনুকে বলল, এখানে দাঁড়াও, কোথাও যাবে না; আমি জিনিসগুলো কিনে আনি।

তনু দোকানের সামনে সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে থাকল।

 জিনিসপত্র কিনে রিনি কোথায় যেন আড়ালে চলে গেল ফোন করতে। ফোন সেরে রাস্তায় নেমে এল, হাতে ব্রাউন পেপারের প্যাকেট।

তনু হাত বাড়াল, আমায় দাও।

থাক।

 দাও, আমি নিচ্ছি।

রিনি হঠাৎ তার ডান হাতের মুঠো তনুর হাতের ওপর আলগা করে দিল। তনু দেখল, রিনি তার হাতে পুরু একটা চকোলেট বার ফেলে দিয়েছে। হেসে ফেলল তনু। বলল, চকোলেট আমার খুব ফেভারিট। তুমি জানলে কী করে?

ঘাড় বেঁকিয়ে রিনি বলল, হাত গুনে।

তোমার শেয়ার নাও।

তুমি খাও। তোমার এখনও টফি-চকোলেট খাবার বয়েস রয়েছে।

 তোমারও আছে।

তনু হাত বাড়িয়ে রিনির জিনিসপত্রের প্যাকেটটা ততক্ষণে নিয়ে নিয়েছে। রিনির হাতে সামান্য কটা জিনিস।

বাড়ির কাছাকাছি এসে রিনি বলল, পার্কে যাবে? না থাক..দেরি হয়ে যাচ্ছে, মা ভাববে।

তনু বলল, কটা বেজেছে?

রিনি হাতে ঘড়ি পরেনি। তা হলেও তার অনুমান, সাতটা বেজেছে হয়তো। না, রাত নিশ্চয় হয়নি; কিন্তু নুকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে, মা ভাবতে পারে। কী মনে করে রিনি বলল, আচ্ছা চলো, পাঁচ-দশ মিনিটে কী আর হবে–একটা পাক দিয়ে যাই।

রিনিদের বাড়ির সামনে চিলড্রেনস পার্কটা সন্ধের পর পাড়ার বড়দের একটু হাওয়া খাওয়ার জায়গা হয়ে ওঠে। গরমের দিনে অনেকেই এসে বসে থাকে, গল্পগুজব করে। সকালে বুড়োরা চক্করবে।

পার্কে এসে রিনি দেখল, বসার জায়গা কোথাও নেই। ছোট পার্ক। ঘাসের চিহ্নও বড় একটা দেখা।

যাচ্ছে না। রিনি হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এসে দাঁড়াল। বসবে? দরকার নেই বসে, যা ধুলো।

তনু বলল, তোমাদের কলকাতায় ঘাস নেই।

রিনি টপ করে বলল, আমাদের কলকাতায় গোরুঘোড়া কম।

তনু প্রথমটায় বোঝেনি, পরে বুঝল। বুঝে জোরে হেসে উঠল। আমি যদি বলি, বেশি। বেশি বলেই এই হাল।

রিনি আর জবাব দিতে পারল না। মার শ্যামচাঁদ একেবারে নেহাত গাধা নয়। বুদ্ধি ধরে।

তনু এর মধ্যে কখন চকোলেটটা ভেঙে ফেলেছে। রিনির হাতে আধখানা গুঁজে দিয়ে, নিজে বাকি আধখানা মুখে দিল।

ঠিক এমন সময় একটা বাচ্চা মতন ছেলে বেলফুলের মালা বেচতে সামনে এসে দাঁড়াল। রিনি মাথার চুলে মালা জড়ানো তেমন পছন্দ করে না, সেরকম কোনও সুযোগও তার আজ নেই, তবু কী মনে করে একটা মালা কিনে হাতব্যাগের মধ্যে রেখে দিল।

পার্কের বাইরে এসে রাস্তা পেরোবার সময় রিনি আবার যমুনাকে দেখল। রিকশায় বসে আছে, পাশে যেন একটা অবাঙালি লোক। রিকশাটা ঠুনঠুন করে ঘন্টা বাজিয়ে চলে গেল। রিনি অবাক হয়ে রিকশার পেছনটা দেখতে দেখতে রাস্তা পেরিয়ে এল।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *