১৪. স্নেইপ-এর ক্ষোভ

১৪. স্নেইপ-এর ক্ষোভ

সেরাতে গ্রিফিন্ডর টাওয়ারের কেউ ঘুমালো না। সে জানে পুরো প্রাসাদটা আবার তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে, কমনরুমে পুরো হাউজের সবাই জেগে থেকেছে, ব্ল্যাক ধরা পড়েছে এটা শোনার জন্য। ভোরে এসে প্রফেসর ম্যাকগোনাগল জানালেন আবার পালিয়ে গেছে ও।

পরদিন ওরা যেখানেই গেছে সেখানেই কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা লক্ষ্য করেছে। প্রফেসর ফ্লিটউইককে দেখা গেল সামনের দরজায় ওদেরকে কিভাবে সাইরিয়াস ব্ল্যাককে চেনা যাবে শেখাচ্ছেন; হঠাৎ করে করিডোর ধরে দ্রুত আসা যাওয়া করছেন ফিলচ, সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে দেয়ালের সামান্য ফাটা থেকে। ইঁদুরের গর্ত পর্যন্ত। স্যার ক্যাডোগানকে বাদ দেয়া হয়েছে। সাত তলার অব্যবহৃত সিঁড়ির নিচে তার জায়গা হয়েছে এবং সেই স্থূলকায় মহিলা আবার ফিরে এসেছেন। তাকে খুব দক্ষতার সাথে আদি রূপে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, কিন্তু তখনও তিনি খুবই নার্ভাস, এবং এই শর্তে ফিরে এসেছেন যে তাকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা দেয়া হবে। তাকে পাহারা দেয়ার জন্যে কাঠখোট্টা দেখতে একদল নিরাপত্তা কর্মীকে ভাড়া করা হয়েছে। করিডোরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা ভীতিকর একটা গ্রুপের মতো, কর্কশ স্বরে কথা বলছে আর নিজেদের মুগুরগুলোকে প্রদর্শন করছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।

হ্যারি লক্ষ্য করল তিনতলার একচক্ষু ডাইনিটার মূর্তিটাকে কেউ পাহারা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ফ্রেড এবং জর্জ ঠিকই মনে করে যে তারা-এবং এখন হ্যারি, রন ও হারমিওনই-একমাত্র এর ভেতরের গোপন পথটার কথা জানে।

তোমার কি মনে হয় ওটার কথা বলে দেয়া উচিত? হ্যারি জিজ্ঞাসা করল রনকে।

আমরা জানি ও হানিডিউকস-এর দিক থেকে আসে না, বলল রন। দোকানটা যদি কেউ ভেঙে ঢুকতো তাহলে আমরা জানতে পারতাম।

রনের দৃষ্টিভঙ্গিতে হ্যারি খুশি হলো। একচক্ষু ডাইনিটাকে পাহারা দেয়া হলে সে আর কখনই হাসমিড-এ যেতে পারত না।

রন মুহূর্তের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে গেল। এই প্রথমবারের মতো লোকে হ্যারির চেয়ে ওর দিকে বেশি নজর দিচ্ছে, এবং এটা পরিষ্কার এই অভিজ্ঞতাটা রন উপভোগও করছে। যদিও রাত্রের ঘটনায় সে এখনও বিধ্বস্ত, তারপরও যেই জিজ্ঞাসা করুক না কেন ওই বিষয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলার ব্যাপারে তার কোন ক্লান্তি নেই।

…আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, কিছু একটা ছেঁড়া হচ্ছে শুনতে পেলাম, মনে করেছিলাম স্বপ্ন দেখছি, তুমি বুঝতে পারছো? কিন্তু তারপর বন্ধ ঘরে বাতাস!… আমি জেগে উঠলাম, দেখলাম বিছানার একদিকের পর্দা টেনে নামানো… আমি আরেকদিকে কাত হলাম… দেখলাম ও ঝুঁকে আছে আমার উপর… যেন একটা কঙ্কাল, নোংরা চুলের বোঝা… লম্বা একটা ছোরা ধরা, নিশ্চয়ই বারো ইঞ্চি হবে… ও আমার দিকে তাকাল আমি ওর দিকে এবং আমি চিৎকার করলাম সে দৌড়ে পালিয়ে গেল।

কিন্তু কেন? রন হ্যারিকে জিজ্ঞাসা করল, দ্বিতীয় বর্ষের মেয়েগুলো ওর গল্প শুনে চলে যাওয়ার পর। ও পালিয়ে গেল কেন?

হ্যারি নিজেও একই বিষয়ে ভাবছে। ব্ল্যাক, ভুল বিছানায় গেলেও রনকে হত্যা করে ওর দিকে কেন এল না? বার বছর আগে সে প্রমাণ করেছে নির্দোষ মানুষকে খুন করতে তার একটু বাধে না, এবং এই সময়ে সে পাঁচটি নিরস্ত্র বালকের মুখোমুখি হয়েছিল মাত্র, এদের মধ্যে চারজনই ঘুমিয়ে ছিল…।

চূড়ান্তভাবে অপমানিত ও লজ্জিত নেভিল। প্রফেসর ম্যাকগোনাগল তার উপরে এত ক্ষেপে গিয়েছেন যে ওর ভবিষ্যতের সবগুলোর হগসমিড যাত্রা বাতিল করে দিয়েছেন। ওকে ডিটেনশন দিয়েছেন এবং ওকে টাওয়ারের পাসওয়ার্ড দেয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। বেচারা নেভিল কমনরুমের বাইরে প্রত্যেক রাতে একাকি দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাকে কখন কে সঙ্গে করে ভেতরে নিয়ে যাবে, সহ্য করতে হতো নিরাপত্তা দলটি তুলনায় অবজ্ঞাসুলভ হাসি। অবশ্য এই শাস্তি গুলোর একটিও, দাদী তার জন্য যে শাস্তি তুলে রেখেছিল তার কিছুই নয়। ব্ল্যাক আসার দুইদিন পর, তিনি নেভিল-এর জন্য সেটাই পাঠালেন, হোগার্টস-এর যেকোন ছাত্রের জন্য যেটা সবচেয়ে জঘন্য, বিশেষ করে নাস্তার সময়–হাউলার।

স্কুলের পেঁচাটা গ্রেট হলের ভেতরে ডাক নিয়ে ঢুকল, নেভিলের সামনে একটা পোষা পেঁচা এসে নামল, ঢোক গিলল, ওটার ঠোঁটে একটা টকটকে লাল খাম। হ্যারি এবং রন ওর উল্টোদিকে চেয়ারে বসেছিল, সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল চিঠিটা, একটা হাউলার-এক বছর আগে মায়ের কাছ থেকে রন পেয়েছিল একটা।

ওটা খুলে পড়ে ফেল, নেভিল, রন উপদেশ দিল।

নেভিলকে এখন কোনকিছুই দুবার বলতে হয় না। খামটা টেনে নিল এবং এমনভাবে ধরল যেন ওটা একটা বোমা, দৌড়ে হল থেকে বেরিয়ে গেল সে, স্লিথারিন টেবিলের সবাই দেখে অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল। এনট্রেনস হল থেকে হাউলারটা শোনা গেল–নেভিলের দাদী, তার গলার স্বর জাদুর কল্যাণে একশ গুণ বেড়ে গেছে, তীক্ষ্ণ স্বরে অভিযুক্ত করছেন তাকে পুরো পরিবারের জন্য লজ্জার কারণ হওয়ার জন্য।

নেভিলের জন্য হ্যারির নিজেরই দুঃখবোধ হচ্ছিল, ওর যে একটা চিঠি এসেছে সেটা খেয়ালই করেনি। কব্জিতে ঠোকর মেরে হেডউইগ ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

আউচ! ওহ্–ধন্যবাদ, হেডউইগ…।

খামটা খুলল, ইতোমধ্যে নেভিলের কর্নফ্লেক্সে ভাগ বসাল হেডউইগ। ভেতরে নোটটাতে লেখা আছে

প্রিয় হ্যারি এবং রন,
আজ সন্ধ্যা ছটার দিকে আমার সঙ্গে চা খেলে কেমন হয়? আমিই এসে তোমাদেরকে নিয়ে যাব। বাইরের হলে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে, নিজে নিজে বাইরে যাওয়া তোমাদের নিষেধ।
চিয়ার্স
হ্যাগ্রিড

মনে হয় সে ব্ল্যাক সম্পর্কে সব কিছু শুনতে চায়! বলল রন।

সন্ধ্যা ছটায় হ্যারি আর রন গ্রিফিন্ডর টারওয়ার থেকে বেরিয়ে, এক দৌড়ে সিকিউরিটি দলটাকে পেরিয়ে নিচের হলের দিকে রওনা হলো।

ওখানে হ্যাগ্রিড আগে থেকেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

ঠিক আছে, হ্যাগ্রিড! বলল রন। মনে হচ্ছে শনিবারের রাত সম্পর্কে তুমি শুনতে চাও, তাই না?

আমি এর মধ্যে সব শুনে ফেলেছি, বাইরের দিকের দরজা খুলতে খুলতে বলল সে।

ওহ, বলল রন, একটু হতাশ হয়েছে।

হ্যাগ্রিডের কেবিনে ঢুকে প্রথম যে জিনিসটা ওদের নজরে পড়ল সেটা হচ্ছে বাকবিক, হ্যাগ্রিডের তালি দেয়া কম্বলের ওপর পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে ওটা, বিশাল পাখাজোড়া শরীরের সঙ্গে গোটানো, মৃত বেজির মাংস দিয়ে তৈরি খাবার খাচ্ছে সে। এ অপ্রিয় দৃশ্য থেকে চোখ সরিয়ে হ্যারি দেখল হ্যাগ্রিডের ওয়ার্ডরোব-এর দরজা থেকে ঝুলছে দৈত্যাকার বাদামি রঙের একটি স্যুট এবং সাংঘাতিক হলুদ ও কমলা রঙের একটি টাই।

ওগুলো কিসের জন্যে? হ্যারি জিজ্ঞাসা করল।

এই শুক্রবার বাকবিকের মামলা। সে আর আমি ওর জন্য লন্ডনে যাব। নাইট বাসে দুটো সিট বুক করেছি …।

মনে মনে নিজেকে দোষী করল হ্যারি। বাকবিকের মামলা এত সামনে চলে এসেছে অথচ ভুলেই গিয়েছিল সে, রনের চেহারা দেখে মনে হলো সেও ভুলে গিয়েছিল। বাকবিকের পক্ষে আইনি সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি তারা যে দিয়েছিল সেটাও ওরা ভুলে গেছে; ফায়ারবোল্ট এসে মন থেকে সবকিছু মুছে দিয়েছে।

ওদের জন্য চা ঢালল, প্লেটে করে কয়েকটা রুটি দিল কিন্তু ওরা নিল না, হ্যাগ্রিডের রান্না সম্পর্কে ওদের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে।

তোমাদের দুজনের সঙ্গে আমার কিছু সলাপরামর্শ রয়েছে, বলল হ্যাগ্রিড ওদের দুজনের মাঝখানে বসে, ওকে চরিত্রের বাইরে সিরিয়াস দেখাচ্ছে।

কী? বলল হ্যারি।

হারমিওন, বলল হ্যাগ্রিড।

তার আবার কী হলো? বলল রন।

ও ঠিকই আছে, ক্রিসমাস থেকে প্রায়ই আমাকে দেখতে আসছে। নিঃসঙ্গ বোধ করছে। তোমরা দুজন ওর সঙ্গে কথা বলোনি ফায়ারবোল্টের কারণে, এখন বলছ না ওর বিড়ালের কারণে

স্ক্যাবার্সকে খেয়ে ফেলেছে ওটা! মাঝখানে ক্ষিপ্তভাবে বলল রন।

আর সব বিড়াল যা করত ওর বিড়ালটাও ঠিক তাই করেছে, বলল হ্যাগ্রিড একগুয়ের মতো। তোমরা জান ও এর জন্য কত কেঁদেছে। আমাকে যদি বলো আমি বলব, যতটুকু চিবোতে পারে তার চেয়ে বেশি কামড়ে নিয়েছে সে। এরপরেও অনেক কাজের পর বাকবিকের মামলায় আমাকে সাহায্য করছে, মনে রেখ ও সত্যি কতগুলো ভালো পয়েন্ট পেয়েছে… মনে হচ্ছে বাকবিকের জেতার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে …

হ্যাগ্রিড, আমাদেরও সাহায্য করা উচিত ছিল. দুঃখিত বলল হ্যারি।

আমি তোমাদেরকে দোষারোপ করছি না! বলল হ্যাগ্রিড হ্যারির মাপ চাওয়াটাকে উড়িয়ে দিয়ে। খোদা জানে তোমাদের আরও অনেক কিছু করার রয়েছে, আমি দেখেছি তোমরা দিনে রাতে কুইডিচ প্র্যাকটিস করছে–কিন্তু তোমাদেরকে আমার বলতেই হবে, আমার মনে হয় ব্রুমস্টিক অথবা ইঁদুরের চেয়ে তোমাদের দুজনকে বন্ধুত্বের মূল্য বেশি দিতে হবে। ব্যাস।

হ্যারি এবং রন অস্বস্তিকর দৃষ্টি বিনিময় করল।

সত্যিই সে ঘাবড়ে গিয়েছিল, যখন ব্ল্যাক তোমাকে ছুরি দিয়ে প্রায় আঘাত করেছিল, রন। ঠিক জায়গায় ওর একটা হৃদয় আছে, হারমিওনের আছে, আর তোমরা দুজন কিনা ওর সঙ্গে কথা বলছ না।

ও যদি ওর বিড়ালটাকে তাড়িয়ে দেয়, আমি আবার ওর সঙ্গে কথা বলব? রেগে বলল রন। কিন্তু ও এখনও ওটা ধরে আছে! ওটা একটা পাগল, এবং ওটার বিরুদ্ধে সে কিছুই শুনতে রাজি নয়!

আহ্, বেশ, নিজেদের পোষা জন্তু সম্পর্কে মানুষ একটা বোকা হতেই পারে, বিজ্ঞের মতো বলল হ্যাগ্রিড। পেছনে হ্যাগ্রিডের বালিশের উপরে বেজির কয়েকটা হাড় ছড়ালো বাকবিক।

পরবর্তী সময়টা ওরা গ্রিফিন্ডর হাউজের কুইডিচ কাপ জেতার সম্ভাবনা আলোচনা করল। নটার সময় হ্যাগ্রিড আবার ওদেরকে পৌঁছে দিল।

কমনরুমে ঢুকে দেখল নোটিশ বোর্ডের সামনে একদল ছাত্রছাত্রী রয়েছে।

আগামী সপ্তাহান্তে আবার হাসমিড! বলল রন, মাথার উপর দিয়ে নোটিশটা পড়তে পড়তে। তোমার কী মনে হয়? শান্তস্বরে হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল।

ফিলচ এখনও হানিডিউকসের যাওয়ার পথটার ব্যাপারে কিছু করেনি… আরও শান্ত স্বরে বলল হ্যারি।

হ্যারি! ওর ডান কানে কে যেন ডাকল। হ্যারি চারদিক চেয়ে হারমিওনের দিকে তাকাল, ও ওদের ঠিক পেছনের টেবিলে বসেছিল।

হ্যারি, তুমি যদি আবার হাসমিডে যাও… আমি প্রফেসর ম্যাকগোনাগলকে ম্যাপটার কথা বলে দেব! বলল হারমিওন।

তুমি কী কাউকে কথা বলতে শুনছ, হ্যারি? বলল রন হারমিওনের দিকে না তাকিয়ে।

রন, ব্ল্যাক তোমাকে প্রায় খুন করে ফেলেছিল, এরপর তুমি কীভাবে হ্যারিকে ওখানে যেতে দাও? আমি সত্যিই বলছি, আমি বলে দেব।

তাহলে এখন তুমি হ্যারিকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করাতে চাও! ক্ষিপ্ত স্বরে বলল রন। এ বছর তুমি যথেষ্ট ক্ষতি ইতোমধ্যেই করে ফেলোনি কী?

জবাব দেয়ার জন্য হারমিওন মুখ খুলেছিল, কিন্তু নরম একটা শব্দ করে কশ্যাংকস লাফিয়ে উঠল ওর কোলে। রনের মুখের দিকে ভয়ে ভয়ে চেয়ে হারমিওন ওকে নিয়ে ওঠে দৌড়ে চলে গেল মেয়েদের হোস্টেলের দিকে।

তাহলে কী হলো? রন বলল হ্যারিকে, যেন ওদের আলোচনায় কোন বাধা পড়েনি। চলো, শেষবার যেবার গিয়েছিলে কিছুই দেখতে পাওনি। তুমি জঙ্কোর ভেতরে যাওনি!

হ্যারি চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল হারমিওন আশেপাশে নেই।

ঠিক আছে, সে বলল। কিন্তু এবার আমি অদৃশ্য হওয়ার জামাটা নিয়ে যাব।

***

শনিবার সকালে অদৃশ্য হওয়ার জামাটা ব্যাগে ভরল হ্যারি, ম্যাপটা পকেটে, সবার সঙ্গে নিচে নাস্তার টেবিলে বসল। হারমিওন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ওর দিকে, কিন্তু ও সরাসরি ওর দৃষ্টি এড়িয়ে গেল। এবং ও মারবেল সিঁড়ি ধরে বাইরের হলে যাচ্ছে এটা যেন দেখতে পায় হারমিওন সে ব্যাপারে সচেতন থাকল।

বাই! হ্যারি বলল রনকে। ফিরে এলে দেখা হবে!

দাঁত বের করে হাসল রন। চোখ টিপল।

তৃতীয়তলায় দৌড়ে উঠল হ্যারি, যেতে যেতে পকেট থেকে ম্যাপটা বের করল। একচক্ষু ডাইনিটার আড়ালে বসে ওটাকে সমান করল। ওর দিকে একটা ক্ষুদ্র বিন্দু এগিয়ে আসছে। চোখ সরু করে দেখল হ্যারি, ছোট্ট করে লেখা আছে নেভিল লংবটম।

দ্রুত জাদুর কাঠিটা বের করে বিড়বিড় করল ডিসেনডিয়াম! মূর্তিটার ভেতরে ওর ব্যাগটা ঢুকিয়ে দিল,কিন্তু ও নিজে ভেতরে যাওয়ার আগে কোণা ঘুরে নেভিল চলে এল।

হ্যারি! আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে তুমিও হাসমিডে যাচ্ছ না!

হাই, নেভিল, বলল হ্যারি, দ্রুত মূর্তিটার কাছ থেকে সরে গেল এবং ম্যাপটা আবার পকেটে ভরে ফেলল। তুমি কী করছ?

কিছুই না, কাঁধ ঝাঁকালো নেভিল। এক্সপ্লোডিং স্নাপ-এর এক হাত হয়ে যাবে নাকি?

ইয়ে–মানে এখন না–আমি লাইব্রেরিতে যাচ্ছিলাম, লুপিনের ওই ভ্যাম্পায়ার সম্পর্কে রচনাটা–

আমিও তোমার সঙ্গে যাব, খুশি হয়ে বলল নেভিল। আমিও ওটা লিখিনি!

ইয়ে–দাঁড়াও–মানে, আমি ভুলে গিয়েছিলাম, গত রাতে ওটা শেষ করে ফেলেছি!

চমৎকার, তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে! বলল নেভিল, ওর গোল মুখটায় উদ্বেগ। ওই রসুন সম্পর্কিত ব্যাপারটা আমি কিছুই বুঝি না–ওটা কি খেতে হয়, অথবা

কথা বন্ধ করে দিল নেভিল, হ্যারির কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে।

স্নেইপ। হ্যারির পেছনে গিয়ে দাঁড়াল নেভিল।

এবং তোমরা দুজন এখানে কী করছ? বললেন স্নেইপ, ওদের সামনে দাঁড়িয়ে, একবার একে একবার ওকে দেখে। দেখা করার জন্যে একটা খুব অদ্ভুত জায়গা।

হ্যারির অস্বস্তির মধ্যে, স্নেইপের কালো চোখ জোড়া ওদের দুজনের দুদিকের দরজা ঘুরে একচক্ষু ডাইনিটার ওপর এসে স্থির হলো।

আমরা এখানে অপেক্ষা করছি না, বলল হ্যারি। এখানে আমাদের দেখা হয়ে গেছে।

সত্যিই? বললেন স্নেইপ। অস্বাভাবিক জায়গাগুলোতে, যেখানে কখনই তোমাকে আশা করা হয় না, সেখানেই দেখা দেয়ার তোমার একটা অভ্যাস রয়েছে, পটার, এবং কোন কারণ ছাড়াই সেখানে তোমাকে পাওয়া যায়… আমি প্রস্তাব করছি তোমরা দুজন গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে ফিরে যাও, ওখানেই তোমাদের জায়গা।

আর কোন কথা না বলে হ্যারি আর নেভিল রওনা হয়ে গেল।

কোণাটা ঘোরার আগে পেছনে ফিরে হ্যারি দেখল স্নেইপ একচক্ষু ডাইনিটার মাথায় হাত দিয়ে খুব কাছে থেকে পরীক্ষা করে দেখছেন।

স্থূলকায়া মহিলার ওখানে পাসওয়ার্ডটা বলে নেভিলকে কাটিয়ে দিল হ্যারি, ওকে বলল যে ভ্যাম্পায়ারের রচনাটা লাইব্রেরিতে ফেলে এসেছে। দৌড়ে গেল হ্যারি। নিরাপত্তা দলটিকে পেরিয়ে আবার ম্যাপটা বের করল পকেট থেকে, চোখের খুব কাছে ধরল ওটা।

তৃতীয়তলার করিডোরটা মনে হচ্ছে একেবারেই জনশূন্য। ম্যাপটা ভালো করে স্ক্যান করে দেখল, স্বস্তি পেল, সেভেরাস স্নেইপ লেখা ছোট্ট বিন্দুটা ওর অফিসে ফিরে গেছে।

দৌড়ে একচক্ষু ডাইনিটার কাছে গেল, ওর কুজটা খুলে নিজেকে ভেতরে নামিয়ে দিল, কিছুদূর যাওয়ার পর ওর ব্যাগটা পেল। ম্যাপ থেকে লেখা মুছে দিয়ে দৌড় শুরু করল হ্যারি।

***

অদৃশ্য হওয়ার জামাটার নিচে সম্পূর্ণ লুকনো হ্যারি হানিডিউকসের বাইরে গিয়ে উপস্থিত হলো, পেছন থেকে খোঁচা মারল রনকে।

আমি, বিড় বিড় করে বলল।

এত দেরি হলো কেন? রন বলল ফিসফিস করে।

স্নেইপ ঘোরাফেরা করছিলেন আশেপাশে…

হাই স্ট্রিট ধরে ওরা রওনা হয়ে গেল।

কোথায় তুমি? রন বার বার ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করছে। তুমি এখনও আছো? এই বোধটা কেমন যেন অদ্ভুত…।

ওরা পোস্ট অফিসে গেল; রন এমন একটা ভান করল যেন মিসরে সে একটা পেঁচা পাঠাবে তার খরচ জানার চেষ্টা করছে, যেন হ্যারি চারদিকটা ভালো করে ঘুরে দেখতে পারে। প্রায় তিনশ পেঁচা, বসে বসে আস্তে আস্তে ডাক ছাড়ছে; গ্রেট গ্রে থেকে শুরু করে ছোট্ট স্কপ পেঁচা (স্থানীয়ভাবে ব্যবহারের জন্য), এগুলো এতো ছোট যে হ্যারির হাতের তালুতে একেকটাকে রাখা যায়।

এরপর ওরা জঙ্কোতে গেল, ওখানে এত ভিড় যে খুব সাবধানে এগোলো হ্যারি, যেন কারো সঙ্গে ধাক্কা না লাগে, কারো পা মাড়িয়ে না যায়, যেন কোনরকম আতঙ্কের সৃষ্টি না হয়। ওখানে নানা রকমের খেলা হচ্ছে, চুটকি চলছে যেগুলো ফ্রেড এবং জর্জ স্বপ্নেও ভাবতে পারে না; ফিসফিস করে রনকে নির্দেশ দিচ্ছে হ্যারি জিনিস কেনার জন্যে আর কাপড়ের নিচ দিয়ে ওর হাতে কিছু সোনার কয়েন খুঁজে দিচ্ছে। ভেতরে ঢোকার সময় ওদের মানিব্যাগ ভরাই ছিল, জঙ্কো থেকে বেরুবার সময় সেগুলো বেশ হালকা লাগছে। ওদের পকেট ভর্তি ডাং–বোমা, হেঁচকি–মিঠাই, বেঙাচি সাবান এবং প্রত্যেকের জন্য একটা করে নাক–কামড়ানো চায়ের কাপ নিয়ে বেরিয়েছে।

দিনটা পরিষ্কার ফুরফুরে, কেউই ঘরের ভেতরে থাকতে চাইছে না, থ্রি মস্টিক পেরিয়ে একটা ঢাল বেয়ে ওরা ব্রিটেনের সবচেয়ে ভূতুড়ে বাড়ি স্রিকিং শ্যাক দেখতে গেল। গ্রামের অন্য বাড়িগুলোর চেয়ে একটু উপরে এবং দিনের বেলায়ও কেমন যেন গা–ছমছম করে ওঠে, তক্তা মারা জানালা এবং স্যাঁতসেঁতে বাগানওয়ালা বাড়িটা।

হোগার্টর্স-এর ভূতগুলোও এ বাড়িটা এড়িয়ে চলে, বলল রন, বেড়ার উপরে হেলান দিয়ে গল্প করছে ওরা। আমি একবার এ ব্যাপারে প্রায় মাথাবিহীন নিককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম… ও বলেছে যে এ বাড়িটাতে এক দঙ্গল উগ্র মেজাজের লোক থাকে। কেউ ভেতরে যায় না। ফ্রেড এবং জর্জ একবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ভেতরে যাওয়ার সবগুলো দরজা বন্ধ…।

উপরে ওঠার কারণে হ্যারির গরম লাগছে, ভাবছিল আলখাল্লাটা খুলে ফেলবে। ঠিক ওই সময় কাছেই কয়েকটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল কারা যেন অন্যদিক থেকে বাড়িটার দিকে উঠে আসছে; কয়েক মুহূর্ত পরে ম্যালফয় উঠে এল, ওর খুব কাছে থেকে পেছনে পেছনে ক্রে এবং গয়ল। কথা বলছিল ম্যালফয়।

…যেকোন মুহূর্তে বাবার পাঠানো পেঁচাটা আসতে পারে। আমার হাত সম্পর্কে শুনানিতে তার যাওয়ার কথা ছিল কিভাবে তিন মাস এ হাতটা আমি ব্যবহার করতে পারিনি।

ক্রেব এবং গয়ল চাপা বিদ্রুপের হাসি হাসল।

আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল ওই বিশাল দেহের লোমশ মানুষটা কিভাবে পক্ষ সমর্থন করে সেটা দেখার… সজ্যিই বলজি ওগুলো বিপজ্জনক লয় ওই হিপোগ্রিফটা মারাই যাবে।

হঠাৎ রনকে দেখতে পেল ম্যালফয়। ওর ফ্যাকাশে মুখটা প্রতিহিংসায় জ্বলে উঠল।

এখানে কি করছ উইজলি?

রনের পেছনের ভূতুড়ে বাড়িটার দিকে তাকাল ম্যালফয়।

মনে হচ্ছে ওখানে থাকতে পেলে তুমি খুশিই হতে, তাই না, উইজলি? তোমার নিজের একটা বেডরুমের স্বপ্ন দেখছ? আমি শুনেছি তোমাদের গোটা পরিবারটাই এক রুমে ঘুমায়-এটা কী সত্যি?

লাফ দিতে যাচ্ছিল রন, পেছন থেকে কাপড় টেনে সামলে নিল হ্যারি।

ওটাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও, ফিসফিস করে রণের কানে বলল ও।

সুযোগটা এতোই ভালো যে হারানো যায় না। চুপিচুপি ম্যালফয়, ক্রেব এবং গয়ল-এর পেছনে গেল হ্যারি, নিচু হয়ে রাস্তা থেকে হাত ভর্তি মাটি তুলে নিল।

আমরা এই মাত্র তোমাদের জন্য হ্যাগ্রিড সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম, ম্যালফয় রনকে বলল। এই ভাবার চেষ্টা করছিলাম আরকি, ও কমিটি ফর দি ডিসপোজাল অফ ডেঞ্জারাস ক্রিয়েচার্স-এর কাছে কি বলছে। তুমি কি মনে কর হিপোগ্রিফটার পা যখন ওরা কাটবে তখন কী হ্যাগ্রিড কাঁদবে

স্প্যাট!

একতাল কাদা ম্যালফয়ের মাথায় এসে লাগল, মাথাটা ঝুঁকে গেল সামনের দিকে; ওর রূপালী চুল হঠাৎ করে কাদাপানিতে ভরে গেল।

কী–যে?

রনের এত জোরে হাসি পেল যে দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে ওকে বেড়াটা জোরে আঁকড়ে ধরতে হলো। ম্যালফয়, ক্রেব এবং গয়ল বোকার মতো ওই জায়গাটায় খালি ঘুরছে, চারদিকে খুঁজছে পাগলের মতো কে মারল কাদাপানি, মাথার চুল মুছে পরিষ্কার করার চেষ্টা করল ম্যালফয়।

কী হচ্ছে এটা? কে করছে এরকম?

এটা একটা ভূতুড়ে জায়গা তাই না? বলল রন, যেন বাতাসের উদ্দেশ্যে কথাটা বলল।

ভয় পেয়ে গেছে ক্রেব আর গয়ল। ভূতের বিরুদ্ধে ওদের মোটাসোটা মাসলগুলো কোন কাজেই আসবে না। খা খা শূন্য চারদিকে পাগলের মতো তাকিয়ে আছে ম্যালফয়।

হ্যারি চুপিচুপি ছোট্ট একটা পানির গর্তের কাছে গেল ওটা থেকে দুর্গন্ধে ভরা তেলতেলা কাদা তুলে নিল।

স্প্ল্যাটার!

এবার লাগল ক্রেব আর গয়ল-এর গায়ে। পাগলের মতো লাফাতে শুরু করল গয়ল, ওর ছোট ছোট চোখ থেকে কাদা সরানোর চেষ্টা করছে।

ওটা ওদিক থেকে আসছে! বলল ম্যালফয়, নিজের মুখটা মুছে হ্যারির থেকে ছফিট বায়ে একটি জায়গা দেখিয়ে।

অন্ধের মতো সামনে যাওয়ার চেষ্টা করল ক্রেব, দুহাত দুদিকে প্রসারিত। ওর পাশ ঘেঁষে এড়িয়ে গেল হ্যারি, ছোট্ট একটা লাঠি তুলে নিল, ছুঁড়ে দিল ওটা ক্রেব-এর পিঠের উপর। পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে শূন্যে এক পা ঘুরে এলো ক্রেব, দেখার চেষ্টা করল লাঠিটা কে ছুঁড়েছে, নীরব হাসিতে ফেটে পড়ল হ্যারি। এবং যেহেতু রনকেই দেখা যাচ্ছে ওদের বাইরে একমাত্র ব্যক্তি, রনের দিকেই ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল সে, পা বাড়িয়ে দিল হ্যারি, হোঁচট খেয়ে পড়ল সে এবং তার বিশাল একটা পা হ্যারির জামাটার একটা কোণায় জড়িয়ে গেল। বড় একটা টান অনুভব করল হ্যারি এবং তার মুখ থেকে সরে গেল আলখাল্লাটা।

এক মুহূর্তের জন্য, ম্যালফয় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ওর দিকে।

আআআরঘ! চেঁচিয়ে উঠল সে, হ্যারির মাথার দিকে আঙুল তুলে। এরপর উধ্বশ্বাসে লেজ তুলে পালাল, ওর পেছন পেছন ক্রেব আর গয়ল ছুটছে।

হ্যারি আবার আলখাল্লাটা পরে নিল, কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে।

হ্যারি! বলল রন, একটু হোঁচট খেয়ে সামনে এগিয়ে যেখানে হ্যারি অদৃশ্য হয়ে গেল সেদিকে তাকিয়ে, মনে হয় তোমার তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত! ম্যালফয় যদি কাউকে কিছু বলার সুযোগ পায়–দ্রুত, ফিরে যাও

আবার দেখা হবে, বলল হ্যারি। আর কোন কথা না বলে হগসমিড-এর দিকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে।

যা দেখেছে, ম্যালফয় কী সেটা বিশ্বাস করবে? অন্য কেউ কী ম্যালফয়কে বিশ্বাস করবে? অদৃশ্য হওয়ার জামাটার কথা আর কেউ তো জানে না–ডাম্বলডোর ছাড়া আর কেউ নয়। হ্যারির পেট যেন কামড়ে উঠল–ডাম্বলডোর বুঝতে পারবে না ঠিক কি ঘটেছিল, যদি ম্যালফয় তাকে কিছু বলে

 হানিডিউকস-এ ফিরে সেলারের ধাপগুলো পেরিয়ে পাথরের মেঝের পর লুকনো দরজা পেরিয়ে, হ্যারি ওর জামাটা খুলে ফেলল, হাতের নিচে গুঁজে দৌড়াতে শুরু করল প্যাসেজটা ধরে যদি ম্যালফয় আগে ফিরে আসে একজন শিক্ষককে পেতে তার কতক্ষণ লাগবে? হাপাচ্ছে হ্যারি, একদিকে ব্যথাও করছে, কিন্তু গতি কমালো না একেবারে পাথরের দরজায় না পৌঁছানো পর্যন্ত। জামাটা যথাস্থানে রেখে দিতে হবে, যদি ম্যালফয় কোন শিক্ষককে বলতে পারে ওটার কথা তাহলে ওর বড় একটা ক্ষতি হয়ে যাবে। একটা অন্ধকার কোণায় ওটাকে লুকিয়ে রেখে উপরে উঠতে শুরু করল সে, যত দ্রুত সম্ভব, ঘামেভেজা হাত বারবার পিছলে যাচ্ছে। অবশেষে একচক্ষু ডাইনিটার কুজের ভেতরে পৌঁছাল সে, জাদুর কাঠি দিয়ে ওটা স্পর্শ করল। খুলে পেল ওটা। মাথা বের করে নিজেও বেরিয়ে এল, কুজটা বন্ধ হয়ে গেল। এবং যে মুহূর্তে মূর্তিটার পেছন থেকে হ্যারি বেরিয়ে এল ঠিক সেই সময় সে শুনতে পেল এগিয়ে আসা পদধ্বনি।

স্নেইপ আসছেন। দ্রুত হেঁটে হ্যারির সামনে দাঁড়ালেন, তার কালো পোশাক দুলছে।

তাহলে, বললেন তিনি।

ওর মধ্যে একটা চাপা বিজয়ের ভাব দেখা যাচ্ছে। হ্যারি একটা নির্দোষ ভাব ধরে থাকল, যদিও সে তার ঘর্মাক্ত চেহারা আর কাদামাখা হাত সম্পর্কে সচেতন, তাড়াতাড়ি হাত দুটো পকেটে ভরে ফেলল।

পটার, আমার সঙ্গে এসো, বললেন স্নেইপ।

নিচতলায় ওকে অনুসরণ করে গেল হ্যারি, যেতে যেতে স্নেইপের অলক্ষ্যে হাত দুটো নিজের পোশাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। নিচতলার অন্ধকার কারা কক্ষ পেরিয়ে সেইপের অফিসে গেল।

এখানে হ্যারি এর আগে মাত্র একবার এসেছিল, এবং ওই সময়ও সে গুরুতর সমস্যায় পড়েছিল। দেখা যাচ্ছে গত বারের পর ওর জারে স্নেইপ আরও কয়েকটি ভয়ঙ্কর জিনিস সংগ্রহ করেছেন, সবগুলো জার ওর ডেস্কের পেছনে সেলফে রয়েছে, ঘরের আগুনে চকমক করছে।

বস, বললেন স্নেইপ।

হ্যারি বসল। স্নেইপ, অবশ্য দাঁড়িয়েই থাকলেন।

এইমাত্র একটা অদ্ভুত গল্প নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে গেছেন মিস্টার ম্যালফয়, পটার, বললেন স্নেইপ।

কিছুই বলল না হ্যারি।

ও বলে গেছে যে শ্ৰিকিং শ্যাক-এ ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল উইজলির–দৃশ্যত উইজলি একাই ছিল।

তারপরও, কথা বলল না হ্যারি।

মিস্টার ম্যালফয় বলেছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ও যখন উইজলির সঙ্গে কথা বলছিল তখন বিরাট একটা কাদার দলা ওর পেছন থেকে মাথায় এসে লাগল। তোমার কি মনে হয় এটা কীভাবে ঘটেছিল?

অবাক হওয়ার ভান করল হ্যারি।

আমি জানি না প্রফেসর।

স্নেইপের দৃষ্টি যেন হ্যারিকে এফোড় ওফোড় করে ফেলছে। যেন একটা হিপোগ্রিফকে দৃষ্টি দিয়ে কাবু করা আর কি। প্রবল চেষ্টা করছে হ্যারি যেন চোখের পাতা না পড়ে।

তারপর একটা অসাধারণ ভূত দেখতে পেল মিস্টার ম্যালফয়। তুমি কী ধারণা করতে পার ওটা কী ছিল, পটার?

না, বলল হ্যারি, চেষ্টা করল যেন ওর নির্দোষ ঔৎসুক্য প্রকাশ পায়।

ওটা ছিল তোমার মাথা, পটার। বাতাসে ভাসছে।

দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল ঘরে।

যদি এরকম কিছু দেখে থাকে তাহলে ওর উচিত মাদাম পমফ্রের কাছে যাওয়া, বলল হ্যারি।

পটার, হগসমিডে তোমার মাথাটা কী করছিল? নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন স্নেইপ। হগসমিডে তো তোমার মাথা যাওয়ার অনুমতি নেই। তোমার দেহের কোন অংশেরই যাওয়ার অনুমতি নেই।

আমি জানি সেটা, বলল হ্যারি, প্রাণপণ চেষ্টা করছে চেহারা থেকে ভয় আর দোষের ভাব সরিয়ে রাখতে। মনে হচ্ছে যেন ম্যালফয়ের দৃষ্টিভ্রম ঘটেছে।

ম্যালফয়ের কোন দৃষ্টিভ্রম হয়নি, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন স্নেইপ, ঝুঁকলেন, হ্যারির চেয়ারে হাতল দুটিতে দুহাত রাখলেন, তাদের মুখ এখন এক ফুট দূরত্বের মধ্যে। যদি তোমার মাথাটা হগসমিডে গিয়ে থাকে, তাহলে শরীরের বাকিটাও গেছে।

আমি গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে ছিলাম, বলল হ্যারি। যেমনটি আপনি বলেছিলেন

কেউ এটা কনফার্ম করতে পারবে?

হ্যারি কিছু বলল না। স্নেইপের সরু মুখটা ভয়াবহ একটা হাসিতে বেকে গেল।

তাহলে,আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ম্যাজিক মন্ত্রণালয়ের সকলেই বিখ্যাত হ্যারি পটারকে সাইরিয়াস ব্ল্যাক-এর হাত থেকে নিরাপদে রাখতে চাইছে। কিন্তু বিখ্যাত হ্যারি পটার নিজেই নিজের আইন। সাধারণ লোককে তার নিরাপত্তা সম্পর্কে ভাবতে দাও! বিখ্যাত হ্যারি পটার যেখানে খুশি সেখানেই যাবে, পরিণতির কথা না ভেবে।

চুপ করে থাকল হ্যারি। সত্যিটা বলার জন্যে ওকে খোঁচাচ্ছেন স্নেইপ। পারবেন না তিনি। এখন পর্যন্ত তার হাতে কোন প্রমাণ নেই।

তোমার বাবার মতো তুমি কতই না অসাধারণ, হঠাৎ বললেন স্নেইপ, চোখ জোড়া জ্বলছে। তিনিও অত্যন্ত একগুঁয়ে ছিলেন। কুইডিচ পিচে সামান্য কিছু প্রতিভা থাকায় ভাবতেন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বড় তিনি, বন্ধু বান্ধব এবং ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে এখানে সদর্পে ঘুরে বেড়াতেন তার সঙ্গে তোমার একটা উদ্ভট মিল রয়েছে।

আমার বাবা সদর্পে ঘুরে বেড়াতেন না, বলল হ্যারি, নিজেকে সামলে উঠবার আগেই। এবং আমিও ওরকম করি না।

তোমার বাবাও খুব বেশি নিয়ম মেনে চলতেন না, বলে চললেন স্নেইপ, যেন হ্যারির উপর একটু বেশি সুবিধা পেয়ে গেলেন, তার সরু মুখে বিদ্বেষ। আইন যেন সাধারণের জন্যে, কুইডিচ কাপ বিজয়ীদের জন্য নয়। ওর মাথাটা এত গরম হয়ে গিয়েছিল।

চুপ করন!

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরল হ্যারি। প্রিভেট ড্রাইভের শেষ সময়ে যেমন ক্রোধ তাকে পেয়ে বসেছিল ঠিক তেমনি ক্রোধ হচ্ছে এখন। স্নেইপের মুখটা শক্ত হয়ে গেল কি ওর কালো চোখ জোড়া বিপদজনকভাবে দ্যুতি ছড়াচ্ছে এর কোনটাই ও পাত্তা দিল না।

আমাকে কী বললে, পটার?।

আমার বাবা সম্পর্কে কিছু না বলার জন্য আপনাকে বলেছি! বলল হ্যারি চিৎকার করে। আমি সব কথা জানি, ঠিক আছে? তিনি আপনার জীবন রক্ষা করেছিলেন! ডাম্বলডোর আমাকে বলেছেন! আমার বাবা না থাকলে আপনিও এখানে থাকতেন না!

স্নেইপের ফ্যাকাশে চামড়া টক দইয়ের মতো বর্ণ ধারণ করল।

এবং কোন পরিস্থিতিতে তোমার বাবা আমার জীবন বাঁচিয়েছিল সেটা কী হেড মাস্টার তোমাকে বলেছেন? ফিসফিস করে বললেন স্নেইপ। নাকি বিস্তারিত ঘটনাটা মূল্যবান হ্যারি পটারের কানের জন্যে খুবই অপ্রিয় মনে করেছেন?

ঠোঁট কামড়ে ধরে আছেন হ্যারি। ও জানে না কি হয়েছিল কিন্তু এটা স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু মনে হয় সত্যতা ধারণা করেছেন স্নেইপ।

তোমার বাবা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা নিয়ে তুমি এখান থেকে চলে যাবে এটা আমি বরদাস্ত করব না, পটার, বললেন তিনি, একটা ভয়াবহ হাসি ওর মুখটাকে বাঁকা করে ফেলল। তুমি কী গৌরবজনক কোন ঘটনার কথা ভাবছ? তাহলে তোমার ভুলটা ঠিক করে দিই–তোমার বাবা এবং বন্ধুরা আমার সঙ্গে এমন একটা মজা করতে চেয়েছিল যে তাতে আমার মৃত্যু হতে পারতো, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তোমার বাবা পিছপা হয়ে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে বীরত্বের কিছু নেই। সে আসলে ওর নিজের চামড়া এবং আমার জীবন রক্ষা করেছিল। যদি ওই তামাশাটা সফল হতো তাহলে তাকে হোগার্টস থেকে বহিষ্কার করা হতো।

স্নেইপের অসমান, হলুদ দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে।

তোমার পকেট উল্টাও, পটার! হঠাৎ থুথু ফেলে বললেন স্নেইপ।

নড়ল না হ্যারি। কানের মধ্যে যেন বোমা ফেটেছে।

পকেট উল্টিয়ে দেখাও, না হয় আমরা সোজা যাচ্ছি হেড মাস্টারের কাছে! উল্টাও, পটার!

ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে হ্যারি, ধীরে ধীরে পকেট থেকে জঙ্কোর ব্যাগ এবং ম্যাপটা বের করল হ্যারি।

জঙ্কোর ব্যাগটা তুলে নিলেন স্নেইপ।

রন আমাকে ওগুলো দিয়েছিল, বলল হ্যারি, মনে মনে প্রার্থনা করছে যেন স্নেইপের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই এ সম্পর্কে রনকে ইঙ্গিত দিয়ে রাখতে পারে। সে–শেষবার যখন হগসমিড়ে গিয়েছিল তখন আমার জন্য নিয়ে এসেছিল

সত্যিই তাই? এবং তারপর থেকে ওগুলো তুমি বয়ে বেড়াচ্ছ তাই না? সত্যিই খুবই আবেগপূর্ণ ব্যাপার আর এটা কী?

ম্যাপটা তুলে নিলেন স্নেইপ। সর্বশক্তি দিয়ে চেহারাটাকে ভাবলেশহীন রাখার চেষ্টা করল হ্যারি।

পার্চমেন্টের একটা বাতিল টুকরা, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল সে। উল্টেপাল্টে ওটা দেখছেন স্নেইপ, চোখটা হ্যারির উপর।

এরকম প্রাচীন একটা পার্চমেন্টের তোমার নিশ্চয়ই দরকার নেই? বললেন তিনি। আমি এটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিই না কেন?

আগুনের দিকে ওর হাতটা উঠল।

না! দ্রুত বলল হ্যারি।

তাহলে! বললেন স্নেইপ, তার লম্বা নাকটা কাঁপছে। এটাও কি মিস্টার উইজলির দেয়া আরেকটি মূল্যবান উপহার? অথবা এটা কী–অন্য কিছু? একটি চিঠি, হয়তো, অদৃশ্য কালিতে লেখা? অথবা, ডিমেন্টরদেরকে এড়িয়ে হগসমিডে যাওয়ার নির্দেশাবলী?

হ্যারির চোখ পিটপিট করল। স্নেইপের চোখ জ্বলে উঠল।

আমাকে ভাবতে দাও, ভাবতে দাও… বিড়বিড় করলেন তিনি নিজের জাদুর কাঠিটা বের করলেন, ডেস্কের উপর ম্যাপটা সমান করে রাখলেন। তোমার গোপন কথা এবার খুলে বল! তিনি বললেন, পার্চমেন্টটাকে জাদুদণ্ড দিয়ে স্পর্শ করলেন।

কিছুই ঘটল না। হাতের কাঁপন থামাবার জন্য মুঠো করল হ্যারি।

আত্মপ্রকাশ কর! বললেন স্নেইপ, জাদুর কাঠি দিয়ে ম্যাপটাকে টোকা দিলেন।

তখনও পার্চমেন্টটা একেবারে সাদা। গভীর স্বস্তির শ্বাস নিচ্ছে হ্যারি ধীরে ধীরে।

প্রফেসর সেভেরাস স্নেইপ, স্কুলের শিক্ষক, তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছে তোমার মধ্যে যে সমস্ত তথ্য রয়েছে সেগুলো প্রকাশ করার জন্যে! বললেন স্নেইপ ম্যাপটাকে জাদুর কাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করে।

যেন একটা অদৃশ্য হাত এর উপর লিখে চলেছে, ম্যাপটার গায়ে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে লেখা।

প্রফেসর স্নেইপকে মিস্টার মুনির অভিনন্দন, এবং সবিনয়ে তার কাছে প্রার্থনা করছে যেন অন্যদের বিষয় থেকে নিজের অস্বাভাবিক লম্বা নাকটা দূরে রাখে।

যেন জমে গেলেন স্নেইপ। বজ্রাহতের মতো তাকিয়ে রয়েছে হ্যারি। কিন্তু ম্যাপটা থামল না। আরও লেখা ফুটে উঠতে লাগল।

মিস্টার মুনির সঙ্গে মিস্টার প্রংস একমত এবং যোগ করতে চান যে প্রফেসর স্নেইপ একজন কুৎসিত অপদার্থ ব্যক্তি।

ব্যাপারটা যদি গুরুতর না হতো তাহলে খুবই মজার হতো। এবং আরও রয়েছে…

মিস্টার প্যাডফুট তার বিস্ময় জানাতে চান যে, এরকম একটা ইডিয়ট কি করে প্রফেসর হতে পেরেছে!

ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল হ্যারি। যখন সে চোখ খুলল, ম্যাপটায় তখন শেষ শব্দগুলো লেখা হচ্ছে।

মিস্টার ওয়ার্মটেইল প্রফেসর স্নেইপকে দিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, এবং তাকে উপদেশ দিচ্ছে তার আঠালো চুলগুলো ধুয়ে ফেলার জন্য।

হ্যারি অপেক্ষা করল বজ্রটা পড়ার জন্য।

তাহলে… বললেন স্নেইপ। এ সম্পর্কে আমরা পরে দেখব…।

হেঁটে আগুনের কাছে গেলেন তিনি, একটা পাত্র থেকে একমুঠো চকচকে পাউডার নিলেন, আগুনে ছুঁড়ে দিলেন পাউডার।

লুপিন! আগুনের দিকে চেয়ে ডাকলেন স্নেইপ। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই!

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হ্যারি আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকল। ওর মধ্যে থেকে বিরাট একটা আকৃতি উঠে এল, ঘুরছে খুব দ্রুত। কয়েক মুহূর্ত পর প্রফেসর লুপিন আগুন থেকে উঠে এলেন, তার ময়লা কোট থেকে ছাই ঝাড়ুছেন।

আমাকে ডেকেছ সেভেরাস? মৃদুস্বরে বললেন লুপিন।

অবশ্যই আমি ডেকেছি, বললেন স্নেইপ, ক্রোধে তার মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। পা ফেলে ডেস্কের কাছে গেলেন। পটারকে আমি ওর পকেট খালি করতে বলেছিলাম। ওর পকেটে এটা পাওয়া গেছে।

পার্চমেন্টটার দিকে আঙুল তুলে দেখালেন স্নেইপ, তখনও ওটার উপরে মেসার্স মুনি, ওয়ার্মটেইল, প্যাডফুট এবং প্রংস লেখাগুলো চকচক করছে। লুপিনের চেহারায় একটা অদ্ভুত বিমূঢ় ভাব ফুটে উঠল।

তাহলে? বললেন স্নেইপ।

ম্যাপটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন লুপিন। হ্যারির মনে হলো খুবই দ্রুত কিছু চিন্তা করার চেষ্টা করছেন লুপিন।

তাহলে? আবার বললেন স্নেইপ। এই পার্চমেন্টটা কালো জাদুতে ভরা। এটা তোমার বিষয়, তুমি এ বিষয়ে দক্ষ। তোমার কি মনে হয় হ্যারি এমন একটা জিনিস কোথায় পেল?

লুপিন মুখ তুলে তাকালেন এবং হ্যারির দিকে চেয়ে সামান্য চোখের ইশারায় ওকে সাবধান করলেন, যেন মাঝপথে বাধা না দেয়।

কালো জাদুতে পরিপূর্ণ? মৃদুস্বরে পুনরাবৃত্তি করলেন লুপিন। আপনার কী তাই মনে হয়, সেভেরাস? আমার কাছে তো মনে হচ্ছে এটা নিছক একটা পার্চমেন্টের টুকরা, যেটা তাকেই অপমান করে যে এটাকে পড়ার চেষ্টা করে। ছেলেমানুষী আর কী, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই বিপদজনক নয়? আমার ধারণা কোন একটা জোক–শপ থেকে এটা পেয়েছে হ্যারি।

সত্যিই? বললেন স্নেইপ। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে তার। তোমার মনে হয় একা জোক–শপ ওকে এমন একটা জিনিস দেবে? তোমার কী মনে হয় না ও এটা সরাসরি প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে পেয়েছে?

স্নেইপ কী বলছেন হ্যারি বুঝতে পারছে না। দৃশ্যত লুপিনও বুঝতে পারছেন না।

তুমি কী বলতে চাচ্ছ, মিস্টার ওয়ার্মটেইল অথবা এদের কারো একজনের কাছ থেকে? বললেন তিনি। হ্যারি, তুমি এদের কাউকে চেন?

না, দ্রুত জবাব দিল হ্যারি।

দেখলে, সেভেরাস? বললেন লুপিন, স্নেইপের দিকে পেছন ফিরে। এটা মনে হচ্ছে যেন জঙ্কোর তৈরি।

সঠিক ইঙ্গিত, ঠিক এই সময় অফিসে ঢুকল রন। দম ফুরিয়ে গেছে ওর, স্নেইপের ডেস্কের একটু দূরেই থামল, ওর বুকের সেলাইটা খামছে ধরে হাপাতে হাপাতে কথা বলার চেষ্টা করছে সে।

আমি–ওটা–হ্যারিকে–দিয়েছিলাম, দম বন্ধ করে বলল সে। অনেক আগে ওটা কিনেছিলাম–জঙ্কো থেকে…।

বেশ! বললেন লুপিন, হাততালি দিয়ে, খুশিতে ঘুরে দাঁড়ালেন। মনে হচ্ছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেছে! সেভেরাস, আমি এটা নিয়ে যাব, যাব? ম্যাপটা ভাঁজ করে পকেটে রাখলেন লুপিন। হ্যারি, রন, আমার সঙ্গে এসো, তোমাদের সঙ্গে ভ্যাম্পায়ার রচনাটা সম্পর্কে কথা আছে। আমাদেরকে মাপ করো, সেভেরাস।

স্নেইপের অফিস থেকে বেরুবোর সময় ভুলেও ওর দিকে তাকায়নি হ্যারি। সে, রন এবং লুপিন একেবারে বাইরের হলঘর পর্যন্ত আসার আগে কোন কথা বলল না। তারপর হ্যারি ঘুরে লুপিনকে বলার চেষ্টা করল।

প্রফেসর, আমি।

আমি কোন ব্যাখ্যা শুনতে চাই না, বললেন লুপিন। শূন্য হলটার চারদিকে দেখে নিয়ে নিচু স্বরে বললেন, আমি জানি কয়েক বছর আগে এই ম্যাপটা মিস্টার ফিলচ বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। হ্যাঁ, আমি জানি এটা একটা ম্যাপ, বললেন তিনি বিস্মিত হ্যারি আর বনের দিকে তাকিয়ে। আমি জানতে চাই না এটা কিভাবে তোমাদের হাতে পড়েছে। তবে, আমি খুবই অবাক হয়েছি যে তোমরা এটা ফিরিয়ে দাওনি। বিশেষ করে, শেষ বার একজন ছাত্র পাসওয়ার্ড হারিয়ে ফেলার পর যে ঘটনা ঘটেছিল তারপরও। এবং এটা আমি তোমাকেও ফিরিয়ে দিতে পারি না, হ্যারি।

সেরকমই আশা করেছিল হ্যারি এবং প্রতিবাদ করার ব্যাপারে তার কোন ইচ্ছা নেই।

স্নেইপ কেন ভাবলেন যে ওটা আমি প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে পেয়েছি?

কারণ… ইতস্তত করলেন লুপিন, কারণ এ ধরনের ম্যাপ যারা তৈরি করেন তারা সাধারণত ভুলিয়ে ভালিয়ে তোমাকে স্কুল থেকে নিয়ে যায়। ওরা মনে করে এটা খুবই মজার।

আপনি কী তাদেরকে চেনেন? বলল হ্যারি।

আমাদের দেখা হয়েছে, লুপিন বললেন সংক্ষেপে। তিনি অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে গুরুতরভাবে হ্যারির দিকে তাকিয়ে আছেন।

এর পরের বার তোমাকে আমি বাঁচিয়ে দেব এটা আশা করো না হ্যারি। সাইরিয়াস ব্ল্যাক-এর বিষয়টা গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারে হয়তো আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না কিন্তু আমি ভেবেছিলাম ডিমেন্টাররা তোমার কাছে আসলে তুমি যা শুনতে পাও সেইসব শব্দাবলী তোমার উপর প্রভাব ফেলবে। হ্যারি, তোমার বাবা-মা জীবন দিয়ে গেছেন তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তাদের আত্মত্যাগের এই প্রতিদান–সামান্য কয়েকটা জাদুর কৌশল বা খেলা, এটা খুবই অন্যায্য।

হেঁটে চলে গেলেন লুপিন। হ্যারির বোধ হচ্ছে স্নেইপের অফিসে যতটা খারাপ লেগেছিল তার চেয়েও অনেক বেশি বিধ্বস্ত এখন সে। মার্বেল সিঁড়ি ধরে সে আর রন উঠে গেল। একচক্ষ ডাইনিটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অদশ্য হওয়ার আজামাটার কথা মনে করল–ওটা এখনও নিচে রয়ে গেছে, কিন্তু গিয়ে নিয়ে আসার সাহস পেল না সে।

সবই আমার দোষ, হঠাৎ বলল রন। আমি তোমাকে যেতে বলেছিলাম। লুপিন ঠিকই বলেছেন, ওটা বোকামিই হয়েছে, আমাদের ওরকম করা উচিত হয়নি।

থেমে গেল রন; করিডোরে পৌঁছে গেছে ওরা, নিরাপত্তা দলটা হাঁটছে, ওদের দিকে এগিয়ে আসছে হারমিওন। ওর দিকে এক নজর তাকিয়েই হ্যারি বুঝতে পারল সব ঘটনাই শুনতে পেয়েছে সে। হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল–ও কী প্রফেসর ম্যাকগোনাগলকে বলে দিয়েছে?

আমাদের দুর্দশায় হাসতে এসেছো? অভদ্রের মতো বলল রন, ওদের সামনে হারমিওন থামতেই। নাকি আমাদের কথা বলে দিয়ে এলে এইমাত্র?

না, বলল হারমিওন। ওর হাতে একটা চিঠি ধরা, ওর ঠোঁট কাঁপছে। ওর মনে হয়েছে তোমাদের জানা উচিত… মামলায় হেরে গেছে হ্যাগ্রিড। বাকবিককে হত্যা করা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *