একা একা – ১১

১১.

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে তনুর দেরি হয়ে গেল। কেউ তাকে ডাকেনি। রিনি রোজ ভোরবেলায় তাকে ডেকে দেয়। ডেকে দিয়ে চা করতে চলে যায়। তনু কোনওরকমে মুখটা ধুয়ে জামাটা বদলাতে না বদলাতে রিনি চা নিয়ে আসে। চা-টুকু খেয়েই দুজনে ভোরের মুখে লেকের দিকে বেড়াতে চলে যায়। এই ভোরটুকু, যখন আলো ফুটছে, ফরসা হয়ে আসছে সব, পাড়াটা ঘুমে জড়ানো, হরিণঘাটার গাড়ি আসছে, গাছতলায় কুকুর ঘুমিয়ে আছে, এক-আধটা ঝাড়ুদার রাস্তায় নেমেছে, গাছের মাথায় পাখি-টাখি ডাকতে শুরু করল–তখন শান্ত নিরিবিলি কলকাতার পথ দিয়ে রিনির সঙ্গে হেঁটে যেতে যেতে তনুর কী ভালই না লাগে! আজকাল তনুর ঠিক সময়ে ঘুম ভেঙে যেতেও শুরু করেছিল। আজ আর ভাঙল না। কিংবা ঘুমটা সময় মতনই পাতলা হয়ে এসেছিল, বাইরে থেকে কেউ দরজায় টক টক শব্দ করছে না, কেউ ডাকছে না দেখে–তনু ঘুমের আলস্যের মধ্যে এখনও ভোর হয়নি ভেবে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। কাল বৃষ্টির জন্যে জানলাগুলোও সব প্রায় বন্ধ। খোলা জানলাটা তার চোখে পড়েনি, পড়ার কথাও নয়।

ঘুম ভেঙে তনু দেখল, বেশ রোদ। তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখে অবাক। বেলা হয়ে গেছে। চায়ের টেবিলে বাবা আর নীহারপিসি। তনু বাথরুমে চলে গেল।

চোখ-মুখ ধুয়ে জামা পালটে তনু যখন চায়ের টেবিলে এল, শরদিন্দু তখন খবরের কাগজ হাতে নিয়ে উঠে পড়ছেন। ছেলেকে একবার দেখলেন তিনি। তারপর কাগজ হাতে করে বসবার জায়গায় গিয়ে বসলেন।

নীহার চা জলখাবার দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস শ্যাম?

তনু ঠিক বুঝতে পারল না প্রথমে, পরে বুঝল।

নীহার টোস্ট আর ডিমের পোচ এগিয়ে দিয়ে বললেন, শরীর-টরীর খারাপ হয়নি তো?

না।

তুই বসে বসে খা। আমার আজ তাড়া আছে একটু। পুজো পাঠাব। আমি স্নান করতে যাই।

 নীহারপিসি চলে গেলেন। বাবা বারান্দার বসার জায়গাটায় বসে কাগজ দেখছেন। সিগারেটের গন্ধ আসছে।

তনু নিজের মনে চা খেতে খেতে এদিকে ওদিক তাকাল। রিনি কোথায়? সকালে ডাকল না। চায়ের টেবিলে নেই। তার গলা শোনা যাচ্ছে না, সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। রিনির কি শরীর খারাপ হল? জ্বর-টর হল নাকি? কাল রিনিই বেশি ভিজেছে। মানে, রিনিই শখ করে প্রথমে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গিয়েছিল, তার মাথায় এত চুল, এত বেশি বড় বড় যে বৃষ্টির জলে তার ভেজা চুল একেবারে পাগলির মতন হয়ে গিয়েছিল। তনু খুব হেসেছে। তার ওপর রিনির জলে পা দিয়ে কী ছলাত ছলাত করে হাঁটা! সর্দি-টর্দি, জ্বর হতে পারে। রিনি জ্বর গায়ে শুয়ে আছে নাকি? পিসিকে জিজ্ঞেস করা হল না। বাবার সামনে জিজ্ঞেস করতেও তার সাহস হল না।

টোস্ট শেষ করে তনু চায়ে মুখ দিল। বারান্দার শার্সিগুলো খোলা, খুব আলো আর রোদ আসছে। কাল বিকেলে যে অমন বৃষ্টি হয়ে গেল বোঝার উপায় নেই। নীচের নার্সারি স্কুল থেকে কাচ্চাবাচ্চার গলা ভেসে আসছে।

কাল বৃষ্টি এসে সব গোলমাল হয়ে গেল। রিনি অবশ্য বৃষ্টি পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হল। আর তনুও কাল যুধিষ্ঠিরের মতন অশ্বত্থামা করেছে! না করে উপায় কী। তারা কাল কালীঘাটে ঠিক যায়নি। কালীঘাট যে কোথায় তাও তনু জানে না। তবে কালীঘাটের কথা সে শুনেছে। তনুরা বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে কোথায় যাবে কোথায় যাবে করছিল–তখন তনু বলল, সেই গির্জাটার দিকে চলো না; ভেরি ফাইন প্লেস। ওরা ট্রামে করে সেন্ট ক্যাথিড্রালের দিকে চলে গিয়েছিল। নিরিবিলি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তনু খুব আবেগ দিয়ে সক্রেটিসের মৃত্যুর শেষ বিবরণটা শোনাচ্ছিল: বুঝলে রিনি, প্লেটোর লেখা থেকে তোমায় পড়ে শোনাব একদিন, মাস্টারপিস। ইউ উইল বি ইন টিয়ারস। তারপর বিষ খাবার সময় ক্রিটো বলল, এত তাড়াতাড়ি খাবার কী আছে, আরও পরে খাবেন, অনেকেই আরও পরে খায়, এখনও পাহাড়ের মাথার ওপর সূর্য রয়েছে। সক্রেটিস জবাব দিলেন, ক্ৰিটো তুমি যাদের কথা বলছ, তারা হয়তো ভাবে, বিষটুকু আরও একটু দেরি করে খেলে কিছু লাভ হবে, আমি তা ভাবি না, যে জীবন চলে গিয়েছে তাকে অল্প সময়ের জন্যে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে কী লাভ… সক্রেটিসের বিষ খাবার কাহিনী থামিয়ে দিয়ে রিনি বলল, এই রে–ওই দেখো। বলতে বলতে কোথাকার এক ঝড় ধুলো উড়িয়ে তাদের কালো করে দিয়ে গেল, তারপর চারপাশ ঘুটঘুট করে উঠল। ছোটাছুটির সময় আর নেই। বৃষ্টি এসে গেল। তনু গাছতলায় দাঁড়িয়ে মাথা বাঁচাচ্ছিল, হঠাৎ দেখল রিনি বৃষ্টির মধ্যে নেমে গেছে।

বৃষ্টির মধ্যে খানিকটা হেঁটে খানিকটা রিকশা করে আসতে আসতে কালীঘাট-পাড়ার কাছে এসে রিনি বলল, এই, খুব তত ভেজা হল, বাড়ি গিয়ে তোমার নীহারপিসির মুখের সামনে দাঁড়ানো যাবে না। শোনো, আমি কিন্তু কালীঘাটের কথা বলব; কালীঘাটের কথা শুনলে রক্ষে পেয়ে যেতে পারি। ঠাকুরদেবতা তোর…বাড়ির কাছাকাছি এক জায়গায় নেমে রিনি কোন একটা শীতলা না কীসের মন্দির থেকে পয়সা ফেলে কপালে সিন্দুর লেপটে নিল। নুর কপালেও লাগিয়ে দিল। বলল, এই দাগটাই। আসল, বুঝলে।

তনু নিজেই এখন হেসে উঠল। হাসবার পর তার বাবার কথা মনে পড়ল। তাকিয়ে দেখল, বাবা তার দিকে চেয়ে রয়েছে।

ছেলের দিকে একটু তাকিয়ে শরদিন্দু বললেন, কী হল?

 না, কিছু না। তনু মুখ নামিয়ে চা খেতে লাগল। খোলা শার্সি দিয়ে এক জোড়া চড়ুই ঢুকে রিনির মানিপ্ল্যান্টের ওপর বসে তাদের ছোট ছোট ডানা ছড়িয়ে আবার গুটিয়ে নিয়ে উড়ে গেল।

শরদিন্দু শেষপর্যন্ত কাগজ হাতেই উঠে পড়লেন। শ্যাম, আজ ডাক্তারের কাছে যাবার কথা, বিকেলে।

আজ?

হ্যাঁ। আজই এইটিন্থ..

আচ্ছা।

 তোমার ওষুধও শেষ হয়ে আসার কথা।

 আছে দু-একটা। দেখব।

শরদিন্দু চলে গেলেন সিঁড়ির দিকে। তেতলায় যাচ্ছেন, নিজের ঘরে।

তনু চারপাশে একবার তাকাল। বাবা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, আশেপাশে আর কেউ নেই–একেবারে ফাঁকা বারান্দা, নীহারপিসি স্নান করতে চলে গেছেন।

চা খেয়ে তনু বসে থাকল। রিনি কি সত্যিই অসুখে পড়ল? ফাঁকা বারান্দায় রোদ-আলো দেখতে দেখতে তনু চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল। রিনির যদি খুব সর্দি হয়ে থাকে, কিংবা জ্বর-টর, তনু রিনিকে বুঝিয়ে দেবে যে, অশ্বত্থামায় কিছু হয় না, পাপের ফল শাস্তি।

রিনি! তনু রিনির শোবার ঘরে গিয়ে দাঁড়াল। রিনি নেই। ঘর ফাঁকা। বিছানা পরিষ্কার। দরজাগুলো হাট করে খোলা। রিনির শোবার ঘরের যেখানে যা সবই ঠিক রয়েছে। তনু বেশ অবাক হল। রিনি কোথায় গেল?

বাইরে এসে দাঁড়াল তনু। সকালে রিনি স্নান করতে যায় না। গেলেও এত দেরি হবার কিছু নেই। পিসি এখন বাথরুমে।

রিনি কি তেতলায়? তেতলায় সে কী করবে? বাবার ঘর পরিষ্কার করে দিতে গিয়েছে? তা হলে এখনও কি থাকবে নাকি? সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে তনু একটু ভাবল। না, রিনি নিশ্চয় তেতলায় নেই। রান্নাঘরে গিয়ে সে রাঁধতে বসেছে যে তাও নয়। তবু তনু একবার ওপাশটা দেখে এল।

বারান্দায় আসতেই নারানের সঙ্গে দেখা, নারান দোকানে গিয়েছিল। হাতে জিনিসপত্র। নারানকে জিজ্ঞেস করল, দিদি কোথায়? নারান বলল, খুব সকালে দিদি বেরিয়ে গেছে। খুব সকালে রিনি কোথায় যেতে পারে তনু বুঝতে পারল না। ভোরবেলায় ওরা দুজনে লেকের দিকে বেড়াতে যায়। রিনি কি একলাই বেড়াতে চলে গেল? বেড়াতে গেলেও এত বেলা পর্যন্ত সে লেকে বসে নেই। তবে?

তনু বারান্দায় কিছুক্ষণ বসে থাকল। কাল বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরে রিনি আর তার সঙ্গে কথাবার্তা বলেনি। ভীষণ চটে গিয়েছিল রিনি, নীহারপিসির উপর, বাবার ওপর। রাগ করে সেই যে নিজের ঘরে গেল তার পর থেকে তনু আর তাকে দেখেনি। অন্যদিন রিনি সন্ধেবেলায় তনুর ঘরে কতবার আসে, রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর এসে দুধের গ্লাস দিয়ে যায়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কত হাসি গল্প করে; কাল খাবার সময় রিনি ছিল না, রাত্রে দুধ ওভালটিন দিতেও আসেনি। খাবার সময় টেবিলে বাবা, পিসি ও তনু সবাই এক রকম চুপচাপ ছিল। রিনির কথা বাবা জিজ্ঞেস করেছিল একবার, পিসি বলল, ও খাবে না বলেছে, রাগ হয়েছে মেয়ের, হোক একটু।

রিনির এত রাগের কী আছে তনু বুঝতে পারল না। তনুর ওপরই বা রাগ হবার কারণ কী? বরং তনু কাল বৃষ্টিতে ভেজার দায়টা নিজের কাঁধেই নেবার চেষ্টা করেছে। রিনির মাথা গরম।

বারান্দায় খানিক বসে তনু নিজের ঘরে এল। জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। যতটা দেখা যায় রাস্তা দেখল, পার্কের সামনেটা দেখল, রিনির কোনও চিহ্ন নেই। তনুর সব সময়ই মনে হচ্ছে, এখুনি সিঁড়িতে রিনির চটির শব্দ পাওয়া যাবে, গলা শোনা যাবে।

রিনি বাড়িতে না থাকায় চুপচাপ হয়ে আছে সব। বাবা তেতলায়, নীহারপিসি স্নান সেরে বেরিয়ে তাঁর ঘরে চলে গিয়েছেন, সরলাদি রান্নাঘরে সাড়াশব্দ খুব কম। কাকের ডাক, চড়ুইয়ের কিচকিচ, নার্সারি স্কুলের ছড়া-পড়ানোর শব্দ ছাড়া তেমন কোনও সাড়া এ বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না। তনু ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠতে লাগল। তার খারাপ লাগছিল। রিনি বড় আশ্চর্য মেয়ে। কোনও কিছু না বলে কোথায় চলে গেল।

তনুর কী খেয়াল হল, সে ঘর থেকে বারান্দায় এসে বাইরের চটিটা পায়ে দিল, তারপর সিঁড়ি দিয়ে সোজা নীচে। নীচে বাচ্চাগুলো সুর করে ছড়া পড়ছে; পুসি ক্যাট, পুসি ক্যাট, হোয়্যার হ্যাড ইউ বিন…। তনুর খুব মজা লাগল। রাস্তায় রিনির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তনু এই রকম সুর করে বলবে–পুসি ক্যাট, পুসি ক্যাট…

ফটকের বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়াল তনু। এই পাড়ার বড় রাস্তাটা তার চেনা হয়ে গেছে। সে এদিকে সোজা ট্রামলাইন পর্যন্ত চলে যেতে পারে, আর ওদিকে হাঁটতে হাঁটতে সোজা লেক পর্যন্ত। তনু আপাতত কোনদিকে যাবে কিছু ঠিক করতে পারল না। লেকের দিকে গিয়ে লাভ নেই, রিনি ওখানে এত বেলা পর্যন্ত একলা বসে থাকবে না। তনু ট্রামরাস্তার দিকেই ধীরে ধীরে হেঁটে চলল। কালকের বৃষ্টির পর আজ রোদ ভীষণ ঝকঝক করছে। রাস্তায় অনেক লোকজন, গাড়ি। দোকানপত্র সব কখন খুলে গিয়েছে, রোদের তাত বাঁচাতে কোনও কোনও দোকানের মাথার ওপর ঢালু করে তেরপল টাঙানো হয়েছে। গোটা কয়েক কুলি আলমারি মাথায় করে যাচ্ছিল। একটা আধটা খানা-খন্দে কালকের বৃষ্টির জল জমে আছে। রাস্তার পাশে পাশে কাদা জমেছে।

অন্যমনস্কভাবে তনু হাঁটছিল, দাঁড়াচ্ছিল কোথাও, রিনিকে খুঁজছিল, যে কোনও সময়ে সে লোকজনের মধ্যে রিনির মুখ দেখতে পেয়ে যাবে এই আশায় চেয়ে চেয়ে মানুষজন দেখছিল। তনু একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। রিনি খুবই আশ্চর্য মেয়ে। ভেরি স্ট্রেঞ্জ। ওর দেমাক খারাপ৷ এত রাগের কোনও দরকার ছিল না। রাগ মানুষকে নষ্ট করে। তনুর ওপর রাগ করার তো কোনও কারণই নেই। সে দোষের মধ্যে গির্জার দিকে বেড়াতে যেতে বলেছিল। কিন্তু রিনিকে বৃষ্টিতে ভিজতে, জলের মধ্যে পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে হাঁটতে বলেনি।

তনু গাছতলা থেকে সরে গেল। মাথায় খুব রোদ লাগছে। আজ রোদের তেজ খুব। ট্রামরাস্তার দিকে এগিয়ে চলল তনু। রিনিকে তনু একটা কথা আজ বোঝাবে; দেখো রিনি, অ্যাঙ্গার ইজ এ কাইন্ড অফ ক্রুয়েলটি। রাগের সঙ্গে নিষ্ঠুরতার কোনও তফাত তেমন নেই। মানুষের অনেক ব্যবহার আছে যা সে সোজাসুজি প্রকাশ করতে না পারলে ইনডিরেক্টলি প্রকাশ করে। রাগ হল জুয়েলটিরই একটা ফর্ম। তোমার এই রকম রাগ হওয়া উচিত নয়। একদিন তুমি নিষ্ঠুর হয়ে যাবে।

প্রায় রিনি বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু রিনি নয়। শাড়িটা রিনির মতো। হাতে বই খাতা মেয়েটির। তনুর হঠাৎ খেয়াল হল, রিনির কলেজ খুলে যায়নি তো? না, কলেজ আরও দু-একদিন পরে খোলার কথা। তা ছাড়া রিনির কলেজ দুপুরে।

তনু হাঁটতে হাঁটতে ট্রামরাস্তার সামনে এসে বড় গাছটার তলায় দাঁড়াল। গাছতলায় ছায়া আছে। ট্রাম আসছিল। বাস চলে গেল ধুলো উড়িয়ে। একটা অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি বাঁ দিকে বেঁকে চলে গেল।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল তনু। ট্রাম দেখছে, বাস দেখছে। এইবার রিনি ঝপ করে ট্রাম কিংবা বাস থেকে নেমে পড়বে ভাবছে। রিনি নামছে না। রোদ খুব চড়ে গেছে। চোখে লাগছে। ট্রাম বাসগুলো ভিড়ে ভরতি হয়ে একদিকে চলে যাচ্ছে।

কোথায় গেল রিনি? আশ্চর্য মেয়ে! কাউকে কিছু না জানিয়ে সে কোথায় যেতে পারে? তনু নানা রকম ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতে তার হঠাৎ মনে পড়ল, কাল রিনি একবার বলেছিল কোথায় যেন যাবে। কোথায়? তনু মনে করবার চেষ্টা করতে লাগল। কাল রিকশা করে ফেরার সময় রিনি বলেছিল সে আজ সকালে কার কাছে কোথায় যেন যাবে। কোথায়? তনু মনে করবার চেষ্টা করতে লাগল। কাল রিকশা করে ফেরার সময় রিনি বলেছিল সে আজ সকালে কার কাছে কোথায় যেন যাবে। কলেজের কোনও বন্ধুর কাছে? মাধুর কাছে? বোধহয় তাই বলেছিল। রিনি একদিন তাকে মাধুর বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। তারা সিনেমা দেখেছিল। বাড়িটা তো তনু দেখেছে। মাধুদের ওখানে গানের ব্যাপার-ট্যাপার কিছু আছে। গানের কোনও স্কুলে নয়তো? ভাল করে মনে করবার চেষ্টা করতে গিয়ে তনুর মনে হল, রিনি যেন বলেছিল মাধুর দিদির গানের স্কুলে একবার যাবে, সেখানে তাকে বার বার করে ডেকেছে। জায়গাটা এমন কিছু দুরে নয়।

তনুর হঠাৎ মনে হল, যে যদি রিনিকে খুঁজতে যায়, রিনি একেবারে আকাশ থেকে পড়বে। সাংঘাতিক সারপ্রাইজ হবে।

পকেটে অন্যমনস্কভাবে হাত দিয়ে দেখল তনু, তারপর বড় রাস্তায় নেমে হাঁটতে লাগল। ট্রামবাস গাড়ি-ঘোড়া দেখতে দেখতে অনেকটা এগিয়ে আচমকা একটা বাসে উঠে পড়ল। বাসটায় ভিড় কিছু কম। তনু বসতে পারল না, দাঁড়িয়ে থাকল। টলেমলে লোহার হ্যাঁন্ডেল ধরে অনেকটা চলে যাবার পর তনু বসতে পারল, বাস ফাঁকা হয়ে এসেছে। কণ্ডাক্টর এসে টিকিট চাইল। তনু কিছু বলার আগেই সে একটা টিকিট দিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী বলল। বাসটা একটা বাঁক ঘুরে যাচ্ছে। আশেপাশে বাড়ি ঘরদোর আর ঠিক কলকাতার মতন নয়, কাঁচা বাড়ি, মাঠ, জলজমা ডোবা, কাঠগোলা চোখে পড়তে তনুও নেমে পড়ল। বাস ফাঁকা হয়ে গেল।

রাস্তায় নেমে পড়ে তনু তার মাথার মধ্যে কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করল। রোদ প্রচণ্ড। সামনে তাকানো যায় না। জলতেষ্টা পাচ্ছিল তনুর। আশেপাশে তাকিয়ে বাঁ দিকে সে ঘর বাড়ি রাস্তা দেখতে পেয়ে হেঁটে এগিয়ে গেল। মাধুদের বাড়ি কি এদিকে? একটা বাড়ি তার দেখা দেখা মনে হল, হলুদ মতন। দোতলা। মাধুদের বাড়ি যেতে দেখেছিল।

রিনি এখানে কোথাও আছে। গানের স্কুলে।

তনুর চোখ জ্বালা করতে লাগল। জল এল বার কয়েক। চশমা খুলে হাত দিয়ে চোখটা মুছল। আকাশের দিকে তাকাবার সাহস হল না, রোদের তাত আর এই ভীষণ উজ্জ্বল আলো থেকেই বোঝা যায়, আকাশটা লাল হয়ে আছে, গনগন করছে।

.

অনেকটা হেঁটে এল তনু। রোদে তার কষ্ট হচ্ছে। চোখে খুব স্পষ্ট করে দেখতে অসুবিধে হচ্ছে। একটা বাড়ির গায়ে সেলাই শেখার স্কুলের বোর্ড ঝুলছে লাল মতন। পাড়াটা খুব চুপচাপ। লোকজন তেমন নেই। দোকানপত্র ভাল করেও যেন খোলা নয়।

রিনি এখানে ঠিক কোথায়, কোন বাড়িতে, কোন গানের স্কুলে, খোঁজবার জন্য তনু দাঁড়াচ্ছে, বাড়ি দেখছে, আবার হাঁটছে। তার চোখ বারবার জলে ভরে আসছিল। মাথার ওপর জৈষ্ঠ্যের রোদ দাউদাউ করে জ্বলছে। বাতাস নেই। অসম্ভব গরম। তনু ঘামছিল, মাথার মধ্যে যন্ত্রণা হচ্ছে, চোখের পাতা খুলে রাখতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তার। তবু তনু মাঝে মাঝে কপালের ওপর হাত রেখে চোখ আড়াল করে সেই বাড়িটা খুঁজছিল–যেখানে রিনি আছে। রিনি।

তনু লক্ষ করেনি যে, সে এখানে ঢোকার পর খানিকটা আসতেই একটা চুলকাটা সেলুন থেকে একজন তাকে লক্ষ করেছিল প্রথমে। খুব ভাল করে তাকে নজর করতে হয়নি। সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিয়ে সে দোকানের ভেতর তাকিয়ে অন্য একজনকে চোখের ইশারা করল।

পরশু এ-পাড়ায় জোড়া খুন হয়েছিল। কাল পুরোপুরি বনধ গিয়েছে। আজও থমথমে ভাব। দোকানপত্র সামান্যই খুলেছে। খুলে আবার টাটা রোদে এতটা বেলায় ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। পাড়াটা খুব থমকে আছে। পরশু, কাল দু-দিন খেপে খেপে বোমা পড়েছে, পুলিশের গাড়ি এসেছে, বিশ-পঁচিশ জন এখনও হাজতে।

তনু একটা ঘুঘুর ডাক শুনতে পেল, ঘুঘু ডাকছে। নারকোল গাছের মাথার ওপর দিয়ে জ্বলন্ত আকাশটা ছড়ানো রয়েছে। কোথায় যেন কে শিস দিল। এপাশ ওপাশ শিস বাজাল। শিসের শব্দটা তনু খেয়াল করল না।

সেলুনের দোকান থেকে একজন বেরিয়ে হন হন করে এগিয়ে একটা ঝাঁপফেলা চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে কসাইখানার দোকানের গায়ে যে-ছেলেটা বেঁকে ঘাড় কাত করে দাঁড়িয়ে ছিল সে ডান হাতটা তুলল, আবার নামাল।

তনু কোনও কিছুই লক্ষ করল না। তার চোখ, ভুরু, কপাল জুড়ে অসহ্য এক যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। যদিও হাতের কাছে আয়না নেই, কিন্তু তনু বুঝতে পারছে, তার চোখে জল আসছে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। রিনি তাকে ওই অবস্থায় দেখলে অবাক হবে।

কসাইখানার টিনের পাললার মধ্যে থেকে ছেলেটা হাত বের করে নিল। তার গায়ে ঘন নীল রঙের একটা কলার-তোলা গেঞ্জি, প্রায় কালো দেখায়। পায়ে মোটা চামড়ার চটি, মাথার চুল ঝাঁকড়া, রুক্ষ। ছেলেটা তার ডান হাতের মুঠো শক্ত করল।

পকেটে হাত দিল তনু, তার সঙ্গে রুমাল নেই। রুমাল থাকলে মুখের গলার ঘাড়ের ঘামটা মোছা যেত। ঘামে ভেজা রুমালটা চোখে চাপা দিলে খানিকটা আরাম পাওয়া যেত। ঘুঘু তো নয়, কোথাও কোনও ছায়ায় বসে কোকিল ডাকছে একটা। রিনি, রিনি যে কোথায়? জামার হাতায় কপাল মুছল তনু। সরু নোংরা গলির মধ্যে থেকে ছিপছিপে চেহারার পাজামা পরা হাতকাটা গেঞ্জি গায়ে দুটো ছেলে উঁকি দিল। দেখল, সব তৈরি। সেলুনের কাছ থেকে, চায়ের দোকানের খিড়কি দিয়ে, কসাইখানার পাশ থেকে ওরা সকলেই আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। হিমুদের মাঠের পানাপুকুরের কাছে একেবারে খালি গায়ে, খাটো কালো প্যান্ট পরে লম্বা তামাটে চেহারার বুলবুল দাঁড়িয়ে। বুলবুল এমনভাবে হাত ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে যেন একটা ছাগল তাড়া খেয়ে তার কাছে আসবে, এলেই সে অক্লেশে তাকে ধরে ফেলবে।

তনু এখন আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। তার চোখে অনবরত জল এসে এসে মণি দুটোর গায়ে পরদা পড়ে গেছে যেন, নাকের পাশ দিয়ে জলটা গড়িয়ে পড়লে খুব গরম লাগছে! যন্ত্রণা এত বেশি যে তনু দু-চোখ গুটিয়ে পাতা বুজে ফেলেছে। তার মাথায় কিছু আর আসছিল না। সমস্ত যেন মাখামাখি হয়ে গেছে চোখ আর মনের মধ্যে, সে কিছুই ভাবতে পারছে না, দেখতে পাচ্ছে না। মাথার ওপর আগুন, পায়ের তলায় হলকা, আশেপাশে ভয়ঙ্কর রোদটা শান দেওয়া অসংখ্য ছুরির মতন ঝকঝক করছে।

তনুকে দাঁড়াতে হল। দাঁড়াবার পর তার মনে হল ওর আশেপাশে কারা আছে।

 কোথাথেকে আসা হচ্ছে? একজন কে জিজ্ঞেস করল।

তনু চুপ। সে দেখবার চেষ্টা করল তার মুখের সামনে কে রয়েছে। দেখতে পেল না।

তনুর সাজ পোশাক খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে পরিষ্কার গলায় আর-একজন বলল, কোথাকার কাট রে?

মুখ ফেরাবার চেষ্টা করল না তনু, হাত উঁচিয়ে চশমাটা খুলে চোখের জল মুছে একবার তাকাবার চেষ্টা করতে গেল। কিন্তু সে হাত ওঠাতে পারল না। তার হাত কে চেপে ধরে ফেলেছে।

তনুর জামার পকেটে একজন হাত ঢুকিয়ে দিল। বুক পকেটে। তারপর পাশ পকেটে।

তিনটে টিকিট। দুটো স্টেট বাসের একটা প্রাইভেট বাসের। আর একজন বলল।

তনু মনে করতে পারল না। স্টেট বাসের টিকিট দুটো রিনি তার হাতে গুঁজে দিয়েছিল একদিন, মেঘলা দুপুরে তারা যখন দোতলা বাসে চেপে ইউনিভারসিটি দেখতে যাচ্ছিল। টিকিট দুটো দিয়ে রিনি বলেছিল, রেখে দিয়ে, তোমার কলকাতা বেড়াবার স্মৃতিচিহ্ন।

প্রাইভেট বাসের টিকিট দেখ তো রতন।

শালার চোখ কী লাল কী রে শুয়োরের বাচ্চা চেপে আছিস কেন?

তনু বুঝল তাকে কেউ প্রচণ্ড জোরে লাথি মেরেছে। সে আবার চোখ খোেলবার, ভাববার চেষ্টা করল। চোখের জন্যে তার ভাবনাও এমন হয়ে গেছে যেন খোলা আয়নার ওপর প্রখর রোদ ঝলসে যাচ্ছে, কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার কপাল, গলা, ঘাড় থেকে ঘাম গড়িয়ে বুক-পিঠ ঠাণ্ডা করে দিয়েছে।

একটা রিকশার আওয়াজ এলো। বেশ জোরেই আসছে। বিশ্রী শব্দ হচ্ছিল।

সঙ্গে সঙ্গে তনু অনুভব করল তার হাতের ওপর আর চাপ নেই। কারা যেন ছুটে পালাচ্ছে, পায়ের শব্দ। পায়ের শব্দ চাপা পড়ে গেল গাড়ির শব্দে। তনু রাস্তার মধ্যে অন্ধর মতন দাঁড়িয়ে। দু-চোখ দিয়ে অবিরত জল গড়িয়ে পড়ছে।

.

পুলিশের ওয়ারলেস ভ্যানে তনুকে তুলে নিয়ে ফিরতে ফিরতে কম বয়েসি এক অফিসার জিজ্ঞেস করল, কোথায় থাকা হয়।

তনু প্রথমে কিছু বলতে পারল না। পরে বলল, আমি কলকাতায় নিউ কামার।

 সে তো বুঝতেই পারছি। কোথা থেকে আসা হয়েছে।

 এখতিয়ারপুর। মধ্যপ্রদেশ।

 এম পি থেকে? সেখান থেকে এখানে কেন? মরবার জন্যে?

আমি বাবার সঙ্গে কলকাতায় চোখ দেখাতে এসেছিলাম।

যেখানে গিয়েছিলে সেটা চোখ দেখাবার জায়গা? ইডিয়েট কোথাকার!

 তনু চুপ করে থাকল। তার চোখ দিয়ে তখনও জল পড়ছে, যন্ত্রণা হচ্ছে।

তুমি ওখানে কোথায় গিয়েছিল? ।

তনু চুপ। তার ঠোঁট কাঁপছে, ফুলে উঠেছে, মুচড়ে যাচ্ছে। গালের মাংস দুমড়ে যাচ্ছিল।

ওরা তোমায় লিঞ্চ করত, বুঝলে? তোমার মতন গাধা, মুর্থ ইডিয়েট আমি দেখিনি। নিজের লাইফটাও বাঁচাতে শেখোনি?

তনুর গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছিল না। তার যে কী তৃষ্ণা পেয়েছে।

তুমি কোন সাহসে ওখানে ঢুকেছিলে? কোথায় গিয়েছিলে?

তনু কোনও রকমে বলল, একজনকে খুঁজতে।

একজনকে! কাকে? ।

তনু কিছু বলতে পারল না। তার ঠোঁট, ফুলে কাঁপতে লাগল।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *