১৪. মেনাজিরি
দুপুর ১টা ৫৫ মিনিট।
সাউথ আফ্রিকা।
দরজায় কান পাতলো ফিওনা। হাতে টেজার নিয়ে প্রস্তুত। দোতলার ল্যান্ডিঙে কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। ভয় পেল ও। গত চব্বিশ ঘণ্টায় একের পর এক ঘটনার পর ওর যতটুকু সহ্যশক্তি ছিল সেটা এখন একদম শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। ওর হাত কাঁপতে শুরু করল, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে।
ওকে যে গার্ডটা ইভটিজিং করেছিল সে একটু গুঙিয়ে উঠতেই টেজার দিয়ে শক দিলো ফিওনা।
ও এখন যেখানে লুকিয়ে আছে কণ্ঠগুলো সেদিকেই আসছে।
ফিওনা ভয় পাচ্ছে।
গ্রে কোথায়? একঘণ্টা হয়ে গেল তার কোনো খবর নেই।
ফিওনার দরজার দিকে এগোল দুজন। তাদের একজনের কণ্ঠস্বর ফিওনা চেনে। সাদাচুলওয়ালি কুত্তীটার কষ্ঠ ওটা। কুত্তীটা ওর হাতের তালু কেটে দিয়েছিল। ইসকি ওয়ালেনবার্গ। ইসকি আর তার সাথের জন ডাচ ভাষায় কথা বলছে। ফিওনা এই ভাষা খুব ভাল করেই বোঝে।
.. কি কার্ড, রেগে বলল ইসকি। যখন পড়ে গিয়েছিলাম যখন হয়তো হারিয়ে ফেলেছি।
সমস্যা নেই, custer, তুমি এখন নিরাপদ।
uster, অর্থাৎ বোন। তাহলে ইসকির সাথে যে ব্যক্তি আছে সেটা তার ভাই।
নিরাপত্তার খাতিরে আমরা কোড চেঞ্জ করে দেব, বলল ইসাক।
কেউ এখনও ওই দুই আমেরিকান আর মেয়েটাকে খুঁজে পায়নি?
এস্টেটের সব সীমান্তে আমরা দ্বিগুণ গার্ড বসিয়েছি। আমি নিশ্চিত ওরা এখনও নিচেই আছে। খুঁজে বের করে ফেলব। আর হ্যাঁ, দাদু একটা চমক রেখেছেন।
কেমন চমক?
এস্টেট থেকে কেউ যাতে প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারে সেটা নিশ্চিত করেছেন তিনি। মনে আছে, ওরা যখন প্রথম এসেছিল তখনই উনি সবার ডিএনএ স্যাম্পল রেখে দিয়েছিলেন।
হেসে উঠল ইসকি। হাসি শুনে ফিওনার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কণ্ঠ দুটো আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে।
এসো। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে বলল ইসাক। দাদু আমাদেরকে নিচে যেতে বলেছেন।
ওরা দুজন সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে থেমে গেছে। দরজায় কান পেতে ফিওনা বুঝতে পারল কিছু একটা নিয়ে তর্ক করছে ভাই-বোন। তবে যা শোনার ফিওনা তা শুনে ফেলেছে।
এস্টেট থেকে কেউ প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না। কী পরিকল্পনা করেছে ওরা? ইসকির ঠাণ্ডা হাসির আওয়াজ এখনও ওর কানে বাজছে। সন্তুষ্টি ও আনন্দের হাসি। তারা যা-ই পরিকল্পনা করে থাকুক না কেন সেটা হয়তো সফল হতে যাচ্ছে। কিন্তু ডিএনএ স্যাম্পল দিয়ে কী করবে তারা?
ফিওনা জানে, উত্তরটা জানার মাত্র একটাই উপায় আছে। গ্রে কখন ফিরবে না ফিরবে সেটা ও জানে না। এদিকে হাত থেকে সময় চলে যাচ্ছে। সামনে কী বিপদ আসছে সেটা যদি জানা সম্ভব হয় তাহলে হয়তো… ওরা সেটাকে এড়িয়ে যেতে পারবে।
তার মানে রাস্তা এখন একটাই।
টেজার পকেটে ঢুকিয়ে পালকযুক্ত ঝাড় বের করল ও। দরজার নব ঘুরিয়ে তালা খুলল। রাস্তায় থাকা অবস্থায় ও যা যা শিখেছিল এই মিশনে সেইসব দক্ষতার প্রয়োজন হবে। আজকের মতো এতটা একা ওর কখনওই লাগেনি। তাই খুব বেশি ভয় হচ্ছে। দরজা খুলে বাইরে বের হলো ফিওনা। চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করল। না, ঈশ্বরের কাছে নয়। যে ওকে শিখিয়েছিলেন সাহস কীভাবে ধরে রাখতে হয়, কীভাবে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তার কাছে প্রার্থনা করল।
মাট্টি..
গ্রিট্টি নেয়ালকে খুব মিস করে ও। অতীতের গোপন কাহিনির কারণে মহিলার প্রাণ গেল আর এখন নতুন গোপন কাহিনি ফিওনাসহ বাকিদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বেঁচে থাকতে হলে ফিওনাকে তার মতো সাহসী ও নিঃস্বার্থ হতে হবে।
সিঁড়ির গোড়া থেকে কণ্ঠস্বরগুলো সরে গেল।
আস্তে করে সামনে পা বাড়াল ফিওনা। ঝাড়কে সামনে ধরে রেখেছে। ল্যান্ডিং বেলকুনিতে আসতেই দুই যমজের সাদাচুল ওর নজরে পড়ল। এখান থেকে ওদের কথা শোনা যাচ্ছে।
দাদুকে অপেক্ষা করিয়ো না। বলল ইসাক।
আমি এখুনি আসছি। স্কাল্ডকে দেখে আসি। দেখি ও ওর ঘরে ফিরে গেছে কি না। ও খুব উত্তেজিত। হতাশার ফলে হয়তো নিজেই নিজের ক্ষতি করে ফেলবে।
একই কথা তোমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, বোন।
আরেকটু সামনে এগোল ফিওনা। ইসকি তার বোনের গাল স্পর্শ করেছে। বাড়াবাড়ি রকমের ঘনিষ্ঠ।
ভাইয়ের হাতের দিকে গাল বাড়িয়ে দিলো ইসকি, তারপরেই আবার সরিয়ে নিলো। আমি বেশিক্ষণ সময় নেব না।
মাথা নেড়ে ইসাক সেন্ট্রাল লিফটের দিকে পা বাড়াল। ঠিক আছে, আমি দাদুকে জানিয়ে রাখছি। সে একটা বাটন চাপতেই দরজা খুলে গেল।
ভিন্ন দিকে এগোল ইসকি। মূল ভবনের পেছনের দিকে।
ফলো করার জন্য ফিওনা দ্রুত পা চালাল। পকেটে থাকা টেজার আকড়ে ধরল ও যদি কুত্তীটাকে একলা পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো কথা বলানো যাবে…
সিঁড়ির ধাপগুলো দ্রুত নেমে এসে থামল ফিওনা। এখান থেকে আরও সাবধানে এগোতে হবে। ইসকি সেন্ট্রাল হলের দিকে এগোচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে মূল ভবনের একদম ভেতর দিয়ে চলে গেছে ওটা।
মাথা নিচু করে দূর থেকে ফলো করল ও। ঝাড়টাকে এমনভাবে হাতে রেখেছে যেন ও একজন নান আর ঝাড়টা হলো বাইবেল। ছোট ছোট করে পা ফেলছে ও, কাজের মেয়েরা এভাবেই পা ফেলে থাকে। ৫টা সিঁড়ির একটা সেট পার হলো ইসকি, তারপর আর একজোড়া গার্ড পার হওয়ার পর হলওয়ের বা দিকে চলে গেল।
জোড়া গার্ডদের দিকে এগোল ফিওনা। গতি বাড়িয়ে দিলো, যেন ওর কাজে খুব তাড়া আছে। এখনও ওর মাথা নিচু করা আছে। সাইজে বড় মেইডের ইউনিফর্ম রয়েছে পরনে।
গার্ড দুজন ওকে পাত্তাই দিলো না। ভেবেছে ইসকির পর পর যেহেতু মেয়েটা যাচ্ছে তাহলে নিশ্চয়ই কোনো কাজ আছে। তাই সেটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। সামনে হলে গিয়ে ফিওনা দেখল সব ফাঁকা।
থামল ও।
ইসকি গায়েব।
একই সাথে স্বস্তি ও ভয় ওকে গ্রাস করল।
এখন কী আমার রুমে ফিরে যাবো?
কিন্তু ইসকির ঠাণ্ডা হাসির আওয়াজ ওর মনে পড়ে গেল। ডানপাশের আয়রন ও গ্লাস ডোরের ওদিক থেকে ইসকির ক্ষিপ্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো হঠাৎ।
কিছু একটা তাকে রাগিয়ে দিয়েছে।
তাড়াতাড়ি এগোল ফিওনা। কান পাতল দরজায়।
মাংস অবশ্যই রক্তাক্ত ও টাটকা হওয়া চাই! খেঁকিয়ে উঠল ইসকি। নইলে তোকে ওর ঘরে ঢুকিয়ে দেব!
বিড়বিড় করে কে যেন মাফ চাইল। দূরে সরে গেল পায়ের শব্দ।
কাঁচের সাথে আরও ভাল করে কান পাতল ফিওনা।
ভুল কাজ।
দরজা খুলতেই মাথায় আঘাত পেল ও। হনহন করে বেরিয়ে এলো ইসকি, একদম ফিওনার দিকে এগোল সে।
কনুই মেরে ফিওনাকে একপাশে সরিয়ে দিলো।
সাথে সাথে কাজ করল ফিওনা, ওর পুরোনো দক্ষতা কাজে লাগানোর সময় হয়েছে। নিজেকে সামলে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ও… খুব সাবলীলভাবে করায় মোটেও মেকি মনে হলো না বিষয়টা।
দেখে-শুনে চলবি! আগুন ঝরছে ইসকির কণ্ঠ থেকে।
Ja, maitresse, মাথা আরও নুইয়ে ফেলল ও।
সর সামনে থেকে!
ঘাবড়ে গেল ফিওনা। এবার ও কোথায় যাবে? ফিওনাকে এখানে দেখে ইসকি কী ভাবছে? ফিওনা এখানে কী করছিল। ইসকি এখনও দাঁড়িয়ে থাকায় দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়নি। ইসকিকে জায়গা করে দিয়ে ফিওনা একটু ভেতরে ঢুকে পড়ল।
লুকোনো টেজারে ফিওনার হাত চলে গেল কিন্তু একটু আগে ইসকির সোয়েটারের পকেট থেকে যে জিনিসটা চুরি করেছে সেটার জন্য দেরি হয়ে গেলো। ওর চুরি করার কোনো ইচ্ছে ছিল না কিন্তু হয়ে গেছে। বদঅভ্যাস। এখন এই দেরিটাই ওর কাল হলো। টেজার বের করার আগেই বড় বড় পা ফেলে চলে গেল ইসকি। ওদের দুজনের মাঝে আয়রন ও গ্লাসের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
নিজের ওপরেই রাগ হলো ফিওনার। এবার কী হবে? এখান থেকে বের হওয়ার আগে ওকে কিছুটা সময় অপেক্ষা করা উচিত। ইসকির পেছন পেছন আবার রওনা হলে বিষয়টা অস্বাভাবিক দেখাবে। তবে ও জানে ইসকি কোনদিকে গেছে। লিফটের দিকে এগোচ্ছে সে। দুর্ভাগ্যবশত ফিওনা এই ভবনটা ভাল করে চেনে না। নইলে বিকল্প কোনো দিক দিয়ে গিয়ে ইসকিকে আক্রমণ করার চেষ্টা করতে পারতো।
ভয় আর হতাশায় কান্না পেল ওর।
ফিওনা সবকিছু এলোমেলো করে ফেলেছে।
অপেক্ষা করার ফাঁকে চেম্বারে নজর দিলো ও। ভেতরে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। ছাদে লাগানো কাঁচ দিয়ে প্রাকৃতিক আলো নামছে। বড় বড় স্তম্ভগুলো ঠেকিয়ে রেখেছে ছাদকে। চমৎকার তিনটা হল আছে। চার্চের মূল অংশের মতো দেখতে ওগুলো। একটা ক্রসের আকৃতি নিয়েছে।
কিন্তু এটা তো প্রার্থনার জায়গা নয়।
গন্ধ পেল ফিওনা। শবঘরে থাকা মৃতদেহের তীব্র দুর্গন্ধ। ঘোট ঘোট গোঙানি আর গর্জন ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কৌতূহল জাগল ওর। সামনে এগিয়ে দেখল তিনটা সিঁড়ি দিয়ে নিচের মূল ফ্লোরে নামা যাবে। ইসকি যে ব্যক্তিকে একটু আগে ধমক লাগিয়েছে তাকে কোথাও দেখা গেল না।
ফিওনা রুম ঘুরে দেখতে শুরু করল।
বড় বড় খাঁচা দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকটার সামনে আয়রন ও গ্লাসের তৈরি ঝাঁঝরি দেয়া। দরজা বলে মনে হলো। খাঁচার ভেতরে বিশালাকৃতির প্রাণী দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা শুয়ে বিশ্রাম করছে আর ঘুরছে ফিরছে বাকিগুলো। পায়ের হাড়ের ওপর হামলে পড়ে কামড়াচ্ছে একটা প্রাণী। এগুলো সব দানবাকৃতির হায়না।
তবে এখানেই শেষ নয়।
ফিওনা অন্য খাঁচায় ভিন্নরকম দানব দেখতে পেল। খাঁচার সামনের অংশে একটা গরিলা বসে আছে। ফিওনার দিকে সোজা তাকিয়ে আছে ওটা, দেখেই বোঝা যায় দানবটা মাথায় অনেক বুদ্ধি রাখে। তবে জঘন্য বিষয় হলো, মিউটেশনের ফলে গরিলার গায়ের লোমগুলো গায়েব হয়েছে। হাতির চামড়ার মতো ভাঁজ পড়া অবস্থায় গা থেকে ঝুলছে সেগুলো।
অন্য আরেকটা খাঁচায় একটা সিংহকে দেখা গেল। এদিক-ওদিক হাঁটছে ওটা। এটার গায়ে লোম আছে কিন্তু সেগুলোর সামঞ্জস্য নেই। কোথাও হালকা তো কোথাও জমাট বাঁধা। হাঁপাচ্ছে সিংহটা। চোখগুলো লাল। বড় বড় দাঁতগুলো বাইরে বেরিয়ে এসেছে। দাঁতগুলো কাস্তের মতো বাঁকা।
অন্যান্য খাঁচায় যেসব প্রাণী আছে সবটারই বৈশিষ্ট্য অস্বাভাবিক। ডোরাকাটা হরিণ যার শিং দুটো প্যাচানো, লম্বা টিংটিঙে শিয়াল, অদ্ভুত রঙের শূকর ইত্যাদি।
তবে এগুলোর মধ্যে ফিওনার কাছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লেগেছে দানবাকৃতির হায়নাকে। কামড়ে ধরা পায়ের দিকে তাকাল ও। বড় কোনো প্রাণীর পা হবে ওটা। বিশাল মহিষ কিংবা হরিণের। হাড়ের সাথে এখনও একটু কালো লোম আর মাংস লেগে রয়েছে। ওটা খেয়ে নিলে পুরো হাড় নগ্ন হয়ে যাবে। ফিওনা ভাবল, গ্রে যদি ওকে না বাঁচাতো তাহলে ওই হাড়ের জায়গায় হয়তো ওর শরীর থাকতো…
কেঁপে উঠল বেচারি।
দাঁতের শক্তি পরীক্ষা করার জন্য হায়নাটা কামড় দিয়ে হাড়কে ভেঙ্গে ফেলল। হাড় ভাঙ্গার আওয়াজটা হলো পুলি ছোঁড়ার মতো।
চমকে গিয়ে লাফিয়ে উঠল ফিওনা।
দরজার দিকে এগোল ও। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে। যে মিশন নিয়ে এসেছিল সেটা ব্যর্থ হয়ে গেছে, এখন যেখান থেকে এসেছিল সেখানে ফিরে গিয়ে লুকিয়ে থাকবে।
দরজা ধাক্কা দিলো ও।
লকড।
তালাবন্ধ হয়ে গেছে।
.
দুপুর ২টা ৩০ মিনিট।
ভারি লিভারগুলোর দিকে তাকাল গ্রে। হৃদপিণ্ড যেন ওর গলায় উঠে এসেছে। ইলেকট্রিক্যাল বোর্ডের ভেতর থেকে মাস্টার সার্কিট সুইচ খুঁজে পেতে অনেক সময় লেগেছে ওর। ও জানে বড় ক্যাবলের ভেতর দিয়ে অনেক পাওয়ার সরবরাহ হচ্ছে। গলার কাছে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স অনুভূত হচ্ছে ওর।
ইতোমধ্যে গ্রে অনেক সময় অপচয় করে ফেলেছে।
জেরাম-৫২৫ রাখা একটা ড্রামকে জায়গা মতো না পেয়ে গ্রে চিন্তিত হয়ে পড়ল। ড্রামটাকে আমেরিকার ক্ষতি করার কাজে ব্যবহার করা হবে। ওয়াশিংটনকে এ-বিষয়ে জানানো জরুরি। অন্যান্য ড্রামের দিকে আর সময় নষ্ট না করে ওয়াশিংটনকে কীভাবে সতর্ক করে দেয়া সম্ভব সেটা নিয়ে ভাবল গ্রে।
মারশিয়াকে যখন তার সেল থেকে বের করা হয়েছিল তখন তিনি সিকিউরিটি ব্লকে একটা ইমার্জেন্সি শর্টওয়েভ রেডিও দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি জানেন ওটা দিয়ে কার সাথে কথা বলতে হবে। ড. পলা কেইন, তার পার্টনার। ওয়াশিংটনে সতর্কবাণী পৌঁছে দিতে পারবেন পলা। গ্রে ও মারশিয়া দুজনই জানে এখন সেই রেডিও আনতে যাওয়া আত্মহত্যার সামিল। কিন্তু তাছাড়া আর কীইবা করার আছে?
যা-ই হোক, ফিওনা অন্তত নিরাপদ আছে।
দেরি করছেন কেন? মারশিয়া প্রশ্ন করলেন। স্টোরেজ থেকে অ্যাপ্রন বের করে পরলেন তিনি। অন্ধকারে তাকে হয়তো গার্ডরা ল্যাবের গবেষক ভেবে ছেড়ে দেবে।
গ্রের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। হাতে একটা ইমার্জেন্সি ফ্ল্যাশলাইট।
প্রথম লিভারের দিকে গ্রে হাত বাড়াল।
ইতোমধ্যে ওরা সাববেজমেন্টে যাওয়ার জন্য ইমার্জেন্সি সিঁড়িটা কোথায় আছে সেটা বের করে ফেলেছে। সেই সিঁড়ি ধরে ওরা মূল ভবনে চলে যেতে পারবে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে সিকিউরিটি ব্লকে পৌঁছুতে হলে ওদেরকে একটা কাণ্ড ঘটাতে হবে, যাতে সবার মনোযোগ সেদিকে চলে যায়।
সেটা কীভাবে সম্ভব? উত্তরটা একটু আগেই পাওয়া গেছে। হলওয়ের একটা দরজার সাথে গ্রে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন ও পাওয়ার প্ল্যান্টের কারণে গুঞ্জন ও কাঁপুনি টের পেয়েছে। যদি ওরা মেইন বোর্ডটাকে পুড়িয়ে দিয়ে… হৈচৈ বাঁধিয়ে দিতে পারে… কিছুটা সময়ের জন্য হলেও চোখে ধুলো দেয়া যাবে শক্রদের চোখে… তখন রেডিওটা সংগ্রহ করা সহজ হবে।
রেডি? প্রশ্ন করল গ্রে।
মারশিয়া ফ্ল্যাশলাইট অন করলেন। গ্রের চোখের দিকে তাকালেন তিনি। গভীর দম নিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, চলুন, করে ফেলি।
লাইন বন্ধ, বলতে বলতে প্রথম লিভারটা টান দিলো গ্রে।
তারপর পরেরটাও টান দিলো… এভাবে পরেরটা… তারপরেরটা।
.
দুপুর ২ টা ৩ মিনিট।
ফিওনা দেখল সবকটি লাইট দপ দপ করে অফ হয়ে যাচ্ছে।
ও খোদা…
সেন্ট্রাল কোর্টইয়ার্ডে একটা ছোট ঝরনার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ও। দরজা তালা বন্ধ হয়ে গেছে দেখতে পেয়ে ভিন্ন পথ খোঁজার জন্য এদিকে এসেছিল। বের হওয়ার বিকল্প আরেকটা পথ তো থাকার কথা।
কিন্তু এখন ও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
পুরো রুম জুড়ে হঠাৎ সুনসান নীরবতা। খাঁচায় থাকা প্রাণীগুলো হয়তো কোনো পরিবর্তন টের পেয়েছে। এতক্ষণ পাওয়ারের মৃদু গুঞ্জন আওয়াজ ছিল এখন সেটা নেই। কারেন্টের পাওয়ার নেই… হয়তো এখন ওদের পাওয়ার চালু হবে।
ওর পেছনের একটা দরজা আওয়াজ করে উঠল।
ধীরে ধীরে ঘুরল ফিওনা।
দানবীয় হায়না নাক দিয়ে ঠেলা দিতেই একটা খাঁচার দরজা খুলে গেছে। পাওয়ার চলে যাওয়ায় অকেজো হয়ে গেছে দরজার তালাগুলো। খাঁচা থেকে বের হয়ে এলো দানবটা। ওটার ঠোঁট থেকে রক্ত চোয়াচ্ছে। এই হায়না নিশ্চয়ই এতক্ষণ মাংস খাচ্ছিল। মৃদুস্বরে গর্জন করল ওটা।
ফিওনার পেছনে অন্যান্য প্রাণী মৃদু আওয়াজ করে নিজেদের মধ্যে চুপচাপ যোগাযোগ সেরে নিলো। দানব সমৃদ্ধ চিড়িয়াখানার সব দরজা খুলে গেল এক এক করে।
ফিওনা তবুও ঝরনার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। পানির পাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন ঝরনার পানিও বন্ধ। নিথর, স্তব্ধ পানি দেখেও ভয় করল ওর।
নিচের কোথাও থেকে বিকট চিৎকার ভেসে এলো। মানুষের চিৎকার। ফিওনা ভাবল, এটা হয়তো সেই লোকটার… যাকে ইসকি একটু আগে ধমকে গেছে। মনে হচ্ছে সে নিজেই প্রাণীগুলোর জন্য রক্তমাখা টাকটা মাংস হয়ে যাচ্ছে। ফিওনার দিকে কারও এগিয়ে আসার শব্দ শোনা গেল। তারপর আবার চিৎকার, আর্তনাদ… গর্জন।
নিজের কান চেপে ধরল ফিওনা। দানবগুলো এখন লোকটাকে খেতে শুরু করেছে।
প্রথমে যে দানবটা বেরিয়েছে সেটার দিকে এখনও তাকিয়ে আছে ফিওনা।
রক্তাক্ত মুখ নিয়ে এগোল ওটা। ফিওনা দানবটার গায়ে থাকা সাদা স্পট দেখে চিনতে পারল। সাদা পশমের ওপর সাদা স্পট, প্রায় বোঝাই যায় না। জঙ্গলে এই দানবটাকে দেখেছিল ও।
ইসকির পোষা জানোয়ার।
স্কাল্ড।
এর আগে খাঁচায় রাখা খাবারটা (ফিওনাকে) স্কাল্ড খেতে পারেনি।
এবার আর সেটা হচ্ছে না।
.
দুপুর ২টা ৪০ মিনিট।
আমাদেরকে সাহায্য করুন… মেজর ব্রুকসকে সাথে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলো গানথার।
লিসা পেইন্টারের বুক থেকে স্টেথোস্কোপ সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। পেইন্টারের বুকের আওয়াজ পর্যবেক্ষণ করছিল ও। গত ১২ ঘণ্টায় পেইন্টারের অনেক অবনতি হয়েছে। স্বাস্থ্যের এদ্রুত অবনতি লিসা এর আগে কখনও দেখেনি। লিসা আশংকা করল ক্রোর হৃদপিণ্ডের ভালবের আশেপাশে কিছু জমেছে। সেটার প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে শরীরে, এমনকি ওর চোখের তরলেও সেটার প্রভাব পড়েছে।
পেইন্টার এতক্ষণ শুয়েছিল, কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে বলল, কী হয়েছে?
জবাব দিলো মেজর ব্রুকস, ওনার বোন, স্যার। তার… হার্টঅ্যাটাক টাইপের কিছু একটা হয়েছে।
মেডি কিট নিলো লিসা। পেইন্টার একা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু ব্যর্থ হয়ে লিসার সাহায্য নিতেই হলো ওকে। তুমি এখানেই থাকো। বলল লিসা।
সমস্যা নেই, আমি ম্যানেজ করে নিতে পারব।
তর্ক করার মতো সময় নেই লিসার। পেইন্টারের হাত ছেড়ে দিলো ও। পেইন্টার টলে উঠল। লিসা গানথারকে বলল, চলুন।
ব্রুকস দাঁড়িয়ে আছে, বুঝতে পারছে না কী করবে। লিসা ও গানরের পিছু পিছু যাবে নাকি পেইন্টার ক্রোর হাত ধরে সাহায্য করবে।
ইশারা করে মেজরকে চলে যেতে বলল ক্রো।
তারপর ওদের পিছু পিছু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোতে লাগল।
দৌড়ে পাশের কুঁড়েঘরে যাচ্ছে লিসা। বাইরে বের হতেই প্রচণ্ড গরমের হলকা অনুভব করল ও। মনে হলো, একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। বাতাসে কোনো গতি নেই, তপ্ত বাতাস থেকে শ্বাস নেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সূর্যের আলোর প্রখরতা এত বেশি যে প্রায় অন্ধ হওয়ার দশা। অবশেষে ঘরের ছায়ায় পৌঁছুল ও।
মাদুরের ওপর অ্যানা শুয়ে আছেন। তাঁর শরীর গুটিয়ে রয়েছে, শক্ত হয়ে আছে মাংসপেশি। লিসা দ্রুত তার কাছে এগিয়ে গেল। অ্যানার হাতে ইতোমধ্যে একটা নল লাগানো আছে। এরকম নল পেইন্টারের হাতেও ছিল। শরীরে তরল পদার্থ প্রবেশ করানোর সহজ উপায় এটা।
হাঁটু গেড়ে বসল লিসা। একটা সিরিঞ্জ বের করল। ইনজেকশন পুশ করার কয়েক সেকেন্ড পর অ্যানার শরীর স্বাভাবিক হলো, মাদুরের ওপর শরীর মেলে দিলেন তিনি। কয়েকবার পিটপিট করার পর চোখ খুলে তাকালেন, জ্ঞান ফিরেছে। অসুস্থ হলেও এখন তার মস্তিষ্ক সচেতন।
পেইন্টার হাজির হয়ে গেছে। ওর সাথে মনকও হাজির।
কী অবস্থা? পেইন্টার জানতে চাইল।
তোমার কী মনে হয়? রেগে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল লিসা।
বোনকে ধরে উঠে বসাল গানথার। অ্যানার চেহারা ফাঁকাসে হয়ে গেছে। ঘেমে গেছেন তিনি। একঘণ্টা পর পেইন্টারেরও এই একই দশা হবে। পেইন্টার ও আনা দুজনই খুব বাজেভাবে আক্রান্ত হয়েছে। তবে ক্রোর বিশালদেহি শরীর ওকে একটু বাড়তি সুবিধা দিলেও মোটের ওপর হাতে আছে মাত্র কয়েক ঘন্টা।
জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলোর দিকে তাকাল লিসা। সন্ধ্যা নামতে এখনও অনেক দেরি।
মনক নীরবতা ভাঙল। খামিশির সাথে কথা বলেছি। সে বলল এইমাত্র এস্টেটের ভেতরকার আলোগুলো সব নিভে গেছে। একটু একটু হাসছে সে। ভাবছে, এই সুখবর দেয়ার জন্য ওকে অভিনন্দন জানানো হবে। আমার মনে হচ্ছে, এটা গ্রের কাজ।
ভ্রু কুঁচকালো পেইন্টার। কাজটা যে সে-ই করেছে সেটা তো আমরা জানি না।
কাজটা যে সে করেনি, সেটাও আমরা জানি। নিজের টাক মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল মনক। স্যার, আমাদের মনে হয় টাইম-টেবিল এগিয়ে এনে কাজ করা উচিত। খামিশি বলছিল…।
খামিশি এই অপারেশন পরিচালনা করছে না, বলল ক্রো। কেশে উঠল।
লিসার দিকে তাকাল মনক। ওরা দুজন ২০ মিনিট আগে একটা ব্যক্তিগত আলোচনা করেছে। এজন্যই খামিশিকে কল করেছিল মনক। অভিযানে রদবদল আনতে হলে অনুমতি নিয়ে রাখা উচিত। সিসার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল মনক।
লিসা পকেট থেকে আরেকটা সিরিঞ্জ বের করল। পেইন্টারের পাশে এলো সে।
তোমার নলটা পরিষ্কার করে দিই, বলল লিসা। ওতে রক্ত জমে গেছে।
হাত উঁচু করল পেইন্টার। কেঁপে উঠল ওটা।
ওর কব্জি ধরে নিয়ে সিরিঞ্জ পুশ করল লিসা। মনক ক্রোর পাশে চলে এসে ধরে ফেলল, কারণ পা সরে গিয়ে আছড়ে পড়তে যাচ্ছিল ক্রো।
কী??? পেইন্টারের মাথা পেছনে হেলে গেছে।
একহাত দিয়ে তাকে সাহায্য করল মনক। আপনার ভালোর জন্যই করা হলো, স্যার।
লিসার দিকে তাকিয়ে পেইন্টার ভ্রু কুঁচকালো। এক হাত ওর দিকে বাড়িয়ে দিল ক্রো। বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য হয়তো লিসাকে আঘাত করতে চাইছে। লিসা সন্দেহ করল, এমনটা হয়তো ক্রো আন্দাজও করতে পারেনি। সিডেটিভ পেইন্টারকে অবশ করে দিলো।
মেজর ব্রুকস এসব দেখে হাঁ হয়ে গেছে।
তার দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল মনক। এর আগে কখনও বিদ্রোহ দেখোনি?
নিজেকে সামলে নিলো ব্রুকস। স্যার, আমি শুধু একটা কথা বলতে পারি… সময়টা খুবই খারাপ।
মাথা নাড়ল মনক। প্যাকেজ নিয়ে খামিশি আর তিন মিনিটের মধ্যে চলে আসছে। সে আর ড. কেইন এখান থেকে গ্রাউন্ড সাপোর্ট নেবে।
লিসা গানথারের দিকে ফিরল। তুমি তোমার বোনকে তুলে নিতে পারবে?
কথা বলল না। গানথার বোনকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়িয়ে কাজে প্রমাণ করল।
আপনারা কী করছেন এসব? দুর্বল কণ্ঠে জানতে চাইলেন অ্যানা।
রাত নামা পর্যন্ত আপনারা দুজন টিকতে পারবেন না, লিসা বলল। তাই আমরা বেল-এর দিকে এগোচ্ছি।
কীভাবে…?
আপনার ছোট মাথা দিয়ে আর এসব চিন্তা করার কষ্ট করবেন না, প্লিজ। পেইন্টারকে ও আর মেজর মিলে সাহায্য করছে। আমরা একটা ব্যবস্থা করে রেখেছি।
লিসার সাথে মনকের আবার চোখাচোখি হয়ে গেল। মনকের চোখের ভাষা পড়ল লিসা।
হয়তো ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
.
দুপুর ২টা ৪১ মিনিট।
হাতে পিস্তল নিয়ে এগোচ্ছে গ্রে। যতটুকু সম্ভব চুপিসারে এগোচ্ছে ও আর মারশিয়া। ফ্ল্যাশলাইটের উপরে মারশিয়া একহাতের তালু রাখলেন। আলোর বিচ্ছুরণ কম রাখতে চান, ঠিক যতটুকু তাদের দরকার ঠিক ততটুকু। বাড়তি আলো বিপদের কারণ হতে পারে। লিফটগুলো যেহেতু এখন বন্ধ হয়ে গেছে… তাই গ্রে ভাবল হয়তো সিঁড়িতে নড়াচড়া করছে গার্ডরা।
যদিও গ্রে নিজেই এখন একজন গার্ডের ছদ্মবেশে আছে। ভাবটা এমন–একজন মহিলা গবেষককে গার্ড দিয়ে গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু তারপরও গ্রে কোনো সত্যিকার গার্ডের সামনে পড়ে গিয়ে বাড়তি ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
ষষ্ঠ সাবলেভেল পার হলো ওরা। নিচের লেভেলের মতো এটাও ঘুটঘুটে অন্ধকার।
চলার গতি বাড়িয়ে এগোচ্ছে গ্রে। ওর মনে ভয় হচ্ছে, কখন না জানি ব্যাকআপ জেনারেটর চালু হয়ে যায়। পরবর্তী ল্যান্ডিঙে পৌঁছে একটু আলোর আভা দেখা গেল।
এক হাত উঁচু করে পেছনে থাকা মারশিয়াকে থামাল গ্রে।
আলোটা নড়ছে না, চুপচাপ স্থির হয়ে আছে।
তাহলে ওটা কোনো গার্ড নয়। হয়তো কোনো ইমার্জেন্সি লাইট।
তারপরও…
এখানেই থাকুন। ফিসফিস করে মারশিয়াকে বলল গ্রে।
মারশিয়া মাথা নাড়লেন।
গ্রে সামনে এগোলো। হাতে পিস্তল নিয়ে একদম প্রস্তুত। সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে আলোর উজ্জ্বলতা বাড়লো। আরও সামনে এগোনোর পর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল গ্রে। এই লেভেলের উপরের লেভেলগুলো এখনও অন্ধকার… নিচের লেভেলগুলোও অন্ধকার… তাহলে এখানে কারেন্ট আছে কীভাবে? এই লেভেলের জন্য নিশ্চয়ই আলাদা সার্কিট আছে।
করিডোর দিয়ে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
পরিচিত কণ্ঠ। ইসাক ও ব্যালড্রিক।
তাদের দুজনকে এখান থেকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে না। রুমের ভেতরে রয়েছে হয়তো। গ্রে নিচে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল আধো আলোতে মারশিয়ার চেহারা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। ইশারা করে মারশিয়াকে ওপরে আসতে বলল ও।
কণ্ঠস্বরগুলো তিনিও শুনতে পেয়েছেন।
ইসাক ও ব্যালড্রিক কারেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টা সম্পর্কে এখনও জানে না। এখানে দিব্যি কারেন্ট আছে, তাই ওরা হয়তো জানে না মূলভবনের কোথাও কারেন্ট নেই। নাকি জানে? উত্তরটা জানার কৌতূহল দমন করল গ্রে। ওয়াশিংটনকে সতর্ক করে দিতে হবে।
গ্রে শুনতে পেল ব্যালড্রিক বলছেন। বেল ওদের সবাইকে মেরে ফেলবে।
থামল গ্রে। তারা কী ওয়াশিংটনকে নিয়ে কথা বলছে? যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে তাদের প্ল্যানটা কী? যদি বিস্তারিত জানা যেত…।
দুই আঙুল উঁচু করে মারশিয়াকে দেখাল গ্রে। দুই মিনিট। এর মধ্যে যদি ও না ফেরে তাহলে মারশিয়াকে নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে এগোতে হবে। ওর কাছে থাকা আরেকটি পিস্তল মারশিয়াকে দিয়ে দিলো। এখানকার বেল-টাকে যদি ও দেখতে পারে তাহলে হয়তো অনেক মানুষের জীবন-বাঁচানো সম্ভব হলেও হতে পারে।
আবার দুই আঙুল দেখাল গ্রে।
মারশিয়া মাথা নাড়লেন। বুঝতে পেরেছেন, গ্রে যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে মারশিয়াকেই নিজের দায়িত্ব নিতে হবে।
সন্তর্পণে এগোচ্ছে গ্রে। একটু টু শব্দ করলে হয়তো ভেতরে থাকা লোকজন সতর্ক হয়ে উঠবে। নিচের লেভেলের মতো এখানে ফুরোসেন্ট লাইট দিয়ে হলওয়ে আলোকিত করা হয়েছে। একটু সামনে এগিয়ে জোড়া স্টিলের দরজার কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে হলওয়ে। তার ঠিক বিপরীত দিকে অন্ধকার লিফটের দরজা খুলে রয়েছে।
জোড়া স্টিল দরজার একটা দরজা এখন খোলা।
পা টিপে দ্রুত এগোল গ্রে। দরজার কাছে পৌঁছে দেয়াল জড়িয়ে ধরল। হাঁটু গেড়ে বসে নিয়ে পার হলো দরজা।
এটা একটা চেম্বার। ছাদটা বেশ নিচু। সাবলেভেলের পুরোটা জায়গা জুড়ে রয়েছে এই চেম্বার। সাধারণ চেম্বার নয়, এটা হলো মূল ল্যাবরেটরি চেম্বার। দেয়ালের পাশ দিয়ে সারি সারি কম্পিউটার রাখা আছে। সারি সারি কোড আর নাম্বার যাচ্ছে মনিটরগুলোতে। কম্পিউটারগুলোর জন্য নিশ্চয় আলাদা সার্কিটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
এখানে এখনও কারেন্ট যায়নি বলে হয়তো ওরা এখনও বিষয়টা টের পায়নি। তবে যেকোনো মুহূর্তে টের পেয়ে যাবে।
দাদা ব্যালড্রিক আর নাতি ইসাক একটা স্টেশনের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। ৩০ ইঞ্চি ফ্ল্যাট স্ক্রিন মনিটর ঝুলছে দেয়ালে, একটার পর একটা প্রাচীন বর্ণমালা তাতে ভেসে উঠছে। হিউগো সাহেবের বই থেকে পাওয়া ৫টি বর্ণ ঘুরে ফিরে দেখা যাচ্ছে মনিটরে।
কোড এখনও খুলতে পারিনি, বলল ইসাক। এরকম পরিস্থিতিতে কী বেল প্রোগ্রামকে পুরো পৃথিবী জুড়ে পরিচালনা করা ঠিক হবে?
কোড খোলা হয়নি তো কী হয়েছে? খোলা হবে। টেবিলে চাপড় দিলেন ব্যালড্রিক। কোড খোলা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাছাড়া, আমরা নিখুঁত করার প্রায় চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। তুমি নিজেকে আর তোমার বোনকে দেখ। অনেকদিন বাঁচবে তোমরা। শেষ দশকে যাওয়ার আগে তোমাদের স্বাস্থ্যের কোনো অবনতি হবে না। এখন আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সময় এসে গেছে।
ইসাক মেনে নিলো।
সোজা হলেন ব্যালড্রিক। হাত দিয়ে ওপরের দিকে ইশারা করে বললেন, দেখ, দেরি করে কী ফল পাওয়া যাচ্ছে। পুরো দুনিয়ার দৃষ্টি হিমালয়ের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, সেটাই এখন আমাদের দিকে বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে।
কারণ আমরা অ্যানা পোরেনবার্গকে ছোটো করে দেখেছিলাম।
এবং সিগমাকেও। যোগ করলেন ব্যালড্রিক। যা-ই হোক, সেটা ব্যাপার না। সোনা দিয়ে আমরা সরকারের কাছ থেকে নিরাপত্তা কিনে নেব। তবে যা করার এখুনি করতে হবে। প্রথমে ওয়াশিংটনকে দিয়ে শুরু করব, তারপর পুরো পৃথিবী। আর সেই হট্টগোলের ফাঁকে কোড ভাঙার জন্য যথেষ্ট সময় পাব আমরা। নিখুঁতের উৎকর্ষতা আমরা অর্জন করেই ছাড়ব।।
আফ্রিকার বাইরে নতুন এক পৃথিবী গড়ে উঠবে, বলল ইসাক। ওর বলার ধরন শুনে মনে হলো যেন কোনো প্রার্থনা করছে।
একদম নিরেট মানবজাতি পাব আমরা। কোনো মিশ্রণ কিংবা শংকর জাত থাকবে না। ব্যালড্রিক তার নাতির সাথে যোগ করলেন।
লাঠিতে ভর দিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন ব্যালড্রিক। গ্রে লক্ষ করে দেখল নিজের নাতির সামনে তিনি যথেষ্ট নরম মানুষ। শুধু বাইরের লোক উপস্থিত থাকলে সেখানে তিনি বাড়তি শক্ত-সামর্থ্য হবার ভান করেন। গ্রে ভাবল, ব্যালড্রিক যেভাবে দাবার ছক কেটে এগোচ্ছেন সেটা কী তিনি সচেতনভাবে করছেন নাকি অবচেতনভাবে? সামনে তিনি যা করতে চাচ্ছেন সেটা সম্পর্কে তাঁর পরিষ্কার ধারণা আছে? ন্যায়-অন্যায়বোধ আছে?
আরেকটি ওয়ার্কস্টেশনে গিয়ে ইসাক মুখ খুলল। বোর্ডে সবুজ আলো দেখতে পাচ্ছি। বেল-এ পাওয়ার আছে… চালু করার জন্য তৈরি। আমরা এখন এস্টেট থেকে পালিয়ে যাওয়া বন্দিদেরকে সাফ করতে পারব।
কপাল কুঁচকালো গ্রে। ওরা কী বলছে এসব? মানে কী?
মনিটরের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন ব্যালড্রিক। রুমের ঠিক মাঝখানে তাকালেন তিনি। তাহলে চালু করার জন্য তৈরি হও।
একটু সরলো গ্রে, যাতে রুমের মাঝে কী আছে সেটা দেখতে পায়।
রুমের মাঝখানে বিরাটাকার শেল রাখা। সিরামিক ও ধাতু দিয়ে নির্মিত ওটা। আকৃতিতে একটা ঘণ্টার মতো। গ্রের সমান উচ্চতা হবে বেলটার। বেল-এর পরিধি দেখে গ্রের সন্দেহ হলো, দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ওটার অর্ধেক নাগাল পাবে কি-না।
মোটরের গুঞ্জন শোনা গেল। একটা ধাতব পর্দা নেমে গেল সিলিং থেকে। বিভিন্ন গিয়ারকে আবৃত করে বাইরের বড় একটা শেলে গিয়ে পড়ল। ঠিক সেইসময় পাশে থাকা একটা হলুদ ট্যাঙ্ক খুলে গ্যাসকিট রক্তবর্ণের তরল প্রবেশ করতে শুরু করল বেল-এর ভেতর।
লুব্রিক্যান্ট? জ্বালানি?
গ্রের কোনো ধারণা নেই। তবে ট্যাঙ্কের পাশে থাকা নাম্বারটা ঠিকই ওর চোখে পড়ল। ৫২৫। সেই রহস্যসময় জেরাম।
ব্লাস্ট শিন্ড তোল! নির্দেশ দিলেন ব্যালড্রিক। কথাটি বলতে গিয়ে রীতিমতো চিৎকার করতে হলো তাকে। কারণ মোটর আর গিয়ারের আওয়াজে কথা শুনতে পাওয়া কঠিন।
এই লেভেলের পুরোটা ধূসর টাইল দেয়া, শুধু একটা বৃত্তাকার কালো অংশ বাদে। বেল-এর চারদিকে প্রায় ৯০ ফুট জুড়ে আছে সেটা। ৯০ ফুট অংশ জুড়ে দেয়াল তুলে দেয়া হলো। দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ১ ফুট। দেখতে অনেকটা সার্কাস রিঙের মতো। মেঝের উপরে থাকা সিলিং দেখতে হুবহু মেঝের মতোই… তবে সিলিঙে একটা খাঁজ কাটা বর্ডার আছে।
পুরোটা সীসার তৈরি।
গ্রে বুঝতে পারল দেয়ালটাকে নিশ্চয়ই সিলিঙ পর্যন্ত তুলে দেয়া হবে। বেল-এর চারিদিকের মোট ৯০ ফুট অংশ একদম সিলিন্ডার বন্দী হবে তাহলে।
কী সমস্যা? আবার গলা ফাটালেন ব্যালড্রিক।
ইসাক একটা সুইচ বারবার চাপ দিলো। ব্লাস্ট শিল্ড মোটরে আমরা কোনো পাওয়ার পাচ্ছি না!
গ্রে নিজের পায়ের দিকে তাকাল। মোটরগুলো নিশ্চয়ই নিচের লেভেলে রয়েছে। অন্ধকার লেভেল। রুমের ভেতরে কোথাও ফোন বেজে উঠল। গ্রে বুঝতে পারল কে ফোন করেছে। আসল কাহিনি অবশেষে সিকিউরিটির লোকজন জানতে পেরেছে।
এখান থেকে কেটে পড়তে হবে।
সোজা হয়ে ঘুরল গ্রে।
একটা পাইপ ওর কব্জিতে এসে আঘাত করল। পিস্তলটা পড়ে গেল ওর হাত থেকে। পরের আঘাতটা এলো ওর মাথা বরাবর। কোনোমতে আঘাত থেকে নিজের মাথা বাঁচাল গ্রে।
ইসকি ওর দিকে ধেয়ে এলো। তার পেছনে অন্ধকার লিফটের দরজা খোলা অবস্থায় রয়েছে। কারেন্ট বন্ধ করে দেয়ার ফলে এই মহিলা নিশ্চয়ই লিফটে আটকা পড়েছিল। তারপর লিফটের ওপরের অংশ খুলে ধীরে ধীরে এখানে এসে হাজির হয়েছে। মোটরের আওয়াজের কারণে গ্রে এসবের কিছুই টের পায়নি।
আবার পাইপ তুলল ইসকি। তার ভাবভঙ্গি দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এসবে সে খুবই দক্ষ।
ইসকির দিকে চোখ রেখে ধীরে ধীরে বেল-এর চেম্বারের দিকে পেছালো গ্রে। ও আর মারশিয়া ইমার্জেন্সি সিঁড়ি দিয়ে এখানে উঠে এসেছিল, পেছানোর সময় গ্রে একবারও সেদিকে তাকালো না। মনে মনে প্রার্থনা করল, মারশিয়া এতক্ষণে সেখান থেকে চলে গিয়ে যেন শর্টওয়েভ রেডিও যোগাড় করে ওয়াশিংটনকে সতর্ক করে দেয়।
ইসকির পোশাকে তেল, ময়লা, আর কালিতে মাখামাখি। গ্রের সাথে সাথে সে-ও বেল-এর চেম্বারে ঢুকছে।
গ্রের পেছন থেকে ব্যালড্রিক মুখ খুললেন। আরে, কী ব্যাপার? দেখা যাচ্ছে আমার ইসকি দাদু একটা ইঁদুর ধরেছে, হুম?
ঘুরল গ্রে।
ওর কাছে কোনো অস্ত্র নেই। বিকল্প কোনো রাস্তাও নেই।
অনলাইনে আসছে জেনারেটরগুলো… জানালো ইসাক। তার কণ্ঠে কোনো প্রাণ নেই, গ্রেকে এখানে দেখে সে মোটেও খুশি হয়নি।
একাধিক মোটর চালু হওয়ায় গ্রের পায়ে কাঁপুনি অনুভূত হলো। ব্লাস্ট শিল্ড উঠতে শুরু করল মেঝে থেকে।
এবার বাকি ইঁদুরগুলোকে মারার পালা। বললেন ব্যালড্রিক।
.
দুপুর ২টা ৪৫ মিনিট।
হেলিকপ্টার রোটরের আওয়াজকে ছাপিয়ে চিৎকার করল মনক। আপনি এই মেশিন ওড়াতে জানেন? ওদের চারপাশে ধুলো-বালি উড়ছে।
কপ্টারের স্টিক ধরতে ধরতে মাথা নাড়ল গানথার, জানে।
গানথারের কাঁধ চাপড়ে দিলে মনক। আপাতত নাসির উপরে ওকে ভরসা করতেই হচ্ছে। কারণ মনক হেলিকপ্টার চালাতে জানে না। তার উপর ওর এক হাত নেই। এদিকে গানথার ওর বোনকে বাঁচাতে মরিয়া, সে-হিসেবে পরিস্থিতি এখন নিরাপদ বলা যায়।
পেছনে লিসা ও অ্যানা একসাথে বসেছে। ওদের দুজনের মাঝখানে বসানো হয়েছে পেইন্টারকে, ওর মাথা ঝুলছে। অল্প করে সিডেটিভ দেয়া হয়েছে ওকে। একটু পরপর শব্দ করছে, গোঙাচ্ছে… সামনে বালুঝড় আসছে বলে সতর্ক করছে কাকে যেন। পুরানো স্মৃতি সব।
কপ্টারের পাখার প্রকোপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে মাথা নিচু করল মনক, কপ্টারের চারপাশে একটা চক্কর দিয়ে এলো। অপরদিকে খামিশি ও মশি পাশাপাশি একে অন্যের কনুই ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী পোশাক ছেড়ে মশি এখন খাকি পোশাক পরেছেন। তাঁর মাথায় ক্যাপ আর কাঁধে অটোমেটিক রাইফেল শোভা যাচ্ছে। কালো বেল্টে একটা পিস্তলও রেখেছেন তিনি। তবে গোত্রীয় ঐতিহ্য পুরোপুরি শ্রাগ করেননি। একটা খাটো বর্শা আছে তার পিঠে।
আপনাদেরকে তো ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, মনক এদিকে আসতেই খামিশিকে বললেন মশি।
জি, জনাব।
মাথা নেড়ে খামিশির কনুই ছাড়লেন মশি। তোমার সম্পর্কে অনেক ভাল কথা শুনেছি, ফ্যাট বয়।
মনক ওদের সাথে যোগ দিলো। ফ্যাট বয়? মানে কী?
খামিশির চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। একই সাথে লজ্জা ও সম্মানের ছাপ পড়েছে ওর চোখে। মাথা নেড়ে পিছু হটল সে। মশি হেলিকপ্টারে চড়লেন। হামলার প্রথম ধাপে থাকছেন তিনি। মনকের এখানে করার কিছু নেই। মশিকে সুযোগটা দেয়া ছাড়া ওর হাতে বিকল্প কোনো রাস্তা ছিল না।
পলা কেইনের দিকে গেল খামিশি। ওরা দুজন ভূমিতে হামলা পরিচালনা করবে।
ধুলো-বালির ভেতর দিয়ে চোখ বুলাল মনক। জনবল সব জড়ো হচ্ছে। পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে, মরিচা ধরা মোটরসাইকেলে আর ট্রাকে করে আসছে সবাই। মশির ঘোষণা শুনে জুলু গোত্রের লোকজন হাজির হচ্ছে। পূর্বপুরুষ বিখ্যাত সাকা জুলুর মতো মশি-ও একদল সেনাবাহিনি জড়ো করে ফেলেছেন। নর-নারী সবাই আছে এতে। সবার পরনে ঐতিহ্যবাহী জুলু পোশাক। এছাড়াও আরও জনবল আসছে।
এস্টেট দখল করার জন্য ওয়ালেনবার্গ আর্মিদের সাথে লড়বে ওরা। জুলু বনাম আধুনিক সিকিউরিটি ফোর্সদের লড়াইটা কেমন হবে? সামনে কী আরেকটা রক্তাক্ত নদীর পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে? আগেভাগে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়। মোকাবেলা করার পরই সেটা জানা যাবে।
কপ্টারের পেছনের জনবহুল অংশে উঠল মনক। মেজর ব্রুকসের পাশে মশি বসেছেন। অ্যানা, লিসা আর পেইন্টারের ঠিক বিপরীত পাশের বেঞ্চে বসে আছেন তারা। আরও একজন আছে এখানে। অর্ধ-নগ্ন জুলু-তাউ। কপ্টারের কো-পাইলটের গলায় বর্শার ফলা ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে ও।
বাধাবস্থায় প্রধান ওয়ার্ডেন জেরাল্ড কেলজ বসে আছেন গানথারের পাশে। তার এক চোখ ফুলে গিয়ে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
মক গানরের কাঁধে টোকা দিয়ে কপ্টারটাকে ওড়ানোর জন্য ইশারা করল। মাথা নেড়ে সায় দিলো গানথার। ইঞ্জিনে গর্জন তুলে হেলিকপ্টার বাতাসে ভর করল।
ভূমি দূরে সরে যেতেই এস্টেটকে সামনে দেখা গেল। মনক জানতে পেরেছে ওখানে ভূমি থেকে আকাশে ছোঁড়া যায় এরকম মিসাইল আছে। এদিকে ওদের কমার্শিয়াল কপ্টারে কোনো গোলা-বারুদ নেই। এই কপ্টার নিয়ে এগিয়ে যাওয়া অনেকটা আত্মহত্যার সামিল।
কিন্তু আপাতত এটাই করতে হবে। হাতে বিকল্প কোনো উপায় নেই।
সামনে ঝুঁকল মনক।
ওয়ার্ডেন সাহেব, সময় হয়ে গেছে।
ফাটা হাসি হাসল মনক। জানে পরিস্থিতি খুব একটা অনুকূলে নেই, তবে ফন্দিটা কাজে দেবে।
সোজা হলো কেলজ।
সন্তুষ্ট হয়ে মনক একটা রেডিও মাউথপিস এসে ওয়ার্ডেনের মুখের সামনে ধরল। আমাদেরকে সিকিউরিটি ব্যান্ডে লাইন দিন।
খামিশি ইতোমধ্যে কোড নিয়ে রেখেছে। সেটা করতে গিয়েই কেলজের এক চোখ রক্তবর্ণ হয়েছে।
যেভাবে শিখিয়েছি সেভাবে বলবেন, সতর্ক করে দিলো মনক, এখনও হাসছে।
একটু পেছনে ঝুঁকল কেলজ।
মনকের হাসি কী এতটাই ভয়ানক?
হুমকির জোর বাড়াতে তাউ ওয়ার্ডেনের গলার নরম মাংসের ভেতরে বর্শার ফলা খানিকটা ঢুকিয়ে দিলো।
রেডিও চালু হতেই শিখিয়ে দেয়া কথাগুলো বলল কেলজ। আমরা আপনাদের এক পালিয়ে যাওয়া বন্দীকে ধরেছি। সিকিউরিটি বেজের সাথে কথা বলছে সে। তার নাম–মক ক্যালিস। তাকে নিয়ে ছাদের হেলিপ্যাডে আসছি আমরা।
ওপাশ থেকে কী জবাব দিলো সেটা খেয়াল করছে গানথার।
ওকে, রজ্যার দ্যাট। ওভার অ্যান্ড আউট। কেলজ কথা শেষ করলেন।
খুশিতে গানথার চিৎকার করে উঠছিল প্রায়। আমরা অনুমতি পেয়ে গেছি। এবার নো প্রবলেম।
নির্ভীকভাবে কপ্টারকে এস্টেটের দিকে নিয়ে চলল ও। উপর থেকে এস্টেটের ভবনটাকে দেখতে আরও বিশাল লাগছে।
লিসার মুখোমুখি বসে আছে মনক। অ্যানা জানালার সাথে ঠেস দিয়ে বসে রয়েছেন। ব্যথায় তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আছে। সিট বেল্টে বাধা অবস্থায় সামনে ঝুঁকে গোঙাচ্ছে পেইন্টার। ওর সিডেটিভের প্রভাব কেটে যাচ্ছে।
লিসা ওকে ঠিক করে বসিয়ে দিলো।
মনক খেয়াল করে দেখল, লিসা পেইন্টারের হাত ধরে আছে… কপ্টারে ওঠার পর থেকেই ধরে ছিল… এখনও আছে।
মনকের দিকে তাকাল লিসা।
লিসার চোখে ভয়।
তবে ভয়টা নিজের জন্য নয়।
.
দুপুর ২টা ৫৬ মিনিট।
ব্রডকাস্টের রঙ উঠেছে? প্রশ্ন করলেন ব্যালড্রিক।
সায় দিলো ইসাক।
বেল-কে চালু হওয়ার জন্য তৈরি করো।
ব্যালড্রিক গ্রের দিকে ফিরলেন। আপনার সাথীদের ডিএনএ কোডগুলো আমরা বেল-এ ঢুকিয়ে দিয়েছি। বেল থেকে এখন যে আউটপুট বেরোবে সেটা ওই ডিএনএ গুলোর সাথে যাদের মিল পাবে ধ্বংস করে দেবে তাদেরকে। এছাড়া আর কারও কোনো ক্ষতি হবে না। একদম পরিষ্কার হিসেব। আমরা এভাবেই হিসেব মিটিয়ে থাকি।
গ্রে ভাবল, ফিওনা তো সেই একটা রুমে লুকিয়ে রয়েছে। আর মনক এখন কোথায় দৌড়াচ্ছে কে জানে।
ওদেরকে মেরে ফেলার কোনো প্রয়োজন নেই, বলল গ্রে। আমার সঙ্গীকে তো আপনারা আবার ধরে ফেলেছেন। বাকিদেরকে ছেড়ে দিন।
গত কয়েকদিনে আমি কিছুই জানতে পারিনি, তবে এতটুকু শিখেছি কোনো কাজের শেষ ঝুলিয়ে রাখতে নেই। ইসাককে ইশারা করলেন ব্যালড্রিক। বেল চালু করো!
থামুন! সামনে এগিয়ে এসে গ্রে চিৎকার করে উঠল।
পিস্তল তাক করে ওকে পিছিয়ে যাওয়ার জন্য ইশারা করল ইসাক।
ব্যালডিক পেছন ফিরে তাকালেন, বিরক্ত হচ্ছেন।
গ্রের হাতে খেলার মতো একটা কার্ড-ই আছে। আমি জানি, হিউগোর কোড কীভাবে ভাঙতে হবে।
কথাটা শুনে চমকে উঠলেন ব্যালড্রিক, একটু নরম হয়ে ইসাকের দিকে হাত তুলে ইশারা দিলেন, অপেক্ষা করো। আপনি পারবেন? যেখানে এক ঝাঁক উন্নতমানের ক্রে কম্পিউটার কোড ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে আপনি একাই হিউগোর কোড ভাঙবেন?
ব্যালড্রিকের কণ্ঠে সন্দেহ।
গ্রে বুঝতে পারছে, ব্যালড্রিকে এমনকিছু বলতে হবে যাতে তিনি এখুনি বেল চালু না করতে পারেন। মনিটর দেখাল ও। ওখানে ঘুরে ফিরে সেই ৫টি প্রাচীন বর্ণ প্রদর্শিত হচ্ছে।
আপনারা নিজেদের কারণেই ব্যর্থ হবেন। বলল গ্রে।
কারণ?
নিজের শুকনো ঠোঁট চাটলো গ্রে, ভয় পাচ্ছে। তবে কথা…কথা ওকে বলতেই হবে। ও জানে কম্পিউটার কোড ভাঙতে ব্যর্থ। কারণ কোডটা ও নিজে ভাঙতে পেরেছে। কিন্তু ভেঙে যে উত্তরটা পেয়েছে সেটা গ্রে বুঝে উঠতে পারছে না। বিশেষ করে হিউগো হিরজফিল্ডের ইহুদি পরিচয়টা বিবেচনায় রাখলে আরও দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে বিষয়টা।
কিন্তু তারপরও হাল তো ছাড়া যাবে না। দর কষাকষি ওকে করতেই হবে। সত্য আর আসল উত্তরের সমম্বয় ঘটাতে নিজের সর্বোচ্চটা দিতে হবে ওকে।
ডারউইন বাইবেল থেকে ভুল বর্ণ নিয়েছেন আপনারা। সতোর সাথে গ্রে জানাল। মোট ৬টা বর্ণ নিতে হবে। আপনারা নিয়েছেন ৫টা।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ব্যালড্রিক। গ্রের কথায় তার বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস নেই। এর আগে সূর্য চক্র এঁকেছিলেন সেরকম বর্ণ, তাই না?
না! জোর দিয়ে বলল গ্রে। দেখাচ্ছি…
এদিক-ওদিক খুঁজে একটা মার্কার দেখতে পেল ও। ওটা দিন, দেখাচ্ছি।
ভ্রু কুঁচকে ব্যালড্রিক ইসাকের দিকে মাথা নাড়লেন।
ইসাক মার্কারটা নিয়ে গ্রের দিকে ছুঁড়ে দিলো।
লুফে নিলো গ্রে। হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে টাইলসের ওপর আঁকতে শুরু করল।
ডারউইন বাইবেল থেকে বর্ণ আঁকছি।
এটা তো Mensch বর্ণ। ব্যালড্রিক বললেন।
বর্ণের ওপর টোকা দিলো গ্রে। এই বর্ণ মানুষের ভেতরে থাকা ঈশ্বরের মতো ক্ষমতার নির্দেশ করে। মানুষের এক উন্নত অবস্থা, এটা আমাদের সবার ভেতরে লুকিয়ে আছে।
তো?
হিউগো সাহেবের চূড়ান্ত লক্ষ্য তো এটাই ছিল তাই না? এই লক্ষ্যেই তিনি পৌঁছুতে চেয়েছিলেন?
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন ব্যালড্রিক।
হিউগো হয়তো চূড়ান্ত ফলাফলকে কোড হিসেবে তৈরি করেননি। তাঁর কোড অনুসরণ করে আমরা এটা পেয়েছি। বর্ণের ওপর জোরে টোকা দিলো গ্রে। কিন্তু এটা মূল কোড় নয়।
কথাগুলোকে বৃদ্ধ ব্যালড্রিকের মাথা ভাল করে ঢোকার জন্য একটু সময় দিলো গ্রে, তারপর ধীরে ধীরে ধীরে বলল, ডারউইন বাইবেলের আরেকটা বর্ণ হলো…
মেঝেতে নতুন একটা চিত্র আঁকল গ্রে।
এই দুটো বৰ্ণ মিলে তৃতীয় বর্ণের সৃষ্টি। প্রথম দুটো বর্ণ মানুষের একদম সাধারণ অবস্থার নির্দেশ করে। আর তৃতীয় বর্ণটা সম্পর্কে তো আগেই বলেছি। তাহলে প্রথম দুইটি বর্ণ কোড হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে।
প্রচলিত ধারাবাহিকতায় বর্ণগুলো আঁকল গ্রে। এটা ভুল।
এবার সঠিকভাবে আঁকল।
ব্যালড্রিক সামনে এগিয়ে এলেন। এটা সঠিক? তার মানে শেষ বর্ণটাকে ভাগ করতে হবে?
হ্যাঁ।
ব্যালড্রিক মাথা নাড়লেন। গ্রের ব্যাখ্যায় তিনি বোধহয় সন্তুষ্ট।
আমার মনে হয়, আপনি ঠিক বলেছেন, কমান্ডার পিয়ার্স।
গ্রে উঠে দাঁড়াল।
যা-ই হোক, ইসাকের দিকে ফিরলেন ব্যালড্রিক। বেল চালু করে ওনার বন্ধুদেরকে খতম করে দাও।
.
বিকাল ৩টা ৩৭ মিনিট।
রোটরের গতি কমার পর লিসা পেইন্টারকে নিয়ে কপ্টার থেকে নামলো। পেইন্টারের আরেকপাশ ধরেছে জুলু তাউ। সিডেটিভের প্রভাব আর কয়েক মিনিটের মধ্যে কেটে যাবে।
অ্যানাকে সাহায্য করছে গানথার। অ্যানার চোখ কাঁচের মতো স্বচ্ছ দেখাচ্ছে। তিনি নিজেই এক ডোজ মরফিন শরীরে পুশ করেছিলেন কিন্তু পরে কাশতে কাশতে রক্ত বেরিয়েছে গলা থেকে।
ওদের সামনে রয়েছে মনক ও মশি। হেলিপ্যাডে তিনজন সেন্ট্রি দাঁড়ানো ছিল। তবে তারা এখন মৃত। এখানকার নিরাপত্তা অতটা জোরদার করা ছিল না। কারণ সবাই আশা করছিল মাত্র একজন বন্দিকে ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে। সাইলেন্সরঅলা দুটো পিস্তল দিয়েই হেলিপ্যাডের সেন্ট্রিদের পরপারে পাঠিয়ে দিতে কোনো সমস্যাই হয়নি।
তাউর সাথে স্থান বদল করল মনক। এখানে থাকো। কপ্টার আর বন্দিকে পাহারা দাও।
ওয়ার্ডেন কেলজকে কপ্টার থেকে নামিয়ে ছাদের উপরে এনে ফেলা হয়েছে। দুই হাত পেছনে নিয়ে কব্জিতে হ্যান্ডকাফ আর পায়ের গোড়ালিতে বাঁধন দেয়া। সে চাইলেও কোথাও যেতে পারবে না।
মেজর ব্রুকস ও মশিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ইশারা করল মনক। পলা কেইনের যাবতীয় নকশা পর্যালোচনা করে ভূগর্ভস্থ লেভেলে যাওয়ার জন্য সেরা রাস্তার দুক কেটে রাখা হয়েছে। সেদিকে এগোতে হবে এখন। এই হেলিপ্যাডের অবস্থান মূলভবনের পেছন দিকে।
ব্রুকস ও মশি মূলভবনে যাওয়ার জন্য ছাদের দরজার দিকে এগোলো। ওদের দুজনের কাঁধে রাইফেল শোভা যাচ্ছে। দুজন এত গোছানোভাবে কাজ করছে যেন একে অন্যের কত চেনা, এর আগেও একসাথে মিশন পরিচালনা করেছে! সুন্দর বোঝাপড়া আছে মেজর আর মশির মধ্যে। গানথারের হাতে পিস্তল আছে, এছাড়া খাটো নাকতলা একটা রাইফেল শোভা পাচ্ছে পিঠে। অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ওরা দরজার কাছে পৌঁছে গেল।
সামনে এগোল ব্রুকস। সেন্ট্রিদের কাছ থেকে কি-কার্ড সংগ্রহ করেছে সে। লক খুলে। নিচের দিকে এগোল দুজন : মশি ও ব্রুকস। বাকিরা দাঁড়িয়ে রইল।
ঘড়ি দেখল মনক। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটা করতে হবে। টাইমিংটাই আসল।
নিচ থেকে শিস দেয়ার আওয়াজ শোনা গেল।
সংকেত।
এবার আমরা নিচে যাব। বলল মনক।
সামনে এগিয়ে ওরা দেখল সাত তলায় একটা সিঁড়ি চলে গেছে। ল্যান্ডিঙে দাঁড়িয়ে আছে ব্রুকস। আরেকটা গার্ড পড়ে আছে সিঁড়িতে। গলা ফাঁক হয়ে রয়েছে তার, গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। মশি পরবর্তী ল্যান্ডিঙে নিচু হয়ে বসে রয়েছেন, হাতে রক্তাক্ত ছুরি।
সিঁড়ি বেয়ে নামছে সবাই। প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে নেমে গেছে সিঁড়িটা। আর কোনো গার্ডের মুখোমুখি হতে হলো না ওদের। ওরা আশা করল, অধিকাশং গার্ড বাইরের দিকে রওনা হয়েছে। কারণ, জুলু গোত্রের লোকজন দৃষ্টিআকর্ষণ করেছে তাদের।
মনক আবার ঘড়ি দেখল।
তিন তলায় পৌঁছে পালিস করা কাঠের লম্বা করিডোরের দিকে এগোল ওরা। করিডোরটা ছায়াময়, বেশ অন্ধকার। দেয়ালে মোমদানি জ্বলছে। পাওয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হয়তো মোম জ্বালানো হয়েছে। কোনো এক কারণে পাওয়ার বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা এমনকিছু চালু করা হয়েছে যেটা অনেক পাওয়ার গ্রহণ করছে।
বাতাসের দুর্গন্ধটা খেয়াল করল লিসা।
একটা আড়াআড়ি ক্রস প্যাসেজে গিয়ে করিডোরটা শেষ হয়েছে। ডান দিকে এগোল ব্রুকস। পরিকল্পনা মতে, ওদেরকে ডান দিকেই যেতে হবে। একটু পরেই দ্রুত ফিরে এলো মেজর।
পিছু হটুন… পিছু হটুন সবাই!
কোণা থেকে রক্তহিম করা গর্জন ভেসে এলো। তারপর আরও কয়েকটা গর্জন… উত্তেজিত হুঙ্কার।
উকুফা। বললেন মশি। ইশারা করে সবাইকে পিছু সরতে বললেন।
দৌড়ান! মেজর বলল। আমরা ওগুলোকে ভয় পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করব, তারপর এগোব।
লিসা ও পেইন্টারকে নিয়ে মনক পিছু হটল।
কী…? লিসা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও আটকে গেল। শব্দ হারিয়ে ফেলেছে। কেউ আমাদের উপরে ওগুলোকে লেলিয়ে দিয়েছে, বলল মনক।
অ্যানাকে নিয়ে চলছে গানথার। বোনকে রীতিমতো উঁচু করে নিচ্ছে সে, অ্যানার পা দুটো আলগোছে মেঝে স্পর্শ করছে।
হঠাৎ ওদের পেছনে বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল।
গর্জন আর হুঙ্কারগুলো পরিণত হলো রাগ আর আর্তনাদে।
দ্রুত দৌড়াল ওরা।
ধুর! গলা উঁচিয়ে বলল মেজর।
লিসা পেছন ফিরে তাকাল।
ব্রুকস আর মশি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু এখন পেছন দিকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারাও ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।
যান, এগোন… তাড়াতাড়ি… চিৎকার করল মেজর। সংখ্যায় ওগুলো অনেক!
ওদের পেছনে তিনটে সাদা রঙের দানব উদয় হলো। মেঝের সাথে মাথা ঠেকিয়ে এগোচ্ছে ওগুলো। থাবা দিয়ে কাঠের মেঝে আকড়ে ধরে এগোচ্ছে। বুলেট হজম করছে ঠিকই কিন্তু বুদ্ধি খাঁটিয়ে মারাত্মক বুলেটগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছে, ওগুলো গায়ে ঢুকলে মারা পড়তো। দানব তিনটার শরীর থেকে রক্ত ঝরলেও নিস্তেজ হওয়ার বদলে উল্টো আরও জেদ নিয়ে এগিয়ে আসছে।
পেছনে তাকানো অবস্থায় একটু চোখ বুলালো লিসা। দেখল ওরকম আরও দুটো দানব করিডোরের দুপাশ থেকে বেরিয়ে আসছে।
অ্যামবুশ। হামলা।
হাতে থাকা বিশাল পিস্তল থেকে গানথার গুলি ছুড়ল কিন্তু সামনে এগিয়ে থাকা দানবটার গায়ে গুলি লাগলো না। গুলির লাইন বরাবর থেকে হঠাৎ করে চোখের পলকে একপাশে সরে গেল দানবটা।
নিজের অস্ত্র তুলল মনক, দানবগুলোকে থামানোর চেষ্টা করবে।
দৌড়ের গতি সামলাতে না পেরে হাঁটু গেড়ে পড়ে গেল লিসা। পড়ার সময় পেইন্টারকেও টেনে নামালো। আছড়ে পড়ার ধাক্কায় একটু জ্ঞান ফিরল ক্রোর।
কী…? কোথায়…?
পেইন্টারকে টেনে আরও নিচে নামাল লিসা। গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। নিচু হয়ে থাকাই নিরাপদ।
তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার ভেসে এলো ওর পেছন থেকে। ভারি দেহের কিছু একটা পাশের দরজা থেকে বেরিয়ে এসে মেজর ব্রুকসকে দেয়ালে আছড়ে ফেলল।
দৃশ্যটা দেখে চিৎকার করে উঠল লিসা।
মেজরকে বাঁচাতে মশি এগিয়ে এলেন। মাথার উপরে একটা বর্শা নিয়ে হুঙ্কার দিলেন তিনি।
ভয়ে লিসা পেইন্টারকে জড়িয়ে ধরল।
দানবগুলো সবজায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে।
লিসার চোখে কিছু একটা নড়াচড়া ধরা পড়ল। বাঁ পাশের একটা দরজার পেছন থেকে আরেকটা দানব বেরিয়ে আসছে। ওটার মুখ তাজা রক্তে মাখামাখি। রুমের অন্ধকারের ভেতরে ওটার লাল টকটকে দুটো চোখ যেন ইট ভাটার মতো জ্বলছে। অতীতে ফিরে গেল সিসা। এরকম চোখ ও আগেও দেখেছে। নেপালে বুদ্ধ সন্ন্যাসীর চোখে ঠিক এরকম ভয়ঙ্কর বুনো চাহনি ছিল, চাহনিতে অস্বাভাবিকতা থাকলেও বুদ্ধি কিংবা চালাকিতে কেউ-ই কম নয়। বুদ্ধ সন্ন্যাসী আর এই দানব দুটোই জাতে মাতাল তালে ঠিক।
দানবটা লিসার দিকে এগোচ্ছে… পেছন দিকে বেঁকে রয়েছে ওটার ঠোঁট দুটো। গরগর আওয়াজ করে বিজয়ের উল্লাস প্রকাশ করছে।