০২. ডারউইন’স বাইবেল

০২.

ডারউইন’স বাইবেল

১৬ মে, সকাল ৬ টা ৫ মিনিট।
কোপেনহ্যাগেন, ডেনমার্ক।

বইয়ের দোকানের সাথে বিড়ালের কীসের সম্পর্ক?

 হোটেল ন্যাভন থেকে বের হওয়ার পর আরও একটি চুষে খাওয়ার ক্লেরিটিন ট্যাবলেটকে কচকচ করে গুড়ো করে ফেলল কমান্ডার গ্রেসন পিয়ার্স। গতকাল কোপেনহ্যাগেনের বইপড়য়া কমিউনিটিতে গবেষণা করার পর আজ শহরের আধ ডজন বই সংক্রান্ত স্থানে ঢু মারতে হয়েছে তাকে। প্রতিটি বইয়ের দোকানে বিড়াল নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। কাউন্টারগুলোতে ঘুরোঘুরি, বুকশেলফে রাখা বইয়ের ওপরে জমে থাকা ধূলোর ওপর দিয়েও তাদের অবাধ যাতায়াত।

বিড়ালগুলোর জন্য এখন ওকে ভুগতে হচ্ছে। একটা হাঁচি দিল ও। তবে এই হাঁচি ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করার কারণেও হতে পারে। কোপেনহ্যাগেনের বসন্ত কাল নিউ ইংল্যান্ডের শীতকাল একই কথা। পিয়ার্স যথেষ্ট গরম কাপড় সাথে আনেনি।

হোটেলের পাশে থাকা এক বুটিকের দোকান থেকে কেনা একটি সোয়েটার পরে আছে ও। গলা কাটা দাম রেখেছে দোকানে। সোয়েটারের উঁচু কলারটা ভেড়ার পশমে মোড়ানো। কোনো রং করা নেই। পশমগুলো চুলকালেও ভোরের ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করছে বেশ ভালভাবেই। অবশ্য ভোর হয়েছে আরও ঘণ্টাখানেক আগে। কালচে-ধূসর আকাশে সূর্যের যেরকম নোনা তেজ দেখা যাচ্ছে তাতে আজ তাপমাত্রা বাড়ার কোনো আশা নেই। কলারের ওখানটায় একটু চুলকে নিল পিয়ার্স। সেন্ট্রাল রেল স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে ও।

শহরের একটি খালের পাশে ছিল ওর হোটেল। সুন্দর করে রং করা এক সারি ঘর ছিল ওটা। পানির দু’ধারে বিভিন্ন ধরনের দোকান, ছাত্রাবাস ও ব্যক্তিগত বাড়ি ছিল। এরকম দৃশ্য দেখে আমসটার্ডামের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল ওর। দুই পাড়ে নোঙর করা ছিল হরেক রকম জলযান। কম আকর্ষণীয় নিচু ছাদের পাল তোলা নৌকা থেকে শুরু করে চমৎকার প্রমোদতরী, কাঠের তৈরি স্কুনার, ঝলমলে ইয়ট; সবই ছিল ওখানে। মাথা নেড়ে একটি ইয়টের পাশ দিয়ে চলে এলো গ্রে। ওটাকে দেখতে ভাসমান ওয়েডিং কেকের মতো লাগছিল। এত সকালেও ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে কিছু দর্শনার্থী এখানে হাজির হয়ে গেছে। এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে কিংবা ব্রিজের রেইলের ওখানে গিয়ে ছবি তুলছে মনের সুখে।

 পাথরের খাম পেরিয়ে খালের তীর ধরে হাফ ব্লক পর্যন্ত এগোল গ্রে। ইটের পাচিলের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পানির দিকে তাকাল ও। স্থির পানিতে ওর প্রতিবিম্ব আছে, একটু বাঁকা অংশ দু’ভাগে আলাদা করেছে থুতনিকে। চেহারার মসৃণতা ও তীক্ষ্ণ ধাকগুলো বলে দিচ্ছে ও যুক্তরাজ্যে ওয়েলস প্রদেশের অধিবাসী। বাবার মতোই হয়েছে গ্রে। একটা ব্যাপার গ্রেসনের মাথায় প্রায়ই ঘুরপাক খায়, রাতে ঘুম হয় না ওর।

বাবার কাছ থেকে আর কী কী পেয়েছে ও?

এক জোড়া ব্ল্যাক সোয়ান ওর পাশ দিয়ে আঁতরে গেল। পানিতে আলোড়ন তৈরি না হওয়ায় প্রতিবিম্ব আর ঠিক থাকল না। হাঁস দুটো ব্রিজের দিকে এগোচ্ছে। গলা নড়িয়ে নির্লিপ্তভঙ্গিতে সাঁতরাচ্ছে ওরা।

গ্রে ওদের দেখে শিখল। সোজা হয়ে নোঙর করে রাখা নৌকাগুলোর ছবি তোলার ভান করল ও। তবে ওর মূল উদ্দেশ্য হলো এইমাত্র পেরিয়ে আসা ব্রিজ পর্যবেক্ষণ করা। কোনো একাকী ব্যক্তি, পরিচিত মুখ কিংবা সন্দেহজনক কাউকে দেখা যায় কি না দেখল ও। খালের পাশে অবস্থান নেয়ার একটা সুবিধা আছে। কেউ পিছু নিয়েছে কি-না সেটা ব্রিজ থেকে সহজেই খেয়াল করা যায়। কারণ, ক্রস করে রাখা পাথরের খামের পর পিছু নেয়া ব্যক্তিকে নিজের অস্তিতের জানান দিতেই হবে। কোনো উপায় নেই। এক মিনিট ধরে পর্যবেক্ষণ করার পর সন্তুষ্ট হলো গ্রে। যাদেরকে দেখল তাদের সবার চেহারা আর হাঁটার ভঙ্গি মাথায় গেঁথে নিল। এগোল নিজের পথে।

 এরকম ছোটো অ্যাসাইনমেন্টে এত সতর্কতার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই কিন্তু ওর গলায় দায়িত্বের বোঝা আছে। জিনিসটি হলো একটি চেইন। রূপোর ছোট একটি ড্রাগন ঝুলছে ওতে। আড়ালে থাকা এক খেলোয়ারের কাছ থেকে উপহার পেয়েছে এটা। মনে রাখার জন্য গলায় পরে ও। সতর্ক থাকার জন্য কাজে দেবে।

সামনে এগিয়েছে এমন সময় পকেটে পরিচিত কম্পন অনুভব করল গ্রেসন পিয়ার্স। সেল ফোন বের করল ও। এত সকাল সকাল কে ফোন করল ওকে?

‘পিয়ার্স বলছি,’ বলল ও।

 ‘গ্রে, যাক, তোমাকে পাওয়া গেল।

সকালের ঠাণ্ডার মধ্যেও পরিচিত মসৃণ কণ্ঠস্বর শুনে উষ্ণতাবোধ করল গ্রে। ওর কঠোর চেহারায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। র‍্যাচেল…? কথা বলতে গিয়ে একটু ধীরে পা ফেলল ও। কোনো সমস্যা হয়েছে?

গ্রেসন পিয়ার্সের আটলান্টিক পেরিয়ে এই ডেনমার্ক আসার পেছনে মূল কারণ হলো এই র‍্যাচেল ভেরোনা। এখানে বর্তমানে যে তদন্ত চলছে সেটা সিগমার কোনো লো-লেভেল রিসার্চ অ্যাসিসটেন্টকে দিয়ে করিয়ে নেয়া যেত। কিন্তু এই মিশন হাতে নিলে কালো চুলের অধিকারিণী সুন্দরী ইটালিয়ান লেফটেন্যান্টের সাথে দেখা করার মোক্ষম সুযোগও পাওয়া যায়। ওদের দুজনের প্রথম দেখা হয়েছিল রোমে, সর্বশেষ একটি কেস নিয়ে। তখন থেকে দুজন দেখা করার জন্য মুখিয়ে আছে, কিন্তু উপযুক্ত সুযোগ পাচ্ছে না। র‍্যাচেল ইউরোপে নিজের কাজ নিয়ে বন্দী থাকে অন্যদিকে ফোর্সের হয়ে কাজ করার সুবাদে ওয়াশিংটন থেকে সরার খুব একটা সময় পায় না গ্রে।

ওদের শেষ দেখা হওয়ার পর প্রায় আট সপ্তাহ কেটে গেছে। দুজন একসাথে ফিরল ওরা।

আট সপ্তাহ। অনেক দিন পার হয়ে গেছে।

ওদের সর্বশেষ দেখা হওয়ার ঘটনা মনে পড়ল গ্রেসন পিয়ার্সের। ভেনিসের এক ভিলায় ছিল ওরা। সূর্যের আলো পেছনে থাকায় বেলকুনির খোলা দরজার সামনে র‍্যাচেলের দেহ কাঠামো ফুটেছিল। পুরো সন্ধ্যায় বিছানায় কাটিয়েছিল দু’জন। স্মৃতির জোয়ারে ভাসতে শুরু করল গ্রে। র‍্যাচেলের ঠোঁটের সেই দারুচিনি ও চকোলেটের স্বাদ, ভেজা চুলের ঘ্রাণ, ঘাড়ে পড়া উষ্ণ নিঃশ্বাস, আলতো গোঙানি, দু’জনের জড়ানো শরীর, নরম আদর….

ব্ল্যাক টেডি বিয়ারটাকে প্যাক করার কথা যেন র‍্যাচেলের মনে থাকে, প্রার্থনা করল গ্রে।

‘আমার ফ্লাইট টাইম পিছিয়ে গেছে। লেট।’ বলল র‍্যাচেল। ওকে কল্পনা থেকে বাস্তবে নিয়ে এল।

‘কী?’ খালের পাশে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। গলার স্বরের হতাশা লুকোতে ব্যর্থ হয়েছে।

 ‘কেএলএম ফ্লাইটে চড়ে আসব আমি। রাত দশটায় ল্যান্ড করব।”

দশটায়। ভ্রু কুঁচকানো গ্রে। তার মানে মধ্যযুগীয় এক মঠ ভল্টের পাশে অবস্থিত সেন্ট জারট্রাডস ক্লোসটার-এর ডিনার বিজারভেশনটা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট দিনের পাক্কা এক সপ্তাহ আগে বুকিং দিয়েছিল গ্রেসন।

‘আমি দুঃখিত, পিয়ার্সের নীরবতা বুঝে বলল র‍্যাচেল।

‘না… কোনো সমস্যা নেই। তুমি এসো। তোমার আসাটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার।’

‘আমি জানি। আমি তোমাকে অনেক মিস করি।’

 ‘আমিও।

র‍্যাচেলকে এত সাদামাটাভাবে জবাব দেয়ার কারণে গ্রেসন দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল। কত কিছু ভেবে রেখেছিল ও কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। কেন কেমন হয়? প্রত্যেক প্রেমিক-প্রেমিকার প্রথম মিলনের দিনে একটি কঠিন ধাপ উত্তীর্ণ হতে হয়। সেটা হলো : অস্বস্তিকর লজ্জা। দুজনে দুজনার প্রেমে ডুবে বাহুডোরে বাঁধা পড়ল…। এরকম কাব্যিক কথা বলা সহজ হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। অতীতের স্মৃতিকে পুঁজি করে প্রথম এক ঘন্টা ওরা প্রায় অপরিচিত মানুষের মতো আচরণ করেছিল। জড়িয়ে ধরে, চুমো খেয়ে, আসল কথা বলে ফেললেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু গভীর প্রণয় জমতে একটু সময়ের প্রয়োজন। আটলান্টিকের দুই তীরে বসবাসরত দুই মানব-মানবীর একে অপরকে বোঝার জন্য এক ঘন্টা লেগে গিয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ছন্দ খুঁজে পেয়েছিল ওরা। কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠস্বরের উঁচু-নিচু হয়ে যাওয়া ওদেরকে আরও আবেগপ্রবণ করে দিয়েছিল।

আর গ্রেসন প্রতিবারই ভয় পাচ্ছিল ওরা হয়তো শেষপর্যন্ত মূল লক্ষ্য খুঁজে পাবে না।

‘তোমার বাবা কেমন আছে?’ নাচতে শুরু করার প্রথম স্টেপ দেয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিল র‍্যাচেল।

প্রয়োজনীয় হোক বা না থোক ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা শুরু হওয়ায় আপত্তি ছিল না গ্রেসনের। আর যেহেতু ওর কাছে ভাল খবর আছে, তাহলে আর সমস্যা কীসের। সে

কয়েকটি অনিশ্চয়তার ধাপ আছে এই আরকী। আমার মায়ের ধারণা বাবার এই উন্নতির পেছনে তরকারির প্রভাব আছে।

 ‘তারকারি? ঝাল দেয়া?

 ‘একদম। কোনো আর্টিকেলে সে পড়েছিল হলুদ তরকারি নাকি এরকম রোগে ভাল কাজে দেয়।’

“আচ্ছা। তারপর?

 ‘তারপর থেকে আমার মা সবকিছুতে তরকারি দেয়া শুরু করল। এমনকি আমার বাবার সকালের ডিমও রেহাই পেল না। ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের মতো ঘ্রাণ বের হয় পুরো বাড়ি থেকে।

র‍্যাচেলের নরম হাসি নিরানন্দ সকালকে মিষ্টি করে তুলল। ‘যাক। তিনি অন্তত রান্নাটা করছেন।’

চওড়া হাসি দিল গ্রে। ওর মা জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির বায়োলজির প্রফেসর। ঘরের কাজে তার কোনো দক্ষতা ছিল বলে ইতিপূর্বে জানা ছিল না। একটি ইন্ডাসট্রিয়াল দুর্ঘটনায় স্বামী অচল হয়ে যাওয়ার পর নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে বিগত বিশ বছর ধরে অনেক ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন তিনি। এখন তার পরিবারে নতুন এক সমস্যার উদয় হয়েছে। গ্রে’র বাবার অ্যালঝেইমার-এর প্রাথমিক অবস্থা চলছে। ইউনিভার্সিটি থেকে অল্প কিছুদিনের ছুটি নিয়ে স্বামীর সেবা করছিলেন তিনি। কিন্তু তার ক্লাসে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে, তাগাদা দেয়া হচ্ছে ভার্সিটি থেকে। ওয়াশিংটন থেকে গা বাঁচিয়ে এই ঝটিকা ভ্রমণে গ্রে’র সবকিছু বেশ ভালই কেটেছিল।

নতুন করে কিছু বলার আগেই আরেকটি কলের ধাক্কায় কেঁপে উঠল ওর ফোন। কে ফোন করেছে, দেখল গ্রে। ধুর…

 ‘র‍্যাচেল, সেন্ট্রাল কমান্ড থেকে ফোন করেছে। ফোনটা ধরতে হচ্ছে। আমি দুঃখিত।

‘ওহ, আচ্ছা। ঠিক আছে, রাখো।’

দাঁড়াও, র‍্যাচেল। তোমার নতুন ফ্লাইট নাম্বার।

‘কেএলএম ফ্লাইট ফোর জিরো থ্রি।

 “ঠিক আছে। আজ রাতে দেখা হচ্ছে।’

‘হুঁ, আজরাতে।’ পুনরাবৃত্তি করে লাইন কেটে দিল র‍্যাচেল। ফ্ল্যাশ বাটন চেপে অন্য কল ধরল গ্রে। পিয়ার্স বলছি।

‘কমান্ডার পিয়ার্স।’ নিউ ইংল্যান্ডীয় উচ্চারণেই বোঝা গেল বক্তার নাম লোগান গ্রেগরি, সিগমা ফোর্সের সেকেন্ড ইন কমান্ড। ডিরেক্টর পেইন্টার ক্রো’র সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাজ করেন তিনি। বরাবরের মতো লোগান এবারও কোনো আলগা কথা বলে সময় নষ্ট করলেন না।

‘আমরা এমন একটা খবর পেয়েছি যেটার সাথে হয়তো তোমার কোপেনহ্যাগেন অনুসন্ধানের কোনো সম্পর্ক আছে। ইন্টারপোল থেকে বলা হয়েছে আজকের নিলাম অনুষ্ঠানের প্রতি হঠাৎ সবাই অনেক আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

আরেকটি ব্রিজ পেরিয়ে আবার থামল গ্রে। দশ দিন আগে, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি কয়েকজন কালো বাজারিকে চিহ্নিত করেছে, যাদের সবাই ভিক্টোরিয়ান-যুগের বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলাদি বেচা-কেনার সাথে জড়িত। কেউ পাণ্ডুলিপি, প্রতিলিপি, আর কেউ আবার দলিল, চিঠি আর ডায়েরি সংগ্রহ করে থাকে। সেই ভিক্টোরিয়ান-যুগের সময় থেকে বিভিন্ন লোকের হাত বদল হয়ে তাদের কাছে এসে পৌঁছে ওগুলো। এরকম বিষয়ে সিগমা ফোর্স একটু আগ্রহ দেখালে দেখাতে পারে যদি সেটা নিরাপত্তার জন্য কোনো প্রকার হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এনএসএ বলছে এগুলো থেকে প্রাপ্ত অর্থ সন্ত্রাস গোষ্ঠীদের কাছে যাচ্ছে। অথচ এরকম প্রতিষ্ঠানের অর্থ কোখী থেকে কোথায় যাচ্ছে সেটার ওপর সবসময় নজরদারি করা হয়ে থাকে।

কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে এরকম ঐতিহাসিক দলিলপত্র অর্থ বিনিয়োগের জন্য ভাল জিনিস, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এগুলোর সাথে তো সন্ত্রাস গোষ্ঠীদের সম্পর্ক থাকে না। কে জানে, দিনকাল বদলেছে। কত কিছুই তো হতে পারে।

এই ব্যাপারের সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রধান বিষয়গুলো অনুসন্ধানে নেমেছে সিগমা ফোর্স। আজ সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিতব্য নিলাম অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যত বেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করাই হচ্ছে গ্রে’র অ্যাসাইনমেন্ট। স্থানীয় সগ্রাহক ও দোকানগুলো কোন কোন জিনিস নিয়ে বেশি আগ্রহী সেটাও জানতে হবে ওকে। এজন্যই গত দুই দিন কোপেনহ্যাগেনের বিভিন্ন সরু গলি-ঘুপচিতে থাকা ধূলো ভর্তি বইয়ের দোকান ও অ্যান্টিকশপগুলোতে টু মেরেছে। তাদের মধ্যে হজব্রা প্ল্যাডস-এর একটি দোকান ওর সবচেয়ে বেশি কাজে এসেছে। জর্জিয়ার এক সাবেক আইনজীবীর দোকান ওটা। তার সাহায্য পেয়ে গ্রে ভেবেছিল, ও এখন কাজের জন্য প্রস্তুত। পিয়ার্সের আজকের প্ল্যান ছিল অনেকটা এরকম :

সকালে উঠে নিলামের এলাকাটা দেখে অনুষ্ঠানে ঢোকা আর বের হওয়ার রাস্তায় কয়েকটি বাটনহোল ক্যামেরা বসাবে, ব্যস। নিলামে গিয়ে ওর কাজ হবে নিলামে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ভাল করে পর্যবেক্ষণ করা এবং সুযোগ পেলে ছবি তুলে নেয়া। ছোট অ্যাসাইনমেন্ট।

‘আকর্ষণীয় কী উঠছে আজ?’ জিজ্ঞেস করল গ্রে।

নতুন আইটেম। আমরা যাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করছি ওটা তাদের অনেকের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। একটা পুরোনো বাইবেল। কোনো এক প্রাইভেট পার্টি নিলামে তুলেছে।

‘এতে এত উত্তেজনার কী আছে?

 ‘আইটেমের বিবরণে লেখা আছে, বাইবেলটা ডারউইনের।

 ‘চার্লস ডারউইন, বিবর্তনবাদের জনক?

 “হ্যাঁ।

ব্রিজের রেলিঙে আঙুল ঠুকল গ্রে। চার্লস ডারউইন, ইনিও ভিক্টোরিয়ান-যুগের বিজ্ঞানী। বিষয়টা ভাবতে ভাবতে পাশের ব্রিজের ওপর চোখ বুলাল ও।

গ্রে দেখল হুড তোলা গাঢ় নীল সোয়েটার জ্যাকেট পরা এক অল্প বয়সী মেয়ে ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সতের… আঠারো বয়স। মসৃণ চেহারা, ত্বকের রং রোদে পোড়া। হুডের একপাশ দিয়ে বেরিয়ে আসা চুলের লম্বা বিণুনি দেখে ভাবল ও… ভারতীয়? নাকি পাকিস্তানি? মেয়েটির বাম কাঁধে একটি সবুজ রঙের ব্যাগ রয়েছে। কলেজ পড়ুয়া অনেক ছাত্র-ছাত্রীর কাছে এরকম ব্যাগ থাকে।

কিন্তু ঘটনা হলো, গ্রে এই মেয়েকে এর আগেও দেখেছে… প্রথম ব্রিজ পার হওয়ার সময়। প্রায় ১৫০ ফুট সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির চোখে চোখ পড়েছিল ওর। চট করে অন্যদিকে ঘুরেছিল মেয়েটি অস্বাভাবিক ব্যাপার।

মেয়েটি ওকে ফলো করছিল।

লোগান বলে যাচ্ছে, ‘তোমার ফোনের ডাটাবেসে আমি বিক্রয়কারীর ঠিকানা আপলোড করে দিয়েছি। নিলাম শুরু হওয়ার আগে তার সাথে কথা বলার জন্য যথেষ্ট সময় পাবে তুমি।’

ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ঠিকানায় চোখ বুলাল গ্রে। শহরের ম্যাপে নির্দিষ্ট স্থান নির্দেশ করা রয়েছে। এখান থেকে আট ব্লক দূরে, স্ট্রোগেটের পাশেই। বেশি দূরে নয়।

কিন্তু প্রথমে…

চোখের কোণা দিয়ে গ্রে এখনও ব্রিজের নিচে থাকা খালের পানির প্রতিবিম্বের দিকে নজর রেখেছে। ও দেখল মেয়েটি কাঁধ কুঁজো করে তার ব্যাকপ্যাক উঁচু করল, নিজের শরীর আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা।

মেয়েটি বুঝতে পেরেছে সে ধরা পড়ে গেছে?

 ‘কমান্ডার পিয়ার্স?’ বললেন লোগান।

ব্রিজের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে মেয়েটি। লম্বা লম্বা পা ফেলে পাশের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু অপেক্ষা করল গ্রে। মেয়েটি যদি আবার উল্টো দিকে ফিরে আসে।

‘কমান্ডার পিয়ার্স, ঠিকানা পেয়েছ?

 ‘হ্যাঁ। আমি ওখানে এখুনি যাচ্ছি।’

‘ভেরি গুড।’ লোগান সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন।

ওই মেয়ে কিংবা সন্দেহজনক অন্য কাউকে দেখার আশায় রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের চারদিকে চোখ বুলাল গ্রে। হোটেলের সেফে নিজের নাইম এমএম গ্রুক রেখে আসার জন্য আক্ষেপ করল। কিন্তু অকশন হাউজ থেকে প্রদত্ত নির্দেশনাবলিতে বলা ছিল ওখানে ঢোকার সময় সবাইকে মেটাল ডিটেকটর দিয়ে সার্চ করা হবে। তাই বাধ্য হয়ে অস্ত্র রেখে এসেছে গ্রেসন। বুটের ভেতর লুকোনো একটি কার্বনাইজড চাকু-ই এখানে ওর একমাত্র অস্ত্র।

অপেক্ষা করল গ্রে।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে ওর আশেপাশে মানুষের আনাগোনাও বেড়ে গেল। ওর পেছনে একটি মাছ-মাংসের দোকানদার রাস্তার পাশে বরফের টুকরো নামিয়ে ঝুড়ি থেকে টাটকা মাছ বের করে আনছে। সৌল, কড, স্যাভ ইল এবং আরও নানা রকম সামুদ্রিক মাছ।

ওগুলোর গন্ধে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হলো গ্রেসন। নিজের পেছনে সতর্ক দৃষ্টি রেখে এগিয়ে গেল ও।

হয়তো গ্রে একটু বেশিই খুঁতখুঁতে কিন্তু ও যে পেশায় আছে এখানে এরকম স্বভাবকে গুণ হিসেবে ধরা হয়। গলায় ঝুলোনো ড্রাগন ছুঁয়ে দেখল পিয়ার্স। এগিয়ে চলল শহরের ভেতরে।

কয়েক ব্লক পার হওয়ার পর নিরাপদ বুঝে একটি নোটপ্যাড বের করল ও। আজকে হতে যাওয়া নিলাম অনুষ্ঠানে কোন কোন জিনিসের প্রতি সংগ্রাহকদের বেশি আগ্রহ আছে সেগুলোর নাম লিস্ট করতে শুরু করল।

 ১. ১৮৬৫ সালে জেনেটিক্সের ওপর লেখা গ্রেগর মেন্ডেল-এর একটি পেপার।

২. ফিজিক্সের ওপর লেখা ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কস-এর দুটো বই। নাম : Thermodynamik (১৮৯৭) এবং Theorie der Warmestrahlung (১৯০৬)। দুটো বই-ই লেখক কর্তৃক স্বাক্ষরিত।

৩. উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিউগো ডি ভ্রিসেস-এর উদ্ভিদ রূপান্তরের ওপর লেখা ডায়েরি। গতকাল এই জিনিসগুলো সম্পর্কে যত তথ্য জেনেছে সবটা টীকা আকারে লিখে রাখল গ্রে। তারপর এই তালিকায় আরও একটি নতুন নাম যোগ করল।

৪. চার্লস ডারউইন-এর পারিবারিক বাইবেল। নোটপ্যাড বন্ধ করল গ্রেসন। এখানে আসার পর থেকে যে ব্যাপারটা নিয়ে এপর্যন্ত প্রায় ১০০ বার চিন্তাটা করেছে সেটা নিয়ে আবার ভাবল ও সম্পর্কটা কোথায়?

হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর সিগমার অন্য কেউ দিতে পারবে। গ্ৰে ভাবছে লোগনিকে এই তথ্যগুলো ওর সহকর্মী মনক ক্যালিস ও ক্যাথরিন ব্রায়ান্টকে দিতে বলবে কি-না। আগেই প্রমাণিত হয়ে গেছে, এই যুগল বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তকে সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে ওস্তাদ। এমনকি আদৌ যদি কোনো কিছু নাও থাকে তবুও ওরা ঠিকই একটা প্যাটার্ন দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম! যা-ই হোক, হয়তো এই কেসে সত্যিই কোনো প্যাটার্ন নেই। এত তাড়াতাড়ি ওদের জানানো ঠিক হবে না। গ্রে’কে মাথা খাঁটিয়ে আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। বিশেষ করে ৪ নম্বর জিনিসটির ব্যাপারে।

ততক্ষণ পর্যন্ত ওই দুই টোনা-টুনি’কে নিজেদের মতো থাকতে দেয়া যায়।

.

রাত ৯ টা ৩২ মিনিট।
ওয়াশিংটন, ডি.সি.।

‘সত্যি?’

 প্রেয়সীর উন্মুক্ত পেটে হাতের তালু রেখেছে মনক। কমলা-কালো রঙের নাইক সোয়েটপ্যান্ট পরে বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছে ও। সন্ধ্যাবেলার জগিং শেষ করে এসে ভেজা শার্ট কাঠের মেঝেতে ফেলে রেখেছে। চোখের ভ্রু ছাড়া ওর মাথায় আর কোনো চুল নেই। পুরো মাথা পরিষ্কার করে কামানো। ইতিবাচক উত্তরের আশায় আছে মনক।

 ‘হ্যাঁ,’ ক্যাট নিশ্চিত করল। আস্তে করে মনকের হাত সরিয়ে বিছানার অপর পাশে চলে গেল ও।

চওড়া হাসি ফুটল মনকের ঠোঁটে। “তুমি শিওর?

 বড় বড় পা ফেলে বাথরুমের দিকে এগোল ক্যাট। সাদা পেন্টি আর ঢোলা জর্জিয়া টেক টি-শার্ট ওর পরনে। কাঁধের ওপর দিয়ে ফেলে রেখেছে ওর লালচে বাদামি সোজা চুলগুলো। ‘আমার পাঁচ দিন দেরি হয়েছিল,’ গোমড়ামুখে বলল ও। “গতকাল ইপিটি টেস্ট করিয়েছি।

উঠে দাঁড়াল মনক। ‘গতকাল? আমাকে বলোনি কেন?

বাথরুমের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল ক্যাট, দরজাটা আধখোলা।

 ‘ক্যাট?

শাওয়ার ছাড়ার শব্দ শুনল মনক। ঘুরে বিছানা পেরিয়ে বাথরুমের দিকে এগোল ও। আরও জানতে চায় মনক। জগিং থেকে ফিরে আসতে না আসতেই ওর কানে বোমা ফাটিয়েছিল ক্যাট। ফোলা ফোলা চোখ আর মলিন মুখ করে বিছানায় শুয়েছিল ও কাঁদছিল। সারাদিন কোন বিষয়টি ওকে কষ্ট দিচ্ছিল সেটা বের করতে মনকের অনেক তেল খরচ করতে হয়েছে।

দরজায় থাবা মারল ও। যতটা শব্দ করতে চেয়েছিল তারচেয়েও জোরে শব্দ হলো দরজায়। বেহায়া হাতের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল মনক। ডারপা (ডিএআরপিএ)-এর আধুনিক গেজেট হলো ওর এই কৃত্রিম হাত। একটি মিশনে নিজের হাত হারানোর পর এই হাত-ই ওকে সঙ্গ দিয়ে আসছে। কিন্তু প্লাস্টিক ও ধাতু তো আর মাংস নয়। দরজায় টোকা মারতে গিয়ে এমন আওয়াজ হলো যেন ও দরজা ভেঙে ফেলতে চাইছে।

‘ক্যাট, কথা বলো,’ নরম সুরে বলল ও।

 ‘আমি চট করে গোসল সেরে আসছি।

শব্দের পেছনে লুকিয়ে থাকা টানটান ভাবটা বুঝতে পারল মনক। বাথরুমের ভেতর উঁকি দিল ও। বিগত এক বছর ধরে একে অন্যকে দেখছে ওরা। আর এখন তো ক্যাটের অ্যাপার্টমেন্টে নিজের জায়গা করে নিয়েছে মনক। তবে ওরা একটি নির্দিষ্ট মাত্রার শালীনতা বজায় রাখে।

বন্ধ করা হাই কমোডের ওপর বসে আছে ক্যাট। হাতের ওপর মাথা রেখেছে।

 ‘ক্যাথরিন…’

মাথা তুলে চাইল ও। মনকের এরকম অনুপ্রবেশে চমকে উঠেছে। মনক! দরজার খোলা অংশটুকু বন্ধ করার চেষ্টা করল।

পা দিয়ে দরজা ঠেকিয়ে দিল মনক। ‘তুমি তো বাথরুম ব্যবহার করছ না।’

 ‘শাওয়ারের পানি গরম হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’

বাথরুমে ঢোকার সময় আয়নায় বাষ্প জমতে দেখেছে মনক। জেসমিনের সৌরভ ছড়িয়ে আছে বাথরুমের ভেতরে। ঘ্রাণটি মনকের ভেতরে থাকা আকুতিকে জাগিয়ে তুলল। ক্যাটের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল ও।

ক্যাট পেছন দিকে হেলান দিল।

ক্যাটের দুই হাঁটুতে নিজের দু’হাত রাখল মনক। ওর চোখে চোখ রাখছে না ক্যাট, মাথা পেছন দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে।

ওর হাঁটু একটু আলাদা করে ওদুটোর ভেতরে ঢুকল মনক। ঊরুর বাইরের অংশ দিয়ে হাত নিয়ে ক্যাটের পশ্চাৎদেশ জড়িয়ে ধরল। নিজের দিকে টেনে নিল ও।

‘আমি…’ শুরু করতে যাচ্ছিল ক্যাট।

‘তুমি আমার কাছে আসবে।’ ক্যাটকে উঁচু করে নিজের কোলে বসাল মনক। ও এখন দুই পা ফাঁক করে বসে আছে। ক্যাটের নিঃশ্বাস এসে পড়ছে ওর মুখে।

অবশেষে মনকের চোখে চোখ রাখল ও। “আমি… আমি দুঃখিত।

ক্যাটের আরও কাছে ঝুঁকল ও। ‘কীসের জন্য? দু’জন দুজনার ঠোঁটে ঠোঁট ঘষল।

 ‘আমার আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।’

‘আমি কোনো অভিযোগ করেছি বলে তো মনে পড়ছে না।”

 ‘কিন্তু এরকম ভুল…’

‘চুপ।’ ওকে শক্ত করে চুমো খেল মনক। রাগে নয়, ওকে নিশ্চিত করতে। আর কখনও এ-কথা বলবে না। ওদের দুই জোড়া ঠোঁটের মাঝে মনক উচ্চারণ করল।

ক্যাট ওর ওপর মোমের মতো গলে পড়ল। মনকের গলা প্যাচিয়ে ধরল ওর দুই হাত। ওর চুল থেকে জেসমিনের সৌরভ আসছে। আমরা কী করতে যাচ্ছি?

‘আমি হয়তো সবকিছু জানি না তবে তোমার প্রশ্নের উত্তরটা জানি।

একবার গড়ান দিয়ে ক্যাটকে নিজের নিচে একটি ভোয়ালের ওপর রাখল ও।

 “ওহ,’ বলল ক্যাট।

.

সকাল ৭টা ৫৫ মিনিট।
কোপেনহ্যাগেন, ডেনমার্ক।

ছোট্ট অ্যান্টিকশপটির বিপরীতে থাকা একটি ক্যাফেতে বসে আছে গ্রে। রাস্তার ওপাশে থাকা ভবনটিকে পর্যবেক্ষণ করছে।

জানালায় লেখা রয়েছে SJAELDEN BOGER, দুষ্প্রাপ্য বই। লাল টাইলের ছাদযুক্ত দোতলা ভবনের দোতলায় এই বইয়ের দোকানের অবস্থান। প্রতিবেশীদের কাছে ভবনটি বেশ পরিচিত। বিত্ত-বৈভবের কমতি থাকায়, শহরের এদিকটা আধুনিকায়ন হয়নি। উপর তলার জানালায় তক্তা মারা রয়েছে। এমনকী স্টিলের উপ গেট বসিয়ে দোতলায় থাকা দোকানটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

দোকান এখন বন্ধ।

দোকান খোলার অপেক্ষায় আছে গ্রে। তরল হারশিস’র বারের মতো পুরু ডেনমার্কের হট চকোলেটে চুমুক দিতে দিতে ভবনটিকে আরও ভাল করে পর্যবেক্ষণ করছে ও। তক্তা মারা জানালা ছাড়িয়ে দৃষ্টি মেলল গ্রে। ভবন পুরোনো হয়ে গেলেও এর পুরোনো সৌন্দর্য এখনও বজায় আছে। দোতলার খাম বাইরে বেরিয়ে গেছে, ছাদের এক ঢালু অংশে জমে আছে অনেকদিনের জমাট বাঁধা বরফ, ছাদের পলেস্তরা প্যাঁচার চোখের মতো কুতকুতে দৃষ্টিতে বাইরে উঁকি দিচ্ছে। এমনকি এককালে জানালার নিচে রাখা ফুলের বাক্স রাখার ফুটোও গ্রে’র নজরে পড়ল।

 গ্রে মনে মনে ভবনটিকে তার অতীত সৌন্দর্যে সাজাতে চেষ্টা করল। ইঞ্জিনিয়ারিং ও সৌন্দর্যের মিশেলে এটা একধরনের মানসিক অনুশীলন।

কল্পনা করতে করতে করাতের ভোর গন্ধ পর্যন্ত নিতে পারছে গ্রে।

শেষ জিনিসটি ওর কল্পনার জাল ছিঁড়ে ফেলল। অনাহুত এক স্মৃতি এসে ঝেটিয়ে বিদায় করল কল্পনাগুলোকে। ওর বাবার কাঠের গ্যারেজ ছিল, স্কুল শেষ করে ওখানে তার সাথে কাজ করত গ্রে। ওখানে ওরা দুজন একসাথে হওয়ার পর ছোট কথা দিয়ে পরিস্থিতি খারাপ হলেও সেটা শেষ হতো অনেক কঠিন ও তিক্ত শব্দ দিয়ে। যেটা মেনে নেয়া অনেক কষ্টের ছিল। সেই তিক্ততার ফলস্বরূপ হাই স্কুল ছেড়ে মিলিটারিতে যোগ দিতে হয়েছিল গ্রে’কে। পরবর্তীতে অনেক দিন পর বাপ-বেটা একে অপরের সাথে ভাল মুখে কথা বলা রপ্ত করতে পেরেছে। দু’জনের ভিন্নতাগুলোকে মেনে নিয়ে মিলগুলো গ্রহণ করতে শিখেছে ওরা।

এখনও গ্রে’কে ওর মায়ের একটি প্রশ্ন তাড়া করে বেড়ায়। বাপ-বেটার মধ্যে এত অমিল থাকা সত্ত্বেও এখন দুজনের মধ্যে মিল হলো কীভাবে। এতদিন পরে এসে কেন গ্রে’র এই প্রশ্ন মনে আসছে? মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তার মেঘকে দূরে ঠেলে দিল ও।

কল্পনার রথ থামিয়ে ঘড়ি দেখল গ্রে। আজকের দিন নিয়ে বেশ চিন্তিত। ইতোমধ্যে নিলাম অনুষ্ঠানে ঢোকার সামনের ও পেছনের অংশে দুটো ক্যামেরা বসিয়ে এসেছে ও। এবার ওর কাজ হচ্ছে বাইবেলের মালিকের সাথে কথা বলে জিনিসটি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জেনে নেয়া। এই কাজগুলো শেষ হলেই ও র‍্যাচেলের সাথে একটা লম্বা ছুটি কাটাতে যাবে।

র‍্যাচেলের হাসিমুখের কথা মনে পড়তেই কাঁধ শিথিল হয়ে গেল গ্রে’র। গলায় থাকা নটে ঢিল পড়ল।

অবশেষে রাস্তার অপর পাশে একটি ঘণ্টা বেজে উঠল। দোকানের দরজা খুলে গেল, সরতে শুরু করল নিরাপত্তা গেট।

গ্রে আরও সোজা হয়ে বসল। দোকান যে খুলছে তাকে দেখে অবাক হয়েছে ও। বিণুনি করা কালো চুল, আরবদের মতো তামাটে রং, কাঠবাদামের মতো চওড়া চোখের অধিকারিণী দোকান খুলছে। এই মেয়েটি ওকে তখন ফলো করছিল। এমনকি এখনও সে ওই একই সোয়েটার-জ্যাকেট আর সবুজ ব্যাগ নিয়ে রয়েছে।

ক্যাফের টেবিলে বিল রেখে বেরিয়ে পড়ল গ্রে। কল্পনার সাগরে হাবুডুবু খাওয়া বন্ধ করে কাজে নামতে পেরে ও বরং খুশিই হয়েছে।

 বড় বড় পা ফেলে সরু রাস্তা পার হলো ও। মেয়েটি তখন মাত্র গেট খোলা শেষ করেছে। গ্রে’র দিকে তাকাল মেয়েটি। মোটেও অবাক হয়নি।

“আচ্ছা বন্ধু, দাঁড়াও আন্দাজ করি…’ ব্রিটিশ উচ্চারণে কেতাদুরস্ত ইংরেজিতে বলল মেয়েটি। গ্রে’র পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিলে বলল, ‘আমেরিকান।

ওর এরকম অপ্রত্যাশিত আচরণ দেখে ভ্রু কুঁচকাল গ্রে। ওকে এখনও একটি শব্দও বলতে দেয়া হয়নি। তবে যতটুকু সম্ভব চেহারায় আগ্রহ ফুটিয়ে রাখল ও একটু আগে যে মেয়েটি ওকে ফলো করছিল আর ও-ও সেটা ধরে ফেলেছে ব্যাপারটা বুঝতে দিতে চাচ্ছে না। তুমি কীভাবে জানলে?’

‘তুমি যেভাবে হাঁটো, পাছা উঁচু করো, ওতেই বুঝেছি।

‘তাই?

গেট আটকিয়ে দিল ও। গ্রে খেয়াল করল মেয়েটির জ্যাকেটে কয়েকটা পিন আছে। রংধনুঅলা সবুজ পতাকা, রুপোর কেল্ট চিহ্ন, একটি সোনার ইজিপশিয়ান ক্রস ও বাহারি রঙিন বোতামগুলোতে ডেনিশ এবং ইংরেজিতে স্লোগান লেখা রয়েছে। ওর হাতে সাদা রঙের একটি রাবারের ব্রেসলেট আছে, “আশা” শব্দটি লেখা রয়েছে ওতে।

সামনে সরে যাওয়ার জন্য গ্রে’কে ইশারা করল ও। কিন্তু গ্রে চট করে সরে না যাওয়ায় দুজনের একটু ধাক্কা লাগল। রাস্তার ওপাশে চলে গেল মেয়েটি। আরও এক ঘণ্টা পর দোকান খুলবে দুঃখিত, বন্ধু।

 দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একবার দরজা আরেকবার মেয়েটির দিকে তাকাল গ্রে। মেয়েটি ক্যাফের দিকে এগোচ্ছে। গ্রে একটু আগে যে টেবিল ছেড়ে উঠে গিয়েছে সেই টেবিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গ্রে’র রেখে যাওয়া নোটগুলো থেকে একটি নোট তুলে নিল মেয়েটি। অপেক্ষা করল গ্রে। জানালা দিয়ে দেখল মেয়েটি দুটো কফির অর্ডার করে চুরি করা টাকা দিয়ে বিল পরিশোধ করে দিল।

দুই হাতে দুটো লম্বা সাইজের স্টাইরোফোম কাপ নিয়ে ফিরল ও।

 ‘এখনও দাঁড়িয়ে আছো?’ গ্রে’কে প্রশ্ন করল।

 ‘এই মুহূর্তে অন্য কোথাও যাওয়ার মতো জায়গা নেই আমার।

 “আহারে!’ দু’হাত উঁচু করে বন্ধ দরজা খুলে দেয়ার ইশারা করল মেয়েটি।

 ‘খুশি?

‘ওহ!’ দরজা খুলে দিল গ্রে।

ভেতরে ঢুকল মেয়েটি। ‘বারটেল!’ হাঁক ছাড়ল ও। পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভেতরে ঢুকবেন নাকি দরজা আটকাবো?

‘আমি ভেবেছিলাম…’।

‘আজব!’ চোখ পাকিয়ে বলল ও। “অনেক ঢং করেছ। এমন একটা ভাব করছ যেন আমাকে আগে দেখইনি।’

ভাবল গ্রে। আচ্ছা, তাহলে ওটা কাকতালীয় ছিল না। মেয়েটা ওকে ফলো করছিল।

দোকানের আরও ভেতরে গিয়ে আবার হাঁক ছাড়ল ও। বারটেল! কোথায় তুমি? দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা নিয়ে মেয়েটির পেছন পেছন দোকানে ঢুকল গ্রে। অবশ্য বেশি ভেতরে ঢুকল না, দরজার কাছেই থাকল। প্রয়োজন বুঝে কেটে পড়বে।

দোকানটা সরু গলির মতো চাপা সাইজের। দোকানের দু’পাশে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট বুকশেলফ আছে। বিভিন্ন ধরনের বই আছে ওতে। ভ্যলিউম, ধর্মগ্রন্থ, পুস্তিকা সবই আছে। কয়েক পা সামনে এগিয়ে চোখে পড়ল দুটো গ্লাস কেবিনেট রয়েছে দোকানের মাঝখানে। চামড়ায় বাধানো বই আছে ওগুলোর ভেতর।

গ্রে আরও ভেতরে চোখ বুলাল।

সকালের সূর্যের আলোতে দেখা গেল পাতলা ধূলো উড়ছে। বাতাসে পুরোনো বোটকা গন্ধ। বইয়ের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে গন্ধটাও বাড়ছে। এখানটা একদম ইউরোপের মতো। বয়সের ভার আর প্রাচীন ঐতিহ্য এখানকার প্রতিদিনের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

অবশ্য ভবনের জীর্ণদশা ছাড়া দোকানের ভেতরটা বেশ ভাল অবস্থাতেই আছে। গ্লাস ওয়ালের সাথে পর্যাপ্ত মই ঠেক দিয়ে রাখা আছে। ওগুলো দিয়ে বুকশেলফে উঠে প্রয়োজনীয় বই নামিয়ে নেয়া যাবে। দোকানের ভেতরে বেশি লোক হয়ে গেলে যাতে বাইরে লোজন বসতে পারে তার জন্য সামনের জানালার আছে অতিরিক্ত দুটো চেয়ারও আছে।

আর সবচেয়ে ভাল দিক হচ্ছে…

গভীরভাবে শ্বাস নিল গ্রে।

কোনো বিড়াল নেই।

আর কেন নেই সেটারও জবাব হাজির হয়ে গেল।

একটি শেলফের পাশে এক উস্কখুস্ক আকৃতি চোখে পড়ল। আকৃতির মালিকটির চোখ দুটো থলথলে, বাদামি রঙের। হঠাৎ করে কুকুরটি ওদের দিকে পা টেনে টেনে এগোতে শুরু করল। বাম পায়ের সামনের অংশ লেংচিয়ে এগোচ্ছে। বাম পায়ের থাবার ওই অংশটুকু নেই।

 ‘এই যে, বারটেল।’ সামনে ঝুঁকে কফি কাপ থেকে তরলটুকু মেঝেতে রাখা একটি সিরামিকের বাটিতে ঢালতে শুরু করল মেয়েটি। কুকুরটি এগিয়ে এসে খুব আগ্রহ নিয়ে বাটিতে জিহ্বা ডুবাতে শুরু করল।

‘কুকুরের জন্য কফি বোধহয় খুব একটা ভাল জিনিস নয়,’ সতর্ক করল গ্রে।

উঠে দাঁড়াল মেয়েটি। কাঁধের পাশ দিয়ে বিনুনি করা চুল সরিয়ে দিল। “চিন্তার কিছু নেই। এই কফিতে ক্যাফেইন নেই।’ দোকানের আরও ভেতরে এগোল ও।

 ‘আচ্ছা, ওর পায়ে কী হয়েছিল?’ পরিস্থিতির সাথে ধাতস্থ হওয়ার ফাঁকে একটু আলাপ করে নিতে চাইছে গ্রে। পাশ দিয়ে আসার পর গ্রে গায়ে একটু আদর করার বিনিময়ে লেজ নাড়ানো উপহার পেল কুকুরের কাছ থেকে।

 ‘বরফে পচন ধরে ছিল। ফ্রস্টবাইট। মাট্টি ওকে অনেক দিন আগে নিয়ে গিয়েছিল।’

 ‘মাট্টি?

‘আমার নানু। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে সে।’

দোকানের শেষ প্রান্ত থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এল। Er det han der vil kobe bogene, ফিওনা?’

‘Ja, মাট্টি! ক্রেতা আমেরিকান। ইংরেজিতে বল।’

‘Send ham ind paa mit kontor.’

‘মাট্টি তোমার সাথে তার অফিসে দেখা করবে।’ ফিওনা নামের মেয়েটি গ্রেকে দোকানের পেছনের দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। কুকুরটি তার সকালের কফি খাওয়া শেষ করছে। এবার সে গ্রে’র পিছু পিছু হাঁটা ধরল।

দোকানের মাঝখানে এসে একটি ছোট ক্যাশ-রেজিস্টার ডেস্কের পাশ দিয়ে এগোল ওরা। ডেস্কের ওপর সনি কম্পিউটার ও প্রিন্টার রাখা আছে। এই পুরাকীর্তি ধাচের দোকানে কম্পিউটার দেখে মনে হলো, যাক, তাহলে আধুনিকতার ছোঁয়া পৌঁছেছে এখানে।

 ‘আমাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে,’ গ্রে’র মনের কথা আন্দাজ করে বলল ফিওনা।

রেজিস্টার পেরিয়ে দোকানের পেছন দিকে খোলা দরজা দিয়ে একটি রুমে ঢুকল। তবে এটাকে অফিস না বলে ড্রয়িংরুম বলাই শ্রেয়। একটি সোফা, টেবিল আর দুটো চেয়ার আছে এখানে। রুমের এক কোণে থাকা ডেস্কটিকে অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনা করার চেয়ে গরম প্লেট আর চায়ের কেটলি রাখার কাজেই বেশি ব্যবহার করা হয় বলে মনে হলো। দেয়ালে এক সারি কালো কেবিনেট আছে। ওগুলোর ওপরে আছে একটি শিকঅলা জানালা। ওটা দিয়ে সকালের মিষ্টি আলো অফিস রুমে ঢুকছে।

বয়স্কা মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলেন। ‘ড, সয়্যার,’ এই মিশনে গ্ৰে যে ছদ্মনাম ব্যবহার করছে সেটা সমোধন করে বললেন তিনি। বোঝা গেল, ভদ্রমহিলা গ্রে’র ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে নিয়েছেন। ‘আমি গ্রিট্টি নেয়াল।’

 মহিলার হাতের মুঠো বেশ শক্ত-পোক্ত। হালকা-পাতলা গড়ন, ত্বকের রং ফ্যাকাসে। তার শরীর স্বাস্থ্য দেখে আবারও প্রমাণিত হলো এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের শরীর কতটা অদম্য, কতটা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এরা। গ্রে’কে একটি চেয়ারে বসার ইশারা করলেন তিনি। মহিলার আচরণ বেশ স্বাভাবিক, এমনকি তার পোশাকও; নেভি জিন্স, ফিরোজা রঙের ব্লাউজ আর কালো পাম্প স্যু। মাথার রুপোলি চুলগুলো সোজা করে চিরুণি করা। দেখে মনে হতে পারে তিনি খুব সিরিয়াস। কিন্তু চোখ দুটো হাসি হাসি।

‘আমার নাতনির সাথে আপনার দেখা হয়েছে। বেশ নিখাদ ইংরেজিতে বললেন গ্রিট্টি তবে তার উচ্চারণভঙ্গিতে ডেনিশের ছোঁয়া আছে। অবশ্য নাতনির এই সমস্যা নেই।

ফ্যাকাসে রঙের বয়স্কা মহিলা আর কালো মেয়েটির মধ্যে চোখ বুলাল গ্রে। এদের দু’জনকে দেখে মনে হচ্ছে না, এদের কোনো পারিবারিক সম্পর্ক আছে। তবে গ্রে এটা নিয়ে কোনো কথা বলল না। এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ নিয়ে কথা বলতে হবে তাকে।

‘হ্যাঁ, দেখা হয়েছে।’ গ্রে জবাব দিলো। আসলে, আজকে আপনার নাতনির সাথে আমার দুবার দেখা হয়েছে।’

 ‘ওহ, ফিওনার এত কৌতূহলী স্বভাব একদিন সত্যিই ওকে বিপদে ফেলবে।’ হাসি দিয়ে রাগ আড়াল করে বললেন গ্রিট্টি। ‘আপনার ওয়ালেট ফিরিয়ে দিয়েছে তো?

গ্রে’র কপালে ভাঁজ পড়ল। পেছন পকেটে হাত দিয়ে দেখল, খালি।

নিজের প্যাকের সাইড পকেট থেকে গ্রে’র বাদামি রঙের চামড়ার ওয়ালেট বের করে দিল ফিওনা।

ওর হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিল গ্রে। ওর মনে পড়ল, একটু আগে মেয়েটির সাথে ধাক্কা খেয়েছিল। মাত্রাতিক্ত অভদ্রতা এটা।

‘আপনি বিষয়টাকে খারাপভাবে নেবেন না, প্লিজ,’ গ্রে’কে শান্ত করার জন্য বললেন গ্রিট্টি। আমার নাতনি এভাবেই “হ্যালো” বলে থাকে।

‘ওর সব আইডি চেক করেছি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল ফিওনা।

 ‘ফিওনা, তাহলে ওনার পাসপোর্টটাও ফিরিয়ে দাও।

 নিজের আরেকট পকেট চেক করল গ্রে। নেই! ওহ খোদা!

কভারে আমেরিকান ঈগলের ছবিযুক্ত নীল রঙের ছোট্ট বইটি ওর দিকে ছুঁড়ে দিল ফিওনা।

‘শেষ? নাকি আরও আছে’? নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলল গ্রে।

 শ্রাগ করল ফিওনা।

‘নাতনির এরকম আচরণের জন্য আমি আবারও ক্ষমা চাচ্ছি। মাঝে মধ্যে ও একটু বেশিই সতর্কতা অবলম্বন করে।

ওদের দুজনের দিকে তাকাল গ্রে। ‘আচ্ছা, আপনারা দয়া করে বলবেন এখানে কী হচ্ছে?’

‘আপনি দ্য ডারউইন বাইবেল সম্পর্কে খোঁজ নিতে এসেছেন।’ বললেন গ্রিট্টি।

 ‘বাইবেল! দ্য বাইবেল! শুধরে দিল ফিওনা।

নাতনির দিকে মাথা নেড়ে সায় দিলেন ভদ্রমহিলা। মাঝেমাঝে জিহ্বা ফসকে যায়।

‘আমি একজন আগ্রহী ক্রেতার পক্ষ হয়ে কাজ করছি।’ বলল গ্রে।

‘হ্যাঁ। আমরা জানি সেটা। এও জানি, গতকাল সারাটা দিন আপনি নিলামে উঠতে যাওয়া অন্যান্য জিনিস সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে কাটিয়েছেন, তাই না?”

বিস্ময়ে গ্রে’র ভ্রু উঁচু হয়ে গেল।

‘কোপেনহ্যাগেনে বইপড়য়াদের কমিউনিটিটা খুবই ছোট। আমাদের মধ্যে কথা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

ভ্রুকূটি করল গ্রে। আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।

 ‘আপনার ওরকম খোঁজ-খবর নেয়ার ব্যাপারটা আমার ডারউইন বাইবেলটিকে নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সাহায্য করেছে। পুরো কমিউনিটি ভিক্টোরিয়ান যুগের বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক গ্রন্থের জন্য মুখিয়ে আছে এখন।’

 ‘বিক্রি করার জন্য এটাই ভাল সময়। কঠিন গলায় বলল ফিওনা। মনে হলো কোনো একটি যুক্তি-তর্কের ইতি টানল ও। ফ্ল্যাটের ইজারা এক মাস…’।

ওর কথা আর এগোল না। সিদ্ধান্তটা বেশ কঠিন ছিল। ১৯৪৯ সালে বাইবেলটি কিনেছিলেন আমার বাবা। ডারউইন পরিবারের পেছনে প্রথিতযশা চার্লস-পর্যন্ত মোট দশ প্রজন্মের নাম হাতে লেখা রয়েছে ওতে। কিন্তু বাইবেলটিতে ইতিহাসও আছে। এইচএমএস বিগলে চড়ে এক ব্যক্তি পৃথিবী ভ্রমণের কথা দিয়ে শুরু হয়েছে ওটা। আপনি এটা জানেন কি-না জানি না কিন্তু চালর্স ডারউইন একবার ক্যাথলিক যাজকদের কলেজে ঢুকেছিলেন। এই বাইবেলে আপনি ধার্মিক ও বিজ্ঞানী হিসেবে একই ব্যক্তির অবস্থান পাশাপাশি দেখতে পাবেন।

 মাথা নাড়ল গ্রে। মহিলা ওকে পটানোর চেষ্টা করছে। এসব করছে যাতে ও নিলামে এই বাইবেল কিনতে যায়? বেশি মূল্য দিয়ে কেনে? তবে এই তথ্যগুলোকে গ্রে তার নিজের সুবিধার্থে কাজে লাগাতে পারে, সমস্যা নেই।

‘এজন্যই ফিওনা আমাকে ফলো করছিল?’ গ্রে প্রশ্ন করল।

গ্রিষ্টিকে একটু ক্লান্ত দেখাল। ওরকম কাজের জন্য আমি আবারও ক্ষমা চাচ্ছি। একটু আগে যেমনটা বললাম, ভিক্টোরিয়ান-যুগের এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলের প্রতি অনেকেরই আগ্রহ আর আমাদের কমিউনিটিটাও ছোট। কালো বাজারিদের কথা তো আমরা সবাই জানি… তাই আরকী!

‘হ্যাঁ, আমিও গুজব শুনেছি।’ বিনয় দেখিয়ে বলল গ্রে। আরও তথ্য জানতে চায়।

 ‘অনেক ক্রেতা আছে যারা নিলামের মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে কথা রাখে না, অবৈধভাবে টাকা দেয়, ভুয়া চেক দেয় ইত্যাদি। ফিওনা ওইদিক নিয়ে সতর্ক থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু মাঝে মাঝে ও অনেক বেশিদূরে চলে যায় যে কাছে থাকা জিনিসটাও দেখতে পায় না।’ নাতনির দিকে এক চোখের ভ্রু উঁচু করে তাকালেন তিনি।

ফিওনা হঠাৎ করে তার পুরো মনোযোগ মেঝেতে দিয়ে দিল।

‘এক ভদ্রলোক বছর খানেক আগে প্রায় এক মাসে আমার ফাইল-পত্র ঘেঁটে দেখেছেন ওটা আমাদেরই কি-না।’ দেয়ালে থাকা কেবিনেটের দিকে ইশারা করলেন তিনি। ডারউইন বাইবেলের টাকা পরিশোধের জন্য তিনি চুরি করা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।

 ‘তবুও আমাদের সতর্কতার অবলম্বন করা যাবে না, তাই না? খোঁচা মারল ফিওনা।

‘লোকটিকে চেনেন?

 ‘না, তবে আবার দেখলে চিনতে পারব। অদ্ভুত লোক, ফ্যাকাসে চেহারা।

ফিওনা আবার জ্বলে উঠল। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওর পেছনে অনুসন্ধান করে নাইজেরিয়া থেকে সাউথ আফ্রিকা পর্যন্ত গিয়েছিল। তারপর শেষ। বেজন্মা হারামিটা পেছনে কোনো সূত্র ফেলে যায়নি।

ভ্রুকূটি করলেন গ্রিট্টি। ‘মুখের ভাষা সামলে কথা বলো, ফিওনা।’

 ‘তো ওরকম একজন বাজে লোকের পেছনে এত অনুসন্ধান করার কারণ?’ গ্রে প্রশ্ন করল।

আবারও মেঝেতে মনোযোগ দিল ফিওনা।

গ্রিট্টি চট করে নাতনির দিকে তাকালেন। ‘ওনার বিষয়টা জানার অধিকার আছে।’

‘মাট্টি…’ মাথা নাড়ল ফিওনা।

‘কী জানব?

 ফিওনা একবার গ্রে’র দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ও গিয়ে অন্য সবাইকে বলে দেবে। তখন আমরা অর্ধেক দাম পাব।’

এক হাত উঁচু করল গ্রে। “আমি সতর্ক থাকব।’

এক চোখ সরু করে গ্রে’কে পর্যবেক্ষণ করলেন গ্রিট্টি। কিন্তু আপনি কতখানি সত্যবাদী… সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, ভ, সয়্যার।

দুই নারীর সামনে নিজেকে চোর চোর লাগল গ্রে’র। ওর ছদ্মবেশ কী এখনও টিকে আছে। দুই নারীর চোখা দৃষ্টি ওকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে।

অবশেষে গ্রিট্টি মুখ খুললেন। ‘আপনার জানা উচিত। সেই লোক এখান থেকে পালানোর কিছু দিন পরেই দোকান ভেঙে কারা যেন ঢুকেছিল। কিছুই চুরি যায়নি তবে ডারউইন বাইবেল আমরা সাধারণত যে শোকেসে রাখি ওটা ভোলা হয়েছিল। কপাল ভাল, বাইবেলটি আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান তাই রাতে ওটাকে মেঝের ভল্টে রেখেছিলাম। অ্যালার্মের আওয়াজ শুনে পুলিশ বেশ চটপট হাজির হয়ে তাদের পিছুও নিয়েছিল কিন্তু ডাকাতি করতে কারা এসেছিল সেটা রহস্যই থেকে গেল।’

‘ওই শালা…’ বিড়বিড় করল ফিওনা।

সেই রাত থেকে বাইবেলটিকে আমরা পাশের ব্যাংকের সেফ-ডিপোজিটে রাখি। এরপরও আমাদের এখানে গত বছর দুবার ডাকাতির চেষ্টা করা হয়েছিল। অ্যালার্ম অকেজো করে পুরো দোকান খোঁজা হয়েছিল তন্ন তন্ন করে।

কেউ একজন বাইবেলটিকে খুঁজছে।’ বলল গ্রে।

 ‘আমাদেরও তা-ই ধারণা।

 গ্রে বুঝতে শুরু করল। অর্থের সংকট-ই শুধু মূল কারণ নয়, এরা বাইবেলের বোঝা থেকে নিজেদেকে হালকা করতে চাচ্ছে। কেউ একজন বাইবেলের পেছনে লেগেছে। সামনে হয়তো বাইবেলটিকে হাতানোর জন্য তারা আরও হিংস্র ও হন্য হয়ে উঠবে। বাইবেল হাত বদলের পর যে নতুন মালিকের কাছে যাবে এই হুমকি হয়তো তার ওপর গিয়েও পড়বে।

 চোখের কোণা দিয়ে ফিওনাকে দেখে নিল গ্রে। মেয়েটি এপর্যন্ত যা যা করেছে সবই ওর নানুকে বাঁচানোর জন্য, ওদের আর্থিক দিক রক্ষার জন্য। গ্রে এখনও মেয়েটির চোখে আগুন দেখতে পাচ্ছে। মেয়েটি চায়, ওর নানু যেন কথা চেপে রাখে।

 ‘বাইবেলটি হয়তো আমেরিকার কোনো এক ব্যক্তিগত সংগ্রহে নিরাপদ থাকবে।’ বললেন গ্রিট্টি। এরকম সমস্যা হয়তো সাগর পেরিয়ে ওপারে পৌঁছাবে না।

 মাথা নাড়ল গ্রে। টের পেল বাইবেল বিক্রি করার জন্য কথাগুলোর পেছনে তেল মাখানো আছে।

 ‘আচ্ছা, আপনি বুঝতে পেরেছেন কেন বাইবেলের পেছনে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা উঠে পড়ে লেগেছে? ও জিজ্ঞেস করল।

নাতনির পর এবার নানু প্রথমবারের মতো অন্যদিকে মনোযোগ দিলেন।

 ‘তথ্যটা পেলে বাইবেলটি আমার ক্লায়েন্টের কাছে হয়তো আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।’ গ্রে জোর করল।

গ্রে’র দিকে চট করে তাকালেন গ্রিট্টি। কোনো একভাবে তিনি গ্রে’র কথার পেছনে লুকিয়ে থাকা মিথ্যের আঁচ করতে পেরেছেন। গ্রে’কে আবার পর্যবেক্ষণ করলেন। সত্য জানার চেষ্টা করছেন তিনি।

এমন সময় অফিসে বারটেল প্রবেশ করল। ডেস্কে থাকা কেটলির পাশে কয়েকটি কেক আছে ওগুলোর কাছ দিয়ে একবার নাক টেনে ঘুরে মেঝেতে ধপ করে বসল সে। ওর মুখের কিছু অংশ গ্রে’র বুটের ওপর রইল। দোকানে আগত অতিথির সাথে বেশ খাতির হয়ে গেছে ওর।

পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট হয়েছে ভেবে ক্ষান্ত হলেন গ্রিট্টি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলেন তিনি। একটু নরম হয়ে বললেন, আমি নিশ্চিত জানি না। তবে কিছু অনুমান করতে পারি।’

‘আপনি বলুন, আমি শুনছি।

‘যুদ্ধের পর খণ্ড খণ্ড করে বিক্রি হওয়া এক লাইব্রেরির সম্পর্কে খোঁজ নিতে সেই লোকটি এখানে এসেছিল। আজকের সন্ধ্যার নিলামে যে জিনিসগুলো উঠতে যাচ্ছে ওগুলোর খবরই চাচ্ছিল সে। হিউগো ডি ভ্রিসেস-এর ডায়েরি, গ্রেগর মেন্ডেল-এর পেপার এবং ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কস-এর লেখা দুটো বই।

গ্রে জানে ওর নোটপ্যাডে এই একই তালিকা আছে। এই জিনিসগুলো সবার নজর কেড়েছে। কে কিনতে চায় ওগুলো? কেন কিনতে চায়?

‘এই পুরোনো লাইব্রেরি কালেকশন সম্পর্কে আরও কিছু জানাতে পারেন? এর শিকড় কোথায়? কোনো বিশেষ অর্থ বহন করে কি-না, এসব?

 গ্রিট্টি উঠে তাঁর ফাইলগুলোর দিকে এগোলেন। ‘আমার বাবা ১৯৪৯ সালে কিনেছিলেন। ওটার মূল রিসিপ্ট আমার কাছে আছে। একটা গ্রাম আর ছোট এলাকার নাম দেয়া আছে ওতে। দাঁড়ান দেখি তো পাই কিনা।

পেছনের জানালা দিয়ে আসা সূর্যালোকের একটি বিম পেরিয়ে মাঝের ড্রয়ার খুললেন তিনি। ‘আমি আপনাকে মূল কপি দিতে পারব না। তবে ফিওনা আপনাকে এটা ফটোকপি করে দিলে খুশি মনে দেব।’

 বয়স্কা মহিলা তার ফাইলের ভেতরে ডুবে যেতেই গ্রে’র পায়ের কাছ থেকে নাক তুলল বারটেল। কিছু একটা পেয়েছে সে। মৃদু স্বরে গরগর করে উঠল।

তবে ওটা গ্রে’র জন্য করেনি।

প্লাস্টিকের হাত মোজা পরে একটি হলুদ কাগজ তুলে ধরলেন গ্রিট্টি। ‘এই যে, পেয়েছি।

মহিলার হাতের দিকে না তাকিয়ে পায়ের দিকে মনোযোগ দিল গ্রে। সূর্যালোকের ভেতর দিয়ে ছোট্ট একটি ছায়া সুড়ৎ করে চলে গেল।

বসে পড়ুন!

 সোফার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বয়স্কা মহিলার দিকে এগোলো গ্রে।

ওর পেছনে গর্জে উঠল বারটেল। গ্লাস ভাঙ্গার আওয়াজ ওর গর্জনের নিচে প্রায় চাপা পড়ে যাচ্ছিল।

এখনো এগোচ্ছে গ্রে কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। গ্রিট্টির কাছে পৌঁছুনোর আগেই রক্ত আর হাড়ের সম্মিলিত বিস্ফোরণে তার চেহারা বিলীন হয়ে গেল। গ্রিষ্টির পেছন থেকে গুলি ছুঁড়েছে স্নাইপার।

গ্রে তার শরীর ধরে সোফায় শুইয়ে দিল।

চিৎকার করে উঠল ফিওনা।

পেছনের জানালার কাঁচ ভাঙ্গার পাশাপাশি দুটো “ঠকাস” শব্দ হলো। কালো রঙের দুটো ক্যানিস্টার অফিস রুমে ঢুকে অপর প্রান্তের দেয়ালে আঘাত হানল। ড্রপ খাচ্ছে ওদুটো।

সোফা থেকে লাফিয়ে নামল গ্রে, কাঁধ দিয়ে ফিওনাকে আড়াল করল। অফিস। থেকে ফিওনাকে সরিয়ে এক কোণায় নিয়ে চলল ও।

 ওদের পেছন পেছন খুড়িয়ে খুড়িয়ে এগোল বারটেল।

 গ্রে ফিওনাকে বুককেসের পেছনে অর্ধেক ঢুকিয়েছে এমন সময় ক্যানিস্টার দুটো অফিস রুমে বিস্ফোরিত হলো। দেয়ালকে প্লাস্টারের মতো চুর্ণ করে দিল ওটা।

বুককেস লাফিয়ে উঠে পাশে হেলে পড়ল। ফিওনাকে নিজের নিচে নিয়ে ঢেকে ফেলল গ্রে।

বিভিন্ন কাগজপত্রে আগুন ধরে ওদের মাথার ওপরে ছাই হয়ে বৃষ্টির মতো পড়তে লাগল।

বৃদ্ধ কুকুরটিকে দেখল গ্রে। বেচারা পঙ্গু পা নিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। বিস্ফোরণের ধাক্কা ওকে ওপাশের দেয়ালের ওপর নিয়ে আছড়ে ফেলেছে। নড়ছে না একটুও। ওর লোমে আগুন জ্বলছে দপদপ করে।

দৃশ্যটা যেন ফিওনার চোখে না পড়ে তাই ওদিকটা আড়াল করল গ্রে। ‘আমাদেরকে সরতে হবে।

হেলে পড়া বুককেসের নিচ থেকে হকচকিয়ে যাওয়া ফিওনাকে বের করল ও। আগুন আর ধোঁয়ায় দোকানের পেছনের অর্ধেক প্রায় ভরে গেছে। মাথার ওপরে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র থেকে পানি ঝরছে। দেরি হয়ে গেছে অনেক আর পরিমাণেও অল্প। এই আগুনকে থামানোর জন্য এতটুকু পানির ছিটা যথেষ্ট নয়।

‘সামনে চলো!’ তাড়া দিল শ্রে।

হোঁচট খেতে খেতে ফিওনাকে নিয়ে এগোল ও।

ওদের সামনে বাইরের সিকিউরিটি গেট ভেঙ্গে পড়ল। বন্ধ হয়ে গেল সামনের দরজা, জানালা। গেটের দু’পাশে অনেক ছায়ার আগাগোনা খেয়াল করল গ্রে। আরও অস্ত্রধারী আসছে।

গ্রে পেছনে তাকাল। দোকানের পেছনটা খুঁড়ো হওয়া দেয়াল, আগুন আর ধোঁয়ায় ভর্তি।

ফাঁদে আটকা পড়েছে ওরা।

.

রাত ১১টা ৫৭ মিনিট।
ওয়াশিংটন, ডি.সি.।

স্বর্গীয় সুখানুভূতি নিয়ে আধো ঘুমে ডুবে আছে মনক। বাথরুমের মেঝে থেকে শুরু হওয়া ভালবাসা ঠাই পেয়েছিল বিছানায়। প্রেমে মত্ত হয়ে উঠেছিল দু’জন। ফিসফিস করে উচ্চারিত কিছু শব্দ আর আলতো নরম ছোঁয়ায় ওরা সমৃদ্ধ হয়েছিল। চাদর ওদের দু’জনের নগ্ন শরীরকে ঢেকে রেখেছে। জড়াজড়ি ধরে শুয়ে আছে ওরা। এখন একে অপরকে ছাড়ার কোনো ইচ্ছেই নেই। শারীরিকভাবে নয়, কোনোভাবেই নয়।

ক্যাটের নগ্ন বুকের বাকে আস্তে করে আঙুল বুলাল মনক। ওর ছোঁয়ায় কামনার চেয়ে ভালবাসার স্পর্শ বেশি ছিল। ক্যাট ওর পা দিয়ে মনকের পায়ে আলতো করে স্পর্শ করল।

নিখুঁত সাড়া। নিখাদ ভালবাসা।

ওদের এই মাখামাখি অক্ষুণ্ণ থাকবে, কেউ ভাঙতে পারবে না…

হঠাৎ ওদের দুজনকে হকচকিত করে রুমের ভেতরে রিং বেজে উঠল।

বিছানার পাশ থেকে শব্দ আসছে। ওখানে প্যান্ট খুলে রেখেছে মনক। ঠিক খুলে নয় শরীর থেকে রীতিমতো হেঁচকা টান মেরে প্যান্টটি ওখানে রেখেছিল। মনকের পেজার এখনও প্যান্টের রাবারের কোমরের সাথে লাগানো রয়েছে। ওর মনে আছে, জগিং শেষ করে ফেরার পর যন্ত্রটিকে ভাইব্রেশন মোডে সেট করে রেখেছিল। তাহলে এভাবে রিং হওয়ার একটাই মানে হতে পারে।

জরুরি কিছু।

 বিছানার আরেকপাশ থেকে দ্বিতীয় পেজার বেজে উঠল।

এটা ক্যাটের।

দুজনই উঠল, চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া।

‘সেন্ট্রাল কমান্ড বোধহয়,’ বলল ক্যাট।

 নিচ থেকে নিজের প্যান্ট ও পেজার তুলে নিল মনক। ক্যাটের ধারণা সঠিক।

মেঝেতে পা নামিয়ে তাড়াতাড়ি ফোনের কাছে গেল মনক। ক্যাট ওর পাশে বসল। চাদর দিয়ে ও নিজের উন্মুক্ত স্তন দুটোকে ঢেকে নিয়েছে। সেন্ট্রাল কমান্ডের সাথে কথা বলবে, তাই এই ভদ্রতা। হোক ফোনে, তাতে কী। সরাসরি সিগমা ফোর্সে ডায়াল করল মনক। ওপাশ থেকে সাথে সাথে ফোন রিসিভ হলো।

‘ক্যাপ্টেন ব্রায়ান্ট’ বললেন লোগান গ্রেগরি।

‘না, স্যার। আমি মনক কক্যালিস। তবে ক্যাট… ক্যাপ্টেন ব্রায়ান্ট আমার কাছেই আছেন।’

 ‘আমি তোমাদের দুজনকে জরুরি ভিত্তিতে কমাতে চাই।’ চটপট আসল কথা জানিয়ে দিলেন লোগান।

মাথা নেড়ে সায় দিল মনক। ‘আমরা এখুনি বেরোচ্ছি।’ ফোন কেটে দিল।

ক্যাটের চোখে চোখ পড়ল ওর। ক্যাট ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখেছে। ‘কী সমস্যা?’

‘বিরাট সমস্যা।

 ‘গ্রের কিছু হয়েছে?

‘না। আমি নিশ্চিত সে ঠিক আছে। প্যান্ট পরে নিল ও। হয়তো র‍্যাচেলের সাথে দারুণ সময় পার করছে।

‘তাহলে…?

‘ডিরেক্টর ক্রো। নেপালে কিছু একটা হয়েছে। বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে প্লেগ টাইপের কিছু একটা হবে।’

‘ডিরেক্টর ক্রো কী রিপোর্ট করেছেন?

‘এপর্যন্তই করেছেন। তার সর্বশেষ রিপোর্ট ছিল তিন দিন আগের। কিন্তু ঝড় এসে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তবে ওটা তেমন চিন্তার বিষয় ছিল না। কিন্তু আজ ঝড় থেমে গেছে অথচ এখনও তার কোনো খবর নেই। আর এখন গুজব শোনা যাচ্ছে প্লেগ, মৃত্যু আর এরচেয়ে কোনো বড় কিছু একটা হচ্ছে ওখানে। মাওবাদীদের হামলাও হতে পারে।

চোখ বড় বড় করল ক্যাট।

 ‘লোগান সবাইকে কমান্ডে ডেকেছেন।

বিছানা ছেড়ে নিজের পোশাকের দিকে এগোল ক্যাট। ‘ওখানে কী হতে পারে?

 ‘ভাল কিছু হচ্ছে না, সেটা নিশ্চিত।

.

সকাল ৯টা ২২ মিনিট।
কোপেনহ্যাগেন, ডেনমার্ক।

‘উপরে যাওয়ার কোনো রাস্তা আছে?’ গ্রে জিজ্ঞাসা করল।

বন্ধ গেটের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে ফিওনা। গ্রে বুঝতে পারল মেয়েটি ঘটনার আকস্মিকতার ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি।

 ‘ফিওনা…’ মেয়েটির কাছে এগিয়ে এল গ্রে। নাকের সামনে নাক এনে ওর দৃষ্টিপথ ঢেকে দিল। ফিওনা, আগুন থেকে আমাদের পালাতে হবে।

ফিওনার পেছনে আগুনের তাণ্ডবলীলা দ্রুত বাড়ছে। আগুনের লেলিহান শিখাকে রসদ যোগাচ্ছে শুকনো কড়কড়ে বই আর বুকশেলফ। আগুনের শিখা উঁচু হয়ে সিলিং ছুঁয়ে ফেলেছে। ধোয়া পাকাচ্ছে ছাদের নিচে। অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র থেকে পানি ছিটে বেরোচ্ছে ঠিকই কিন্তু একটু ধোয়া তৈরি করা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই করতে পারছে না।

প্রতিবার নিঃশ্বাসের সাথে গরমের আঁচ বাড়ছে। ফিওনার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে গ্রে খেয়াল করল মেয়েটি কাঁপছে, পুরো শরীর কাঁপছে ওর। তবে হাত ধরায় মেয়েটি এবার ওর দিকে তাকাল।

‘উপর তলায় যাওয়ার কোনো সিঁড়ি আছে?

 ফিওনা উপর দিকে চোখ মেলল। ধোয়ার চাদরে সিলিং আড়াল হয়ে গেছে।

‘কিছু পুরোনো রুম। একটা চিলেকোঠা…’

 ‘বেশ। আমরা ওখানে যেতে পারব?

প্রথমে ধীরে মাথা নাড়লেও পরে বিপদের হিসেব কষে জোরালোভাবে না-সূচক মাথা নাড়ল ও। ‘না। একটাই সিঁড়ি আছে আর ওটা…’ আগুনের দিকে নির্দেশ করল ফিওনা। ‘বিল্ডিঙের পেছন দিকে।

‘মানে–বাইরে?

মাথা নাড়ল ও। আগুনের লেলিহান দেয়াল আরও সামনে এগোতেই ওদের মাথার উপরে ছাইয়ের কুণ্ডলী এসে আঘাত হানল।

দাতে দাঁত পিষল গ্রে। উপরের রুমগুলো থেকে নিচতলাকে আলাদা করে দোকান বানানোর আগে নিশ্চয়ই ভেতরে একটি সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এখন নেই। পথ খুঁজে বের করতে হবে।

‘তোমাদের এখানে কোনো কুড়াল আছে? গ্রে প্রশ্ন করল।

 ফিওনা মাথা নাড়ল।

‘ক্রোবার (ভারি জিনিস ভোলার জন্য বাঁকা প্রান্ত বিশিষ্ট লোহার দণ্ড) নেই? বক্স কিংবা ঝুড়ি খোলার মতো কিছু?

মাথা নাড়ল ও। ‘ক্যাশ রেজিস্টারের ওখানে।’

‘এখানে থাকো। হাতের বাঁ পাশে থাকা দেয়াল ঘেঁষে এগোল গ্রে। এদিক দিয়ে এগোলে তরতর করে সেন্ট্রাল ডেস্কে পৌঁছুনো যাবে। আগুন এখনও এদিকটীয় আসেনি।

গ্রে’র পিছু নিল ফিওনা।

 ‘আমি তোমাকে ওখানে থাকতে বলেছি।

 ‘ক্রোবারটা কোথায় আছে জানি আমি,’ গ্রের ওপর তেঁতে উঠল ও।

ফিওনার রাগের পেছনে লুকিয়ে থাকা ভয় টের পেল গ্রে। তবে কিছুক্ষণ আগে হতভম্ব হয়ে থাকা ফিওনার চেয়ে রাগী ফিওনা ঢের ভাল। তাছাড়া এরকম রাগী স্বভাব গ্রে’র সাথে যায় ভাল। মেয়েটি এর আগে পিছু নিয়েছিল, ওটা খারাপ হলেও এখন তো পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। অজ্ঞাত আততায়ী গ্রে’কে কোণঠাসা করে ফেলেছে। র‍্যাচেলের চিন্তা করতে করতে মিশন সম্পর্কে তুলনামূলক কম সজাগ ছিল গ্রে। যার ফলস্বরূপ এবার ওর জীবন হুমকির মুখে।

গ্রে’কে ধাক্কা দিল ফিওনা। ধোয়ায় বেচারির চোখ লাল হয়ে গেছে, কাশছে। ‘এই যে, এখানে।’ ডেস্কের পেছন থেকে সবুজ রঙের একটি স্টিলের বার বের করল ও।

‘চলো।‘ বাড়তে থাকা আগুনের দিকে এগোল গ্রে। নিজের উলের সোয়েটারের বিনিময়ে ক্রেবার নিল ও।

‘যন্ত্র থেকে ছিটে আসা পানিতে ভাল করে সোয়েটারকে ভিজাও।’ ক্রোবার দিয়ে উপরের অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র দেখাল ও। এবং পারলে নিজেকেও ভিজিয়ে নাও।

‘তুমি কী করতে যাচ্ছো…?

 ‘আমাদের জন্য একটা সিঁড়ি বানানোর পায়তারা করছি।

বুকশেলফের জন্য রাখা একটি মইয়ে উঠল গ্রে। ওর মুখের ওপর ধোয়া পাক খেল। বাতাস পুড়ে গেল যেন। ক্রোবার দিয়ে টিনের সিলিং টাইলসে গুতা দিল গ্রে। সহজেই নিজের স্থান থেকে সরে গেল ওটা। যে যেমনটা ধারণা করেছিল, দোকানের ছাদে নিচে একটি ড্রপ সিলিং আছে। এই সিলিং উপর তলার মেঝেতে থাকা কাঠ তার স্তর ঢেকে রেখেছিল।

 মইয়ের একদম উঁচুতে উঠল গ্রে। ওখান থেকে বুককেসের শেষ কয়েক তাকে চড়ল ও। বুককেসের উপরে রীতিমতো চড়ে বসে ক্রোবার দিয়ে দুটো তক্তার ভেতরে ঢুকাল গ্রে। ক্রোবার বেশ গভীরে চলে গেল। এবার নিজের গায়ের জোর খাটাল ও। স্টিলের বার পুরোনো কাঠ চিরে দিল। কিন্তু ওটার আকার একটি ইঁদুরের গর্তের মতো।

চোখ জ্বালাপোড়া করে পানি পড়ছে। নিচ দিকে ঝুঁকল গ্রে। কাশল। অবস্থা ভাল নয়। ধোয়ার সাথে প্রতিযোগিতা করে ক্রোবার চালাতে হবে ওকে। পেছন ফিরে আগুনের দিকে তাকাল গ্রে। আগুনের হিংস্রতা বাড়ার সাথে সাথে ধোয়াও বেড়ে চলেছে।

এই গতিতে কাজ করতে থাকলে কিছুই হবে না।

কিছু একটা নড়ে ওঠায় গ্রে নিচ দিকে তাকাল। মই বেয়ে উঠছে ফিওনা। এক টুকরো কাপড় পেয়ে ওটাকে ভিজিয়ে নিজের নাক-মুখে বেঁধেছে ও। গ্রে’র উলের সোয়েরটা সে উপরে তুলে ধরল। এটাকেও ভিজিয়ে এনেছে, ভিজে সাইজে ছোট হয়ে গেছে সোয়েটার, দেখতে কুকুরের ছোট্ট বাচ্চার মতো লাগছে। গ্রে অনুধাবন করল মেয়েটির বয়স ১৭ নয় তারচেয়েও কম। ওর আগের ধারণা ভুল ছিল। এই মেয়ের বয়স ১৫’র বেশি হতে পারে না। আতঙ্কে ওর চোখ দুটো লাল হলেও ওখানে আশার আলো আছে, গ্রের ওপর অন্ধের মতো ভরসা করছে মেয়েটি।

কেউ যখন ওকে এভাবে অন্ধের মতো ভরসা করে, বিশ্বাস করে গ্রে’র তখন রাগ হয়। কারণ, ও তাদের ভরসা না রেখে পারে না।

সোয়েটারের দুই হাতা নিজের গলায় বেঁধে বাকি অংশ পিঠের ওপর ফেলে রাখল গ্রে। ছাইযুক্ত বাতাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হাতার এক অংশ তুলে নিয়ে নিজের নাক-মুখ ঢাকল।

গ্রে’র শার্টের পেছনের অংশ ভিজে যাচ্ছে ভেজা সোয়েটারের কারণে। এতে বরং ভালই হচ্ছে। ঘাড়ত্যাড়া কাঠের তক্তাগুলোকে শায়েস্তা করার জন্য আবার যুদ্ধে নামল ও। ওর নিচে ফিওনা দাঁড়িয়ে আছে, গ্রে নিজের দায়িত্ব আঁচ করতে পারল।

ড্রপ সিলিং আর কাঠের তক্তার স্তরের মধ্যকার ফাঁকা জায়গাটুকুতে চোখ বুলাল গ্রে। যদি পালানোর জন্য বিকল্প কোনো রাস্তা পাওয়া যায়। চারিদিকে পাইপিং আর ওয়্যারিঙের ছড়াছড়ি। নিচের অংশ দোকান আর ওপরের অংশ রুম হিসেবে আলাদা হওয়ার পর বাড়তি অনেক কিছু যোগ হয়েছে এখানে। নতুন যুক্ত হওয়া পাইপিংগুলো দেখতে বিশ্রী লাগছে। পুরোনো ওয়্যারিং ও পাইপিংগুলো সুন্দর গোছানোভাবে করা হলেও নতুনগুলো করা হয়েছে একদম যা-তা ভাবে।

গ্রে খুঁজতে খুঁজতে সারি সারি কাঠের তক্তার মাঝে একটি জায়গায় বক্স আকৃতির ভিন্নতা লক্ষ করল। জায়গাটির আকার তিন বর্গ ফুট, পুরু করে চিহ্ন দেয়া। সাথে সাথে চিনতে পারল ও। ওর ধারণাই সঠিক। উপরতলার সাথে নিচ তলার যোগাযোগের জন্য আগে এখানে একটি সিঁড়ির ব্যবস্থা ছিল।

কিন্তু এটাকে এরকম সুন্দর করে বন্ধ করা হয়েছে কীভাবে?

সেটা জানার মাত্র একটাই রাস্তা আছে।

বুককেসের একদম ওপরে উঠে দাঁড়াল ও। বক্স আকৃতির জায়গাটির কাছে যাওয়ার জন্য বুককেসের ওপর দিয়ে এগোল, ওটাকে খুলবে। খুব বেশি দূরে নয়, মাত্র কয়েক ফুট কিন্তু সমস্যা হলো যেদিকে আগুন জ্বলছে ওকে সেই দিকে যেতে হবে।

‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ মইয়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা ফিওনা প্রশ্ন করল।

জবাব দেবার মতো অবস্থায় নেই গ্রে। ওর প্রতি পদক্ষেপে ধোয়া আরও ভারি হয়ে উঠছে। তাপমাত্রাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। অবশেষে ও বন্ধ করে দেয়া সিঁড়ির ওখানটায় গিয়ে পৌঁছল।

 নিচ দিকে তাকাল ও। বুককেসের নিচের তাকে ইতোমধ্যে আগুন ধরে গেছে। আগুনে চুড়োর কাছাকাছি চলে এসেছে গ্রে।

কোনভাবেই সময় নষ্ট করা চলবে না।

নিজেকে তৈরি করে ক্রোবারকে কাজে লাগাল ও।

পাতলা কাঠের তক্তার ভেতর দিয়ে সহজেই ক্রোবার ঢুকে পড়ল। ঠিক তক্তা নয়, পাতলা ফাইবারবোর্ড আর ভিনাইল টাইলস। বর্তমান যুগের জিনিসগুলো যেমন হালকা পাতলা হয়, সেরকম। গ্রে’র ধারণা এবারও সঠিক প্রমাণিত হলো। আধুনিক যুগের এরকম হালকা-পাতলা জিনিস দিয়ে কাজ সারার নীতির জন্য মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল গ্রে।

বাতাসে তাপ বাড়ছে। হাতে ধরা ক্রোবারকে যন্ত্রের মতো ব্যবহার করে উপরে ওঠার মতো যথেষ্ট জায়গা তৈরি করল ও।

সদ্য খোলা জায়গা দিয়ে ক্রোবারটিকে উপরে ছুঁড়ে দিল গ্রে। উপরে আছড়ে পড়ে ঠনঠন আওয়াজ করল ওটা।

ফিওনার দিকে তাকিয়ে ওর কাছে আসার ইশারা করল।

‘পারবে বুকশেলফের উপরে উঠে তারপর…?

‘আমি দেখেছি, তুমি কীভাবে ওখানে উঠেছ। বুককেসে চড়তে শুরু করল ফিওনা।

নিচ দিক থেকে ভেসে আসা একটি শব্দ গ্রে’র দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ওর নিচে থাকা বুককেস কেঁপে উঠল থরথর করে।

এই সেরেছে…।

গ্রে’র ওজন আর বুককেসের নিচে আগুন ধরে যাওয়ার কারণে বুককেসের নিচের অংশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। তৈরি করা গর্তে নিজের অর্ধেক তুলে দিয়ে শেলফের ওপর থেকে ওজন কমাল ও।

‘তাড়াতাড়ি,’ মেয়েটিকে তাড়া দিল।

ভারসাম্য রক্ষার জন্য হাত ছড়িয়ে রেখে ফিওনা বুককেসের ওপরে চড়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রে’র কাছ থেকে প্রায় তিন ফুট দূরে আছে ও।

‘তাড়াতাড়ি করো, গ্রে আবার তাড়া দিল।

 ‘প্রথম যখন বলেছ তখনই শুনেছি তো…?

গ্রের নিচে থাকা বুককেস সশব্দে ধসে পড়ল। বুককে ধসে পড়তে দেখে গর্তের কিনারা আরও শক্ত করলে ধরল গ্রে। এক পশলা টাটকা ছাই, আগুন আর তাপমাত্রা উপরে উঠে এল।

ফিওনার পায়ের নিচে থাকা বুককেসের অংশ কেঁপে উঠতেই চিৎকার করে উঠেছিল তবে সামলে নিয়েছে।

হাতে ঝুলে থাকা অবস্থায় মেয়েটিকে ডাকল ও। ‘লাফ দাও। আমার কাঁধ ধরবে।

আর কিছু বলে সাহস যোগাতে হয়নি গ্রে’র, বুককেস আবার কেঁপে উঠতেই লাফ দিল ফিওনা। গ্রে’কে জাপটে ধরল। গ্রে’র গলায় হাত আর কোমরে পা প্যাচিয়ে ধরেছে। ফিওনার লাফের দমকে আর একটু হলেই গ্রে’র হাত ফসকে গিয়েছিল।

‘আমার শরীরকে ব্যবহার করে গর্তের ভেতরে উঠে যেতে পারবে?’ টান টান অবস্থায় বলল গ্রে।

‘ম…মনে হয় পারব।’

 চুপচাপ গ্রে’কে ধরে ঝুলে থাকল ও। নড়ল না।

গর্তের এবড়োখেবড়ো কিনারা গ্রে’র আঙুলে আঘাত করছে। ‘ফিওনা…’

একটু কেঁপে উঠে গ্রে’র পিঠের ওপর কাজ শুরু করল ও। নড়তে শুরু করেই এক পা গ্রে’র বেল্টে বাধিয়ে কাঁধে ভর দিয়ে মাকড়সা ও বানরসুলভ যৌথ দক্ষতার সমন্বয়ে চটপট উপরে উঠে গেল মেয়েটি।

নিচে বইয়ে লাগা আগুন দাবানলে রূপ নিয়েছে।

ফিওনার পর গ্রে নিজেও গর্তের ভেতর দিয়ে উপরে উঠে এল। একটি হলওয়ের মাঝখানে এসে উঠেছে ওরা। ওর দু’পাশে রুম ছড়ানো আছে।

‘আগুন এখানেও চলে এসেছে,’ ফিসফিস করে বলল ফিওনা, যেন ওর কথা শুনতে পেলে আগুন এদিকে আরও বেশি করে ধেয়ে আসবে। গর্তের ভেতর থেকে পা উঠিয়ে গ্রে খেয়াল করল অ্যাপার্টমেন্টের পেছনের দিক থেকে উজ্জ্বল শিখার আভাস দেখা যাচ্ছে। এখানে থোয়াও আছে, তবে নিচের চেয়ে কম।

‘চলো,’ বলল গ্রে। দৌড় এখনও শেষ হয়নি।

আগুনের উল্টো দিকে দ্রুত এগোল ও। উপরের দিকে বসানো একটি জানালার কাছে এসে থামল। দুই পাতের ভেতর দিয়ে উঁকি দিল গ্রে। দূর থেকে সাইরেনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। লোকজন জড়ো হয়েছে নিচের রাস্তায়। লাজুক দর্শক এরা। তবে এদের মধ্যে নিশ্চিতভাবে দু-একজন আততায়ীও ঘাপটি মেরে আছে।

জানালা দিয়ে বেয়ে ওঠার চেষ্টা করলে ওরা দুজনই সবার চোখে পড়ে যাবে।

 ফিওনা-ও লোজনের দিকে তাকাল। ‘ওরা আমাদেরকে বেরোতে দেবে না, তাই না?

‘আমরা আমাদের নিজেদের পথ বের করে নেব।’

পেছনে হটে খুঁজতে শুরু করল গ্রে। রাস্তা থেকে বিল্ডিঙের যা যা দেখেছিল মনে করার চেষ্টা করল। ছাদে যেতে হবে ওদের।

গ্রে’র মতলব বুঝল ফিওনা। ‘পাশের রুমে একটা মই আছে।’ পথ দেখিয়ে এগোল ও। ‘আমি এখানে এসে মাঝে মাঝে পড়তাম যখন মাট্টি…’ ওর কণ্ঠ ভেঙে গেল। শব্দগুলো আর বেরোল না।

গ্রে জানে, মেয়েটিকে ওর নানুর মৃত্যু অনেকদিন তাড়া করে বেড়াবে। মেয়েটির কাঁধে এক হাত রাখল ও কিন্তু রেগে কাঁধ ঝাঁকিয়ে গ্রে’কে সরিয়ে দিল ফিওনা।

 ‘এককালে’ বসার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত রুমে ঢুকে বলল ও। এখন এই রুমে কয়েকটি বাক্স আর ফাটা-ছেঁড়া সোফা ছাড়া কিছুই নেই।

সিলিং থেকে ঝুলে থাকা একটি ক্ষয়প্রাপ্ত রশি দেখাল ফিওনা, ছাদের একটি ট্রাপড়োরের সাথে ওটা লাগানো রয়েছে।

 গ্রে রশি ধরে টান দিতেই একটি কাঠের মই ওপর থেকে মেঝেতে নেমে এল। মই বেয়ে প্রথম উঠল গ্রে, ওর পেছন পেছন উঠল ফিওনা।

 চিলেকোঠাটির নির্মাণ কাজ শেষ না করে অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল। এখানে থাকা দুটো জানালা দিয়ে ভেতরে আলো আসছে। একটি জানালার মুখ রয়েছে সামনের রাস্তার দিকে আর অন্যটি পেছন দিকে। ধোয়া এখানেও হাজির হয়েছে তবে কোনো আগুন নেই।

গ্রে প্রথমে পেছনের জানালা দিয়ে চেষ্টা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। পশ্চিম দিকে মুখ করে রয়েছে ওটা, দিনের এসময়টায় ওখানে ছাদের ছায়া পাওয়া যাবে। এছাড়াও বিল্ডিঙের ওদিকেই আগুন লেগেছে। তাই হামলাকারীরা হয়তো ওদিকে কম নজর দেবে। কাঠের তক্তার ওপর দিয়ে লাফিয়ে এগোল গ্রে। নিচ থেকে উঠে আসা তাপের আঁচ ও এখানেও অনুভব করতে পারছে।

জানালার কাছে পৌঁছে নিচ দিকে তাকাল গ্রে। নিচ তলার ছাদের বাড়তি অংশ এমনভাবে রয়েছে যে ও দোকানের পেছন দিকটা দেখতে পারছে না। যদি গ্রে হামলাকারীদের দেখতে না পারে তাহলে হামলাকারীরাও গ্রে’কে দেখতে পাবে না। তার ওপর নিচের ভাঙ্গা জানালাগুলো থেকে গলগল করে ধোয়া বেরিয়ে এসে এদিকটাকে আড়াল করে দিয়েছে।

একবারের জন্য হলেও আগুন ওদের উপকারে এলো!

জানালার পাল্লা খুলে দেয়ার পরও গ্রে ওখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। অপেক্ষা করছে। না, কোনো গুলি হলো না। তবে রাস্তার ওপাশে জড়ো হওয়া সাইরেনগুলোর আওয়াজ শোনা গেল।

‘আমি আগে যাচ্ছি, ফিওনাকে ফিসফিস করে বলল গ্রে। যদি সব ঠিক থাকে তাহলে…’।

ওদের পেছনে ছোট গর্জনের মতো শব্দ হলো।

দু’জনই ঘুরল ওরা। আগুনের একটি জিহ্বা এসে কাঠের তক্তায় আঘাত হেনে ওটার সর্বনাশ করে দিয়েছে। সশব্দে ভেঙে, ধোয়া তৈরি করল ওটা। ওদের হাতে সময় খুব কম।

‘আমাকে দেখো,’ বলল গ্রে।

জানালার বাইরে গেল ও, নিচু হয়ে আছে। একটানা শ্বাসরুদ্ধকর তাপমাত্রায় থাকার পর ছাদের এ-অংশের বাতাসকে সুন্দর ঠাণ্ডা মনে হলো ওর।

পালানোর স্বার্থে ছাদের টাইলসগুলো পরীক্ষা করল গ্রে। জায়গাটি বেশ খাড়া ও ঢালু তবে ওর জুতোয় বেশ ভাল গ্রিপ আছে। সাবধানে হাঁটলে, সম্ভব। জানালার কাছ থেকে সরে উত্তরদিকের ছাদের কিনারার দিকে এগোল ও। সামনে দুটো বিল্ডিঙের মাঝে প্রায় ফুট তিনেক ফাঁকা জায়গা আছে। সমস্যা নেই, এটুকু ওরা লাফিয়ে পার হয়ে যেতে পারবে।

সন্তষ্ট হয়ে জানালার দিকে ফিরল ও। “ঠিক আছে, ফিওনা… সাবধানে।

ফিওনা জানালা দিয়ে আগে মাথা বের করে চারিদিক দেখে নিল, তারপর নামল ছাদে। নিচু হয়ে প্রায় বসে বসে এগোচ্ছে ও।

মেয়েটির জন্য গ্রে অপেক্ষা করছে। ‘বেশ দারুণ করছ তুমি।

কথা শুনে গ্রে’র দিকে তাকাল মেয়েটি। মনোযোগ সরে যাওয়া একটি ভাঙ্গা টাইলের ওপর পা পড়ল ওর। টাইল ভেঙ্গে যাওয়ায় ফিওনার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল। পেটের ওপর ভর দিয়ে আছড়ে পড়ল বেচারি। ঢালু ছাদ দিয়ে পিছলে নামতে শুরু করল।

হাত-পা দিয়ে নিজেকে থামাতে চেষ্টা করলেও ফিওনা আকড়ে ধরার মতো কিছু পেল না।

গ্রে ওকে বাঁচানোর জন্য সামনে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না।

টাইলসগুলোর ওপর দিয়ে পিছলে যেতে যেতে ওর গতি বাড়তে লাগল। আরও টাইলস ভাঙ্গল হাত-পা ছোঁড়ার কারণে। ওর সামনে থাকা টাইলস ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে “টাইলসধস”-এর মতো অবস্থা হলো।

উপুড় হয়ে পড়ে রইল গ্রে। কিছুই নেই ওর।

‘গাটার! (ছাদ থেকে পানি গড়ানোর জন্য পাইপ বা নালী)’ মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল গ্রে। “গাটার ধরো!’

ফিওনা দেখে মনে হলো ও কিছুই শুনতে পায়নি। টাইলস ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নিচে চলে যাচ্ছে সে। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে এবার গড়াতে শুরু করল ও। একটি আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো ওর গলা দিয়ে।

প্রথমে ভেঙ্গে যাওয়া কয়েকটি টাইলস কিনারা থেকে ছিটকে পড়ল। আগুনের চিরবির শব্দের সাথে পাথুরে উঠোনে ওগুলো আছড়ে পড়ার শব্দও শুনতে পেল গ্রে।

 ফিওনাও ওগুলোর অনুসরণ করল, হাত ছড়িয়ে ছাদের কিনারা থেকে খসে পড়ল বেচারি।

চলে গেল ফিওনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *