আরব-জাতি, মুসলিম ও সিমাইট
হযরত মুহম্মদের (সঃ) ইন্তিকালের একশ বছর পর তাঁর অনুগামীরা এক বিশাল সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। রোম যখন তার উন্নতির শীর্ষদেশে অবস্থিত, তার তখনকার সাম্রাজ্যের চেয়েও এ আরব সাম্রাজ্য ছিল বৃহত্তর। বিষ্কে উপসাগর হতে সিন্ধুনদ এবং চীনের সীমান্ত ও আরব সাগর হতে নীলনদের নিম্নভাগের জলপ্রপাত পর্যন্ত ছিল এ বিরাট সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি। দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার হাজার হাজার মিনার হতে আরবের পয়গম্বরের নাম সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রোজ পাঁচবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। এই অপূর্ব বিস্তারের যুগে মুসলিম-আরব তার ধর্মে, তার ভাষায়, এমনকি তার শেকেল-সুরতে এত অধিক পরিমাণে বাইরের জাতিকে আত্মস্থ করেছিল, যার নজীর আগের ইতিহাসেও নাই, পরের ইতিহাসেও নাই। গ্রীক, রোমক, অ্যাংলো-স্যাকসন অথবা রাশিয়ানরাও এ প্রভাবের বাইরে রয় নাই।
ব্যাবিলনীয়, আসিরীয়, কালদীয়, আর্মেনীয় এবং ফিনিশীয় জাতি–এদের সবারই পূর্বপুরুষের এই আরব উপদ্বীপের কোলে লালিত হয়েছিল। এরা সবাই এককালে ছিল, আজ আর নাই। আরবেরা ছিল, আজো তারা আছে। তারা বিশ্ব-বাণিজ্যের একটি বিরাট চলাচল পথের মাঝখানে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে তখনো ছিল, এখনো আছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর হতে ক্রমবর্ধমানভাবে এ জাতি তাদের অতিত উত্তরাধিকার এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। প্রথম মহাযুদ্ধের আগ পর্যন্ত, আরব জাহানের সমস্ত পূর্ব-ভাগ তুর্ক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বৃটিশ শক্তির আওতায় অছি রাজ্য হিসেবে কিছুকাল শিক্ষানবিশী করার পর ইরাক আজ সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার রাজা একজন আরব, তার রাজধানী বাগদাদ–এককালে আরব্য-উপন্যাস খ্যাত হারুনর রশীদের শাসনাবাস। ফিনিশীয় যুগ হতে লেবানন সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্য অভিমুখী; আজ খৃষ্টানরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। লেবানন ফরাসীদের অছি-রাজ্য থাকাকালেই নিজেকে রিপাবলিক বলে ঘোষণা করেছে। এর রাজধানী বৈরুত এখন এশিয়ার সব চেয়ে আধুনিক ও সব চেয়ে কর্মব্যস্ত নগরসমূহের অন্যতম। লেবাননের প্রতিবেশী সিরিয়া। সিরিয়াও ফরাসীদের মুরুব্বিয়ানা হতে অব্যাহতি পেয়ে এক আযাদ রিপাবলিক। উমাইয়া খলীফাদের সেকালের গৌরবময়ী রাজধানী দামেস্ক বর্তমান রিপাবলিকেরও রাজধানী। কিছুকাল বৃটিশ অছি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকার পর জর্দান এখন মহানবীর জনৈক বংশধরের অধীনে হাশেমী রাজ্যরূপে গড়ে উঠেছে। আধুনিক আরবের লৌহ-মানব ইবনে সউদ মধ্য, উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব আরব নিয়ে একটা মস্ত সুসংবদ্ধ রাজ্য গড়ে তুলেছেন। খোলাফায়ে রাশেদীনের পর আরবে আর অমন রাজ্যের উদ্ভব হয় নাই। বহুকাল পর্যন্ত বৃটিশ অধিকার ও প্রভাবে থাকার পর মিসর ষোলআনা আযাদী অর্জন করেছে, তার দেড় শতাব্দীকাল স্থায়ী রাজবংশের শাসন কর্তৃত্ব বর্জন করেছে এবং তার আর্থিক ও সামাজিক সংস্কারের জন্য বৈপ্লবিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। মিসরের প্রতিবেশী সুদান, লিবীয়া, তিউনিসিয়া এবং মরক্কোও পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করেছে। পশ্চিমে আলজেরীয়া আরব জাতীয়তার অপূর্ব স্পন্দনে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে এবং বর্তমানে আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সগ্রামে লিপ্ত রয়েছে।
হুমা আরবের নব-জীবনের পাখী। সেই হুমা আবার জেগে উঠছে। তার পাখা শক্তিমান। হযরত মুহম্মদের (সঃ) প্রবর্তিত ইসলামের ছায়াতলে আজ পৃথিবীর প্রায় সর্বজাতির অন্তর্গত কমপক্ষে ত্রিশ কোটি মানুষ আশ্রয় লাভ করে আছে। তারা মুসলিম। মুহম্মদী নামে পরিচিত হওয়ার চেয়ে এই নামে পরিচিত হতে তারা ভালবাসে। আমাদের বর্তমান জগতের প্রত্যেক সপ্তম মানুষ মহানবীর অনুগামী এবং মুসলমানের আযান প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই পৃথিবীর সর্বত্র শোনা যায়।
আরব জাতি কেবল একটা সাম্রাজ্য গড়ে তোলে নাই, তারা একটা তমদ্দুনও গড়ে তুলেছিল। যে প্রাচীন সভ্যতা তাইগ্রীস ও ইউফ্রেতীসের তীর ভূমিতে, নীল নদের উপত্যকায় এবং ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে বিকাশ লাভ করেছিল, আরবেরা উত্তরাধিকারসূত্রে তা পেয়েছিল; উপরন্তু তারা শ্রীকো-রোমান সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্টগুলি আহরণ ও আত্মস্থ করেছিল এবং পরবর্তীকালে যে জ্ঞানের প্রভাব পাশ্চাত্য জগতকে জাগ্রত করে বর্তমান রেনেসাঁর পথে তুলে দেয়, মধ্যযুগে আরব-জাতি মাধ্যম হিসেবে সে জ্ঞান ইউরোপের বুকে সঞ্চারিত করে।
আরব–জাতি বলতে আরব উপদ্বীপের বাসিন্দাদের সহ আরব-ভাষাভাষী সমস্ত জাতিকে আমরা বুঝব। মধ্যযুগের প্রথম ভাগে এই আরব জাতি মানব সভ্যতার প্রগতির ক্ষেত্রে যে অপূর্ব দান করেছে, অমন আর কোন জাতিই করে নাই। শার্লেমেন ও তাঁর লর্ডরা যখন নাম দস্তখত করতে শিখছিলেন বলে কথিত হয়, তখন আরব পণ্ডিতেরা আরাস্তুর গ্রন্থ অধ্যয়নে ব্যাপৃত ছিলেন। কর্ডোভার বিজ্ঞানীরা সতরটি বিরাট লাইব্রেরী নিয়ে গবেষণা করতেন। তার একটি লাইব্রেরীর বইয়ের সংখ্যা ছিল ৪,০০,০০০। আর সে পণ্ডিতেরা যখন পরম আরামদায়ক গোসলখানা ব্যবহার করতেন, তখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্গ প্রক্ষালনকে এক ভয়ঙ্কর অনাচার বলে বিবেচনা করা হত।
আরব-জাতির কাহিনী যে আমাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ তার বিশেষ কারণ হচ্ছে, সে কাহিনীর মূলে আছে এমন এক মহান ধর্ম-প্রবর্তকের সাধনার কথা যিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিনজন একেশ্বরবাদী ধর্ম সংস্থাপকের মধ্যে তৃতীয় ও আধুনিকতম এবং যার ধর্ম ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত।
আরব অভিযান কখনো বিজয় লাভ করেছে, কখনো বা পরাজয় বরণ করেছে। কিন্তু রসূলুল্লাহ্ যে মহান ধর্মমত একমাত্র আল্লাহর উপর ইমান–সে ধর্মমত বার বার তুর্ক ও মোগলদের উপর বিজয় লাভ করেছে, যদিও দৈহিক শক্তিতে এ দুই জাতিই আরব-জাতিকে পরাজিত করেছে। এইতো সে দিন–১৯৪৭ খৃস্টাব্দে নতুন ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান জন্ম লাভ করল; বাসিন্দা সংখ্যা এর সাত কোটি। বর্তমান জগতে এ গুরুত্ব স্বীকার করতেই হবে যে, মরক্কো হতে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ইসলাম আজো জীবন্ত শক্তি এবং কোটি কোটি মানুষ ইসলামের বিধি-নিষেধ অনুসারে তাদের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
আজ আরবী ভাষা প্রায় পাঁচ কোটি লোকের মধ্যে তাদের ভাব বিনিময়ের মাধ্যম। মধ্যযুগে বহু শতাব্দী পর্যন্ত সমস্ত সভ্য জগতব্যাপী আরবী ছিল জ্ঞান, তমন ও প্রগতিমুখী চিন্তার ভাষা। খৃস্টীয় নবম শতাব্দী হতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কালে আরবী ভাষায় দর্শন, চিকিৎসা-বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম জ্যোতির্বিদ্যা এবং ভূগোল সম্বন্ধে যত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, তত আর কোন ভাষাতেই প্রকাশিত হয় নাই। ইউরোপীয় ভাষাসমূহের শব্দাবলীর মধ্যে আজো সে প্রভাবের চিহ্ন বর্তমান। ল্যাটিন হরফের পর আরবী হরফই জগতের সব চেয়ে প্রচলিত হরফ।
সিমাইট জাতির দুইটি প্রতিনিধি এখন বর্তমান-আরব ও ইহুদী। এদের মধ্যে আরবরাই তাদের জাতির দৈহিক বৈশিষ্ট্য ও মানসিক গতিভঙ্গী অধিকতর রূপে রক্ষা করে এসেছে। তাদের ভাষা সিমাইট ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সাহিত্যের দিক দিয়ে সর্বকনিষ্ঠ । কিন্তু তথাপি এ ভাষা হিব্রু ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ভাষাসমূহের মধ্যে সব চেয়ে বেশি পরিমাণে আদি সিমাইট ভাষার শব্দ-রূপসহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেছে। ইসলামের যে আদি রূপ, তাতে তাকে সিমাইট ধর্মের অনিবার্য পরিণতি বলেই মনে হয়। ইউরোপ ও আমেরিকায় সিমাইট’ বলতে ইহুদীদের বুঝায়। কিন্তু তাদের দেহের সেমিটিক বৈশিষ্ট্য (উন্নত নাসিকাসহ) আদতে মোটেই সেমিটিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ওই বৈশিষ্টগুলিই প্রমাণ করে যে, ইহুদীরা খাঁটি সিমাইট নয়। স্পষ্টই বোঝা যায় যে, সেকালে হিটাইট হুররিয়ান ও হিব্রুদের মধ্যে যে বিয়ে-শাদী হয়েছিল, এ বৈশিষ্ট্যগুলি তারই অবদান।
দেহ, মন, সমাজ ও ভাষার দিক দিয়ে আরবদেশীয় আরব বিশেষ করে বেদুঈনরাই সেমিটিক-গোষ্ঠীর সব চেয়ে খাঁটি প্রতিনিধি। এর কারণ, তারা বাকি দুনিয়া হতে বিচ্ছিন্নভাবে মরু বৈচিত্র্যহীন জীবনযাপন করে। বাস্তবিক, গোষ্ঠীগত পবিত্রতা রক্ষা একমাত্র নিরনন্দ বিচ্ছিন্ন পরিবেশই সম্ভব। মধ্য-আরব এই-ই জীবনের পরিবেশ। মাটির সঙ্গে মানুষের নিরবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধের নজীর এক আরব উপদ্বীপেই পাওয়া যায়। ভারত, গ্রীস, ইতালী, ইংল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কত দেশ হতে কত মানুষের ধারাই না এসে মিশেছে! কিন্তু আরবে অমন কখনো ঘটেছে কিনা ইতিহাসে তার কোন প্রমাণ নাই। আমরা এমন কোন আক্রমণকারীর কথাও অবগত নই যিনি বালির বাধা ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে স্থায়ীভাবে তথায় আসন গেড়ে বসেছেন। ইতিহাস যতকালের খবর রাখে, ততকালের মধ্যে আরবদের বাসিন্দারা বিশেষ করে তার বেদুঈনেরা মোটামুটি একই রয়ে গেছে। আর ব্যাবিলোনিয়ান, আসিরিয়ান, হিব্রু, আরব এবং আবিসিনীয়ান প্রভৃতি সেমিটিক জাতিসমূহের পূর্বপুরুষের এই আরবেই আদিম বাসিন্দা ছিল। কোন এককালে এই অঞ্চলে তারা এক জাতি হিসেবে বসবাস করত।
ইরাক ও বৃহত্তর সিরিয়াসহ পারস্য উপসাগর হতে সিনাই পর্যন্ত ভূখণ্ডকে “উর্বর হেলাল’ বলা হয়। আরব যেমন সেমিটিক জাতিসমূহকে দিয়েছিল তাদের আদিম বাসভূমি, উর্বর হেলাল তেমনি তাদের দিয়েছিল তাদের প্রাথমিক সভ্যতার সূতিকাগার। সেমিটিক-জাতিরা খৃস্টের জন্মের প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ইউফ্ৰেতীস নদীর উপত্যকায় চলে আসে এবং এইখানেই ব্যাবিলোনীয় সংস্কৃতির প্রথম বিকাশ ঘটে। এই সংস্কৃতির অবদান হিসেবেই আমরা পেয়েছি ওজন ও সময় পরিমাপক বিদ্যা। এর এক হাজার বছর পর আমোরাইটরা উত্তর সিরিয়ায় চলে যায়। এদেরই একাংশের নাম ছিল ক্যানানাইট। গ্রীকরা ক্যানানাইটদের বলত ফিনিশীয়ান। এরা লেবাননের উপকূল-ভূমিতে বাস করত। পরে এরাই হয়ে ওঠে জগতের প্রথম উপনিবেশ স্থাপনকারী ও প্রথম আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী। যদি এরা জগতকে কেবল মাত্র হরফ দিয়ে থাকে, তবে শুধু সেই জন্যেই এদের মানব জাতির মহত্তম বন্ধুদের মধ্যে গণ্য করতে হবে।
আরবের মুসলমানের তাদের বিস্ময়কর বিজয়ের ফলস্বরূপ আরমিনীয়দের (সিরিয়া) মারফত এই প্রাচীন সেমিটিক জাতিসমূহের উত্তরাধিকার লাভ করে। দক্ষিণ আরবের সংস্কৃতিও তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পায়। ইয়েমনে মিনিয়ান, সেবীয়ান ও হিমারাইট গোষ্ঠির মানুষেরা ঐশ্বর্যশালী রাজ্যের পত্তন করে এবং খৃষ্টপূর্ব ১২০০ সাল হতে খ-পরবর্তী : ৫২৫ সাল পর্যন্ত এ সব রাজ্য স্থায়ী থাকে। নামেই বোঝা যায়, শেবার রাণীর আদি বাসভূমি ছিল দক্ষিণ-আরব।