০৮. কলিকাতা খাইবার পাস-১

কলিকাতা খাইবার পাস-১

পুজো তো এসে গেল। হাতেগোনা আর মাত্র কয়েকদিন। মাসকয়েক আগে থেকেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে দণ্ডায়মান হোর্ডিং-ব্যানারে বড় বড় ক্লাবগুলোর থিম শোভিত জগজ্জননীর মুখ। এই ভ্যাপসা গরমেও ব্লেজার পরা সুদর্শনা ঘোষিকার মিষ্টি ঘোষণা, টিভিতে— আর মাত্র তেইশ দিন। মাঝে মাঝে জুম অথবা ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ইনকমপ্লিট মা দুর্গা, ঘর্মাক্ত কুমোর, কুমোরটুলি। আপনি চান বা না চান উপরোক্ত সব ঘটনাক্রম বা দৃশ্যাবলি আপনার ঘাড়ের নড়া ধরে মনে করিয়ে দেবেই, ‘আজি মেগাপূজা জাগ্রত দ্বারে।’

আপনারা যারা বহুকাল যাবৎ ধরেই নিয়েছেন যে, ‘ওফ! ক্যালকাটা ইজ নট আ ওয়ার্থ লিভিং প্লেস ডিউরিং পূজা টাইম’। অথবা যারা সাধারণত এ সময়টায় এই পোড়া শহরেই থাকেন অথচ এবারই এই বিপুল ভিড়ভাট্টা-ক্যাঁওম্যাও থেকে কেটে পড়ার ধান্দা করছেন, তাদের তো প্রস্তুতি সারা হয়ে গিয়েছে। অনলাইন বুকিং ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে ডুয়েল, ভ্রমণ-সংক্রান্ত যাবতীয় পত্রপত্রিকা চেটে ফেলা, কয়লাঘাটে দীর্ঘ লাইন, বুকিং অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, শেয়ালচোখো দালাল, হোটেল, রিসর্ট, হলিডে হোমের তত্ত্বতালাশ পুরী না লোলেগাঁও, আন্দামান না পাটায়া, মানালি থেকে অমৃতসর হয়ে ফেরার টিকিটটা কনফার্মড হবে কি হবে না— এই অজস্র শোয়েব আখতার মার্কা টেনশন-বাউন্সার সামলে আপনার নিট লাভ কিন্তু একটাই—জিরোতে প্যাভিলিয়ন অথবা দাদার লর্ডস মার্কা সেঞ্চুরি। অর্থাৎ টিকিট পাওয়ার তুরীয় আনন্দ নইলে অ্যালজোলাম হতাশা!

উপরোক্ত অনুচ্ছেদগুলি থেকে এই অধম লেখক কি এটা পাঠককুলকে বোঝাতে পারল যে, আপনি সপরিবারে আনন্দ ভ্রমণে যেতে পারুন বা নাই পারুন, প্রাক-উদ্বেগ বা পরবর্তী হতাশার ব্যাপারটাকে কিছুতেই এড়াতে পারবেন না। ঠিক এইখানে গরিব সৎ ব্রাহ্মণের সুপরামর্শ যদি নেন তা হলে একখান কথা বলি। না, না, আগেই ঠ্যাঙাতে উঠবেন না। অধমের কথাটা মন দিয়ে শুনুন। একটু অন্য ধরনের ভ্রমণ-কথা। খোদ কলকাতাতেই। এই ভ্রমণের একমাত্র শর্তই হল, পাঠক অথবা পরিযায়ীকে হতে হবে ভোজনরসিক (পেটুক নয়)। দ্বিতীয় একটি শর্তও অবশ্য আছে তবে সেটি ততটা কঠোর নয়। এই পরিব্রাজন পদব্রজে হলেই ভাল হয়। কারণ, এতে পরিপাক যন্ত্রটি সক্রিয় থাকবে। একান্তই অপারগ হলে গাড়িই ভরসা। আর খরচ! রোটাং পাস বা জয়সলমির তো দূরের কথা, দীঘা বা বকখালির চারভাগের একভাগে এঁটে যাবে। প্রতিবেদকের গ্যারান্টি!

অতএব হে মহামহিম পরিব্রাজকগণ— সপ্তমীর পুণ্যলগ্নেই শুরু হোক আপনাদের এই ভোজন পরিযায়। ধর্মতলা থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে হাতের বাঁদিকে গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনের গায়ে, নিরঞ্জন আগার। কাঠের টেবিল চেয়ার। কোণের দিকে আরেকটি ছোট টেবিলে ক্যাশবাক্স সমেত খোদ মালিক। পাশে খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে প্রায় পুরো রসুইঘরটাই দেখা যায়। কোনও রাখঢাক নেই। এদের সব পদই এক কথায় যাকে বলে মহাভারতের কথার মতো ‘অমৃতসমান’। তবে সেরার সেরা ভেজিটেবল চপ। হাতবোমার সাইজ। চামচে দিয়ে কেটে কাসুন্দি লাগিয়ে মুখে পুরলে মনে হবে এতদিন বিস্কুটের গুঁড়ো মাখানো আর ভিতরে লাল বিট-আলুর ঘ্যাঁটকে উপরোক্ত জিনিসটি ভেবে খেয়েছি বলে নিজের গালেই টেনে টেনে থাপ্পড় মারা দরকার। স্বাদগুণের বিশদ বিবরণে গেলাম না। স্ব-জিহ্বায় পরীক্ষা প্রার্থনীয়।

নিরঞ্জন আগারকে আলবিদা জানিয়ে এগিয়ে চলুন উত্তরমুখী। সোনাগাছিকে পাশ কাটিয়ে এসে পড়বেন যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ আর গ্রে স্ট্রিটের মোড়ে। মিত্র কাফে। ইতিহাস এখানে ফ্রিজড্ হয়ে গিয়েছে। একসঙ্গে বড়জোর কুড়ি-পঁচিশ জন বসতে পারে। খেতেই হবে এদের বিখ্যাত ব্রেইন চপ আর পুডিং। কয়েকশো মিটার দূরে উলটো ফুটে আরেক কিংবদন্তি—অ্যালেন রেস্তোরাঁ এবং এদের চিংড়ির কাটলেট। ভিতরে চিংড়ির ফিলে আর মোলায়েম ক্রিম-ব্যাটারে মাখামাখি। খাঁটি ঘিয়ের অ্যারোমা। দেখলে ছ’মাসের খিদে একদিনে পেয়ে যাবে।

অ্যালেন-মিত্র কাফের মায়া কাটিয়ে এবার ঢুকে পড়ুন শ্যামবাজার এভি স্কুলের পাশ ঘেঁষে শ্যামপুকুর স্ট্রিটের গলিতে। ‘চিত্তরঞ্জন’ কোথায়, যদি রাস্তার নেড়ি কুকুরটাকেও জিজ্ঞেস করেন দেখিয়ে দেবে। মোহনবাগান না ইস্টবেঙ্গল, উত্তম না সৌমিত্রর মতো উত্তর কলকাতাতেও বিতর্ক রয়েছে— চিত্তরঞ্জন না কেসি দাশ, কে নবীনচন্দ্রের আসল এবং সার্থক উত্তরসূরি। চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লা খেতে কেমন? দূর! আর এক কথা বারবার ঘ্যান ঘ্যান করতে ইচ্ছে করছে না।

গলি থেকে উত্তরমুখী হয়ে বেরিয়ে ভূপেন বোস অ্যাভিনিউ ধরে সোজা চলে আসুন শ্যামবাজার মোড়। নেতাজির ঘোড়ার ল্যাজ ঘেঁষে ল্যান্ড করুন বাগবাজার মোড়। হাতের বাঁদিকে অধুনা কলকাতায় প্রায় লুপ্ত হয়ে যাওয়া গাড়িবারান্দার নীচে দ্বারিক ঘোষ অ্যান্ড গ্র্যান্ড সন্স। এই দো-আঁশলা ‘ফিট হায় বস’ ‘বিন্দাস’ ‘ঝক্কাস’ সময়ে বাঙালি তো কতই রাম-লক্ষ্মণের লাড্ডু খেল। বলি, দরবেশ খেয়েছেন কখনও? আজকের প্রজন্মের অধিকাংশই এই মহার্ঘ বস্তুটির নামই জানে না, চেখে দেখা তো দূরস্থান। হলুদ সোনালি বোঁদের গোল্লার উপর ছড়ানো খোওয়া ক্ষীরের গুঁড়ো। হ্যাঁ মহাশয়— ইহাকেই, এই রঙিন সুন্দরীকেই দরবেশ বলিয়া ডাকা হয়। এরপরই রয়েছে কেসি দাশ। চিত্তরঞ্জনেই তো একবার রসগোল্লায় মজেছেন। আমি বলি কী, এখানে আপনার ফোকাস হোক রসমালাই। ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদু-বাস্তব কথাটা তো অনেক ক্ষেত্রেই শুনেছেন। শিল্পে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে। এবার রসনায় উপলব্ধি করুন। এরই ফাঁকে বাগবাজারের মোড়ের প্রবাদ হয়ে ওঠা তেলেভাজার দোকানগুলোয় মোচার চপ আর ছান্তাবড়ার সন্ধানে একবর অন্তত ঢুঁ মারতে ভুলবেন না।

এবার যে একটু পিছিয়ে আসার পালা। ফিরে আসুন শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে। যেমনভাবে ছাঙ্গু আর বাবামন্দির ঘুরে আবার ফিরে আসেন গ্যাংটক। পাঁচমাথার মোড় আর গোলবাড়ির কষা মাংস সমার্থক। একটু কালচে রঙের ঘন গ্রেভি। পরোটা সহযোগে, কুচোনো পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে এককথায় স্বর্গাদপী গরিয়সী!

উলটো ফুটেই হরিদাস মোদকের শতাব্দী প্রাচীন লুচি, কচুরির কুইজিন। খাবার ব্যবস্থা আছে কলাপাতায়। এখনও। সঙ্গে আলু, কুমড়োর ছক্কা বা ছোলার ডাল। অত্যুত্তম বললে কম বলা হয়। লুচি হোক বা কচুরি কোনটা কখন ভাজবে তার কোনও ঠিক নেই কিন্তু যেটাই ভাজবে সেটাই এক্সেলেন্সের চরম সীমা অতিক্রম করবে একথা বুক বাজিয়ে বলা যায়।

অতঃপর পরিযায়ীগণ, আমাদের যাত্রার পরবর্তী পর্যায় শুরু হোক বিধান সরণি ধরে গোলবাড়ির পাশ ঘেঁষে কলেজ স্ট্রিট অভিমুখে। পথিমধ্যে যে আরও মণি থুড়ি খাদ্যমাণিক্যের ভাণ্ডার সামনে পড়বে সে কথা বোধহয় এতক্ষণ বাদে আর না বললেও চলবে।

বিধান সরণি ধরে একটু এগোলেই বাঁদিকে ফড়িয়াপুকুর লেন। মিটার বিশেক ভিতরে ঢুকেই হাতের ডানদিকে সেন মহাশয়। এদের অলৌকিক সৃষ্টি কাঁঠাল সন্দেশ। কোনও কৃত্রিম গন্ধ নয়, আসল খাজা কাঁঠালের রস থেকেই তৈরি হয় ওই দেবভোগ্য মিষ্টি। ফলে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ বড়জোর আষাঢ়ের মাঝামাঝি অবধি পাওয়া যায়। পুজোর সময় পাওয়া না গেলেও হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই। বিকল্প হিসেবে রয়েছেন ক্ষীরের চপ, গোলাপ সন্দেশগণ। রূপে, স্বাদে, গন্ধে এরাও কিছু কম যান না।

এবার যাত্রাপথ কিঞ্চিৎ দীর্ঘ, যা থামবে গিয়ে বিডন স্ট্রিট সিমলে অঞ্চলে একেবারে হেদুয়ার সামনে। বেথুন স্কুলের গায়ে চার্চটির পাশের গলি ধরে মিনিট খানেক এগিয়ে গেলেই হাতের বাঁদিকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, আমাজন বা হিমালয়ের মতোই নকুড়চন্দ্র নন্দী। বর্তমানে হিলারি ক্লিন্টনের জন্য মিষ্টি পাঠানো বা ক্যাডবেরির সঙ্গে জোট বেঁধে ফিউশন জাতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা এই দোকানকে খবরের শিরোনামে নিয়ে এলেও আমি সাজেস্ট করব একবার ট্রাই করে দেখুন এদের ‘পারিজাত’ অথবা ছানার মুড়কি। মুখে মাথায় ঘোর লেগে যাবে।

গলি থেকে বেরিয়ে এসে ট্রামলাইন ধরে এগিয়ে বিবেকানন্দ রোডের মোড় আর চাচার হোটেল, সংক্ষেপে চাচা’স। বহু লোভনীয় সব আইটেম এদের মেনু কার্ডে। ‘অল টাইম প্রিমিয়াম’ কিন্তু ফাউল কাটলেট, যার ভক্ত ছিলেন বিবেকানন্দ থেকে উত্তমকুমার হয়ে শিব্রাম চক্রবর্তী। বর্তমানেও এই ভক্তসংখ্যা বেড়েই চলেছে বই কমেনি। তথাকথিত বিশ্বায়নের বাজারেও এরা প্রতিদিন রাত ন’টায় দোকান বন্ধ করেন নিয়ম করে। হিংস্র বাজারি প্রতিযোগিতার আঁচ এদের স্পর্শ করতে পারেনি।

পাঠককুল, এতক্ষণে আমরা এই ‘নাতিদীর্ঘ’ খাদ্যসরণির প্রায় মাঝপথে। এযাবৎ যা কিছু পেটে পড়েছে তার প্রায় সবটাই সলিড। এবার একটু জলবিহারে যাওয়া যাক। নোঙর ফেলা যাক কপিলাশ্রমের বন্দরে। নাম শুনে ঘাবড়ে যাবেন না। সত্যিই কোনও মা-বাবার আশ্রম নয়। শরবতের দোকান। বিধান সরণি-কৈলাস বোস স্ট্রিটের মোড়ে। দোকান না বলে উঁচুতে একচিলতে খুপরি জানালা বলাই ভাল। ভিতরটা প্রায়ান্ধকার। তার মধ্যে কোলকুঁজো হয়ে বসে অন্তত মাইনাস টেন পাওয়ারের চশমা পরিহিত একটি মানুষ সৃষ্টি করছেন আম, মালাই, আবার খাই নামের অসামান্য সব শরবত জাদু। অমৃত কখনও খাইনি। কিন্তু কপিলাশ্রমের শরবত খাওয়ার পর আধঘণ্টা মনে হতেই পারে চূড়ান্ত গরমেও সুইটজারল্যান্ড নিদেনপক্ষে লোনাভালা-খাণ্ডালায় পৌঁছে গিয়েছি। স্বাদ ও গন্ধের কথা তো বাদই দিলাম। খাওয়ার, থুড়ি পান করার ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে। গরমকালে যে-কোনও সময় কুড়ি-পঁচিশ জনের পিছনে লাইন দিতে হবে।

চরৈবতি, চরৈবতি গন্তব্যস্থল কলেজ স্ট্রিট মোড়। মোড়ের উপরই ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে দিলখুশা আর তাদের সৃষ্ট মটন কবিরাজি। এহেন ভয়ংকর সুস্বাদু এবং গুরুপাক খাবারের নাম কবিরাজি রাখা হয়েছিল কেন আমার জানা নেই (অমিতাভ মালাকার বা রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কাছে খোঁজ নিতে পারলে ভাল হত)। পঞ্চাশ থেকে নব্বই দশক অবধি দাপিয়ে রাজত্ব করেছে দিলখুশা। বর্তমানে শোনা যায় আগের রমরমা আর নেই। তবু একবার ঢুকুন। অর্ডার করুন কবিরাজি, চিকেন অথবা মটন। যা হোক কিছু একটা। ইতিহাসকে তো ছুঁয়ে আসা যাবে। দিলখুশার পাশে বইপাড়ার মধ্যে দিয়ে ঢুকে সোজা কফি হাউস। জানি না পুজোর সময় খোলা থাকে কি না। কারণ, ওই সময় কোনওদিন যাইনি। খোলা পেলে সোজা উঠে যান দোতলায়। একটু নিরিবিলি চাইলে তিনতলায়। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলে হৈ হট্টগোল আর সিগারেটের ধোঁয়াকে উপেক্ষা করুন বুদ্ধের ঔদার্যে। সবাই কফি হাউসের ‘ইনফিউসন’ আর ‘পাকোড়া, পাকোড়া’ করে হেদিয়ে মরেন। পরিযায়ীরা অর্ডার করুন চিকেন ওমলেট। ওপরটা মাখনে ভাজা হালকা ক্রিসপি, ভিতরে তুলতুলে, মোলায়েম, সুপক্ক কুসুমের মধ্যে আত্মগোপনকারী চিকেনের টুকরো। ধ্যাবড়া বড়ও না আবার একদম ছোটও না। সঠিক মাপে কাটা। স্যস মাখিয়ে, গোলমরিচ ছিটিয়ে কাঁটার ডগায় গেঁথে মুখে তোলার পর উপেক্ষা নয় বুদ্ধের ঔদার্যে হৈ হট্টগোলকে ক্ষমা করে দেবেন। আরেকটা কথা। কফি নেবেন না। তেষ্টা বাঁচিয়ে রাখুন ‘প্যারামাউন্টের’ জন্য।

প্যারামাউন্ট। আরেক শরবত বিপণি এবং কলকাতার পানপিপাসুদের (মদ নয়) কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক। এখানে অবশ্য খাওয়ার ব্যবস্থা বসে। শ্বেতপাথরের টেবিল। একেকটায় তিনজন-তিনজন করে ছ’জন বসতে পারেন। তাতেও গরমকালে লোকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খায়। আর শরবতই বা কতরকম— গ্রিন ম্যাঙ্গো, লিচি, অরেঞ্জ, ডাব (উপরে শাঁস ভাসানো), গ্রেপস ‘কিন্তু সবার চাইতে সেরা’ (কৃতজ্ঞতা সুকুমার রায়)— কোকো মালাই! কাজি নজরুল থেকে শুরু করে বড়ে গোলাম আলি সবাই এর দিওয়ানা ছিলেন। ক্যাশ কাউন্টারের ঠিক পাশে একটা বাঁধানো ফ্রেমে প্যারামাউন্টের শরবত গুণগ্রাহী সেলিব্রিটিদের নামের একটা লিস্ট টাঙানো আছে। চোখ বোলালে কপালে উঠে যাবে। পুজোর মধ্যে যদি খেয়ে নেওয়ার সুযোগ পান তা হলে বলতেই হবে আপনি সবিশেষ ভাগ্যবান। কারণ, নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি কলকাতার বুকে স্বর্গসুধা সঞ্চারকারী এই বিপণিটি বন্ধ হয়ে যায় প্রায় চার মাসের জন্য। খুলতে খুলতে মার্চ। এখানে একটা কথা বলা জরুরি। প্যারামাউন্টের পানীয় তৈরির মূল উপকরণ ডাবের জল।

এবার আমরা বিচিত্র খাদ্য-সরণির প্রায় শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি আর চারটি ‘লেজেন্ডারি ফুড শপ’-এর কথা বলেই দাঁড়ি টানব। নবকৃষ্ণ গুঁই, ভীমনাগ, পুঁটিরাম আর কালিকা। শেষ থেকেই শুরু করি, প্যারামাউন্ট থেকে বেরিয়েই মির্জাপুর স্ট্রিটের উপর লম্বা একফালি দোকান। এককোণে বিশাল কড়াইয়ে ক্রমাগত ভাজা হয়ে চলেছে আলুর চপ, পেঁয়াজি, মোচার চপ, ধোঁকা, ডিমের ডেভিল, মাটন চপ মায় ফিশ ফ্রাই। তবে যে জিনিসটির জন্য এদের খ্যাতি কলকাতা থুড়ি জগত্জোড়া তা হল বেগুনি। প্রায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাতের পাঞ্জার সাইজ! তেলালো শরীরে পোস্তর ছিটে। বিটনুন ছিটিয়ে একটা কামড় (অবশ্যই গরমটা সইয়ে নিয়ে)। ব্যস! স্বর্গের আগের স্টেশনে পৌঁছে যাবেন। এরপর চলে আসি পুঁটিরামে। এদের সব প্রিপারেশনই অসামান্য তবে খাস্তা নিমকিটা একবার খেয়ে দেখা অবশ্য কর্তব্য। বাড়ির বাচ্চাদের প্র্যাকটিস করান। নামী কোম্পানির পোট্যাটো চিপ্‌স ফেলে খাবে। কেসি দাশের স্পঞ্জ রসগোল্লাকে অনেকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেন। আমি এগিয়ে রাখব পুঁটিরামকে। বউবাজারের ভীম নাগকে নিয়ে এত কথা লেখালেখি হয়েছে যে, এদের জলভরা বা অন্যান্য মিষ্টি নিয়ে কথা বাড়ানো বেকার। শুধু দু’টি তথ্য দিয়ে রাখি যে, এদের দোকানের মিষ্টি বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখুজ্জের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। ইউনিভার্সিটি থেকে রোজ ভবানীপুরের বাড়িতে ফেরার পথে চ্যাঙাড়ি ভর্তি মিষ্টি কিনে জুড়িগাড়িতে বসে খেতে খেতে যেতেন। ওঁর নামে তো ভীম নাগ কর্তৃপক্ষ একটা মিষ্টির নামই রেখেছিলেন ‘আশুভোগ’। দু’নম্বর তথ্য— এদেরই আবিষ্কার লেডিকেনি। বড়লাট পত্নী ‘লেডি ক্যানিং’-এর নামে, পরবর্তীতে মানুষের মুখে মুখে পালটাতে পালটাতে অপভ্রংশ রূপ ধারণ করে লেডিকেনিতে পরিণত হয়েছে।

ভীমনাগের ঠিক পাশেই নবকৃষ্ণ গুঁই। তবে আদি দোকানটি উল্টোফুটে কয়েক পা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে হিদারাম ব্যানার্জি লেনে, গলির মধ্যে। নবকৃষ্ণের অতুলনীয় সৃষ্টি রাম বোঁদে। উপরটা শুকনো কুড়কুড়ে, ভিতরটা রসে টইটুম্বুর। একেকটার সাইজ মার্বেল গুলির মতো। একবার দাঁতে চাপলেই লাল-হলুদ ম্যাজিক। এর আরেকটি মহান সৃষ্টির কথা বলেই খাদ্যতীর্থ ভ্রমণ শেষ করব— ভিক্টোরিয়া সন্দেশ, সত্যিমিথ্যে জানি না, তবে লোকমুখে কথিত যে, মহারানি ভিক্টোরিয়া যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন, তাঁর সম্মানে এই মিষ্টির নামকরণ হয়। খেতে কেমন এটা বর্ণনা করার মতো কলমের জোর অথবা ধৃষ্টতা, কোনওটাই আমার নেই। শুধুমাত্র এটুকু বলতে পারি আজ অবধি যত ধরনের মিষ্টি খেয়েছি তার মধ্যে সেরার সেরা এটি।

তা হলে, খাদ্য পরিযায়ী থুড়ি রসনা পরিযায়ীদের পরিব্রাজন তো শেষ হল। এবার পথপ্রদর্শক-ছড়িদার-গাইডের তরফ থেকে কিছু টিপস যা আপনার এই পরিযায়কে আরও সুপরিকল্পিত, আনন্দময় এবং সহনীয় করে তুলবে।

টিপসগুলি এই প্রকার

• কখনওই একদিনে পুরো রুটটা কভার করার চেষ্টা করবেন না। পেট-পা গোটা শরীর কোনওটাই ধকল নিতে পারবে না। তার চেয়ে বরং সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিনে গড়ে চার-পাঁচ ঘণ্টার একেকটা স্পেলে গোটা ট্যুরটাকে ভেঙে দিন।

• উত্তর না দক্ষিণ—আপনি কোনদিকে থাকেন তার উপর নির্ভর করবে রুট এবং টাইম প্ল্যান, কাকে অগ্রাধিকার দেবেন এই পর্বে।

• পুরো ট্যুরটাকে দিনে দিনে সেরে ফেলার চেষ্টা করুন। সেরা সময় দুপুর বারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা।

• কোনটার পরে কোনটা খাবেন রুট-প্ল্যানের উপর চোখ বুলিয়ে আগে থেকে ঠিক করে নিন।

• প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার অর্ডার দিয়ে ফেললে ঘাবড়াবেন না। অতিরিক্ত খাবার প্যাক করে দিতে বলুন অথবা সঙ্গে রাখুন ক্যাসারোল। রাতে বন্ধুদের আড্ডায়, সুরাসঙ্গমে—অতিথি আপ্যায়নে জমে ক্ষীর হয়ে যাবে। শুধু মাইক্রোয় গরম করে নেওয়ার ওয়াস্তা। দুঃখের ব্যাপার, শরবতের ক্ষেত্রে এই ছকটা কাজ করবে না।

• প্রতিটি দলে অন্তত দশ-বারোজন খাদ্য পরিযায়ী থাকলে ভাল হয়। প্রয়োজন এবং চাহিদা অনুযায়ী ভাগ যোগ করে খাওয়া যাবে।

• পুজোর সময় বলেই বলছি। প্রতিটি দোকানেই ভিড় হবে। অপেক্ষা করতে হতে পারে। বিশেষত সন্ধের পর থেকে। তাই আবারও বলছি এই ভোজন ভ্রমণ শেষ করার চেষ্টা করুন দুপুর থেকে শুরু করে সন্ধের আগে। অবশ্য এসব অমৃতভোগের আস্বাদ পেতে একটু-আধটু অপেক্ষা করা যেতেই পারে।

• রাতের আড্ডায় বন্ধুমহলে শেয়ার করুন ভোজন পরিযায়ের সুখস্মৃতি। দল ভারী হবেই। নেক্সট ডে অর নেক্সট পুজো।

• পুজোর আগেই কোনও ছুটিছাটার দিন একটা ট্রায়াল রান দিয়ে নিন না, পরিবার-বন্ধুবান্ধব মিলে। একটা প্র্যাকটিক্যাল এক্সপিরিয়েন্স কাম প্ল্যান আগে থেকেই ছকা হয়ে থাকবে।

• মা বেনট্যাকেশ্বরী আর বাবা জেলুসিলনাথে অগাধ ভক্তি ও ভরসা রাখতে ভুলবেন না।

• বছরের অন্য সময়ও এই পরিযায় চলতেই পারে, বিশেষত বর্ষা থেকে গোটা শীত। কারণ বাঙালি তো শুধুই পুজোয় বেড়াতে যায় না। তবে শরবত সুধাপানের সেরা সময় কিন্তু গ্রীষ্মকাল।

• টিপসের সঙ্গে সঙ্গে গাইডের মজুরির ব্যাপারটা দয়া করে মাথায় রাখলে ভাল হয়।

এবার বলি, এই পরিযায়ের শেষে উপরি পাওনা বা ফাউ হিসেবে কী কী পাবেন। দেখে নিতে পারবেন বাগবাজার, কুমোরটুলি, সিমলা ব্যায়াম সমিতি, বিবেকানন্দ স্পোর্টিং, চালতাবাগান (লোহাপট্টি), শোভাবাজার রাজবাড়ির অসাধারণ সব পুজো। দিনের বেলাতেই। কারণ নাম কামানোর জন্য এদের আলোকসজ্জা বা থিমের প্রয়োজন হয় না। আর একটু বেশি উত্সাহী হলে মেন রোড ছেড়ে ঢুকে পড়তে পারেন গলিঘুঁজিগুলোতে, যেখানে ঊনবিংশ শতাব্দী এখনও থম মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাবু সভ্যতার আমলের বিশালাকৃতি ভগ্নপ্রায় প্রাসাদে, বিলুপ্তপ্রায় গাড়িবারান্দা—পায়রার ব্যোম-রকের আড্ডায়। বেঁচে রয়েছে নোনাধরা ইটের দেয়ালে, গঙ্গার জল আর কুচো চিংড়ি বয়ে নিয়ে আসা চৌবাচ্চার কলে, ছোট ছোট অজস্র তেলেভাজা-ফুলুরি-মালপোয়া-গুঁজিয়ার দোকানে, সন্ধেবেলা শাঁখের আওয়াজ আর বেলফুলওয়ালার ডাকে। বানিয়া আগ্রাসন, মল, মাল্টিপ্লেক্স, স্কাইস্ক্র্যাপার, সুপার মার্কেট, হাইরাইজের যৌথ অভিযান এদের ঘাড়ে ক্রমাগত দাঁত বসালেও একেবারে নিকেশ করে ফেলতে পারেনি। এখনও। তাই দেখে নিন, চেখে নিন এইসব প্রায় ডাইনোসর হয়ে যাওয়া উৎকর্ষতাকে। এই পুজোতেই। সময় থাকতে থাকতে। পরে পরে করলে দেরি হয়ে যেতে পারে।

এই লেখা যখন শেষ হল তখনই খবর পেলাম বাগবাজারে কে সি দাশের দোকানটা উঠে গেছে। হৃদয়বিদারক সন্দেহ নেই। কী আর করা যাবে। ধর্মতলার মোড়ের দোকানটি থেকে শুরু হোক আপনাদের মুসাফির-খানা। দ্বিতীয় তথ্য: প্যারামাউন্ট আজকাল বারোমাসই খোলা থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *