জাতির জীবন
খলীফাদের বিচিত্র কার্যাবলী, শাসক-বংশের উত্থান ও পতনের জটিল রক্তাক্ত কাহিনী, ভণ্ড দাবীদারদের কিস্সা এবং সেনাপতি, উজীর ও রাজনৈতিক নেতাদের উত্থান ও পতনের বর্ণনা–এসবেই আরব ঐতিহাসিকদের মনোযোগ ও দরদ নিঃশেষ হয়ে গেছে। সাম্রাজ্যের জনগণের সামাজিক ও আর্থিক জীবনের কোন পর্যাপ্ত বিবরণ দেওয়ার অবকাশ তাঁদের ঘটে ওঠে নাই। তবে তাঁদের রচিত গ্রন্থে এখানে সেখানে দু’চারটি ঘটনার উল্লেখ মিলে। সাহিত্যিক কেতাবে এবং আজকের পরিবর্তন-বিমুখ মুসলিম-প্রাচ্যের সাধারণ জীবনের ঘটনাবলী হতে সে যুগের জনগণের জীবনের একটা খসড়া ছবি আঁকা যেতে পারে।
প্রাথমিক যুগের মুসলিম মহিলারা যেমন প্রচুর স্বাধীনতা ভোগ করত, নবম শতাব্দীর মহিলারাও তা-ই ভোগ করত; কিন্তু দশম শতাব্দীর শেষভাগে নারীর অবরোধ এবং নর নারীর মধ্যে পরিপূর্ণ বিভেদ-ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। আব্বাসীয় জামানার প্রথমভাগে আমরা দেখতে পাই, সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা কেবল যে সাম্রাজ্য পরিচালন ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন ও প্রভাব বিস্তার করছে, এমন নয়–আরব কুমারীরা লড়াইয়ে যাচ্ছে, সৈন্য পরিচালনা করছে, কবিতা লিখছে এবং পুরুষদের সঙ্গে সাহিত্য-সাধনায় প্রতিযোগিতায় নামছে; অথবা তাদের হাস্যালাপ, তাদের সঙ্গীত প্রতিভায় বা কণ্ঠস্বরে মজলিস মহফিলকে উজ্জীবিত করে তুলছে।
অবনতির যুগে উপপত্নী-সম্ভোগ অস্বাভাবিক রকমে বেড়ে ওঠে–যৌন পত্রিতার বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ে, বিলাস-ব্যসন মাত্রা অতিক্রম করে। তখন নারীর আসন নিতান্ত নিম্নস্তরে নেমে যায়। আরব্য উপন্যাসে এই নারীর সঙ্গেই আমাদের সাক্ষাৎ হয়। এ পুস্তকে দেখান হয়েছে যে, নারী সমস্ত ধূর্ততা ও ষড়যন্ত্রের প্রতিমূর্তি, সমস্ত হীনভাব ও হীন চিন্তার আকর।
মুসলিম জগতের প্রায় সর্বত্রই বিবাহ এক বড় কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়ে আসছে; অবিবাহিত থাকাকে বিশেষভাবে নিন্দা করা হয়েছে এবং সন্তানকে–বিশেষ করে পুরুষ সন্তানকে আল্লাহর দান বলে মনে করা হয়েছে। স্ত্রীর প্রথম কর্তব্য ছিল স্বামীর সেবা, সন্তান পালন এবং এরপর যদি সময় থাকে তবে সে চরকা কাটবে এবং কাপড় বুনবে।
এ যুগের কবিদের প্রণয়-সংক্রান্ত ভাষা হতে মনে হয়, প্রাথমিক যুগে নারী সৌন্দর্যের যে আদর্শ ছিল, এ যুগে তার বিশেষ পরিবর্তন ঘটে নাই। নারীর দৈহিক উচ্চতা বৃক্ষ-লতার মধ্যে বাঁশের মত হবে, তার মুখ হবে পুর্ণিমার চাঁদের মত গোলাকার, তার চুল হবে রাতের চেয়ে অন্ধকার, তার গাল হবে সাদা ও গোলাপী–তাতে থাকবে একটি তিল। তার চোখ হবে অত্যন্ত কালো এবং বন্য হরিণের চোখের মত ডাগর, তার চোখের পাতা হবে ঘুমলো, তার মুখ হবে ছোট, তাঁর দাঁত প্রবালের উপর বসানো মুক্তার মত হবে, তার বুক হবে ডালিমের মত, তার নিতম্ব হবে চওড়া এবং তার সরু আঙ্গুল লতিয়ে যাবে–আর সে আঙ্গুলের ডগা হবে মেহেদী রঞ্জিত।
মহিলাদের ফ্যাশান-সম্মত শিরস্ত্রাণ ছিল, মাথা-চোখা টুপী; টুপীর নিম্নভাগে একটি ছোট্ট বৃত্ত ছিল। কেউ কেউ হীরা-জহরতে এ বৃত্ত সাজিয়ে রাখত। নারীদের সজ্জিত হওয়ার অন্যান্য উপকরণের মধ্যে ছিল মল ও বালা। পুরুষদের পোশাক এখন যা আছে, তখন মোটামুটি তা-ই ছিল। লেবানন ও সিরিয়াতে প্রচীনেরা এখনো সেই পোশাকই পরিধান করে। সাধারণ শিরস্ত্রাণ ছিল কালো উঁচু চূড়া-যুক্ত পশমের টুপী। পোশাকের মধ্যে ছিল পারস্য ফ্যাশানের ঢিলা পাজামা, সার্ট, ফতুয়া, ছোট কোর্তা এবং জুব্বা’। এই আরবী শব্দটিকে আমরা দশম শতাব্দীতেও স্পেনীয় ভাষার অভিধানে দেখতে পাই; স্পেনীয় ভাষার মারফত এই শব্দ রোমান্স ভাষার বাকী শাখাগুলির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখান হতে ইংরেজী, ম্যানিক এবং জার্মান জাতীয় বিভিন্ন ভাষায় প্রবেশ করে।
বাড়ীর আসবাবপত্রের মধ্যে দিন ক্রমে সবচেয়ে বড় আসন দখল করে বসে। দিবান মানে কামরার তিন পাশ বরাবর প্রসারিত সোফা। উমাইয়াদের আমলেই চেয়ারের মত উঁচু আসনের প্রবর্তন হয়। কিন্তু মেঝের উপর পাতা ছোট চারকোণা মাদুরের উপর বিছানো গদীর চল রয়েই যায়। এ গদীর উপর একজন আরামের সঙ্গে আসন করে বসতে পারত। মাদুরের ইংরেজী প্রতিশব্দ ‘ম্যাট্রেস’ কথাটি আরবী মারাহ্ শব্দ হতে উদ্ভূত। হাতে বোনা গালিচায় মেঝে ঢাকা থাকত। পিতলের বড় গোলাকার খাঞ্চায় খানা সাজিয়ে তা দিবান কিংবা মেঝের গদীর সামনে একটি নিচু টেবিলের উপর রাখা হত। ধনীদের বাড়ীতে রূপার খাঞ্চা এবং আলুশ কাঠ, মতি বা কচ্ছপের খোলস খচিত-কাঠের টেবিল ব্যবহার করা হত। অমন টেবিল এখনো দামেস্কে তৈরি হয়ে থাকে। একদা যারা বিচ্ছা, গোবরে পোকা এবং বেজীকে অতি উপাদেয় খাদ্য মনে করত, ভাতকে বিবেচনা করত বিষাক্ত খাদ্য এবং রুটী পাতলা করে তার উপর লিখত–এই সময়ের মধ্যে তাদের খানার রুচি এত উন্নত হয়ে উঠেছিল যে, সভ্য জগতের অতি উপাদেয় খাদ্য ছাড়া আর কিছু তাদের মুখে ভালো লাগত না। তাদের খানার মধ্যে থাকত, মূল্যবান মিষ্টি ইত্যাদি ইরানী খানার বিভিন্ন দফা। তাদের মুরগীকে খাওয়ান হত জলপাই, দুধ, নারিকেল ইত্যাদি। গ্রীষ্মকালে বরফ দ্বারা ঘর ঠাণ্ডা রাখা হত। পান করার জন্য পরিবেশন করা হত মাদকতাহীন শরবত। পানিকে চিনি দিয়ে মিঠা ও গোলাব, কলা ইত্যাদির নির্যাস দিয়ে সুগন্ধ করে এই শরবত বানানো হত। পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে কফি প্রচলিত হয় নাই এবং আমেরিকা অধিকারের আগে তামাক অজানা ছিল। নবম কি দশম শতাব্দীর একজন গ্রন্থকার তার লিখিত একটি বইয়ে সে আমলের ভদ্রলোকের মেজাজ, আচার-ব্যবহার ও সংস্কৃতিবোধ সম্বন্ধে বর্ণনা দিয়ে গেছেন : ভদ্রলোকের ব্যবহার মোলায়েম, আত্মসম্মান-জ্ঞান পুরুষোচিত, আচার মার্জিত; সে হালকা তামাসা হতে বিরত থাকে, সৎলোকের সঙ্গ করে, একান্ত সত্যনিষ্ঠ, প্রতিজ্ঞা পালনে উদগ্রীব, অন্যের গোপন সত্য রক্ষা করে, অমলিন তালিহীন কাপড় পরে, খানার টেবিলে বসে ছোট ছোট লোকমা মুখে দেয়, কথা অল্প বলে, উচ্চস্বরে হাসে কম, তার খানা ধীরে চিবিয়ে খায়, আঙ্গুল চাটে না, পিয়াজ, রসুন খাওয়া পরহেজ করে, মুখ ধোয়ার কামরায়, গোসলখানায়, প্রকাশ্য সভায় এবং রাস্তাঘাটে খিলাল করা বন্ধ রাখে।
প্রাইভেট ও প্রকাশ্য উভয় অবস্থাতেই অনেক সময় মদ খাওয়া হত। আগানী ও আরব্য উপন্যাসের মত কেতাবে আমরা প্রমোদ-উৎসবের যে অসংখ্য কাহিনী দেখতে পাই এবং মদের প্রশংসায় যে অগণ্য কবিতা ও গান আছে, তাতে মনে হয় মদ খাওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও কার্যতঃ সে নিষেধ বড় কেউ মেনে চলত না। এমন কি খলীফা, উজীর, শাহজাদা এবং বিচারক কাজীরাও ধর্মীয় আদেশের দিকে ক্ৰক্ষেপ করত না। খেজুর হতে তৈরি ‘খমর’ প্রিয় পানীয় ছিল।
প্রমোদ উৎসবে কখনো কখনো মদের মহিমা-কীর্তনমূলক গান হত। এই সব মদের মজলিসে মেহমান ও মেজবান মেশক অথবা গোলাব পানিতে তাদের দাড়ি সুগন্ধ করত এবং উজ্জ্বল রঙ্গের খাস পোশাক পরত। সুগন্ধ কাঠ পুড়িয়ে কামরা সৌরভময় করা হত। অনেক কাহিনী থেকে প্রমাণিত হয় যে, এসব মজলিসের গায়িকারা প্রধানতঃ ছিল হয় বাদী, না হয় ভ্রষ্ট-চরিত্র নারী। যুগের তরুণদের নৈতিক চরিত্রের পক্ষে এরা ছিল মারাত্মক ভয়ের কারণ। জনসাধারণ খৃষ্টানদের মঠ অথবা ইহুদীদের পরিচালিত মদখানায় গিয়ে মদ খেতে পারত।
মহানবী বলেছেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ধর্মের অঙ্গ। এ কথা মুসলিম জগতের সবাই জানে। হযরত মুহম্মদের (সঃ) আগে আরবে কোন গোসলখানা ছিল বলে আমরা শুনি না। তিনি নিজেও নাকি গোসলখানার প্রসন্ন ছিলেন না এবং তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, প্রত্যেকে কাপড় পরে কেবল গোসলের জন্য গোসলখানায় যেতে পারে। আমরা যে সময়ের কথা বলছি তখন সরকারী গোসলখানা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কেবল উৎসব উপলক্ষে বা স্বাস্থ্য লাভের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য নয়, আমোদ প্রমোদ ও বিলাসের স্থান হিসেবেও। বিশেষ রিজার্ভ করা দিনে মেয়েরাও সরকারী গোসলখানায় যেতে পারত। দশম শতাব্দীর আরম্ভে বাগদাদ ২৭ হাজার সরকারী গোসলখানার গর্ব করত। অন্য সময় নাকি গোসলখানার সংখ্যা ৬০ হাজারে গিয়ে পৌঁছে। অবশ্য আরবদের বর্ণিত বেশির ভাগ সংখ্যাতেই যেমন অতিরঞ্জন থাকে, এ সংখ্যাতেও তেমনি অতিরঞ্জন আছে। ১৩২৭ সালে একজন মুর ভ্রমণকারী বাগদাদে আসেন এবং তিনি দেখতে পান যে, শহরের পশ্চিম অংশের তেরটি বাড়ীর প্রত্যেক বাড়ীতে দুই হতে তিনটি ব্যাপকভাবে সজ্জিত গোসলখানা আছে এবং প্রত্যেক গোসলখানায় গরম ও ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা আছে।
এখনকার মত কখনো গোসলখায় কয়েকটি কামরা থাকত। কামরাগুলির মেঝে মোজাইক করা এবং ভিতরের দিকের দেয়ালে মার্বেল বসানো থাকত। মাঝখানের একটি বড় কামরার চারপাশে এই কামরাগুলির স্থান ছিল। এই মাঝখানের কামরাটির উপরে একটি গম্বুজ; গম্বুজে উজ্জ্বল গোলাকার ছিদ্র থাকত, যাতে ঐ পথে আলো আসতে পারে। পানি গরম করে সেই পানির বাষ্পে এই ঘরকে গরম করা হত। উক্ত বাইরের কামরাগুলি বিশ্রাম, নাস্তা ও পান উপভোগের জন্য ব্যবহৃত হত।
ইতিহাসে বরাবরই দেখা গেছে যে, চারুশিল্পের মত খেলা-ধুলাও ইন্দো ইউরোপীয় সভ্যতারই প্রকৃতিগত লক্ষণ–সেমিটিক সভ্যতার নয়। খেলা-ধুলায় কেবল খেলা-ধুলার জন্যই অনেক হিনত করতে হয়। কবিত্ব-প্রবণ আরব সন্তানের চোখে এ এক অযৌক্তিক কার। বিশেষতঃ নিতান্ত সঙ্গত কারণেই সে দিনের গরম এড়িয়ে চলতে চায়।
বাইরের খেলাধুলার মধ্যে দেখতে পাই তীরন্দাজী, পলো, বল, হকী, তলোয়ারবাজী, বর্শা নিক্ষেপ, ঘোড়দৌড় এবং সর্বোপরি শিকার। কেউ ভবিষ্যতে খলীফার প্রমোদসঙ্গী হতে চাইলে অন্যান্য গুণের মধ্যে তাকে দক্ষতা অর্জন করতে হত তীরন্দাজী, শিকার, বল ও দাবা খেলায়। এসবের মধ্যে সঙ্গী তার রাজকীয় মনীবের সমকক্ষ হলেও তার বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কা ছিল না। খলীফাদের মধ্যে বিশেষ করে পলোর ভক্ত ছিলেন আল–মুতাসিম। একদা তাঁর তুর্ক সেনাপতি তার বিপক্ষে খেলতে অস্বীকার করেন। বলেন : এখন কি খেলার ব্যাপারেও আমি আমীরুল-মুমিনের বিপক্ষতা করতে চাই না।’ এক রকম বল খেলার কৌতূহল-উদ্দীপক উল্লেখ পাওয়া যায়। এই খেলায় একখণ্ড কাঠ ব্যবহার করা হত। এ-কি টেনিসের শৈশব অবস্থার কথা? সাধারণতঃ মনে করা হয় যে, টেনিস শব্দটা ফরাসী ক্রিয়া ‘টেনেজ’ (মানে-খবরদার!) হতে উৎপন্ন; কিন্তু আসলে শব্দটা বোধহয় ‘টিন্নিস’ হতে এসেছে। মোহনায় অবস্থিত একটি মিসরীয় শহরের আরবী নাম ছিল টিন্নিস। মধ্যযুগে এই শহর পট্টবস্ত্র উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। এই পট্টবক্সে টেনিস বল তৈরি হয়ে থাকবে।
সাধারণ শিকার, রাজপাখী দিয়ে শিকার এবং ফাঁদ ব্যবহার সম্বন্ধে প্রাথমিক যুগের আরবীতে যত বই আছে তার সংখ্যা দেখে মনে হয়, এসব ব্যাপারে সবাই খুব আনন্দ পেত। বাজপাখী দিয়ে শিকার করার প্রথা পারস্য হতে আরবে আসে; এ শিকার সম্বন্ধে আরবীতে যে সব শব্দ আছে, তাতেই এ প্রমাণিত হয়। খলীফাদের যুগের শেষভাগে এবং ক্রুসেডের যুগে বাজ দিয়ে শিকার অতিপ্রিয় হয়ে ওঠে। আরব্য উপন্যাসে যেমন বর্ণনা পাওয়া যায়, মোটামুটি সেই নিয়মেই আজো পারস্য, ইরাক ও সিরিয়ায় বাজ দিয়ে শিকার করা হয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা চলে যে, শিকার ধরার পরই মুসলমান তাকে জবেহ করে, নইলে তার গোশত্ হালাল হয় না।
সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদাতাদের মধ্যে সবার উপর স্থান ছিল খলীফা ও তার পরিবারস্থ লোকের; তারপর সরকারী আমলা, তারপর উপরোক্তদের ভক্ত অনুগৃহীতদের দলের। এই শেষোক্ত পর্যায়ে পড়ত সৈন্য, দেহরক্ষী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রমোেদ সঙ্গী এবং চাকর-বাকর।
চাকরেরা প্রায় সবাই ছিল অমুসলমানদের মধ্য হতে সংগৃহীত গোলাম। এদের কেউ ছিল জোর করে ধরে আনা লোক, কেউ যুদ্ধবন্দী, কেউ বাজারে খরীদ। এদের কতক ছিল নিগ্রো, বাকীদের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল তুর্ক, কিছুসংখ্যাক ছিল শ্বেতাঙ্গ। শ্বেতাঙ্গ গোলামরা জাতে প্রায়ই ছিল গ্রীক, স্ন্যাভ, আর্মেনীয়ান ও বার্বার। কতক ছিল খোঁজা–এরা নিযুক্ত হত হেরেমের কাজে; আবার কতক ছিল ‘গিলমান’-এরাও খোঁজা হতে পারত। তবে গিলমানরা মনীবের বিশেষ অনুগ্রহভাজন ছিল। তারা দামী সুন্দর পোশাক পরত; এবং অনেক সময় মেয়েদের মত আতর-গোলাব মাখত। আর-রশীদের জামানার বইপত্রে আমরা গিলমানদের কথা পাই। কবিরা তাদের এ অস্বাভাবিক আকর্ষণকে তাদের রচনায় বর্ণনা করতে এবং এই শহীন বালকদের কাছে প্রেমপত্র লিখতে লজ্জাবোধ করত না।
কুমারী দাসীদের গায়িকা, নর্তকী বা রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহার করা হত। এদের কেউ কেউ তাদের খলীফা-মনীবের উপর বেশ প্রভাব বিস্তার করে বসত। এমন একজন ছিল, ‘তিল-ওয়ালা সুন্দরী।’ আর-রশীদ তাকে ৭০ হাজার দেরেমে খরিদ করেন এবং পরে এক ঈর্ষান্ধ মুহূর্তে তার এক চাকরকে দান করে দেন। আর-রশীদ আর একটি নর্তকী বালিকার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। সে নর্তকীর কবল হতে উদ্ধারের জন্য বেগম জোবায়েদা তাঁকে দশটি কুমারী উপহার দেন; এদের দুইজন পরে খলীফার মা হয়। আরব্য উপন্যাসে তাওয়াদুদ নাম্নী একটি সুন্দরী ও প্রতিভাশালিনী বাদীর কাহিনী আছে। হারুনর-রশীদ তাকে ১ লক্ষ দিনারে খরিদ করতে চেয়েছিলেন; কারণ খলীফার মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতদের সে চিকিৎসা, আইন, গ্রহ-বিজ্ঞান, দর্শন, সঙ্গীত, গণিত, অলঙ্কার, ব্যাকরণ, কবিতা, ইতিহাস ও কুরআন প্রভৃতি সর্বশাস্ত্রে প্রতিযোগিতায় পরাজিত করে। বাদীদের কারো কারো সাংস্কৃতিক স্তর কত উঁচু ছিল, এ কাহিনী হতে তা অনুমান করা চলে। আল আমিনের অন্যতম অবদান ছিল, একটি ছুরী বাহিনী গঠন। এ বাহিনীর ছুকরীরা বাবরীর মত করে চুল রাখত, বালকদের মত পোশাক পরত এবং রেশমী পাগড়ী মাথায় দিত। উঁচু নীচু উভয় সমাজে অল্পকাল মধ্যে এ প্রথা চালু হয়ে যায়। একজন চাক্ষুষ সাক্ষী বললেন যে, তিনি একদিন আল-মামুনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে দেখেন যে, আল-মামুনের সামনে বিশজন গ্রীক কুমারী সুসজ্জিত অবস্থায় এবং হাতে জলপাইর শাখা ও খেজুরের পাতা নিয়ে নাচছে। ৩ হাজার দিনার নর্তকীদের মধ্যে বিতরণ করে উৎসব সমাপ্ত করা হল।
রিপোর্টে পাওয়া যায়, খলীফা আল-মুতাওয়াক্কিলের ৪ হাজার উপপত্নী ছিল এবং আমাদের বিশ্বাস করতে বলা হয় যে, এদের সবাইর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হত। খলীফা বা উজীরকে গভর্নর ও সেনাপতিদের পক্ষ হতে নজর পাঠানের রীতি ছিল; এবং সে নজরের মধ্যে প্রজাদের মধ্য হতে সংগৃহীত বালিকা থাকত। এ রীতির ব্যতিক্রম হলে, তা রাজদ্রোহ বলে গণ্য হত। (এই সব কথার মধ্যে অতিরঞ্জন থাকা স্বাভাবিক।)
জনসাধারণ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল? উচ্চ শ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণী। উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা অভিজাতদের কাছাকাছি স্থান দখল করত। এদের মধ্যে দেখতে পাই সাত্যিক, বিদ্বান সমাজ, শিল্পী, সওদাগর, কারিকর এবং পেশাদার শ্ৰেণী। জাতির অধিকাংশই ছিল নিম্ন শ্রেণীর লোক আর এদের মধ্যে ছিল কৃষক, পশুপালক এবং গেয়ে মানুষ। এই শেষোক্তরা ছিল দেশের আদত লোক (নেটীভ) এবং এরা এ সময় জিম্মীর অধিকার ভোগ করত।
সাম্রাজ্যের বিপুল বিস্তার এবং সভ্যতার উন্নত স্তর–এ উভয় কারণে ব্যাপক আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। প্রাথমিক যুগে খৃস্টান, ইহুদী এবং জরোস্তরাই (জরোয়েষ্ট্রীয়ান) সওদাগরী কাজ করত। কিন্তু পরবর্তী যুগে আরব ও অন্যান্য মুসলমানরা অনেকাংশে তাদের স্থান দখল করে; কারণ এরা কৃষিকাজকে ঘৃণা করলেও ব্যবসা-বাণিজ্যকে ঘৃণা করত না। বাগদাদ, বসরা, সিরাজ, কায়রো এবং আলেকজান্দ্রিয়ার মত বন্দর স্থল ও জল-বাণিজ্যের কর্মব্যস্ত কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
পূর্ব দিকে মুসলিম সওদাগররা চীন পর্যন্ত গিয়ে হাজির হত। চীনের সঙ্গে রেশমের ব্যবসা চলত। পাশ্চাত্য জগতের প্রতি চীনের বহু অমূল্য অবদানের মধ্যে এটিই ছিল সর্বপ্রথম। এ রেশমের কারবার চলত সমরকন্দ ও চীনা তুর্কীস্তানের ভিতর দিয়ে। এই পথকে বলা হত, ‘রেশমের রাজপথ। অথচ আজকের সভ্য মানুষ পৃথিবীর মধ্যে এ অঞ্চলেই সবচেয়ে কম পরিভ্রমণ করে থাকে। সওদাগরী মাল একের পর আর–এমনি বহু দলে বহন করত। সাধারণতঃ একই কাফেলাকে সমস্ত পথ চলতে হত না। সামুদ্রিক বাণিজ্য ইসলামকে দূর দূরান্তরের দ্বীপসমূহে নিয়ে যায় । এদেরই কতকগুলি দ্বীপ ১৯৪৯ সালে ইন্দোনেশীয়া রিপাবলিক গঠন করে।
পশ্চিম দিকে মুসলিম সওদাগররা মরক্কো ও স্পেনে দিয়ে পৌঁছে। লেসূসেপের এক হাজার বছর আগে একজন আরব খলীফা (হারুনর-রশীদ) সুয়েজ যোজাকের ভিতর দিয়ে একটি খাল কাটার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ভূমধ্যসাগরের আরবদের বাণিজ্য বিশেষ প্রসার লাভ করে নাই। কৃষ্ণ সাগর ও বাণিজ্যের জন্য খুব নিরাপদ ছিল না; যদিও দশম শতাব্দীতে উত্তরে ভগা অঞ্চলের লোকের সঙ্গে স্থল পথে দস্তুরমত ব্যাপক ব্যবসা চলত। কিন্তু কাষ্পীয়ান সমুদ্র ছিল পারস্য দেশীয় বহু বাণিজ্য কেন্দ্রের সন্নিকট এবং বোখারা, সমরকন্দের মত সমৃদ্ধিশালী শহরগুলিও দূরে ছিল না। কাজেই এই সমুদ্রই ছিল এ যুগের মুসলিম-বাণিজ্যের বিরাট আদান-প্রদান ক্ষেত্র। মুসলিম সওদাগররা সঙ্গে নিয়ে যেত খেজুর, চিনি, কার্পাস ও পশম-বস্ত্র, ইস্পাতের যন্ত্রপাতি এবং কাঁচের জিনিস। আর তারা সুদূর এশিয়া হতে অন্যান্য জিনিসের মধ্যে আমদানী করত : মসলা কর্পূর এবং রেশম, আর আফ্রিকা হতে হাতীর দাঁত, আবলুশ এবং নিগ্রো গোলাম-বাদী।
সে জামানার রথচাইলড় ও রকফেলাররা কি অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছিল, তার খানিকটা আঁচ পাওয়া যাবে বাগদাদের জওহরী ইবনুল জাস্সাসের ঘটনা হতে। ইবনুল জাস্সাসের সম্পত্তি হতে খলীফা ১ কোটি ৬০ লক্ষ দিনার বাজেয়াপ্ত করেন। তার পরও তিনি জওয়াহেরাতের সওদাগরমণ্ডলীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে থাকেন। বসরার কয়েকজন সওদাগর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সওদাগরী জাহাজ পাঠাতেন। এদের প্রত্যেকের বার্ষিক আয় ছিল দশ লক্ষ দেরেমের বেশি। বসরা ও বাগদাদের একজন নিরক্ষর যাতা-কলওয়ালা দৈনিক ১ শত দিনার গরীবকে ভিক্ষা দিতে পারত। সীরা নগরে একজন সওদাগরের বাড়ী করতে গড়ে খরচ হত দশ হাজার দিনারের উপরে। কেউ কেউ ত্রিশ হাজার দিনারও খরচ করত এরং অনেক জাহাজী সওদাগরের প্রত্যেকে ৪০ লক্ষ দিনারের মালিক ছিল। এক দিনারের দাম ছিল প্রায় ২.৪০ ডলার।
সাম্রাজ্যের ভিতরে শিল্প ও কৃষির উপর নির্ভর না করে কোন বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপই এত ব্যাপকতা লাভ করতে পারত না। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে হস্তশিল্প প্রচুর উন্নতি লাভ করে। পশ্চিম এশিয়ায় এ শিল্প মারফত প্রধানতঃ উৎপন্ন হত কম্বল, কারুকার্যখচিত বস্ত্র, রেশম, সূতী ও পশমী কাপড়, সাটিন, কিংখাব, সোফা (সুফফা হতে), গদীর ঢাকনী, ঘরের আসবাব ও বাবুর্চীখানার বাসনপত্র। পারস্য ও ইরাকে বহু তাঁত ছিল এবং সে তাঁতে বোনা গালিচা ও কাপড় অত্যন্ত উঁচুমান রক্ষা করে চলত। তাদের স্বতন্ত্র মার্কা ছিল। এক খলীফার মা ফরমাস দিয়ে ১৩ কোটি দেরেম খরচে একটি কম্বল তৈয়ার করান। এ কম্বলের গায় সব রকম পাখীর সোনায় তৈরী ছবি ছিল এবং রুবী ও অন্যান্য বহুমূল্য পাথর দিয়ে সে পাখীর চোখ বানানো হয়। আত্তাব নামক একজন উমাইয়া শাহজাদা বাগদাদের এক মহল্লায় বাস করতেন। তাঁর নাম অনুসারে উক্ত মহল্লার নাম হয় আত্তাব। দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রথম এইখানে এক রকম ডোরাদার কাপড় তৈরি হয় এবং এর নাম দেওয়া হয় আত্তাবী। স্পেনের আরবরা এ কাপড়ের অনুকরণে কাপড় তৈরি করে এবং তাবী নামে সে কাপড় ফ্রান্স, ইতালী এবং ইউরোপের অন্য বহু স্থানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শব্দটা আজো ‘টেব্বী’ শব্দের মধ্যে বেঁচে আছে; টেব্বী মানে ডোরাদার বিড়াল। কুফায় রেশম ও রেশমে তৈরী মাথার রুমাল উৎপন্ন হত। এখনো ‘কুফীয়া’ নাম এ রুমাল ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
দামেস্ক শহরে এক রকম ফুলদার কাপড় তৈরী হত; এই কাপড় দামাস্ক নামে পরিচিত হয়। সুসিয়ানার কয়েকটি কারখানা এই দামাস্ক কাপড়ে সোনার না ভোলার জন্য বিখ্যাত ছিল। এখানকার তৈরী পরদা, উট ও ছাগ পশমের কাপড় এবং রেশমী জামা বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। শিরাজ নগরে তৈরী হত ডোরাদার পশমী জামা, সূক্ষ্ম রেশমী বস্ত্র ও কিংখাব। মধ্যযুগের ইউরোপীয় মহিলারা তাদের দোকান হতে ‘টাফেটা’ নামে পারস্যের রেশমী কাপড় ‘তাফ্তা’ খরিদ করতেন।
সিডন, টায়ার এবং লেবানন ও সিরিয়ার অন্যান্য শহরে তৈরী কাঁচ নিতান্ত স্বচ্ছ ও পাতলা বলে বিখ্যাত ছিল।
পৃথিবীতে মিসরই সর্বপ্রথম কাঁচ শিল্পের প্রবর্তন করে। তারপরই প্রাচীন ফিনিশীয়ানরা এ শিল্পে হাত দেয়। সিডন, টায়ার প্রভৃতি স্থানের কাঁচ শিল্পের মূল ছিল এই ফিনিশীয়ান শিল্প। ক্রুসেডের ফলে সিরীয় কাঁচের অনুকরণে ইউরোপের গীর্জায় গীর্জায় রঙ্গীন কাঁচ ব্যবহারের চল হয়। ব্যবহারের সুবিধা ও বিলাদ্রব্য হিসেবে বাজারে সিরিয়ার কারুকার্য খচিত কাঁচ ও ধাতুর বাসনপত্রের যথেষ্ট চাহিদা ছিল।
লেখার জন্য কাগজ উৎপাদন এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে চীন হতে সমরকন্দে কাগজ আমদানী হয়। সমরকন্দের কাগজকে অতুলনীয় বিবেচনা করা হত। আমরা আগে দেখেছি যে, মুসলমানরা ৭০৪ সালে সমরকন্দ জয় করে। অষ্টম শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই বাগদাদে কাগজের প্রথম কল স্থাপিত হয়। ক্রমে ক্রমে আরো অনেক কল জন্মলাভ করে। ৯০০ সাল বা তার আগেই মিসরে, ১১০০ সালের কাছাকাছি কালে মরক্কোতে, ১৯৫০ সালের দিকে স্পেনে কাগজের কল দেখা দেয় এবং সাদা ও রঙ্গীন নানা রকম কাগজ উৎপন্ন হতে থাকে। মুসলিম-স্পেন ও ইতালী হতে দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কাগজ-শিল্প খৃষ্টান ইউরোপে চলে যায় এবং সেখানে ১৪৫০-৫৫ সালে ছাপার কল আবিষ্কার হওয়ার ফলে ইউরোপ আমেরিকায় আজ আমরা এই বহু বিস্তৃত শিক্ষা দেখতে পাই।
আব্বাসীয় বংশের আগের দিকের খলীফারা কৃষির উন্নতির জন্য বিশেষ যত্নবান হন। প্রথম কারণ, তাঁদের রাজধানীই অবস্থিত ছিল অত্যন্ত উর্বর পলিমাটি অঞ্চলে; দ্বিতীয় কারণ, তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, রাজ্যের আয়ের বড় উৎসই হল কৃষিকাজ; তৃতীয় কারণ, চাষের কাজ প্রায় সম্পূর্ণ রকমে দেশের আদিম বাসিন্দাদের হাতে ছিল এবং নতুন শাসকদের আমলে তাদের অবস্থার খানিক উন্নতি হয়েছিল। পরিত্যক্ত জোত-জমি ও বিধ্বস্ত গ্রাম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিল; ক্রমে ক্রমে সেগুলির আবাদ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার তাইগ্রীস-ইউফ্রেতীম উপত্যকার নিম্ন অঞ্চল ও কথিত ইডেন উদ্যান অঞ্চলে বিশেষ মনোযোগ দেয়। এক মিসর ছাড়া সমস্ত সাম্রাজ্যের মধ্যে উক্ত উপত্যকার মত উর্বর স্থান আর কোথাও ছিল না। ইউফ্ৰেতীস নদী হতে নির্গত খাল দিয়ে এ-অঞ্চলের যেন একটা সত্যিকার জাল বোনা হয়েছিল। আরব ভৌগোলিকেরা মাঝে মাঝেই খলীফাদের নদী কাটা বা নদীর মুখ খুলে দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। আসল কথা এই যে, ব্যাবিলনীয় যুগ হতে যে সব খাল ছিল, তারা প্রধানতঃ সেগুলিই পুনরায় কাটেন বা সেগুলির মুখ খুলে দেন। ইরাক এবং মিসর উভয় দেশেই খালসম্পর্কিত কাজ ছিল, প্রধানতঃ প্রাচীন পানি সেচ ব্যবস্থাকে কায়েম রাখা। এমন কি মহাযুদ্ধের আগে যখন তুর্ক সরকার স্যার উইলিয়াম উইলককে ইরাকের সেচ সমস্যার অনুসন্ধান করতে নিযুক্ত করেন, তখন তাঁর রিপোর্টে তিনি এই কথার উপরই জোর দেন যে, নতুন খাল কাটার চেয়ে পুরাতন খালগুলিকে চালু করাই এখানকার প্রধান কাজ। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, আব্বাসীয় জামানা হতে আজ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এই বিরাট পলিময় প্রান্তরের চেহারা অনেকখানি বদলে গেছে এবং তাইগ্রীস, ইউফ্ৰেতীস উভয় নদীই তাদের আসল প্রবাহ পথ হতে বহু দূরে সরে গেছে।
আম, টমেটো, গোলআলু এবং তজ্জাতীয় লতা অল্পকাল আগে আমেরিকা ও সুদূর ইউরোপীয় উপনিবেশ হতে পশ্চিম এশিয়ায় আমদানী হয়েছে। এগুলি ছাড়া পশ্চিম এশিয়ায় আজকাল যে সব ফল ও সজীর আবাদ হয়, তার প্রায় সবই সেকালে বর্তমান ছিল। কমলালেবুর আদি জন্মস্থান ছিল উত্তর পাক-ভারত ও মালয়; এখান হতে এ ফল পশ্চিম এশিয়া, ভূমধ্যসাগরের উপকূলস্থ দেশ এবং অবশেষে আরবদের মারফত স্পেন দেশ হতে বাকী ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ-পশ্চিম পারস্যে আখের আবাদ ও সংশ্লিষ্ট পরিশোধনাগার দেখে প্রায় এই সময় উহা সিরিয়ার উপকূল ভূমিতে প্রবর্তিত হয়। পরবর্তীকালে ক্রুসেডীয় যোদ্ধারা এখান হতে আখ ও চিনি ইউরোপে নিয়ে যায়। চিনির আদি জন্মস্থান হয়তো ছিল, বাংলাদেশ। সেই মিষ্টি দ্রব্যটি এমনিভাবে ধীরে ধীরে পশ্চিম পানে যাত্রা করে। আজ সভ্য মানুষের খাদ্যের অন্যতম উপকরণ হিসেবে চিনি কি অপরিহার্যই না হয়ে পড়েছে।
সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ লোকেরই পেশা ছিল কৃষিকাজ; কৃষকরাই রাজস্বের ছিল প্রধান উৎস। এরা দেশের আদিম বাসিন্দা ছিল। এদের সাথে বিজয়ীদের ধর্মীয় স্বাধীনতার চুক্তি ছিল এবং সে সূত্রে এরা ছিল জিম্মী। আরবরা চাষের কাজকে তার মর্যাদাহানীকর মনে করত। জিম্মীরা প্রথমে ছিল কেবল কেতাবী জাতি খৃস্টান, ইহুদী ও সেবীয়ান। ক্রমে আরো কয়েকটি সম্প্রদায় এদের অন্তর্ভুক্ত হয়। পল্লীতে এবং তাদের গোলাবাড়ীতে জিম্মীরা তাদের প্রাচীনসংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে থাকত এবং তাদের নিজ ভাষা রক্ষা করে চলত। মোটের উপর চুক্তি ভালভাবেই রক্ষিত হত; যদিও কোন সময় ধর্মীয় নির্যাতনও ঘটত।
শহরে খৃস্টান ও ইহুদীরা গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব সংক্রান্ত পদে, কেরানী পদেও পেশা সংক্রান্ত পদে অধিষ্ঠিত ছিল। এতে অবশ্য মুসলিম বাসিন্দাদের মনে হিংসার উদয় হত এবং এ সম্বন্ধে কোন কোন সময় নতুন আইনও হত কিন্তু এ সব বিভেদমূলক আইন প্রায়শঃ কাগজেই থাকত; কর্যত এদের প্রয়োগ হত না।
উমাইয়া খলীফা দ্বিতীয় ওমর খৃস্টান ও ইহুদীগণকে আলাদা পোশাক পরার, হুকুম দেন এবং সরকারী পদ তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ করেন। হারুনর রশীদই বোধহয় প্রথম কতকগুলি পুরানো আইন পুনঃপ্রবর্তন করেন। খলীফা আল মুতাওয়াক্কিল ৮৫০ ও ৮৫৪ সালে আইন করেন যে, খৃস্টান ও ইহুদীগণকে তাদের বাড়ীর সঙ্গে শয়তানের কাষ্টমূর্তি লাগিয়ে রাখতে হবে, তাদের কবর উচ্চতায় মাটির সমান স্তরে রাখতে হবে, তাদের বহির্জামার রং হলদে হতে হবে, তাদের গোলামের জামায় দুটি হলদে রঙ্গের তালি দিতে হবে–একটি পেছনে অন্যটি সামনে; তারা কেবল গাধা ও খচ্চরে কাঠের গদিতে চড়বে। এই বিভেদমূলক পোশাকের জন্য জিম্মীদের এক নাম হয় চক্করওয়ালা’ । জিম্মীদের আর একটা বিশেষ অসুবিধা ছিল এই যে, তকালীন মুসলিম আইনজ্ঞরা এক রায় দেন যে, কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে খৃস্টান বা ইহুদীদের সাক্ষ্য গৃহীত হবে না; কারণ, কোরআনের মতে খৃস্টান আর ইহুদীরা তাদের ধর্ম পুস্তককে বিকৃত করেছে। কাজেই তাদের আর বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু এসব বাধা সত্ত্বেও খলীফাদের অধীনে খৃস্টানরা যথেষ্ট পরিমাণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করেছে। নবম শতাব্দীর শেষার্ধে আমরা খৃস্টান উজীরের কথাও শুনতে পাই। এ সব খৃস্টান উচ্চ আমলারা তাদের যথাযযাগ্য সম্মান লাভ করত। খলীফাদের অধীনে খৃস্টান ধর্মের প্রাণশক্তি যথেষ্ট প্রবল ছিল এবং এরই ফলে সুদূর পাক-ভারত ও চীন পর্যন্ত তারা মিশনারী পাঠিয়েছে।
কোরআনে ইহুদীদের সম্বন্ধে কয়েক স্থানে কঠোর মন্তব্য থাকা সত্ত্বেও তাদের দিন খৃস্টানদের চেয়েও ভালভাবে গিয়েছে। আমরা কাগজপত্রে দেখি, কয়েকজন খলীফার অধীনে ইহুদীরা দায়িত্বপূর্ণ সরকারই পদ দখল করেছে। খাস বাগদাদের বুকে ইহুদীদের একটি সমৃদ্ধশালী উপনিবেশ ছিল এবং রাজধানীর পতনের আগ পর্যন্ত সে উপনিবেশ ভালভাবেই চলে। বেনজামিন নামক টুডেলার একজন ইহুদী ধর্মযাজক ১৯৭০ সালে এই ইহুদী উপনিবেশ পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানে দশটি ধর্মশিক্ষালয় এবং তেইশটি ধর্মমন্দির দেখতে পান। প্রধান ধর্মমন্দিরটি বিচিত্র মার্বেল পাথর ও সোনা-রূপায় বিশেষরূপে সজ্জিত ছিল। বেনজামিন পরম গর্বের সঙ্গে বর্ণনা করেন যে, প্রধান ধর্মযাজক স্বয়ং দাউদ পয়গম্বরের বংশধর বলে সকলে তাঁকে অগাধ শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং ইহুদীরা সকলেই বাগদাদের খলীফার পরম অনুগত। প্রধান ধর্মযাজক একদা খলীফার সঙ্গে দেখা করতে রাস্তায় বের হন। তাঁর গায় ছিল ফুলদার রেশমী পোশাক, তার মাথায় ছিল মণি মানিক্যখচিত সাদা পাগড়ী এবং তার সঙ্গে ছিল একদল অশ্বারোহী দেহরক্ষী। তার আগে আগে এব নকীব হেঁকে চলছিল ও রাস্তা কর–আমাদের প্রভু দাউদ পুত্রের জন্য পথ কর।’
খলীফার রাজ্যের মানুষের এবং তাদের পরস্পর সম্বন্ধের দৃশ্য এই । আমরা এখন আরব বিজয়ের তৃতীয় মঞ্চে। প্রথম মঞ্চ ছিল সামরিক ও রাজনৈতিক আরব সমর-বাহিনীর অভিযান। দ্বিতীয় মঞ্চ ছিল ধর্মীয় প্রথম শতাব্দীতে ছিল এর আরম্ভ। এই যুগ সাম্রাজ্যের বেশীরভাগ লোকই ইসলাম গ্রহণ করে। তৃতীয় মঞ্চ ছিল–ভাষাগত ও বিজিত জাতিদের নিজস্ব ভাষার উপর আরবী ভাষার জয়লাভ। এইখানে বিজয়-রথ চলে সবচেয়ে ধীরগতিতে এবং বিজিত জাতিরা এই মঞ্চেই সবচেয়ে কঠিন বাধা দেয়। মনে হয়, মানুষ বরং তাদের রাজনৈতিক এমন কি ধর্মীয় আনুগত্য বিসর্জন করতে রাজী, তথাপি ভাষার আনুগত্য ত্যাগ করতে রাজী নয়।
মাতৃভাষা হিসেবে আরবী ভাষার জয়লাভের আগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা হিসেবে তার জয়লাভ ঘটে। আগের অধ্যায়গুলিতে আমরা দেখেছি, কিরূপে গ্রীক-সংস্কৃতি এবং পারস্য ও পাক-ভারত হতে নব নব চিন্তার ধারা এসে ৮০০ সালের দিকে বাগদাদে এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম ও বিকাশের সূচনা করে। এখন আরবী ভাষা আরব সভ্যতার বাহন হিসেবে জয়লাভ করেছে। এই বিজয় ইসলামের জ্ঞানাত্মক সোনার-যুগের আগমন-বার্তা ঘোষণা করছে।