ক্যাসিনো কলকাতা
মধ্য কলকাতার একটা সরু গলির মুখে একচিলতে দোকানে আধাখোলা ঝাঁপ। পঞ্চাশ পাওয়ারের টিমটিমে বালবের আলো জ্বলছে। কাঠের ছোট শোকেসের গায়ে হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছে সিড়িঙ্গে মতো একটা লোক। মাঝ ডিসেম্বরের হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে রাত সাড়ে এগারোটায় দোকানের বাইরে বিশ-পঁচিশজন। ফিসফাস, উৎকণ্ঠা, আলোচনা নিচুস্বরে, পৌনে বারোটা তো বাজতে চলল। খবর আসতে কত দেরি? ক্রিং ক্রিং…দূর থেকে সাইকেল ঘণ্টির আওয়াজ…ওয়ান টু সিক্স— নয়লা। বলতে বলতে পাস দিয়ে চলে গেল সাইকেল আরোহী। দোকানের মধ্যে ঝিমোতে থাকা সিড়িঙ্গে লোকটা মুহূর্তে গা ঝাড়া দিয়ে শোকেসের কাচ সরিয়ে বের করে আনল ছোট একটা শ্লেট। চক দিয়ে খসখস করে কিছু লিখে টাঙিয়ে দিল দোকানের বাইরে। তাতে লেখা— ১২৬/৯। বাইরে অপেক্ষমাণ জনতার প্রতিক্রিয়া এবার সরাসরি দ্বিধাবিভক্ত। একদল ‘বুকি’ নামক খলনায়কের পিতৃমাতৃকুল উদ্ধার করতে করতে পা বাড়াল বাড়ির দিকে। অপরদল রয়ে গেল ‘পেমেন্ট’ নামক ওয়েসিসের আশায়।
এই অবধি পড়ে যাদের ব্যাপারটা ধোঁয়াটেপানা লাগছে তাদের জন্য ঝেড়ে কাশি এবার। আসলে উপরোক্ত দৃশ্যাবলির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি শব্দ— ‘সাট্টা’। ষাটের মাঝামাঝি মুম্বাইয়ে শুরু হয় এই জুয়াখেলা, স্থানীয় নাম ‘মটকা’, পরবর্তীতে রতনলাল ক্ষেত্রী নামে অন্ধকার জগতের এক বাদশার হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে, সত্তরের দশকে, বাংলার জুয়ারসিক মহলে পরিচিত হয় ‘সাট্টা’ নামে। চল্লিশের দশকে আমেরিকান মাফিয়াদের আবিষ্কৃত ‘নাম্বার গেমের’ আদলে এই খেলা। তিনটি নম্বর— জুয়াড়িদের কোড ল্যাঙ্গুয়েজে ‘পাত্তি’, ‘পাত্তি’-র যোগফল কখনওই দুটি সংখ্যার বেশি হবে না। সবসময় শেষ নম্বরটি বাজি জেতার মাপকাঠি হিসেবে পরিগণিত হবে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ধরা যাক ‘পাত্তি’ হল ৪৫৯। এর যোগফল ১৮। শেষ সংখ্যা ৮ই এখানে জয়ের মাপকাঠি যা জুয়াড়িমহলে ‘সিঙ্গল’ নামে পরিচিত। আবার দোকানের গায়ে টাঙানো ১২৬-এর যোগফল ৯-এর বেশি হবে না কোনওমতেই। সেক্ষেত্রে কোনও ঝামেলাই নেই। ওই একটি নম্বরই ‘সিঙ্গল’ হিসেবে ধরা হবে। খেলা হবে দিনে দুবার। নো হলিডে। বিশাল একটি এলাকাভিত্তিক ভাবে যে পুরো ব্যাপারটা কন্ট্রোল করবে তার নাম ‘বুকি’, ‘বুকি’-র নীচে ‘এজেন্ট’। ছোট ছোট টুকরোয় ভাগ করা এলাকার দায়িত্বে। এদের নীচে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার পেনসিলার। পাড়ার মোড়ে বেঞ্চি অথবা ছোট পান বিড়ির দোকান এদের ‘অফিস’। গ্রাহকরা খেলতে আসবে পেনসিলারদের কাছে। মুম্বই থেকে রেজাল্টের খবর প্রথমে জানবে বুকি, টেলিফোনে। বুকি থেকে এজেন্ট। এজেন্টের ক্যুরিয়ার সাইকেলে ঘুরে ঘুরে খবরটা পৌঁছে দেবে পেনসিলারের দরজায় দরজায়। আশা করি এতক্ষণে দোকানে অর্ধেক ঝাঁপ ফেলে বসে থাকা সিড়িঙ্গে আর সাইকেল আরোহীর পরিচয়টা স্পষ্ট হয়ে গেছে পাঠকের কাছে। এবার আসি খেলার নিয়ম আর পেমেন্টের কথায়। ছোট ছোট লাল নীল রঙের পাতলা কাগজের প্যাডে লেখা হবে গ্রাহকের পছন্দের নম্বর। প্রতিটি পাতার তলায় লাগানো কার্বন পেপার। অরিজিনাল কপি দেওয়া হবে গ্রাহককে। রেজাল্ট বেরোলে প্যাডের কার্বন কপি মিলিয়ে টাকা দেওয়া হবে জয়ীদের। কেউ যদি একটি নম্বর বা সিঙ্গল-এর ওপর বাজি ধরেন এবং জেতেন তিনি পাবেন এক টাকায় ন টাকা। তিনটে নম্বর বা ‘পাত্তি’ মেলাতে পারলে একে একশো পঁচিশ। আর একদিনে খেলা দুটি ‘পাত্তি’র নম্বর একসঙ্গে মেলাতে পারলে জাস্ট ‘মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার’, মানে এক টাকায় আট হাজার টাকা। খেলার সময় রাত আটটা আর এগারোটা। মুম্বাই থেকে টেলিফোনে বুকি, এজেন্ট, ক্যুরিয়ার হয়ে পেনসিলার অবধি খবর পৌঁছোতে পৌঁছোতে যথাক্রমে নটা এবং বারোটা। প্রথম খেলা ‘ওপেন’ আর দ্বিতীয়টা ‘ক্লোজ’ নামে পরিচিত জুয়াড়িদের কাছে। প্রবল শীতের কামড় উপেক্ষা করে অত রাতে দোকানের সামনে অপেক্ষারত লোকজনের উদ্দেশ্যটাও আশাকরি পরিষ্কার এতক্ষণে। পরবর্তীতে মুম্বাইয়ের অনুকরণে মধ্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিট আর বড়বাজার অঞ্চল থেকে চালু হয় ‘কলাবাগান’, ‘ভূতনাথ’, ‘ফটাফট’ নামের সাট্টা। দিনে চার-পাঁচবার অবধি খেলা, একই সিস্টেমে। যদিও পেমেন্টের হার মুম্বাইয়ের তুলনায় অনেকটাই কম। কলকাতা জুড়ে সাট্টার ফলাও কারবার অনেকটাই ধাক্কা খায় তিরানব্বই সালে বউবাজার বোমার মামলায়। মধ্য কলকাতার সাট্টা তথা অপরাধ জগতের মুকুটহীন সম্রাট, ‘বুকি’ রশিদ খান ছিল বিস্ফোরণে ভেঙে পড়া বাড়িটার মালিক। অবধারিতভাবেই শ্রীঘরে যেতে হয় রশিদকে। বিস্ফোরণে শুধু বাড়ি বা একাধিক মানুষের প্রাণ নয় ভেঙে টুকরো হয়ে যায় শহরজোড়া রশিদের সাট্টা সাম্রাজ্য। এখনও বন্ডেল গেট আর আনোয়ার শা রোডের কয়েকটা জায়গায় লুকিয়ে চুরিয়ে চললেও সাট্টার সে বোলবোলা আর নেই। হুবহু সাট্টার অনুকরণে রীতিমতো সরকারি ট্যাক্স দিয়ে শুরু হয় ‘প্লে উইন’, ‘সুপার লোটো’, আরও সাতসতেরো নামের জুয়া, নব্বইয়ের শেষদিকে। কোনও পেনসিলার, বুকির প্রয়োজন নেই। একটা দোকান বা একফালি ঘরে সিকিওরিটি ডিপোজিট জমা করে যে-কেউ নিতে পারেন লাইসেন্সড সাট্টার এজেন্সি। সর্বনাশা সুপারলোটোর পাল্লায় পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যান বহু মানুষ, আত্মহননে বাধ্য হন অনেকে। অবশেষে দু’হাজার বারো সালে পরিবর্তনের পর সরকারি নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায় এই মারণখেল।
মাল কোম্পানিকা
একটা প্লাইউডের হালকা আর ছোট ফোল্ডিং টেবিল। ওপরে সাদা চাদর বিছানো, তিনটে ক্যারামবোর্ডের স্ট্রাইকার সরলরেখায় সাজানো। চালকের দক্ষ হাতের পরিচালনায় স্থান পরিবর্তন করছে ঘুঁটিগুলো, এদিক থেকে ওদিক। দুটো স্ট্রাইকার বিলকুল ফাঁকা। কেবলমাত্র একটা ঘুঁটির একদিকে গোলাপফুলের স্টিকার সাঁটানো। ঘুঁটি চালাচালি বন্ধ করে চালক যেইমাত্র হাঁক পাড়বে ‘লাগাও,’ ওমনি পছন্দের ঘুঁটির ওপর টাকা চেপে ধরবে জুয়াড়ির দল। ঘুঁটি উলটে যদি দেখা যায় গায়ে গোলাপ-স্টিকার সাঁটানো তা হলে লগ্নীকৃত টাকার পরিমাণের দ্বিগুণ ফেরত পাবে খেলুড়ে। ফাঁকা স্ট্রাইকারের ওপর বাজি ধরা টাকা ঢুকে যাবে চালকের পকেটে। ফুটপাথ ধরে চলেছেন। কমবেশি টাকাও রয়েছে পকেটে। এরকম দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে গেলেন। দাঁড়িয়েও পড়লেন কৌতূহলে। একটু দূর থেকে খেয়াল করলেন কিছুক্ষণ। টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু লোক। পছন্দের ঘুঁটির ওপর টাকা লাগাচ্ছে, জিতছেও। হাতের সঙ্গে সঙ্গে মুখও চলছে চালাকের… ‘লাগাইয়ে লাগাইয়ে…পাঁচ কা দশ, দশ কা বিশ, পচাশ কা শও… ঘুঁটি মে গুলাব তো মাল খিলাড়িকা…ঘুঁটি খালি তো মাল কোম্পানিকা…’ লোভ হল। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলেন টেবিলের দিকে এবং ফাঁসলেন। প্রথম অল্প টাকা লাগালেন ভয়ে ভয়ে— দশ। কী আশ্চর্য! আপনি জিতেছেন মানে গোলাপ লাগানো স্ট্রাইকারেই টাকা লাগিয়েছেন। আরও দু’-একবার এরকম হল। আপনার লোভও বাড়ল। পাশ থেকে অন্য খেলোয়াড়দের ক্রমাগত প্ররোচনা— ‘উফ্! কী লাক আপনার! আরে দাদা বড় অ্যামাউন্ট লাগান…মালামাল হয়ে যাবেন আজ…।’ সম্মোহিত আপনার পকেট থেকে বেরোতে লাগল পঞ্চাশ, একশো এমনকী পাঁচশোর নোট। ব্যস! এরপর আর মিনিট দশেকও লাগবে না ট্যাঁক ফাঁকা হতে। কুলকুলে ঘাম, পালস রেট বেড়ে গেছে কয়েকগুণ, ভিড় থেকে বেরিয়ে এলেন আপনি। দু’চোখে নির্বোধ চাহনি, ঠকে যাওয়ার কষ্ট। দুঃখ করবেন না। আসলে কখনওই জেতেননি আপনি। আপনাকে জিততে দেওয়া হয়েছিল। লোভ বাড়তেই বেশি করে টাকা লাগিয়েছেন। হেরে যাওয়া টাকা উদ্ধারের প্রচেষ্টায় আরও বেশি এবং নিপুণ হাত সাফাইয়ের খেলায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন মুহূর্তে। ওই যে আপনার পাশে দাঁড়িয়ে উত্সাহ প্রদানকারী খেলুড়ের দল? শতকরা নিরানব্বই ভাগই নিজেদের লোক। মানে একটা সংগঠিত জুয়া কাম প্রতারণা চক্রের হাতে এইমাত্র প্রতারিত হলেন আপনি। শহরের বুকে আরও দুটি কায়দায় চলে এই একই ধরনের লোকঠকানো খেলা। পরিবর্তন শুধু খেলার সামগ্রীতে। ঘুঁটির জায়গায় তাস অথবা চায়ের ভাঁড় আর লুডোর ছক্কা। মূলত সদর স্ট্রিটের মোড়, কলকাতা মিউজিয়ামের ফুটপাথ, কার্জন পার্ক থেকে হাওড়া ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় দেখা মিলতে পারে এদের। এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকে না। এক দেড়ঘণ্টা বাদে বাদেই হালকা ফোল্ডিং টেবিল গুটিয়ে হাওয়া হয়ে যায় সাত-আট জনের ‘কোম্পানি’।
লাল বাদাম সাদা বাদাম
খেলাটা চলে টেরিটি বাজার-চুনাগলি-কলুটোলা অঞ্চলে। মাছের বাজারের সাইজ ছোট একটা থলি নিয়ে দাঁড়িয়ে একজন। থলির মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিকের গুলি। লাল আর সাদা রঙের। কোড ল্যাঙ্গুয়েজে ‘বাদাম’, খেলার নিয়ম হল খেলোয়াড় ঝুলির মধ্যে হাত ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে ঝুলির মুখটা খেলোয়াড়ের কবজির ওপর চেপে ধরবে চালক। মুঠো ভর্তি করে ‘বাদাম’ বের করে আনবে খেলোয়াড়। মুঠোর মধ্যে লাল বাদামের সংখ্যা বেশি হলে জিত জুয়াড়ির। বিপরীত ফলাফলে লাভ চালকের। ‘বাদাম’ পিছু পয়সা অথবা টাকার বাজি ফেলে চলে এই খেলা। খেলা শুরুর আগে থলের মুখ খুলে নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে দেখানো হবে খেলোয়াড়কে। সাধারণ চোখে মনে হবে লাল বাদামের সংখ্যা অনেক বেশি। হাত ঢুকিয়ে থলের মুখ বন্ধ হওয়ার পর সূক্ষ্ম, প্রায় টের না পাওয়া একটা ঝাঁকুনি। হাত বের করে আনার পর মুঠো খুললে দেখা যাবে কোনও জাদুমন্ত্রবলে বেশির ভাগ লাল বাদামের রং সাদা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্যাঁকখালির জমিদার হয়ে স্থানত্যাগ করতে হবে জুয়াড়িকে। যেহেতু এই সব এলাকা পাইকারি বাজারের একটা বড় ঘাঁটি, ফলে কেনাকাটা করতে আসা ব্যবসায়ী আর বিবাদী বাগ থেকে বউবাজার দিয়ে এগারো নম্বর বাসে পায়ে হাঁটার কোডনেম শর্টকাট মারা শেয়ালদাগামী অফিসবাবুরা প্রায়ই এদের শিকার হন। পুজোর ঠিক আগের মাস পয়লায় এই বর্গীচক্রের পাল্লায় পড়ে সর্বস্বান্ত এক অফিসবাবুকে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে হাপুসনয়নে কাঁদতে দেখার দৃশ্যটা প্রতিবেদকের আজও মনে আছে।
কি অফ লাক
একটা সাদা বোর্ড, চওড়ায় ফুট দুয়েক। স্ট্যান্ডে হেলান দিয়ে ফুটপাথে দাঁড় করানো। বোর্ডের দু’প্রান্তে মারা দুটো পেরেকের গায়ে টান টান করে বাঁধা সরু গালভানাইজড তার। ডানদিকে পেরেকের ওপর আটকানো ছোট একটা টুনিবালব। বাঁদিকে তারের গায়ে ঝুলছে একটা চাবি। চাবির ফুটোটাকে তারের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে হবে বাঁদিক থেকে ডানদিকে। তার স্পর্শ না করে, চাবির অংশ তারকে স্পর্শ করলেই পিঁইই শব্দে জ্বলে উঠবে টুনি। তার মানে আপনি হারলেন। আবার চেষ্টা। আবার হার। আবার, আবার। আপনি তো ততক্ষণে রবার্ট ব্রুসের আত্মীয় হয়ে উঠেছেন। ব্রুস যুদ্ধটা শেষমেশ জিতেছিলেন। আপনি জিতবেন না। এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যেতে পারে। মেছুয়া, বড়বাজার অঞ্চলে সন্ধের মুখে চলে এই জুয়া। চালকের হাতে বাজির টাকা অ্যাডভান্স গুঁজে দিয়ে জিতলে ডাবল অ্যামাউন্ট অফ মানি রিটার্ন— এটাই খেলার নিয়ম। লাকট্রাই করবেন নাকি একবার?
শের-ফুল
জুয়া খেলার সহজতম পদ্ধতি। একটা পুরনো আমলের সিকি বা আধুলি। একপিঠে বাঘের ছবি। অন্যপিঠে ফুলের তলায় পয়সার সংখ্যা। ইভেন স্টেকে টস করে করে খেলে যেতে হয় ক্রমাগত যতক্ষণ না দু’জনের মধ্যে এক তরফের পকেট খালি হয়ে যায়। সংখ্যালঘু মহল্লা এবং চটকল শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। অপরিমিত মদ্যপানের পর রাত আটটা নাগাদ খেলতে বসে বারোটার মধ্যে বউ খুইয়ে ফেলার নজিরও রয়েছে জগদ্দলে।
খেলার আড়ালে
ক্লাবঘর অথবা ফুটপাতের ধারে টাঙানো ছাউনির নীচে ম্যাচবোর্ডের ওপর ঝুলন্ত ঢাকনা লাগানো বালব। পাকা হাতের মারে লাল সাদা কালো ঘুঁটিগুলো আশ্রয় নিচ্ছে গর্তের জালে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে এ তো সাধারণ ক্যারাম খেলা। কথাটা অনেকটা সত্যি হলেও পুরোটা নয়, বিশেষত পার্কসার্কাস-রাজাবাজার-মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে। সিঙ্গলস্ (একটি বোর্ডে দু’জন প্রতিযোগী) আর ডাবলস্ (এক বোর্ডে চারজন) সিস্টেমে রমরমা জুয়ার আসর বসে আপাত নিরীহদর্শন এই খেলার আড়ালে, প্রতি সন্ধ্যায়। মূলত বোর্ড পিছু বাজি ধরে চলে এই খেলা। আসর ভাঙতে ভাঙতে মধ্যরাত্রি, ফুটপাতের চক্রগুলো কন্ট্রোল করে অন্ধকার জগৎ থেকে অবসর নেওয়া মাঝবয়সি দাদারা। বোর্ড এবং খেলোয়াড় পিছু কমিশন বরাদ্দ থাকে দাদাদের জন্য। এটাকে তাদের রিটায়ারমেন্ট পেনশন স্কিম বলা চলে।
ভাগ্যের চাক্কাটা তো ঘুরছে…
প্লাস্টিকের নীল রঙের চাদরের ওপর আটটা খোপে আঁকা পশুপাখির ছবি। হাতি, বাঘ, পায়রা, ময়ূর…। পাশে ঘূর্ণায়মান বোর্ড। বোর্ডের গায়ে ওই একই ছবির হুবহু রেপ্লিকা। প্রতিটি ছবিকে ভাগ করা হয়েছে বোর্ডের কেন্দ্রবিন্দু থেকে শেষ পর্যন্ত আঁকা লাইনের সাহায্যে। লাইনগুলোর শেষপ্রান্তে মারা রয়েছে একটা করে ছোট পেরেক। বোর্ডের ঠিক পাশে একটা ছোট ডান্ডার গায়ে আটকানো জিভ ছোলা, প্লাস্টিকের খড়কে। অপর প্রান্তটা ছুঁয়ে গেছে পেরেকগুলোকে। ‘খেলা চালু’ বলে পরিচালক যেই বোর্ডটাকে ঘুরিয়ে দেবে ওমনি চাদরের গায়ে আঁকা খোপগুলোয় পছন্দের ছবিতে টাকা লাগাবে জুয়াড়িরা, বোর্ডের গতি কমার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই খড়কেটা আটকাবে পেরেকের সীমানা তোলা কোনও না কোনও ছবির খোপে। চাদরের গায়ে সেই একই ছবির ওপর টাকা লাগিয়েছে যে খেলোয়াড় সে পাবে লগ্নিকৃত অর্থের দ্বিগুণ। পরাজিতদের লাগানো টাকার ওপর হক পরিচালকের। এটাই খেলার প্রচলিত নিয়ম। তবে ছবির ক্ষেত্রে পশুপাখির জায়গা নিতে পারে ভগবান, নম্বর, মহাপুরুষদের ছবি। নলহাটি বাজারের সামনে বোর্ডের খোপে খোপে রামকৃষ্ণদেব, বাবা লোকনাথের ছবিও দেখেছিলাম বছর সাতেক আগে। সঠিক কারণ জানা নেই, তবে বছর দশেক হল কলকাতায় অনেকটাই কমে গেছে বোর্ডের জুয়ার দাপট। কিন্তু শহরতলি বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মেলাগুলোয় এখনও অবাধে ঘোরে ভাগ্যের চাকা।
তাসের দেশ
বব দাস, বিকে, ফৈয়াজ, গান্ধি…। নামগুলো চেনা? স্বাভাবিক উত্তর—‘না।’ পাঠকদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি এরা সব বিখ্যাত জুয়াড়ি। হাতের জাদুতে থুড়ি তাসের জাদুতে প্রায় হারতে বসা খেলাকে জিতে পালটে দিতে পারতেন। কলকাতার বুকে রাজত্ব করেছেন ষাট থেকে আশির দশক জুড়ে। শেষতক অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে অনেক ‘ফার’-এ এদের ঢোকা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ‘ফার’ শব্দটায় হোঁচট খেলেন তো? আসলে ‘ফার’ মানে পেশাদার জুয়ার আড্ডা যেখানে বোর্ডে টাকা ফেলে মোটা বাজির জুয়া খেলা হয়। গোটা কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে আছে এরকম একাধিক ‘ফার’। তাসের জুয়ার ধরন অনেক রকম। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘ফিশ’ ‘কল ব্রে’ ‘রামি’ আর টুয়েন্টি নাইন। কার্ডপিছু পয়সা বাজি রেখে খেলা হয় দুই পদ্ধতিতে— ‘সিন’ আর ‘ব্লাইন্ড’, ‘সিন’ মানে প্রতি দানের শেষে প্রতিযোগীরা হাতের তাস ‘শো’ করবে অর্থাৎ একে অপরকে দেখিয়ে দেবে এবং পয়েন্ট বা তাস পিছু বাজি ধরা পয়সার হাতবিনিময় ঘটবে, গায়ের প্রতিটি লোম দাঁড় করিয়ে দেবার মতো উত্তেজনাকর খেলা ‘ব্লাইন্ড’। দানের পর দান, চালের পর চাল কোনও প্রতিযোগী একে অপরের তাস দেখতে চাইবে না। বোর্ডের ওপর জমতে থাকবে টাকার পাহাড়। খেলা চলাকালীন যাদের কলজের জোর কম তারা ‘প্যাক’ বলে সরে যাবে। অনেক সময় এমনও দেখা যায় মাত্র দু’জন প্রতিযোগীই শেষ অবধি খেলায় টিকে আছে, অবশেষে কেউ একজন ‘শো’ মানে হাতের তাস দেখাতে বলবে, যার হাতে সেরা তাস সে-ই বাজি জিতবে আর বোর্ডের ওপর রাশিকৃত টাকা ঢুকে যাবে বিজেতার পকেটে। তাসের জুয়ায় সেরা প্রাপ্তি ‘তিন টেক্কা’ মানে ইংরেজি এ লেখা তিনটে তাস। যার হাতে থাকবে তার জয় নিশ্চিত। এ তো গেল বহু সময় ধরে চলতে থাকা খেলার কথা। খুব তাড়াতাড়ি একে অপরের টাকা পকেটে ঢোকাতে চাইলে ‘অন্দর বাহারের’ জুড়ি নেই। মূলত দু’জন প্রতিযোগী থাকে এই খেলায়। এক সেট তাস শ্যাফল করে এক প্রতিযোগী রেখে দেবে অপর জনের সামনে। সে তাসের বান্ডিলটাকে আধাআধি কেটে রেখে দেবে বাকি অর্ধেক বান্ডিলের নীচে। এরপর শুরু হবে বান্ডিল থেকে একটি করে তাস তুলে নেওয়া, যে প্রথম তাস শ্যাফল করেছিল তার তোলা তাস ‘অন্দর’। অপরজনের তোলা তাস ‘বাহার’। তাস পছন্দ করার অধিকার ‘বাহার’ওয়ালার। ধরা যাক সে কল করল ‘লালপান বিবি বাহার।’ এরপর থেকে যতক্ষণ না লালপান বিবি ‘অন্দর’ অথবা ‘বাহার’ না হবে ততক্ষণ খেলা চলবে। বোর্ডে রাখা থাকবে বাজি ফেলা টাকা। খেলা চলাকালীন উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে বাজি ধরা টাকার পরিমাণ বাড়তে পারে। একেকটি দান শেষ হতে মিনিট পনেরোর বেশি সময় লাগে না। খেলার নিয়ম নিয়ে আর বেশি জ্ঞান না ফলিয়ে আসুন এবার জুয়াড়ি আর ‘ফার’ মালিকদের প্রসঙ্গে আসি। এই পরিচ্ছেদের প্রথমেই যাদের নাম করেছিলাম তাদের মধ্যে গান্ধিদার হাতের কাজ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল একবার, পার্ক সার্কাস ট্রামডিপোর কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাটে। এক বান্ডিল তাস নিয়ে মিনিট তিনেক শ্যাফল করে (ফেটে) রেখে দিল আমাদের সামনে। হাতে তুলে নিয়ে দেখা গেল লাল আর কালো রঙের তাস জাস্ট আধাআধি ভাগ হয়ে গেছে। ফারের মধ্যে বিখ্যাত কালাবাবুর ফার, বেনিয়াপুকুর অঞ্চলে। লাখলাখ টাকার ডিল হত প্রতি রাতে। লগ্নিকৃত টাকাপিছু কমিশন বরাদ্দ কালাবাবুর জন্য। এই নিয়ম অবশ্য অন্য ফার মালিকদের জন্যও প্রযোজ্য। বহুদিন ধরে খেলতে আসা জুয়াড়িদের মধ্যে কেউ খেলতে বসে পুরো টাকা হেরে বসলেও টাকা ধার দেওয়ার রেওয়াজ আছে অনেক ফারে। আর একটি নামী ফার, পার্ক-সার্কাস-বালিগঞ্জ সীমানা সংলগ্ন অঞ্চলে। মালিকের নাম বি কে। সন্ধ্যাবেলা ফারের সামনে ফুটপাতে গাড়ি রেখে খেলতে বসে ভোরবেলা ট্যাক্সি খুইয়ে পথে নেমেছে গাড়ির মালিক, এ ঘটনাও ঘটেছে বি কে-র আড্ডায়। নব্বই দশকের মাঝামাঝি দুটি ফারই বন্ধ হয়ে গেলেও কলকাতা জুড়ে আজও রমরমিয়ে চলছে একাধিক জুয়ার ঠেক। এ ছাড়া বহু নামী-দামি ক্লাবেও প্রতিরাতে জমিয়ে বসে জুয়ার আসর। বিতর্ক বাড়বে তাই নামগুলো আর করলাম না এখানে।
কুইনালা— টানালা— জ্যাকপট
কথাগুলো বহুল প্রচলিত। রেসকোর্সে অর্থাৎ কলকাতায় ঘোড়দৌড়ের ময়দানে। প্রতি সপ্তাহে শনি ও রবিবার বসে এই দৌড়ের আসর। মাঝে মাঝে বুধবারেও হয়। তবে রেসের সেরা রেস ‘ডার্বি’, বছরে মাত্র একদিন। জানুয়ারি মাসের যে-কোনও সময়। সারা ভারতবর্ষ থেকে বাছা বাছা ঘোড়া আর তাদের জকিরা আসে ‘ডার্বি’-তে অংশ নিতে। চালকদের বলা হয় ‘জকি’। এ ছাড়াও ঘোড়ার দেখভালের দায়িত্ব ট্রেনারের। ঘোড়ার দৌড়ে বাজি ধরা হয় বিভিন্ন পদ্ধতিতে, ‘ফেভারিট’ মানে বংশানুক্রমিক ভাবে বনেদি ঘোড়ার পিছনে লগ্নি করা টাকায় জেতা অর্থের পরিমাণ কম। ধরা যাক দশ টাকায় পনেরো টাকা। ‘আপসেট’ বা অনামী ঘোড়ায় টাকা লাগিয়ে জিতলে লাভের অঙ্ক অনেকটাই বেশি। যে ঘোড়া যত কম ‘ফেভারিট’ হবে, জেতা অর্থের পরিমাণ তত বেশি হবে তার ক্ষেত্রে, সেটা দশ টাকায় দেড় লাখেও গিয়ে দাঁড়ায়। একটি মাত্র ঘোড়ায় বাজি ধরে জেতাকে বলে ‘সিঙ্গল উইন,’ একদিনে পরপর দুটো বাজি জেতার নাম ‘কুইনালা,’ টানা তিনটে—‘টানালা’। তবে সেরার সেরা ‘জ্যাকপট’। পরপর পাঁচটি জয়ী ঘোড়ার নাম অগ্রিম মিলিয়ে দিতে পারা বাজির নাম। জেতা টাকার পরিমাণও এতে অনেক বেশি। তার ওপরে সেগুলো যদি ‘আপসেট’ ঘোড়া হয় তা হলে তো কথাই নেই। শুধুমাত্র রেস নিয়ে লিখতে গেলে শ-খানেক পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যাবে। তারচেয়ে একটা ঘটনার কথা বলে রেসপর্ব শেষ করি।
যা একই সঙ্গে মজার এবং বেশিরভাগ দুঃখের। আমাদের বন্ধু সালাউদ্দিন, অগাধ ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলে। রেসের নেশা প্রবল। সঠিক সময়টা মনে নেই, মোটামুটি আশির দশকের মাঝামাঝি রয়্যাল চ্যালেঞ্জ নামে বিখ্যাত ঘোড়ার ওপর হাজার তিরিশেক বাজি ধরেছিল। প্রাণীটির ট্র্যাক রেকর্ড মারাত্মক— দেশের সব কটা ডার্বিতে জয়ী। রেস শুরু হওয়ার পর দেখা গেল ‘রয়্যাল চ্যালেঞ্জ’ দৌড়োচ্ছে রাজাবাজারের মোড়ে দাঁড়ানো ছ্যাঁকড়া গাড়ির ঘোড়ার চেয়েও ঢিমেতালে। ডেডলাস্ট, স্বাভাবিকভাবেই। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে গ্যালারিতেই মুখে গ্যাঁজলা তুলে অজ্ঞান সালাউদ্দিন। বাজি জেতার টাকায় আনন্দ করার বদলে বন্ধুকে নিয়ে ছুটতে হয় পি জি। হাসপাতালে দিন তিনেক কাটিয়ে বাড়ি ফেরে। মাঠমুখো আর হয়নি কোনওদিন।
দ্য এন্ড…
কথাটা বলার আগে জানিয়ে রাখি-আরও দু’-এক ধরনের জুয়া চলে এ শহরে। দিওয়ালির রাতে অবাঙালি শ্রেষ্ঠীদের তাসের বাজিতে কোটি কোটি টাকার পকেটবদল ঘটে যায় ঘণ্টা ছয়েকের মধ্যে। এ ছাড়াও আছে ‘হাউজি’, উচ্চবিত্ত মহিলারা এক-একটি নম্বর বা ঘরের ওপর টাকা লাগিয়ে খেলাটা খেলে থাকেন। তবে এগুলো এতটাই সাময়িক আর নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ যে এ নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে কলমের খাপ বন্ধ করলাম। ঠিক আছে?