০২. আন্ট মার্জ-এর বিরাট ভুল

০২. আন্ট মার্জ-এর বিরাট ভুল

পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে পৌঁছে হ্যারি দেখল ডার্সলি তিনজন আগেই টেবিল ঘিরে বসে গেছে। ওরা দেখছিল একেবারে আনকোরা নতুন একটি টেলিভিশন। গ্রীষ্মে বাড়ী এসেছে–তারই প্রেজেন্টেশন এই নতুন টেলিভিশন। বেচারার খুবই কষ্ট হতো বার বার ফ্রিজ থেকে টেলিভিশন পর্যন্ত হেঁটে যেতে। তাতে সারাদিন বিরামহীন খাওয়ার আনন্দটাই মাটি। এখন বেশ হয়েছে খাওয়ার আর টেলিভিশন দেখা একই জায়গায়। গ্রীষ্মটা ডাডলি কাটিয়ে দিয়েছে শুয়োরের মতো কুতকুতে চোখচোড়া মিনি পর্দার দিকে তাকিয়ে থেকে আর মুখ নেড়ে বিরামহীন খাওয়ার মধ্য দিয়ে।

ডাডলি আর গুঁফো আংকল ভারননের মাঝখানে বসল হ্যারি। ওরা কেউ হ্যারিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা তো জানালই না, খেয়ালও করল না যে সে ঘরে ঢুকেছে। যাকগে, এসবে হ্যারির অভ্যাস হয়ে গেছে। একটা টোস্ট তুলে নিয়ে টিভির দিকে তাকাল সে। খবর হচ্ছে। সংবাদ পাঠক একজন পলাতক আসামী সম্পর্কে কি যেন বলছে।

জনসাধারণকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে যে ব্ল্যাক সশস্ত্র অবস্থায় রয়েছে এবং অত্যন্ত বিপদজনক। একটি হটলাইন স্থাপন করা হয়েছে। ব্ল্যাককে দেখা মাত্র সেখানে জানাতে হবে।

খবরের কাগজের উপর দিয়ে মুখ বের করে মুখ ভেংচে ভারনন আংকল বলল, ও ব্যাটা যে কতো বদমাশ তার ফিরিস্তি আর দিতে হবে না। টেবিলের ওপর বিরাট থাবার ঘুষি মেরে বলল, কখন আর ব্যাটারা শিখবে যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়াই এধরনের লোকদের জন্য একমাত্র দাওয়াই।

রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে আন্ট পেটুনিয়া বলল, ঠিক বলেছ। হ্যারি জানে হটলাইনে ব্ল্যাক সম্পর্কে কোন খবর দিতে পারলে আন্টির চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না। বিশ্বের সবচেয়ে বিরক্তিকর এই মহিলার সবচেয়ে বেশি সময় কাটে নিরীহ পাড়া প্রতিবেশীর ওপর গোয়েন্দাগিরি করে।

চায়ের কাপটা গলায় উপুড় করে আংকল ভারনন ঘড়ি দেখেই লাফিয়ে উঠল, আমি বরং রওনা হয়ে যাই মার্জ-এর ট্রেনটা ঠিক দশটায় পৌঁছবে।

হ্যারির মাথায় এতক্ষণ ওপর তলায় রেখে আসা ব্রুমস্টিক সার্ভিসিং কিট-এর কথাই ঘোরাফেরা করছিল। হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খেয়ে বাস্তবে ফিরে এলো, আন্টি মার্জ! নিশ্চয় তিনি আসছেন না এখানে? আপনা আপনিই প্রশ্নটা হ্যারির মুখ থেকে বের হয়ে এলো।

আন্টি মার্জ হচ্ছে আংকল ভারননের বোন। এবং সারাজীবন ধরেই আন্টি যদিও তার সঙ্গে কোন রক্তের সম্পর্ক নেই, হ্যারিকে (যার মা আন্ট পেটুনিয়া বোন) এই মহিলা ডাকতে বাধ্য করেছে। মার্জ আন্ট থাকে গ্রামে, বাড়ীতে রয়েছে বিশাল বাগান, যেখানে সে বুলগের খোয়াড় করেছে। কুকুরের ভালোবাসার জন্যে এখানে এসে বেশিদিন থাকতে পারে না ঠিকই, কিন্তু তার প্রতিবারের আসার ভয়াবহ স্মৃতি হ্যারিকে তাড়িয়ে বেড়ায় সবসময়ই।

ডাডলির পঞ্চম জন্মদিনে এই মহিলা তাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছিল। তার অপরাধ ছিল ডাডলি তার সাথে মিউজিক কম্পিটিশনে পারছিল না। তাকে পিটিয়ে থামিয়ে দিয়েছিল আন্টি মার্জ। একবার ক্রিস্টমাস প্রেজেন্টেশন নিয়ে এলো, ডাডলির জন্যে কম্পিউটারাইজড রোবট আর হ্যারির জন্যে কুকুরের বিস্কিট। যে বছর সে হোগার্টস-এ গেল তার আগের বছরই শেষ এসেছিল আন্টি মার্জ। সেবার ভুলে সে মার্জ-এর প্রিয় কুকুর রিপারের পা মাড়িয়ে দিয়েছিল। আর যায় কোথায়, বিচ্ছ কুকুরটা ওকে তাড়াতে তাড়াতে বাগান পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে একেবারে গাছে উঠিয়ে ছাড়ল। কুকুরটা গাছের নিচে বসে থাকল রাত বারোটা পর্যন্ত। ওকেও থাকতে হলো গাছের ওপর। এর আগে কিছুতেই আন্টি মার্জ কুকুরটাকে ডেকে নিয়ে ওকে গাছ থেকে নামার সুযোগ করে দেয়নি। এ ঘটনা মনে করে এখনও ডাডলি হাসতে হাসতে চোখে এনে ফেলে।

মার্জ এখানে এক সপ্তাহ থাকবে এবং আমি তাকে আনতে যাওয়ার আগে কয়েকটা বিষয় মাথায় ঢুকিয়ে নাও, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল আংকল ভারনন, টিভি থেকে চোখ ফেরালো ডাডলি। বাপ দুর্বল হ্যারিকে দাঁতমুখ খিচাচ্ছে এটা ডাডলির সবচেয়ে কাংখিত বিনোদন।

প্রথম, গর্জন করে উঠল আংকল ভারনন, মার্জ-এর সঙ্গে কথা বলার সময় তোমার জিহ্বাটাকে ভদ্রোচিত রাখবে।

ঠিক আছে, তিক্তভাবে বলল হ্যারি, যদি সে আমার সাথে কথা বলার সময় ঠিক তাই করে।

দ্বিতীয়ত, আবার শুরু করল আংকল ভারনন যেন হ্যারির জবাবটা শুনতেই পায়নি, মার্জ তোমার অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে কিছুই জানে না। সে যতদিন থাকবে আমি কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখতে চাই না, বুঝলে, নিজের আচরণ ঠিক রাখবে।

আমি রাখবো যদি সেও রাখে, দাঁত কিড়মিড় করে বলল হ্যারি।

এবং তৃতীয়ত, এখন ভারনন আংকেলের চোখ দুটো কুতকুত করছে ওর বেগুনি মুখের ওপর, আমরা মাকে বলেছি তোমাকে সংশোধন করা যায় না এমন পিচ্চি অপরাধীদের সেন্ট ব্রুটাস সিকিওর সেন্টারে দেয়া হয়েছে।

কি! চিৎকার করে উঠল হ্যারি।

এবং তোমাকেও একই কথা বলতে হবে, নাহলে তোমার কপালে দুঃখ আছে বুঝলে হে ছোকরা, থু! মুখের জমানো থুথু ফেলল আংকল ভারনন।

রাগে হ্যারি একবারে লাল হয়ে গেল। একদৃষ্টিতে আংকল ভারননের দিকে চেয়ে আছে, এখনও কথাটা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। মার্জ আন্টি এক সপ্তাহের জন্যে এখানে আসছে, এটা হচ্ছে ডার্সলিদের দেয়া জন্মদিনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রেজেন্ট, এমনকি আংকেল ভারননের দেয়া পুরনো সেই মোজা জোড়ার চেয়েও।

ডাডলির থলথলে কাঁধের ওপর দুটো স্নেহের চাপড় দিয়ে রওয়ানা দেয়ার জন্যে পা বাড়ালো আংকেল ভারনন।

হ্যারি বসেছিল ভীত সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে, হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। হাত থেকে টোস্টটা ফেলে সে আংকেল ভারননের পেছন পেছন সামনের দরজায় চলে এলো।

আংকেল কোট পড়ছিল।

আমি তোমাকে নিচ্ছি না, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল।

যেন আমি যেতে চাচ্ছি, হ্যারির রেডিমেড জবাব, আমি তোমার কাছে একটা জিনিস চাচ্ছি।

সন্দেহে চোখ সরু করে আংকেল ভারনন তাকাল তার দিকে।

হ্যারি দ্রুত বলল, আমাদের স্কুলের মানে হোগার্টস-এর তৃতীয় বছরে কখনও কখনও হগসমিড-এ নিয়ে যায়।

তাকে কি? ঠাস করে বলল আংকল ভারনন দরজার হুক থেকে গাড়ির চাবিটা নিতে নিতে।

তোমাকে আমার অনুমোদন পত্রটায় সই দিতে হবে।

আমি কেন সই করব, খিট খিট করে উঠল আংকল।

বেশ, খুব সতর্কভাবে শব্দ বেছে বেছে জবাবটা দিল হ্যারি, মার্জ আন্টির কাছে। ভান করা খুবই কঠিন হবে যে আমি ওই সেন্ট কি যেন নামটা স্কুলে।

সংশোধন করা যায় না এমন ক্ষুদে অপরাধীদের জন্য সেন্ট ব্রুটাস সিকিওর সেন্টার, চীৎকার করে উঠল আংকল ভারনন। তৃপ্ত হলো হ্যারি আংকলের স্বরে ভয়ের চিকণ একটা সুর আনতে পেরেছে বলে।

ঠিক তাই, বলল হ্যারি আংকল ভারননের বিশাল বেগুনি মুখটার দিকে চেয়ে, আমাকে অনেক কিছুই মনে রাখতে হবে। আমাকে সেটা বিশ্বাসযোগ্যও করতে হবে তাই না? কি হবে হঠাৎ করেই যদি আমার মুখ ফস্কে কিছু বেরিয়ে যায়?

ঘুষি উঁচিয়ে আংকল ভারনন হুংকার দিয়ে উঠল, পিটিয়ে নাড়িভুড়ি সব বের করে দেব হতচ্ছাড়া।

হ্যারি সাহস হারালো না। গম্ভীরভাবে বলল, আমাকে পিটিয়ে তক্তা বানালেও আমি যা বলব সেটা মার্জ আন্টি কোনদিনই ভুলবে না।

আংকল ভারনন মাঝপথে থেমে গল, ঘুষিটা তখনও উদ্যত। মুখটা কুৎসিৎ দেখাচ্ছে।

কিন্তু তুমি যদি আমার অনুমোদন পত্রটা সই করে দাও কসম খেয়ে বলছি তাহলে তোমাদের ওই বানানো স্কুলটার কথাই আমার মনে থাকবে, দ্রুত কথাটা শেষ করল হ্যারি। এবং আমি মাগ–মানে স্বাভাবিক মানুষের মতই আচরণ করব।

তখনও দাঁত বেরিয়ে আছে আংকল ভারননের, তার কপালের কাছে শিরাটাকে লাফাতে দেখে হ্যারি বুঝল খুব গভীরভাবে হ্যারির প্রস্তাব ভেবে দেখছে সে। ঠিক আছে, অবশেষে বলল সে, আমি তোমার দিকে সবসময় লক্ষ্য রাখব, যদি মার্জ এর থাকার সময়টা তুমি লাইন মতো চলো এবং যা বলেছি তাই বলো তবে আমি তোমার ফালতু ফরমটায় সই করে দেবো। চট করে ঘুরে এতো জোরে দরজাটা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল আংকল, যে ওপরের জানালার একটি কাঁচ খসে পড়ল। হ্যারি আর রান্নাঘরে ফিরে না গিয়ে তার শোবার ঘরে গেল। তাকে একজন মাগল এর মতো আচরণ করতে হবে। এখন থেকেই শুরু করা যাক না। মনের দুঃখে সে তার জন্মদিনের সব প্রেজেন্টেশন, কার্ড নিয়ে হোমওয়ার্কের সাথে লুকিয়ে ফেলল আলগা করা ফ্লোরবোর্ডের নিচে। হেডউইগের খাঁচার কাছে গেল হ্যারি। মনে হয় এরল ভালো হয়ে গেছে। পাখার নিচে মাথা গুঁজে দুজনেই ঘুমাচ্ছিল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হ্যারি। খোঁচা দিয়ে দুজনকে জাগাল।

হেডউইগ এক সপ্তাহের জন্যে তোমাকে কেটে পড়তে হবে। হ্যারির স্বর ভারি। এরলের সাথে যাও। রন তোমাকে দেখে রাখবে। আমি একটা চিরকুট লিখে দেবো।

হেডউইগের বড় বড় চোখ থেকে রাগ ঝরে পড়ছে।

আমার দিকে অমন করে তাকিও না, এটা আমার দোষ নয়। শুধু এই ভাবেই রন আর হারমিওনের সাথে আমি হগসমিড-এ যাওয়ার পারমিশন পাবো।

দশ মিনিট পর এরল আর হেডউইগ জানালা দিয়ে বেরিয়ে উড়তে দূর দিগন্তে মিলিয়ে গেল। হেডউইথের পায়ের সাথে রনের জন্যে একটা চিঠি বাঁধা। হ্যারির এখন নিজেকে দুঃখী মনে হচ্ছে। শূন্য খাঁচাটা নিয়ে ওয়ার্ডরোবে রেখে দিল সে।

মন খারাপ করে বসে থাকার জন্যে বেশি সময় পেলো না হ্যারি। মুহূর্ত না যেতেই আন্টি পেটুনিয়ার চিলের মতো চিক্কার শোনা গেল। নিচে গিয়ে মহামান্য অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।

চুলটা ঠিক করো। হ্যারি হলে গিয়ে আন্টি পৌঁছতে না পৌঁছতে হুকুম জারি হলো। হ্যারি বুঝতে পারছে না চুল ঠিক করবার দরকারটা কি। মার্জ তো তাকে অপছন্দই করে, সে নোংরা ভুত হয়ে থাকবে আন্টি তো সেটাই চায়।

ড্রাইভ ওয়েতে গাড়ী থামার আওয়াজ হলো। গাড়ীর দরজা খুললো। দরজা বন্ধ হলো। বাগানের রাস্তায় পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল।

দরজাটা খোল! হিস হিস করে বলল আন্ট পেটুনিয়া।

হ্যারির পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠল। তবুও দরজাটা খুলতেই হলো।

দরজায় দাঁড়িয়ে আছে আন্ট মার্জ, একেবারে আংকল ভারননের মতো বিশাল শরীর, মাংসল আর বেগুনি মুখ, ওর গোঁফও আছে মনে হয়, অবশ্য সেটা তার ভাইয়ের মতো না। এক হাতে বিশাল স্যুটকেস অন্য হাতে বুড়ো একটা বদমেজাজি বুলডগ।

কোথায় আমার ডাডারস? গর্জন বের হলো মার্জ আন্টির উইন্ড পাইপ দিয়ে। কোথায় আমার ভাইয়ের ব্যাটাটা!

হেলতে দুলতে হল থেকে বেরিয়ে এলো ডাডলি, ব্লন্ড চুলগুলো মাথার সঙ্গে লেপটানো, থুতনির নিচ দিয়ে কোনরকমে উঁকিঝুঁকি মারছে একটা বোটাই। স্যুটকেসটা দিয়ে হ্যারিকে প্রায় পিষে ফেলে মার্জ আন্টি একহাতে কষে ডাডলির গলাটা জড়িয়ে ধরে তার গালে বিশাল এক চুমু খেল। হ্যারি জানে মার্জ আন্টির এই রাক্ষুসে সোহাগ ডাডলি সহ্য করে কারণ বিনিময়ে সে পুরস্কারটা ভালোই পায়। বস্তুত এই মুহূর্তে তার হাতে একটা কুড়ি পাউন্ডের নোট শোভা পাচ্ছে।

পেটুনিয়া মার্জ আন্টির আরেক হুংকার। এগিয়ে গেল আন্টি হ্যারিকে পাশ কাটিয়ে, যেন হ্যারি একটা হ্যাট স্ট্যান্ড। আন্টি মার্জ পেটুনিয়ার হাড্ডিসার চোয়ালের ওপর তার বিশাল মুখটা চেপে ধরল।

স্মিত হাস্যে এগিয়ে এসে দরজাটা বন্ধ করল আংকল ভারনন। চা চলবে মার্জ? বলল সে আর আমাদের রিপার কী খাবে?

রিপার আমার ওখান থেকেই চা খেয়ে নেবে। বলতে বলতে ওরা সকলেই হ্যারিকে স্যুটকেস হাতে দরজায় ফেলে রেখে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ একাকী দাঁড়িয়ে থেকে অত বড় স্যুটকেসটা টানতে টানতে হ্যারি দোতালার বাড়তি বেডরুমে গেল।

নিচে নেমে দেখে রান্নাঘরে মার্জ আন্টি চা আর ফুট কেক সাবাড় করছে, এক কোণে রিপার সড়াৎ সড়াৎ করে চা খাওয়ার কসরৎ করছে। ওকে দেখে গরগর করে উঠল রিপার।

হ্যারির দিকে নজর পড়ল মার্জ আন্টির।

এই যে এখনও এখানেই আছো? ঘেউ করে উঠল সে।

হ্যাঁ, হ্যারির ঠান্ডা জবাব।

ওরকম অকৃতজ্ঞের মতো হ্যাঁ বলবি না। ভারনন আর পেটুনিয়া বলে তোকে জায়গা দিয়েছে, আমি হলে তো কিছুতেই দিতাম না। সোজা এতিমখানায় পাঠিয়ে দিতাম।

মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করল হ্যারির যে ডার্সলিদের সঙ্গে থাকার চেয়ে এতিমখানায় থাকা অনেক ভালো। কিন্তু না, তাকে হাসমিডে যাওয়ার অনুমতি বাগাতে হবে। একটা কাষ্ঠ হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল হ্যারি।

হ্যারির সঙ্গে আচরণের ব্যাপারে মার্জ আন্টির সঙ্গে ভারনন আর পেটুনিয়ার একটা তফাৎ রয়েছে। ওরা দুজন কোন সময়ই চায় না হ্যারি চোখের সামনে থাকুক। কিন্তু মার্জ-এর ইচ্ছা হ্যারিকে সবসময়ই ওর চোখের সামনেই থাকতে হবে। যেন নানা ছলছুতায় ওকে অপমান করা যায়। ওর সামনে ডাডলির জন্যে দামি দামি প্রেজেন্টেশন কিনে ওর মনে দুঃখ দেয়া যায়। মার্জ যেন মনে মনে চায় একবার শুধু হ্যারি জিজ্ঞাসা করে দেখুক কেন তার জন্যেও প্রেজেন্টেশন কেনা হচ্ছে না, তাহলেই সে সুযোগ পেয়ে যায় হ্যারিকে যাচ্ছে তাই বলার।

.

দুপুরে খাবার টেবিলে মার্জ আন্টি বলেই ফেলল, তোমার আর কি দোষ ভারনন, জন্মেই যদি কারো দোষ থাকে তুমি আর কি করতে পারো।

হ্যারি না শোনার ভান করল কিন্তু তার তখন হাত কাঁপছে আর মুখ লাল হয়ে গেছে রাগে। মনে মনে সে নিজেকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করল। নিজেকে বলল অনুমোদন পত্রের কথা মনে কর, হগসমিড যাওয়ার কথা ভাবো, কিছু বলল না, উঠো না…

ওয়াইনের গ্লাসটা হাতে নিয়ে মার্জ বলল, আসলে এটা জন্ম তত্ত্বের মৌলিক একটি বিষয়। কুকুরের বেলায় দেখো যদি কুত্তিটার মধ্যে কোন গলদ থাকে তবে অবশ্যই বাচ্চার মধ্যেও একই গলদ থাকবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে মার্জ আন্টির হাতে ধরা ওয়াইনের গ্লাসটা ফেটে গেলো। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল উড়ন্ত গ্লাসের টুকরো আর ওয়াইনে ভিজে একাকার হয়ে ওর মুখটা একেবারে দেখার মতো হলো, চুঁইয়ে চুঁইয়ে ওয়াইন পড়ছে ওর বিশাল বেগুনি মুখটা থেকে।

মার্জ! তীক্ষ্ম চিৎকার বেরিয়ে এলো পেটুনিয়ার গলা চিরে,, তুমি ঠিক আছে তো।

ভয় পাবার কিছু নেই আমি ঠিক আছি, ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আশ্বস্ত করল সে, ওয়াইনের গ্লাসটা বোধহয় বেশি জোরে চেপে ধরেছিলাম।

কিন্তু হ্যারির আংকল আর আন্টি দুজনেই ততক্ষণে ওর দিকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। হ্যারি ঠিক করল পুডিং খাওয়া বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়াই ভালো।

বাইরের হলে গিয়ে ধাতস্থ হলো হ্যারির অনেকদিন পর সে এভাবে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালো। কাজটা উচিৎ হয়নি। শুধু যে হগসমিডে যাওয়া হবে না তাই নয়। ম্যাজিক মন্ত্রণালয়েও তাকে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। হ্যারি এখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক যাদুকর। আইন অনুসারে সে স্কুলের বাইরে ম্যাজিক প্রাকটিস করতে পারে না। অবশ্য তার রেকর্ড কখনই পরিষ্কার ছিল না। মাত্র গত বছরই সে মন্ত্রণালয় থেকে ওয়ার্নিং পেয়েছে, ওদের কাছে স্কুলের বাইরে ম্যাজিক করার সামান্যতম বাতাসও পৌঁছালে ওকে হোগার্টস থেকে বের করে দেয়া হবে।

খাবার টেবিল ছেড়ে ডার্সলিদের ওঠার শব্দ পেয়ে দ্রুত দোতালায় উঠে গেলো হ্যারি।

.

পরের তিনদিন মার্জ-এর শত উস্কানিতেও হ্যারি নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারায়নি। ভেতরের প্রাণপণ চেষ্টার কারণে বাইরে তার চেহারায় একটা খরখরে ভাব ফুটে উঠত। এই না দেখে মার্জ তো বলেই ফেলল সে মানসিকভাবে অর্ধেক স্বাভাবিক।

অবশেষে সেই কাংখিত সন্ধ্যাটি এলো, এই বাড়িতে মার্জ-এর শেষ সন্ধ্যা। কোন ঘটনা ছাড়াই ডিনারটা প্রায় শেষ হয়ে আসছিল। প্রচুর ওয়াইন খেয়েছে মার্জ। ভারনন ব্রান্ডির বোতল বের করল।

মার্জ তোমাকে একটু… জিনিসটা ভালো। প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করল আংকল ভারনন।

একটুখানি, বলল মার্জ, আর একটু আর একটুখানি দ্যটস আ গুড বয়…

ডাডলি তার চতুর্থ পাইটা খাচ্ছিল, আন্ট পেটুনিয়া কফির কাপে একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছিল। টেবিল ছাড়ার জন্যে উসখুস করছে হ্যারি। কিন্তু চোখ রাঙানি দিয়ে তাকে বসিয়ে রেখেছে আংকল। ডিনারের সময়টা পার করতেই হবে।

ব্র্যান্ডির খালি গ্লাসটা নামিয়ে রাখল মার্জ আহ! খাসা ডিনার হয়েছে পেটুনিয়া। নিজের বিশাল পেটের ওপর তৃপ্তির হাত বুলাল সে। আমি বড়সড় বাচ্চা পছন্দ করি। ডাডার তুমি নিশ্চয়ই তোমার বাবার মতো বিরাট এবং স্বাস্থ্যবান হবে।

কিন্তু এইদিকে দেখো, হ্যারির দিকে মাথা ঝাঁকালো মার্জ, হ্যারির পেট যেন খামছে ধরল। এটা দেখতে একবারে ছোটলোকের মতো। কুকুরের মধ্যে ওরকম থাকে। গত বছর আমি ওরকম একটা কুকুরকে ডুবিয়ে মেরেছি।

প্রথমে হ্যারি ভাবল ডু-ইট-ইওরসেলফ ব্রুম কেয়ার হ্যান্ড বুক সম্পর্কে, মনটাকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

মার্জ চালিয়ে যাচ্ছে, আমাকে আর একটা ব্রান্ডি দাও। যা বলছিলাম সেদিন, রক্তের মধ্যেই দোষ থাকে। আমি তোমার পরিবারের বিরুদ্ধে কিছু বলছি না পেটুনিয়া। কিন্তু তোমার বোনটা ছিল খারাপ ডিম। সবচেয়ে ভালো পরিবারগুলোর মধ্যেও এরকম এক আধজন থাকে। তারপর সে একটা বখাটের সঙ্গে ভেগে গেলো আর তার ফল তো দেখতে পাচ্ছি এই আমাদের সামনে বসে আছে।

হ্যারি তার প্লেটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

এই পটার, ব্র্যান্ডির বোতল থেকে আরো একটু ঢালল মার্জ, যতটা ঢালল তার চেয়ে বেশি টেবিলে ফেলল, ভারনন তোমরা তো আমাকে কোনদিনই বলোনি ওর বাপটা কি করত?

ও–ও মানে, হ্যারির দিকে চেয়ে বলল ভারনন, ও বেকার ছিল।

যেমন ভেবেছিলাম একটি অকম্মা, চাল নেই চুলো নেই কুড়ে একটা কাজ করেনি কখনো…

আমার বাবা সেরকম কিছু ছিল না, দৃঢ় স্বরে হ্যারি বলল। পুরো ডিনার টেবিলে পিনপতন স্তব্ধতা। হ্যারি রাগে কাঁপছে। জীবনে তার এরকম রাগ হয়নি।

আরো ব্র্যান্ডি?, চীৎকার করল ভারনন, ওকে একেবারে সাদা দেখাচ্ছে। আর্চির গ্লাসে বোতলটা উপুড় করে দিল। এই ছেলে যাও ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়।

না ভারনন না, একটা হেঁচকি তুলল মার্জ। ওকে বলতে দাও। ক্রুর চোখ জোড়া যেন হ্যারিকে এফোড় ওফোড় করে ফেলবে। বলে যা রে ছোঁড়া, বাপমায়ের জন্যে গর্ব হচ্ছে? গাড়ী অ্যাকসিডেন্টে যারা মারা গেছে–আশাকরি মাতাল ছিল দুটোই

ওরা গাড়ী অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়নি, হ্যারি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে।

ওরা অ্যাকসিডেন্টেই মারা গেছে পাঁজি মিথ্যুক কোথাকার! আর তোকে ছেড়ে গেছে তাদের নির্দোষ আত্মীয়দের বোঝা করে। তুই একটি বেয়াদপ অকৃতজ্ঞ…

হঠাৎ মার্জের কথা বন্ধ হয়ে গেলো এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো যেন সে কথা হারিয়ে ফেলেছে। মনে হলো রাগে সে ফুলছে এবং আশ্চর্য ফোলা কমছে না, সে কেবল ফুলেই চলেছে। ওর বিরাট বেগুনি মুখটা ফুলছে, কুতকুতে চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে এবং মুখটা ফুলে এত টান টান হয়ে গেছে যে কথা বলারও আর কোন উপায় নেই। পরমুহুতে টুইড জ্যাকেটের কয়েকটা বোতাম ছিঁড়ল পট পট করে-একটা দৈত্যাকার বেলুনের মতো মার্জ আন্টি ফুলেই চলেছে, পেটটা ফুলতে ফুলতে কোমড়ের বেল্টের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলল, আঙুল এক একটা ফুলে সত্যিকার অর্থেই কলা গাছ হয়ে গেল…

মার্জ! একসাথে চেঁচিয়ে উঠল ভারনন আর পেটোনিয়া। ফুলতে ফুলতে মার্জের রাক্ষুসি বপুটা চেয়ার ছেড়ে সিলিং-এর দিকে উঠতে শুরু করল। এখন সে পুরোপুরি গোল হয়ে গেছে। ওর হাত পা ঝুলছে অদ্ভুতভাবে, রিপার দৌড়ে ঘরে ঢুকল। পাগলের মতো ঘেউ ঘেউ করছে কুকুরটা।

নাআআআআ…

আংকল ভারনন মার্জ-এর পা ধরে টেনে নিচে নামানোর চেষ্টা করতে গেলে নিজেই ওর টানে ওপরে উঠে গিয়েছিল প্রায়। পরমুহূর্তে লাফিয়ে উঠে রিপার ওর পা কামড়ে ধরল। কেউ থামাবার আগেই হ্যারি সবেগে ঘর থেকে বের হলো, লক্ষ্য সঁড়ির নিচের কাপবোর্ড। কাছাকাছি পৌঁছতেই কাপবোর্ডের দরজাটা যাদুর গুণে আপনাআপনি খুলে গেল। এক মুহূর্ত দেরি না করে সে তার ট্রাংকটা বের করে সামনের দরজার কাছে রাখল। দৌড়ে ওপরে গেল, বিছানার নিচে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আলগা করা ফ্লোর বোর্ডটা একটানে খুলে তার সব বই আর জন্মদিনের প্রেজেন্টেশনসহ বালিশের ওয়াড়টা বের করে ফেলল। হেডউইগের খালি খাঁচাটা হাতে নিয়েই দৌড়ে নিচে এলো ট্রাংকটার কাছে। ঠিক সেই সময় ঠাস করে দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো আংকল ভারনন, পা তার রিপারের কামড়ে রক্তাক্ত।

চিৎকার করে উঠল,

এদিকে আয়! এদিকে আয় হতভাগা ওকে ঠিক করে দিয়ে যা।

হ্যারির রাগ তখন বেপরোয়া এক লাথি মেরে সে তার ট্রাংকটা খুলে যাদুর কাঠিটা হাতে নিয়ে আংকেল ভারননের দিকে তাক করল।

ওর যা প্রাপ্য তাই সে পেয়েছে। খবরদার তুমি আমার কাছে আসবে না!

পেছনে হাত নিয়ে দরজার হুকটা খুলে ফেলল হ্যারি।

আমি যাচ্ছি। যথেষ্ট হয়েছে, আর না।

পর মুহূর্তেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো হ্যারি। অন্ধকারে ভারী ট্রাংকটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আরেক হাতে ঝুলছে প্রিয় পেঁচা হেডউইগের খাঁচাটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *