ঝি-স্পেশাল
প্রথমেই দুঃখপ্রকাশ করছি প্রতিবেদনের এরকম একটা শিরোনাম বেছে নেওয়ার জন্য। কোনও পেশা সম্পর্কে ন্যূনতম অশ্রদ্ধা বা অসম্মানজনক মন্তব্য করার কিছুমাত্র ইচ্ছেও নেই মনের মধ্যে। কিন্তু প্রত্যেকদিন আমরা মানে কসবা, বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ, যাদবপুর, গড়িয়া যখন বিছানায় ঘুমে কাদা, সেই কাকভোরে সূর্যের আলো ঠিকঠাক ফোটার আগেই বেশ কয়েকটা ট্রেন ছাড়ে দক্ষিণ লাইনের ক্যানিং, ডায়মন্ড হারবার, লক্ষ্মীকান্তপুর— এইসব স্টেশনগুলো থেকে। স্থানীয় মানুষ তো বটেই, এ শহরের হাজার হাজার ফেলাটবাড়ির গিন্নিমারাও অনেকেই ওই নামে ডাকেন ট্রেনগুলোকে— ‘ঝি স্পেশাল’। এই ট্রেনগুলোই শহরে ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর জিয়নকাঠি। সংসার নামক দুই অথবা তিনজনের মাইক্রো ফ্যামিলিগুলোকে সচল রাখার জাদুদণ্ড। হাজার হাজার হাড়হাভাতে গরিবগুর্বো ঘরের মেয়ে বউদের প্রতিদিন বাঘাযতীন, গড়িয়া, যাদবপুর, ঢাকুরিয়া, বালিগঞ্জ, পার্কসার্কাস স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উগরে দেয় ডাউন ক্যানিং, লক্ষ্মীকান্তপুর, ডায়মন্ডহারবার লোকাল। এরা সবাই পরিচারিকা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঝাড়ু, পোঁছা, রান্নাবান্নার কাজ করেন শহরে পাঁচ বাবুর বাড়িতে। মোটামুটি সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটার মধ্যে কাজে লেগে পড়া। মাঝখানে সময় সুযোগ পেলে বসে বসেই একটু ঝিমিয়ে নেওয়া ফ্ল্যাটবাড়ির বেসমেন্ট অথবা দিদিমণিদের ড্রইংরুমের মেঝেয়। দুপুরে লাঞ্চ বলতে জোটে বাবুদের বাড়ির বাড়তি এবং বাসি এঁটোকাটা অথবা মোড়ের সস্তা দোকানের চা-লেড়ো বিস্কুট নইলে পেটা পরোটা, সঙ্গে ট্যালটেলে ঘুগনি নয়তো আলুর দম। অতঃপর ফের আড়াইটে থেকে সেকেন্ড শিফটের কাজ শুরু করে ফেরার ট্রেন ধরার জন্য মরণপণ দৌড় লাগাতে লাগাতে সেই সন্ধে ছটা-সাড়ে ছটা। ট্রেনে খিদে পেলে ‘মোস্ট পপুলার কুইজিন; ফেরিওয়ালার কাঁচা পাউরুটি আর স্যাকারিন মেশানো সোডাপানি— ‘ফটাস জল।’ বিক্রি হয় নামী পানীয় কোম্পানিগুলোর পুরনো, লেভেল চটে যাওয়া বোতলে ভরে। পাওয়া যায় একমাত্র সাউথ লাইনের ট্রেনেই। প্রতিবারই ওপেনার দিয়ে খোলার সময় ‘ফট’ করে ধানিপটকা ফাটার মতো আওয়াজ হয় একটা। আওয়াজ না হলে কাজের মাসিরা তো বটেই ঝাঁকামুটে, সবজিওয়ালা… কেউই খাবেন না। তাই শব্দটা হওয়া চাই-ই চাই। পাউরুটি-ফটাস জল ছাড়াও লোকাল ট্রেনের আরেকটা চালু এবং জনপ্রিয় খাবার মুড়ি-ঘুগনি। ঠোঙা অথবা থার্মোকলের বাটিতে মুড়ির ওপর একহাতা ঘুগনি ঢেলে নেড়েচেড়ে ছড়িয়ে দেওয়া পেঁয়াজ-লঙ্কাকুচি, সামান্য মশলা আর বিটনুন। সঙ্গে এক চামচ তেঁতুলজল। মুড়ি ঘুগনির ঘ্যাঁট, এটাই কাজের মাসিদের ‘হেভি টিফিন’, অনেক সময় রাতের ডিনারও বটে। ক্লান্ত শরীরে টলতে টলতে বাড়ি ফিরেও রেহাই নেই। ফেরামাত্র সংসারের চুলো জ্বালার উদোম হাড়ভাঙা খাটনি। সঙ্গে চোলাইয়ের ঠেক থেকে ফেরা মাতাল এবং বেশির ভাগ সময় বেকার অকর্মণ্য স্বামীর রামঠ্যাঙানি। এসব সামলে সুযোগ মিললে ঘণ্টা চার-পাঁচেক একটু চোখ বুজে নেওয়া। ফের ভোর থাকতে উঠে সেই ঝি-স্পেশাল ধরতে দৌড়োনো। সেই একই ক্লান্তিকর, একঘেয়ে রুটিন রোজ। দুগ্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, দোল, দেয়ালি, ইদ, বড়দিন, পরব, পার্বণ… কোনও ছুটিছাটা নেই। একমাত্র কঠিন অসুখবিসুখ ছাড়া। সেখানেও শত অভিযোগ ফেলাটবাড়ির বউদিমণিদের। নিশ্চয়ই অসুখের নাম করে ডুব মেরেছে। বাড়িতে বসে হাওয়া লাগাচ্ছে গায়। এবার মাইনে কাটতেই হবে। রোজ সন্ধের মুখে যদি যাদবপুর, ঢাকুরিয়া, বালিগঞ্জ স্টেশন রোডের মুখে দাঁড়ান, দেখতে পাবেন শয়ে শয়ে কাজের মেয়ে পিটি উষা বা পিঙ্কি হালদারের স্পিডে দৌড়োচ্ছেন ছটা পঁচিশের ক্যানিং বা সাতটা পাঁচের লক্ষ্মী (লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল) ধরতে। বাড়ি ফেরার সময় প্রচণ্ড তাড়া। কাজে আসার সময় গতিটা কিন্তু তুলনামূলকভাবে রিল্যাক্সড। চার-পাঁচজনের ছোট ছোট দল বেঁধে গল্পগাছা করতে করতে হেঁটে যাওয়া। হাসিঠাট্টা, নিন্দেমন্দ। গল্পের বিষয়ও একাধিক। বাবুদের বাড়ির হাঁড়ির খবর চালাচালি… ‘দাদাবাবু আপিস বেইরে গেলে দুপুরব্যালা অমুক বউদিমণির ঘরে ছোকরাপানা একটা লোক আসে।’… ‘কদিন আগে বউদি বাপের বাড়ি গেসলো সাতদিনের জন্য, দাদাবাবু ফেলাটে একা পেয়ে’… ‘ঘরের মানুষটা, মা-মেগোর ব্যাটা একদম হারামি। কাজকম্মো কিচ্ছুটি করে না। দিনরাত চুল্লু টেনে এসে টাকা চায়। না দিলে মেরে পাটপাট করে। নেতাই খুব ভাল। শ্যালদার ফুটপাতে সবজির ডালা লাগায়। একই টেরেনে আসে। বারবার বলেছে চলে আয় সনকা। ও সেগোমারানির ঘর আর করিস না। আমি তোকে রানি করে রাখব…কিন্তু কোলের দুটোকে ফেলে যাওয়া যাচ্ছে না…।’ ফ্ল্যাটবাড়ির দরজায় না এসে পড়া অবধি চলতেই থাকে এই সুখদুঃখের বারোমাস্যা। একটার পর একটা ফ্ল্যাটবাড়ি। একটু একটু করে ছোট হতে থাকে দলটা। একসময় আর কেউ নেই। সব ফেলাটবাড়ির গর্ভে। আর ফ্ল্যাটবাড়ি? সারাদিন ধরে সমস্তটুকু নিঙড়ে নিয়ে সন্ধের মুখে ছুড়ে ফেলে দেবে রাস্তায়। যাতে ভোরবেলার ঝি স্পেশালটা ঠিক টাইমে ধরতে পারে সনকারা।