০৪.
তেতলায় ঘরের সামনে ছাদটুকুতে শরদিন্দু বসেছিলেন। আকাশটা খুব পরিষ্কার, চারদিক জুড়ে তারা ফুটে আছে। শরদিন্দুর সামনে কিছু টবের গাছ, ফুল নেই, পাতাই চোখে পড়ে। সিঁড়ির দিকের বাতিটা জ্বলছিল। তার সামান্য আলো ছাদের অন্ধকারে পাতলা ভাবে মিশে আছে।
রিনি খানিকটা আগে ছাদে ছিল। শরদিন্দু তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। তনুশ্যাম ছাদের আলসের কাছে দাঁড়িয়ে আশপাশের বাড়ি, দুরের নারকোল গাছ, আকাশ দেখছিল। মাঝে মাঝে বাবা এবং রিনির কথাবার্তা তার কানে আসছিল। বাবা যে খুব গম্ভীর মানুষ তা নয়, কিন্তু কলেজে বাবাকে বেশ গম্ভীর, ভারিক্কি মনে হয়, বাড়িতে বাবা অনেক হালকা। তবু তনু বুঝতে পারছিল, বাবা রিনির সঙ্গে গল্প করার সময় আরও হাসিখুশি মজার মানুষ হয়ে যাচ্ছিল। বাবা যেসব গল্প করছিল, তার অর্ধেকই পুরনো গল্প, নিজেদের বাড়িঘরের গল্প, নীহারপিসির গল্প। তনুর সঙ্গে বাবা বড় একটা এসব গল্প করে না। নীহারপিসি কেমন করে একবার নাকের মধ্যে সেফটিপিন ঢুকিয়ে ফেলেছিল, ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়ে তবে সেটা বার করা গেল: কবে যেন এক সাধু এসে পিসির মুঠোয় ছাই দিয়ে হাতের রুলি খুলে নিয়ে পালিয়েছিল–এইসব গল্প। রিনি যে কতটা অবাক হচ্ছিল কে জানে, মাঝে মাঝে খিলখিল করে হেসে উঠছিল। তনুর মনে হল, রিনি এসব গল্পের বেশিটাই জানে। সে প্রায়ই বাবাকে বলছিল: এটা আমি জানি, ও গল্প আমি শুনেছি। নিজেই কোনও কোনও কথার খেই ধরিয়ে দিচ্ছিল। শেষে তনু ছাদ থেকে নেমে গেল।
রিনি গেল আরও খানিকটা পরে, নীহার ওপরে আসার পর। নীহার ছাদে এসে মেয়েকে বললেন, রিনি, তোর মামাকে একটু শরবত করে এনে দে। আর শ্যামকে জিজ্ঞেস কর, শরবত খাবে, না এখন দুধ খাবে খানিকটা। যদি দুধ খায়, ওভালটিন দিয়ে দিবি।
মনে মনে রিনি একটা সংলাপ সঙ্গে সঙ্গে ভেবে নিল। নীচে নেমে মার শ্যামকে সে বলবে: এই যে আসুন খোকাবাবু, মা আপনাকে দুধ খাইয়ে দিতে বললেন। কথাটা মনে করে নিজের মনেই রিনি হেসে ফেলল।
হাসিটা নীহার দেখতে পেয়েছিলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, হাসছিস যে?
রিনি চট করে বলে ফেলল, না, মামার জন্যেও দুধ দিয়ে আসি বরং।
শরদিন্দু তাড়াতাড়ি বললেন, না দুধ নয়। দুধ আমি একবারই খাই, রাত্রে। তুমি আমায় বরং শরবতই করে দাও। সন্ধেবেলায় আমি ইশবগুলের শরবতই খাই লেবু আর মিছরি দিয়ে। …সে পরে হবে, আজ এমনি শরবত খাই।
রিনি চলে গেল।
শরদিন্দু বললেন, তুমি নাকি পুজোপাঠ করতে বসেছিলে?
নীহার গিয়েছিলেন জলের ট্যাঙ্কটার দিকে। রিনির ভিজে শাড়িটা বাতাসে জাপটে গিয়েছিল। তারে-মেলা শাড়িটা ছড়িয়ে দিলেন ভাল করে। সন্ধেবেলায় গা ধোয়ার অভ্যেসটা মেয়ের গেল না, বিকেলে গা ধুয়ে নিলে ক্ষতি কীসের! অনেক বলেও মেয়েকে এই অভ্যেস ছাড়ানো গেল না। গরম-ঠাণ্ডায় মাসের মধ্যে কুড়িদিন ওর গলা খুসখুস, টনসিল ব্যথা লেগে আছে। একসময় গানের গলা করেছিল চমৎকার, বেশ মিষ্টি, আজকাল সে-পাটও তুলে দিয়েছে। কী বলবেন আর মেয়েকে! নিজের মরজিতে ও চলে। একেবারে বাপের মতন। এই গরম বাতিক এখন চলল। খুব বাড়াবাড়ি করে বর্ষা নামার পর বাতিকটা ঘুচবে। শাড়ির পাশে ব্লাউজ, টপটপ করে জল পড়ছে এত ভিজে। নীহার জলটা নিংড়ে দিয়ে ফিরে এলেন।
আমায় কিছু বললে? নীহার শুধোলেন।
বলছিলাম, তুমি নাকি পুজোপাঠ করছ আজকাল?
তা একটু করছি বইকি। বুড়ি হয়ে গেলাম, এখনও যদি না করি, তবে আর কবে করব? নীহার মৃদু হাসলেন।
নীহারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শরদিন্দু দুহাত মাথার ওপর তুলে ক্যাম্বিসের চেয়ারের মাথায় রাখলেন। তুমি বুড়ি হয়ে গেলে? শরদিন্দু যেন সস্নেহে, এবং সকৌতুকে হাসলেন।
শরদিন্দুর মুখোমুখি বেতের চেয়ার ছিল একটা; পাশে মোড়া। নারান সন্ধের মুখে বাইরে বের করে রেখে গেছে সব। বেতের ছোট টেবিলে শরদিন্দুর চশমার খাপ, সিগারেট, দেশলাই, ছাইদান।
নীহার বেতের চেয়ারটায় বসলেন। বুড়ি হতে আমার কিছু বাকি দেখছ নাকি?
শরদিন্দু সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিলেন না। সামান্য পরে বললেন, তোমার কত বয়েস হল, বলল তো?
নীহার শরদিন্দুর চোখ, মুখ, আলস্যভরা চেহারা, বিশ্রাম উপভোগের হালকা ভাবটা লক্ষ করতে করতে বললেন, তুমিই বলো না। আমি বললে তো বয়সে কমাব।
কেন, কেন?
মেয়েরা যে নিজেদের বয়েস কমিয়েই বলে, নীহার মুচকি হাসলেন।
শরদিন্দু হেসে ফেললেন। তোমার পঞ্চাশ হয়নি। পঞ্চাশ হতে এখনও দেরি আছে দু-চার বছর।
তোমার কি ষাট হয়ে গেল? নীহার কৌতুক করে বললেন।
আমার ফিফটি ফোর চলছে। তোমাতে আমাতে ছ সাত বছরের তফাত।
মেয়েদের বুড়ি হতে বয়েস শুনতে হয় না গো, এবেলার ফল ওবেলায় গলে যায়।
শরদিন্দু নীহারকে দেখলেন। যতটা নীহার বলছে অতটা বুড়ো হয়ে যাবার লক্ষণ তার চেহারায় নেই। এখনও ওর মুখে লাবণ্য আছে, বরং সাংসারিক সুখ-দুঃখের স্পর্শে সে লাবণ্য আরও ঘরোয়া আরও কোমল হয়েছে। তোমার কি গুরু-টুরু আছে?
গুরু–?
দীক্ষা নাওনি?
না, সেভাবে আমার দীক্ষা নেওয়া হয়নি। শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে রামকৃষ্ণ আশ্রমের অনেকের মেলামেশা ছিল। আশ্রম থেকেই যেটুকু…
ও! শরদিন্দু চেয়ারের মাথার ওপর থেকে হাত দুটো নামিয়ে নিলেন।
নীহার খানিকটা হালকা করেই শুধোলেন, তা তুমি কিছু করো না?
পুজোটুজো? না– মাথা নাড়লেন শরদিন্দু না, আমার ও পাট নেই। ঠাকুরদেবতা নিয়ে বসবার সময় কই?
নীহার ঠাট্টার গলায় বললেন, ছেলেবেলায় তো খুব ঠাকুর ভক্তি ছিল। দুর্গাপূজায় অষ্টমীতে অঞ্জলি দিতে, কালীপুজোয় রাত জেগে বসে থাকতে, সরস্বতীপুজোয় মাতব্বরি করতে। সে সব গেল কোথায়?
শরদিন্দু যেন স্মৃতির কেমন এক স্পর্শ অনুভব করে মুদু হাসলেন। ভক্তি আমার এখনও যে একেবারে নেই নীহার তা নয়, আছে। বারো-চোদ্দো মাইল ঠেঙিয়ে দুর্গাপুজো দেখতে যাই। কিন্তু ঘরবাড়ি ছেড়ে বির্ভুইয়ে থাকতে থাকতে আমাদের সংসারের আচার আচরণ অর্ধেক নষ্ট ঘরে ফেলেছি। আমাদের বাঙালি হিন্দুবাড়িতে মেয়েরা থাকলে তবু একটা আচার-ধর্ম চোখে দেখা যায়। সেসব পাটও চুকেছে আমার। তার ওপর ছেলেটা। ওর জন্যে মাথায় যে কতরকম ভাবনা থাকে। বলতে বলতে শরদিন্দু চুপ করে গেলেন, তাঁর গলার স্বর গাঢ় শোনাচ্ছিল। দীর্ঘ করে নিশ্বাস ফেললেন। সামান্য পরে বললেন, চাকরি-বাকরি শেষ হয়ে এল। আর দু চারটে বছর, তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসে ওই ভগবান-টগবান করেই জীবনটা কাটাতে হবে।
নীহার কিছু বললেন না। শরদিন্দুর মনের বারো আনা ছেলের মধ্যে রয়েছে। সারাদিন হয়তো সেই চিন্তাতেই কাটে। বোধহয় এখন ভগবান-টগবানে ভরসাও নষ্ট হয়ে এসেছে।
কাল একবার গুপ্তসাহেবের কাছে যাই, কী বলো? নীহার বললেন।
একটা খবর দিতে হবে না?
কিছু না। আমার সবই বলা কওয়া আছে। কালকেও আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। আমি বলেছি, তোমরা আজ এসে পৌঁছোচ্ছ। উনি জানেন সব। কাল সকালে রিনিকে দিয়ে না হয় বাড়িতে একটা ফোন করিয়ে দেব।
কখন যেতে হবে?
বিকেলে। সকালে হাসপাতালে থাকেন। বিকেলে ওঁর চেম্বারে যাব। পার্ক স্ট্রিট।
শরদিন্দু অন্যমনস্ক হয়ে ফুলের টব-গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, উনি তোমাদের খুব জানাশুনো?
হ্যাঁ নীহার ঘাড় হেলালেন, মানুষটি খুব ভাল। রিনির বাবার সিনিয়ার ছিলেন। একই হাসপাতালে ছিলেন একসময়। খুব ভালবাসতেন ওঁকে।
শরদিন্দু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, একেই গেরো বলে বুঝলে নীহার, সেই কলকাতায় আসতে হল, আগে যদি আসতুম, তোমার স্বামী থাকতে, কত সাহায্য পেতাম, হয়তো ছেলেটা এতদিনে ভাল হয়ে যেত।
নীহার বললেন, এলে না কেন।
কেন যে শরদিন্দু আসেননি, তা তিনিও জানেন না। তাঁর তো সব জানা ছিল, নীহারের স্বামীর কথা, নীহারের ঠিকানা; এটাও জানতেন ছেলেকে নিয়ে আসতে চাইলে কোনও অনাদর তাঁর হত না। তবু শরদিন্দু আসেননি! সেটা কি অভিমান বশে? ক্ষোভটা দূর করতে পারতেন না? নাকি তাঁর মনে হত, নীহারের স্বামীর কাছে আসায় তাঁর কোনও গ্লানি, আছে? শরদিন্দু, যে কোনও কারণেই হোক, দূরে দূরেই থাকতে চেয়েছিলেন, কাছে আসতে চাননি। নীহার তখনও তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে, যেন জানতে চাইছেন–এলে না কেন?
শরদিন্দু বললেন, তখন যে এরকম অবস্থা ছিল না। ভুগছিল অবশ্য শ্যাম, কিন্তু চোখ খারাপ চোখ খারাপ করে কেটেছে। জেনারেল হেলথ আর চশমার ওপরই নজর ছিল। ওখানকার ডাক্তাররা আমায় কিছু অ্যাডভাইস করেনি। আস্তে আস্তে অন্যরকম দাঁড়িয়ে গেল। তারপর তো কত রকম করলাম। কলকাতায় পেশেন্ট নিয়ে আসা, থাকা, চিকিৎসা করিয়ে ফিরে যাওয়া, এ তো আমাদের পক্ষে সহজ ব্যাপার নয়, এই দেখো না, তোমাকে কবে থেকে লিখছি শীতের শেষাশেষি আসব। বলেছিলাম শীত, আসতে আসতে সামার পড়ে গেল।
রিনি আসছিল। তার পায়ের আওয়াজ হচ্ছিল সিঁড়িতে। বাড়িতে অর্ধেকসময় পায়ে চটি রাখে না রিনি, খালি পায়ে হাঁটতে নাকি তার আরাম লাগে খুব। সাদা ডিশের ওপর শরবতের গ্লাস নিয়ে সে দেখা দিল।
হাত বাড়িয়ে শরদিন্দু শরবত নিলেন। রিনি মার জন্যে পান সেজে এনেছে, নীহারের হাতে পান দিল।
শরদিন্দু রিনিকে বললেন, শরবতে বরফ-উরফ দাওনি তো?
না, রিনির মাথা নাড়ল, খাবেন বরফ? এনে দেব?
না না।
ও বলল, আপনি বরফ-টরফ খান না, গলা ধরে যায়।
শরদিন্দু রিনির ও শব্দটা শুনলেন, ও মানে শ্যাম। কানে কেমন যেন লাগল তাঁর, দুপুর থেকে সন্ধের মধ্যে শ্যাম আর রিনির সম্পর্ক বেশ হৃদ্য হয়ে উঠেছে।
নীহারও একসময় তাঁকে এই ভাবে ও বলত। শরদিন্দু কেমন স্নিগ্ধ বোধ করলেন।
নীহার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, শ্যামকে দুধ-টুধ দিয়েছিস?
দুধ খাবে না। শরবত খাচ্ছে।
দুধ খাবে না কেন?
কে জানে! আমি জানি না।
দুধ খাওয়া নিয়ে তোরা ছেলেমেয়েরা যা করিস বাপু, আমার মাথা গরম হয়ে যায়। রাত্তিরেই খাবে তবে– নীহার বললেন।
শরদিন্দুর কী যেন মনে পড়ে গেল। নীহারের দিকে সকৌতুক চোখে তাকিয়ে বললেন, তোমারও তো দুধ নিয়ে কত বাতিক ছিল।
নীহার বললেন, আমার সঙ্গে ওদের তুলনা কোরো না। ওদের এই বয়সে—
বাধা দিয়ে শরদিন্দু বললেন, আমি কিন্তু তোমার ওই বয়েসের কথাই বলছি। এটা আমার জানার মধ্যে পড়ে কিনা।
নীহার বোধহয় জব্দ হয়ে চুপ করে গেলেন। তাঁর পান-খাওয়া ঠোঁটে রসের সঙ্গে হাসি এসে মিশে গেল।
রিনি হেসে ফেলেছিল। আর দাঁড়াল না। চলে গেল।
শরদিন্দু আস্তে আস্তে শরবত খেতে লাগলেন। তাঁর কয়েকগুচ্ছ পাকা চুল কানের পাশের কপালের ওপর এলোমেলো হয়ে ছিল।
নীহার ধীরে ধীরে পান চিবোচ্ছেন। মাথায় কাপড় নেই। চুলের খোঁপাটা এলো করে জড়ানো।
বসে থাকতে থাকতে নীহার বললেন, তুমি যেন কী বলছিলে?
কীসের? শ্যামের কথা?
না, শ্যামের কথা নয়। শ্যামকে কাল নিয়ে যাই আগে তারপর। …তুমি অন্য কী বলছিলে না? রিটায়ার করে আবার নিজের বাড়ি-টাড়িতে ফিরে গিয়ে বসবে।
ও, হ্যাঁ; বলছিলাম। আমার সেইরকম ইচ্ছে। প্রবাসেই তো জীবনের বারো আনা কেটে গেল। এবার জীবতারা খসে যাবার আগে নিজের জায়গায় ফেরা ভাল। কী বলো? শরদিন্দু পরিহাস করে বললেন।
নীহার জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির এখন খবর কী? তোমার আসা-যাওয়া ছিল বলে তো শুনিনি।
একেবারে ছিল না, তা বোলো না। মা যতদিন বেঁচে ছিল পুজোর ছুটিটা বাড়িতেই কাটাতাম। মা মারা যাবার পর দিদির জন্যে যেতে হত। দিদিও চলে গেল, আমারও আসা-যাওয়া ফুরোল। শরদিন্দু সামান্য থেমে আবার খানিকটা শরবত খেলেন। আমাদের সাধুকে তোমার মনে আছে। সাধুই বাড়িটা দেখাশোনা করত, থাকত। আমি কখনও-সখনও গিয়েছি। গত বছর পুজোতে গিয়েছিলাম। বাড়িটার কড়ি, দেওয়াল-টেওয়াল অনেক নষ্ট হয়েছে। বাগানটুকু জঙ্গল। অল্পসল্প মেরামত করিয়ে এসেছি। সাধুই করাচ্ছে, আমি টাকা-পয়সা পাঠিয়ে দিই। ও থাকতে থাকতে বাড়িটা আবার বাসযোগ্য করিয়ে নিলে আমার ঝঞ্জাট বেঁচে যায়।
নীহার প্রত্যেকটি কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। শরদিন্দুদের বাড়ির ছবিটি তাঁর মনে ভাসছিল। আমিও শুনছিলাম, তুমি বাড়িকাড়ি সারাচ্ছ।
আস্তে আস্তে সারিয়ে নিই, আমার তাড়াহুড়োর কোনও দরকার নেই।
ভালই করছ। বাইরে বাইরে আর কতকাল থাকবে!
শরবতের গ্লাসটা রেখে দিলেন শরদিন্দু, বেশ তৃপ্তি পেয়েছেন মনে হল শরবতটুকু খেয়ে। এবার হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই তুলে নিলেন। দেখো নীহার, বুড়ো হয়ে গেলে মানুষের মধ্যে একটা কেমন ভয়-ভয় ভাব হয়। তখন ইচ্ছে করে জানাশোনাদের মধ্যে থাকতে। যাদের চিনি-জানি তাদের মধ্যেই ভরসা খুঁজি। আমি যেখানে চাকরি করেছি এতকাল, সেখানে মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। অনেকেই বলেছিল। কিন্তু আমার ইচ্ছে হল না। ভালও লাগে না ওভাবে পড়ে থাকতে। তা ছাড়া ছেলেটা? তার কথা ভাবলে দুশ্চিন্তায় রাত্রে ঘুম হয় না। আমার নিজের মানুষ বলতে আর কেউ নেই। তবু নিজের জায়গায় ফিরে আসতে পারলে ছেলেটাকে অন্তত দেখার লোক জুটবে।
নীহার সমস্তই অনুভব করতে পারছিলেন: শরদিন্দুদের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, দুঃখ। মানুষটিকে সান্ত্বনা ও ভরসা দিতে বড় ইচ্ছে হল, বললেন, তোমার অত দুর্ভাবনা করার কিছু নেই। এখনও তো একেবারে থুথুরে বুড়ো হয়ে যাওনি। হেসেখেলে কুড়িটা বছর কাটিয়ে দিতে পারবে। শ্যামও বড়টি হয়ে গেছে। দু-চার বছরের মধ্যে সে মানুষ হয়ে যাবে। তোমার ভাবনা কী?
শরদিন্দু দেশলাই জ্বেলে সিগারেটটা ধরিয়ে নিলেন। নীহারের দিকে না তাকিয়েই বললেন, আরও কুড়িটা বছর বেঁচে থাকতে বলছ?
নীহার পায়ের দিকের কাপড়টা গুছিয়ে নিতে হেঁট হয়েছিলেন, ঘাড় তুলে বললেন, ওমা, তা কেন থাকবে না! তোমার এমন কী বয়েস হয়েছে বাপু! সত্তর, পঁচাত্তর বছর পর্যন্ত মানুষ বেঁচে থাকে না? বলছ কী তুমি! আমার শ্বশুরমশাই তো আটষট্টি বছর বয়সে গিয়েছেন।
শরদিন্দু নীহারের দিকে তাকালেন। সামান্য অপেক্ষা করে বললেন, বেঁচে থাকার কথা কেউ কি জোর করে বলতে পারে নীহার? তুমি নিজের অবস্থা দেখে বুঝতে পারছ না, সংসারে ওই জিনিসটার সময় বলে কিছু নেই।
নীহার নীরব থাকলেন। জীবনে এই সত্যটা তাঁর অজানা নয়। শরদিন্দুর জীবনেও তেমন দুর্ভাগ্য না ঘটেছে এমন নয়, নীহার যেমন স্বামীকে হারিয়েছেন, শরদিন্দুও হারিয়েছেন স্ত্রীকে। নিজের বেদনা, শরদিন্দুর বেদনা–দুইই যেন নীহারের মধ্যে কেমন পাশাপাশি দুটি ধারার মতন বয়ে যেতে যেতে একসময় একত্রে মিশে যাচ্ছিল।
শরদিন্দু অন্যমনস্কভাবে সিগারেট খেতে খেতে পিঠ হেলিয়ে বসলেন আবার। তিনি যে কোন দিকে তাকিয়ে ছিলেন বোঝা যাচ্ছে না; আকাশের দিকে, নাকি অনেকটা দূরে–যেখানে নারকোল গাছের মাথায় অন্ধকার জমে মেঘের আকার নিয়েছে সেদিকে তাকিয়ে আছেন!
নীহার শরদিন্দুকে দেখছিলেন। মুখটি চৌকো ধরনের, গালের চামড়ার টান পাতলা হয়ে আসছে, চোখের তলা কুঁচকে যাচ্ছে, চিবুক বেশ পাতলা। মাথায় পাকা চুলের মাত্রাটাই বেশি। চোখ দুটি অনেক স্তিমিত। গলার চামড়া ঝুলে এসেছে যেন। বয়স হিসেবে শরদিন্দুকে আরও প্রৌঢ় মনে হয়। গলার স্বরটি কিন্তু এখনও ভরাট।
নিশ্বাস ফেলে নীহার বললেন, তুমি পুরুষমানুষ। তোমার অত ভয়-ভাবনা সাজে না। কথাটা বলার পর নীহারের নিজের কাছেই কেমন অর্থহীন শোনাল।
শরদিন্দু মুখ ফিরিয়ে নীহারের দিকে তাকালেন। আমি অনেক সময় তোমার কথা ভাবতুম। লোকে বলত, তুমি খুব বুদ্ধিমতী, বিচক্ষণ, সাংসারিক বোধবুদ্ধি তোমার কম নয়। আজ এখানে এসে তোমাদের দেখে আমি সত্যিই বেশ অবাক হয়েছি। তুমি তো মেয়ে হয়ে একলা বেশ টেনে এনেছ এই সংসার। তোমার সংসারটিও বড় সুন্দর লাগছে।
নীহার কেমন এক মুখ করে সামান্য হাসলেন। বললেন, মেয়েদের কি আর ছটফট করলে চলে গো? আমাদের পা-ছড়িয়ে বসে কাঁদার সময় কই! বলে বাঁ পা আস্তে করে চেয়ারের ওপর তুলে হাঁটু মুড়ে নিলেন। পা ঝুলিয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকতে তাঁর কষ্ট হয়, বাঁ হাঁটুতে একবার জল জমেছিল। মৃদু গলায় বললেন, উনি যখন যান তখন আমি বড় একলা, অসহায় হয়ে পড়েছিলুম। হঠাৎই চলে গেলেন, দুদিন আগেও বুঝতে পারিনি। কী যে ব্যাধি পুষছিলেন পেটে, রক্ত পড়তে শুরু করল সকাল থেকে, বিকেলে নিয়ে গেল হাসপাতালে। পরের দিন ভোরে চলে গেলেন। আমার তখন যা অবস্থা–চোখের সামনে শুধু অন্ধকার দেখেছি। ভগবানের পায়ে শুধু মাথা খুঁড়েছি। ওই কচি মেয়ে, সম্বল বলতে এই বাড়িটা, আর সহায় বলতে নিজের কেউ না, বাইরের দু-একজন। কিন্তু বসে বসে কাঁদলে তো দিন চলে না। বুক বেঁধে উঠে দাঁড়িয়েছি। এখন আমার যা ভাবনা ওই মেয়েকে নিয়ে, আর কিছু নয়।
শরদিন্দু স্থির, শান্ত, সস্নেহ দৃষ্টিতে নীহারকে দেখছিলেন।
দুজনেই কিছুক্ষণ আর কথা বলার মতন কিছু পেলেন না। শরদিন্দু সিগারেটের টুকরোটা ছাইদানে ফেলে দিলেন।
নীহারই কথা বললেন আবার, আমাদের ওখানে পালিতবাবুদের বাড়িতে এক সন্ন্যাসী এসেছিল একবার তোমার মনে আছে?
শরদিন্দুর খেয়াল করতে সময় লাগল। খেয়াল হলে মাথা নাড়লেন আস্তে করে।
সেই সাধু আমার হাত দেখে বলেছিলেন, কোনও কালেই আমার মনের শান্তি হবে না, নীহার বললেন।
নীহারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শরদিন্দু শুধোলেন, হয়নি?
কোথায় আর হল?
শরদিন্দু নীরব থাকলেন। নীহারের দুর্ভাগ্যই কি সব? তার সৌভাগ্যের দিনে সে কি শান্তি পায়নি? কথাটা পালটে নিয়ে নীহারকে ভরসা দেবার মতন করে বললেন, তোমার দায় তো শেষ হয়ে এসেছে।
ব্যস্ত ভাবে হাত নেড়ে নীহার বললন, বোলো না বোলো না। মেয়েটা আছে আমার গলার সঙ্গে জড়িয়ে। ওর বরাতে কী আছে–সেই ভেবে ভেবে আমার রাত কাটে।
শরদিন্দু নীহারের উদ্বেগটুকু অনুভব করলেন। তারপর হালকা করেই বললেন, তোমার মেয়েকে দেখলে তোমায় খানিকটা বোঝা যায়।
আমায়? নীহার অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন।
ওর বয়সে তুমিও অনেকটা ওই রকম ছিলে।
আমি আবার ওর মতন ছিলাম কোথায়! নীহার আপত্তি জানিয়ে বললেন, আমার চোখমুখ ও পায়নি, ওর বাবারটা পেয়েছে।
শরদিন্দু নরম গলায় হাসলেন। তোমারও পেয়েছে। তোমার গায়ের রং, কোঁকড়ানো চুল, ছিপছিপে গড়ন–সবই দেখছি তোমার মেয়ে পেয়েছে। কথাবার্তা বলার ধরনটাও প্রায় তোমার মতন।
নীহার হেসে ফেললেন। মাথা নেড়ে বললেন, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে, আমি ওর মতন ছিলাম না।
শরদিন্দু কোনও প্রত্যুত্তর করলেন না, হাসিমুখে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, নীহার অতীতে কেমন ছিলেন তিনি তা বিলক্ষণ জানেন।
নীহার যেন হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কয়েক পলক, চোখ নামিয়ে শরদিন্দুর দিকে তাকালেন। তারপর আচমকা বললেন, তুমি আমায় ভুলে গেছ।
শরদিন্দুর মুখের ভাব বদলাল না। নীহারের চোখে চোখ রেখে মৃদু গলায় বললেন, ভুলে গিয়েছি?
দুজনেই নীরব। যেন দুজনের মধ্যে দিয়ে কুড়ি বাইশটা বছরের জল গড়িয়ে যাচ্ছিল।
শেষে নীহার বললেন, ভুলে যাওয়া আশ্চর্য কী। কতকাল পরে আবার আমায় দেখলে বলল তো?
তুমিই বলো।
আঠারো উনিশ বছর পরে। কুড়ি বছরই ধরো– নীহার অন্তরঙ্গ গলায় বললেন। তোমাকে আমি শেষবার দেখেছি, শ্যাম তখন বাচ্চা, বছর চার পাঁচ বয়েস। আমি মেয়ে কোলে করে বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম, একেবারে কচি তখন রিনি, দাঁত উঠেছে সবে। তুমি শীতের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলে। বউদিকেও আমি সেই প্রথম দেখলাম। এসব কি আজকের কথা! আজ রিনির বয়েস কুড়ি হতে চলল, শ্যামের তেইশ-টেইশ হবে। প্রায় দু যুগ পরে আবার আমায় দেখছ। ভুল হওয়ারই তো কথা।
শরদিন্দু বাঁ হাতটা পাতলা চুলের ওপর দিয়ে বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে কেমন এক মমতা জড়ানো। ধীরে ধীরে বললেন, হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। দু যুগ বলতে পারো। পুষ্প তখন বেঁচে ছিল। …তারপর অবশ্য দেখাসাক্ষাত আর হয়নি। কিন্তু খবরটবর পেতাম সবই।
নীহার আবার পা নামিয়ে নিলেন। হাঁটুতে সাড়া পাচ্ছেন না, চাপ লেগে যেন অস্বস্তি হচ্ছিল, ব্যথাও করছিল। সরল গলায় বললেন, তা হলে আমি মন্দটা আর কী বলেছি বলো! আমার বিয়ের পর সেই আমায় প্রথম দেখলে, বিয়ের সময় তুমি ছিলে না, তার আগে যা দেখেছ। অতদিনের চেহারা কি তোমার মনে থাকার কথা?
শরদিন্দু সকৌতুক অথচ শান্ত গলায় বললেন, মনে না থাকলে আজ আমি তোমায় হাওড়া স্টেশনে চিনতে পারলাম কী করে?
নীহার যেন একথাটা ভেবে দেখেননি আগে। সামান্য থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর হেসে বললেন, থাক, ও বড়াই আর কোরো না। তুমি আমায় চেনার আগেই আমি তোমায় খুঁজে নিয়েছি।
শরদিন্দু মৃদু হেসে বললেন, তোমার সেই পুরনো অভ্যেস আজও আছে নীহার। এখনও তুমি তোমারটা আগে দেখবে। বেশ, তাই হল। তুমিই আমায় আগে খুঁজে নিয়েছ, আমি তোমায় পরে চিনেছি। ..খুশি হলে তো?
নীহার নীরব হয়ে গেলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি স্নান, বিমর্ষ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ পরে নিশ্বাস ফেলে বললেন, কে কাকে আগে চিনেছে সে ঝগড়া আর আমি করব না গো। তুমি ছেলেটাকে নিয়ে আমার কাছে এসেছ, এতকাল পরে, এতেই আমি খুশি।
.