১২. উকুফা
সকাল ৬টা ১৯ মিনিট।
রিচার্ডর্স বে, সাউথ আফ্রিকা।
ব্রিটিশ টেলিকম ইন্টারন্যাশনালের স্থানীয় অফিসে সিঁড়ির ধাপ দিয়ে উঠতে গিয়ে লিসা খেয়াল করল পেইন্টারের পা কাঁপছে। এখানকার একজন ব্রিটিশ অপারেটিভের সাথে দেখা করতে এসেছে ওরা। ওয়ালেনবার্গ এস্টেটে কোনো আক্রমণ করার প্রয়োজন পড়লে এই ব্রিটিশ অপারেটিভ প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে। রিচার্ডস বে এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সিতে করে এই ফার্মে আসতে খুব একটা সময় লাগে না। এখান থেকে ওয়ালেনবার্গ এস্টেট ১ ঘণ্টার পথ।
শক্ত করে সিঁড়ির রেলিং ধরল ক্রো। আর্দ্র হাতের ছাপ পড়ল রেলিঙের উপর। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছুনোর সময় ওর কনুই ধরে সাহায্য করল লিসা।
লাগবে না, পেইন্টার ক্রো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আপত্তি করল।
লিসা অবশ্য ওর রাগকে পাত্তা দিল না। ও ভাল করেই জানে, দুশ্চিন্তার কারণে ক্রোর মেজাজ এখন একটু খারাপ আছে। তার ওপর বেচারা অসুখে আক্রান্ত। আফিমের নেশায় আসক্ত ব্যক্তির মতো খোঁড়াতে খোঁড়াতে অফিসের দরজার দিকে এগোল ক্রো। লিসা ভেবেছিল প্লেনে বিশ্রাম শেষে নামার পর পেইন্টারের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। কিন্তু কীসের কী, দিনের প্রায় অর্ধেক সময় প্লেনে চড়ে আকাশে ছিল ওরা, উন্নতি তত দূরে থাক উল্টো আরও দুর্বল হয়ে গেছে। অ্যানার কথা সত্য হয়ে থাকলে… বিকেন্দ্রীকরণ আরও বেড়েছে ওর।
অ্যানা আর তার ভাই গানথারকে এয়ারপোর্টে গার্ডের তত্ত্বাবধানে রেখে এসেছে ওরা। নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে ভেবে ওদের আনা হয়নি, বিষয়টা তেমন নয়। শেষ কয়েকঘন্টা প্লেনের বাথরুমে বমি করতে করতে আনা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তাঁকে আর গানথারকে সাথে করে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। লিসা আর ক্রো যখন রওনা হচ্ছিল, গানথার তার বোনকে কাউচে শুইয়ে দিচ্ছিল তখন। অ্যানার কপালে জলপট্টি দেয়া। বেচারির বাম চোখ টকটকে লাল। বিতৃষ্ণাবোধ লাঘব করার জন্য তাঁকে লিসা অ্যান্টিমেটিক দিয়েছিল, তার সাথে অল্প একটু মরফিন।
মুখে কিছু না বললেও লিসা মনে মনে আন্দাজ করল স্বাস্থ্যের চরম অবনতি হওয়ার আগে এটাই ক্রো আর অ্যানার সর্বশেষ ভাল দিন। এরপর হয়তো এদের স্বাস্থ্যের এমন অবনতি হবে, তখন চিকিৎসা করেও হয়তো আর উন্নতি করা সম্ভব হবে না।
ওদের দুজনের সামনে এগোচ্ছে মেজর ব্রুকস। লিসা ও পেইন্টারের জন্য দরজা খুলে দিল সে। নিচের রাস্তায় সতর্ক নজর রেখেছে, যদিও সকালের এসময়ে খুব একটা মানুষের আনাগোনা নেই।
নিজের খোঁড়ানো ভঙ্গিকে যতটুকু সম্ভব সুকোনোর চেষ্টা করল পেইন্টার ক্রো, কিন্তু পুরোপুরি আড়াল করতে পারল না।
ওর পিছু পিছু এগোল লিসা। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওরা রিসিপশন এরিয়া পেরিয়ে অফিস ও কিউবিকলের ধূসর সারি পেরিয়ে একটা কনফারেন্স রুমে পৌঁছুল।
রুমটা খালি। এর জানালাগুলো দিয়ে রিচার্ডস বে-এর উপহ্রদ দেখা যাচ্ছে। উত্তরে আছে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত ক্রেনের পোর্ট আর কনটেইনার জাহাজ। দক্ষিণে দেয়াল তুলে মূল হ্রদ থেকে এক অংশকে বিচ্ছিন্ন করে সংরক্ষিত এলাকা ও পার্ক তৈরি করা হয়েছে। ওখানে কুমীর, হাওর, জলহস্তী, পেলিকান, কোমর্যান্ট এবং কলহংসদের অভয়ারণ্য।
সকালের সূর্য হ্রদের পানিকে অগ্নিময় আয়নায় পরিণত করেছে।
ওদের অপেক্ষা করার সময়টুকুতে টেবিলে চা আর কেক চলে এলো। দেরি না করে বসে পড়ল ক্রো। লিসাও যোগ দিলো ওর সাথে। তবে মেজর ব্রুকস বসল না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল সে।
লিসা কিছু জিজ্ঞেস করেনি, তারপরও পেইন্টার ওর চেহারা দেখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে বলল, আমি ঠিক আছি।
না, তুমি ঠিক নেই, নরম স্বরে আপত্তি তুলল লিসা। এই ফাঁকা রুম দেখে ওর কেমন যেন ভয় ভয় করছে।
লিসার দিকে তাকিয়ে হাসল পেইন্টার, ওর চোখ চকচক করছে। শারীরিকভাবে অবনতি হলেও মানসিকভাবে যথেষ্ট ভাল আছে ক্রো। তবে লিসা খেয়াল করে দেখল, ওর কথাগুলো একটু জড়িয়ে যাচ্ছে, একটু অস্পষ্ট। ওষুধের কারণে এরকমটা হতে পারে। কিন্তু এরপর যদি ওর মানসিক বিকৃতি ঘটে। ক্রো আর কতক্ষণ টিকবে?
টেবিলের নিচ দিয়ে হাত বাড়িয়ে ক্রোর দিকে হাত বাড়াল লিসা।
পেইন্টার ওর হাত ধরল।
লিসা চায় না পেইন্টারের কিছু হয়ে যাক। পেইন্টারের প্রতি আবেগ দেখে নিজেই অভিভূত হয়ে গেল লিসা। ক্রোকে ও এখনও সেভাবে চেনে না, তারপরও এত আবেগ। ওর সম্পর্কে আরও জানতে চায় লিসা। ওর পছন্দের খাবার, পছন্দের কৌতুক, ওর নাচের ধরন, রাতে ফিসফিস করে গুড নাইট জানানোর সময় কীভাবে জানায়… লিসা এসব জানতে চায়। আর তাই ও পেইন্টারকে হারাতে চায় না।
পেইন্টারের হাত শক্ত করে ধরল ও, যেন এভাবে ধরে রাখলে ওকে আটকে রাখতে পারবে।
রুমের দরজা খুলে গেল। ব্রিটিশ অপারেটিভ এসেছে বোধহয়। তাকে দেখার জন্য ঘুরল লিসা, কিন্তু অবাক হলো। ও মনে মনে ভেবেছিল জেমস বন্ডের মতো ক্লিন সেভ করা, আরমানি স্যুট পরিহিত কেউ আসবে। কিন্তু রুমে যে ঢুকল সে একজন মধ্যবয়স্কা নারী। পরনে খাকি সাফারি স্যুট। তার এক হাতে হ্যাট দেখা যাচ্ছে। লাল ধুলোয় তার চেহারা পুরোটা মাখামাখি হয়েছে। তবে নাকের কিছু অংশে ধুলো লাগেনি। সম্ভবত ওখানে চশমা রাখা ছিল।
আমি ড. পলা কেইন, বললেন তিনি। মেজর ব্রুকসের দিকে একবার মাথা নেড়ে লিসা ও পেইন্টারের দিকে এগোলেন।বোঝাপড়া করার মতো যথেষ্ট সময় আমাদের হাতে নেই।
***
টেবিলের ওপর ঝুঁকে আছে ক্রো। অনেক স্যাটেলাইট ফটো টেবিল জুড়ে বিছানা রয়েছে। কতদিন আগের ছবি এগুলো? প্রশ্ন করল ও।
গতকাল সন্ধ্যার দিকে ভোলা, পলা কেইন জবাব দিলেন।
পলা কেইন ইতোমধ্যে এখানে তার ভূমিকার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। জীববিজ্ঞান নিয়ে পিএইচডি করার পর ব্রিটিশ ইন্টেলিজেলে যোগ দিয়ে সাউথ আফ্রিকায় আসেন তিনি। বান্ধবী মারসিয়াকে সাথে নিয়ে একাধিক রিসার্চ প্রজেক্ট করতে করতে গোপনে ওয়ালেনবার্গ এস্টেটের ওপর বিগত দশ বছর যাবত নজর রেখে আসছিলেন। কিন্তু দুই দিন আগে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে। অদ্ভুতভাবে তার বান্ধবী মারা গেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছে সিংহের আক্রমণে মৃত্যু। কিন্তু পলা এই ব্যাখ্যায় সদুষ্ট নন।
মাঝরাতের পর ইনফ্রারেড-এ কিছু একটা পার হয়েছিল, বললেন পলা, কিন্তু যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে আমরা ছবিটা পাইনি।
বিশাল এস্টেটের নকশার দিকে তাকিয়ে রয়েছে পেইন্টার। প্রায় এক লাখ একর নিয়ে এই এস্টেট! প্লেন ওঠানামার জন্য জঙ্গলের মাঝে ছোট একটা ল্যান্ডিং ট্রিপও আছে। জঙ্গলের একদম মধ্যে ওয়ালেনবার্গদের মূল ভবন অবস্থিত। শুধু ভবন বললে ভুল বলা হবে। পাথর ও কাঠ দিয়ে বানানো এক অট্টালিকা ওটা।
ভবনের আশপাশ দেখার জন্য এরচেয়ে আর কোনো ভাল উপায় নেই?
মাথা নাড়লেন পলা। ওই এলাকাটা হচ্ছে আফনোমন্টেইন ফরেস্ট, প্রাচীন জঙ্গল। সাউথ আফ্রিকায় এরকম জঙ্গল খুব কমই আছে। নিজেদের সুবিধের জন্য ওয়ালেনবার্গরা এস্টেটের তৈরির ক্ষেত্রে এরকম জায়গা বেছে নিয়েছে। তাদের এস্টেটের সুরক্ষায় বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে এই সুবিশাল জঙ্গল। ওখানকার গাছগুলোর উচ্চতা ৪০ মিটার, ডালপালার স্তরে ভরপুর, অনেকটা সামিয়ানার মতো অবস্থা। যেকোনো রেইন ফরেস্ট কিংবা কঙ্গো জঙ্গলের চেয়ে ওটার ঘনত্ব ও বৈচিত্র্য অনেক বেশি।
এবং গা ঢাকা দেয়ার জন্যও এই জঙ্গল খুবই কার্যকরী, বলল ক্রো।
জঙ্গলের সামিয়ানার নিচে কী হচ্ছে সেটা একমাত্র ওয়ালেনবার্গরা ছাড়া আর কেউ জানে না। তবে আমরা এটুকু জানি, মূল ভবনটা হলো পাহাড়ের চূড়োর মতো ছোট। ভূগর্ভস্থ বিশাল কমপ্লেক্স আছে এস্টেটের নিচে।
কতখানি গভীর? পেইন্টার প্রশ্ন করল। তাকাল লিসার দিকে। যদি ওয়ালেনবার্গরা এখানে বেল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ওটাকে মাটির নিচে রাখতে চাইবে।
আমরা জানি না। নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, ওয়ালেনবার্গরা সোনার খনিতে কাজ করে এত বিত্তের অধিকারী হয়েছে।
উইটওয়াটারসর্যান্ড রিফ-এ।
ওর দিকে তাকালেন পলা। একদম ঠিক। হোমওয়ার্ক বেশ ভালভাবে সেরে এসেছেন দেখছি। আবার স্যাটেলাইট ফটোগুলোর দিকে ফিরলেন তিনি। খনিতে যেধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কাজ করানো হয় তাদেরকে দিয়েই ভূগর্ভস্থ কমপ্লেক্সেও কাজ করিয়ে নেয়া হয়েছিল। আমরা জেনেছি, খনি ইঞ্জিনিয়ার, বার্টর্যান্ড কালবার্টকে ভবনের ফাউন্ডেশনের কাজে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তখন। যদিও কিছু দিন পরই তিনি মারা যান।
আন্দাজ করছি… উনি রহস্যময় কোনো ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন।
একটা মোষ তাকে মাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ওয়ালেনবার্গদের কাজ করতে এসে শুধু তিনিই মারা যাননি। পলা কেইনের চোখে বেদনার ছাপ ফুটে উঠছে, বান্ধবীর কথা মনে পড়ে গেছে নিশ্চয়ই। গুজব আছে এখান থেকে আরও অনেক লোক গায়েব হয়েছিল।
এখনও পর্যন্ত এস্টেটের বিরুদ্ধে কোনো সার্চ ওয়ারেন্ট পাওয়া যায়নি?
আপনাকে সাউথ আফ্রিকার রাজনীতির হালচাল বুঝতে হবে। সরকার বদল হতে পারে কিন্তু সোনার কোনো হেরফের হয় না। সোনা যার মুল্লুক তার। ওয়ালেনবার্গরা সবসময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। গভীর পরিখা কিংবা ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর চেয়ে সোনা তাদেরকে বেশি নিরাপত্তা দেয়।
আচ্ছা। তো আপনার কী খবর? জানতে চাইল ক্রো। এমআই-৫ এখানে কেন আগ্রহী হলো?
আমাদের আগ্রহের কারণ অনেক পুরোনো। ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স ওয়ালেনবার্গদের ওপর ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নজর রেখে আসছে।
নিজের চেয়ারে বসে পড়ল ক্রো, ক্লান্ত। ওর এক চোখ ঠিকভাবে কাজ করছে না। চোখ ডলল ও। খুব ভাল করেই জানে লিসা ওকে পর্যবেক্ষণ করছে। তাই চোখ ডলা বাদ দিয়ে পলার দিকে মনোযোগ দিল পেইন্টার ওয়ালেনবার্গদের পারিবারিক প্রতীকে নাৎসিদের চিহ্ন দেয়া আছে এটা ও এখনও বলেনি। কিন্তু নাৎসিদের সাথে ওয়ালেনবার্গদের যোগসূত্রের বিষয়টা এমআই-৫ ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছে।
আমরা জানি, ওয়ালেনবার্গরা Ahmenerbe Forschungs und Lehrgemeinshaft-এর মোটা অংকের অর্থ যোগানদাতা হিসেবে কাজ করতো। নাসিদের সোসাইটি ওটা। গ্রুপটা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে?
মাথা নাড়ল ক্রো। নেই। মাথাব্যথা করছে ওর। দুঃসহ ব্যথাটা ঘাড় বেয়ে পিঠে চলে গেল। দাতে দাঁত চেপে সহ্য করল পেইন্টার।
রিসার্চ গ্রুপ ছিল ওটা। কর্ণধার ছিলেন হেনরিক হিমল্যার। আর্য জাতিদের শেকড় অনুসন্ধান করা ছিল তাদের কাজ। এছাড়া যুদ্ধবন্দীদের ক্যাম্প ও গোপন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে জঘন্য কাজের সাথে তারা জড়িত ছিল। এককথায় তারা ছিল–অস্ত্রধারী বৈজ্ঞানিক।
ব্যথায় কুঁচকে গেল ক্রো… তবে এবারের ব্যথা শারীরিক নয়, মানসিক। সিগমা থেকেও এরকম কথা বলা হয়েছে। অস্ত্রধারী বৈজ্ঞানিক। তাহলে এখানে কী সেই বৈজ্ঞানিকরাই ওদের শত্রু? এটা কী সিগমা ফোর্সের নাৎসি ভার্সন?
লিসা বলল। এই রিসার্চের সাথে ওয়ালেনবার্গদের সম্পর্ক কী?
আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত নই। কিন্তু যুদ্ধের সময় সাউথ আফ্রিকায় অনেক নাস সমর্থক ছিল। আমরা এও জানি স্যার ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গ-এরও সুপ্রজননবিদ্যার প্রতি আগ্রহ ছিল। যুদ্ধের শেষদিকে বিজ্ঞানীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার আগে তিনি জার্মানি ও অস্ট্রিয়াতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কনফারেন্সে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধর পর পুরো পরিবার নিয়ে তিনি গা ঢাকা দেন।
লজ্জায়? প্রশ্ন করল পেইন্টার।
না, আমাদের তা মনে হয় না। যুদ্ধের পর মিত্রবাহিনী জার্মানিতে নাৎসি প্রযুক্তি হাত করার জন্য লুঠপাট চালিয়ে ছিল। পলা ত্যাগ করলেন। আমাদের ব্রিটিশ বাহিনীও লুঠ-পাটের সাথে জড়িত ছিল।
মাথা নাড়ল ক্রো। অ্যানার মুখ থেকে ইতোমধ্যে সে কাহিনি ও শুনেছে।
কিন্তু নাৎসিরা তাদের প্রযুক্তি লুকোতে ওস্তাদ। ভাঙব তবু মচকাবো না এই নীতি অনুসরণ করেছিল তারা। প্রযুক্তির বেহাত হওয়া ঠেকাতে বিজ্ঞানীদের খুন করে, বোম মেরে ল্যাব উড়িয়ে দিতে তারা দ্বিধাবোধ করেনি। আমাদের বাহিনী সেরকম একটা জায়গায় ঘটনার ঠিক কয়েক মিনিটের মধ্যে হাজির হয়েছিল। এক বিজ্ঞানীর হদিস পেয়েছিল তারা, তার মাথায় গুলি লাগলেও তখনও বেঁচে ছিল। মারা যাওয়ার আগে সে কিছু তথ্য দিয়ে যায়। রিসার্চে কোয়ান্টাম পরীক্ষার মাধ্যমে তারা নতুন একধরনের এনার্জীর উৎস আবিষ্কার করেছে। যুগান্তকারী কিছু করেছিল তারা। ভিন্ন ধরনের এক শক্তির উৎসের আবিষ্কার হয়েছিল তাদের হাতে।
লিসার দিকে তাকাল ক্রো। জিরো পয়েন্ট এনার্জী সম্পর্কে অ্যানার বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেছে ওদের।
যা-ই আবিষ্কার হয়ে থাকুক না কেন সেটার গোপনীয়তা অক্ষত ছিল। নাৎসিরা সেই প্রযুক্তি নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। বিষয়টি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। শুধু বস্তু আর সূত্রের শেষ হয়েছে কোথায় এতটুকু জানা সম্ভব হয়েছে।
সূত্রের শেষ হয়েছে ওয়ালেনবার্গ এস্টেটেঃ লিসা আন্দাজ করল।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন পলা।
আর বস্তুর নাম? উত্তরটা ক্রো জানে, তবুও জানতে চাইল। ওটার নাম কী
ক্রোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন পলা। ভ্রু কুঁচকে বললেন, আপনি জানলেন কীভাবে?
বেল-এর জ্বালানি, লিসা বিড়বিড় করল।
পেইন্টার বুঝতে পারল, সময় হয়ে গেছে। ড. পলা কেইনের সাথে আসল হিসেব নিকেশ শুরু করতে হবে।
আপনার সাথে একজনের দেখা করা দরকার।
***
অ্যানা বেশ উদ্বেগের সাথে বললেন, তাহলে জেরাম-৫২৫ তৈরির ফর্মুলা এখনও ধ্বংস হয়নি? Unglaublich!
ওরা আবার রিচার্স বে এয়ারপোর্টে ফিরে এসেছে। ইসুজু ট্রুপারের ট্রাকে অস্ত্র আর ইকুইপমেন্ট তোলা হচ্ছে এয়ারপোর্টের হ্যাঁঙ্গারে।
পলা, অ্যানা আর পেইন্টার যখন আলোচনা করছে এই ফাঁকে মেডিক্যাল কিটের ভেতরে চোখ বুলিয়ে নিয়েছে লিসা। গানথার লিসার পাশেই রয়েছে। নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে দুশ্চিন্তায় ক্রু কুঁচকে রেখেছে বেচারা। লিসার দেয়া ওষুধ খাওয়ার পর অ্যানা এখন আগের চেয়ে খানিকটা সুস্থ।
কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ?
আপনার দাদা যখন বেল নিয়ে উত্তরে পালিয়ে গিয়েছিলেন, অ্যানাকে ব্যাখ্যা করল ক্রো, ঠিক সেসময় জেরামের গোপন ফর্মুলা নিশ্চয়ই দক্ষিণে যাত্রা করেছিল। একই পরীক্ষার দুটো অংশ ভিন্ন দুই দিকে চলে গিয়েছিল তখন। তারপর কোনো এক সময় ওয়ালেনবার্গদের কানে আসে বেল এখনও টিকে আছে। হিমল্যারের অধীনে থাকা বিশেষ গ্রুপটির অর্থের যোগানদাতা ছিলেন ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গ। তিনি নিশ্চয়ই Granitschlo৪ সম্পর্কে জানতেন।
সায় দিলেন পলা। হিমালয়ে অভিযানের সময় এই গ্রুপটি-ই ছিল হিমল্যারের সাথে।
বেল সম্পর্কে জানার পর GranitschloB-এ গুপ্তচর ঢুকিয়ে দেয়া ব্যালজিকের জন্য কঠিন কিছু ছিল না।
অ্যানার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। পুরোটা সময় ধরে কুত্তার বাচ্চাটা আমাদেরকে ব্যবহার করেছে!
মাথা নাড়ল পেইন্টার। হ্যাঁঙ্গারে ফেরার পথে লিসা ও পলাকে পুরো বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছে ও। সবকিছুর পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গ। মেধার কোনো অপচয় তিনি করেননি। GranitschloB-এর বিজ্ঞানীদেরকে বেল নিয়ে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন, আর ওদিকে নিজের গুপ্তচর দিয়ে ওখানকার যাবতীয় তথ্য পাচার করিয়েছেন আফ্রিকায়।
তারপর ব্যালড্রিক নিশ্চয়ই নিজেই একটা বেল তৈরি করে ফেলেছেন, বলল ক্রো। গোপনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে উৎপাদন করেছেন নিজস্ব sonnekonige, আপনার বৈজ্ঞানিকদের উদ্ভাবিত উন্নত কলা-কৌশল তাদের ওপর প্রয়োগ করে আরও নিখুঁত করেছেন। সবমিলিয়ে নিখুঁত ছক। জেরাম-৫২৫-এর বিকল্প কোনো উৎস না থাকলে GranitschloB অচল। পুরো বিষয়টা ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গের দয়ার ওপর ছিল। যে-কোনো সময় তিনি আপনাদের প্রজেক্ট বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন।
শুধু রাখেন না, সেটা কাজে করিয়েও দেখিয়েছেন! অ্যানার কণ্ঠে যেন আগুন ঝরল।
কিন্তু কেন? জানতে চাইলেন পলা। দূর থেকে কলকাঠি নেড়ে যদি সব ঠিকঠাকভাবে চলছিল তখন এসবের কী দরকার ছিল?
শ্রাগ করল ক্রো। হয়তো অ্যানার গ্রুপ আর্য জাতিদের ব্যাপারে নাৎসিদের থাকা মূলমন্ত্র থেকে অনেক বেশি দূরে সরে যাচিছল।
হাতের তালু দিয়ে কপাল চেপে ধরলেন অ্যানা। কিছু বিজ্ঞানীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল… বাইরের পৃথিবীর মূলধারায় যোগ দিতে চাচ্ছিল তারা… আমাদের রিসার্চ শেয়ার করতে চাচ্ছিল ওখানে গিয়ে।
কিন্তু আমার মনে হয় কারণটা এত ছোট নয়, বলল ক্রো! বড় কোনো কারণ ছিল। অনেক বড় কিছু। যার কারণে GranitschloB-কে থামানোর প্রয়োজন হয়েছিল।
আমার মনে হয় আপনার ধারণা হয়তো সত্য। পলা বললেন। গত চার মাস যাবত এসেস্টের কর্মতৎপরতা বেড়ে গেছে। কিছু একটা হয়েছে ভেতরে।
নিশ্চয়ই নতুন কিছু আবিষ্কার করেছে ওরা, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন অ্যানা।
অবশেষে গানথার এবার মুখ খুলল, কর্কশ কণ্ঠে বলল, Genus: হতাশায় ইংরেজি বলতে ভুলে গেছে। নিজেকে সামলে বলল, হারামজাদাটার কাছে বেল আছে… জেরামও আছে… আমরা ওটা খুঁজে বের করব। ওটা ব্যবহার করব আমরা। বোনের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল ও। অনেক কথা হয়েছে!
গানধারের কথার সাথে মন থেকে একমত হলো লিসা। বিশালদেহির পাশে দাঁড়িয়ে বলল, এস্টেটের ভেতরে ঢোকার পথ বের করতে হবে আমাদের। তারপর নিজেই যোগ করল, অবশ্য ভেতরে ঢুকতে একদল সেনাবাহিনী লাগবে।
পলার দিকে ঘুরল ক্রো। আমরা কী সাউথ আফ্রিকা সরকারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য আশা করতে পারি?
পলা মাথা নাড়লেন। বিন্দু পরিমাণও নয়। ওয়ালেনবার্গদের হাত অনেক বড়। ভেতরে ঢোকার জন্য আমাদেরকে আরও কৌশলী পথ অবলম্বন করতে হবে।
স্যাটেলাইট ফটোগুলো দিয়ে খুব একটা সুবিধে হচ্ছে না, বলল ক্রো।
তাহলে আমরা একটু নিচে নামি, ইসুজু ট্রুপারের দিকে ওদেরকে এগিয়ে নিতে নিতে বললেন পলা। ইতোমধ্যে একজনকে আমি মাঠে নামিয়ে দিয়েছি।
.
সকাল ৬টা ২৮ মিনিট।
পেটের ওপর ভর দিয়ে শুয়ে আছে খামিশি। সবেমাত্র ভোর হয়েছে, বনের গাঢ় ছায়ার ভেতর দিয়ে মাটিতে পৌঁছুচ্ছে সূর্যের নরম আলো। সৈনিকদের পোশাক পরে আছে ও। দুইনলা রাইফেল আছে ওর সাথে। পিঠে রয়েছে .৪৬৫ নিট্রো হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ড রয়্যাল। আর হাতে আছে জুলুদের ঐতিহ্যবাহী খাটো বল্লম, একটা অ্যাসেগাই।
দুজন জুলু রয়েছের ওর পেছনে। তাউ এবং নজঙ্গো। খামিশিকে যে জুলু বৃদ্ধ বাঁচিয়েছিল তাউ হচ্ছে তাঁর নাতি। আর নজঙ্গো হলো তাউর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। খাটো, লম্বা বল্লম ছাড়া ওদের হাতে গুলি করার অস্ত্রও আছে। ঐতিহ্য মেনে পরনে পশুর চামড়া আর গায়ে এটা সেটা এঁকে রেখেছে ওরা। ভোদরের চামড়া দিয়ে বানিয়েছে মাথার বন্ধনী। খাঁটি জুলু বলে কথা।
সারারাত ওরা জঙ্গলের ভেতরে কাটিয়েছে। গার্ডদের চোখ এড়িয়ে কীভাবে জঙ্গল মাড়িয়ে মূল ভবনে ঢোকা যাবে সেটা নিয়ে ম্যাপ করছে ওরা। বড় বড় গাছের নিচে থাকা ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে গর্ত করে রাস্তা তৈরি করেছে ওরা তিনজন। এরফলে ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে সুবিধে হবে। কাজটা করার সময় বিভিন্ন জায়গায় থেমেছিল খামিশি। বিভিন্ন ছোটখাটো সংশোধন, ছদ্মবেশ তৈরি এবং চমকে দেয়ার মতো কিছু ব্যবস্থা রেখেছে।
কাজ সেরে তিন মাস্কেটিয়ার এস্টেট থেকে বের হওয়ার জন্য এগোচ্ছে ওরা। এমন সময় রক্তহিম করা আর্তনাদ কানে এলো।
হুউউ ইইই ওওওও!
আর্তনাদের শেষটা হলো গর্জনের মাধ্যমে।
বরফের মতো জমে গেল খামিশি। ওর শরীরের হাড় পর্যন্ত এই গৰ্জন চেনে।
উকুফা।
পলা কেইন ঠিকই বলেছিলেন। তার ধারণা এই দানব ওয়ালেনবার্গ এস্টেট থেকে এসেছে। হয় এটা পালিয়ে বের হয়েছে নয়তো খামিশি আর মারসিয়াকে আক্রমণ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যেটাই হোক না কেন, ওগুলো এখন মুক্ত। শিকার করে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু কাজটা করল কে?
বাঁ দিকে একটু দূর থেকে এসেছে গর্জনটা।
ওটা এখন ওদেরকে শিকার করার জন্য বের হয়নি। খুব দক্ষ শিকারী ওগুলো। নিজেদের অস্তিত্ব এত তাড়াতাড়ি জানান দিতে যাওয়ার কথা নয়। অন্য কিছু একটা ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রক্ততৃষ্ণা জাগিয়েছে ওদের।
তারপর জার্মান ভাষায় চিৎকার শুনতে পেল খামিশি, ফুঁপিয়ে উঠে কেউ সাহায্য চাইছে।
কাছ থেকে এসেছে শব্দটা।
উকুফার গর্জন হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। কিন্তু খামিশির হাড়ের কাপনি এখনও থামেনি। দ্রুত এখান থেকে পালিয়ে যেতে চাইল ও। মানুষের আদিম স্বভাব। ভয় পেলে পালানো।
ওর পেছনে থাকা তাউ-ও জুলু ভাষায় বিড়বিড় করে একই ইচ্ছে জানালো।
যেদিক থেকে কান্নার আওয়াজ এসেছে সেদিকে ঘুরল খামিশি। দানবের কাছে মারসিয়াকে হারিয়েছে, ওর এখনও মনে আছে ভয়ের চোটে জলধারায় গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু এবার আর ও-কাজ করবে না।
জঙ্গলে ঘুরে তৈরি করা ম্যাপটা তার হাতে দিল ও। ক্যাম্পে ফিরে যাও। ড. কেইনকে এটা দেবে।
খামিশি… ভাইয়া… না, যেয়ো না। চলে এসো। ভয়ে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। ওর দাদা নিশ্চয়ই উকুফার গল্প শুনিয়েছে ওকে। গালগল্প এখন জীবন্ত হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই আর ওর বন্ধুকে বাহবা দিতেই হবে। খামিশির সাথে এস্টেটের ভেতরে অন্য কেউ ঢুকতে রাজি হতো না। কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস খুব কঠিন জিনিস।
তবে এখন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে তাউর আর এখানে থাকার কোনো ইচ্ছে নেই।
এজন্য খামিশি অবশ্য ওদেরকে দোষও দিতে পারে না। মারসিয়ার ক্ষেত্রে সে নিজে কীরকম ভয় পেয়েছিল! নিজের দায়িত্ব ভুলে ডাক্তারকে মরতে দিয়ে কাপুরুষের মতো পালিয়েছিল ও।
যাও, নির্দেশ দিলো খামিশি। সামনে নদী আছে। ওটার ওপর দিয়ে এস্টেটের বেড়া দেয়া। ওদিকে নির্দেশ করল ও। ম্যাপটাকে বাইরে পৌঁছুতে হবে।
তাউ ও নজঙ্গো এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করল। অবশেষে মাথা নাড়ল তাউ। দুই বন্ধু নিচু হয়ে এগিয়ে চলল জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। ওরা এত সতর্কভাবে এগোচ্ছে যে খামিশি ওদের কোনো শব্দ পর্যন্ত শুনতে পেল না।
পুরো জঙ্গল জুড়ে এখন অস্বস্তিকর নীরবতা। একদম সুনসান। নীরবতার গভীরতা যেন ঠিক এই জঙ্গলের মতো। দানবের গর্জন আর মানুষের কান্নার আওয়াজ এসেছিল বাঁ দিক থেকে। খামিশি সে-দিকে পা বাড়াল।
ঠিক এক মিনিটের মাথায় নেকড়ের গর্জনের মতো আওয়াজে কেঁপে উঠল পুরো জঙ্গল। গর্জন শেষ হতে এক ঝাঁক পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনা গেল। খামিশি দাঁড়িয়ে পড়েছে। রহস্যময় কিন্তু পরিচিত কিছু একটা ওর দাঁড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী।
কিন্তু সেটা সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবার আগেই ফোপানোর আওয়াজ ওর দৃষ্টিআকর্ষণ করল।
ঠিক সামনে থেকে এসেছে আওয়াজটা।
দুইনলা রাইফেল ব্যবহার করে সামনে থাকা পাতার বাধা দূর করার চেষ্টা করল খামিশি। গুলির ফলে সামনে যতটুকু দৃষ্টি গেল তাতে ও দেখল… একটা গাছ শুয়ে আছে। খুব সম্প্রতি ঘটেছে বিষয়টা। গাছ পড়ে যাওয়ার কারণে জঙ্গলের এই অংশের ডালপালার সামিয়ানার একটি অংশে ফাঁক তৈরি হয়েছে। সূর্যের আলো আসছে সেই ফাঁক দিয়ে। মজার ব্যাপার হলো, সীমিত অংশ দিয়ে সূর্যের আলো আসায় জঙ্গলের অন্যান্য অংশ দেখতে আরও বেশি ভোগান্তি হচ্ছে। ছায়া পড়ে আরও বেশি অন্ধকার হয়ে গেছে সব।
কিছু একটার নড়াচড়া খামিশির চোখে পড়ল। একজন তরুণ… কৈশোর পেরিয়ে সবে তরুণ হয়েছে… একটা গাছের নিচু অংশে রয়েছে সে। আরেকটা ডালে পৌঁছে আরও উঁচুতে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছে বেচারা, কিন্তু পারছে না। কারণ, ডান হাত দিয়ে শক্ত করে কিছু আঁকড়ে ধরতে পারছে না সে। এতদূর থেকেও খামিশি দেখতে পেল, ছেলেটার হাতা রক্তে ভিজে আছে।
তারপর হঠাৎ ছেলেটা নিজের পা গুটিয়ে নিলো, গাছের গুঁড়ি ধরে লুকোনোর চেষ্টা করল।
পরমুহূর্তেই হঠাৎ করে তার এরকম ভয় পাওয়ার কারণটা বোঝা গেল।
দৃশপটে দানবটির আগমন দেখে বরফের মতো জমে গেল খামিশি। ঠিক সেই গাছের নিচেই এসেছে ওটা। আকারে বিশাল, কিন্তু কোনো আওয়াজ না করে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে এসেছে। একটি পূর্ণ-বয়স্ক পুরুষ সিংহের চেয়েও আকারে বড় এটা। কিন্তু এটা সিংহ নয়। এর মোটা লোমগুলো সাদা রঙের, চোখগুলো অতিমাত্রায় লাল, জ্বলজ্বল করছে। কান দুটো বাদুড়ের মতো চওড়া। কাঁধের উঁচু অংশ থেকে এর পিঠ ঢালু হয়ে শরীরের শেষ অংশ পর্যন্ত চলে গেছে। পেশিবহুল গ্রীবার ওপর রয়েছে একটা বড়সড় মাথা। কান দুটো বাদুড়ের মতো চওড়া। দানবটা গাছের দিকে তাকিয়ে আছে।
মাথা উঁচু করে ওপরের গন্ধ শুঁকছে, রক্তের গন্ধ।
ঠোঁট উল্টে রাখায় ওটার ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে।
আরেকবার গর্জন করে গাছে উঠতে শুরু করল দানবটা।
খামিশি জানে নিজে কী দেখছে।
উকুফা।
মৃত্যু।
বিকটদর্শন এই দানবের আসল নামটাও জানা আছে ওর।
.
সকাল ৬টা ৩০ মিনিট।
প্রজাতির নাম–ক্রোকুটা ক্রোকুটা এলসিডি মনিটরের দিকে এগোতে এগোতে বললেন ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গ। ফিওনার খাঁচার ভিডিওর ওপরে দানবটির ভিডিও ফুটেজ দেখা যাচ্ছে মনিটরে। ব্যালড্রিক লক্ষ করেছেন, গ্রে দানবটিকে হা করে দেখছে।
বিশাল ভালুকের মতো বড় সাইজের দানবটিকে পর্যবেক্ষণ করছে গ্রে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। মুখ হাঁ করে গর্জন করছে। ওটার মাঢ়ি সাদা, তীক্ষ্ণ দাঁতগুলোর রঙ হলুদ। প্রায় ৩শ পাউন্ড ওজন হবে দানবটির। কোনো হরিণ জাতীয় প্রাণীর দেহাবশেষের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ওটা।
এটা হচ্ছে হায়না, বললেন ব্যালড্রিক। অফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহৎ মাংসাশী প্রাণী। বড়সড় বুনো যাড়কে একাই কাবু করার ক্ষমতা রাখে।
ভ্রু কুঁচকালো গ্রে। মনিটরে থাকা দানবটি কোনো সাধারণ হায়না নয়। সাধারণ হায়নার চেয়ে এর আকার প্রায় ৩ থেকে ৪ গুণ বড়। লোমগুলোও অনেক বেশি ফ্যাকাসে। আকারে বিশাল ও গায়ের রঙ সাদাটে; দুটোর সম্মিলিত রূপান্তর। দানবীয় মিউটেশন।
কী করেছেন এটা? কণ্ঠে থাকা বিরক্তি চেপে রাখতে পারল না গ্রে। এর পেছনে অবশ্য আরও কারণ আছে। ও চায় ব্যালড্রিক আরও কথা বলুক, তাহলে হাতে বাড়তি সময় পাওয়া যাবে। গ্রে একবার মনকের দিকে তাকিয়ে দুজন একসাথে বৃদ্ধের দিকে মনোযোগ দিল।
আমরা প্রাণীটিকে আরও উন্নত ও শক্তিশালী করেছি। নাতির দিকে তাকিয়ে বললেন ব্যালড্রিক। ইসাক বিরসমুখে ওদের কথাবার্তা শুনছে। ঠিক না, ইসাক?
জ্বী, grootvader.।
ইউরোপের প্রাগৈতিহাসিক গুহার ছবিতে আজকের দিনের হায়নাদের পূর্বপুরুষদের দেখা গেছে। অতীতে বিশালাকার হায়না ছিল। আমরা এই ক্রোকুটা প্রজাতিকে তাদের সোনালি দিন ফিরিয়ে দেয়ার রাস্তা বের করেছি। ব্ল্যাক অর্কিড চাষ করার ব্যাপারে ব্যালড্রিক যেরকম আবেগহীনভাবে কথা বলছিলেন এখনও তিনি ঠিক সেভাবেই কথা বলছেন। প্রজাতির আকার উন্নতির পাশাপাশি আমরা এদের মস্তিষ্কে হিউম্যান স্টিম সেল যোগ করেছি। দারুণ ফলাফল পাওয়া গেছে।
গ্রে পড়েছিল এইরকম পরীক্ষা ইঁদুরের ওপর চালানো হয়েছে। স্যাটফোর্ডের বিজ্ঞানীরা এমন এক ধরনের ইদর উৎপাদন করেছিলেন যাদের মস্তিষ্কের এক শতাংশ মানুষের মতো। কিন্তু এখানে হচ্ছেটা কী?
৫টি প্রাচীন বর্ণমালা আঁকা ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে এগোলেন ব্যালড্রিক। হাতের লাঠি দিয়ে বোর্ডে টোকা দিয়ে বললেন, আমাদের এক ঝক Cray XT3 সুপারকম্পিউটার হিউগোর কোডের ওপর কাজ করে যাচ্ছে। কোড ব্রেক করতে পারলেই আমরা এই একই কাজ মানুষের সাথেও করতে পারব। মানবজাতির নতুন বিবর্তন ঘটাব আমরা। আফ্রিকা থেকে মানবজাতির নতুন যাত্রা শুরু হবে। যেখানে বিভিন্ন জাত, সাদা-কালো এসবের কোনো ভেদাভেদ, মিশ্রণ কিছু থাকবে না। একদম খাঁটি মানবজাতির যাত্রা শুরু হবে, বাকি সব বাদ। আমাদের কলুষিত জেনেটিক কোডকে পরিশুদ্ধ করলেই সেটা সম্ভব।– এ যেন নাৎসি দর্শনের প্রতিধ্বনি শুনল গ্রে। এই বুড়ো পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু তার তাকানোর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। আর মনিটরের পর্দায় তার কাজের দানবীয় প্রমাণও দেখা যাচ্ছে।
ইসাকের দিকে তাকাল গ্রে। ইসাক একটা বোম চাপতেই মনিটর থেকে হায়নার ভিডিও গায়েব হয়ে গেল। হঠাৎ গ্লে চমকে উঠল… হায়না দানবীয়করণ, ইসাক আর তার যমজ বোন, ক্যাসলের সাদা-চামড়ার আততায়ী… ব্যালড়িক শুধু হায়না আর অর্কিড় নিয়ে পরীক্ষা করেই ক্ষান্ত দেননি।
এবার আমরা পেইন্টার ক্রোর ব্যাপারে আসি, বললেন বৃদ্ধ। মনিটর দেখিয়ে বললেন, এখন তো বুঝতে পারছেন আপনি যদি ঠিকভাবে জবাব না দেন তাহলে সেই মেয়েটির জন্য কী অপেক্ষা করছে। অতএব, আর কোনো চাল দেয়ার চেষ্টা করবেন না।
মনিটরের দিকে তাকাল গ্রে। মেয়েটা খাঁচার ভেতরে রয়েছে। ফিওনার কিছু হতে দেবে না ও। আর কিছু হোক বা না হোক, মেয়েটাকে আরও কিছু সময় ওকে দিতেই হবে। কোপেনহ্যাগেনে ওর আনাড়ি তদন্তের জন্য মেয়েটা আজ এসবের মধ্যে জড়িয়ে গেছে। ফিওনার জন্য দায়ী গ্রে। মেয়েটার দেখাশোনা করা ওর দায়িত্ব। আর সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েটাকে ওর ভাল লেগেছে, ফিওনাকে ও সম্মান করে, যদিও মেয়েটা ওকে অনেক জ্বালিয়েছে। গ্রে জানে এখন ওকে কী করতে হবে।
ব্যালড্রিকের দিকে ফিরল ও।
কী জানতে চান?
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পেইন্টার ক্রো আপনার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ। সেটা ইতোমধ্যে তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। আমাদের অ্যামবুশ থেকে পালিয়ে রীতিমতো গায়েব হয়ে গেছেন তিনি। এখন আপনার কাজ হলো তাকে খুঁজে বের করার জন্য আমাদেরকে সাহায্য করা।
কীভাবে?
সিগমা কমান্ডের সাথে যোগাযোগ করবেন। আমাদের একটা বিশেষ সংযোগ আছে, ওটা দিয়ে কথা বললে কেউ লাইন ট্রেস (সনাক্ত করতে পারবে না। আপনি সিগমার সাথে যোগাযোগ করে শুনবেন তারা প্রজেক্ট ম্যাক সান সম্পর্কে কতটুকু জানে এবং এটাও জেনে নেবেন পেইন্টার ক্রো এখন কোথায় লুকিয়ে আছেন। আর যদি কোনোরকম চালাকির চেষ্টা করেন তাহলে… মনিটর দেখালেন ব্যালড্রিক।
এবার গ্রে বুঝতে পারল ওকে কী কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলা হচ্ছে। এরা ওকে চালাকি করার কোনো সুযোগই রাখছে না। হয় ফিওনাকে বাঁচাও নয়তো সিগমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো?
সিদ্ধান্ত নিতে যাবে এমন সময় ওর দাবি অনুযায়ী একটা জিনিস নিয়ে ফিরল গার্ড।
আমার হাত! হাঁক ছাড়ল মনক। গার্ড ওর কৃত্রিম হাত নিয়ে এসেছে। মনকের পঙ্গু হাতের কনুই এখনও পিঠের সাথে বাঁধা।
ওটা ইসাকের কাছে দাও। গার্ডকে নির্দেশ দিলেন ব্যালড্রিক।
ইসাক ডাচ ভাষায় বলল, ল্যাব থেকে কী বলেছে? এতে কোনো লুকোনো অস্ত্র নেই তো?
মাথা নাড়ল গার্ড। না, স্যার, নেই। অল ক্লিয়ার।
তারপরও ইসাক নিজ হাতে কৃত্রিম হাতটা পরীক্ষা করে দেখল। ডারপা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অভিনব আবিষ্কার এটা। শরীরের স্নায়ুগুলোর সাথে সরাসরি সংযোগ দিয়ে এই হাত ব্যবহার করা যায়। এর কব্জিটা টাইটেনিয়ামের তৈরি। উন্নত কারিগরি কৌশল ব্যবহার করার ফলে এর নড়াচড়া খুবই সাবলীল এবং সংবেদনশীল ইনপুট নিতে সক্ষম।
গ্রের দিকে তাকাল মনক।
গ্রে খেয়াল করে দেখল মনকের আঙুলগুলো ডান হাতের কব্জিতে থাকা স্ট্যাম্পের ওপর কোড লিখে ফেলেছে।
মাথা নেড়ে মনকের কাছে গেল গ্রে।
ডারপার নির্মিত এই কৃত্রিম হাতে আরেকটি সুবিধা আছে।
এটা ওয়্যারলেস। অর্থাৎ, তারবিহীনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাজ করতে সক্ষম।
মনক আর ওর কৃত্রিম হাতের মধ্যে রেডিও সিগন্যাল আদান-প্রদান হয়ে গেছে। যার ফল স্বরূপ কৃত্রিম হাতটি ইসাকের হাতে থাকা অবস্থাতেই সক্রিয় হয়ে উঠল।
ঘুষি দেয়ার মতো করে মুষ্টিবদ্ধ করেছে ওটা।
তবে শুধু মধ্যমা আঙুল খোলা রেখেছে।
মর শালা, বিড়বিড় করল মনক।
মনকের কনুই ধরে জোড়া দরজার উদ্দেশ্যে গ্রে সুইংডোরের দিকে এগোল। ওটা দিয়ে মূল ভবনে যাওয়া যাবে।
বিস্ফোরণটা খুব বেশি বড় নয়… একটা উচ্চস্বরে ফাটা ফ্ল্যাশ গ্রেনেডের চেয়ে বেশি হবে না। হাতের বাইরের দিকের কব্জির অংশ থেকে বিস্ফোরণটা ঘটেছে। তবে সেটা জানা না থাকলে বোঝা অসম্ভব। বিস্ফোরণের ফলে গার্ডদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটানো গেছে। চমকে উঠে হাঁক-ডাক ছাড়ছে তারা। জোড়া দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল মনক ও গ্রে। প্রথম মোড় ধরে এগোলো ওরা। এখন পেছন থেকে ওদেরকে সরাসরি দেখা সম্ভব নয়। কাঠের মেঝের ওপর দিয়ে ধুপধাপ করে দৌড়াচ্ছে দুজন।
ঘটনা ঘটতে না ঘটতেই অ্যালার্ম বেজে উঠল, সুর শুনেই বোঝা যাচ্ছে জরুরি তলব করা হচ্ছে ওটা দিয়ে।
পালাতে হবে ওদের, যত দ্রুত সম্ভব।
গ্রে খেয়াল করে দেখল একটি চওড়া সিঁড়ি ওপর দিকে উঠে গেছে। মনকে সাথে নিয়ে ওদিকে চলল ও।
আমরা কোথায় যাচ্ছি? মনক জানতে চাইল।
উপরে… উপরে… সিঁড়িতে একসাথে দুইধাপ করে ডিঙাতে ডিঙাতে বলল গ্রে। সিকিউরিটির লোকজন আশা করবে ওরা ধারে কাছে থাকা কোনো দরজা কিংবা জানলার দিকে যাবে। তাদেরকে ধোকা দিতেই গ্রে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। পালানোর বিকল্প রাস্তা জানা আছে ওর। এই ভবনের নকশা ওর মাথায় রাখা আছে। এখানে আসার সময় এস্টেটটাকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিয়েছিল গ্রে। সেই পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে সে এখন দিক ও দূরত্ব মেপে এগোচ্ছে।
এদিকে এসো। মনককে নিয়ে অন্য করিডোরে চলে এসেছে গ্রে। এটা ছয় তলা। অ্যালার্ম বাজছে সব জায়গায়।
এবার কোথায়…? মনক আবার কথা শুরু করতে যাচ্ছিল।
উপরে, করিডোরের শেষ প্রান্ত দেখিয়ে বলল গ্রে। ওখানে একটা দরজা রয়েছে। একটা রাস্তা আছে ওপাশে। সামিয়ানার ভেতর দিয়ে গেছে ওটা।
কিন্তু কাজটা অত সহজে করা সম্ভব হবে না।
উপর থেকে ধাতব পাত নেমে এসে ওই দিকের পথ বন্ধ করে দিচ্ছে এখন, মনে হলো ওদের পরিকল্পনার কথা কেউ শুনে ফেলেছে। স্বয়ংক্রিয় লকডাউন সিস্টেম।
তাড়াতাড়ি! গ্রে তাগাদা দিলো।
ধাতব শাটার খুব দ্রুত নেমে আসছে। চারভাগের তিনভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে।
মনককে পেছনে রেখে গ্রে দৌড়ের গতি বাড়াল। ছুটতে ছুটতে একটা চেয়ার নিয়ে সেটা ছুঁড়ে দিল ও। মসৃণ মেঝের ওপর দিয়ে ছুটে গেল ওটা। চেয়ারের পেছন পেছন গ্রে-ও ছুটল। ধাতব শাটারের গতিপথে বাধা হয়ে দাঁড়াল কাঠের চেয়ার। নিচে নামতে পারছে না। দরজার ওখানে একটা লালবাতি জ্বলে উঠল। ক্রটির ইঙ্গিত। গ্রে নিশ্চিত এরকম একটা সতর্কীকরণ বাতি ভবনের মূল সিকিউরিটি জোনেও জ্বলে উঠেছে।
শাটারের কাছে পৌঁছুতেই কাঠের চেয়ারের পায়া ধাতব চাপের কাছে হার মেনে ভেঙ্গে যেতে শুরু করল…!
মনক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে, ওর হাত দুটো এখনও পিঠমোড়া করে বাঁধা। গ্রে শাটারের ওপরে থাকা দরজা খোলার জন্য নব ঘুরাল।
লকড।
খুলছে না।
ধুর!
কাঠের চেয়ারের আরও কিছু অংশ ভেঙে গেল এবার। ওদের পেছন থেকে এক ঝাঁক বুটের এগিয়ে আসার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠে আসছে বুটগুলো। হাঁক ছেড়ে নির্দেশ দিচ্ছে কেউ কেউ।
ঘুরল গ্রে। আমাকে ধরো! মনককে বলল ও। নবে কাজ হয়নি, লাখি মারতে হবে। মনকের কাঁধের ওপর ঝুঁকে সুবিধামতো জায়গা করে নিয়ে গ্রে দরজায় কষে লাখি হাঁকার জন্য প্রস্তুত এমন সময় দরজা সুন্দর করে খুলে গেল। খাকি পোশাক পরিহিত একজোড়া পা দেখা যাচ্ছে ওপাশে। উপরে থাকা কোনো গার্ড নিশ্চয়ই। শাটারের ত্রুটি দেখতে পেয়ে তদন্ত করতে এসেছে।
লোকটার পায়ের হাড়ের সংযোগস্থল বরাবর লক্ষ্য করে লাথি মারল গ্রে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটার নিচ থেকে তার পা সরে গেল। শাটারের সাথে মাথা ঠুকে গিয়ে কাঠের তক্তার ওপর আছড়ে পড়ল গার্ড। শাটারের নিচ দিয়ে বের হয়ে গ্রে পা দিয়ে লোকটাকে উল্টে দিল। গার্ড একটা লাথি খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে।
গ্রের পথ অনুসরণ করল মনক, তবে শাটারের নিচ দিয়ে বের হওয়ার আগে লাথি দিয়ে চেয়ারটাকে সরিয়ে দিতে ভুলল না। বাধামুক্ত হয়েই শাটার আপনগতিতে নিচে নামতে শুরু করল। বন্ধ হয়ে গেল পথ।
গার্ডের কাছে থাকা অস্ত্রগুলো গ্রে এক এক করে নিয়ে নিল। ছুরি দিয়ে মনকের হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে HK Mark 23 সেমি অটোমেটিক পিস্তল ধরিয়ে দিল মনকের হাতে। নিজের কাছে রাইফেল রাখল। সামিয়ানা ব্রিজের ওপর দিয়ে এগিয়ে প্রথম সংযোগস্থলে থামল ওরা। ব্রিজ জঙ্গলের কাছে পৌঁছুতেই রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। দুজন দুদিকে তাকাল। যতদূর চোখ যায় অল ক্লিয়ার। বিশেষ কিছু নেই।
আমাদের আলাদা হয়ে যেতে হবে, বলল গ্রে। নইলে সফল হবার সম্ভাবনা কম। সাহায্য লাগবে আমাদের। একটা ফোন যোগাড় করে লোগানকে ফোন করতে হবে।
আর তুমি কী করবে?
গ্রে জবাব দিল। ওর কাছে জবাব নেই।
গ্রে… ফিওনা হয়তো এতক্ষণে মারা গেছে।
আমরা না জেনে সেটা বলতে পারি না।
গ্রের চেহারার দিকে তাকাল মনক। কম্পিউটার মনিটরে সেই দানবটার ছবি দেখেছে ও। মনক জানে গ্রের আর কোনো উপায় নেই।
মাথা নাড়ল ও।
আর কোনো কথা না বলে দুজন দুটো ভিন্ন দিকে রওনা হয়ে গেল।
.
সকাল ৬টা ৩৪ মিনিট।
বিপরীত দিকের একটা গাছ বেয়ে উপরে থাকা হাঁটার রাস্তায় উঠে এলো খামিশি। সাবধানে সন্তর্পণে নড়াচড়া করছে।
নিচে, এখনও উকুফা গাছটির চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফাঁদে পড়া শিকারকে পাহারা দিচ্ছে ওটা। একটু আগে উচ্চ শব্দে কিছু একটা বিস্ফোরিত হওয়ায় উকুফা ভড়কে গেছে। গাছে উঠছিল ওটা ভড়কে গিয়ে পড়ে গেছে গাছ থেকে। সাবধান ও সতর্ক হয়ে গাছের চারদিকে হাঁটছে ওটা। কান খাড়া করে রেখেছে। অ্যালার্মের আওয়াজ ভেসে আসছে মূল ভবন থেকে।
এই আকস্মিক হৈচৈ খামিশিকেও দুশ্চিন্তায় ফেলে দিলো।
তাউ আর নজঙ্গো কী ধরা পড়ে গেছে। কেউ দেখে ফেলেছে ওদের?
নাকি এস্টেটের বাইরের মাঠে ওদের ছদ্মবেশী বেজ ক্যাম্প কারও চোখে পড়েছে? জুলু শিকারিদের মতো করে ওরা ওদের ক্যাম্প সাজিয়েছিল। কেউ কী বুঝতে পেরেছে ওটা কোনো সাধারণ জুলু ক্যাম্প নয়?
অ্যালার্ম যে-কারণেই বেজে থাকুক না কেন, শব্দের দানবীয় হায়না… উকুফা… এখন আরও সতর্ক ও সাবধান হয়ে গেছে। ওটার ভড়কে যাওয়ার সুযোগে উপরে থাকা ব্রিজে উঠে এসেছে খামিশি। ব্রিজের কাঠের তক্তার ওপর গড়িয়ে শুয়ে পড়ল ও, রাইফেলটাকে সামনে আনলো। উদ্বেগ ওকে সতর্ক থাকতে সাহায্য করছে। কীভাবে যেন এখন আর ভয় পাচ্ছে না ও। খামিশি দানবটির আস্তে আস্তে হাঁটার ভঙ্গি, চাপা গর্জন আর একটু আওয়াজ হলেই ভড়কে গিয়ে হাঁক ছাড়া… এসব কিছু লক্ষ করল।
সাধারণ হায়নাদের স্বভাব এগুলো।
আকারে দানবের মতো হলেও এটা পৌরাণিক কিংবা অতিপ্রাকৃত কোনো দানব নয়।
একটু সাহস পেল খামিশি।
খামিশি জলদি ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে ছেলেটার গাছের কাছে এলো। নিজের প্যাক থেকে এক গাছা দড়ি বের করল ও।
ব্রিজের হাঁটার রাস্তার পাশে স্টিলের ক্যাবল দেয়া। খামিশি ক্যাবলের ওপর দিয়ে ঝুঁকে ছেলেটাকে দেখে নিলো। শিস দিল ও। শব্দ শুনেও ছেলেটার দৃষ্টি নিচের দিক থেকে সরল। কিন্তু পরমুহূর্তেই সম্বিত ফিরে পেয়ে উপরে তাকাল সে। খামিশিকে দেখতে পেয়েছে।
আমি তোমাকে এখান থেকে বের করব, নিচু স্বরে ইংরেজিতে বলল খামিশি। আশা করল, ছেলেটা ওর ভাষা বুঝতে পেরেছে।
তবে ওর কথা শুধু ছেলেটা-ই নয় আরেকজনও শুনতে পেয়েছে।
ব্রিজের দিকে তাকাল উকুফা। ওটার টকটকে লাল চোখ দুটো খামিশিকে দেখছে। ব্রিজের ওপর খামিশিকে দেখতে দেখতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল ওটার। খামিশি টের পেল দানবটা কিছু একটা হিসেব করছে। এই দানবটাই কী মারসিয়াকে আক্রমণ করেছিল?
সেটা জানার কোনো প্রয়োজন নেই খামিশির। তারচেয়ে বরং ওটার দাঁত বের করা বিদঘুঁটে হাসিমাখা মুখের ওপর ডাবল ব্যারেল রাইফেলের গুলি খুঁজে দিতে পারলে ভাল হবে। কিন্তু বড় বোরের রাইফেল থেকে অনেক আওয়াজ হয়। এমনিতেই এস্টেটের সবাই এখন সতর্ক অবস্থায় আছে। তার ওপর এখন রাইফেল থেকে গুলি ছুঁড়লে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। তাই খামিশি পায়ের কাছে রাইফেল রেখে দিলো। দুই হাত আর কাধকে এখন কাজে লাগাতে হবে।
এই ছেলে! বলল খামিশি। আমি তোমার দিকে রশি ছুঁড়ে দেব। রশিটাকে তুমি কোমরে জড়িয়ে নিয়ে। বলতে বলতে ইশারা করেও দেখিয়ে দিলো ও। তারপর আমি তোমাকে টেনে তুলব।
ছেলেটা বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল। ওর চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেছে। কান্না আর ভয়ের কারণে মুখ ফুলে গেছে বেচারার। খামিশি সামনে ঝুঁকে ছেলেটার দিকে রশি ছুঁড়ে দিলো। ঘন পাতায় বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ফলে রশিটা ছেলের কাছে পৌঁছুতে পারল না। ছেলেটার মাথার ওপরে থাকা একটা ডালে আঁটকে রইল।
তোমাকে ওপরের ডালে উঠতে হবে
ছেলেটাকে আর বাড়তি কোনো তাগাদা দেয়ার প্রয়োজন নেই। এই বিপদ থেকে পালানোর উপায় পেয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সে। হ্যাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠল উপরের ডালে। রশিকে ডাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের কোমরে জড়িয়ে নিলো। বেশ দক্ষতার সাথে কাজটা করল সে। ভাল।
ব্রিজের একটা স্টিলের ক্যাবলের পোলে রশিটা প্যাচিয়ে নিলো খামিশি। তোমাকে। টেনে তুলতে যাচ্ছি। তোমাকে কিছুক্ষণ ঝুলতে হবে!
তাড়াতাড়ি! খুব তীক্ষ্ণস্বরে ও চিৎকার করে বলল ছেলেটাকে।
খামিশি খেয়াল করল উকুফা ছেলেটার এই নতুন অবস্থান খুব ভাল করে দেখছে। মনে হচ্ছে দানবটা হলো বিড়াল আর ছেলেটা হলো ইঁদুর! ইঁদুরের পেছনে বিড়াল লেগেছে! থাবার নখগুলোকে কাজে লাগিয়ে গাছে উঠতে শুরু করল ওটা।
আর কোনো সময় নষ্ট না করে খামিশি রশি টানতে শুরু করল। রশি টানতে গিয়ে টের পেল ছেলেটার ওজন নেহাত কম নয়। একটু টানার পর হাতে রশি রেখে নিচের দিকে তাকাল ও। ছেলেটা পেণ্ডুলামের মতো এদিক-ওদিক দুলছে।
উকুফাও দুলছে। ছেলেটার সাথে সাথে ওটারও দৃষ্টি এদিক-ওদিক সরে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে গাছে উঠছে ওটা। খামিশি বুঝতে পারল, গাছ থেকে লাফ দিয়ে ছেলেটাকে ধরার মতলব করেছে উকুফা।
খামিশি দ্রুত রশি টানতে শুরু করল।
Wie zijn u? হঠাৎ একটা কণ্ঠ ঘেউ করে উঠল খামিশির পেছন থেকে।
চমকে উঠে আর একটু হলে রশিটা খামিশি ছেড়েই দিচ্ছিল! ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ও।
একজন লম্বা নারী ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, পরনের পোশাক কালো। নারী হলেও তার চোখ দেখে মনে হলো এর ভেতরে কোনো দয়া-মায়া নেই। চুলগুলো সাদা তবে একদম কদমছাট দেয়া। ওয়ালেনবার্গ পরিবারের সন্তান। এই সেকশনে হাঁটতে বেরিয়েই হয়তো খামিশিকে দেখে ফেলেছে সে। তার হাতে ইতোমধ্যে একটা ছুরি দেখা যাচ্ছে। খামিশির ভয় হলো, হাত থেকে রশিটা যেন ছুটে না যায়।
অবস্থা ভাল নয়।
নিচ থেকে চিৎকার করে উঠল ছেলেটা।
খামিশি ও নারী দুজনই নিচ দিকে তাকাল।
ছেলেটা প্রথমে যে ডালে ছিল উকুফা এখন সেই ডালে পৌঁছে গেছে। এবার লাফ দেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে ওটা। খামিশির পেছনে থাকা নারী হেসে উঠল। নিচ থেকে দানবটাও কেমন এক আওয়াজ করল। দুটো আওয়াজ প্রায় একই রকম। ছুরি হাতে নিয়ে খামিশির পিঠের দিকে এগোচ্ছে কদমছাটধারী।
ছেলে ও খামিশি দুজনই এবার ফাঁদে পড়েছে।
.
সকাল ৬টা ৩৮ মিনিট।
রাস্তার সংযোগস্থলে এসে হাঁটু গেড়ে বসল গ্রে। ব্রিজের উপরে হাঁটার রাস্তা তিনভাগে ভাগ হয়ে গেছে। বাম পাশের রাস্তা ফিরে গেছে মূল ভবনে। মাঝেরটা জঙ্গলের কোল ঘেঁষে এগিয়েছে বাগানের দিকে। ডান পাশের রাস্তা সোজা চলে গেছে জঙ্গলের গভীরে।
এবার কোনদিকে এগোনো যায়?
গ্রে নিচু হয়ে বসল। এলসিডি মনিটরে জঙ্গলের ভেতরে সূর্যের আলো আর গাছপালার মিশেলে যে ছায়া দেখেছিল সেটার সাথে জঙ্গলের বর্তমান অবস্থার তুলনা করল ও। ছায়ার দৈর্ঘ্য আর দিক ভাল করে হিসেব করলে ফিওনাকে ঠিক কোথায় আটকে রাখা হয়েছে সেটার হদিস পাওয়া সম্ভব।
অনেক পায়ের চাপে হাঁটার রাস্তা খানিকটা দুলে উঠল।
আরও গার্ড আসছে।
ইতোমধ্যে দুটো দলের সাথে ওর মোকাবেলা হয়ে গেছে।
কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে ব্রিজের কিনারায় চলে গেল গ্রে। নিজের হাত ও ব্রিজের ক্যাবলের সাহায্যে পাশে থাকা গাছের ঘন পাতাঅলা ডালে আশ্রয় নিলো। কিছুক্ষণ পর তিনজন গার্ডকে দেখা গেল, হাঁটার রাস্তা দুলিয়ে এগোচ্ছে ওরা। গাছের সাথে নিজেকে দৃঢ়ভাবে লেপ্টে রাখল গ্রে, পারলে গাছের ভেতরে সেঁধিয়ে যায় এমন অবস্থা!
গার্ডরা চলে যাওয়ার পর গ্রে আবার ব্রিজে উঠল। ওঠার সময় হাতে ধরে থাকা ক্যাবলে এক ধরনের ছন্দময় কাপুনি অনুভব করল ও। আরও গার্ড আসছে নাকি?
কাঠের তক্তার ওপর উপুড় হয়ে ক্যাবলে কান পাতল গ্রে। ইন্ডিয়ান ট্র্যাকাররা এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে। স্পষ্ট ছন্দময় কাঁপুনি শোনা যাচ্ছে, পরিষ্কার আওয়াজ অনেকটা গিটারের ছিঁড়ে যাওয়া তারের মতো। ৩টা দ্রুত টুং-টাং, ৩ টা ধীরে, আবার ৩ টা দ্রুত… এভাবে চলছে।
মোর্স কোড।
S.0.S.
কেউ ক্যাবলের মাধ্যমে সিগন্যাল দিচ্ছে।
নিচু হয়ে অন্য পাশের ক্যাবল ধরে অনুভব করল গ্রে। নাহ, শুধু একটা ক্যাবলই কাঁপছে। সেই ক্যাবল ধরে এগোলে ডান পাশের রাস্তা নিতে হবে। সোজা জঙ্গলের ভেতরে চলে গেছে রাস্তাটা।
তাহলে এটা কী…?
আর কোনো সূত্র না পেয়েও গ্রে ডানদিকের পথ ধরল। রাস্তার একপাশ দিয়ে এগোল ও, চেষ্টা করল ওর হাঁটার ফলে ব্রিজ যাতে না দোলে কিংবা কোনো শব্দ না হয়। পথ ধরে এগোতে এগোতে আরও অনেক পার্শ্বরাস্তা পেল গ্রে। প্রতি রাস্তার সংযোগস্থলে পৌঁছে ক্যাবলের কাঁপুনি পরীক্ষা করে সঠিক পথ নিলো।
গ্রে রাস্তার দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে এগোচ্ছিল, বড় একটা তালপাতার নিচ দিয়ে এগোনোর সময় হঠাৎ খেয়াল করে দেখল ওর কাছ থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে একটা গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। বাদামি চুল, বয়স ২৫ হবে হয়তো, হিটলারি করার জন্য একদম উপযুক্ত বয়স। ক্যাবলের রেলিঙের ওপর ঝুঁকে একদম গ্রের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তালপাতা নড়তে দেখে অস্ত্র উঠে এসেছে তার হাতে।
গ্রের হাতে নিজের রাইফেল নেয়ার মতো যথেষ্ট সময় নেই। সামনে এগোতে থাকা অবস্থাতেই পাশের ক্যাবলের দিকে ঝাঁপ দিল ও। না, ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ার কোনো ইচ্ছেই ওর নেই। কারণ এখান থেকে লাফিয়ে নিচে পড়লেও এত অল্প রেঞ্জে গার্ডের বুলেট লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হবে না। ক্যাবলের ওপর নিজের শরীরের ওজন চাপিয়ে দিয়ে ঝাঁকি দিল গ্রে।
গার্ড নিজে ক্যাবলের উপর শরীরের ভার দিয়ে থাকায় গ্রের দেয়া ঝাঁকিতে দুলে উঠল সে। ঝাঁকিতে এলোমেলো হয়ে গেল অস্ত্রের টার্গেট। দুই বার পা ফেলে গার্ড আর নিজের মধ্যকার ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলল গ্রে। গার্ডের কাছে পৌঁছুতে পৌঁছুতে ওর হাতে ছোরা চলে এসেছে।
গার্ডের এই ভারসাম্যহীনতার সুযোগ নিয়ে কণ্ঠনালীতে ছোরা ঢুকিয়ে দিয়ে গ্রে তাকে চিরতরে চুপ করিয়ে দিল। ছোরাটা একদম কণ্ঠের স্বরযন্ত্রে আঘাত হেনেছে। রক্তবাহিত ধমনী দিয়ে রক্ত ছিটকে বেরোল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গার্ডের প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবে। গার্ডের শরীর ব্রিজের কাঠের তক্তার ওপর ঢলে পড়ার আগেই ধরে ফেলল গ্রে। খুন করেও গ্রের ভেতরে কোনো অনুশোচনাবোধ হলো না। রায়ানকে খাঁচা থেকে ফেলে দেয়ার সময় গার্ডরা কীভাবে হেসেছিল সেটা মনে পড়ে গেল ওর। এভাবে কতজনকে মেরেছে ওরা? গার্ডের শরীর তুলে নিয়ে ব্রিজের বাইরে ছুঁড়ে দিল গ্রে। ঘন ঝোঁপের ওপর গিয়ে আছড়ে পড়ল গার্ডের লাশ।
নিচু হয়ে কান পাতল গ্রে। গার্ডের এই আছড়ে পড়ার শব্দ কেউ কি শুনে ফেলেছে?
বাম দিক থেকে হঠাৎ করে এক নারী কন্ঠের চিৎকার শোনা গেল। ইংরেজিতে চিৎকার করছে সে। বারে লাথি মারা বন্ধ কর! নইলে কিন্তু তোকে ফেলে দেব।
কণ্ঠটা গ্রের পরিচিত। ইসকি। ইসাকের যমজ বোন।
তারচেয়েও পরিচিত কণ্ঠস্বর ইসকির কথার জবাব দিলো। দূরে গিয়ে মর,, মাগী!
ফিওনা।
মেয়েটা এখনও বেঁচে আছে।
বিপদের মধ্যেও স্বস্তিতে গ্রে হেসে ফেলল।
ধীরে ধীরে রাস্তার শেষপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছুল গ্রে। জঙ্গলের ভেতরে একটা ফাঁকা জায়গায় বৃত্ত রচনা করে রাস্তা শেষ হয়েছে। ব্রিজ থেকে ক্যাবলের সাহায্যে খাঁচাকে ঝুলানো হয়েছে। পা দিয়ে খাঁচার বারে লাথি দিচ্ছে ফিওনা। ৩টা দ্রুত, ৩টা ধীরে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ দেখা যাচ্ছে ওর চেহারায়। এখন নিজের পায়ের নিচে কাঁপুনি অনুভব করতে পারছে গ্রে। ব্রিজ থেকে খাঁচাকে যে ক্যাবলের সাহায্যে ঝোলানো হয়েছে সেই ক্যাবলের মাধ্যমেই কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ছে।
চালু মেয়ে।
মূল ভবনের অ্যালার্ম নিশ্চয়ই মেয়েটা শুনতে পেয়েছিল। হয়তো ধরে নিয়েছিল এভাবে লাথি মেরে গ্রেকে সিগন্যাল দিলে কাজ হবে। আর যদি তা না হয়… তাহলে এটা স্রেফ ওর পাগলামো{ মোর্স কোডের প্যাটার্নটা হয়তো নিতান্তই কাকতালীয়।
ঘড়ির কাঁটার ২, ৩ ও ৯ টায়; অর্থাৎ ভিন্ন তিনটি পজিশনে তিনজন গার্ডকে আবিষ্কার করল গ্রে। ইসকি সাদা-কালো পোশাক পরে ১২টার অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার দুই হাত রেলিঙের ওপর রাখা, দৃষ্টি–নিচের খাঁচায় থাকা ফিওনার ওপর।
তোর হাঁটুর ভেতরে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দিলে তখন এমনিতেই থেমে যাবি, পাশে থাকা পিস্তলের ওপর হাত রেখে বলল সে।
লাথি মারার মাঝপথে ফিওনা থেমে গেল। কী যেন বলল বিড়বিড় করে। পা চালানো থামিয়ে দিলো বেচারি।
গ্রে পরিস্থিতি হিসেব করতে শুরু করল। ওর কাছে একটা রাইফেল আছে। ওদিকে বিপক্ষে রয়েছে তিনজন গার্ড, প্রত্যেকে সশস্ত্র। এমনকি ইসকির কাছেও একটা পিস্তল আছে। পরিস্থিতি সুবিধের নয়।
কোথা থেকে যেন যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
নিজের রেডিও তুলে মুখের কাছে ধরল ইসকি। la?
আধ-মিনিট ধরে ওপাশের বক্তব্য শোনার পর একটা প্রশ্ন করল ও। কিন্তু গ্রে প্রশ্নটা বুঝে উঠতে পারল না। তারপর রেডিও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
নতুন নির্দেশ পাওয়া গেছে! রেডিও নামিয়ে গার্ডদেরকে ডাচ ভাষায় নির্দেশ দিলো সে। আমরা মেয়েটাকে এক্ষুনি মেরে ফেলব!
.
সকাল ৬টা ৪০ মিনিট।
উত্তেজনার প্রকাশ স্বরূপ গর্জন ছেড়ে ঝুলন্ত ছেলেটার দিকে লাফ দিলো উকুফা। ওদিকে খামিশি টের পেল ওর পেছন দিক থেকে মহিলাটি এগিয়ে আসছে। দুই হাতে রশি ধরে থাকায় ওর পক্ষে কোনো অস্ত্র বের করা সম্ভব নয়।
কে তুমি? আবার প্রশ্ন করল সে, হাতে উদ্যতভঙ্গিতে ছুরি ধরা আছে।
খামিশির পক্ষে একটা কাজই করা সম্ভব ছিল, সেটাই করল ও।
হাঁটু ভাঁজ করে রেলিং ক্যাবলের ওপর দিয়ে লাফ দিলো খামিশি। লাফ দিয়ে নামার সময় হাতের রশিকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছিল ও। মাথার উপরে থাকা স্টিলের পপালের ওপর দিয়ে রশি ঘষা খাওয়ার সময় শিস বাজার মতো আওয়াজ শোনা গেল। নিচের দিকে পড়তে পড়তে ছেলেটার দিকে তাকাল খামিশি। ছেলেটা সোজা আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে, ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠে বিকট চিৎকার দিয়েছে বেচারা।
উড়ন্ত শিকারের দিকে ঝাঁপ দিলে উকুফা। কিন্তু খামিশির হেঁচকা লাফ ছেলেটাকে ব্রিজের রাস্তার ওপর নিয়ে আছড়ে ফেলে দিয়েছে।
এদিকে হাতে রশিতে হঠাৎ করে টান লাগায় খামিশির মুঠোর বাঁধন ভেঙ্গে গেল।
ঘাসের ওপর পিঠ দিয়ে পড়ল ও। নিচে ঝুঁকে খামিশির দিকে তাকাল মহিলা, তার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
খামিশির কাছ থেকে কয়েক মিটার দূরে বড় কিছু একটা আছড়ে পড়েছে।
উঠে বসল খামিশি।
উকুফা-ও উঠে দাঁড়িয়েছে, রাশি রাশি লাল ছিটল ওটার মুখ থেকে, ভয়ঙ্করভাবে গর্জন করছে।
সামনে থাকা একমাত্র শিকারের দিকে লাল চোখ মেলে তাকিয়ে আছে ওটা।
খামিশি।
ওর হাতে এখন কিছুই নেই। রাইফেলটা ব্রিজের কাঠের তক্তার ওপর রয়ে গেছে। রক্তের নেশা ও রাগে হুঙ্কার ছাড়ল দানবটা। ঝাঁপিয়ে পড়ল খামিশির ওপর। ওর গলার রগ ছিঁড়ে নেবে।
শুয়ে পড়ল খামিশি, সাথে থাকা একমাত্র অস্ত্রকে বের করল। জুলু অ্যাসেগাই। ছোট আকৃতির এই বর্শা ওর উরুতে বাধা ছিল। উকুফা ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তেই বর্শার ফলাকে কাজে লাগাল খামিশি। এই অস্ত্র কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটা ওর বাবা ওকে শিখিয়েছিলেন। জুলু সম্প্রদায়ের ছেলেরা সবাই এই বর্শা চালাতে জানে। বাবার কাছ থেকে শেখা বিদ্যাকে খামিশি আজ জায়গামতো কাজে লাগাল। বর্শার ফলাটুকু উকুফার পাজরের ভেতরে সেঁধিয়ে দিলো ও। এটা আর কোনো রূপকথা নয়, একদম বাস্তবেই উকুফা ঢলে পড়ল খামিশির ওপর।
আর্তনাদ ছাড়ল উকুফা। ব্যথা আর যন্ত্রণায় সরে গেল খামিশির ওপর থেকে। একটা গড়ান দিয়ে খামিশি উঠে পড়ল, ওর কাছে এখন আর কোনো অস্ত্র নেই। ঘাসের ওপর পড়ে আছে উকুফা, বর্শার ফলা সেঁধিয়ে আছে ওটার পাজরের ভেতর। শেষবারের মতো গর্জন করে শরীর ঝাঁকি দিলো ওটা, তারপর সব শেষ।
মারা গেছে।
রাগে চিৎকার করে উঠল কে যেন, উপরে তাকাল খামিশি।
ব্রিজের উপরে থাকা মহিলাটা খামিশির রাইফেল তুলে নিয়ে ওর দিকে তাক করে রেখেছে। ফায়ার করতেই গ্রেনেড ফাটার মতো আওয়াজ হলো। খামিশির পায়ের কাছের ঝোপে গিয়ে মুখ খুঁজল বুলেট। পিছু হটল খামিশি। ওর সাথে তাল মিলিয়ে মহিলা তার রাইফেলের টার্গেটে পরিবর্তন আনল। এবার গুলি ছুঁড়লে নির্ঘাত লক্ষ্যভেদ করে ছাড়বে।
ফায়ার করার আওয়াজ হলো, তবে শব্দটা আগের মতো বিকট নয়, বেশ তীক্ষ্ণ।
গড়িয়ে পড়ল খামিশি… কিন্তু নিজেকে অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কার করল সে।
উপরে তাকিয়ে দেখল ক্যাবলের ওপর দিয়ে মহিলা নিচের দিকে পড়ি পড়ি করছে, রক্তে লাল হয়ে গেছে তার বুক।
ব্রিজের রাস্তায় নতুন একজনের উদয় হলো।
পেশিবহুল শরীর, মাথাটা চকচকে করে কামানো। তার এক হাতে পিস্তল ধরা রয়েছে, অন্যহাতটির অংশবিশেষ দিয়ে পিস্তলকে স্থির করে এগোচ্ছে সে। কাছে এসে ছেলেটাকে দেখল সে।
রায়ান…
স্বস্তিতে ফুঁপিয়ে উঠল ছেলেটা। আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করুন।
প্ল্যান তো সেরকমই… হঠাৎ খামিশিকে দেখল আগন্তক। কিন্তু কথা হলো, ওই লোক যদি এখান থেকে বের হওয়ার পথ জানে তাহলে সুবিধে হবে। আমি তো রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছি!
.
সকাল ৬টা ৪৪ মিনিট।
দুটো গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ জঙ্গলে প্রতিধ্বনিত হলো।
শব্দে চমকে উঠে পাখা মেলে উড়ে গেল এক ঝাক টিয়া পাখি।
নিচ হলো গ্রে।
মনক কী ধরা পড়ে গেছে?
ইসকিও হয়তো সে-রকম কিছু ভেবেছে। শব্দ দুটো যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে তাকাল ও। গার্ডদের উদ্দেশ্য করে বলল, দেখ তো কী হয়েছে!
আবার রেডিও তুলে নিল ইসকি।
বৃত্তাকৃতির ঝুলন্ত রাস্তার ওপর দিয়ে রাইফেল হাতে নড়াচড়া শুরু করল গার্ডরা। গ্রের দিকে আসছে সবাই। গার্ড থেকে বাঁচতে শুয়ে পড়ল গ্রে, বুকে নিজের রাইফেলটাকে জড়িয়ে নিলো। আগের বারের মতো এবারো কাঠের তক্তা ধরে ঝুলে পড়ল ও। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবচেয়ে কাছের গার্ড উদয় হবে। কিন্তু এবার ভারসাম্যে গোলমাল হয়ে যাওয়ায় ওর শরীর বেশি দুলে উঠল। রাইফেল ফসকে গেল কাঁধ থেকে। নিচে পড়ে যাচ্ছে ওটা।
এক হাতে নিজেকে ঝুলিয়ে রেখে আরেক হাত বাড়িয়ে এক আঙুল দিয়ে কোনমতো রাইফেলের স্ট্রাপটা ধরল গ্রে। রাইফেলের পতন ঠেকাতে পেরে ও চুপচাপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
হঠাৎ ওর মাথার উপরে শব্দ শোনা গেল। বুটের আওয়াজ। কাঠের তক্তা দুলছে এখন।
দুলুনিতে গ্রের আঙুল থেকে রাইফেলের স্ট্রাপটা ফসকে গেল। মাধ্যাকর্ষণ ওটাকে টেনে নিয়ে ফেলল নিচের ঝোঁপের ভেতর। এবার দুই হাত দিয়ে নিজেকে শক্ত করে ঝুলিয়ে রাখল গ্রে। ভাগ্য ভাল, রাইফেল নিচে আছড়ে পড়ে তেমন বড় কোনো শব্দ করেনি।
গার্ডদের বুটের আওয়াজ প্রতিধ্বনি তুলতে তুলতে দূরে চলে গেছে।
রেডিওতে কথা বলছি ইসকি।
এবার?
ইসকির পিস্তলের বিপক্ষে ওর কাছে একটা ছুরি আছে। প্রয়োজন পড়লে ইসকি গুলি ছুঁড়তে একটুও দ্বিধা করবে না আর তার হাতের নিশানা নিয়েও গ্রের মনে কোনো সন্দেহ নেই।
গ্রের হাতে সম্বল একটাই, সেটা হলো ওকে চমকে দিতে হবে।
তবুও চমকে দিয়ে কতটা সফলতা পাওয়া যাবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে।
কাঠের তক্তা ধরে ঝুলে ঝুলে এগোল গ্রে। বৃত্তাকার অংশে পৌঁছে গেল। একটু বাইরের অংশ ধরে এগোচ্ছে ও, যাতে ইসকির চোখে না পড়ে যায়। সাবধানতার সাথে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে গ্রে। অতিরিক্ত দুলুনি ইসকিকে সতর্ক করে দিতে পারে। একটু পর পর বাতাস এসে ব্রিজকে দুলিয়ে যাচ্ছে, সেই দুলুনির সাথে মিল রেখে গ্রে এগোল।
কিন্তু এর এই আগমন লুকোনো সম্ভব হলো না।
ফিওনা খাঁচার ভেতরে নিচু হয়ে বসেছে। ইসকি আর ওর মধ্যে যত বেশি সম্ভব বার রাখতে চাইছে সে। একটু আগে ইসকি ডাচ ভাষায় যে নির্দেশ দিয়েছিল সেটার অর্থ ফিওনা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। আমরা মেয়েটাকে এক্ষুনি মেরে ফেলব! তবে গুলির শব্দ হওয়ায় আপাতত সেদিকে মনোযোগ সরে গেছে ইসকির। তবে ওটা তো সাময়িক, একসময় ঠিকই ফিওনার দিকে মনোযোগ সে দেবেই।
খাঁচায় নিচু অবস্থানে থেকে গ্রেকে দেখতে পেল ফিওনা। সাদা রঙের জাম্পস্যুট পরিহিত গরিলা ব্রিজের হাঁটার রাস্তার তক্তা ধরে ঝুলে সামনে এগিয়ে আসছে। গাছের পাতার জন্য তার শরীরের অর্ধেক দেখা যাচ্ছে না। বিস্ময়ে চমকে উঠল ফিওনা। আর একটু হলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, নিজেকে জোর করে বসিয়ে রাখল। চোখ গরিলাটাকে অনুসরণ করতে করতে দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল।
ফিওনা যতই সাহসী হোক কিংবা সাহস দেখাক গ্ৰে দেখল এখন ওর চেহারায় ভয় ফুটে উঠেছে। খাঁচার ভেতরে আরও বেশি ছোট দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। দুহাত দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে ফিওনা। ফুটপাতে ঠোকর খেয়ে বড় হওয়া এই মেয়েটিও এখন ভয়ে সেটিয়ে গেছে।
ওই অবস্থায় থেকে নিচের দিকে নির্দেশ করল ফিওনা, তারপর মাথা নেড়ে না বোধক ভঙ্গি করল। ওর চোখ দুটো ভয়ে বড় বড় হয়ে গেছে। গ্রেকে সতর্ক করার চেষ্টা করছে ও।
নিচে পড়লে খবর আছে।
গ্রে নিচের ঘন ঘাস আর ঝোঁপের ওপর দিয়ে চোখ বুলাল। পুরু ছায়া ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। তবুও ফিওনার সতর্কতাকে ও গুরুত্বের সাথে নিলো।
নিচে পড়া যাবে না।
কতদূর চলে এসেছে হিসেব কষল গ্রে। বৃত্তাকার পথে ঘড়ির কাঁটার হিসেবে আটটা বাজলে ঘন্টার কাটা যেখানে থাকবে ওর অবস্থান এখন সেখানে। ইসকির অবস্থান বারোটায়। এখনও বেশ খানিকটা যেতে হবে ওকে। কিন্তু ওর হাত টনটন করছে, ব্যথা করছে আঙ্গুলগুলো। দ্রুত এগোতে হবে। বারবার থেমে গিয়ে শুরু করার ফলে ওর বেশি শক্তি অপচয় হচ্ছে। কিন্তু দ্রুত এগোতে গেলে ইসকির নজরে পড়ে যেতে হবে, সেটাও একটা সমস্যা।
ফিওনাও হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। সে আবার উঠে দাঁড়িয়ে বারে লাথি দিতে শুরু করল। ওর লাখির ধাক্কায় খাঁচা ঝনঝন করছে, দুলছে এদিক-ওদিক। খাঁচার দুলুনিতে ব্রিজও দুলে উঠল, সেই দুলুনির সুযোগ নিয়ে নিজের গতি বাড়িয়ে দিল গ্রে।
দুর্ভাগ্যবশত ফিওনার এই চেষ্টা ইসকির নজরে পড়ে গেল।
রেডিও মুখ থেকে নামিয়ে ফিওনাকে উদ্দেশ্য করে গলা ফাটাল ইসকি। তোর ফাজলামি অনেক সহ্য করেছি, শয়তান ছেমড়ি!
ফিওনাও নাছোড়বান্দা। বারে লাথি দিয়ে যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে।
গ্রে ঘড়ির কাঁটার নয়টার অবস্থানে পৌঁছে গেল।
ভেতরের রেলিঙের দিকে পা বাড়াল ইসকি, তার অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। কপাল ভাল, তার নজর পুরোপুরি ফিওনার দিকে। সোয়েটারের পকেট থেকে একটা ডিভাইস বের করল সে। দাঁত দিয়ে ওটার অ্যান্টিনা বের করল। ফিওনার দিকে তাক করে বলল, স্কাল্ড-এর সাথে দেখা করার সময় হয়েছে তোর।
একটা বাটন চাপল সে।
প্রায় গ্রের পায়ের নিচ থেকে কিছু একটা রাগ আর বেদনায় গর্জন করে উঠল। জঙ্গলের ভেতর থেকে হুমড়ি খেয়ে সামনে বেরোল ওটা। আরেকটা রূপান্তরিত হয়না। এটারও ওজন কম করে হলেও ৩০০ পাউন্ড। পুরোটাই পেশি আর দাঁতের প্যাকেজ। শরীর নিচু করে আক্রমণাত্মকভঙ্গিতে গর্জন ছাড়ল ওটা। ঠোঁট বাঁকিয়ে খেউ করে উঠল, কামড় বসাল বাতাসে। খামার কাছে গিয়ে গন্ধ শুঁকতে শুরু করল।
গ্ৰে বুঝতে পারল, এই দানব নিচ থেকে ওকে এতক্ষণ ধরে খেয়াল করছিল। এরপর কী হতে যাচ্ছে আন্দাজ করতে পারল গ্রে।
দ্রুত ঘড়ির দশটার অবস্থানে চলে এলো।
দানবটি বেরিয়ে এসে যে ভয় আর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে সেটা উপভোগ করতে করতে ফিওনাকে ডাকল ইসকি, স্কাল্ডের মগজের ভেতরে একটা চিপ বসানো আছে। ওটার মাধ্যমে রক্ততৃষ্ণা আর ক্ষুধা জাগিয়ে তোলা যায়। বুঝলি কিছু? আবার বাটন চাপল সে। আরেকবার গর্জন ছেড়ে স্কাল্ড খাঁচার দিকে লাফ দিল। কিন্তু লাফটা সফল হলো না। লাফের ব্যর্থতায় আরও বেশি খেপে গেল দানবটা।
আচ্ছা, তাহলে এভাবেই ওয়ালেনবার্গরা তাদের দানবগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।
রেডিও ইমপ্ল্যান্টস।
প্রকৃতির ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করায় ওটা।
এবার আমরা বেচারা স্কাল্ডের ক্ষুধা নিবারণ করার সুযোগ দেব, বলল ইসকি।
গ্রে সময়মতো পৌঁছুতে পারবে না। তারপরও হাল ছাড়ল না ও।
ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা।
প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে।
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে।
আরেকটা বাটন চাপল ইসকি। টং জাতীয় আওয়াজ শুনল গ্রে। ফিওনার খাঁচার নিচের অংশে থাকা ট্রাপডোরটা খুলে গেছে।
ওহ, না।
দুলুনির মাঝপথে গ্রে থেমে গেল। ও দেখল, ফিওনার নিচে থাকা ট্রাপভোর খুলে উন্মুক্ত হয়ে আছে। নিচে অপেক্ষারত দানবটার কাছে পড়তে যাচ্ছে মেয়েটা।
ফিওনার পর পর লাফ দেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল গ্রে। মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে।
কিন্তু ফিওনা চালু মেয়ে। সে রায়ানের অবস্থা দেখে শিক্ষা নিয়ে রেখেছিল। নিচে পড়তে পড়তে খাঁচার নিম্নাংশের বার ধরে ফেলল ও। ঝুলছে এখন। দানবটা ওর পা লক্ষ্য করে লাফ দিলো। চট করে নিজের পা দুটো গুটিয়ে নিলো ফিওনা।
স্কাল্ড আবারও ব্যর্থ, হতাশায় গর্জন ছাড়ল দানবটা।
ফিওনা বানরের মতো হাত পা ব্যবহার করে খাঁচার বাইরের অংশ বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল।
আনন্দে হেসে উঠল ইসকি! eer goed, meisje. ছেমড়ির দম আছে দেখছি! তোর জিনকে সংরক্ষণ করার কথা Grootvader-এর ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্কাল্ডকে সন্তুষ্ট করাটাই তোর কপালে লেখা আছে।
গ্রে দেখল আবার পিস্তল তুলছে ইসকি।
তার নিচ দিয়ে কাঠের তক্তা ধরে ঝুলে এগোল গ্রে।
এবার খেল খতম। ডাচ ভাষায় ইসকি বিড়বিড় করল।
কথা সত্য। আসলেই খেল খতম।
নিজের হাত দুটো ব্যবহার করে শরীরকে তুলে নিয়ে পা ছুড়ল গ্রে। জিমন্যাস্টের মতো সামনের দিক দিয়ে উঠে এলো ও। ইসকি রেলিঙে হেলান দিয়ে ফিওনার দিকে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল, গ্রের পায়ের গোড়ালি এসে সেঁধিয়ে গেল তার পেটের ভেতর।
ঠিক যে-মুহূর্তে গ্রের পা ইসকির পেটে আঘাত হানছে ঠিক সেই মুহূর্তে গুলিও বেরিয়ে গেছে পিস্তল থেকে।
লোহার সাথে সংঘর্ষের শব্দ পেল গ্রে।
গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।
গ্রের লাথি খেয়ে ইসকি কাঠের তক্তার ওপর ভূপাতিত হলো। হাতে ছুরি নিয়ে উঠে দাঁড়াল গ্রে। ওদিকে ইসকিও হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসেছে। ওদের দুজনের মাঝখানে পড়ে আছে পিস্তলটা।
পিস্তলের দখল নেয়ার জন্য হামলে পড়ল দুজন।
পেটে ওরকম একটা মোক্ষম লাথি খাওয়ার পরও ইসকি খুব দ্রুততার সাথে স্থান পরিবর্তন করল। তার হামলে পড়াটা অনেকটা ছোবল দেয়া সাপের মতো। গ্রের আগে পিস্তলের নাগাল পেল সে।
কিন্তু গ্রের হাতে আগে থেকেই একটা ছুরি আছে।
ইসকির কব্জির ভেতর দিয়ে ছুরির ফলা ঢুকিয়ে দিলো গ্রে। কাঠের তক্তার সাথে ইসকির হাত গেঁথে গেল। বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল সে, হাত থেকে পিস্তল ফেলে দিয়েছে। তার ওপর ঢলে পড়ার সময় ইসকির কব্জি গাঁথা অবস্থায় ঝাঁকি খেয়ে উঠল কাঠের তক্তা।
এই ঝাঁকির দুলুনির ফাঁকে তক্তা থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো ইসকি। অন্য হাতের উপর ভর দিয়ে গ্রের মাথা বরাবার লাথি হাঁকাল সে।
লাথি আসতে দেখে গ্রে নিজেকে পেছনে সরিয়ে নিচ্ছিল কিন্তু টাইমিঙে হেরফের হয়ে যাওয়া লাথিটা ওর কাঁধে এসে লাগল। লাথিটা এতটাই জোরালো যে মনে হলো কোনো স্পিডকার এসে ধাক্কা দিয়েছে। গড়ানি খেলো গ্রে। আঘাত ওর হাড় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সেরেছে, এই নারী তো অনেক শক্তিশালী।
গ্রে উঠে দাঁড়াবার আগেই ইসকি ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাতের কব্জিতে গেঁথে থাকা ছুরির ফলা দিয়ে গ্রের মুখে আঘাত করার চেষ্টা করছে। উদ্দেশ্য : গ্রের চোখ অন্ধ করে দেয়া। কোনোমতে গ্রে তার কনুইটা ধরল, ধরেই মুচড়ে দিল ও। দুজন একসাথে ব্রিজের কিনারার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
গ্রে থামল না।
দুজন একে অপরের সাথে লেপ্টে থাকা অবস্থায় ব্রিজ থেকে ছিটকে পড়ল।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাম হাঁটু একটা পোস্টের সাথে বাঁধিয়ে নিজের পতনরোধ করল গ্রে। আচমকা টান লেগে ওর শরীর ঝাঁকি খেল। পায়ের ওপর ভর করে ঝুলছে এখন। ইসকি ওর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে।
উল্টো হয়ে ঝুলে থাকা অবস্থায় গ্ৰে দেখল, কিছু ডালপালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে ইসকির শরীরটা বশ জোরেশোরে আছড়ে পড়ল নিচের ঘাসযুক্ত জমির ওপর।
নিজেকে ব্রিজের উপর তুলে নিলো গ্রে।
উপরে উঠে অবিশ্বাসের সাথে দেখল ইসকি নিজের পায়ের ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে সামলে নিতে একটু খোঁড়াল সে, পায়ের গোড়ালিটা মচকে গেছে।
গ্রের পাশে শব্দ হলো।
গ্রে আর ইসকির মারামারির সময়ে খাঁচার ক্যাবল বেয়ে উঠে এসে কাঠের তক্তার ওপর ফিওনা অবতরণ করেছে। গ্রের দিকে দ্রুত এগোল ও ইসকি বেচারির হাতের যেখানটা কেটে দিয়েছে রক্ত বেরোচ্ছে সেখান থেকে।
নিচে তাকাল গ্রে।
ইসকি উপরে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে খুনের নেশা।
কিন্তু নিচে মহিলা একা নয়।
পেছনে তারদিকে স্কাল্ড এগিয়ে আসছে। শরীর নিচু করে শিকার করার ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে দানবটা। এ যেন ডাঙ্গার হাঙর। রক্তের তৃষ্ণা পেয়ে বসেছে ওটাকে।
এবার বেশ হয়েছে, ভাবল গ্রে।
কিন্তু ইসকি তার সুস্থ হাতটা দানবটার দিকে বাড়িয়ে দিলো। থেমে গেল হায়নাটা। নাক বাড়িয়ে শুকল কী যেন। কাছে এসে ইসকির হাতের তালুতে এসে গাল ঘষল। মনে হলো ওটা কোনো পোষা বিড়াল। মনিবের কাছ থেকে আদর নিচ্ছে। নিচুস্বরে আওয়াজ করে বসে পড়ল দানবটা।
এরমধ্যে ইসকি কিন্তু একবার গ্রের দিক থেকে চোখ সরায়নি।
খুঁড়িয়ে সামনে এগোলো সে।
গ্রে নিচ দিকে তাকিয়ে আছে।
মহিলার পায়ের কাছে নিরীহভঙ্গিতে চুপচাপ পড়ে রয়েছে পিস্তলটা।
গ্রে উঠে দাঁড়াল। ফিওনার কাধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, দৌড়াও!
ফিওনার জন্য ওই একটা শব্দই যথেষ্ট। ব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটল ওরা। ভয়ের চোটে ফিওনা প্রায় উড়ে যাচ্ছে। এই বৃত্তাকার পথ থেকে বেরোনোর প্রান্তে পৌঁছে গেছে ওরা।
ওরা যেই সোজা রাস্তায় উঠতে যাবে ওমনি পেছন দিক থেকে গুলির আওয়াজ শোনা গেল।
ইসকি পিস্তলটা তুলে নিয়েছে।
দ্রুত দৌড়ে খোঁড়া পিস্তলধারী আর নিজেদের মধ্যে যতদূর সম্ভব দূরত্ব তৈরি করতে চাচ্ছে ওরা। এক মিনিটের মাথায় ওরা দুজন রাস্তার সংযোগস্থলে পৌঁছে গেল। গ্রে ভাবল ওরা এখন নিরাপদ।
এই সংযোগস্থলের যেখানটায় গ্রে এর আগে থেমেছিল ফিওনাকে ঠিক ওখানেই থামাল ও। এই সংযোগস্থল থেকে সবদিকে পথ চলে গেছে। কিন্তু ওরা এখন কোনদিকে এগোবে? এরমধ্যে ইসকি নিশ্চয়ই সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছে, অবশ্যই যদি তার রেডিও ঠিক থাকে তাহলে। কিন্তু সেটার ওপর তো আর গ্রে ভরসা করতে পারে না। ওকে ধরে নিতে হবে গার্ডরা ইতোমধ্যে ভেতরে-বাইরে সার্চ শুরু করে দিয়েছে।
আর মনকের কী খবর? তখন গুলির আওয়াজটা কীসের ছিল? মনক কি মারা গেছে? বেঁচে আছে? নাকি ধরা পড়েছে আবার? অনেক সম্ভাবনা। নাহ, গ্রের এখন কোথাও গিয়ে লুকোতে হবে। ঠাণ্ডা হতে হবে ওকে।
কিন্তু লুকোবে কোথায়?
একটা রাস্তা মূল ভবনের দিকে চলে গেছে।
ওটা দিয়ে এখোনো যেতে পারে। কেউ ভাববে না ওরা আবার মূল ভবনের দিকে গেছে। তার ওপর ওখানে ফোনও আছে। যদি বাইরের পৃথিবীর সাথে সংযোগ স্থাপন করা যায়… তাহলে হয়তো এখানকার কার্যবিধি সম্পর্কে বিস্তারিত অনেক কিছু জানা যাবে…
কিন্তু এগুলো আপাতত আকাশ-কুসুম কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। পুরো জায়গাটা কঠিন নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা।
ফিওনা খেয়াল করে দেখল, গ্রে কিছু একটা ভাবছে।
ওর হাতে টোকা দিয়ে নিজের পকেট থেকে কী যেন বের করল মেয়েটা। একটা চেইনে থাকা দুটো তাসের কার্ডের মতো দেখতে ওটা।
না তাস খেলার কার্ড নয়।
কি (চাবি) কার্ড।
আমি ওই কুত্তী মহিলার কাছ থেকে এটা ঝেড়ে দিয়েছি, থুতু ফেলে বলল ফিওনা। আমার গায়ে আঁচড় দেয়ার প্রতিশোধ।
গ্রে কার্ড দুটো নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। মনকের খোঁচা মনে পড়ে গেল ওর। জাদুঘরে আটকা পড়ার পর ফিওনাকে মনক খোঁচা মেরে বলেছিল জাদুঘরের পরিচালকের পকেট থেকে চাবির গোছা চুরি না করে কি কার্ড চুরি করলেই বেশি কাজে দিতো। দেখা যাচ্ছে, মেয়েটা মনকের কথাটাকে বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।
চোখ সরু করে আবার মূল ভবনের দিকে তাকাল গ্রে।
ওর সাথে থাকা পকেটমারকে বিশেষ ধন্যবাদ দিতেই হয়। ক্যাসলে ঢোকার কি। কার্ড এখন হাতের মুঠোয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীভাবে কী করবে?