১৬. প্রফেসর ট্রিলনির ভবিষ্যদ্বাণী

১৬. প্রফেসর ট্রিলনির ভবিষ্যদ্বাণী

হ্যরির কুইডিচ কাপ জেতার অন্তহীন আনন্দ সপ্তাহ খানেক থাকল। মনে হচ্ছে আবাহওয়া যেন বিজয়টাকে উপভোগ করছে। জুন মাস আসছে, দিনগুলো মেঘহীন এবং বাতাসে লোনা ভাব। সবারই এখন আস্তে ধীরে হেঁটে বেড়াতে, ধপ করে ঘাসের উপরে বসে পড়তে ইচ্ছে করে। সঙ্গে বরফ দেয়া কুমড়োর জুস, হয়তো কোন খেলা অথবা লেকে দৈত্যাকার স্কুইডকে পানির মধ্যে দিয়ে সাঁতরে যেতে দেখাতেই আনন্দ।

কিন্তু ওরা পারছে না। মাথার ওপর পরীক্ষা, বাইরে অলস সময় কাটানোর চেয়ে ছাত্ররা ভেতরে খোলা জানালায় বসে গ্রীষ্মের বাতাসের মধ্যে পরীক্ষার জন্য মাথা পরিষ্কারেই বেশি ব্যস্ত থাকল। এমনকি ফ্রেড এবং জর্জ উইজলিকেও দেখা গেছে পড়তে। হোগার্টস-এর সর্বোচ্চ ডিগ্রির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে পার্সি। এবং যেহেতু সে ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ে যোগ দিতে চায়, তার ফলাফল খুব ভালো হওয়া দরকার। ক্রমেই যেন সে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, কমনরুমে সন্ধ্যা বেলায় যারাই একটু ডিস্টার্ব করছে তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিচ্ছে। বস্তুত পার্সির চেয়ে যে মানুষটি বেশি উদ্বিগ্ন সে হচ্ছে হারমিওন।

হ্যারি এবং রন এখন আর ওকে জিজ্ঞাসা করে না যে একই সঙ্গে কয়েকটি ক্লাস কিভাবে সে করতে পারছে, ওরা হাল ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু ওর নিজের পরীক্ষা সূচি দেখে ওরা আর ঠিক থাকতে পারল না।

পরীক্ষা সূচি
সোমবার সকাল নটা, অ্যারিথম্যান্সি
সকাল নটা, ট্রান্সফিগিউরেশন
লাঞ্চ
দুপুর ১টা, চার্মস
দুপুর ১টা, প্রাচীন ঐন্দ্রজালিক বর্ণমালা

হারমিওন? সতর্কতার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল রন, কারণ আজকাল কোন কিছুতে বাধা পেলেই ও একেবারে রাগে ফেটে পড়ে। ইয়ে–মানে, তুমি কী নিশ্চিত যে সময়গুলো ঠিকমত লিখেছো?

কী? চট করে জিজ্ঞাসা করল হারমিওন, পরীক্ষা সূচিটা তুলে নিয়ে পরীক্ষা করছে। হ্যাঁ, নিশ্চয় আমি ঠিকই লিখেছি।

তোমাকে এখন এটা জিজ্ঞাসা করা কী কোন মানে আছে যে তুমি একই সময়ে দুটো পরীক্ষা কীভাবে দেবে? বলল হ্যারি।

না, সংক্ষেপে বলল হারমিওন। তোমাদের কেউ কী আমার নিউমোরলজি এবং গ্রামাটিকা বই দুটো দেখেছো?

ওহ্, হ্যাঁ, বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ার জন্য আমি ও দুটো নিয়েছিলাম। বলল রন, শান্তস্বরে। টেবিলের ওপর থেকে পার্চমেন্টের পাহাড় সরিয়ে খুঁজছে হারমিওন। ঠিক সেই সময় জানালায় একটা খসখস শব্দ শোনা গেল এবং হেডউইগ উড়ে এল জানালা দিয়ে, ওর ঠোঁটে শক্ত করে ধরা একটা কাগজ।

হ্যাগ্রিড পাঠিয়েছে, বলল হ্যারি, চিঠিটা খুলতে খুলতে। বাকবিকের আপিল ছয় তারিখ।

ওইদিনই আমাদের পরীক্ষা শেষ হবে, বলল হারমিওন, এখনও খুঁজছে তার বই।

এবং এখানেই আসছেন ওরা আপিলের জন্য, বলল হ্যারি তখনও চিঠিটা পড়ছে ও। ম্যাজিক মন্ত্রণালয় থেকে কেউ একজন-এবং একজন জল্লাদ।

হকচকিয়ে তাকাল হারমিওন।

আপিল শুনানিতে জল্লাদকে নিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে যে এরই মধ্যে ওরা সব ঠিক করে ফেলেছে!

হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে, বলল হ্যারি ধীরে ধীরে।

ওরা সেটা পারে না! গর্জন করে উঠল রন। এই আপিলের জন্যে অনেক কিছু আমি করে ফেলেছি, ওরা এটা করতে পারে না।

কিন্তু হ্যারির মনে হচ্ছে যে কমিটি মিস্টার ম্যালফয়ের পক্ষে মন স্থির করে ফেলেছে। ড্র্যাকো, কুইডিচ হারার পর মন মরা হয়েই ছিল এতদিন, এখন যেন কয়েকদিন ধরে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ওর বিদ্বেষমূলক মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে ও নিশ্চিত বাকবিককে মেরে ফেলা হবে। এবং এই ঘটনা ঘটানোর জন্য সে নিজে মহা খুশি। হ্যারি শুধু যেন একটাই কাজ এখন করতে পারে হারমিওনের মতো ম্যালফয়ের মুখে চড় মারা। এবং সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে এখন হ্যাগ্রিডকে গিয়ে দেখে আসারও সময় নেই, কারণ নতুন নিরাপত্তা নিয়মগুলো এখনও রয়ে গেছে। এবং নিজের অদৃশ্য হওয়া জামাটা একচক্ষু ডাইনির ভেতর থেকে নিয়ে আসার সাহস এখন হ্যারির নেই।

***

পরীক্ষা সপ্তাহটা শুরু হতেই পুরো প্রাসাদ জুড়েই নেমে এল নীরবতা। তৃতীয় বর্ষের ছাত্ররা সোমবার ট্রান্সফিগিউরেশন পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে নিজেদের মধ্যে ফলাফল বিনিময় করছে আর ক্ষোভ প্রকাশ করছে যে তাদেরকে অনেক কঠিন প্রশ্ন দেয়া হয়েছিল, এর মধ্যে একটা ছিল চায়ের পটকে কচ্ছপে রূপান্তরিত করা। ওর নিজের বানানো কচ্ছপটা কেমন কাছিমের মতো লাগছিল বলে হারমিওন অন্য সবাইকে আরও বিরক্ত করছিল।

আমারটার তখনও চায়ের পটের নলটাই লেজ হিসেবে থেকে গিয়েছিল, একেবারে দুঃস্বপ্ন আর কি…

কচ্ছপের নিঃশ্বাসে কী জলীয় বাষ্প বের হয়?

ওটার পিঠে তখনও চায়ের পটের আকৃতির ঢাকনা, তোমার কী মনে হয় যে এর ফলে আমার নাম্বার কাটা যাবে?

তারপরে দ্রুত লাঞ্চ শেষ করে ওরা সোজা উপরতলায় গেল চার্মস পরীক্ষার জন্যে। হারমিওন ঠিকই বলেছিল; প্রফেসর ফ্লিটউইক সত্যিই আনন্দের চার্মস সম্পর্কে প্রশ্নই করেছেন। হ্যারিরটা একটু বেশি হয়ে গেল আর রন যে ওর পার্টনার ছিল হাসতে হাসতে ওর দম ফাটার যোগাড়। ওকে ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে যেতে হয়েছিল, এক ঘণ্টা পর ওর হাসি কমলে নিজে চার্ম পরীক্ষা দেয়ার জন্য তৈরি হলো। ডিনারের পর সবাই দ্রুত চলে এল কমনরুমে, গল্পগুজব করার জন্যে নয়, পোশন, জ্যোতির্বিদ্যা এবং ম্যাজিক্যাল জীবের যত্ন নেয়া বিষয়গুলো আবার রিভিশন দেয়ার জন্য।

পরদিন সকালে ম্যাজিক্যাল জীবের যত্ন নেয়ার বিষয়ে পরীক্ষা নিল হ্যাগ্রিড কিন্তু পরীক্ষায় যেন ওর কোন মনোযোগ নেই। ওদের জন্য সবচেয়ে সহজ পরীক্ষাটা বেছে নিল হ্যাগ্রিড। এবং সেই কারণেই হ্যারি, রন এবং হারমিওন ওর সঙ্গে কথা বলার প্রচুর সুযোগ পেল।

বিকি একটু যেন হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে, ওদেরকে বলল হ্যাগ্রিড, এমন একটা ভান করে যেন নিচু হয়ে হ্যারির ফ্লোবার ওয়ার্ম পরীক্ষা করে দেখছে ওগুলো তখনও বেঁচে আছে কি না। অনেক দিন ধরেই ব্যাপারটা চলছে। যাইহোক… কাল বাদ পরশু-একভাবে না একভাবে আমরা পরিণতিটা জানতে পারব।

বিকেলে হলো পোশন পরীক্ষা, এবং সেটা ছিল বিপর্যয়কর। হ্যারি অনেক চেষ্টা করেও ওর পোশনটাকে ঘন করতে পারল না, এবং স্নেইপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল চোখে প্রতিশোধের আনন্দ,ওখান থেকে সরে যাওয়ার আগে ওর খাতায় শূন্য-এর মতো কি যেন একটা লিখে গেল।

মধ্যরাতে জ্যোতির্বিদ্যা পরীক্ষা, বুধবার সকালে ম্যাজিকের ইতিহাস। বুধবার বিকেলে হার্বোলজি, তার মানে হচ্ছে উত্তপ্ত রোদে গ্রিন হাউজে যেতে হবে, আবার ফিরতে হবে কমনরুমে, মনে হবে গা যেন পুড়ে গেছে।

সবশেষের আগের পরীক্ষাটা বৃহস্পতিবার সকালে, ডিফেন্স এগেনস্ট দ্য ডার্ক আর্টস। প্রফেসর লুপিন ওদের জন্যে খুবই একটা অস্বাভাবিক পরীক্ষা ঠিক করেছেন; বাইরে সূর্যালোককে একভাবে বাধা দেয়ার পরীক্ষা, যেখানে একটা গভীর জলাশয় ওদেরকে হেঁটে পেরুতে হবে, পানি ভর্তি থাকবে গ্রিনডিলো, লাল টুপি ভর্তি গর্ত পেরুতে হবে, জলাভূমি হেঁটে পেরুতে হবে, হিংকিপাংকের দেয়া ভুল দিকনির্দেশনা এড়িয়ে গিয়ে তারপরে একটা পুরনো গাছের গুঁড়িতে উঠে নতুন একটা বোগার্টের মোকাবিলা করতে হবে।

অতি চমৎকার, হ্যারি, বিড়বিড় করলেন লুপিন, দাঁত বের করে হ্যারি যখন গাছের গুঁড়ির ওখান থেকে বেরিয়ে এল। পুরো নম্বর।

সাফল্যে উজ্জীবিত হ্যারি অপেক্ষা করল রন এবং হারমিওন কি করে দেখার জন্য। হিংকিপাংকের কাছে পৌঁছনো পর্যন্ত রন খুব ভালো করল কিন্তু ওটা ওকে একেবারে কোমর পর্যন্ত ডুবিয়ে দিল জলাভূমির মধ্যে। হারমিওনও গাছের গুঁড়িতে পৌঁছনো পর্যন্ত খুব ভালো করল, গুঁড়ির মধ্যে বোগার্ট। ওটার ভেতরে মিনিট খানেক থাকার পরে ও বেরিয়ে এলো চিৎকার করতে করতে।

হারমিওন! বললেন প্রফেসর লুপিন হকচকিয়ে। কী হয়েছে?

পপপ প্রফেসর ম্যাকগোনাগল! দম নিল হারমিওন, গাছের গুঁড়িটাকে দেখিয়ে। উনি বললেন আমি সবকিছুতে ফেল করেছি!

ওকে শান্ত করতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। অবশেষে যখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আনতে পারল, তখন সে, হ্যারি আর রন প্রাসাদে ফিরে এল। রন তখনও হারমিওনের বোগার্ট নিয়ে একটু হাসি তামাশা করতে চেয়েছিল, কিন্তু এমন একটা দৃশ্য ঠিক তখনই ওরা সিঁড়ির ধাপে দেখতে পেল যে, তখন আর ওরকম কিছু করা যায় না।

কর্নেলিয়াস ফাজ, ঘামছেন, ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন মাটির দিকে তাকিয়ে। হ্যারিকে দেখে কথা বলতে শুরু করলেন।

হ্যালো, হ্যারি! তিনি বললেন। এই মাত্র পরীক্ষা শেষ হলো? প্রায় শেষ হলো?

হ্যাঁ, বলল হ্যারি। হারমিওন এবং রন ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে দেখে ব্ৰিতভাবে পেছনে রয়ে গেল।

চমৎকার দিন তাই না, বললেন ফাজ, লেকটার উপরে চোখ বুলিয়ে। আহহা আহহা

গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি হ্যারির দিকে তাকালেন।

আমি এখানে একটি অপ্রীতিকর কাজে এসেছি হ্যারি। বিপদজনক জীবের ব্যবস্থাকরণ কমিটি হিপোগ্রিফ হত্যার একজন চাক্ষুষ সাক্ষী চায়। এবং যেহেতু ব্ল্যাক বিষয়ক জটিলতার কারণে আমাকে হোগার্টসে আসতেই হতো, সে কারণে এ ব্যাপারে আমাকেই থাকতে বলা হয়েছে।

তার মানে কি ইতোমধ্যেই আপিলের শুনানি শেষ হয়ে গেছে? বাধা দিয়ে বলল রন, সামনে এগিয়ে এসে।

না, না, আজ বিকেলে হবে এটা, বললেন ফাজ, কৌতূহলের সঙ্গে রনকে দেখে।

তাহলে আপনাকে হয়তো কোন হত্যাকাণ্ড দেখতেই হবে না! দৃঢ়ভাবে বলল রন। হিপোগ্রিফ মুক্তি পেয়েও যেতে পারে!

ফাজ কোন উত্তর দেয়ার আগেই, ওর পেছনের দরজা দিয়ে প্রাসাদ থেকে দুজন জাদুকর এল। তাদের একজন এত প্রাচীন যেন ওদের চোখের সামনেই যেন মিলিয়ে যাবে। অন্যজন দীর্ঘ, চিকন গোঁফ রয়েছে তার। হ্যারির মনে হলো ওরা দুজনেই কমিটির প্রতিনিধি। কারণ, খুব বুড়ো জাদুকরটি চোখ কুচকে হ্যাগ্রিডের কেবিনের দিকে তাকাল, দুর্বল স্বরে বলল, ডিয়ার, ডিয়ার, এ কাজের জন্য আমি সত্যিই খুব বুড়ো হয়ে গেছি … দুটোর সময় তাই না ফাজ?

কালো গোঁফওয়ালা লোকটি ওর বেল্টে কোন একটা কিছু আঙুল বুলাচ্ছেন; হ্যারি দেখল যে ওর বুড়ো আঙুলটা একটা চকচকে কুড়ালের ওপর বুলাচ্ছে। কিছু একটা বলার জন্য রন মুখ খুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কনুইয়ের এক ধাক্কায় হারমিওন ওকে চুপ করিয়ে দিল। মাথা ঝাঁকাল বাইরের হলের দিকে।

তুমি আমাকে চুপ করিয়ে দিলে কেন? রাগতস্বরে বলল রন গ্রেট হলে লাঞ্চের জন্য ঢুকতে ঢুকতে। ওদেরকে দেখেছো তুমি? ওরা কুড়ালটা পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, একেবারে তৈরি! এটা ন্যায়বিচার নয়!

রন, তোমার বাবা এই মন্ত্রণালয়েই কাজ করেন। তার মন্ত্রীকে তুমি এভাবে ওরকম কথা বলতে পার না! বলল হারমিওন, কিন্তু ওকে খুব বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে। যদি এবার মাথা ঠিক রেখে ঠিকভাবে যুক্তি দিতে পারে হ্যাগ্রিড, তাহলে সম্ভবত বাকবিককে ওরা মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিতে পারবে না

কিন্তু হ্যারি বলতে পারে হারমিওন যা বলছে সেটা ও নিজেই বিশ্বাস করে না। এই বিকেলেই পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে ওদের চারদিকে সবাই উত্তেজিত স্বরে কথা বলছে। কিন্তু হ্যারি, রন এবং হারমিওন–হ্যাগ্রিড এবং বাকবিকের দুঃশ্চিন্তায় অন্যমনস্ক, ওদের সঙ্গে যোগ দিতে পারল না।

হ্যারি এবং রনের সবশেষ পরীক্ষা ছিল ডিভাইনেশন। হারমিওনের মাগল স্টাডিজ। এক সঙ্গে ওরা মার্বেলের সিঁড়িটা ভেঙ্গে উঠল। দোতলায় হারমিওন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং হ্যারি ও রন একেবারে আটতলা পর্যন্ত উঠে গেল। ওখানে অনেকেই তখনও অপেক্ষা করছে ঘোরানো সিঁড়িটার উপরে বসে, শেষ মুহূর্তের রিভিশন দিচ্ছে।

আমাদেরকে সবাইকে তিনি আলাদা আলাদাভাবে ডাকবেন, নেভিল বলল ওদেরকে। ওরা গিয়ে ওর পাশে বসল। ওর সামনে ক্রিস্টাল বল দিয়ে ভবিষ্যৎ দেখার অধ্যায়টা খোলা। তোমরা কী কখনও ক্রিস্টাল বলের ভেতর দিয়ে কিছু দেখতে পেয়েছো?

না বলল রন, যেন কোন ব্যাপারই না। ঘড়ি দেখছে বার বার সে; হ্যারি। জানে ও বাকবিকের আপিল শুনানির সময়টা গুনছে।

ক্লাসরুমের বাইরের লাইনটা ছোট হচ্ছে ধীরে ধীরে। এক একজন রূপালী সিঁড়িটা বেয়ে নেমে আসছে আর অপেক্ষমাণ সবাই চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করছে, কী জিজ্ঞাসা করেছিল? ঠিকঠাক হয়েছে তো?

কিন্তু কেউই কথা বলেনি।

উনি বলেছেন যে ক্রিস্টাল বলটি তাকে বলেছে, যদি আমি তোমাদেরকে কিছু বলি, আমার একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটবে! চিকন স্বরে বলল নেভিল, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে।

এটা খুব সুবিধার হলো, নাক টেনে বলল রন। তুমি জান আমার এখন মনে হচ্ছে ওঁর সম্পর্কে হারমিওনের চিন্তাটাই সঠিক, উনি একটা ভণ্ড।

হু, বলল হ্যারি নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে। এখন দুটো বাজে। ইস যদি আরও তাড়াতাড়ি করতেন

সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে পার্বতী, খুশিতে ডগমগ।

উনি বলেছেন একজন একজন ঋটি ভবিষ্যৎ বক্তা হওয়ার সকল লক্ষণই আমার মধ্যে রয়েছে, ও বলল হ্যারি এবং রনকে লক্ষ্য করে। আমি অনেক কিছু দেখতে পেয়েছি … আচ্ছা, গুড লাক!

সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে ল্যাভেন্ডরের কাছে চলে গেল ও।

রোনাল্ড উইজলি, পরিচিত রহস্যময়ী স্বরটা শোনা গেল মাথার উপর থেকে। হ্যারির দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচালো রন এবং রূপালী মইটা বেয়ে উপরে হারিয়ে গেল। এখন পরীক্ষা দিতে একমাত্র হ্যারি বাকি থাকল। দেয়ালে পিঠ দিয়ে মেঝেতে বসল ও, রৌদ্রালোকিত জানালায় একটা মাছি ভনভন করছে, ওর মন পড়ে রয়েছে মাঠে, হ্যাগ্রিডের সঙ্গে।

অবশেষে, প্রায় বিশ মিনিট পর, মইয়ের মাথায় রনের বিশাল পা দেখা গেল।

কেমন হলো? উঠে দাঁড়িয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করল হ্যারি।

যাচ্ছেতাই, বলল রন। কিছুই দেখতে পাইনি, সে কারণে আমি কিছু গপ্পো বানিয়ে বলেছি, যদিও মনে হচ্ছিল তিনি খুব একটা বিশ্বাস করছেন না…

কমনরুমে দেখা হবে তোমার সঙ্গে, বিড়বিড় করে বলল হ্যারি, প্রফেসর ট্রিলনির গলা শোনা গেল, হ্যারি পটার!

ক্লাসরুমটা অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি গরম; পর্দাগুলো দেয়া, আগুন জ্বলছে, এবং একটা দুর্গন্ধে হ্যারি প্রায় বমি করে ফেলেছিল আর কি, চেয়ার টেবিলের মধ্যে দিয়ে হোঁচট খেয়ে এগিয়ে গেল সে, প্রফেসর ট্রিলনি ওর জন্য অপেক্ষা করছেন বড় একটা ক্রিস্টাল বল সামনে নিয়ে।

শুভ দিন, মাই ডিয়ার, আস্তে করে বললেন তিনি। তুমি যদি এখন দয়া করে ক্রিস্টাল বলটার দিকে চেয়ে থাক সময় নাও, এখন … আমাকে বল দেখি ওটার ভেতরে কি দেখতে পাচ্ছ…।

ক্রিস্টাল বলটার উপরে নুয়ে পড়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল হ্যারি, যতটা পারে ততটা মনোযোগের সঙ্গে তাকিয়ে থাকল, মনে মনে ইচ্ছা করছে ওটা ওকে ঘুরন্ত সাদা কুয়াশা ছাড়া আর কিছু দেখাক, কিন্তু কিছুই হলো না।

আচ্ছা? বললেন প্রফেসর ট্রিলনি। কি দেখতে পাচ্ছ?

প্রচণ্ড গরম, নাকে এসে লাগছে আগুনের পেছন থেকে আসা ধোয়ার দুর্গন্ধ। একটু আগে রন যা বলে গিয়েছে সেটা তার মনে পড়ল, ভান করল হ্যারি।

ইয়ে–, বলল হ্যারি, একটা কালো আকৃতি… মানে…

কিসের মতো দেখতে? ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন প্রফেসর ট্রিলনি। ভাবো, এখন…

হ্যারি আবার ওতে মন দিল এবং ওর মনে চলে এলো বাকবিক।

একটা হিপোগ্রিফ, ও দৃঢ়ভাবে বলল।

সত্যিই! ফিসফিস করলেন প্রফেসর ট্রিলনি, হাঁটুর উপরে রাখা পার্চমেন্টের উপরে কিছু লিখলেন। মাই বয়, তুমি হয়তো ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে হ্যাগ্রিডের বিপদের পরিণতিটাই দেখতে পাচ্ছ! আরও কাছে থেকে দেখ… হিপোগ্রিফটাকে কি মনে হচ্ছে … ওটার মাথাটা কি আছে?

হ্যাঁ, বলল হ্যারি দৃঢ়ভাবে।

তুমি নিশ্চিত? প্রফেসর ট্রিলনি ওকে আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল। তুমি কী নিশ্চিত, ডিয়ার? তুমি কী ওটাকে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দেখছ না, এবং সম্ভবত, ছায়ার মতো কেউ একজন একটা কুড়াল তুলছে পেছন থেকে?

না! বলল হ্যারি, এখন ওর অসুস্থ লাগছে।

কোন রক্ত নেই? হ্যাগ্রিডের কান্নাকাটি নেই?

না! আবার বলল হ্যারি, এখন এই রুমটা ছেড়ে বাইরে যেতে চাচ্ছে হ্যারি। ওটাকে চমৎকার লাগছে, ওটা–উড়ছে, চলে যাচ্ছে…।

প্রফেসর ট্রিলনি একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

বেশ, আমার মনে হচ্ছে এখানেই শেষ করা ভালো… একটু হতাশার মতো হলেও… কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি তোমার চুড়ান্ত চেষ্টাই করেছে।

ছাড়া পাওয়ায় উঠে দাঁড়াল হ্যারি, ওর ব্যাগটা তুলে নিল, ঘুরল ফিরে যাওয়ার জন্যে, এবং তারপর, ভীষণ জোরে একটা কর্কশ স্বর ওর পেছন থেকে বলে উঠল।

আজ রাতেই ঘটবে।

পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল হ্যারি। আর্মচেয়ারে বসা প্রফেসর ট্রিলনি যেন শক্ত হয়ে গেছেন; চোখে কোন দৃষ্টি নেই এবং মুখটা ঝুলে পড়েছে।

স–সরি? বলল হ্যারি।

কিন্তু মনে হচ্ছে প্রফেসর ট্রিলনি ওর কথা শুনতে পাননি। ওর চোখ ঘুরতে শুরু করেছে। ভয় পেয়ে গেল হ্যারি। ওর মনে হচ্ছে উনি যেন অজ্ঞান হয়ে যাবেন। ইতস্তত করল ও, হাসপাতালে দৌড়ে যাওয়ার চিন্তা করল–কিন্তু প্রফেসর ট্রিলনি আবার কথা বলে উঠলেন, ওইরকমই কর্কশ কণ্ঠস্বরে, যেটা মোটেই তার মতো নয়।

ডার্ক লর্ড একাকী এবং বন্ধুহীন, তার অনুসারীরা তাকে পরিত্যাগ করেছে। বার বছর ধরে তার দাসকে শেকলে বদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আজ রাতে, মধ্য রাতের আগে, তার দাস শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে এবং যোগ দেবে প্রভুর সঙ্গে। দাসকে সঙ্গে নিয়ে ডার্ক লর্ড আবার জেগে উঠবেন, আগের যেকোন সময়ের চেয়ে ভয়াবহ রূপে। আজ রাতে… মধ্য রাতের আগে… দাস… বেরিয়ে পড়বে… তার প্রভুর সঙ্গে… যোগ দেয়ার জন্য…

প্রফেসর ট্রিলনির মাথাটা সামনের দিকে বুকের উপরে ঝুঁকে পড়ল। এক ধরনের ঘোৎ করে শব্দ করল। তারপর, হঠাৎ, তার মাথাটা আবার সোজা হয়ে গেল।

আমি খুব দুঃখিত, যেন স্বপ্নের ঘোরে বললেন তিনি। দিনের উত্তাপ, বুঝতেই পারছ … ক্ষণিকের জন্য যেন আমি দূরে সরে গিয়েছিলাম…

হ্যারি তখনও ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, নিশ্চল, তাকিয়ে আছে অপলক।

কোন কিছু হয়েছে?

এই মাত্র-এই মাত্র আপনি আমাকে বললেন–যে ডার্ক লর্ড আবার জেগে উঠবেন যে তার দাস আবার তার কাছে ফিরে যাবে…

প্রফেসর ট্রিলনিকে সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে।

ডার্ক লর্ড? যার নাম নেয়া যায় না? মাই ডিয়ার বয়, এটা এমন একটা বিষয় যা নিয়ে কখনই ঠাট্টা করা যায় না… আবার জেগে উঠবেন, সত্যিই…

কিন্তু এইমাত্র আপনি বললেন! আপনি বললেন যে ডার্ক লর্ড।

আমার মনে হচ্ছে তুমিও যেন কোথায় চলে গিয়েছিলে! বললেন প্রফেসর ট্রিলনি। আমি নিশ্চয়ই এত দূরের কোন বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারব না!

মই দিয়ে নেমে ঘুরানো সিঁড়িটা ভেঙে নামছে হ্যারি, ভাবছে ও… এই মাত্র ও শুনে এলো প্রফেসর ট্রিলনি সত্যিকারের একটা ভবিষ্যদ্বাণী করলেন? অথবা ওটা কি পরীক্ষার কোন মনে রাখার মতো সমাপ্তি ছিল?

পাঁচ মিনিট পর ও গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে নিরাপত্তা দলটিকে পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, ওর মাথায় তখনও বাজছে প্রফেসর ট্রিলনির কথাগুলো। ওর উল্টো দিক থেকে সবাই আসছে হাসতে হাসতে, ঠাট্টা করতে করতে মাঠের দিকে যাচ্ছে যেন অনেক দিনের পর পাওয়া স্বাধীনতা; ও কমনরুমে পৌঁছতে পৌঁছতে দেখল ওটা জনশূন্য হয়ে গেছে। অবশ্য এক কোণায় বসেছিল রন এবং হারমিওন।

প্রফেসর ট্রিলনি, হ্যারি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এই মাত্র আমাকে বললেন।

কিন্তু ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝপথে থেমে যেতে হলে ওকে।

বাকবিক হেরে গেছে, দুর্বল স্বরে বলল রন। এইমাত্র হ্যাগ্রিড এটা পাঠিয়েছে।

এবার হ্যাগ্রিডের চিঠিতে চোখের পানির কোন দাগ নেই, তবুও যেন মনে হচ্ছে লেখার সময় ওর হাতটা এতো কেঁপেছিল যে চিঠিটা প্রায় পড়াই যাচ্ছে না।

আপিলে হেরে গেছি। সূর্যাস্তের সময় বাকবিকের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হবে। এখন তোমাদের আর কিছুই করার নেই। নিচে এসো না। আমি চাই না তোমরা দেখ।
হ্যাগ্রিড।

আমাদেরকে যেতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে বলল হ্যারি। ওখানে একা একা বসে ও জল্লাদের জন্য অপেক্ষা করতে পারে না!

সূর্যাস্ত, বলল রন, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে ও। আমাদেরকে তো বাইরে যেতে দেয়া হবে না বিশেষ করে, হ্যারি তোমাকে।

চলে হাত ভোবাল হ্যারি, ভাবছে।

যদি শুধু অদৃশ্য হওয়ার জামাটা থাকতো

ওটা কোথায়? বলল হারমিওন।

একচক্ষু ডাইনিটার নিচে পথের ওপর ওটা রেখে আসার কথা হারমিওনকে বলল হ্যারি।

…স্নেইপ যদি ওটার ধারে কাছে আর কখনও দেখতে পায়, তাহলে আমি ভয়ানক সমস্যায় পড়ব, বলল হ্যারি।

সেটা অবশ্য সত্যি, বলল হারমিওন, উঠে দাঁড়িয়ে। যদি সে তোমাকে দেখে একচক্ষু ডাইনিটার কুজ কীভাবে খোলো তোমরা?

ওটাকে জাদুর কাঠি দিয়ে ছুঁয়ে বলতে হবে ডিসেন্টডিয়াম, বলল হ্যারি। কিন্তু–

বাক্যের বাকিটা শোনার জন্য দাঁড়াল না হারমিওন; দ্রুত রুমটা পেরিয়ে স্থূলকায় মহিলার ছবিটা সরিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

ও কী ওটা আনতে গেছে? ওর পেছনে তাকিয়ে বলল রন।

তাই গেছে সে। পনের মিনিট পর ফিরে এল হারমিওন ওর কাপড়ের নিচে রূপালী জামাটা সযত্নে ভাঁজ করা।

হারমিওন, ইদানীং যে তোমার কি হয়েছে আমি বুঝতেই পারছি না! বলল বিস্মিত রন। প্রথমে তুমি মারলে ম্যালফয়কে, তারপর প্রফেসর ট্রিলনির ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলে–

হারমিওনকে দেখে মনে হচ্ছে প্রশংসায় যেন বিগলিত সে।

***

সবার সঙ্গে ডিনারে গেল ওরা, কিন্তু ডিনারের পর গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে ফিরে এল না। পোশাকের নিচে হ্যারির আলখাল্লাটা লুকানো; হাত ভাঁজ করে রেখেছে যেন ওটা দেখা না যায়। বাইরের হলটার সামনে এসে কান পেতে নিশ্চিত হয়ে নিল ভেতরে কেউ নেই। দরজা দিয়ে মাথা গলিয়ে দেখল হারমিওন।

ঠিক আছে, ফিসফিস করে বলল, কেউ নেই–জামাটা।

বড়সড় জামাটার ভেতর জড়াজড়ি করে পা টিপে টিপে ওরা হলটা পার হলো, সামনের পাথরের ধাপগুলো পেরিয়ে মাঠে এসে দাঁড়াল। নিষিদ্ধ বনের আড়ালে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, গাছের উপরের শাখাগুলোকে রাঙিয়ে দিয়েছে।

হ্যাগ্রিডের কেবিনে পৌঁছে নক করল ওরা। মিনিটখানেক লাগল ওর জবাব দিতে, দরজা খুলে আগন্তুকদের খুঁজল সে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে এবং কাঁপছে হ্যাগ্রিড।

আমরা এসেছি, ফিসফিস করে হ্যারি বলল। অদৃশ্য হওয়ার জামা আমাদের গায়ে। আমাদের ভেতরে আসতে দাও ওটা খুলে ফেলা যাক।

ইয়ে–তোমাদের আসা উচিত হয়নি! ফিসফিস করে হ্যাগ্রিড বলল। কিন্তু পেছনে সরে গেল, যেন ওরা ভেতরে ঢুকতে পারে। দ্রুত দরজাটা বন্ধ করে দিল হ্যাগ্রিড, আলখাল্লাটা খুলে ফেলল হ্যারি।

হ্যাগ্রিড কাঁদছিল না, ওদেরকে জড়িয়ে ধরেনি। কিন্তু ওকে এমন দেখাচ্ছিল, যেন জানে না ও কোথায় আছে এবং কি করবে। কাদার চেয়ে এই অসহায়ত্ব দেখা ওদের কাছে আরও অসহনীয় মনে হলো।

চা খাবে? বলল সে। কেটলির দিকে বাড়ানো ওর বিশাল হাতটা কাঁপছে।

বাকবিক কোথায়, হ্যাগ্রিড? হারমিওন জিজ্ঞাসা করল ওর স্বরে দ্বিধা।

আ–আমি ওকে বাইরে নিয়ে গিয়েছি, বলল হ্যাগ্রিড, জগে দুধ ঢালতে গিয়ে কিছুটা ফেলে দিল টেবিলের উপরে। ভাবলাম ওর এখন গাছ দেখা উচিত–বিশুদ্ধ। বাতাসে শ্বাস নেয়া উচিত। কারণ এর পর

হ্যাগ্রিডের হাত এত জোরে কাঁপছিল যে সে দুধের জগটাই ফেলে দিল এবং ওটা ভেঙে সমস্ত মেঝে দুধে ভেসে গেল।

আমি সব দেখছি হ্যাগ্রিড, তাড়াতাড়ি বলল হারমিওন, দ্রুত মেঝেটা পরিষ্কার করতে শুরু করল সে।

কাবার্ডে আরেকটা রয়েছে, হ্যাগ্রিড বলল, বসে জামার হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে। রনের দিকে তাকাল হ্যারি, অসহায়ভাবে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল রন।

কারো কী কিছু করার নেই? তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করল হ্যারি, হ্যাগ্রিডের পাশে বসতে বসতে। ডাম্বলডোর

উনি চেষ্টা করেছিলেন, বলল হ্যাগ্রিড। কিন্তু কমিটির সিদ্ধান্তকে পাল্টানোটা তার ক্ষমতার বাইরে। উনি বলেছিলেন ওদেরকে যে বাকবিকের কোন সমস্যা নেই, কিন্তু ওরা ভয় পায় মানে তোমরা জান তো লুসিয়াস ম্যালফয় কি রকম মানুষ

ওদেরকে হুমকি দিয়েছে, তাই আমার ধারণা… এবং যে ঘাতকের ভূমিকায় এসেছে সে নিজে ম্যালফয়ের পুরনো বন্ধু… যাইহোক, ব্যাপারটা বিনা ঝঞ্ঝাটেই শেষ হবে… এবং আমি ওর পাশেই থাকব…।

ঢোক গিলল হ্যাগ্রিড। কেবিনটায় ঘুরছে ওর চোখজোড়া, যেন আশার ক্ষীণ কোন সম্ভাবনা খুঁজছে।

যখন ওকে–মানে ঘটনাটা ঘটবে, ডাম্বলডোরও থাকবেন ওখানে। আজ সকালে চিঠি দিয়ে আমাকে জানিয়েছেন। বলেছেন তিনি আমার সঙ্গে থাকতে চান। মহৎ হৃদয়ের মানুষ, ডাম্বলডোর…।

হ্যাগ্রিডের কাবার্ডে আরেক জগ দুধ খুঁজছিল হারমিওন, ওর কণ্ঠ থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। নতুন জগটা নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল, অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখেছে।

আমরাও তোমার সঙ্গে থাকব, হারমিওন বলতে শুরু করল, কিন্তু হ্যাগ্রিড মাথা নাড়তে শুরু করল।

তোমাদেরকে প্রাসাদে ফিরে যেতে হবে। আমি তোমাদের বলেছি আমি চাই না তোমরা এটা দেখ। এবং কোন অবস্থাতেই তোমরা নিচে থাকবে না… যদি ফাজ এবং ডাম্বলডোর তোমাদেরকে অনুমতি ছাড়া নিচে ঘুরতে দেখে, তাহলে হ্যারি, তুমি খুব মুশকিলে পড়ে যাবে।

হারমিওনের চোখ থেকে নীরবে পানি গড়াচ্ছে, অবশ্য হ্যারি ওগুলো সে আড়াল করে রেখেছে। কিন্তু জগে ঢালবার জন্যে দুধের বোতলটা হাতে নিতেই তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে।

রন! আ–আমি বিশ্বাস করতে পারছি না–স্ক্যাবার্স!

হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে রন।

কী বলছ তুমি? হারমিওন দুধের জগটা টেবিলের ওপরে নিয়ে ওটাকে উল্টো করে দিল। ইঁদুরটা তখন পাগলের মতো চি চি করছে আর ভেতরে যাওয়ার জন্য চার পায়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু জগের ভেতর থেকে গড়িয়ে নিচে নামল স্ক্যাবার্স।

স্ক্যাবার্স! ফাঁকা স্বরে বলল রন। স্ক্যাবার্স, ওখানে তুমি কী করছ?

ইঁদুরটাকে ধরে আলোতে নিয়ে এল সে। ওটাকে ভয়াবহ রকম বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে। শুকিয়ে গেছে, লোম পড়ে গেছে অনেক। রনের মুঠোর মধ্যে থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে ইঁদুরটা।

ঠিক আছে, ঠিক আছে স্ক্যাবার্স! বলল রন। কোন বিড়াল নেই! এখানে কোন কিছুই তোমার ক্ষতি করবে না!

হঠাৎ হ্যাগ্রিড উঠে দাঁড়াল। ওর চোখ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। ওর স্বাভাবিক লাল মুখটা পার্চমেন্টের রঙ হয়ে গেছে।

ওরা আসছে…।

হ্যারি, রন ও হারমিওন চট করে ঘুরে দাঁড়াল। দূরে প্রাসাদের সিঁড়ি দিয়ে কয়েকজন মানুষ হেঁটে আসছে। সবার সামনে অ্যালবাস ডাম্বলডোর, ডুবন্ত সূর্যে ওর রূপালী দাড়িটা চিকমিক করছে। ওর পাশে পা টেনে টেনে হাঁটছে কর্নেলিয়াস ফাজ। পেছনে আসছে কমিটির বুড়ো সদস্য এবং জল্লাদ ম্যাকনেয়াচ।

তোমাদের চলে যাওয়াই ভালো, বলল হ্যাগ্রিড। ওর শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি যেন কাঁপছে। তোমাদেরকে এখানে দেখে ফেলা উচিত না… যাও জলদি এখনই…

পকেটে স্ক্যাবার্সকে ভরল রন, অদৃশ্য হওয়ার জামাটা তুলে নিল হারমিওন।

পেছনে দরজা দিয়ে তোমাদেরকে বের করে দিচ্ছি, বলল হ্যাগ্রিড।

ওর পেছন পেছন বাগানে এলো ওরা। হ্যারির কাছে সবকিছুই যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে, বিশেষ করে কয়েক গজ দূরে বাকবিককে দেখে, হ্যাগ্রিডের কুমড়োর বাগানের পেছনে বাধা। মনে হচ্ছে ও যেন টের পেয়েছে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। মাথাটাকে এদিক ওদিক দোলাচ্ছে, পা দিয়ে মাটি আঁচড়াচ্ছে ভয়ে।

ঠিক আছে, ঠিক আছে বিকি, নরম স্বরে বলল হ্যাগ্রিড। ঠিক আছে…হ্যারি রন আর হারমিওনের দিকে ফিরে বলল, এখন যাও, যেতে থাক।

কিন্তু ওরা নড়ল না।

হ্যাগ্রিড, আমরা পারব না।

আসল ঘটনাটা আমরা ওদের বলব।

ওরা ওকে মেরে ফেলতে পারে।

যাও! ক্ষিপ্ত হয়ে বলল হ্যাগ্রিড। তোমরা বিপদে পড়া ছাড়া এমনিতেই অনেক ঝামেলা হচ্ছে!

ওদের আর কিছু করার নেই। হ্যারি এবং রনের গায়ের ওপর জামাটা ছড়িয়ে দিতে দিতে হারমিওন শুনতে পেল কেবিনের সামনের দিকে কারা যেন কথা বলছে। ওরা যেখানে অদৃশ্য হয়ে গেল সেদিকে একবার তাকাল হ্যাগ্রিড।

জলদি যাও, ভাঙা গলায় বলল সে।এবং কিছু শোনার চেষ্টা করো না…।

 হেঁটে কেবিনে ফিরে গেল সে, শুনতে পেল সামনের দরজায় নক করছে কেউ।

ভীতসন্ত্রস্ত, হ্যারি, রন এবং হারমিওন ধীরে ধীরে নিঃশব্দে হ্যাগ্রিডের বাড়িটা ঘুরে রওনা হলো। সামনে আসতে আসতে ওরা শুনতে পেল দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেছে।

প্লিজ, জলদি চল, ফিসফিস করে বলল হারমিওন। আমার আর সহ্য হচ্ছে না, আমি পারছি না…।

ঢালু লনটা পেরিয়ে প্রাসাদের দিকে রওনা হল ওরা। সূর্য এখন দ্রুতই অস্ত যাচ্ছে; আকাশের লাল ছোপে ধূসর হয়ে গেছে, কিন্তু পশ্চিম দিকে এখনও চুনির মতো টকটকে লাল।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল রন।

ওহ, প্লিজ রন, হারমিওন বলল।

স্ক্যাবার্স, ও থাকতে চাচ্ছে না– রন একটু বাঁকা হয়ে ওটাকে ওর পকেটে রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু ইঁদুরটা যেন পাগল হয়ে গেছে; চিৎকার করছে, গা মোচড়াচ্ছে এমনকি রনের আঙুলে কামড় দেয়ার চেষ্টা করছে।

স্ক্যাবার্স, আমি রন, ইডিয়ট বুঝতে পারছ না, ফিসফিস করে বলল রন।

ওদের পেছনে একটা দরজা খুলে গেল, আরেকটা গলার স্বর শোনা গেল।

ঠিক আছে–স্ক্যাবার্স চুপ কর।

সামনের দিকে হেঁটে গেল ওরা; হারমিওনের মতোই হ্যারিও ওদের পেছনের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছে। রন আবার থেমে দাঁড়াল।

আমি এটাকে ধরে রাখতে পারছি না–স্ক্যাবার্স, মুখ বন্ধ কর, সবাই শুনতে পাবে–

বন্যপ্রাণীর মতো চিৎকার করছে ইঁদুরটা, কিন্তু হ্যাগ্রিডের বাগানের ভেতরে থেকে যে আওয়াজটা আসছে তার চেয়ে জোরে নয়। অস্পষ্ট কয়েকটি পুরুষ কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, তারপরে সব নীরব, এরপর কোনরকম সতর্কতা ছাড়াই শোনা গেল স্যাৎ করে এক কুড়ালের আঘাত করার শব্দ।

মাথা ঘুরে গেল হারমিওনের। শেষ পর্যন্ত ওরা মেরেই ফেলল! ফিসফিস করে হ্যারিকে বলল সে। আ আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না–ওরা এরকম একটা জঘন্য কাজ করতে পারল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *