একা একা – ৬

০৬.

দশ বারোটা দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। এই দশ বারো দিন তনুকে নিয়ে টানাহেঁচড়া কিছু কম হল না। নানা ধরনের পরীক্ষা হল, ছোটাছুটি হল, কাগজপত্র, রিপোর্ট জমল পকেট ভর্তি করে; তনু বুঝতে পারল না তার চোখের কিছু ইতর-বিশেষ হয়েছে বা হবে। গুপ্তসাহেব মানুষটি ভাল, নীহারের স্বামীর সিনিয়ার ছিলেন, এইসব নিজেদের চেনাশোনা বাড়ির ব্যাপারে নিজের হাতে আর ব্যাপারটা রাখলেন না, নিজেই কথাবার্তা বলে ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দিলেন আরও বড় জায়গায়। সেখানে গিয়ে শরদিন্দু শুনলেন এসব ব্যাপারে অস্থির হলে চলে না, তাঁকে আরও ধৈর্য ধরতে হবে, তাড়াহুড়ো করে কিছু হবে না। ধৈর্য ধরতে শরদিন্দুর আপত্তি ছিল না, এতকাল তো তিনি ধৈর্য ধরেই আছেন, আরও থাকবেন। অধৈর্য হয়েও কি কোনও লাভ আছে? তাতে কি তনুর চোখ সারবে? তবে?

দিন পনেরোর মাথায় দুটি জিনিস ধরা পড়ল। তার মধ্যে একটা খুবই বিচিত্র। ছেলেবেলায় তনুর একবার টনসিল অপারেশন হয়েছিল। সেটা ভালমতন হয়নি; তার একটা খুঁত থেকে গেছে। তনুর চোখের ব্যাপারে অদ্ভুত এক গোলমেলে কাণ্ড করেছে ওই খুঁতটাই। আর ধরা পড়ল, আগে কোনও সময়ে এমন কিছু উলটোপালটা চিকিৎসা হয়ে গিয়েছে যাতে চোখের ক্ষতি হয়েছে বেশি,নয়তো এতটা হয়তো হত না। চোখের স্বাভাবিকতা একেবারেই নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। নতুন বড় ডাক্তার পরামর্শ দিলেন, চোখের স্বাভাবিকতা খানিকটা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রথমে: চোখ আগলে রাখা চলবে না, গগলস-টগলস তুলে রাখা হোক, বেশি রোদ চোখে না লাগালেই হল। ওষুধপত্র অবশ্য থাকল।

শরদিন্দু অবশ্য একটা বিষয়ে ভরসা পেলেন। তনুর চোখ কতটা যে ভাল করা যাবে বলা যায় না, তবে আশা করা যাচ্ছে আর বেশি খারাপও হবে না, অন্তত যাতে না হয় তার ব্যবস্থা করা যাবে। একেবারে অন্ধ হবার মতন ঘটনা ঘটবে না বলেই মনে হয়।

সেদিন ফেরার পথে শরদিন্দুর মনটা সামান্য হালকা থাকায় ট্যাক্সির মধ্যে তিনি হঠাৎ বললেন, নীহার, মাঠে একটু বেড়িয়ে গেলে কেমন হয়?

নীহার বললেন, বেশ তো, চলো না; দুদণ্ড বসে যাবে।

রিনি সঙ্গে ছিল। মার সঙ্গে সে বেরিয়েছিল অন্য একটা কাজ সারতে। কথা ছিল, কাজ সেরে চৌরঙ্গিতে ডাক্তারের চেম্বারে চলে আসবে। কাজটা অবশ্য সাংঘাতিক কিছু নয়, রিনি কোথায় যেন বাটিকের প্রিন্ট করতে দিয়েছে, সেটা নেবে–আর নিউ মার্কেটে গিয়ে কিছু লেস কিনবে। রিনি তার কাজ সেরে ঠিকসময় চেম্বারে ফিরে এসে দেখে, শরদিন্দুমামা তখন ডাক্তারের ঘরে। সামান্য পরেই ফিরলেন।

ট্যাক্সিটাকে ছেড়ে দেওয়া হল। চারজনেই নেমে পড়লেন।

নীহারের হাঁটাহাঁটির অভ্যেসটা কম, বাঁ পায়ের হাঁটুর বাতটাও পূর্ণিমায় বেশ বেড়েছিল। তার জের রয়েছে এখনও। তিনি ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন।

বিকেল পড়ে গেছে। গ্রীষ্মের রোদ এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। আকাশের তলা দিয়ে সরে যাচ্ছে। আলোর ভাবটা মাঠে-ঘাটে পড়ে আছে হালকা করে। ট্রামলাইন পেরিয়ে এক ফালি জমি, তারপর পিচের রাস্তা, পিচের রাস্তা পেরোলে মাঠ।

ট্রামলাইন পেরিয়ে শরদিন্দু বললেন, গড়ের মাঠেও আজকাল কত ভিড় হয়।

নীহার বললেন, ভিড় আজকাল সব জায়গায়, কোথায় নয়। এখানে তেমন ভিড় কোথায়, ফাঁকাই তো! লোকে এই গরমের দিনে একটু বেড়াতে আসবে না? তার ওপর আজ শনিবার।

রিনি শরদিন্দুকে বলল, ওপাশে চলুন, মাঠের মধ্যে গিয়ে ঢুকলে একেবারেই ফাঁকা।

পশ্চিমের দিকে হাঁটতে লাগল শরদিন্দুরা, মাঠের দিকেই। খানিকটা উত্তর ঘেষে যেতে পারলে সত্যিই নিরিবিলি। মাঠ জুড়ে আজ বাতাস রয়েছে। এক টুকরো মেঘ উঠেছে গঙ্গার মাথার ওপর, যেন আকাশটা চোখের তলায় কাজল দিতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে।

খানিকটা এগুতেই রিনি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ওমা, ওই দেখো

রিনি যেদিকে হাত তুলে দেখাল, নীহার সেদিকে তাকালেন। খানিকটা তফাতে গাছের তলায় একজন দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় বারান্দামাকা টুপি; গোলগাল বেঁটে-সেটে চেহারা, পরনে প্যান্ট, গায়ে বুশশার্ট। তাকিয়েই নীহার চিনতে পেরে গিয়েছিলেন, গজেন ঠাকুরপো৷ গজেন ঠাকুরপো তাঁদের দিকে তাকিয়ে রুমাল নাড়ছে।

নীহার শরদিন্দুকে শুনিয়ে বললেন, গজেন ঠাকুরপো।

রিনি ততক্ষণ অন্যদের পিছনে ফেলে গজেনকাকার দিকে এগিয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে শরদিন্দু বললেন, উনি তোমাদের কেমন সম্পর্ক?

রিনির বাবার মাসতুতো ভাই। আমাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর আত্মীয়স্বজন বলতে ওই গজেন ঠাকুরপোই যা মাঝেমধ্যে এসে খোঁজখবর নিয়ে যায়। মানুষটি খুব মজার।

তনু নীহারপিসিদের কাছাকাছি হাঁটছিল। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল সামনে

 নীহাররা গজেনের কাছাকাছি এসে খানিকটা অবাকই হলেন। গজেনের সামনে একটা স্কুটার দাঁড় করানো। রিনি তার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে। স্কুটারটা নজরে আগেও যে না পড়েছিল নীহারের তা নয়, কিন্তু গজেন ঠাকুরপোর সঙ্গে স্কুটারটার কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়নি। রিনির ভাবসাব দেখে তাঁর অন্যরকম মনে হল।

কাছে আসতেই রিনি হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলল, মা, সাংঘাতিক ব্যাপার, গজেনকাকা স্কুটার চড়া শিখছে।

গজেন যেন কতই অপ্রস্তুতে পড়েছেন, মুখটি সলজ্জ করে নীহারকে দেখলেন, তারপর রিনিকে বিচিত্র এক মুখভঙ্গি করে বললেন, য্যাঃ, য্যা।

নীহার হেসে বললেন, তাই নাকি। তুমি ওই দু-চাকাটা চড়তে শিখেছ?

গজেন বললেন, পুরো শিখিনি। এখনও, ওই শিখব-শিখব করছি।

কিনেছ বুঝি?

না না, গজেন মাথা নাড়লেন, না শিখে কিনে ফেলাটা বোকামি হবে। এটা আমাদের পাড়ার একটা ছেলের। তাকে ধরেটরে শিখে নিচ্ছি।

আশেপাশে কোনও ছোকরাকে দেখা যাচ্ছিল না। নীহার চারদিকে তাকালেন, কোখায় সে?

তাকে একটু এগিয়ে দেখতে পাঠিয়েছি। গজেন কিছু গোপন রাখলেন।

 রিনি হেসে বলল, দেখতে পাঠিয়েছ কাছাকাছি পুলিশ আছে কি না?

য্যাঃ য্যাঃ, পুলিশ দেখতে পাঠাব কেন! আমার এল আছে–দেখছিস না। আমি রাস্তায় গাড়ি চড়ছি, মাঠে নাকি?

তবে আর কী দেখতে পাঠিয়েছ?

গজেন রিনির দিকে তাকিয়ে মুখের ভাবটা এমন করলেন যেন প্রশ্নটা করে রিনি তাকে বিপদে ফেলেছে। নীহারে দিকে তাকিয়ে গজেন বললেন, ব্যাপারটা কী জানো বউদি, আমি মাঠে এসে স্কুটার-চড়া শিখছি এটা আমার বউ বিশ্বাস করে না। আমি আজ বলে দিয়েছি, অফিস ছুটির পর চলে এসো, তোমায় দেখিয়ে দেব। বনবন করে কটা পাক মেরে দেখিয়ে দিতাম, নো ব্লাফ, অল ভেরি সিরিয়াস। মজাটা দেখেছ, সাড়ে চারটে থেকে এসে দাঁড়িয়ে আছি, এখন ছটা-টটা বাজতে চলল, কোনও পাত্তা নেই। যত ট্রাম যাচ্ছে হাঁ করে তাকিয়ে আছি, ভাবছি এই বুঝি নামল ট্রাম থেকে। শেষে ছোকরাটাকে পাঠালাম। একবার এগিয়ে দেখে আসুক। জায়গা ভুল হতে পারে। কখন অফিস ছুটি হয়ে গেছে, এতক্ষণ এসে পড়া উচিত ছিল।

নীহার হেসে ফেললেন। বীণা অফিস থেকে বেরিয়ে তোমার স্কুটার-চড়া দেখতে আসবে?

আসার কথা।

জায়গাটা চিনিয়ে দিয়েছিলে ঠিক করে?

 হাজারবার করে বুঝিয়ে দিয়েছি। মেয়েদের কাণ্ডকারখানাই আলাদা।

নীহার হাসিমুখে বললেন, তোমার কাণ্ডকারখানাও আলাদা…তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। বলে নীহার শরদিন্দুকে চোখ দিয়ে দেখালেন।

পরিচয় পর্বটা শেষ হতেই দিলেন না গজেন, রিনির মুখে আগেই শুনেছেন সব, খুব চেনাচেনা চোখে শরদিন্দু এবং তনুশ্যামের দিকে তাকিয়ে বললেন, বউদির মুখে আগেই আমি আপনাদের কথা শুনেছি। আপনারা কলকাতায় আসছেন তাও জানতাম। খুব ভাল করেছেন এসে পড়ে। কলকাতায় ডাক্তারের অভাব কী?

শরদিন্দু মৃদু হেসে বললেন, আজও ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরছি।

শুনলাম। রিনি বলছিল।

 নীহার গজেনকে বললেন, তোমার অনেকদিন কোনও খোঁজ নেই। ব্যাপার কী? বীণাকে নিয়ে আসতে পারছ না একদিন?

এই তো যাব। এবার একদিন যাব। আমার একেবারে মরার সময় নেই বউদি। চরকি মেরে বেড়াচ্ছি। সকালে গৃহপালিত–ডোমেস্টিক হয়ে থাকি, তোমার ভাজ অফিস যায়, তার ফরমাস খাঁটি। দুপুরে কাগজের অফিস ঘুরে মাঠ, খেলার সিজন শুরু হয়ে গেছে, মাঠ আর টেন্ট ঘুরে আবার কাগজের অফিস, বেরোতে বেরোতে রাত আটটানটা। থাকিও এক বেয়াড়া জায়গায়, রোজ এটা বন্ধ ওটা বন্ধ, বাস পাই না, ট্রাম চলে না, তার ওপর খুননাখুনি লেগে আছে। কী করে যে বেঁচে আছি তুমি বুঝবে না!

নীহার হাসিমুখে বললেন, সবই বুঝতে পারছি। কাজের চোটে আর দিশে পাচ্ছ না।

 রিনি গজেনকাকার গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে একটা হাত ধরে টানতে লাগল। আজ মাঠে খেলা নেই?

ওরে ব্বাস বলিস কী! আজ ইমপর্টেন্ট গেম, লিগের। এরিয়ান্স-বি এন আর।

রিনি হেসে বলল, বেশ আছ।

গজেন হাসিমুখে বললেন, খেলা একটাই, নাইনটিন ইলেভেনে মোহনবাগান খেলে গেছে। তারপর থেকে কলকাতায় মাঠের পর মাঠ পড়ে আছে রে, কিন্তু খেলা নেই। এই তো আমি, মাঠে গেলাম না, কাল একবার আমাদের কাগজটা পড়ে দেখবি! কী লেখা! চোখে দেখলে এর চেয়ে ভাল লেখা যেত না। চুটিয়ে লিখে দেব।

হি হি করে হেসে উঠে রিনি বলল, তুমি বুঝি সারা বছর এই করো?

য্যাঃ য্যাঃ কী যে বলিস, মাঝে-সাঝে করি– গজেন মজার ভঙ্গি করে হাসতে লাগলেন।

 তনু বেশ অবাক হয়ে গজেনকাকাকে দেখছিল।

 নীহার বললেন, তুমি একদিন এসো, দরকার আছে।

যাব যাব, গজেন মাথা হেলিয়ে বললেন। যাওয়া আসার অসুবিধের জন্যেই তো স্কুটারটা শিখছি, বউদি। কারও তোয়াক্কা করতে হবে না। যখন তখন চলে যাব।

রিনি গজেনকাকার পেটের কাছে আস্তে করে হাত ছোঁয়াল। গজেন উঁড়ির জন্যে কেমন অস্বস্তি বোধ করেন, উসখুস করতে লাগলেন।

একটা ম্যাজিক দেখাও, রিনি বলল।

 য্যাঃ য্যাঃ, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ম্যাজিক কী।

দেখাও না।

রাস্তায় ম্যাজিক হয়! তুই একেবারে পাগল।

 নীহার মেয়েকে শাসনের মতন করে বললেন, আঃ, কী করছিস! তুই বড় জ্বালাতন করিস, রিনি।

 গজেন রিনির মাথায় একটা টোকা মেরে বললেন, বাড়িতে গিয়ে দেখাব। নতুন ম্যাজিক।

নীহার এবার যাবার জন্যে ব্যস্ত হলেন, তুমি ঠাকুরপো তা হলে তোমার দু-চাকা নিয়ে কেষ্টঠাকুর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো, আমরা একটু বেড়িয়ে আসি।

গজেন মাথা হেলালে, হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমরা একটু ময়দানে ঘুরে নাও। এরপর অন্ধকার হয়ে যাবে।

রিনি বলল, আমাদের বাড়িতে কবে আসছ?

যাব, আসছে হপ্তায়।

 ঠিক?

ঠিক।

কাকিমাকে নিয়ে যাবে।

যাব।

কী মনে করে রিনি বলল, আমাদের একদিন ফুটবল খেলা দেখাতে নিয়ে যেতে হবে বলে চোখ দিয়ে তনুকে দেখাল।

যাবি? বেশ তো! যে কোনওদিন। বলে তনুর দিকে তাকালেন, কলকাতার মাঠ এখনও ইন্ডিয়ার মধে বেস্ট। এর ইজ্জত আলাদা। তোমায় একদিন ভাল খেলা দেখিয়ে আনব।

নীহাররা বিদায় নিলেন। শরদিন্দুও একদিন আসতে বললেন গজেনকে; গল্প-টল্প করবেন।

 সামান্য হেঁটে এসে তনু রিনিকে বলল, উনি ম্যাজিসিয়ান?

 রিনি বলল, গজেনকাকা ওয়ান্ডারফুল ম্যান। ম্যাজিক যা দেখায় না! অদ্ভুত। তোমার মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। খুব মজার লোক।

শরদিন্দু এবং নীহারকে সামনে এগিয়ে দিয়ে রিনিরা হাত কয়েক পেছনে হাঁটছিল। রিনির হাতে একটা প্যাকেট। হঠাৎ বাঁ দিকে হাত তুলে দেখিয়ে রিনি বলল, ওই যে তোমার প্ল্যানেটোরিয়াম।

তনু দেখল। সে এর মধ্যে রিনির সঙ্গে এসে প্ল্যানেটোরিয়াম দেখে গেছে। আর একবার আসার ইচ্ছে, পরে আসবে। রিনি তাকে কলকাতার অনেকগুলো জায়গা এর মধ্যে দেখিয়ে ফেলেছে। ডাক্তার-ফাক্তারের ঝঞ্জাট সত্ত্বেও ফাঁকে ফাঁকে রিনি তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রিনি ছাড়া এসব হত না। নানারকম বুদ্ধি তার মাথায় বেশ এসে যায়। তনুকে প্যাথলজিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হল, রিনি শরদিন্দুকে যেতে দিল না; বলল, আপনি আবার কেন যাবেন ভবানীপুর, এখন যা ভিড় ট্রামেবাসে, ট্যাক্সি পাওয়াও মুশকিল হবে। এই তত ভবানীপুর, আমি গিয়ে করিয়ে নিয়ে আসছি। ওকে ওই সঙ্গে একটু বেড়িয়ে নিয়ে আসব। শরদিন্দু কলকাতা শহরের পথঘাট, ভিড়, চেঁচামেচি, ট্রামবাস, ট্যাক্সি করে তীর্থকাকের মতন দাঁড়িয়ে থাকা–তেমন বরদাস্ত করতে পারছিলেন না। বাড়িই তাঁর ভাল লাগত। একদিন শুধু পুরনো এক বন্ধুর খোঁজ করতে কালীঘাট গিয়েছিলেন। কোনও হদিশ করতে পারলেন না, শুনলেন অনেককাল আগেই বাড়ি-টাড়ি বেচে চলে গেছেন।

রিনির আগ্রহ এবং বুদ্ধির অভাব ঘটলে তনুর এর মধ্যে যা যা দেখা হয়েছে তার একটাও বোধহয় হত না। খুবই আশ্চর্য যে রিনি একেবারে যেন ফিতে মেপে সময় ঠিক করে তাকে জু পর্যন্ত বেড়িয়ে নিয়ে এসেছে। অবশ্য কোথাও দু দণ্ড ভাল করে দাঁড়াতে পারেনি তনু–রিনি জামা ধরে টেনে নিয়ে গেছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, যেন ছেলেমানুষের মতন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। তা বেড়াক, তবু রিনির কৃপায় কিছু ঘোরা হল, কিছু দেখা হল। আরও হবে। এখন দিনকয়েক আর ডাক্তার ফাক্তার নেই।

হাঁটতে হাঁটতে রিনি বলল, ডাক্তার তোমায় নরম জিনিস দেখতে বলেছে না? কী বলেছে?

সবুজ-টবুজের দিকে তাকিয়ে থাকতে, যতদূর চোখ যায়। আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে।

 তুমি তাহলে বসে বসে ঘাস দেখো, আমি একটু ফুচকা খেয়ে আসি।

 ফুচকা?

ফুচকা জানো না–? বলে রিনি হাত দিয়ে খানিকটা দূরে দেখাল।

তনু বেশ কিছুটা তফাতে মানুষজন, একটা গাড়ি, দুটো ছুটন্ত বাচ্চা, গাছতলায় জনা কয়েকের ভিড় দেখতে পেল।

রিনি তাকে ফুচকা জিনিসটা হাত মুখ নেড়ে মজা করে বর্ণনা করতে যাচ্ছিল তনু বুঝতে পারল। খেও না। খুব ডার্টি।

ডার্টি না হাতি। আমরা ফুচকা খেয়ে খেয়ে বলে পেটে চরা পড়িয়ে ফেললুম। কী টেস্ট.. বলে জিভ টেনে শব্দ করে হাসতে হাসতে সত্যিই সে ফুচকা খেতে এগিয়ে গেল। তনু দাঁড়িয়ে থাকল।

নীহার আর শরদিন্দু হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সূর্যের তাপে ঘাসের রং বিবর্ণ হয়ে এসেছে, আলো ও ছায়ামাখানো ঘেঁড়া একটা কাগজ উড়ে উড়ে যাচ্ছিল।

শরদিন্দু বললেন, আমাদের সময়ে গড়ের মাঠের এসব দিকে তোকজনই আসত না। ভয় পেত। গড়ের মাঠে খুন-টুন হত। আমরা কত রকম গল্প শুনতাম। তারপর যুদ্ধের সময় তখন, এমনিতেই কলকাতায় মানুষজন কম, এসব জায়গায় মিলিটারির ভয় ছিল।

নীহার বললেন, তোমার কলকাতার কথা ভুলে যাও। সে শহর আর নেই। আমিই বিয়ের পর এসে কী দেখেছি, আর এখন কী দেখছি। বলছিলাম না তোমায়, আমাদের পাড়াটাই কী ছিল আর চোখের ওপর দেখতে দেখতে কী হয়ে গেল।

সময়– শরদিন্দু বললেন, বড় করে নিশ্বাস ফেললেন, সময়ের পরিবর্তন নীহার।

দিনকাল এমনি করেই বদলে যায়।

তা যায়।

চুপ করে হেঁটে এসে নিরিবিলিতে নীহার বললেন, আমি একটু বসি; বাতের হাঁটু, শরীরটাও যা ভারী–। বসবে?

শরদিন্দু নীহারের দিকে তাকিয়ে আচমকাই হেসে ফেললেন। বসো বসো। বুঝলে নীহার, এটাও সময়ের পরিবর্তন।

বসতে বসতে নীহার হেসে বললেন, পরিবর্তন বইকি! দেখছ না, বাতে ধরেছে, দাঁত পড়েছে, চুল পেকেছে।

শরদিন্দু ঠাট্টা করে বললেন, চোখটা এখনও রয়ে গেছে এই তো? ছানি পড়েনি।

মাথার কাপড়টা হাতে করে তুলে দিতে দিতে নীহার স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

শরদিন্দুও বসলেন। শুকনো মাঠ। চারপাশ থেকে হাওয়া আসছে। চৌরঙ্গি দিয়ে গাড়িঘোড়ার শব্দ অনেক চাপা হয়ে ভেসে আসছে।

বসে পড়ে শরদিন্দু পকেট হাতড়ে সিগারেট দেশলাই বার করতে লাগলেন। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, তনু একলা খুব ধীরস্থির পায়ে আসছে, রিনি নেই। মেয়েটা কোথায় গেল আবার?

মাথা ফিরিয়ে দেখলেন নীহার। রিনিকে দেখা গেল না। বললেন, যাবে কোথায়? ওইদিকেই আছে। কোনও বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে হয়তো, গল্প করছে।

শরদিন্দু আরও একটু তাকিয়ে থাকলেন। তনু বারবার ফিরে তাকাচ্ছে মানুষজনের দিকে। রিনি হয়তো ওখানেই কোথাও আছে।

পা ছড়িয়ে বসে শরদিন্দু এবার একটা সিগারেট ধরালেন। আলো ক্রমেই কমে আসছে। অনেকখানি ধূসর হয়ে গিয়েছে চারপাশ।

শরদিন্দু সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললেন, আমি তো ভেবে পাচ্ছি না নীহার, শ্যামের টনসিল অপারেশানের সময় কী গণ্ডগোল হল! পুষ্প তখন বেঁচে। পাটনায় গিয়ে অপারেশান করাতে হয়েছিল। পুষ্পর জানাশোনা ডাক্তার।

নীহার বললেন, গোলমাল হতেই পারে। শ্যামের চোখ নিয়েও তো ভুল চিকিৎসা হয়েছে।

হ্যাঁ, শরদিন্দু কাছাকাছি একটা গাছের মাথায় অন্ধকার জমা দেখতে দেখতে বললেন, একটার পর একটা ভুলই হচ্ছে। আমার খুবই আশ্চর্য লাগে নীহার, শ্যামের জন্মের সময় একটা ক্রাইসিস গেল, ওর টনসিল অপারেশানের সময়ও গণ্ডগোল হল, পুষ্প বাচ্চা হতে মারা গেল, সেও একটা গোলমালের মধ্যে। তারপর দেখছ তো, শ্যামের ভুল চিকিৎসাও কেমন হয়েছে। আমার জীবনে যা হবে সবই কি ভুল? কী আশ্চর্য!

শরদিন্দুকে হঠাৎ কেমন বিরক্ত, অসহিষ্ণু, ক্ষুব্ধ মনে হল। তাঁর মুখেও যেন হতাশা ফুটে উঠেছে।

নীহার শরদিন্দুর মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকলেন। ভুল তো নিশ্চয়। অনেক ভুল শরদিন্দুর জীবনে বাস্তবিকই ঘটে গেছে।

শরদিন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেও নীহারের দুঃখ হচ্ছিল। মানুষের সব ভুল কপালের দোষে হয় না। কিছু ভুল সে নিজেই করে, জেদের বশে, রাগের বশে, অহঙ্কারের বশেও। শরদিন্দু এমন ভুল না করেছেন এমন নয়। কিন্তু এসব কথা তুলতে নীহারের ইচ্ছে হল না। নীহার নিজেও কি নিস্তার পাবেন কথাটা যদি সত্যিই ওঠে? শরদিন্দুর মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নীহার সামনে তাকিয়ে থাকলেন। এই তেপান্তরের মাঠের ওপ্রান্তে অন্ধকার জমে গিয়েছে, বাতি জ্বলছে, আলোর ফোঁটা চোখে পড়ছে, গাড়ি চলে যাবার লাল আলোগুলো ফুলকির মতন ছুটে যাচ্ছে।

নীহার নীরব; শরদিন্দুও কথাবার্তা বলছিলেন না।

আরও একটু পরে নীহার বললেন, আমার তো মনে হয় না ছেলেটার আবার টনসিল কাটানো উচিত। এখন বয়েস হয়ে গিয়েছে।

শরদিন্দু প্রথমে জবাব দিলেন না; পরে অন্যমনস্কভাবে বললেন, আমি আর কী বলব! কিছুই বুঝতে পারছি না। দেখা যাক নতুন ওষুধটষুধ কী হয়, তারপর যেমন দাঁড়ায়…

ভালই দাঁড়াবে, নীহার সাহস দিয়ে বললেন।

 কী করে তুমি বুঝলে? শরদিন্দু ঘাড় ঘুরিয়ে নীহারের মুখের দিকে তাকালেন।

আমার মন বলছে,নীহার ছোট করে জবাব দিলেন।

তোমার মন– বলে শরদিন্দু যেন খানিকটা হালকা ঠাট্টাই করতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় কেমন একটা শব্দে মুখ ফিরিয়ে দেখলেন রিনি মাঠের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে একপাশে চলে যাচ্ছে, শ্যামও যেন খুব তাড়াতাড়ি প্রায় ছোটার মতন রিনির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। শরদিন্দু কিছু বুঝতে পারলেন না। তাকিয়ে থাকলেন। রিনি দাঁড়াল একবার, শ্যাম কাছাকাছি গেলে সে আবার ডান দিক দিয়ে খানিক ছুটে গিয়ে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। শ্যাম গাছের দিকে চলল। রিনি আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। দুজনে কাছাকাছি হল। রিনি হাত দিয়ে কী যেন দেখাল, বোধহয় শরদিন্দুদের দিকটাই। তারপর ওরা ফিরে আসতে লাগল।

শরদিন্দু কিছুক্ষণ শ্যামদের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নীহারের দিকে তাকালেন।

নীহার?

 কী হল?

 চলো, উঠি। অন্ধকার হয়ে এল।

 ওরা আসুক।

আসছে ওরা। শরদিন্দু উঠে পড়েছিলেন।

নীহার ওঠার আগে আরও মুহূর্ত কয়েক বসে থাকলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে কাপড়টা ঝেড়ে নিতে নিতে বললেন, এখানেও চোরকাঁটা আছে গো, আমার পায়ের দিকে লেগেছে মনে হচ্ছে।

শরদিন্দু মাঠের দিকে তাকালেন, নীহার যেখানে বসেছিল তার পাশে খানিকটা জায়গা বড় বড় ঘাসে ঝোঁপ মতন হয়ে আছে।

নীহার মাথার কাপড় সামান্য তুলে দিলেন, মাঠে বসে জিরিয়ে যেটুকু আরাম পেয়েছেন সেই আরামে গা ভাঙলেন যেন। আমাদের সেই ধোপী মাঠটার কথা তোমার মনে পড়ে? নীহার বললেন ধীরে ধীরে, মস্ত একটা শিমুলগাছ ছিল, পুকুর ছিল রাজবাড়ির, সেই মাঠে কী চোরকাঁটা বাবা; আমরা বলতাম চোরকাঁটার মাঠ।

শরদিন্দু বললেন, তোমার মনে থাকলে আমারও মনে আছে।

আমার সবই প্রায় মনে আছে। মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছে করে একবার যাই, দেখে আসি। আমাদের সেই দুর্গাবাড়ি, গোরক্ষমঠ, নইনি টিলা, রানী ঝিলের সেই সিঁড়ি…আমার নিখুঁত করে মনে আছে। নাড়ির টান গো, জন্মস্থানের নাড়ির টান। আহা, ভাবলে মন কেমন করে!

শরদিন্দু পা বাড়িয়ে বললেন, আমরা যা দেখে এসেছি সে সব কি আর সেই চেহারায় আছে নীহার! নেই। এই কলকাতা যেমন বদলে গেছে সেই রকম সবই বদলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। তুমি, আমি, আমরাও কত বদলে গিয়েছি। বলে একটু থেমে কী মনে করে হাসির গলায় শরদিন্দু আবার বললেন, তখন তুমিও হাঁটুর বাত নিয়ে কি ভুগতে, না দু-চার পা হাঁটতে গিয়ে হাঁসফাঁস করতে? ।

নীহার হেসে ফেলে বললেন, যা বলেছ। আমি কি আর সেই নীহার আছি। বলতে বলতে মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, রিনি আর শ্যাম তাঁদের কাছাকাছি চলে এসেছে। পাশাপাশি ওরা হেঁটে আসছে, গায়ে গা লাগিয়ে যেন। নীহারের চোখ দুটি শান্ত, স্নিগ্ধ, কোমল হয়ে উঠল।

খুব আচমকা, নিজের প্রায় অজ্ঞাতেই, নীহারের গলা দিয়ে মৃদু শব্দের মতন একটি প্রসন্ন পরিতৃপ্ত স্বর শোনা গেল।

শরদিন্দু নীহারের মুখের দিকে তাকালেন।

রিনিরা কাছে এলে শরদিন্দু ছেলেকে বললেন, অন্ধকারে মাঠে তুমি ছোটাছুটি করছিলে কেন? কোথাও পড়ে গেলে আবার একটা ঝঞ্জাট হত। শরদিন্দুর গলার স্বর স্বাভাবিক নয়। সামান্য গম্ভীর।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *