১৫. কলকাতার পকেটাত্মীয়

কলকাতার পকেটাত্মীয়

অফিস টাইম। পিক্ আওয়ার। ভিড় বাসে উঠেছেন। বরাতজোরে একটা বসার জায়গা পেয়ে গেলেন। আপনার ভাগ্যকে আরও একটু সুপ্রসন্ন করে দু’-এক স্টপেজ পরে জানলার ধারে বসা যাত্রীটিও নেমে গেলেন। হোয়াট লাক!— আপনি জানলার ধারে। ফুরফুরে হাওয়া খেলছে। নিজেকে কেমন একটু রাজা রাজা মনে হচ্ছে না? মনে মনে ভাবছেন কার মুখ দেখে আজ উঠেছিলাম। হঠাৎই ছন্দপতন। বলা নেই কওয়া নেই একটা লোক হুড়মুড় করে জানলার সামনে ঝুঁকে পড়ে বিকট ওয়াক ওয়াক শব্দে বমি করার চেষ্টা করতে লাগল। নোংরা ক্ষয়াটে চেহারা। অপরিষ্কার জামাপ্যান্ট। হাতের পলিপ্যাক যেটা আপাতত আপনার মুখের সামনে দুলছে— সেটিও ততোধিক নোংরা। একটা চরম অস্বস্তিকর ঘেন্নাধরা পরিবেশ। আপনি চোখ-মুখ কুঁচকে, দমবন্ধ করে বসে রইলেন। লোকটা শেষ অবধি কিন্তু বমি করল না। মিনিট খানেকের ব্যাপার। স্বস্থানে ফিরে গিয়ে ওপরের হাতলটা ধরল। যেন শরীরটা খুব খারাপ লাগছে এমন ভাব দেখিয়ে পরের স্টপেজে নেমে গেল। যাক নিশ্চিন্তি। অতএব আবার কিছুক্ষণ নির্মল বায়ুসেবন ও পথিপার্শ্বের দৃশ্য অবলোকনের পর হঠাৎ বুক পকেটে হাত দিতেই বুক ধুকপুক ও রক্তচাপের মাত্রা একলাফে কয়েক গুণ বৃদ্ধি। কারণ পকেটের চলমান দূরভাষটি উধাও। ন্যাচারাল হিউম্যান রিয়্যাকশন অনুযায়ী অতঃপর হাঁচোড়-পাঁচোড় করে প্যান্টের সব পকেট দেখা। এমনকী যেখানে কোনওদিন মোবাইল রাখেন না সেই সাইড ব্যাগটাও তন্ন তন্ন করে চিরুনি তল্লাশি। যা যৌথবাহিনীকেও লজ্জা দেবে। নাঃ কোথাও নেই! অতএব কীরকম একটা ভ্যাবলা ভ্যাবলা হতভম্ব ভাব। প্রাথমিক ঝটকা কাটিয়ে ওঠার পর সহযাত্রীদের সোত্সুক প্রশ্নবাণ— ‘কখন টের পেলেন? কী খোয়া গেল? মোবাইল নতুন না পুরনো?’ আবার কারও কারও জ্ঞানগর্ভ উপদেশ কাম সতর্কবাণী— ‘একটু সাবধানে থাকবেন তো’; ‘এত বেখেয়াল হলে চলে’, ‘আরেকবার ভাল করে দেখুন।’ অতএব আর এক প্রস্থ খোঁজাখুঁজির পালা। কোনও সহৃদয় যাত্রী আপনার থেকে নম্বরটা জেনে নিয়ে ফোন করলে অবশ্যই ‘সুইচ অফ’— বামাকণ্ঠে এই মধুর বাক্যবন্ধটি শুনতে পাবেন। আমি বলি কী— আসলে বেকার এতক্ষণ খোঁজাখুঁজি করলেন। ওটা তো বুকপকেটেই ছিল। সেই বমি করতে চেয়ে জানলার ওপর ঝুঁকে পড়া লোকটাকে মনে আছে? আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার ছোট্ট যোগাযোগের মাধ্যমটি ওর হাত ধরেই নিরুদ্দেশের যাত্রী হয়ে গেছে। হায়রে! বকেয়া ডি. এ-র টাকাটা পেয়ে পুরনোটার সঙ্গে এক্সচেঞ্জ অফারে কিনেছিলেন। নোকিয়া টাচস্ক্রিন। সঙ্গে ব্লু-টুথ, রেকর্ডিং সিস্টেম, ফোর জিবি মেমরি, ফাইভ পিক্সেল ক্যামেরা, এফএম— সব সুবিধে এক সঙ্গে ঝাঁক বেঁধে সাইবেরিয়ার হাঁসের মতো উড়ে চলে গেল। বাসে কারও কারও উপদেশ মেনে নিকটবর্তী থানায় একটা মিসিং ডায়েরি করাতেই পারেন কিন্তু চান্স অফ রিকভারি টু-পার্সেন্টেরও কম। অতঃপর হে ভগ্ন মনোরথ সহনাগরিক, মনকে দৃঢ় করে গৃহে প্রত্যাবর্তন করুন। তোমার মতো আতাক্যালানে জীবনে আর দুটো দেখিনি, তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না— অর্ধাঙ্গিনীর মুখ থেকে উড়ে আসা অমোঘ সেইসব সেলফ গাইডেড বাক-মিসাইলের মুখে নীরব-নিরুত্তর থাকুন। কোনও প্ররোচনায় ভুল করেও পা দেবেন না। পানাহারে অল্পবিস্তর আসক্তি থাকলে দুটো-তিনটে পটিয়ালা পেগ ধীরে ধীরে পান করুন। চালিয়ে দিন রাশিদ খান অথবা চন্দ্রবিন্দু। তারপর একটু ঝিম ধরলে দেশ-আইন-প্রশাসন-দুর্নীতির মুন্ডুপাত করতে করতে এবং নতুন একটা সেট কেনার পরিকল্পনা নিতে নিতে শয্যাগমন করুন। ডিনারটা ভুলবেন না। আরে বাবা, শরীরটাকে তো রাখতে হবে।

দশাননের ছেলেপুলে

পটলডাঙার বিখ্যাত চাটুজ্জেদের রোয়াকে বসে টেনিদা ক্যাবলা, হাবুল আর প্যালাকে বলেছিল— ‘…জানিস তো, কলকাতা মানেই পকেটমারদের স্বর্গ। অনেক গুণী লোক তো আগে থেকেই ছিল, কিন্তু বছরখানেকের ভেতর দশানন তাদের সম্রাট হয়ে উঠল। তার উত্পাতে লোক পাগল হয়ে গেল। টালা থেকে টালিগঞ্জ আর শেয়ালদা থেকে শালকে পর্যন্ত, কারুর পকেটের টাকা-কড়ি কলম থেকে মায় সুপুরির কুচি কিংবা এলাচদানা পর্যন্ত বাদ যেত না।’ আপনার মুখের সামনে পলিব্যাগ লটকে রেখে আলতো টাচে বুক পকেট থেকে মোবাইলটা তুলে নিল দশাননেরই কোনও উত্তরসূরি। এবং মোটেই এ কথা ভাবার কোনও কারণ নেই যে এই কাজটা ও একাই করল। অন্তত দু’ থেকে তিনজন ওর সাপোর্টে ছিল। এই পুরো ব্যাপারটা একটা দুর্দান্ত টিম ওয়ার্ক। এখানে কোন কাজটা কে করবে, কার কী ভূমিকা খুব নির্দিষ্ট ভাবে ভাগ করা থাকে। সেই অনুযায়ী পদ ও পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়। যে মূল কাজটা করবে অর্থাৎ পকেট থেকে মালটা তুলে নেবে ওদের জগতে তার কোড নেম ‘মিস্তিরি’/‘কারিগর’। ‘মিস্তিরি’র পাশেই একজন দাঁড়িয়ে থাকবে। হাতসাফাই করামাত্র ‘মিস্তিরি’ যার হাতে মালটি পাচার করে দেবে এবং সবার আগে সেই অকুস্থল থেকে সরে পড়বে তার কোড নেম ‘সেয়ানা’, এবং যারা ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোককে চেপে অথবা ঘিরে ধরবে যাতে কর্মকাণ্ডটি চলার সময় মানুষটি বিশেষ নড়াচড়া না করতে পারে— তাদের আন্ডার ওয়ার্ল্ড-এর ভাষায় বলা হয় ‘টিংবাজ’/ ‘ঘেরা’/ ‘লেবার’। সিটে বসে থাকা লোকের পকেট থেকে কিছু তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘মিস্তিরি’ আর ‘সেয়ানার’ ভূমিকাই মুখ্য। যদিও ‘লেবার’-রাও গায়ে গায়ে লেগে থাকে প্রয়োজনে কাজে লাগার জন্য। সমস্ত কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হবার পর একে একে বাস থেকে নেমে পড়ে। একসঙ্গে কখনওই নয়। বাসের দুটো দরজা থাকলে আলাদা আলাদা ভাবে দুটি দরজাই ব্যবহার করে নামার সময়। খুব প্রয়োজন ছাড়া একে অপরের সঙ্গে কথা বলে না। বললেও খুব আস্তে। আসলে গ্যাং-এর এক সদস্যের সঙ্গে অপরের পরিচয়টা প্রকাশ্যে জানান না দেওয়াটাই মূল উদ্দেশ্য। এতে কাজের ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়, কারণ একই সঙ্গে একই ধরনের চেহারা এবং বেশভূষার লোকজন পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত— এই ব্যাপারটা মানুষের মনে সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে। যেটা দলের কাছে একান্তই অবাঞ্ছনীয়।

পদমর্যাদা

যে-কোনও পকেটমার গ্যাং-এই হায়ারারকির ব্যাপারটা কঠোর ভাবে পালন করা হয়। র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী নীচে সাজিয়ে দিলাম।

১. মিস্তিরি/কারিগর

২. সেয়ানা

৩. টিংবাজ/ঘেরা/লেবার

অপারেশনের টাকা ও অন্যান্য জিনিসের অর্থমূল্য পদমর্যাদা অনুযায়ী ভাগ বাঁটোয়ারা করা হয়। দক্ষতা অনুযায়ী একজন লেবারও ধাপে ধাপে মিস্তিরি পদমর্যাদায় উন্নীত হতে পারে।

কোসা নস্ত্রা

ইতালিয়ান মাফিয়াদের মধ্যে এক সময় এই কথাটি প্রচলিত ছিল। চল্লিশের দশকে ইতালির তত্কালীন শাসক বেনিতো মুসোলিনি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ব্যাপক দমন পীড়নের মুখে পড়ে মাফিয়াদের একটা বিশাল অংশ আমেরিকায় পালিয়ে আসে এবং শিকাগো, ক্যালিফোর্নিয়া, ম্যানহাটান, নিউইয়র্ক ইত্যাদি প্রদেশে তাদের অপরাধ সাম্রাজ্য বিস্তার করে। শিরোনামে উঠে আসতে থাকে একের পর এক অন্ধকার জগতের বেতাজ বাদশার নাম— আল কাপোন, লাকি লুসিয়ানো, ডাচ শুল্‌জ ইত্যাদি ইত্যাদি। সে কথা থাক, এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই মাফিয়ারা ‘কোসা নস্ত্রা’ শব্দটি ব্যবহার করত, আমেরিকাতেও। ‘কোসা নস্ত্রা’ মানে ইংরেজিতে ‘ইটস্ আওয়ার ম্যাটার’। সোজা বাংলায় যার মানে দাঁড়ায় ‘এটা আমাদের ব্যাপার’ বহির্জগতের প্রবেশ এখানে নিষেধ। আসলে সব অপরাধ জগতেরই একটা নিজস্ব ‘কোসা নস্ত্রা’ আছে। কলকাতার চোর-পকেটমারদেরও আছে। আলাদা জগৎ, আলাদা ভাষা। যেমন যে-কোনও তালা খোলার চাবির নাম ‘গামছা’। মহিলা যাত্রী— ‘তরকারি’, সোনার গয়না— ‘ছল্লি’ অথবা ‘পাক্কি’, ক্ষুর অথবা ব্লেড— ‘আস্তুরা’, মোবাইল ফোন— ‘বাচ্চা’। মানিব্যাগ— ‘কালা তাকিয়া’। একশো টাকার নোট— ‘গজ’। পাঁচশো টাকার নোট— ‘গান্ধি’, হাজার টাকার নোট— ‘লালপান’। এরকম আরও অজস্র কোড নেম। আমার সীমিত জ্ঞান অনুযায়ী তার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করলাম। এ ছাড়া ‘মিস্তিরি’— ‘সেয়ানা’— ‘লেবারদের’ সঙ্গে পাঠকরা ইতিমধ্যেই পরিচিত হয়েছেন। সুতরাং আসুন আমরা এই কোসা নস্ত্রার কোশাকুশি গুটিয়ে লক্ষ্মীপুজোর পুরোহিতের মতো অন্য গৃহে গমন করি।

বাদামি চিনির জ্বালা

কালো-কালো ক্ষয়াটে চেহারা। নোংরা জামাকাপড়। স্নান করে না। গায়ে অসম্ভব দুর্গন্ধ। এর মূল কারণ পকেটমারদের একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই পাতাখোর, মানে ড্রাগ অ্যাডিক্ট। নেশার মূল উপাদান হেরোইন বা ব্রাউন সুগার। এ ছাড়াও এদের মধ্যে কেউ কেউ কাশির সিরাপ যেমন কোডিন বা কোরেক্সের নেশায় অভ্যস্ত। আর আছে ফেভিকল/ডেনড্রাইট শোঁকা অথবা শিরায় মাদক-ওষুধ নেওয়া ‘মেনলাইনারের’ দল। ফলে খাবার জুটুক বা না জুটুক, কাজে বেরোতে ইচ্ছে করুক বা না করুক, নেশার বস্তু জোগাড় করতে ধান্দায় বেরোতে হবেই। পুলিশ খুব ঠেকায় না পড়লে এদের বড় একটা ঘাঁটাতে চায় না। কারণ এদের ধরলে থানার লক-আপে দিতে হবে। লক-আপে ভরে যদি নেশার জোগান না দেওয়া যায় তা হলে তীব্র চাহিদার তাড়নায় (যাকে ইংরেজিতে বলে ‘উইথড্রয়াল সিনড্রোম) গারদের দেওয়ালে বা রডে ঠুকে ঠুকে মাথা ফাটিয়ে ফেলবে। পুলিশ পড়বে উভয় সংকটে। ছেড়েও দিতে পারবে না। আবার লক-আপে কিছু একটা ঘটে গেলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো চ্যাঁচামেচি শুরু করবে। আইনরক্ষকদের যাকে বলে শাঁখের করাতের মতো অবস্থা। আসতেও কাটবে, যেতেও কাটবে। অথচ ষাট-সত্তর দশক অবধিও অবস্থাটা এরকম ছিল না। নেশার জগতে মাদক দ্রব্য তখনও দাঁত ফোটায়নি। তখন পকেটমারিটা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে ছিল। এইবার সেইরকম কিছু শিল্পীর কথা বলব।

শিল্পী

হাসমত চাচা, এক অসাধারণ শিল্পী। রোগা বেঁটে-খাটো চেহারা। এঁর জোড়া ‘মিস্তিরি’ তখনকার দিনে তামাম কলকাতায় খুব কমই ছিল। কোনও এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে ভুগে ওঁনার ছোটমেয়ে অকালে মারা যায়। ব্যস! চাচার ধারণা হয় ওঁর পাপের ফলেই প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান মারা গিয়েছে। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে টুপি পরে, দাড়ি রেখে, ওপরওয়ালার কাছে তওবা করে পাঁচ ওয়াক্তের নামাজি হয়ে যান। টুকটাক কাজকর্ম করে সংসার গুজরান করতেন। সর্বদা হাসিমুখ। একটু খাতির করে ডেকে বসিয়ে চা-রোল-বিস্কুট খাওয়ালে অসাধারণ সব পামিং বা হাতসাফাইয়ের খেলা দেখাতেন। এই হাতের তালুতে পয়সা রেখে মুঠো করলেন। মুঠো খুললে দেখা গেল হাত খালি। সেই পয়সাই অনায়াস দক্ষতায় বের করে আনলেন অপর একজনের কানের ফুটো বা নিজের জিভের তলা থেকে। এক কথায় যাকে বলে মেসমারাইজিং শো। সেই চাচাকে একবার তাঁর বিগত দিনের দক্ষতার কিছু ঝলক দেখানোর জন্য অজস্র অনুরোধ উপরোধে কিছুটা নিমরাজি হয়েই বাজার থেকে একটা লাউ কিনে আনতে বলেন। সঙ্গে আনতে বলেন একটুকরো পরিষ্কার পাতলা সাপি (ন্যাকড়া)। একটা ব্লেডকে আধটুকরো করে ভেঙে একটা অংশ মাঝখানের দু’ আঙুলের ফাঁকে রেখে ন্যাকড়াটাকে ভাল করে ভিজিয়ে নিয়ে টানটান করে লাগিয়ে দিলেন লাউয়ের ওপর। আধমিনিটের এক কনসেনট্রেশন ফেজ। এরপর হঠাৎই হাতের ব্লেড ঝলসে উঠল ন্যাকড়া থুড়ি লাউয়ের গায়ে। ন্যাকড়া সরিয়ে নেবার পর দেখা গেল সেটা আড়াআড়ি চিরে গেলেও লাউয়ের গায়ে আঁচড়টুকুও লাগেনি। মহামান্য পাঠক, একবার লাউটাকে মানবদেহ আর ন্যাকড়াকে প্যান্টের পকেট হিসেবে কল্পনা করার চেষ্টা করে দেখুন। দক্ষতার ব্যাপারটা আঁচ করতে পারবেন। আঙুলের নিয়ন্ত্রণের আর একটা খেলাও দেখিয়েছিলেন চাচা। প্রায় কানায় কানায় ভরতি একটা কাচের গ্লাসে সেকেন্ড তিনেকের গড় ব্যবধান রেখে পাঁচটা পুরনো আমলের তামার পয়সা একের পর এক ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ একটুও জল ওপচায়নি। শুধু বলতে চাননি ধরা পড়ে হাটুরে মার খেলে কীভাবে সহ্য করেন। শুধু বলেছিলেন মন্ত্র দিয়ে শরীর বাঁধা থাকে। মার খেলেও লাগে না। এর বেশি আর একটা কথাও চাচার পেট থেকে বের করা যায়নি। আর এক অসামান্য শিল্পীর কথা বলে এই পর্ব শেষ করব। জিম্বো। পার্ক সার্কাস চার নম্বর ব্রিজ টপকে এর আস্তানা ছিল। টকটকে গায়ের রং। ছ’ ফুটের কাছাকাছি হাইট। অসাধারণ রূপবান। ট্রাম-বাস ছাড়াও ওর আর একটা অপারেটিং জোন ছিল। নামজাদা প্রেক্ষাগৃহগুলিতে খ্যাতনামা শিল্পীদের গজল জাতীয় অনুষ্ঠান থাকলে নিজের সঙ্গে দু’-একজন বিশ্বস্ত অনুচরের জন্যও বেশি দামের টিকিট কাটত। এই ধরনের অনুষ্ঠানের দর্শক-শ্রোতা মূলত অবাঙালি বণিক শ্রেণি। মধ্যান্তরের সময় হলের ভিতরের ফুডস্টলগুলিতে ভিড় উপচে পড়ত। সবার মধ্যেই খাবার-কোল্ডড্রিংকস কেনার ব্যস্ততা। এই সুযোগটাই কাজে লাগাত জিম্বো। মিনিট দশেকের মধ্যে হাতের কাজ সেরে নিয়ে হল থেকে কেটে পড়ত। মধ্যান্তর পরবর্তী অনুষ্ঠান দেখেনি কোনওদিন।

হালচাল: আজকাল

এবার বঙ্কিমবাবুকে একটু ঘুরিয়ে কোট করি— ‘হায় শিল্প সত্যিই তোমার দিন গিয়াছে।’ কালের অতল গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছেন হাসমত চাচা বা জিম্বোর মতো অসাধারণ সব শিল্পীর দল। যাদের হাতের জাদুমাখানো আঙুলে ব্লেড-কাঁচি কথা বলত। এখন পকেটমারি ব্যাপারটা একদম গোদা হয়ে গিয়েছে। দল বেঁধে বাসে উঠছে। কন্ডাকটার ভয়ে কিছু বলছে না। কারণ দলের মধ্যে অন্তত দু’-তিনজনের পকেটে ক্ষুর রয়েছেই রয়েছে। জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ কে করবে? আগেকার দিনে ধরা পড়লে পকেটমাররা বেধড়ক মার খেত। দলের অন্যান্যরাই পাবলিকের মধ্যে ভিড়ে গিয়ে নিজের সঙ্গীকেই মারতে মারতে ছাড়িয়ে নিয়ে যেত। সেটাও ছিল একটা শিল্প। এখন সেসবের বলাই নেই। ধরা পড়লে অথবা কেউ বেশি বেগড়বাই করলে ক্ষুর খুলে চমকে দাও। তারপর হেলতে দুলতে বাস থেকে নেমে যাও। ভয়ডরের লেশমাত্র নেই। বাস থেকে নেমে স্টপেজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মেরে দেওয়া মোবাইল থেকে সিম খুলে ফেলছে দু’-তিনজনের তস্কর দল— এ দৃশ্য একটু সন্ধানী চোখ চালালেই হরবখত দেখতে পাওয়া যাবে বিশেষ কয়েকটি অঞ্চলের নির্দিষ্ট কিছু রুটে। এবার সেই রুটগুলোর কথাই বলব।

রঙরুট

শিরোনামটা লাগসই না হলেও চটকদারি ব্যবহারের লোভ সামলাতে পারলাম না। ভনিতা না করে প্রসঙ্গে ঢুকে পড়ি। সতর্ক থাকুন ট্রামে-বাসে-মিনিবাসে বিশেষ কিছু অঞ্চল বা রুট দিয়ে গাড়ি গেলে। নীচে তালিকা দিলাম।

যানের ধরনরুট
বাস/মিনিবাসহাওড়া স্টেশন থেকে ব্রেবোর্ন রোড ধরে পোদ্দার কোর্ট।
ট্রাম/বাস/মিনিবাসহাওড়া স্টেশন থেকে স্ট্র্যান্ড রোড ধরে কলেজ স্ট্রিট।
ট্রাম/বাস/মিনিবাসবালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে বেকবাগান সি আই টি রোড হয়ে মৌলালি।
ট্রাম/বাস/মিনিবাসবালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে নোনাপুকুর ট্রামডিপো হয়ে রিপন স্ট্রিট মোড়।
ট্রাম/মিনিবাসপার্ক সার্কাস চার নম্বর ব্রিজ এবং ট্রামডিপো থেকে ইলিয়ট রোড হয়ে হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়ার।
বাস/মিনিবাসতপসিয়া থেকে চার নম্বর ব্রিজ-নিউপার্ক স্ট্রিট-পার্ক সার্কাস ট্রামডিপো-সেভেন পয়েন্ট-মল্লিক বাজার হয়ে রিপন স্ট্রিট মোড়।
ট্রাম/বাস/মিনিবাসমেটিয়াবুরুজ থেকে খিদিরপুর হয়ে রেসকোর্স ধরে ধর্মতলা।
বাস/মিনিবাসবালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে ব্রড স্ট্রিট ধরে চার নম্বর ব্রিজ।
ট্রাম/বাস/মিনিবাসশিয়ালদা থেকে রাজাবাজার।
ট্রাম/বাস/মিনিবাসশিয়ালদা থেকে কলেজ স্ট্রিট মোড়।
বাস/মিনিবাসএক্সাইড মোড় থেকে এ জে পি বোস রোড হয়ে মল্লিক বাজার।
বাস/মিনিবাসএক্সাইড মোড় থেকে পার্ক সার্কাস সেভেন পয়েন্ট হয়ে চার নং ব্রিজ।

এ ছাড়াও সতর্ক থাকুন যে-কোনও লাইনের লোকাল ট্রেনে। কোনও কোনও লাইনে পকেটমারদের দাপট বাস ট্রামের চেয়ে বেশি।

অবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ

কী কী করবেন:• সঙ্গে বেশি টাকা থাকলে পকেটে না রেখে ব্যাগের ভেতরে কোনও কভারড ফাইল বা প্লাস্টিক ফোল্ডারে রাখুন। ভাল করে চেন আটকাতে ভুলবেন না।
 • বাস-ট্রামে ওঠার পরই মোবাইলটিকে হাতে রাখার চেষ্টা করুন।
 • যেরকম চেহারা বা বেশভূষার কথা আগে উল্লেখ করেছি সেরকম এক বা একাধিক লোকজনকে আশেপাশে দেখলে জায়গা পরিবর্তন করার চেষ্টা করুন অথবা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিন যে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি সবিশেষ সচেতন আছেন।
 • সব সময় বাসের মাঝখানে এবং ট্রামের প্রথম দিকে ড্রাইভারের কেবিনের কাছাকাছি দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন। যতই ভিড় থাক, প্রয়োজনে যথাসম্ভব ভিড় ঠেলে ভিতরের দিকে এগিয়ে যান। গেটের সামনে অতিরিক্ত মানুষের ভিড় পকেটমারদের পাতা ফাঁদ হতে পারে।
 • সোনার গয়না পরার অভ্যাস যথাসম্ভব বর্জন করুন। বিশেষত গলার হারের ক্ষেত্রে।
 • কন্ডাকটার বার বার করে ভিতরে ঢুকতে বললে অযথা বিরক্ত না হয়ে সেই অনুরোধকে মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন যে-কোনও যাত্রীবাহী যানের কন্ডাকটাররা পকেটমারের উপস্থিতি সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন থাকেন। সরাসরি সে কথা আপনাকে জানালে তাদের বিপদ হতে পারে। তাই এই অনুরোধ করে থাকেন। মেনে চললে লাভ বই লোকসান নেই।
কী কী করবেন না:• মোবাইল পকেটে রাখবেন না, বুকপকেটে তো কোনওমতেই নয়।
 • দরজার সামনে কখনওই দাঁড়াবেন না।
 • মনঃসংযোগ হারাবেন না। বন্ধুর সঙ্গে গল্পে মজে যাবেন না।
 • দলে ভারী না হলে, প্রবল জনসমর্থন জোগাড় না করতে পারলে অথবা নিজের শক্তি সম্পর্কে অগাধ আস্থা না থাকলে পকেটমারদের সঙ্গে অযথা সংঘাতে যাবেন না। মনে রাখবেন প্রতিটি দলে অন্তত দু’জনের পকেটে ক্ষুর থাকে। বিপদে পড়লে চালিয়ে দিতে দু’ সেকেন্ডও লাগবে না।

মোটামুটি এই কয়েকটি টিপ্‌স মেনে চললেই যে সবসময় লোকসান এড়ানো যাবে তার কোনও মানে নেই। তবে রিস্ক ফ্যাক্টর অনেকটাই নিম্নগামী হবে একথা বলাই যেতে পারে।

অর্ধেক আকাশ

‘যেখানে মেয়েরাও থাকবে ধরে পৃথিবীর অর্ধেক আকাশ’— আমার নয়, চেয়ারম্যান মাও-সে-তুং-এর কোটেশন। এই অমর উক্তি পকেটমার-জগতে সামগ্রিক না হলেও আংশিক সত্য। বিশেষ করে লোকাল ট্রেনে এরকম বেশ কয়েকজন মহিয়সী আছেন যাদের কথা একাধিকবার সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় সংগঠিত প্রমীলা বাহিনীগুলি কলকাতায় আসে পুজোর মাসখানেক আগে। পরিযায়ী পাখির মতো অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। সোনার দোকান-শাড়ি বিপণি-শপিংমল-রাস্তার ভিড়— কেনাকাটার হইহট্টগোল— প্রতিমা দর্শনের জনসমুদ্র সর্বত্র এদের অনায়াস এবং অমোঘ বিচরণ। প্রতিমা বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে এরাও কলকাতাকে বিসর্জন দিয়ে নিজভূমের উদ্দেশে রওনা দেয়। পড়ে থাকে মানিব্যাগ-মোবাইল-গয়না হারানো কিছু মানুষের হাহুতাশ আর অজানা পকেটাত্মীয়ের প্রতি অভিসম্পাত। শোনা কথা কলকাতা পুলিশের একটি বিশেষ অংশ এই তেলেগু বাহিনীর গতিবিধি বিশেষ নজরে রাখে, পুজোর সময়।

এবার তাহলে…

কী মুশকিল! কলম তো আর থামছে না। যত টানছি ততই বেড়ে যাচ্ছে। এবার দোকান গোটাই। আপনারা যারা এই ছাইপাঁশ পড়লেন তারা আবার পকেটাত্মীয়দের কাছে রসিয়ে রসিয়ে এসব গুহ্যকথা গাবিয়ে দেবেন না যেন। একটা মারও বাইরে পড়বে না। আমার কিন্তু বডি-ইনসিওরেন্স নেই। মনে রাখবেন কথাটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *