ক্রুসেড
ইতিহাসের দূর অতীত হতে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া লক্ষিত হয়, ক্রুসেড তারই মধ্যযুগীয় অধ্যায়। ট্রোজান ও পার্সীয়ান যুদ্ধগুলি ছিল সূচনা। পশ্চিম ইউরোপের এ যুগে এই সাম্রাজ্য বিস্তার তার আধুনিকতম পরিণতি।
আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বলা চলে যে, ৬৩২ সাল হতে মুসলিম এশিয়া সিরিয়া, এশিয়া মাইনর, স্পেন ও সিসিলী প্রভৃতি ভূভাগে যে আক্রমণমূলক সংগ্রাম পরিচালনা করে, ক্রুসেড তারই বিরুদ্ধে খৃস্টান ইউরোপের প্রতিক্রিয়া। ক্রুসেডের পরিপোষক আরো কতকগুলি পূর্ববর্তী কারণ ছিল; যেমন : টিউটনিক সম্প্রদায়গুলির যাযাবর জীবন ও সগ্রাম প্রবণতা; ইতিহাসে প্রথম আবির্ভাব কাল হতে এরা ইউরোপের মানচিত্র বদলিয়ে দেয়; ১০০৯ সালে একজন ফাতেমীয় খলীফা কর্তৃক বায়তুল মোকাদ্দেসের গীর্জা ধ্বংস;–এখানে হাজার হাজার ইউরোপীয় তীর্থে যেত এবং ৮০০ সালে এর চাবি বায়তুল মোকাদ্দেসের প্রধান পুরোহিত শার্লেমেনকে আশীর্বাদরূপে পাঠান; আর এশিয়া মাইনরের ভিতর দিয়ে যাওয়া কালে তীর্থযাত্রীদের প্রতি জুলুম। কিন্তু ক্রুসেডের আশু কারণ ছিল, বাইজেন্টাইন সম্রাট আলেকসিয়াস কমনেনাস-এর যুদ্ধ আবেদন। সালজুকদের দ্বারা তার এশিয়াস্থ মর্মরার উপকূল পর্যন্ত আক্রান্ত হয়। তারা কন্সটানটিনোপলের উপর পর্যন্ত হামলা করতে ব্ৰতী হয়। এই অবস্থায় সম্রাট ১০৯৫ সালে পোপ দ্বিতীয় আরবানের নিকট আবেদন করেন। মনে হয়, পোপ এই আবেদনের সুযোগ নিয়ে গ্রীক চার্চ ও রোমক চার্চের মধ্যে ঐক্যবিধানের আশা পোষণ করছিলেন; কারণ, উভয়ের ভিতরকার মতবাদমূলক বিভেদ ইতিপূর্বেই ১০০৯ ও ১০৫৪ সালের মাঝখানে দূরীভূত হয়েছিল।
১০৯৫ সালের ২৬ নভেম্বর পোপ আরবান দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের ক্লারমন্ট নামক স্থানে যে বক্তৃতা দেন, জগতের ইতিহাসে অমন কার্যকরী বক্তৃতা বোধহয় আর কেউ কখনো দেন নাই। তিনি ধার্মিকদের সম্বোধন করে পবিত্র জেরুজালেমের পথে অগ্রসর হয়ে সে স্থানকে পাপিষ্ঠ জাতির হাত হতে উদ্ধার করে নিজেদের অধীনে আনতে আহ্বান জানান। এ যুদ্ধ ঈশ্বর চান–এই ধ্বনি দেশের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ছোট বড় সবাইকে উন্মত্ত করে তোলে। পরবর্তী বছর বসন্তকালে দেড়লক্ষ লোক এ আবেদনে সাড়া দেয় এবং কন্সটানটিনোপলে একত্র হয়। এদের মধ্যে বেশীর ভাগই ছিল ফিরিঙ্গী (ফ্রাঙ্ক) ও নর্মান। এদের সবাই নিজ নিজ পোশাকে ক্রুস চিহ্ন বহন করত; তাই এদের অভিযানের নাম হয় ক্রুসেড। এইরূপে প্রথম ক্রুসেড শুরু হয়।
যারা ক্রুস বহন করে যাত্রা করে, তাদের সবাই যে ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অগ্রসর হয়, এমন নয়। বোহেমন্ড-এর মত কতিপয় নেতা নিজেদের জন্য ছোট খাটো রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিল। পিসা, ভেনিস ও জেনোয়ার সওদাগরগণ ব্যবসায়ের সুযোগ খুঁজতে বের হয়; দুঃসাহসী ও ধর্মোম্মাদগণ নতুন কর্মক্ষেত্রের অনুসন্ধানে গৃহ ত্যাগ করে এবং পাপীরা এই পথে প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। ফ্রান্স, লোরেইন, ইটালী এবং সিসিলীর দারিদ্র-পীড়িত জনসাধারণ ক্রুসেডে যাওয়াকে ত্যাগ স্বীকার মনে না করে বরং লাভজনকই মনে করত।
ক্রুসেডকে সাত হতে নয় সংখ্যায় বিভক্ত করার যে সনাতন নীতি চলে আসছে, তা সন্তোষজনক নয়। মোটের উপর এ ছিল এক অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ; কাজেই এদের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভেদ রেখা টানা কঠিন। তবে একে তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা চলে : প্রথম বিজয়ের যুগ (১১৪৪ সাল পর্যন্ত); দ্বিতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার যুগ এবং সালাহ্উদ্দীনের বিরাট বিজয়; তৃতীয়–ছোট ছোট ঘরোয়া যুদ্ধের যুগ (১২৯১ পর্যন্ত)–এ সময় তারা সিরিয়ার মূলভূমি হতে শেষ ঘাঁটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। বিজয়ের যুগ সম্পূর্ণরূপে তথাকথিত দ্বিতীয় ক্রুসেডের (১১৪৭–১১৪৯) আগে পড়ে এবং তৃতীয় যুগ মোটামুটি এয়োদশ শতাব্দীর সাথে মিলে যায়। এই শেষোক্ত যুগের একটি ক্রুসেড পরিচালিত হয় কন্সটানটিনোপলের বিরুদ্ধে (১২০২–১২০৪), দুইটি মিসরের বিরুদ্ধে (১২১৮–১২২১), একটি তিউনিসের বিরুদ্ধে (১২৭০)। এ সব অভিযান নিষ্ফল হয়।
প্রথম ক্রুসেডারগণ কন্সটানটিনোপল হতে এশিয়া মাইনরের পথে যাত্রা করে। ম্রাট আলেকসিয়াস অধিকাংশ ক্রুসেডীয় নেতার নিকট হতে তার প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। ক্রুসেডারগণ তাদের বিজয় পথে এশিয়া মাইনরের অর্ধভাগের উপর বাইজেন্টাইন প্রভুত্ব পুনঃস্থাপন করে এবং তুর্কদের ইউরোপ আক্রমণ সাড়ে তিনশ’ বছর পিছিয়ে দেয়।
১০৯৪ সালের মধ্যেই ক্রুসেডারগণ ইডেসা, টারসাস, এনটিওক এবং আলেপ্পা অধিকার করে। যে ‘পবিত্র বর্শা’ ক্রুসোপরি যীশুখৃস্টের দেহকে বিদ্ধ করে এবং যা বহু শতাব্দী পর্যন্ত এনটিওকের একটি গীর্জার তলে সমাহিত ছিল, ক্রুসেডারদের দ্বারা সেই বর্শা আবিষ্কৃত হওয়ায় তাদের উৎসাহ শতগুণে বেড়ে যায়। ১০৯৯ সালের ৭ জুন প্রায় বিশ হাজার নিয়মিত সৈন্যসহ চল্লিশ হাজার ক্রুসেডার জেরুজালেমের সম্মুখে গিয়ে হাজির হয়। এখানে মিসরীয় সৈন্য দলের সংখ্যা ছিল মাত্র এক হাজার। জেরিকোর দেয়াল যেমন ধ্বসে পড়েছিল, জেরুজালেম দেয়ালও তেমনি ধ্বসে পড়বে –এই ভরসায় ক্রুসেডাররা খালি পায় শিঙ্গা ধ্বনি করতে করতে চারপাশ ঘুরে আসে। ১৫ জুলাই আক্রমণকারীরা নগরে প্রবেশ করে এবং নর-নারী ও আবাল-বৃদ্ধ নির্বিশেষে নগরবাসিগণকে কতল করে। শহরের অলিতে-গলিতে ও ভ্রমণ স্থানে স্থূপীকৃতভাবে মানুষের মাথা, হাত ও পায়ের পাতা পড়ে থাকতে দেখা যায়। ক্রুসেডারদের অনেকে তাদের ব্রত সাধিত হয়েছে ভেবে জাহাজে চড়ে দেশে ফিরে যায়।
ফ্রান্সের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী কাউন্ট ছিলেন তোলোর রেমন্ড। তিনি ও বোহোন্ড, বলডুইন, গডফ্রে এবং ট্যানক্রেডের নেতৃত্বে ক্রুসেডাররা সিরিয়া ফিলিস্তিনে তিনটি ছোট ল্যাটিন রাজ্য স্থাপন করে এবং আরো রাজ্য স্থাপনে উদ্যোগী হয়। কিন্তু এসব রাজ্য বেশী দিন টিকে নাই। তাদের কলহ-কোন্দলের বিবরণ আরব ইতিহাসের অঙ্গ নয় ইউরোপীয় ইতিহাসের একটি অধ্যায়। তবে স্থানীয় লোক এবং ইউরোপীয় আগন্তুকদের মধ্যে যে শান্তি ও বন্ধুত্বময় সম্বন্ধ গড়ে ওঠে, তা উল্লেখযোগ্য।
খৃষ্টানরা পবিত্র ভূমিতে এই ধারণা নিয়ে আসে যে, তারা স্থানীয় লোকদের চেয়ে বহু গুণে উন্নত; স্থানীয় লোকেরা প্রতিমা পূজক, তারা হযরত মুহম্মদকে (সঃ) আল্লাহ, জ্ঞানে পূজা করে। প্রথম সাক্ষাতেই তাদের এ ভুল ভেঙ্গে যায়। খৃস্টানরা আরবদের মনে যে ধারণা রেখে আসে, তা একজন আরব ঐতিহাসিকের কথায় পাওয়া যায়? ইউরোপীয় লোকগুলি জন্তু; তবে তাদের সাহস ও লড়াইয়ের ক্ষমতা–এই দুই গুণ আছে; আর কিছুই নাই। স্থানীয় ও আগন্তুকদের মধ্যে যুদ্ধের চেয়ে শান্তির সময় দীর্ঘতর ছিল। এই সময়ে তারা বাধ্য হয়ে পাশাপাশি থাকে; কিন্তু এই বাধ্যতামূলক প্রতিবেশিত্বের ফলে তারা পয়গম্বরকে জানাবার সুযোগ পায়; ফলে তাদের পরস্পরের প্রতি আগের মনোভাব বহুলাংশে বদলে যায়। ক্রমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। ফিরিঙ্গীরা বিশ্বাসভাজন স্থানীয় লোককে ক্ষেত-খামারের কাজে নিযুক্ত করতে থাকে। তারা যে সামন্ততান্ত্রিক প্রথার প্রবর্তন করে, আস্তে আস্ত তা স্থানীয় ভূমি-ব্যবস্থায় স্থান করে নেয়। তারা তাদের সঙ্গে ঘোড়া, বাজ ও কুকুর নিয়ে যায়। অল্পকাল মধ্যেই চুক্তি হয়ে যায় যে, শিকারীদল আক্রমণের বিপদ হতে মুক্ত থাকবে। পথিক ও সওদাগরদের জন্য রক্ষী বদলা–বদলী হত এবং সাধারণতঃ উভয় পক্ষই সত্য রক্ষা করত। ফিরিঙ্গীরা ইউরোপীয় পোশাক ছেড়ে দিয়ে দেশীয় লোকের অধিকতর আরামজনক পোশাক গ্রহণ করে। খাওয়া-খাদ্য ব্যাপারে–বিশেষ করে চিনি ও মসলাযুক্ত খাদ্যের দিকে তাদের নতুন রুচি গড়ে ওঠে। প্রাচ্য ফ্যাশনের বড় বড় কোঠা ও প্রবহমান পানির উৎস-যুক্ত বাড়ীই তারা পছন্দ করতে শুরু করে। কেউ কেউ স্থানীয় লোকের মধ্যে বিয়ে-শাদী করে। এমন ঘরের ছেলে-মেয়েকে বলা হত ‘পুলেইন’-বকরীর বাচ্চা’ অথবা কেবল বাচ্চা। মুসলমান ও ইহুদী উভয়ে ভক্তি করে এমন কোন কোন তীর্থস্থানকে তারা ভক্তি করা আরম্ভ করে। তাদের মধ্যে কলহের অন্ত ছিল না। সে সব কলহে তারা কখনো কখনো বিধর্মীদের সাহায্য চাইত; মুসলমানরাও তাদের দুশমনের বিরুদ্ধে খৃস্টানদের সাহায্য চাইত।
খৃস্টানরা সিরিয়া এবং মিসরের অধিকাংশ স্থান জয় করে নেয়। মুসলিম জগতে ১১২৭ হতে এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। আর তারই ফলে রঙ্গমঞ্চের কেন্দ্রস্থলে আবির্ভূত হন এক অসাধারণ বীর পুরুষ সালাহ্উদ্দীন আল-মালিক আল-নাসির আস সুলতান সালাহউদ্দীন ইউসুফ। সিরিয়ার এক কুর্দ পরিবারে এর জন্ম হয় ১৯৬৯ সালে। ইনি মিসরের উজীরের পদে কাজ করেন। তারপর ইনি মিসর হতে শীয়া মতবাদ উৎসাদনে এবং ফিরিঙ্গীদের বিরুদ্ধে জেহাদে নিজকে উৎসর্গ করেন।
ছয়দিন অবরোধের পর ১১৮৭ সালের ১ জুলাই সালাহ্উদ্দীন টাইবেরিয়াস দখল করেন। এরপর এল সন্নিহিত হিট্টিনের লড়াই। এ লড়াই শুরু হয় শুক্রবারে; সালাহ্উদ্দীনের লড়াই শুরু করার এই-ই ছিল একটি প্রিয় দিন। আর ফিরিঙ্গীদের জন্য এ ছিল এক বিষাদময় দিন। তারা সংখ্যায় প্রায় বিশ হাজার ছিল; পিপাসায় কাতর অবস্থায় তারা প্রায় সকলেই দুশমনের হাতে বন্দী হয়। সম্ভ্রান্ত বন্দীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অভিজাত ছিলেন জেরুজালেমের রাজা গাই-ডি লুসিগনান। বীর সুলতান ক্ষুণ্ণ রাজাকে পরম সমাদরে গ্রহণ করেন; কিন্তু তার সঙ্গী চ্যাটিলনের রেজিনান্ডের জন্য অন্য ব্যবস্থা করা হয়। সমস্ত ল্যাটিন নেতার মধ্যে রেজিনাল্ডই বোধহয় সর্বাপেক্ষা দুঃসাহসী এবং সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিপরায়ণ ছিলেন। তিনি সবচেয়ে ভাল আরবী বলতে পারতেন। তিনি কারাক (ল্যাটিনে) ‘ক্রাক’ শহরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে একাধিকবার নিকটবর্তী পথে নিরীহ কাফেলা লুণ্ঠন করেন। তিনি একটি নৌবাহিনী নিয়ে হজযাত্রীদের উপর আক্রমণ দ্বারা হেজাজের পবিত্র উপকূলে উৎপাত করেন। সালাহ্উদ্দীন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি নিজ হাতে এই সন্ধি ভঙ্গকারীকে হত্যা করবেন। এইবার তার প্রতিজ্ঞা পূরণের সুযোগ আসে। আরবের মেহমানদারীর সনাতন রীতি অনুযায়ী কোন লোককে কিছু খেতে দিলে আর তার উপর অস্ত্র ধারণ করা চলে না। সেই সুযোগ নেওয়ার মতলবে রেজিনাল্ড সালাহউদ্দীনের তাঁবু হতে এক গেলাস পানি চেয়ে খান। কিন্তু এ পানি সালাহ্উদ্দিন নিজে খেতে দেন নাই; কাজেই দুইয়ের মধ্যে মেজবান ও মেহবান সম্বন্ধ স্থাপিত হতে পারে নাই। রেজিনাল্ডকে তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য জান দিতে হল। টেম্পলার ও হস্পিটালার নামীয় যোদ্ধাদের সবাইকে প্রকাশ্য স্থানে হত্যা করা হয়।
হিট্টিনের বিজয়ে ফিরিঙ্গীদের কপাল ভাঙ্গে। এক সপ্তাহের অবরোধের পর জেরুজালেম ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর আত্মসমর্পণ করে। আকসা মসজিদে খৃস্টানদের ঘণ্টা-ধ্বনির স্থলে মুয়াজ্জিনের আজান ধ্বনি শুরু হয় এবং প্রস্তর গম্বুজের উপর যে সোনার ক্রুস ছিল, সালাহউদ্দীনের সৈন্যরা তা ছিঁড়ে নামিয়ে আনে।
ল্যাটিন রাজ্যের রাজধানী দখল হওয়ায় সিরিয়া-ফিলিস্তিনের বেশীর ভাগ ফিরিঙ্গী শহরই সালাহ্উদ্দীনের হাতে আসে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত কয়েকটি অভিযানে তিন বাকী দুর্গগুলি দখল করে নেন। দেশ হতে ফিরিঙ্গীদের সমূলে উচ্ছন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। কয়েকটি ছোট ছোট শহর ও কেল্লাসহ কেবল এনটিয়ক, ত্রিপলী এবং টায়ার তাদের হাতে থাকে।
জেরুজালেমের পতন ইউরোপকে জাগিয়ে তোলে। রাজায় রাজায় কলহ তারা ভুলে যায়। জার্মানীর সম্রাট ফ্রেডারিক বারবারোসা, ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড কোর-ডি-লায়ন এবং ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্টাস ক্রুস ধারণ করে তলোয়ার খোলেন। পশ্চিম ইউরোপে এরাই ছিলেন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজ্যেশ্বর এবং এঁদেরই নিয়ে শুরু হয় তৃতীয় ক্রুসেড (১১৮৯ ১১৯২)। এঁদের সৈন্যসংখ্যা ছিল বিপুল। এ ক্রুসেডের ময়দানে একদিকে সালাহ্উদ্দীন, অন্যদিকে কোর-ডি-লায়ন (সিংহ-হৃদয়)-এই দুই দুর্দোণ্ডপ্রতাপ প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়ে প্রাচ্যে-পাশ্চাত্যে কত কাব্য কাহিনীই না রচিত হয়েছে।
ফ্রেডারিক সকলের আগে যাত্রা করেন ও স্থল পথে অগ্রসর হন; কিন্তু পথি মধ্যে সিসিলীর একটি নদী পার হওয়ার সময় ডুবে মারা যান। তাঁর অনুচরদের বেশীর ভাগই দেশে ফিরে যায়। যাওয়ার পথে রিচার্ড সাইপ্রাস অধিকার করেন। পরবর্তীকালে এই সাইপ্রাসই মূল-ভূমি হতে বিতাড়িত ক্রুসেডারদের শেষ আশ্রয় স্থল হয়ে দাঁড়ায়।
ইতিমধ্যে জেরুজালেমের ল্যাটিনরা সাব্যস্ত করে যে, তাদের হৃত রাজ্য উদ্ধার করতে একার চাবিকাঠির কাজ করতে পারে। সুতরাং, তাদের সমস্ত সৈন্য-বল একত্র করে তারা একারের পানে যাত্রা করে। ফ্রেডারিকের বাকী সৈন্য দল ও ফ্রান্সের রাজার কয়েক দল যোদ্ধা এসে এদের সঙ্গে যোগ দেয়। রাজা গুই সালাহ্উদ্দীনের হাতে বন্দী ছিলেন। তিনি আর কোনদিন সুলতানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবেন না এই শর্তে সুলতান তাকে কিছুকাল আগে মুক্তি দেন। সেই গুই এসে একার আক্রমণের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। আক্রান্ত নগর পুনরুদ্ধার করার জন্য পরদিনই সালাহ্উদ্দীন এসে হাজির হন ও দুশমনদের শিবিরের । অপর দিকে তাঁবু গাড়েন। জলে-স্থলে সংগ্রাম চলতে থাকে। রিচার্ডের আগমনে ক্রুসেডাররা উল্লসিত হয়ে ওঠে ও খুশীতে বাজী পোড়ায়। অবরোধকালে বহু চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটে এবং আরবী ও ল্যাটিন উভয় ভাষাতেই তার মনোরম বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়। সালাহ্উদ্দীন এবং রিচার্ডের মধ্যে উপহার আদান-প্রদানও চলে; তবে উভয়ের মধ্যে সাক্ষাৎ হয় নাই। শহরের দেয়াল হতে প্রত্যেক পাথর খুলে আনার জন্য রিচার্ড প্রচুর পুরস্কার ঘোষণা করেন। ফলে পুরুষ ও নারী অনেকেই অসাধারণ সাহসের পরিচয় দেয়। কেউ কেউ এই অবরোধকে মধ্যযুগের অন্যতম প্রধান সামরিক অভিযান বলে মনে করেন। দীর্ঘ দুই বছর পর্যন্ত অবরোধ চলতে থাকে–১১৮৯ সালের ২৭ আগস্ট হতে ১১৯১ সালের ১২ জুলাই পর্যন্ত। ফিরিঙ্গীদের সুবিধা ছিল, তাদের নৌ-বাহিনী আর অবরোধের আধুনিক যন্ত্রপাতি মুসলমানদের সুবিধা ছিল, তাদের এক নেতৃত্ব। শেষ পর্যন্ত কেল্লার পতন হয়।
দুটি শর্তে কেল্লা আত্মসমর্পণ করে? পয়লা শর্ত–২ লক্ষ দিনারের বদলে কেল্লার সমস্ত সৈন্যকে ছেড়ে দেওয়া হবে; দ্বিতীয় শর্ত-পবিত্র জুস খৃস্টানদের ফেরত দেওয়া হবে। এক মাসের মধ্যেও মুক্তি-মূল্য আদায় না হওয়ায় রিচার্ডের আদেশে সাতাইশ শ’ বন্দীকে হত্যা করা হয়। সালাহউদ্দীন যখন জেরুজালেম জয় করেন, তখন সেখানকার বন্দীদের প্রতি তার যে ব্যবহার, তার সঙ্গে রিচার্ডের এ নিষ্ঠুর ব্যবহারের কি শোচনীয় পার্থক্য! তিনিও বন্দীদের কাছে মুক্তি মূল্য চেয়েছিলেন। কয়েক হাজার গরীব তাদের মুক্তি-মূল্য দিতে অসমর্থ হয়। সালাহ্উদ্দীনের ভাইয়ের সুপারিশে তিনি এদের এক হাজার জনকে ছেড়ে দেন। প্রধান পুরোহিতের অনুরোধে আরো একদলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর সুলতান ভাবেন–ভাই আর পুরোহিত তো তাদের কর্তব্য পালন করলেন, এখন আমাকেও তো কিছু করতে হয়। তখন তিনি নারী ও শিশু-সহ বহু বন্দীকে বিনা মূল্যে আযাদী দিয়ে দেন।
জেরুজালেমের নেতৃত্ব এখন থেকে এস্তুকারে কেন্দ্রীভূত হয় এবং দুই প্রতিদ্বন্দী যোদ্ধাদলের মধ্যে শান্তির জন্য অনবরত প্রস্তাব চলতে থাকে। রিচার্ডের মন রোমাঞ্চকর কল্পনায় পরিপূর্ণ ছিল। তিনি সালাহ্উদ্দীনের ভাইয়ের সঙ্গে তার বোনের বিয়ের প্রস্তাব করলেন–তারপর বিয়ের যৌতুক স্বরূপ নব দম্পতিকে জেরুজালেম উপহার দানের কথা ঘোষণা করলেন। এইভাবে তিনি খৃষ্টান ও মুসলমানদের এ যুদ্ধ পরিসমাপ্তির পথ প্রশস্ত করতে চাইলেন। ১১৯২ সালের ২৯ মে তিনি তার ভাইয়ের ছেলেকে পরিপূর্ণ উৎসবের মধ্যে নাইটের মর্যদায় ভূষিত করেন। অবশেষে ১১৯২ সালের ২ ডিসেম্বর এই শর্তে সন্ধি স্থাপিত হয় যে, উপকূলের শহরগুলি ল্যাটিনদের হাতে থাকবে, আর ভিতরের সমস্ত এলাকা থাকবে মুসলমানদের হাতে এবং পবিত্র শহরের তীর্থযাত্রিগণের উপর কোন রকম জুলুম করা হবে না। সালাহউদ্দীন বেশীদিন এ শান্তি ভোগ করতে পারেন নাই। ১১৯৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী দামেস্কে তার জ্বর হয় এবং এর বারো দিন পর পঞ্চান্ন বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। উমাইয়া মসজিদের পার্শ্বে এক অনাড়ম্বর সমাধি শয্যায় তিনি ঘুমিয়ে আছেন। তিনি কেবল একজন যোদ্ধা ও সুন্নি আদর্শের পৃষ্ঠপোষক হিলেন না; তিনি আরো কিছু ছিলেন। তিনি বিদ্বানদের সাহায্য করেন, ধর্ম-শাস্ত্র অধ্যয়নে উৎসাহ দেন, অসংখ্য বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন, মাদ্রাসা ও মসজিদ তৈরী করেন। তার স্থাপত্য কীর্তির মধ্যে কায়রোর কেল্লা আজো টিকে আছে। ১৯৮৩ সালে তিনি এই কেল্লা ও শহরের দেয়াল নির্মাণ শুরু করেন এবং এ কাজে তিনি ছোট ছোট পিরামিডের পাথর ব্যবহার করেন। তাঁর স্বধর্মীদের মধ্যে হারুণ ও বায়বার্স-এর উপরে তার স্থান। ইউরোপের মধ্যে ইংল্যান্ডে তিনি চারণ ও ঔপন্যাসিকদের কল্পনা বিশেষভাবে উদ্দীপ্ত করেন এবং এখনো তাকে আদর্শ নাইট হিসেবে গণ্য করা হয়।
এরপর একশ বছর পর্যন্ত মাঝে মাঝেই লড়াই চলতে থাকে; কিন্তু তার ফলে কোন পক্ষেরই কোন সুনির্দিষ্ট লাভ হয় নাই। ল্যাটিনরা মোটামুটি তাদের অধিকার রক্ষা করে চলে। ইতিমধ্য ফ্রান্সের নবম লুই ও তার বীর যোদ্ধারা ষষ্ঠ ক্রুসেড শুরু করেন। ইতিহাসে এ রাজা সাধু লুই নামে বিখ্যাত। ইনি ১২৪৯ সালে মিসরের অন্তর্গত দিমিয়াত শহর দখল করেন। এরপর তার সৈন্যরা এক জলাভূমির ভিতর দিয়ে কায়রো অভিমুখে মার্চ করতে শুরু করে। তখন নীলনদে পূর্ণ বর্ষা; জলাভূমিতেও বহু আঁকাবাঁকা খাল ছিল। এই অবস্থায় লুইয়ের সৈন্যদলে বিষম মড়ক দেখা দেয়। সৈন্যদের যাতায়াতের পথ একদম বন্ধ করে দেওয়া হয়; সমস্ত সৈন্যদল ধ্বংস হয়ে যায়; রাজা লুই তার অধিকাংশ আমীর রইসসহ বন্দী হন। একমাস কারা? রে থাকার পর উপযুক্ত মুক্তি-মূল্য ও দিমিয়াত ফেরত দেবার শর্তে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ১২৭০ সালে লুই তিউনিসে আর একটি ক্রুসেডীয় বাহিনী নিয়ে অভিযান করেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ক্রুসেডকারী সমস্ত নেতার মধ্যে তার চরিত্র মহত্তম ছিল।
এই সময় মিসরের মামলুক দাস-বংশে বায়বার্স নামে এক অসম সাহসী যোদ্ধার আবির্ভাব হয়। তিনি ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত শাসক বংশ ক্রুসেডারদের উপর চরম আঘাত হানেন। ১২৬৩ সালে বায়বার্স করক অধিকার করে নাজারেথের গীর্জা ভূমিসাৎ করেন। তাঁর দুর্বার আক্রমণের ফলে সিজারীয়া, জাফফা ও এনটিয়কের পতন ঘটে। এনটিয়কের কেল্লায় ১৬ হাজার সৈন্য ছিল; তাদের হত্যা করা হয় এবং ১ লক্ষ নর-নারী বালক-বৃদ্ধকে বন্দী করে বাজারে গোলাম রূপে বিক্রি করা হয়। লুণ্ঠনের জিনিস ভাগ করার সময় মুদ্রা পেয়ালায় ওজন করা হয়। এ ক্ষয়-ক্ষতির ফলে এনটিয়ক আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে নাই।
বায়বার্সের উত্তরাধিকারীদের আমলে একার অবরুদ্ধ হয়; বিরানব্বইটি অবরোধ-স্তম্ভ হতে দুর্গ প্রকারের উপর প্রস্তর-বর্ষণ হতে থাকে এবং ১২৯১ সালে এর দেয়াল ভেঙ্গে ফেলা হয়। এর টেম্পলার রক্ষীরা নিহত হয়। মুসলিম বাহিনী সেই বছরই টায়ার, সিডন, বৈরুত এবং আন্তাতাস দখল করে। ক্রুসেডারগণ বিতাড়িত হয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এইরূপে সিরিয়ার ইতিহাসের একটি রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের অবসান ঘটে।
ক্রুসেড উপলক্ষে বহু রোমাঞ্চকর ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় এর ঐতিহাসিক মূল্য অতিরঞ্জিত হয়েছে। প্রাচ্যের তুলনায় পাশ্চাত্য জগত এর দ্বারা অনেক বেশী উপকৃত হয়; সাহিত্য ও বিজ্ঞানের চেয়ে চারু-কলা, শিল্প ও বাণিজ্য-সভ্যতার বিস্তার ঘটে। এরই সঙ্গে ক্রুসেডাররা সিরিয়ায় রেখে আসে নিরবচ্ছিন্ন ধ্বংসের লীলা এবং সমগ্র নিকট প্রাচ্যময় ছড়িয়ে আসে খৃষ্টান মুসলমানের মধ্যে এক বিষময় বিদ্বেষ। আজো সে বিদ্বেষের চিহ্ন মুছে যায় নাই।
ক্রুসেডের যুগের আগেই প্রাচ্যের মুসলিম তমদ্দুনে ভাটা শুরু হয়। দর্শন, চিকিৎসা, সঙ্গীত ও অন্যান্য অনুশীলনের ক্ষেত্রে জ্ঞানের মশাল তখন নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সিরিয়া ইসলাম ও পাশ্চাত্য খৃস্টান ধর্মের সাক্ষাৎকেন্দ্র ছিল। কিন্তু অতঃপর প্রধানতঃ প্রাচ্য ইসলামের সাংস্কৃতিক অবনতির জন্যই সিরিয়া আরব প্রভাব বিস্তারের কাজে স্পেন, সিসিলী, উত্তর সিসিলী, উত্তর আফ্রিকা, এমনকি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যেরও পেছনে পড়ে যায়। একথা সত্য যে, ক্রুসেডারদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ মারফত সিরিয়ায় ইসলাম পাশ্চাত্য খৃস্টান ধর্মের উপর প্রভাব বিস্তার করে; আর সেই প্রভাব সমগ্র পাশ্চাত্যের উপর আংশিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাণিজ্য-পথ ধরেও এ প্রভাব পাশ্চাত্যের বুকে অনুপ্রবিষ্ট হয়। তবে সিরিয়া ক্রুসেডারদের উপর যে আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করে, তা নগণ্য। অন্যদিকে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ক্রুসেডারদের সাংস্কৃতিক মান আক্রান্ত মুসলমানদের সাংস্কৃতিক মানের চেয়ে নিম্নতর ছিল। ক্রুসেডারদের মধ্যে বহু দেশের বহু রকমের মানুষ এসে এলোমেলোভাবে জমা হয়। তারা দেশের অভ্যন্তরে কেল্লায় কেল্লায় বাস করে ও প্রধানতঃ স্থানীয় কৃষক ও কারিগরদের সংস্রবে আসে; বুদ্ধিজীবীদের সাহচর্যে আসার সুযোগ তারা পায় না। এর উপর ছিল জাতি ও ধর্মগত কুসংস্কার; তার ফলে আক্রমণকারী ও আক্রান্ত জাতিসমূহের মধ্যে ভাবের যথেষ্ট আদান-প্রদান হতে পারে নাই। ফিরিঙ্গীদের পক্ষে সাহিত্য ও বিজ্ঞানে স্থানীয় লোকদের কিছুই শিক্ষা দিবার ছিল না। সমসাময়িক আরব ঐতিহাসিকরা ফিরিঙ্গীদের চিকিৎসা-জ্ঞান সম্বন্ধে হাস্যকর উপাখ্যান লিপিবদ্ধ করে; তারা বিদ্রুপের ভাষায় এ কথাও উল্লেখ করে যে, ‘ফিরিঙ্গীদের আইন-শাস্ত্র অদ্ভুত, তারা দ্বন্দ্বযুদ্ধ ও পানির সাহায্যে অপরাধ নির্ণয় করে।’
দ্বাদশ শতাব্দী হতে সমগ্র ইউরোপে আমরা মুসাফিরখানা ও হাসপাতাল বিশেষ করে কুষ্ঠাশ্ৰম স্থাপিত হচ্ছে দেখতে পাই। স্পষ্টতঃই নিয়মিত হাসপাতাল স্থাপন মুসলিম-প্রাচ্যের প্রভাবেরই ফল। মুসলমানদের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই ইউরোপে সরকারী গোসলখানা প্রবর্তিত হয়। এক সময়ে রোমকরা এ প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা এবং খৃস্টানরা বিরোধিতা করত।
সাহিত্য ক্রুসেড ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। পবিত্র মধ্যপাত্র বিষয়ক উপকথায় নিঃসন্দেহ রকমে সিরিয় উপাদান বিদ্যমান আছে। ক্রুসেডারগণ নিশ্চয়ই বিদপাই’ ও আরব উপন্যাসের কাহিনী শুনে তা তাদের দেশে নিয়ে যায়। চসারের ‘স্কোয়ারের কাহিনী’ আসলে আরব্য উপন্যাসের কাহিনী বিশেষ। বোকাশিয়ে মুখে মুখে প্রাচ্য কাহিনী শুনে তা তাঁর ‘ডেকামিরন” নামক গ্রন্থের শামিল করেন। আরবী ও অন্যান্য ইসলামী ভাষা অনুশীলনে উৎসাহ বৃদ্ধিও সেডারদেরই প্রভাবের ফল।
যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যাপারে ক্রুসেডের প্রভাব আরো সুস্পষ্ট। যুদ্ধে ঘোড়া, গায় ভারী জেরা ও বর্মের নীচে তুলার গদী ব্যবহার–এসব ক্রুসেডেরই প্রত্যক্ষ অবদান। সিরিয়ায় ফিরিঙ্গীরা যুদ্ধের বাজনায় মৃদঙ্গ ও দামামা ব্যবহার শুরু করে; আগে তারা কেবল শিঙ্গা ও তুর্য ব্যবহার করত। যুদ্ধের খবর আদান প্রদানের কাজে কবুতর ব্যবহার ক্রুসেডাররা আরবদের নিকট শিক্ষা করে। আরবদের নিকট হতেই তারা বিজয় উৎসবে আলোকসজ্জা ও টুনামেন্ট নামক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানের শিক্ষা গ্রহণ করে। প্রকৃতপক্ষে, শিভালরী প্রতিষ্ঠানের কোন কোন বৈশিষ্ট্য সিরিয়াতেই গড়ে ওঠে। মুসলিম-যোদ্ধাদের সংস্পর্শের ফলেই ইউরোপে সমরাস্ত্র ও অভিনব সামরিক পরিচ্ছেদের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয়।
ক্রুসেডাররা অবরোধ সংক্রান্ত কায়দা-কানুনের অনেক উন্নতি বিধান করে । নানা রকম বিস্ফোরক পদার্থের ব্যবহার তাদের দ্বারা প্রবর্তিত হয়। বারুদ চীন দেশে আবিষ্কৃত হয় বলেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। তবে সেখানে ইহা কেবল আগুন জ্বালানোর কাজেই ব্যবহৃত হতে থাকে। মঙ্গোলরা বারুদ চীন হতে নিয়ে ইউরোপে প্রবর্তন করে। বারুদের সাধারণ ব্যবহার হতে চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই ইউরোপে আগ্নেয়াস্ত্রের উদ্ভাবন হয়। ইউরোপ ভূখণ্ডে মার্ক নামক একজন গ্রীকের ১৩০০ সালের কাছাকাছি লিখিত একখানি গ্রন্থের পরিশিষ্টে সর্বপ্রথম বারুদ প্রস্তুত-প্রণালীর বর্ণনা পাওয়া যায়; বেকনের বারুদ তৈরীর বর্ণনা প্রক্ষিপ্ত ।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতের চেয়ে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য জগতে ক্রুসেড অধিকতর ফলপ্রসূ হয়। ক্রুসেডের মারফতই পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলিতে নতুন নতুন শস্য ও ফল গাছের আবাদ প্রসার লাভ করে। এ গুলির মধ্যে তিল, জোয়ার, ধান, লেবু, তরমুজ, খুবানী, গন্ধ-পিয়াজ প্রভৃতি অন্যতম। লেমন (লেবু) শব্দের মূল আরবী লেমুন’; শেলট অথবা স্কেলিয়ন (গন্ধ-পিয়াজ) শব্দের মূল মানে ছিল এস্কালনের পিয়াজ। এ শব্দের উদ্ভব স্থান ফিলিস্তিন। বহুকাল পর্যন্ত খুবানীকে দামেস্কের আলুবোখারা বলা হত।
সিরিয়ার বাজার গন্ধদ্রব্য, মসলা, মিঠাই এবং আরব ও ভারতের অন্যান্য উৎপন্ন দ্রব্যে ভরপুর থাকত। প্রাচ্য দেশে অবস্থানকালে ফিরিঙ্গীরা এইসব দ্রব্যের অনুরক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে তাদের এই রুচি ইটালী ও ভূমধ্যসাগরীয় শহরগুলির বাণিজের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আরবের ধূপ-ধুনা, দামেস্কের গোলাব, গন্ধ-দ্রব্য বহু রকমের সুগন্ধ তেল এবং পারস্যের আতর সকলের প্রিয় হয়ে ওঠে। ফিটকিরির সঙ্গেও এই সময় পাশ্চাত্য-জগত পরিচিত হয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে লবণ ও গোল মরিচ জাতীয় সুগন্ধি মসলা প্রবর্তিত হয়। এই সময় হতে পাশ্চাত্য জগতে মসলাওয়ালা রান্না ছাড়া ভোজনের কোন আয়োজনই পূর্ণ বিবেচিত হত না।
ক্রুসেডাররা তাদের রান্নায় আদা (জিঞ্জার–আরবী শব্দ) খেতে শিখে মিসরে। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ছিল চিনি (সুগার–আরবী শাককর) খাওয়া শিক্ষা। এ যাবতকাল পর্যন্ত ইউরোপীয়রা তাদের খাদ্যবস্তু মিষ্টি করার জন্য মধু ব্যবহার করত। লেবানন ও সিরিয়ার উপকূলবর্তী স্থানে এখনো বালক বালিকাদের আখ চিবাতে দেখা যায়। এইখানেই ক্রুসেডাররা আখের সঙ্গে পরিচিত হয়। তারপর হতেই আখ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় কি গুরুত্ত্বপূর্ণ স্থানই না অধিকার করে আসছে। পাশ্চাত্য জগতে প্রবর্তিত বিলাস-দ্রব্যের মধ্যে চিনিই প্রথম এবং তারা আর কোন কিছু খেয়েই এত মজা পায় না। চিনির সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশে যায় শরবত, গোলাব পানি, নানারকম ফুল, সমস্ত রকম মিছরী (ক্যাভী–আরবী শব্দ হতে উদ্ভুত) এবং মিঠাই। মসলীন, দেমাস্ক, আতলাস ও সাটিন প্রভৃতি সূক্ষ্ম বস্ত্র যে আরব-প্রাচ্য হতে আমদানী হয়, এসবের নামেই তার পরিচয় মিলে।
প্রাচ্যের কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের জন্য ইউরোপীয় বাজারের সৃষ্টি এবং তীর্থযাত্রী ও ক্রুসেডারদের চলাচলের প্রয়োজনের তাগিদে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এত প্রসার লাভ করে যে, রোমক শাসনের পর অমন আর দেখা যায় নাই। সামুদ্রিক বন্দর হিসেবে এবং ঐশ্বর্যের দিক দিয়ে মার্সাই ইটালীর সিটি রিপাবলিকগুলির সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করে। নতুন পরিস্থিতির আর্থিক তাগিদে মুদ্রার ব্যাপকভাবে উৎপাদন ও দ্রুততর প্রবহনের প্রয়োজন হয়। এ কারণেই এরকম ক্রেডিট নোটের উদ্ভাবন হয়। জেনোয়া ও পিসায় ব্যাঙ্ক স্থাপিত হয় এবং লেভান্টে খোলা হয় তার শাখা। টেম্পলাররা হুণ্ডীর কারবার শুরু করে।
ক্রুসেড উপলক্ষে দ্রুত ও ব্যাপকতর জাহাজ-চলাচলের প্রয়োজন হতে কম্পাসের আবিষ্কার ঘটে। চুম্বক কাটার দিক নির্ণয়ক গুণ সম্বন্ধে বোধহয় প্রথম অবহিত হয় চীন দেশ। কিন্তু মুসলমানরা বহু আগে পারস্য উপসাগর ও দূর প্রাচ্যের সমুদ্রসমূহের মধ্যে বাণিজ্য করত এবং সেই সময়ই তারা জাহাজ চলাচলের ব্যাপারে চুম্বক কাটার যথাযথ প্রয়োেগ শুরু করে। তারপর তারা তাদের এই আবিষ্কার ইউরোপে পাঠিয়ে দেয়।
এই যুগে সামগ্রিকভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যে সংকোচন শুরু হয় আর মুসলিম মানসে স্থবিরতা দেখা দেয়। আর ঠিক এসময়ই আকস্মিকভাবে সম্প্রসারিত জগতের প্রতি ইউরোপীয়দের দৃষ্টি প্রসারিত হতে শুরু করে। মুসলমানদের এই সাম্রাজ্যের অবসানের আগে সিরীয়-মিসরীয় মামলুক বংশ তার পুনরুজ্জীবনের জন্য শেষ চেষ্টা করে।