১৬. রিডল অফ দ্য রুনস
বিকাল ৩ টা ২৫ মিনিট।
সাউথ আফ্রিকা।
এটা কোড নয়, বলল গ্রে। এটা কখনও কোড ছিলই না।
হাতে মার্কার নিয়ে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসল ও। ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গকে দেখানোর জন্য ও যে প্রাচীন বর্ণগুলো লিখেছিল ওগুলো কেন্দ্রে রেখে একটা বৃত্ত আঁকল।
ওর চারপাশে এসে দাঁড়াল বাকি সবাই। তবে গ্রের দৃষ্টি শুধু লিসার দিকে। গ্রে যে উত্তরটা পেয়েছে সেটার কোনো মানে ওর জানা নেই। কিন্তু এতটুকু বুঝতে পেরেছে এটা হলো তালা আর লিসা যেহেতু বেল সম্পর্কে ধারণা রাখে তাই সে হলো চাবি। ওদের দুজনকে একসাথে কাজ করতে হবে।
আবার সেই প্রাচীন বর্ণ, বলল লিসা।
ব্যাখ্যা শোনার জন্য লিসার দিকে গ্রে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
মেঝের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল লিসা। আমি এর আগে ভিন্ন ধরনের বর্ণ দেখেছি। ওগুলো রক্তে আঁকা ছিল। উচ্চারণ করলে দাঁড়াল : Schwarze Sonne.
ব্ল্যাক সান। কালো সূর্য। গ্রে অনুবাদ করল।
নেপালে আনার প্রজেক্টের নাম ছিল এটা।
কথাটা গুরুত্ব সহকারে নিলো গ্রে। নিচের ওয়ার্কস্টেশনে দেখে আসা কালো সূর্যের প্রতীকের কথা ভাবল ও। হিমল্যারের মূল সংঘটি নিশ্চয়ই যুদ্ধের পর ভেঙে গিয়েছিল। অ্যানার দল গিয়েছিল উত্তরে। ব্যালড্রিক দক্ষিণে। আলাদা হওয়ার পর দূরত্ব বাড়তে বাড়তে পরিস্থিতি এমন পর্যায় চলে গেল যে একসময়ের মিত্র হয়ে গেল শত্রু।
মেঝেতে আঁকা বর্ণগুলোর ওপর টোকা দিলো লিসা। আমি সেই রক্তে আঁকা বর্ণগুলোর অর্থ একটু এদিক-ওদিক করে খুব সহজেই বের করেছিলাম। এটাও কী সেরকম কিছু?
গ্রে মাথা নাড়ল। আপনার মতো ব্যালড্রিকও একইভাবে চিন্তা করেছিল। আর সেজন্যই এতদিনেও সফল হতে পারেনি। গুরুতর গোপন কোনো তথ্যকে হিউগো সাহেব এত হালকাভাবে লুকিয়ে রাখবেন না।
আচ্ছা, এটা যদি কোড না হয়, তাহলে কী? মনক প্রশ্ন করল।
জিগস পাজল।
কী?
রায়ানের বাবার সাথে আমরা যখন কথা বলেছিলাম, মনে আছে?
মনক মাথা নাড়ল, আছে।
তিনি বলেছিলেন, একটু অদ্ভুত প্রকৃতির ছিলেন তার দাদা। উদ্ভট বিষয়গুলো নিয়ে পড়ে থাকতেন, ঐতিহাসিক রহস্যগুলো নিয়ে তার ব্যাপক আগ্রহ ছিল।
আর সে কারণেই তিনি নাৎসিতে যোগ দিয়েছিলেন। বলল ফিওনা।
অবসর সময়েও তিনি নিজেকে বিশ্রাম দিতেন না। ধাঁধা, জিগস পাজল, মগজের খেলা নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। এই বর্ণগুলো তেমনি এক মগজের খেলা। কোড নয়,.. জিগস পাজল। বর্ণগুলোকে এদিক-ওদিক সরিয়ে, ঘুরিয়ে, সাজিয়ে সমাধান করতে হবে।
বিগত দিন জুড়ে গ্রে এই বর্ণগুলোকে ওর মাথায় এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে সাজানোর চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করতে করতে একটা নির্দিষ্ট আকৃতি পাওয়ার সময় ক্ষান্ত দিয়েছে ও। এখন ও উত্তরটা জানে। বিশেষ করে, হিউগো সাহেবের জীবনের শেষ অংশ জানার পর উত্তরটার ওপর ওর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়েছে। নাৎসিদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য আফসোস করেছিলেন হিউগো। কিন্তু কেন? মানে কী? লিসার দিকে তাকাল গ্রে।
বর্ণগুলোকে গ্রে আবার মেঝেতে আঁকল। তবে এবার পাশাপাশি না একে একটু ভিন্নভাবে আঁকল ও। জিগস পাজলের সমাধান এটা।
অন্ধকার থেকে আলোর জন্ম।
পাপ থেকে প্রায়শ্চিত্তের পথ।
অপবিত্র থেকে পবিত্রকরণ।
পেগান ধর্মের বর্ণগুলো ব্যবহার করে নিজের আসল রূপ প্রকাশ করেছেন হিউগো।
এটা তো একটা স্টার, বলল মনক।
লিসা চোখ তুলল। কোনো সাধারণ তারকা নয়… এটা হলো স্টার অফ ডেভিড। (ডেভিড–বাইবেলের একটি চরিত্র। জুদাহ রাজ্যের দ্বিতীয় রাজা।)
মাথা নাড়ল গ্রে।
এই মুহূর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি করল ফিওনা। কিন্তু এটার মানে কী?
গ্রে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমি জানি না। আমি এটাও জানি না এই স্টারের সাথে বেল-এর কী সম্পর্ক কিংবা এটা কীভাবে এই ডিভাইসের সাথে নিখুঁত করার কাজ করে। হতে পারে এটা হিউগোর শেষ বার্তা। নাৎসিদের সাথে কাজ করলেও তিনি তাঁর আসল পরিচয়টা হয়তো পরিবারকে জানাতে চেয়েছিলেন।
অ্যানার শেষ কথাটা মনে পড়ল গ্রের।
আমি নাৎসি নই।
হিউগো কী এই বর্ণগুলো দিয়েও একই কথা জানাতে চেয়েছেন?
না, তীক্ষ্ণ স্বরে বলল লিসা। যদি আমরা এটার সমাধান করতে চাই তাহলে আমাদেরকে উত্তরের দেখানো পথে কাজ করতে হবে।
লিসার চোখে কী যেন দেখতে পেল গ্রে। একটু আগে সেটা ছিল না।
আশা।
অ্যানার মতে, বলল লিসা, একটা বাচ্চা নিয়ে হিউগো একা একা বেল চেম্বারে ঢুকেছিলেন। তাঁর সাথে কোনো বিশেষ যন্ত্র ছিল না। পরীক্ষা শেষ করে দেখা গেল তার এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়েছে। প্রথমবারের মতো সূর্যের বীর-এর জন্ম হয়েছিল তখন।
ভেতরে ঢুকে কী করেছিলেন তিনি? ফিওনা প্রশ্ন করল।
স্টার অফ ডেভিডে টোকা দিলো লিসা। ওটার সাথে কোনো না কোনোভাবে এটা জড়িত। কিন্তু আমি এই চিহ্নের সঠিক মর্মার্থটা ধরতে পারছি না।
তবে গ্রে পেরেছে। তরুণ বয়সে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক বিষয় ও ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করেছে গ্রে। এছাড়াও সিগমার ট্রেনিং নেয়ার সময়ও সেই জ্ঞানগুলো আরেকবার ঝালাই হয়েছিল। এই স্টারের মানে, নানা রকম। এটা প্রার্থনা ও বিশ্বাসের প্রতীক। তারচেয়ে বেশিও হতে পারে। খেয়াল করে দেখুন ৬টা শীর্ষের কী অবস্থা। প্রত্যেকটা একে অন্যের বিপরীত দিক নির্দেশ করছে। একটা উপরের দিকে, আরেকটা নিচের দিকে। ইহুদিদের কেবলা অনুযায়ী… স্টারে থাকা দুটো ত্রিভুজ ইন ও ইয়াং, আলো ও আঁধার, শরীর ও আত্মা নির্দেশ করে। একটা ত্রিভুজ নির্দেশ করে বস্তু ও শরীরকে। আর আরেকটা নির্দেশ করে আত্মা, আধ্যাত্মিক জগৎ আর মনকে।
আর সবমিলিয়ে, দুটো জিনিস দাঁড়ায়। বলল লিসা। শুধু কণা কিংবা তরঙ্গ নয়… দুটোই… একসাথে।
গ্রে বুঝতে বুঝতেও ঠিক বুঝতে পারছে না। কী?
ব্লাস্ট চেম্বারের দিকে তাকাল লিসা। অ্যানা বলেছিলেন বেল হচ্ছে একধরনের কোয়ান্টাম পরিমাপক যন্ত্র। বেল দিয়ে বিবর্তনে প্রভাব ফেলা যায়। কোয়ান্টাম বিবর্তন। এসব কিছুই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিষয়। চাবি এটাই।
ভ্রু কুঁচকাল গ্রে। মানে কী?
অ্যানা লিসাকে যা শিখিয়েছিলেন সেটা জানালো লিসা। জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের ওপর পর্যাপ্ত পড়াশোনা করা আছে গ্রের। স্রেফ একটু বিস্তারিত জানার দরকার ছিল। চোখ বন্ধ করে স্টার অফ ডেভিড আর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মধ্যে ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টা করল গ্রে। এই দুটোর মধ্যে কী উত্তরটা আছে?
আপনি বললেন, হিউগো শুধু সেই বাচ্চাটাকে নিয়ে চেম্বারে ঢুকেছিল? প্রশ্ন করল গ্রে।
হ্যাঁ, লিসা নরমভাবে জবাব দিলো। ও বুঝতে পারল গ্রেকে চিন্তা-ভাবনা করতে দিতে হবে। প্রয়োজন আছে।
মনোযোগ দিলো গ্রে। হিউগো সাহেব ওকে তালা দিয়েছেন। লিসা চাবি দিয়েছে। এবার ওর পালা। যাবতীয় চাপ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মনকে এপর্যন্ত পাওয়া সব তথ্য, উপাত্ত, সূত্র পর্যালোচনা করার সুযোগ দিলো ও। তথ্য, উপাত্ত পরীক্ষা করছে, প্রয়োজনে বাতিলও করে দিচ্ছে।
এ যেন হিউগোর আরেকটা জিগস পাজল।
স্টার অফ ডেভিডকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে অবশেষে ওর মাথায় আসল বিষয়টা উদয় হলো। এত পরিষ্কার, এত নিখুঁত। বিষয়টা আরও আগে মাথায় আসা উচিত ছিল।
চোখ খুলল গ্রে।
ওর চেহারায় লিসা কিছু একটা দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী?
উঠে দাঁড়াল গ্রে। বেল চালু করুন, কনসোলের পাশ দিয়ে এগোলো ও, এক্ষুনি!
লিসা ওর পিছু পিছু এগোলো। বেল চালু করবে। প্রশমনকারী পালস্-এ পৌঁছুতে চার মিনিট লাগবে। কাজ করতে করতে গ্রের দিকে তাকাল লিসা। আমরা কী করছি?
গ্রে বেল-এর দিকে ফিরল। হিউগো কোনো যন্ত্র ছাড়াই চেম্বারে ঢুকেছিলেন।
কিন্তু সেটা অ্যানার বক্তব্য…।
না। লিসাকে থামিয়ে দিলো গ্রে। তিনি স্টার অফ ডেভিডকে সাথে নিয়ে ঢুকেছিলেন। প্রার্থনা ও বিশ্বাস নিয়ে ঢুকেছিলেন তিনি। আর সবচেয়ে বড় কথা তার সাথেই নিজস্ব কোয়ান্টাম কম্পিউটার ছিল।
কী?
দ্রুত বলতে শুরু করল গ্রে। চেতনা বিষয়টা বিজ্ঞানীদেরকে শত বছর ধরে ঘোল খাইয়ে আসছে। সেই ডারউইন থেকে শুরু করে…। চেতনা জিনিসটা কী? সেটা কী শুধুই আমাদের মস্তিষ্ক? নার্ভ ফায়ার করে চলেছে? মস্তিষ্ক আর মনের মাঝে সীমারেখাটা কোথায়? জাগতিক আর আধ্যাত্মিক-এর সীমানা কোনটা? দেহ আর আত্মার সীমা কী?
চিহ্নের দিকে নির্দেশ করল গ্রে।
বর্তমান গবেষণা বলছে সবকিছু ওখানে। আমরা দুটোই। কণা ও তরঙ্গ; দুটোই আমরা। দেহ ও আত্মা। আমাদের জীবনটাই একটা কোয়ান্টাম ঘটনা কিংবা বিষয়।
খুব ভাল কথা। কিন্তু তোমার কথা সব আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে, মনক নিজের মতামত জানালো।
গভীর দম নিলো গ্রে, উত্তেজিত। আধুনিক বিজ্ঞান আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে বাতিল করে দিয়েছে। বিজ্ঞান অনুযায়ী, আমাদের মস্তিষ্ক একটা জটিল কম্পিউটার ছাড়া কিছুই নয়। নিউরনের (স্নায়ুকোষ) ফায়ারিঙের ফলে আমাদের চেতনা জাগ্রত থাকে। সহজ ভাষায় বললে, আমাদের ব্রেন একটা নিউর্যাল-নেট কম্পিউটার যেটা কোয়ান্টাম লেভেলে চালিত হয়।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার, বলল লিসা। আপনি বিষয়টা ইতোমধ্যে একবার বলেছেন। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার জিনিসটা কী এবার সেটা বলুন।
আপনি দেখেছেন কম্পিউটার কোডগুলোকে একদম বেসিক পর্যায়ে নিলে কী দেখা যায়। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জিরো আর ওয়ান। এই শূন্য আর এক দিয়ে আধুনিক কম্পিউটার চিন্তা করে থাকে। একটা সুইচ বন্ধ নাকি চালু। শূন্য কিংবা এক। তাত্ত্বিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার… যদি সেটা তৈরি করা সম্ভব হতো তাহলে সেখানে তৃতীয় একটা অপশন থাকত। শূন্য বা এক, সাথে তৃতীয় অপশন। শূন্য ও এক দুটোই।
কোয়ান্টাম দুনিয়ার ইলেকট্রনের মতো। সেগুলো কণা হতে পারে, তরঙ্গ হতে পারে আবার একই সাথে দুটোই হতে পারে।
তৃতীয় অপশন, মাথা নেড়ে গ্রে বলল, এটা শুনতে খুব একটা সুবিধের মনে না হলেও এই অপশনটাকে যদি কম্পিউটারে যোগ করা যেত তাহলে একই সাথে একাধিক অ্যালগরিদম কার্য সম্পাদন করা সম্ভব হতো।
কিছুই বুঝতে পারছি না। পকেটে চুইংগাম নেই, নইলে ওটা চিবিয়ে সময় কাটাতাম। বিড়বিড় করল মনক।
যে কাজগুলো করতে আধুনিক কম্পিউটারগুলো বছর বছর সময় নেয় সেগুলো কয়েক সেকেন্ডে করা সম্ভব হতো তখন।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মতো আমাদের ব্রেন এই কাজ করে? লিসা বলল।
বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন… জটিল নিউরন সংযোগের মাধ্যমে আমাদের ব্রেন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করতে সক্ষম। কয়েকজন বিজ্ঞানীর ধারণা সেই ফিল্ডের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্ক কোয়ান্টাম দুনিয়ায় সংযোগ ঘটাতে পারে। ফিল্ডটা একটা সেতু হিসেবে কাজ করে থাকে।
আর কোয়ান্টাম বিষয় নিয়ে বেল খুবই সংবেদনশীল, বলল লিসা। সেজন্য হিউগো নিজেও বাচ্চাটির সাথে বেল চেম্বারে ঢুকেছিলেন যাতে এক্সপেরিমেন্টের ফলাফলে নিজে প্রভাব ফেলতে পারেন।
দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করলে অনেককিছু দেখতে অন্যরকম লাগে। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টাকে আরও বড় বলে মনে হয়। স্টার অফ ডেভিডের দিকে তাকাল গ্রে। এটা কেন? প্রার্থনার প্রতীক কেন?
লিসা মাথা নাড়ল, জানে না।
প্রার্থনা জিনিসটা কী? মনকে একাগ্রচিত্তে আনা, চেতনা জাগ্রত করা… আর চেতনা যদি কোয়ান্টাম বিষয় হয় তাহলে প্রার্থনা করাটাও কোয়ান্টাম বিষয়।
এবার লিসা বুঝতে পেরেছে। আর কোয়ান্টাম সংবেদনশীল হওয়ায় সেটাকে পরিমাপ করে ফলাফলে অবশ্যই প্রভাব ফেলবে।
সহজে বললে…গ্রে থামল।
উঠে দাঁড়াল লিসা। প্রার্থনা কাজ করে।
ঠিক এই বিষয়টাই আবিষ্কার করেছিলেন হিউগো। বইগুলোর ভেতরে এটাই লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। বিষয়টা খুবই ভয়ঙ্কর আর খুব সুন্দরও।
লিসার পাশে কনসোলের ওপর ঝুঁকল মনক। তারমানে তুমি বলতে চাচ্ছো, হিউগো সাহেব প্রার্থনা করেছিলেন বাচ্চাটা যাতে নিখুঁত হয়?
গ্রে মাথা নাড়ল। বাচ্চাটিকে নিয়ে হিউগো সাহেব চেম্বারে ঢোকার পর নিখুঁত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। চিন্তা, চেতনা একত্র করে…. একাগ্রচিত্তে, নিঃস্বার্থভাবে, খাঁটি মনে প্রার্থনা করেছিলেন তিনি। মানুষ যখন প্রার্থনা করে তখন তার চেতনা একটা নিখুঁত কোয়ান্টাম পরিমাপক যন্ত্র হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। আর বেল-এর ভেতরে থাকা অবস্থায় বাচ্চাটির সম্ভাবনা পরিমাপ করা হচ্ছিল কিন্তু হিউগো তার প্রার্থনা ও চেতনার সাহায্যে বাচ্চাটিকে একদম নিখুঁত করতে সক্ষম হোন। একটা নিখুঁত জেনেটিক ছক তৈরি হয়।
ঘুরল লিসা। তাহলে আমরাও সেভাবে পেইন্টারের কোয়ান্টাম ক্ষতিকে উল্টোদিকে চালিত করতে পারব।
নতুন একটা কণ্ঠ ভেসে এলো। মারশিয়ার। তিনি মেঝেতে বসে পেইন্টারের সেবা করছেন। যা করার তাড়াতাড়ি করুন।
.
বিকাল ৩টা ৩২ মিনিট।
একটা তেরপলে করে পেইন্টারকে ব্লাস্ট চেম্বারের ভেতরে নিয়ে গেল।
ওকে বেল-এর কাছে রাখুন। বলল লিসা।
ওরা লিসার কথামতো কাজ করল। বেল ইতোমধ্যে ঘুরতে শুরু করেছে। বেল এর ব্যাপারে গানথার একটা কথা বলেছিল সেটা মনে পড়ল লিসার। বেল একটা মিক্সমাস্টার। ভালই বলেছিল গানথার। বেল-এর বাইরের সিরামিক শেল থেকে অল্প করে আলোর দ্যুতি বের হচ্ছে এখন।
পেইন্টারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল লিসা। ক্রোকে পরীক্ষা করে দেখল।
আমি আপনার সাথে থাকতে পারি, লিসার কাঁধে হাত রেখে বলল গ্রে।
না। একাধিক কোয়ান্টাম কম্পিউটার থাকলে ফলাফল বিগড়ে যেতে পারে।
অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট, সায় দিলে মনক।
তাহলে আপনি যান, আমি থাকি স্যারের সাথে। গ্রে প্রস্তাব দিলো।
মাথা নাড়ল লিসা। আমাদের হাতে মাত্র একটাই সুযোগ আছে। ঠিকভাবে একাগ্রতার সাথে প্রার্থনা না করলে পেইন্টারকে সুস্থ করা সম্ভব হবে না। আর কাজটা একজন মেডিক্যাল ডাক্তার করলেই বোধহয় বেশি ভাল হয়।
মেনে নিলো গ্নে।
আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদেরকে উত্তরটা জানিয়েছেন, আশার আলো দেখিয়েছেন। গ্রের দিকে তাকাল লিসা। এবার আমাকে আমার কাজ করতে দিন।
গ্রে মাথা নেড়ে সরে গেল।
লিসার দিকে ঝুঁকল মনক। কী প্রার্থনা করছেন সেটার ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকবেন। বলল ও। কথাটার পেছনে একধরনের ভয় কাজ করছিল ওর।
গ্রে আর মনক বেরিয়ে এলো বেল চেম্বার থেকে।
মারশিয়া কনসোল থেকে ঘোষণা করলেন, এক মিনিটের মধ্যে পালস পাওয়া যাবে।
ঘুরল লিসা। ব্লস্ট শিল্ড তুলে দিন।
পেইন্টারের ওপর ঝুঁকল লিসা। ক্রোর চামড়া এখন নীল হয়ে আছে, হয়তো বেল-এর আলোর কারণে এরকম দেখাচ্ছে এখন। এক অন্তিম মুহূর্তে আছে ক্রো। ঠোঁট ফেটে গেছে, শ্বাস নিচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে, ওর হৃদপিণ্ড আর ধকধক করছে না… এখন যেরকম আওয়াজ করছে সেটা অনেকটা গুঞ্জনের মতো। চুলের অবস্থাও খারাপ। চুলের গোড়াগুলো বরফ-সাদা দেখাচ্ছে। খুব করুণ অবস্থা পেইন্টারের।
লিসার চারপাশে ব্লাস্ট শিল্ড উঠতে শুরু করল। বাকি সবার থেকে আলাদা করে ফেলছে ওদের দুজনকে। ধীরে ধীরে শিল্ড উঠে গিয়ে ছাদের সাথে গিয়ে ঠেকল।
লকড।
ওদের দুজনকে এখন আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না। পেইন্টারের বুকে কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে লিসা। প্রার্থনা করার জন্য বিশেষ কোনো পন্থা অবলম্বন করার প্রয়োজন নেই ওর। একটা কথা আছে, খুব বেকায়দায় পড়লে নাকি কেউ-ই আর নাস্তিক থাকে না। বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটা সেরকম। তবে লিসা জানে না ঠিক কোন ঈশ্বরের কাছে ও প্রার্থনা করবে।
বিবর্তন ও ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন সম্পর্কে অ্যানার কথাগুলো লিসার মনে পড়ল। তার ভাষ্য অনুযায়ী কল্পনা করল লিসা।
অ্যামিনো অ্যাসিড… প্রথম প্রোটিন… প্রথম জীবন… চেতনা
কিন্তু চেতনা-এর পর কী আছে? এভাবে কতদূর? শেষটা কোথায়?
অ্যামিনো অ্যাসিড… প্রথম প্রোটিন… প্রথম জীবন… চেতনা…???
অ্যানার আরেকটা কথা মনে পড়ল লিসার। এই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় ঈশ্বরের হাত কোথায় ও জানতে চেয়েছিল। জবাবে অ্যানা বলেছিলেন, আপনি ভুল দিকে, ভুল দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবছেন। লিসা তখন ভেবেছিল মহিলা হয়তো শান্তিতে ভুল বকছে। কিন্তু এখন ওর মনে হচ্ছে, অ্যানার মনেও হয়তো একই প্রশ্ন জেগেছিল। বিবর্তনের শেষে কী আছে? কী হবে? কোনো একটা নিখুঁত কোয়ান্টাম পরিমাপক যন্ত্র থাকবে তখন?
আর যদি তাই হয়, তাহলে সেটাই কী ঈশ্বর?
লিসা পেইন্টারের বুকে মাথা রেখেছে, ওর কাছে এসবের কোনো জবাব নেই। ও শুধু এতটুকুই জানে পেইন্টারকে জীবিত দেখতে হবে। হয়তো অন্য সবার আড়ালে লিসা নিজের আবেগ, অনুভূতি আর ভালবাসাকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে কিন্তু নিজের কাছ থেকে নিজের কাছ থেকে আর ওগুলোকে লুকোতে পারবে না।
নিজের হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিলো লিসা। যত আবেগ আছে সব বেরিয়ে আসতে দিলো। বেল-এর গুঞ্জন আর আলো বাড়ছে। বাড়ক।
হয়তো এতদিন এই বিষয়টাই ওর জীবনে অনুপস্থিত ছিল। এজন্য হয়তো পুরুষ মানুষকে ওর কাছে অত ইন্টারেস্টিং লাগতো না। কোনো সম্পর্ক টিকাতে পারছিল ও। কারণ, পেশাগত ব্যস্ততা আর বাহ্যিক সৌজন্যতাবোধের আড়ালে ও নিজের হৃদয়কে, নিজের মনকে আড়াল করে রেখেছিল। তাই এত বয়স হয়ে যাওয়ার পরও পাহাড়ের ওপরে পেইন্টার যখন ওর জীবনে আসে তখনও একা ছিল ও। কোনো জীবনসঙ্গী ছিল না।
কিন্তু আর একা থাকা নয়।
মাথা উঁচু করল লিসা, সামনে সরাল। আস্তে করে চুমো খেলো পেইন্টারের ঠোঁটে। এই আবেগটাই লুকিয়ে রেখেছিল ও।
আর দশ সেকেন্ডের মধ্যে বেল ডিসচার্জ করবে। চোখ বন্ধ করল লিসা। মন খুলে প্রার্থনা করতে শুরু করল পেইন্টারের জন্য। সুন্দর ভবিষ্যৎ, সুস্থ-সবল দেহ আর ওর সাথে আরও কিছু সময় কাটানোর জন্য প্রার্থনা করল।
এটাই কী বেল-এর বিশেষ দিক? একটা কোয়ান্টাম নালার ভেতর দিয়ে কোয়ান্টাম পরিমাপক যন্ত্রকে বিবর্তনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেয়া, মূল নকশাকারীর সাথে একটা ব্যক্তিগত সংযোগস্থাপন করা।
লিসা জানে ওকে কী করতে হবে। নিজের ভেতরে থাকা বিজ্ঞানমনস্ক সত্তা ও নিজের সহজাত স্বভাবকে দূর করে দিলো। চেতনা কিংবা প্রার্থনা নয়…
এটা স্রেফ বিশ্বাস আর আস্থার বিষয়।
এরকম মুহূর্তে চোখ ধাঁধানো আলো বিচ্ছুরিত হলো বেল থেকে। লিসা আর পেইন্টারকে একত্রিত করে দিলো সেটা। বাস্তবতা রূপান্তরিত হতে শুরু করল নিখুঁত সম্ভাবনায়।
.
বিকাল ৩টা ৩৬ মিনিট।
সুইচ চাপল গ্রে, শিল্ড নিচে নামতে শুরু করল। দম নিতে ভুলে গেল সবাই। কী দেখতে পাবে ওরা? মোটরের গুঞ্জন থেমে গেছে। সবাই শিন্ডের দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
চিন্তিত চোখে ওর দিকে তাকাল মনক।
নিস্তবতার মাঝে ছোট্ট তীক্ষ্ণ একটা শব্দ আসছে বা পাশ থেকে। ধীরে ধীরে ব্লাস্ট চেম্বার দেখতে পেল ওরা। বেল এখন চুপ করে রয়েছে। অন্ধকার, স্থির হয়ে আছে। এরপরে ওরা লিসাকে দেখতে পেল। পেইন্টারের ওপর ঝুঁকে আছে সে। ওর পিঠটা ওদের দিকে ঘোরানো।
কেউ কিছু বলল না।
আস্তে আস্তে ঘুরল লিসা। মাথা তুলল। ওর চোখের পানি গড়িয়ে গাল ভিজিয়ে দিয়েছে। পেইন্টারকে ধরে তুলল ও। পেইন্টারকে দেখতে এখনও আগের মতো ফ্যাকাসে আর দুর্বল লাগছে। তবে সে ঠিকই গ্রেকে চিনতে পারল।
চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও সজাগ।
স্বস্তির পরশ বয়ে গেল গ্রের শরীরে।
সেই তীক্ষ্ণ শব্দটা শোনা গেল আবার।
চট করে সেদিকে তাকাল পেইন্টার ক্রো… তারপর গ্রের দিকে ফিরল। ঠোঁট নাড়াল কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। ভাল করে শোনার জন্য ক্রোর কাছে এগিয়ে গেল গ্রে।
চোখ সরু করে কঠিন দৃষ্টিতে ক্রো ওর দিকে তাকাল। বলার চেষ্টা করল আবার। খুব নিচু লয়ে একটা শব্দ বেরোল এবার। কিন্তু সেটা অর্থবহ নয় বোধহয়। গ্রে ভাবল পেইন্টারের মানসিক অবস্থা পুরোপুরি ভাল নয়।
বোম… আবার বলল ক্রো।
এবার লিসাও ওর কথা শুনতে পেয়েছে। পেইন্টার যেদিকে তাকিয়েছিল সেদিকে তাকাল ও। ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গের লাশ রয়েছে ওখানে। পেইন্টারকে নিয়ে মনকের দিকে এগোল লিসা।
ওকে ধরুন।
বুড়ো ওয়ালেনবার্গের দিকে এগোল ও। ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গ অবশেষে তার। দেহ শ্রাগ করেছেন।
লিসার সাথে গ্রেও যোগ দিলো।
হাঁটু গেড়ে বসল লিসা, বুড়োর হাতা সরাল। কব্জিতে বড় একটা ঘড়ি পরে আছেন ব্যালড্রিক। ঘড়িটা নিজের দিকে ঘোরাল লিসা। ডিজিটাল ফরম্যাটে সেকেন্ড কাউন্ট ডাউন হচ্ছে।
আমরা এর আগেও এটা দেখেছি, বলল লিসা। হৃদপিণ্ডের সাথে মাইক্রোট্রান্সমিটার জুড়ে দেয়া থাকে। হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেলেই উল্টোদিকে কাউন্ট শুরু হয়।
ব্যালড্রিকের কব্জি মোচড় দিলো লিসা, যাতে গ্রেও ঘড়িতে ওঠা নাম্বারগুলো দেখতে পায়।
০২:০১ সেকেন্ড।
গ্রে আরও এক সেকেন্ড কমে গেল। পরিচিত তীক্ষ্ণ আওয়াজটাও শোনা গেল আবার।
০২:০০ মিনিট।
আমাদের হাতে দুই মিনিটের মতো সময় আছে। তার মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। বলল লিসা।
সবাই বেরিয়ে পড়ুন! মনক, রেডিওতে খামিশিকে ডাকো! তাকে বলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে যেন তার লোকজন নিয়ে ভবনের কাছ থেকে দূরে যায়। গ্রে নির্দেশ দিলো।
কথামতো কাজ করতে শুরু করল মনক।
ছাদে একটা হেলিকপ্টার আছে, লিসা জানালো।
মুহূর্তের মধ্যে ছুটল সবাই। মনকের কাছ থেকে পেইন্টারকে নিলো গ্রে। মশি মেজরকে সাহায্য করছেন। ওদের পিছু পিছু এগোলো লিসা, ফিওনা আর মারশিয়া।
গানথার কোথায়? ফিওনা জানতে চাইল।
সে তার বোনকে নিয়ে চলে গেছে। জবাব দিলো মেজর।
গানথারকে খোঁজার সময় নেই। লিফট দেখাল গ্রে। মনকের দল লিফটের দরজায় চেয়ার ঢুকিয়ে রেখেছিল যাতে দরজা বন্ধ হতে না পারে। ফলে লিফটটাকে কেউই ব্যবহার করতে পারেনি। মশি এক হাতে চেয়ারটাকে টান দিয়ে বের করে হলের দিকে ছুঁড়ে মারলেন।
ভেতরে ঢুকল সবাই।
উপরের বাটনে লিসা চাপ দিলো। সাত তলা। ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করল লিফট।
মনক বলতে শুরু করল। উপরে আমি আমার লোককে রেডিওতে খবর জানিয়ে দিয়েছি। সে কপ্টার উড়াতে পারে না তবে ইঞ্জিন চালু করে গরম রাখতে পারবে।
বোম, বলল যে, লিসার দিকে ফিরল ও। বিস্ফোরণটা কীরকম হতে পারে?
হিমালয়তে যেরকম দেখে এসেছি এটাও যদি সেরকম হয় তাহলে ব্যাপক বিস্ফোরণ হবে। জেরাম-৫২৫ দিয়ে এরা কোয়ান্টাম বোম টাইপের কিছু একটা বানিয়েছে।
নিচের ভূগর্ভস্থ লেভেলে থাকা ট্যাংকগুলোর কথা গ্রের মনে পড়ে গেল।
সর্বনাশ…
লিফট ধীরে ধীরে উপরে উঠছে।
পেইন্টার এখনও দুর্বল। নিজের ওজন বহন করতে অক্ষম। তবে গ্রের চোখে ঠিকই। চোখ রাখল সে। পরেরবার…ভাঙা স্বরে বলল, … তুমি নিজে নেপালে যাবে।
হাসল গ্রে। পেইন্টার ক্রো ফিরেছে।
কিন্তু কতক্ষণের জন্য?
সাততলায় এসে পৌঁছুল লিফট, দরজা খুলে গেল।
এক মিনিট, বললেন মারশিয়া। মনে মনে সময়ের দিকে খেয়াল রাখছেন তিনি।
সিঁড়ি ধরে ছাদে পৌঁছে গেল সবাই। হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে ওদের জন্য। ব্লেড ঘুরছে। একে অপরকে সাহায্য করতে করতে এগোল সবাই। রোটরের নিচে পৌঁছুনোর পর পেইন্টারকে মনকের হাতে তুলে দিলো গ্রে। সবাইকে নিয়ে উঠে পড়ো।
অপরপাশে ঘুরে গিয়ে গ্রে পাইলটের সিটে গিয়ে বসল।
১৫ সেকেন্ড! জানিয়ে দিলেন মারশিয়া।
গ্রে ইঞ্জিনের স্পিড বাড়িয়ে দিলো। চিৎকার করে উঠল ব্লেডগুলো। কন্ট্রোল প্যানেল ব্যবহার করে গ্রে কপ্টারটাকে ছাদ থেকে শূন্যে তুলল। এর আগে কোনো জায়গা ছেড়ে চলে যেতে পেরে গ্রের এত খুশি লাগেনি। বাতাসে ভর করেছে কপ্টার। উপরে উঠে যাচ্ছে। বিস্ফোরণের প্রভাব থেকে বাঁচতে কতটা দূরে সরতে হবে ওদের?
আরও পাওয়ার যোগ করে ব্লেডের গতি বাড়িয়ে দিলো গ্রে।
উপরে উঠতে উঠতে গ্রে কপ্টারের নাকটাকে একটু নিচ দিকে রাখল। এস্টেটের ভূমিতে নজর ওর। জিপ, মোটরসাইল সবকটি ভবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
কাউন্ট ডাউন শুরু করলেন মারশিয়া। পাঁচ, চার…
কিন্তু তার হিসেবে একটু গলদ ছিল।
হঠাৎ ওদের নিচে দৃষ্টিশক্তি অন্ধ করে দেয়ার মতো আলো ঝলসে উঠল। মনে হলো ওরা যেন সূর্যের উপরে উড়ছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব: সুনসান নীরবতা। কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছে না। চোখে কিছু দেখতে না পারার ফলে গ্রে কপ্টারটাকে বাতাসে উড়িয়ে রাখতে খুব কসরত করছে। মনে হচ্ছে, বাতাসও নেই। ও টের পেল কপ্টার নিচ দিকে ছুটে যাচ্ছে।
তারপর হঠাৎ করেই শব্দ ও আলো দুটোই ফিরে এলো।
অনেকক্ষণ আকাশে খাবি খাওয়ার পর কপ্টারের নোটরগুলো অবশেষে আঁকড়ে ধরতে পারল বাতাসকে।
কপ্টারকে স্থির করল গ্রে, খুব ভয় পেয়েছে। ভবনটা যেখানে থাকার কথা সেদিকে তাকাল। কিন্তু ওখানে এখন একটা বড় গর্ত দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো বিশাল দৈত্য, বিরাটাকার চামচ দিয়ে ওখান থেকে মাটি তুলে নিয়েছে।
কিছু নেই ওখানে নেই কোনো ধ্বংসাবশেষ। শুধুই শূন্যতা।
গর্ত থেকে দূরে তাকাল গ্রে। দূরে সরতে থাকা যানবাহনগুলো থেমে দাঁড়িয়ে পেছন দিকে তাকাচ্ছে। অনেকে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে গর্তের দিকে। ওরা সবাই খামিশির সৈন্যবাহিনি। সবাই নিরাপদ। সীমানার কাছে দাঁড়িয়েছে জুলুরা। অনেকদিন আগে ওরা যেটা হারিয়েছিল আজ সেটা আবার ফিরে পেয়েছে।
ওদের ওপর দিয়ে গ্রে কপ্টার উড়িয়ে নিলো। নিখোঁজ একটা ড্রামের কথা মনে পড়ল ওর। ওতে জেরাম-৫২৫ আছে, আমেরিকার নাম লেখা ছিল ড্রামটায়। রেডিও অন করল ও। একগাদা সিকিউরিটি কোড জানিয়ে সিগমা কমান্ডে পৌঁছুতে হলো।
লোগ্যান-এর জায়গায় অন্য কারও কণ্ঠ শুনে অবাক হলো গ্রে। এখন কথা বলছেন শ্যেন ম্যাকনাইট, সিগমার সাবেক ডিরেক্টর। গ্রের শরীর দিয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল। ওখানে যা যা হয়েছে চটপট সবকিছু জানিয়ে দিলেন ম্যাকনাইট। সর্বশেষ খবরটা গ্রেকে বড়সড় ধাক্কা মারল।
অবশেষে রেডিওতে কথা বলা শেষ হলো। গ্রে স্তম্ভিত। সামনে ঝুঁকল মনক।
কী হয়েছে?
ঘুরল গ্রে।
মনক… বিষয়টা ক্যাট সংক্রান্ত।
.
বিকাল ৫টা ৪৭ মিনিট।
ওয়াশিংটন, ডি.সি।
তিন দিন কেটে গেছে। দীর্ঘ তিনটি দিন কেটে গেছে সাউথ আফ্রিকার বিষয়গুলোকে শেষ করতে।
জোহান্সবার্গ এয়ারপোর্ট থেকে ডিরেক্ট ফ্লাইটে চড়ে অবশেষে ডালেস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছে ওরা। মনক টার্মিনালেই বাকিদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। একটা ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে ছুটেছে ও। পার্কে কাছে গিয়ে জ্যামে পড়তেই মনকের ইচ্ছে হলো দরজা খুলে পায়ে হেঁটেই রওনা দেয়। কিন্তু নিজেকে সামাল দিলো ও। একটু পরে জ্যাম ঘোটার পর ট্যাক্সি আবার চলতে শুরু করল।
সামনে ঝুঁকল মনক। যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারো তাহলে ৫০ বাকস্ পাবে।
দুই মিনিটের মধ্যে মনক তার গন্তব্যে পৌঁছে গেল। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি হসপিটাল।
ড্রাইভারের দিকে এক মুঠো বিল ছুঁড়ে দিয়েই বেরিয়ে গেল মনক। অটোমেটিক দরজার সামনে গিয়ে ছটফট করছে… অটোমেটিক দরজাগুলো এত আস্তে আস্তে খোলে কেন! রোগী আর স্টাফদের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে হল দিয়ে ছুটল ও। আইসিইউ-এর কোন রুমে যেতে হবে ওর জানা আছে।
নার্সিং স্টেশনের পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটল ও, কয়েকজন চিৎকার করে থামতে বললেও ও সেগুলো কানে তুলল না।
আজকে আর কিছু শুনছি না…
কোণায় পৌঁছে মনক বেডটা দেখতে পেল। দৌড়ে গেল ও। শেষ মুহূর্তে হাটু গেড়ে বসল… ওর সোয়েটপ্যান্টের কারণে পিছলে একদম বিছানার পাশে পৌঁছে গেল। বেডের পাশে গিয়ে ধাক্কা খেল বেশ জোরেশোরে। এক চামচ সবুজ জেলি মুখে পুড়তে গিয়েও থমকে তাকাল ক্যাট। মনক…?
আমার পক্ষে যত আসা সম্ভব আমি চেষ্টা করেছি, মনক হাঁপাচ্ছে।
কিন্তু ৯০ মিনিট আগেও তো আমি তোমার সাথে স্যাটেলাইট ফোনে কথা বলেছি।
ওটা শুধু কথা বলা ছিল।
উঠল মনক, বিছানার ওপর ঝুঁকে ক্যাটের ঠোঁটে গভীরভাবে চুমো খেলো। বেচারির বা কাঁধ আর শরীরের উপরের অংশে ব্যান্ডেজে জড়ানো। হাসাপাতালের নীল গাউনের ফলে অর্ধেক ব্যান্ডেজ ঢাকা পড়ে গেছে। তিনটা বুলেট এসে ঢুকেছিল ওর শরীরে। ২ ইউনিট রক্তক্ষরণ, ক্ষত্রিস্ত ফুসফুস, ভেঙে যাওয়া কাঁধের হাড় আর কিছু ক্ষত নিয়ে ক্যাট এখনও বেঁচে আছে।
ক্যাট সত্যিই খুব ভাগ্যবতী।
লোগ্যান গ্রেগরির শবসৎকার অনুষ্ঠিত হবে আজ থেকে ৩ দিন পর।
তারপরও ক্যাট ও লোগ্যান ওয়াশিংটনকে সন্ত্রাসী আক্রমণের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছেড়েছে। ওয়ালেনবার্গের সেই আততায়ীকে খতম করে দিয়েছিল ওরা। নইলে অনেক ক্ষতি হয়ে যেত। সেই সোনার বেলটা এখন সিগমার রিসার্চ ল্যাবে শোভা পাচ্ছে। আর বেল-এর জন্য আসা জেরাম-৫২৫-এর জাহাজটাকে নিউ জার্সির শিপিং ইয়ার্ডে পাওয়া গিয়েছিল।
এই ফাঁকে আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিরা শিপমেন্টের সূত্র ধরে জানতে পেরেছে জেরামটা ওয়ালেনবার্গদেরই একটা কর্পোরেশন পাঠাচ্ছিল। তবে দীর্ঘক্ষণ রোদের আলোতে থাকার ফলে জেরাম-৫২৫ তার কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। জ্বালানি ছাড়া বেল চালানো অসম্ভব। তাই অন্যান্য দূতাবাস থেকে উদ্ধার করা বেলগুলো আর কখনই বাজবে না।
ভাল খবর।
পুরোনো আমলের বিবর্তনই মনকের পছন্দ।
ক্যাটের পেটের ওপর হাত বুলাল ও। প্রশ্নটা করতে ভয় পাচ্ছে।
তবে প্রশ্নটা ওকে করতে হলেও না। ক্যাট ওর হাতের ওপর হাত রাখল। আমাদের বাবু ভাল আছে। ডাক্তার বলেছেন, কোনো সমস্যা হবে না।
ক্যাটের পেটের ওপর মনক মাথা রাখল। চোখ বন্ধ করল ও। এক হাত দিয়ে ক্যাটের কোমরে হাত বুলাল, তবে আঘাতের কথা ভেবে সাবধানতা অবলম্বন করতে ভুলল না।
ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ক্যাট ওর গাল ছুঁয়ে দিলো।
পকেট হাতড়ে মনক একটা কালো বক্স বের করল। আংটির বক্স। বেচারা এখনও চোখ খোলেনি।
আমাকে বিয়ে করো। বলল ও।
ওকে।
ঝট করে চোখ খুলল মনক। যে নারীকে সে ভালবাসে তার দিকে তাকাল। কী?
বললাম তো ওকে।
তুমি শিওর?
তুমি কী চাও আমি মত বদলে ফেলি?
না, তোমাকে তো ওষুধ দিয়ে রেখেছে। থাক সুস্থ হও পরে জিজ্ঞেস করব…
আংটিটা দাও তো।বলতে বলতে মনকের হাত থেকে বক্সটা নিয়ে নিলো ক্যাট। খুলল। নিস্পলক তাকিয়ে থাকল খোলা বক্সের দিকে। এটা তো খালি!
মনক বক্সটা হাতে নিয়ে দেখল, কথা সত্য। ভেতরে কোনো রিং নেই!
মাথা নাড়ল বেচারা।
কী হয়েছে? ক্যাট জানতে চাইল।
মনক দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ফিওনা।
.
সকাল ১০ টা ৩২
পরদিন সকালে জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি হসপিটালের আরেকটি অংশে শুয়ে আছে পেইন্টার। একঘণ্টা ধরে সিটি স্ক্যান করা হয়েছে ওর। ও প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল, বিগত কয়েক দিনে খুব একটা বিশ্রাম করতে পারেনি। উদ্বেগে কাটিয়েছে রাতগুলো।
দরজা খুলে একজন নার্স ভেতরে প্রবেশ করল।
ওর পিছু পিছু ঢুকল লিসা।
পেইন্টার উঠে বসল। রুমটা বেশ ঠাণ্ডা। অথচ ওর পরনে একটা পাতলা হসপিটাল গাউন ছাড়া কিছুই নেই। ভদ্রতা ও সৌজন্যবশত নিজের গাউনটাকে একটু টানা-হেঁচড়া করল ক্রো… কিন্তু খুব একটা সুবিধে করতে না পেরে হাল ছেড়ে দিলো।
ওর পাশে এসে বসল লিসা। মনিটরিং রুমের দিকে মাথা নাড়ল ও। ওখানে একঝাক গবেষক রয়েছেন। জন হপকিন্স ও সিগমা থেকে এসেছেন তাঁরা। তাঁদের সবার নজর পেইন্টারের স্বাস্থ্যের ওপর।
অবস্থা ভাল।, বলল লিসা। সবকিছু প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তোমার হৃদপিত্রে ভালবে ছোটখাটো কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে… তবে সেটা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেরে ওঠার হার খুবই ভাল… অলৌকিক ব্যাপার।
তা তো বলতেই পারো। বলল ক্রো। কিন্তু এগুলো কী?
কানের ওখানে থাকা কয়েকটা পাকা চুলে হাত বুলাল ও।
লিসাও হাত বাড়িয়ে ওর চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে দিলো। পাকা চুল আমার ভাল লাগে। তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে।
ওর কথা বিশ্বাস করল ক্রো। প্রথমবারের মতো, একদম মনের গভীর থেকে ও বিশ্বাস করল… হ্যাঁ, ও ঠিক হয়ে যাবে। স্বস্তির শ্বাস ফেলল ও। বাঁচবে। ওর সামনে এখনও একটা জীবন আছে।
লিসার হাত ধরল ক্রো, হাতের তালু চুমো খেয়ে নামিয়ে রাখল। লজ্জায় লিসার চেহারা উদ্ভাসিত হলো, মনিটরিং জানালার দিকে তাকাল ও। তবে নার্সের সাথে বিভিন্ন কারিগরি বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেও ক্রোর কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো না।
পেইন্টার ওকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। নিজে একটা কেস তদন্ত করতে নেপালে গিয়েছিল পেইন্টার। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হতে হতে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক ঘুরে আসতে হয়েছে ওকে।
নিজের আঙুলগুলো দিয়ে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ক্রো।
লিসাকে পেয়েছে ও। বিগত কয়েকদিন ওরা অনেক কাছাকাছি ছিল। কিন্তু তারপরও একে অপরকে খুব একটা চেনে না। কে লিসা? ওর পছন্দের খাবার কী? কী শুনলে ও হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে? ওর সাথে নাচতে কেমন লাগবে? কিংবা রাতে গুড নাইট ও কীভাবে বলে? ফিসফিস করে? সেটা শুনতে কেমন লাগবে?
পেইন্টার ওর পাশে গাউন পরে বসে রইলেও আসলে নগ্ন হয়ে রয়েছে। কারণ হৃদয়-মন থেকে শুরু করে ডিএনএ পর্যন্ত খুলে রেখেছে ও।
লিসার সবকিছু ও জানতে চায়।
.
২টা ২২ মিনিট।
দুই দিন পর। জাতীয় কবরস্থান।
রাইফেল থেকে শেষ গুলি ছোঁড়া হলো আকাশের দিকে। লোগ্যান গ্রেগরির শবসৎকার অনুষ্ঠান আজ।
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর একপাশে সরে দাঁড়াল গ্রে। দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে এই কবরস্থানে ঠাই হয়েছে অনেকের। অথচ কেউ তাদের নামটাও জানতে পারে না।
লোগ্যান গ্রেগরি এখন তাদের একজন। একজন অপরিচিত ব্যক্তি। খুব কম লোকই তার বীরত্বপূর্ণ মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পারবে। সবাইকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার বীরত্বগাঁথা লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যাবে আজীবন।
গ্রে দেখল ভাইস প্রেসিডেন্ট লোগ্যানের মায়ের হাতে একটা ভাজ করা পতাকা তুলে দিচ্ছেন। লোগ্যানের বাবাও আছেন সাথে। লোগ্যান গ্রেগরির কোনো স্ত্রী, সন্তান ছিল না। সিগমা-ই ছিল তার জীবন… আর মরণ।
সান্ত্বনার বাণী দেয়া শেষ হওয়ার পর ধীরে ধীরে কবরস্থান ফাঁকা হয়ে গেল।
পেইন্টারের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল গ্রে। ক্রো একটা লাঠিতে ভর করে এগিয়ে আসছে। যত দিন যাচ্ছে সুস্থ ও শক্তিশালী হয়ে উঠছে সে। ড, লিসা আছে তাঁর পাশে। ক্রোর একটা কনুই ধরে এগোচ্ছে। না, পেইন্টারকে এখন আর ধরে রাখতে হয় না, লিসা স্রেফ ওর সংস্পর্শে আছে।
মনককে সাথে নিয়ে ওরা সবাই অপেক্ষমাণ গাড়িগুলোর দিকে এগোল।
ক্যাট এখনও হাসপাতালে। শবসকার অনুষ্ঠানে আসার মতো অবস্থা নেই ওর।
পার্কিং করা গাড়িগুলোর কাছে গিয়ে পেইন্টারের দিকে এগোল গ্রে। কয়েক বিষয় নিয়ে ওদের আলোচনা করতে হবে।
ডিরেক্টরের গালে চুমো দিলো লিসা। তোমরা কথা বলো। ওখানে গিয়ে দেখা হবে। মনকের সাথে রয়ে গেল সে। ওরা দুজন অন্য একটা গাড়িতে চড়ে গ্রেগরির বাসায় যাবে। কয়েকজন লোক আসছেন সেখানে।
গ্রে যখন জানতে পারল লোগ্যানের বাবা-মা ওর বাবা-মায়ের বাসার মাত্র কয়েক ব্লক পাশেই বাস করছেন তখন অবাক না হয়ে পারেনি। বুঝতে পারল, একসাথে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করলেও লোগ্যান সম্পর্কে জানাশোনা কত কম ছিল।
গাড়ির দরজা খুলে পেছনের সিটে বসল পেইন্টার।
গ্রে, তোমার রিপোর্ট পড়েছি, ইন্টারেস্টিং। রিপোর্টটাকে ফলো-আপ করো। তবে সেটার জন্য ইউরোপে আরেকবার ঢু মারতে হবে।
ব্যক্তিগত কাজেও আমাকে ওখানে যেতেই হতো। সেজন্যই আমি আলোচনা করতে এসেছি। অতিরিক্ত কয়েকটা দিন হাতে পেলে ভাল হয়।
এক ভ্রু উঁচু করল পেইন্টার। আবার আরেকটা ছুটি হয়তো দেয়া সম্ভব হবে না।
গ্রেও বিষয়টা বুঝতে পারল।
একটু নড়ল পেইন্টার… এখনও হালকা অসুস্থ আছে। ড. মারশিয়া ফেয়ারফিল্ডের কাছ থেকে রিপোর্ট পেয়েছ? সেটার কী খবর? তুমি কী ওয়ালেনবার্গদের বংশতালিকায় বিশ্বাস করো…? মাথা নাড়ল ক্রো।
গ্রে নিজেও সেই রিপোর্ট পড়ে দেখেছে। ভূগর্ভস্থ ভ্ৰণ-ল্যাবে ঢোকার আগে মারশিয়া বলেছিলেন যে গুপ্তধন যত মূল্যবান সেটা তত গভীরে লুকোনো থাকে। একই কথা গোপন বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও খাটে। আর সেই গোপনীয়তাটা যদি ওয়ালেনবার্গরা করে তাহলে তো কথাই নেই। যেমন : তারা ব্রেনের ভেতরে মানুষ আর জানোয়ারের কোষ মিশিয়েছিল।
তবে কাহিনি ওখানেই শেষ নয়।
আমরা ১৯৫০ সালের শুরুর দিককার কর্পোরেট মেডিক্যাল রেকর্ডগুলো চেক করে দেখেছি, বলল গ্রে। সেখান থেকে নিশ্চিত হয়েছি, ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গের সন্তান জন্ম দেয়ার কোনো ক্ষমতা ছিল। তিনি অক্ষম ছিলেন।
পেইন্টার মাথা নাড়ল। জেনেটিক্স আর প্রজনন প্রক্রিয়া নিয়ে বুড়ো ভামটার রীতিমতো নেশা ছিল। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাচ্ছিল সে। ওয়ালেনবার্গ পরিবারের শেষ পুরুষ ছিল ব্যালড্রিক। কিন্তু তার নতুন সন্তান… সেটাকে সে এক্সপেরিমেন্টের কাজে ব্যবহার করেছিল? বিষয়টা সত্য?
কাঁধ ঝাঁকাল গ্রে। নাৎসিদের প্রজনন প্রোগ্রামের সাথে ব্যালড্রিক জড়িত ছিল। প্রজনন প্রজেক্টের পাশাপাশি ডিম ও বীর্য সংরক্ষণ করত তারা। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল জেরাম-৫২৫-ই ব্যালড্রিকের একমাত্র গোপন প্রজেক্ট নয়। সংরক্ষিত বীর্যগুলো কাঁচের স্ট্রয়ের ভেতরে হিমায়িত করত সে। তারপর সেটা যখন গলত তখন সেটাকে নিষিক্ত করার জন্য নিজের যুবতী স্ত্রীর ভেতরে সেই বীর্য ঢোকাত।
তুমি নিশ্চিত?
মাথা নেড়ে গ্রে সায় দিলো। ভূগর্ভস্থ ল্যাবে ড. মারশিয়া ওয়ালেনবার্গদের নতুন ও উন্নত বংশতালিকা দেখেছিলেন। সেখানে ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গের স্ত্রীর নামের পাশে হেনরিক হিমল্যারের নাম ছিল। ব্ল্যাক অর্ডার-এর প্রধান ছিলেন হিমল্যার। যুদ্ধের পর হেনরিক আত্মহত্যা করলেও আর্য সুপারম্যান তৈরির পরিকল্পনা করে রেখে গিয়েছিলেন। তাঁর নিজের জঘন্য ঔরস থেকে জন্ম নেবে… নতুন প্রজননুর জার্মানরা।
ওয়ালেনবার্গদেরকে সমূলে উৎপাটন করা হয়েছে, বলল গ্রে। ওদের বংশ নির্বংশ হয়েছে।
আমরা তো সেরকমটাই আশা করছি।
মাথা নাড়ল গ্রে। আমি খামিশির সাথে যোগাযোগ রাখছি। সে জানিয়েছে এস্টেটের চিড়িয়াখানা থেকে হয়তো কয়েকটা জানোয়ার জঙ্গলের গভীরে ঢুকে গেছে। তবে বিস্ফোরণের ফলে তাদের অধিকাংশই মারা পড়েছে হয়তো। তবে অনুসন্ধান চলছে।
খামিশি এখন হুলুহুলুই-আমলোজি প্রিজার্ভ-এর প্রধান ওয়ার্ডেন।
ড. মারশিয়া আর ড, পলা কেইন দুজন তাদের বাসায় ফিরে গেছেন। তবে তাদের সাথে একজন সঙ্গী জুটেছে, ফিওনা। দুই নারী স্পাই ফিওনাকে অক্সফোর্ডে ভর্তি হওয়ার জন্য সাহায্য করছেন।
গ্রে ভাবল অক্সফোর্ডে ফিওনা নিরাপদে থাকবে। ইউনিভার্সিটির আশেপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ ভাল।
ফিওনার কথা ভাবতে গিয়ে রায়ানের কথাও ওর মনে পড়ল। বাবার মৃত্যুর পর রায়ানা ওদের পুরো এস্টেটকে নিলামে তুলে দিয়েছে। সে চায় না উইউইলসবার্গ-এর কোনো ছায়া ওর সাথে থাকুক।
সঠিক সিদ্ধান্ত।
মনক আর ক্যাটের কী খবর? জানতে চাইল ক্রো। শুনলাম গতকাল নাকি ওদের এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে?
আজ সারাদিনে এই প্রথমবারের মতো গ্রের মুখে হাসি ফুটল। হ্যাঁ হয়েছে তো।
ভালই। ওরা সুখী হোক।
কথা বলতে বলতে ওরা গন্তব্যে চলে এসেছে।
গাড়ি থেকে নামল পেইন্টার।
লিসা ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে।
আমাদের কাজ শেষ? পেইন্টার গ্রেকে প্রশ্ন করল। গাড়ি থেকে বেরোল গ্রে। মনকও ওর পাশে যোগ দিল।
জি, স্যার।
ইউরোপ থেকে কী জানতে পারলে সেটা আমাকে জানাবে। আর অতিরিক্ত দিনগুলো নিয়ো, সমস্যা নেই।
লিসার হাত ধরে ক্রো লোগ্যানের বাড়িতে ঢুকল।
মনক ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, দই জমে ক্ষীর। কোনো সন্দেহ আছে?
গ্রে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়ালেনবার্গ এস্টেট থেকে এপর্যন্ত তাদের দুজনকে আলাদা করা যাচ্ছে না। অ্যানা ও গানথার যেহেতু নেই তাই একমাত্র লিসা-ই বেল সম্পর্কে তথ্য জানাতে সক্ষম। তাই ওকে নিয়ে সিগমায় ঘণ্টার পর ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সেই উসিলায় ক্রো আর লিসা দুজন দুজনের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।
দেখে মনে হচ্ছে, বেল শুধু ক্রোর শারীরিক ক্ষতিপূরণ করেনি মনে প্রেমের ফুলও ফুটিয়েছে।
মনকের প্রশ্নটা এতক্ষণে ওর মাথায় ঢুকল। এই মুহূর্তে কোনোকিছু বলা কঠিন। জীবন আর চেতনা যদি বিষয় হয় তাহলেও ভালবাসাও কোয়ান্টাম বিষয়।
তার মানে… ভালবাসা কিংবা ভালবাসা নয়।
কণা ও তরঙ্গ দুটোই।
পেইন্টার আর লিসার ক্ষেত্রে বিষয়টা এখনও দুটো অপশনেই যেতে পারে। সময়ই বলে দেবে শেষমেশ ওরা কোনটা হবে। ভালবাসা… নাকি ভালবাসা নয়।
জানি না, বিড়বিড় করে গ্রে জবাব দিলো। গ্রে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবছে।
ওর কপালে কী আছে, কে জানে।
.
পরিসমাপ্তি
সন্ধ্যা ৬ টা ৪৫ মিনিট।
রোক্ল, পোল্যান্ড।
ওর দেরি হয়ে গেছে।
ঘড়ি দেখল গ্রে। কিছুক্ষণের মধ্যে র্যাচেলের ফ্লাইট ল্যান্ড করবে। একটা কফিহাউজে দেখা করবে ওরা। সবকিছু ঠিকঠাক করা হয়েছে। তবে তার আগে একটু কাজ আছে গ্রের। একটা সাক্ষাৎকার নিতে হবে।
রোক্ল একসময় ব্রিসলাউ নামে পরিচিত ছিল। ২য় বিশ্ব যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মান আর রাশিয়ানরা লড়েছিল এখানে।
এগোচ্ছে গ্রে। সামনে ক্যাথেড্রাল আইল্যান্ড দেখা গেল। ওটার লোহার গেট পেরিয়ে পাথুরে রাস্তায় পা রাখল ও।
দ্য চার্চ অফ সেইন্ট পিটার অ্যান্ড পল। এখানেই কী সেই বাচ্চাটি হেসে খেলে বড় হয়েছে।
সেই নিখুঁত বাচ্চাটি?
সিলমুক্ত থাকা রাশিয়ান রেকর্ড থেকে গ্রে জানতে পেরেছে চার্চের অধীনে থাকা একটা এতিমখানায় মা হারা এক বাচ্চা ছিল। অবশ্য যুদ্ধের পর অনেক বাচ্চাই ছিল যারা তাদের বাবা-মা হারিয়েছে। কিন্তু গ্রে বয়স, লিঙ্গ আর চুলের রং বিবেচনা করে পর্যবেক্ষণ করেছে। বিশেষ করে সাদা চুলের ছেলে বাচ্চাদের রেকর্ড ঘেটেছে ও।
এছাড়াও গ্রে আরও জানতে পেরেছে, সেসময় ওয়েনসেলস্ মাইনে রাশিয়ান রেড আর্মি নাৎসিদের ভূগর্ভস্থ অস্ত্রাগার ও ল্যাবগুলোতে হামলা চালায়। তখন SS-Obergruppenfihrer জ্যাকব স্পোরেনবার্গ; তিনি হলেন অ্যানা ও গানরের দাদু রাশিয়ানদের হাত থেকে বেলকে রক্ষা করে সাথে নিয়ে পালাচ্ছিলেন। লিসা অ্যানার কাছ থেকে শুনেছে, এটাই সেই শহর। এখানকার নদীতে হিউগো সাহেবের মেয়ে টোলা সেই বাচ্চাটিকে নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল।
আসলেই কী তাই?
বিষয়টা সম্পর্কে জানার জন্য সিগমার রিসার্চ এক্সপার্টদের শরণাপন্ন হয়েছিল গ্রে। তারপর এক যাজকের ডায়েরি থেকে জানা গেছে… তিনি তখন এখানে এতিমখানা চালাচ্ছিলেন। তার ডায়েরিতে একটা ছেলে শিশুর কথা লেখা আছে। মৃত মায়ের সাথে নদী থেকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি। পাশের কবরস্থানে সেই নারীকে সমাধিত করা হলেও এখনও পর্যন্ত তার নাম জানা যায়নি।
তবে বাচ্চাটি সেই যাজকের অধীনে সুন্দরভাবে বড় হয়ে উঠেছিল। সেই বাচ্চাটি এখন নিজেও একজন যাজক। নাম : ফাদার পাইটোর। তার বয়স এখন ৬২ বছর। ফাদার পাইটোরের সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্যই গ্রে এখানে হাজির হয়েছে।
চার্চে ঢোকার মুখে একজন এসে গ্রেকে স্বাগত জানাল। ভাজবিহীন চেহারা আর সাদা চুল দেখেই গ্রে চিনতে পারল ইনি কে। ফাদার পাইটোরের পরনে জিন্স, কালো শার্ট, পেশার চিহ্ন হিসেবে রোমান কলার আর বোমঅলা হালকা সোয়েটার রয়েছে।
পোলিশ ভাষার টান আছে তার ইংরেজি উচ্চারণে। আপনি নিশ্চয়ই নাথান সয়্যার?
না, গ্রে তো নাথান নয় তারপরও মাথা নাড়ল। হ্যাঁ। এভাবে একজন ফাদারের সাথে মিথ্যা কথা বলতে গ্রের অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু কাজের প্রয়োজনে মিথ্যা বলতেই হবে।
গলা পরিষ্কার করল গ্রে। সাক্ষাৎকার নেয়ার অনুমতি দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অবশ্যই। প্লিজ, ভেতরে আসুন।
ভেতরে গেল ওরা দুজন। ফাদারের টেবিলে বাইবেলসহ বেশ কিছু জীর্ণ রহস্যপন্যাস দেখা গেল।
আপনি ফাদার ভেরিক সম্পর্কে জানতে এসেছেন, মন থেকে অমায়িক হাসি হেসে জানতে চাইলেন পাইটোর। উনি একজন মহান ব্যক্তি।
মাথা নাড়ল গ্রে। আপনার এতিমখানার জীবন সম্পর্কেও জানতে চাই।
যদিও গ্রে ইতোমধ্যে সবই জেনে ফেলেছে। র্যাচেলের চাচা ভিগোর, তিনি ভ্যাটিক্যান ইন্টেলিজেন্স-এর প্রধান, সিগমাকে যাবতীয় তথ্য দিয়েছেন।
সাথে মেডিক্যাল রেকর্ড দিতেও ভোলেননি।
অমায়িকভাবে জীবন কাটিয়ে আসছেন ফাদার ভেরিক। জীবনে কখনও ডাক্তার দেখাতে হয়নি তাকে। তবে কৈশোরে একবার টিলা থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল। চিকিৎসা নিয়েছিলেন তখন। এছাড়া আর কোনো অসুখে পড়েননি। শারীরিকভাবে একদম সুস্থ তিনি। ওয়ালেনবার্গদের জানোয়ারগুলোর মতো পাগলা, বিরাটাকার কিংবা গানথারের মতো বিশালদেহিও নন। স্রেফ স্বাস্থ্যবান।
সাক্ষাৎকার থেকে নতুন তেমন কিছু জানা গেল না।
গ্রে ঠিক করল, র্যাচেলের চাচার সাহায্য নিয়ে পাইটোর রক্ত ও ডিএনএ স্যাম্পল নিয়ে রাখবে। অবশ্য সেখান থেকেও নতুন কিছু জানা যাবে কিনা সন্দেহ আছে।
রুমের এক কোণে একটা টেবিলের ওপর অমীমাংসিত জিগস পাজল পড়ে থাকতে দেখল গ্রে। ওদিকে মাথা নেড়ে বলল, আপনি পাজল পছন্দ করেন?
ফাদার পাইটোর যেন একটু লজ্জা পেলেন। অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, এমনি শখ আরকি।
মাথা নেড়ে ফাদারের কাছ থেকে বিদেয় নিলো গ্রে। হিউগো হিরজফিল্ডের শখটা বেল-এর মাধ্যমে বাচ্চাটির ভেতরে প্রবেশ করেছে তাহলে? বিষয়টা কী শুধু জেনেটিক্স? নাকি তারচেয়েও বেশি কিছু? কোয়ান্টাম লেভেলের কিছু?
বাবা-ছেলের কথা ভাবতে গিয়ে নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেল গ্রের। ওর সাথে ওর বাবার সম্পর্ক কখনই ভাল ছিল না। তবে বর্তমানে একটু উন্নতির পথে। আচ্ছা, ও নিজে কেমন বাবা হবে? ও কি ওর বাবার মতোই হবে?
মনক বাবা হবে শুনে ওর নিজেরই আতঙ্কবোধ হয়েছিল।
ও কী মনকের চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে?
স্ত্রী, বন্ধন, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে সংসার করতে পারবে ও?
সাহস হবে?
এসব ভাবতে ভাবতে কফিহাউজের কাছে চলে এসেছে গ্রে। ভেতরে ঢুকে দেখল র্যাচেল ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে। গ্রে ওকে দেখতে পেলেও র্যাচেল ওকে এখনও দেখতে পায়নি। একটু আগেই এসে পৌঁছেছে হয়তো। থেমে দাঁড়িয়ে গ্রে র্যাচেলকে দেখতে শুরু করল। কী সুন্দরী! যতবার দেখে প্রথম দেখার মতো অনুভূতি হয়। লম্বা একহারা দেহ, আকর্ষণীয় ঢেউ, কোমর, গলা, বুক… সবই সুন্দর। র্যাচেল ঘাড় ঘুরিয়ে এবার গ্রেকে দেখতে পেয়েছে। হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। ওর চোখ ছুঁয়ে গেল হাসিটা। লজ্জায় আলগোছে নিজের চুলে হাত বুলাল র্যাচেল।
কে এই নারীর সাথে জীবন কাটাতে চাইবে না? সবাই চাইবে।
ওর দিকে গ্রে এগিয়ে গেল। হাত ধরল দুজন।
গ্ৰে মনকের চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত। সংসার করবে ও। আর ভয় পাওয়া নয়।
ভালবাসা কিংবা ভালবাসা নয়….
কণা কিংবা তরঙ্গ… কিংবা কণা তরঙ্গ দুটোই…।
কিন্তু সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওসব থিওরি কাজ করবে না। হয় হ্যা নয় তো না। একসাথে হ্যাঁ ও না হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
র্যাচেলকে নিয়ে একটা টেবিলে গিয়ে বসল ও। র্যাচেলের চোখে চোখ রেখে ভয়ে ভয়ে বলল, আমাদের কথা বলা দরকার।
ওর চোখের দিকে তাকাল গ্রে। দুজনের দুটো ভিন্ন পেশা, ভিন্ন দেশ, ভিন্ন, দুজন ভিন্ন পথের যাত্রী।
গ্রের হাতের আঙুলে চাপ দিলো র্যাচেল। আমি জানি।
***
ফাদার পাইটোর পায়ের কাছে ভোরা-কাটা বিড়াল এসে মিউ মিউ করছে। এই জাতের বিড়াল ফাদার ভেরিক পুষতেন এখনও তিনি পোষেন।
হঠাৎ নদীর পাশে নজর পড়ল তার। একটা বাদামি চড়ুই পাখি ঘাড় ভেঙ্গে পড়ে রয়েছে।
মাথা নেড়ে পাখিটাকে দুহাতে তুলে নিলেন ফাদার। মুখের কাছে নিয়ে ওটার পালকে ফুঁ দিলেন। ডানাগুলো মেলে ধরলেন তিনি। তার হাতের তালু থেকে চড়ইটি বাতাসে ডানা মেলল। উড়ে গেল আকাশ পানে।
পাখিটার ওড়া দেখতে দেখতে হাত ঝাড়লেন ফাদার পাইটোর। তারপর দুই পাশে দুহাত বাড়িয়ে দিলেন।
জীবন মানেই এক বিস্ময়কর রহস্য।
এমনকি তার জন্যও।
.
.
লেখকের বক্তব্য
বেল সত্য নাকি কল্পনা নতুন এই যাত্রায় আমার সঙ্গী হওয়ার জন্য ধন্যবাদ। শেষ মুহূর্তে এসে আমি আপনাদেরকে এই উপন্যাসের কতটুকু সত্য আর কতটুকু কল্পনা সেটা জানিয়ে দেয়ার প্রয়োজনবোধ করছি।
প্রথমে ছোটখাটো বিষয়…
ডারপা (DARPA) সত্যি সত্যিই সংযোজনযোগ্য কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করেছে। তবে হ্যাঁ, ওরা তাতে ফ্ল্যাশ চার্জ করার অপশন রেখে কি-না সেটা আমার জানা নেই।
বইয়ের উকুফার ব্যাপারে বলব… স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাস্তবে এমন এক ধরনের ইঁদুর উদ্ভাবন করেছিল যাতে মানব নিউরাল কোষ ঢোকানো ছিল। বিজ্ঞানীরা এখন চেষ্টা করছেন কীভাবে একশভাগ মানব নিউরাল কোষযুক্ত ইঁদুর তৈরি করা যায়।
২০০৪ সালে মিউটেশনের প্রভাবযুক্ত একটি জার্মান ছেলের জন্ম হয়েছিল। যার ফলে ছেলেটার শরীরে স্বাভাবিকের চাইতে দ্বিগুণ পরিমাণে পেশি ও অতিরিক্ত শক্তি ছিল। এই ছেলেটাকে কী তাহলে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া প্রথম Sonnekonig?
১৯৯৮ সালে হিমালয়ে সাংরি-লা আবিষ্কৃত হয়। সেখানে বরফে ঢাকা পাহাড়ের মধ্যে প্রাকৃতিক পানির প্রবাহ আর সবুজ গাছপালা রয়েছে। ওখানে আর কী কী লুকিয়ে রয়েছে কে জানে?
এবার বড় বিষয়গুলোতে আসি…।
বইয়ের শুরুতে যেরকম বলেছি… বেল সত্যি সত্যিই ছিল। মাঝেমাঝে বাস্তব কাহিনি কল্পনাকেও হার মানায়। বেল নিজেই সেটার প্রমাণ। নাৎসিরা একটা অদ্ভুত ডিভাইস তৈরি করেছিল, সেটার জ্বালানি ছিল জেরাম-৫২৫ নামের একটি অজ্ঞাত বস্তু। ডিভাইসটা কীভাবে চালানো হতো সে সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে এতটুকু জানা গেছে, ওটায় যখন পাওয়ার সঞ্চালিত হতো তখন প্রজেক্টের সাথে জড়িত বিজ্ঞানীরা ও কাছের গ্রামগুলোর লোজন আক্রান্ত হয়েছিল। যুদ্ধের পর বেল গায়ের হয়ে যায়, ওটার সাথে জড়িত বিজ্ঞানীদের খুন করা হয়। বেল-এর শেষ পরিণতি কী হয়েছিল সেটা আজও অজানা। এ-ব্যাপারে যদি আপনি আরও কিছু জানতে চান তাহলে আমি আপনাকে নিক কুক-এর লেখা দ্য হান্ট ফর জিরো পয়েন্ট বইটা পড়ার পরামর্শ দেব।
এই উপন্যাসে আমি অনেকটা সময় জুড়ে হেনরিক হিমল্যারের প্রাচীন বর্ণ প্রীতি, গুপ্ত সংঘ ও হিমালয়ে আর্য জাতিদের জন্মস্থান খোঁজা নিয়ে ব্যয় করেছি। সবই তথ্যগতভাবে সত্য। এমনকী উইউইলসবার্গের হিমল্যারের ব্ল্যাক কেইমলটটাও সত্য। এ-বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে আপনি ক্রিস্টোফার হেইল-এর লেখা হিমল্যারস ক্রুসেড এবং পিটার লেভেনন্ডার আনহোলি অ্যালাইন্স পড়ুন।
সর্বশেষ, জনোজি ম্যাকফ্যাডেন-এর লেখা কোয়ান্টাম এভ্যুলুশন বইটা এই উপন্যাসের প্রাণ হিসেবে কাজ করেছে। এই বইতে মিউটেশন ও বিবর্তনবাদে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে। চেতনার বিবর্তন নিয়েও লেখা আছে ওতে। বইয়ের শেষ অংশে আপনি সেটার প্রভাব দেখবেন। এরপরও যদি আপনি আরও বিস্তারিত জানতে চান তাহলে বইটি সংগ্রহ করে পড়ুন।
এবার আসি বইয়ের শেষ অংশের মতবাদ বিষয়ে। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন বনাম বিবর্তন। আমার মনে হয় এই বই যত প্রশ্ন তৈরি করেছে তত উত্তরও জুগিয়েছে। বর্তমান বিতর্ক ভুল দিকে পরিচালিত হচ্ছে বলে আমি মনে করি। আমরা কোথা থেকে এসেছি? সেটার চেয়ে আমরা কোথায় যাচ্ছি? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বেশি জরুরি।
আর সেটার উত্তর জানতে হলে যে পরিমাণ রহস্য ও রোমাঞ্চের সম্মুখীন হতে হবে সেটা যেকোন ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট।
.
কৃতজ্ঞতা
উপন্যাস লেখা মানে ফাঁকা পৃষ্ঠার সাথে সময় কাটানো। এই বইয়ে অনেক ব্যক্তির ছোঁয়া জড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে চার জনের নাম উল্লেখ করছিঃ আমার সম্পাদক Lyssa Keusch, তাঁর সহকর্মী May Chen, আমার এজেন্ট Russ Galen এবং Danny Baror!
আর বরাবরের মতো বইতে তথ্য, সিকোয়েন্স ও বর্ণনাজনিত যেকোন ধরনের ভুলের জন্য দোষ সম্পূর্ণ আমি নিজের কাঁধে নিচ্ছি।
.
অনুবাদকের কৃতজ্ঞতা
আমার অনুবাদকৃত বইটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই বইয়ের অনুবাদের পেছনে আমার কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীদের অবদান আছে।
ডোকাবিল্ডার বইয়ের লেখক ফরহাদ হোসেন মাসুম ভাইকে ধন্যবাদ বিজ্ঞানের বিভিন্ন জটিল বিষয় অনুবাদে সাহায্য করার জন্য। বইটিকে যথাসম্ভব নিখুঁতভাবে পাঠকদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার বান্ধবী আফসানা আক্তার বিন্দুর কাছে কৃতজ্ঞ। নিজের পড়াশোনার চাপ থাকার পরও বইটির বিভিন্ন বানান ভুল ও বাক্যে থাকা ত্রুটিগুলো দূর করার দুরূহ কাজটি সে সম্পন্ন করেছে। বইটিতে ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি ছবির কোয়ালিটি উন্নত করতে সাহায্য করেছেন জিরো টু ইনফিনিটি ম্যাগাজিনের বিভাগীয় সম্পাদক সিরাজাম মুনির শ্রাবণ, তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। প্রকাশক রিয়াজ ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ ঢাউস সাইজের এই বইটির অনুবাদক হিসেবে আমার ওপর আস্থা রাখার জন্য। নির্ধারিত সময়ের ২ মাস পর পাণ্ডুলিপি জমা দেয়ার পরও তিনি কোনো আপত্তি করেননি কিংবা অসন্তোষ প্রকাশ করেননি, বিষয়টা আমাকে একই সাথে লজ্জা দিয়েছে ও সম্মানিত করেছে। বিশেষ কৃতজ্ঞতা আমার মা শাহনাজ পারভীনের কাছে। এই বইটি অনুবাদের সময় আমার ওপর দিয়ে অনেক চড়াই-উত্রাই গেছে। ব্যক্তিগত জীবনে মানসিকভাবে অনেক দুর্দশাগ্রস্ত ছিলাম। কঠিন সময়ে শক্ত হাতে আমাকে সমর্থন দিয়ে বইটির কাজ শেষ করার তাগাদা ও উৎসাহ দেয়ার জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ। সন্তান হিসেবে এরকম মা পেয়ে আমি গর্বিত।
এছাড়া অনুবাদে যেকোন ধরনের গড়মিল, অসংগতি কিংবা ভুল চোখে পড়লে নির্দ্বিধায় আমাকে জানান। এ ব্যাপারে গঠনমূলক সমালোচনা সাদরে গৃহীত হবে।