পর্যালোচনা থেকে বাছাইকৃত কিছু অংশ
প্রো বোনো পুবলিকো (জনগণের কল্যাণে)
পিটার মেদাওয়ার, দ্য স্পেক্টেটর, ১৫ জানুয়ারী, ১৯৭৭
জীববিজ্ঞানে অপেশাদারীরা– একটি শ্রেণী, যার মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় সমাজবিজ্ঞানীরা অন্তর্ভুক্ত– যখন আপাতদৃষ্টিতে পরার্থবাদী অথবা প্রাণীদের কোনো না কোনোভাবে নিঃস্বার্থ আচরণের মুখোমুখি হন, খুব সহজেই তারা বলতে প্রলুদ্ধ হন, এই “আচরণটি বিবর্তিত হয়েছে, “প্রজাতির কল্যাণের জন্য।
একটি সুপরিচিত পুরাণ কাহিনী আছে, যেমন, লেমিংরা (১)– এই প্রয়োজনীয়তার প্রতি আমাদের চেয়েও যারা স্পষ্টতই অনেক বেশী সচেতন– হাজারে হাজারে পাহাড় থেকে নীচে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেবার মাধ্যমে তাদের অতিরিক্ত জনসংখ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এমনকি সবচেয়ে বিশ্বাসপ্রবণ প্রকৃতিবিদও নিশ্চয়ই নিজেকে অবশ্যই প্রশ্ন করবেন, প্রজাতির আচরণ সম্ভারে কিভাবে এই ধরনের পরার্থবাদীতামূলক কাজ অংশ হতে পারে, যদি সেই বাস্তব সত্যটি বিবেচনা করা হয়, এই ধরনের আচরণে সহায়ক জিনগত গঠনের বহনকারীদের এই সুবিশাল জনসংখ্যাতাত্ত্বিক আত্মাহুতির (প্রকাশ্য প্রায়শ্চিত্ত) মাধ্যমে তো অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাওয়ারই কথা। এটিকে পুরাণ কাহিনী হিসাবে প্রত্যাখ্যান করা মানে কিন্তু এটিকে অস্বীকার করা নয়। যদিও, এই জিনগত স্বার্থপর কাজগুলো হয়তো কখনোও নিঃস্বার্থ অথবা পার্থবাদী আচরণে প্রকাশ ( যেভাবে ডাক্তাররা বলেন) পেতে পারে। পিতা/মাতামহী সুলভ পশ্রয়, অসংবেদনশীল নির্বিকারতার বীপরিতে বিবর্তনে জয়ী হতে পারে কারণ দয়ালু পিতা/মাতামহীরা স্বার্থপরভাবেই তাদের নিজেদের জিনের অংশকে বিস্তার করতে বিশেষভাবে সহায়তা করছেন, যা তাদের নাতীনাতনীরা তাদের শরীরে বহন করছে।
উঠতি প্রজন্মের সবচেয়ে মেধাবী জীববিজ্ঞানীদের একজন, রিচার্ড ডকিন্স মৃদুভাবে ও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরার্থবাদের বিবর্তন সংক্রান্ত সোস্যাল বায়োলজী বা সামাজিক জীববিজ্ঞানের কিছু প্রিয় বিভ্রমকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই বইটিকে শুধুমাত্র কোনো ধারণা ভুল প্রমাণ করার প্রচেষ্টাপূর্ণ বই হিসাবে ভাবলে চলবে না: এটি এর বিপরীত, সোস্যাল বায়োলজীর কেন্দ্রীয় সমস্যাটির প্রাকৃতিক নির্বাচনের জিনগত তত্ত্বের অত্যন্ত দক্ষতাপূর্ণ পুনসূত্রবদ্ধকরণ। এছাড়াও, এটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত এবং অত্যন্ত সুলিখিত। প্রাণিবিদ্যা অধ্যয়নের জন্য যে জিনিসগুলো রিচার্ড ডকিন্সকে আকর্ষণ করেছিল সেটি হলো প্রাণীদের স্বাভাবিক পছন্দনীয়তা- যে দৃষ্টিভঙ্গিটি সব ভালো জীববিজ্ঞানীরাই ধারণ করেন, যাদের প্রজ্ঞা এই পুরো বইটি জুড়েই দ্যুতি ছড়াচ্ছে। যদিও দ্য সেলফিশ জিন বইটি তার প্রকৃতিতে বিতর্কমূর্খর, এবং কিছু বইয়ে –যেমন, লরেঞ্জের ‘অন অ্যাগ্রেসন’ (২), আর্সেই এর দ্য সোস্যাল কন্ট্রাক্ট (৩), এবং আইবেল-আইবেসফেল্ড ‘লাভ অ্যান্ড হেট’ (৪)– উল্লেখিত দাবীগুলোর আত্মম্ভরিতা দর্পচূর্ণ করার ডকিন্সের পরিকল্পনার জন্য যা খুবই জরুরী অংশ, যেমন, ডকিন্স মন্তব্য করেছেন– ‘এই বইগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এদের লেখকরা বিষয়টি বুঝতে পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে ভুল করেছেন.. কারণ, তারা বিবর্তন কিভাবে কাজ করে সেই বিষয়টি সম্বন্ধে ভুল বুঝেছিলেন। তারা সেই ভ্রান্ত প্রাকধারণা করেছেন যে বিবর্তনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি একক সদস্য (বা জিন) নয় বরং প্রজাতির কল্যাণ (অথবা গ্রুপের)। আসলেই স্কুলের ছেলেদের প্রবচন ‘মুরগী হচ্ছে আরেকটি ডিম তৈরী করার জন্য ডিমের একটি উপায়’ এ ডজন খানেক বক্তৃতা দেবার জন্য যথেষ্ট পরিমান সত্য আছে। রিচার্ড ডকিন্স বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এভাবে:
‘এই বইয়ের যুক্তি হচ্ছে যে আমরা, এবং অন্য সব জীবরা, আমাদের জিনদের তৈরী যন্ত্র… আমি যুক্তি দেবো যে কোনো একটি সফল জিনের প্রধান যে গুণটি আশা করা উচিৎ, সেটি হচ্ছে এর নিষ্ঠুর স্বার্থপরতা। এই জিন স্বার্থপরতাই সাধারণত সৃষ্টি করে একক সদস্যদের স্বার্থপর আচরণগুলোকে। তবে, আমরা এটাও দেখবো, বিশেষ কিছু পরিস্থিতি আছে, যেখানে একটি জিন তার নিজের স্বার্থপর উদ্দেশ্যগুলো সবচেয়ে ভালোভাবে অর্জন করতে পারে সীমিত রুপে পরার্থবাদীতার চর্চা করার মাধ্যমে। যে বাক্যটি আপনি এই মাত্র পড়লেন সেখানে বিশেষ’ এবং ‘সীমিত আকারে’ এই দুটি শব্দ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যতই চেষ্টা করিনা কেন অন্য কিছু বিশ্বাস করতে, বিশ্বজনীন ভালোবাসা এবং প্রজাতির কল্যাণ সার্বিকভাবে এমন একটি ধারণা যা বিবর্তনীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আদৌ অর্থবহ হয়না।
‘আমরা হয়তো এই সত্যটাকে ঘৃণা করতে পারি’, ডকিন্স বলেন, ‘কিন্তু কোনো অংশেই তা এটিকে কম সত্যতে রূপান্তরিত করেনা। যত বেশী সুস্পষ্টভাবে আমরা জিনগত প্রক্রিয়ার স্বার্থপরতা বুঝতে পারবো, ততই আমরা আরো বেশী যোগ্য হয়ে উঠবো উদারতা এবং সহযোগিতার উপকারিতা এবং বাকী সব কিছু যা সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে সেগুলো শিক্ষা দেবার জন্য। এবং বাকী সবার চেয়ে ডকিন্স আরো সুস্পষ্টভাবে মানবজাতির ক্ষেত্রে সংস্কৃতি অথবা জিনের বাইরের– এক্সোজেনেটিক– বিবর্তনের বিশেষ গুরুত্বটিকে ব্যাখ্যা করেছেন।
বইটর শেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে, ডকিন্স নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছেন একটি মৌলিক নীতি সূত্রবদ্ধ করার প্রয়াসে, যা অবশ্যই সব বিবর্তনীয় পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে– এমনকি হয়তো সেই সব জীবের ক্ষেত্রেও যেখানে কার্বন পরমাণুর জায়গা নিয়েছে সিলিকন পরমাণু, এবং মানুষের মত জীবের ক্ষেত্রেও, যেখানে অনেক পরিমান বিবর্তন ঘটে থাকে জিনগত নয় এমন প্রক্রিয়ায়। সেই মূলনীতি হচ্ছে, বিবর্তন কাজ করে অনুলিপি করতে সক্ষম সত্তাদের সর্বমোট প্রজনন সুবিধার উপর। সাধারণ কোনো পরিস্থিতিতে সাধারণ কোনো জীবের ক্ষেত্রে এই সত্তাগুলো ডিএনএ অনুতে একক হিসাবে অবস্থান করে, যারা পরিচিত ‘জিন’ নামে। ডকিন্সের প্রস্তাবনায় সাংস্কৃতিক বিস্তারের একক হচ্ছে সেটি, যার তিনি নাম দিয়েছেন ‘মিম’ এবং তার বইটির শেষ অধ্যায়ে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, যা কার্যত একটি ডারউইনিয় মিম তত্ত্ব।
ডকিন্সের এই অসাধারণ ভালো বইটির সাথে আমি একটি পাদটিকা যোগ করবো: সকল জীবিত জীব মৌলিক একটি বৈশিষ্ট্য হিসাবে ‘মেমোরি ফাংশন’ ধারণ করে এমন ধারণাটি প্রথম ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ব্যাখ্যা করেছিলেন অস্ট্রীয় ফিজিওলজিস্ট ইভার্ল্ড হেরিং। ঠিক ‘মিম’ এর মত করেই উপস্থাপন করে তিনি তার এই একক সম্বন্ধে বলেছেন, এর উৎস সম্বন্ধে সচেতন থেকে বাছাই করা ঋজু একটি শব্দ এটি। এই বিষয়ে রিচার্ড সেমন এর ব্যাখ্যা (১৯২১) যথেষ্ট স্বাভাবিকভাবেই সম্পূর্ণ অ-ডারউইনীয়, এখন আর যাকে সেই সময়ের একটি ধারণা ছাড়া আর কোনোভাবে অন্য কিছু ভাবা যাবে না। হেরিং এর একটি ধারণাকে তিরষ্কার করেছিলেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাকৃতিক দার্শনিক অধ্যাপক জে. এস. হলডেন: সেই ধারণাটি, এমন একটি যৌগের অবশ্যই অস্তিত্ব আছে যার ঠিক সেই একই গুণাবলী আছে, যা এখন আমরা জানি ডি-অক্সিরাইবোজ নিউক্লিক এসিড বা ডিএনএ অণুর আছে।
.
প্রকৃতির খেলা
ডাবলিউ ডি, হ্যামিলটন, সায়েন্স, ১৯৬:৭৫৭–৫৯ (১৩ মে। ১৯৭৭) (আংশিক)
এই বইটি পড়া উচিৎ, আর প্রায় যে কেউই এই বইটি পড়তে পারবেন। এটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিবর্তন তত্ত্বের একটি নতুন রুপের বিবরণ দিয়েছে। যথেষ্ট হালকা, ভারমুক্ত একটি শৈলী সমৃদ্ধ– যা ইদানীং জনগণের কাছে নতুন এবং ভ্রান্ত জীববিজ্ঞান বিক্রি করছে– এই বইটি, আমার মতে, একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এটি সফল হয়েছে সরল, অকারিগরী ইংরেজী ভাষা ব্যবহারের করে সাম্প্রতিক বিবর্তন জীববিজ্ঞানের কিছু অস্পষ্ট, জটিল এবং প্রায় গাণিতিক মূল ধারণাগুলোকে উপস্থাপন করার আপাতদৃষ্টিতে প্রায় অসম্ভব কাজটি সম্পাদন করতে। অবশেষে, এই বইটির মাধ্যমে সেই ধারণাগুলোর বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে, ধারণাগুলো বিস্মিত ও কৌতূহলী করে তুলবে এমনকি অনেক গবেষণারত জীববিজ্ঞানীকেও, যারা নিজেরাই হয়তো মনে করেছেন ইতিমধ্যেই তারা সব জানেন। অন্ততপক্ষে, এই কারণে বইটি এই পর্যালোচনাকারীকে বিস্মিত করেছে। তারপরও, পুনরাবৃত্তি করলে, এই বইটি খুব সহজেই পাঠযোগ্য যে কারো পক্ষেই যাদের ন্যূনতম পর্যায়ে বিজ্ঞান ধারণা আছে।
এমনকি আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করার কোনো উদ্দেশ্যই ছাড়াই, কারো। গবেষণার বিষয়বস্তুর নিকটবর্তী কোনো বিষয়ে জনপ্রিয় কোনো বই পড়লে, এর পাঠককে আসলেই বাধ্য করে ভ্রান্তির একটি তালিকা করার জন্য, যেমন: এই উদাহরণটি প্রযোজ্য নয়, এই বিষয়টির অস্পষ্ট ব্যাখ্য দেয়া হয়েছে, সেই ধারণাটি ভুল, বহু আগেই তাদের পরিত্যাগ করা হয়েছে ইত্যাদি। আমার জন্য এই বইটির সেই তালিকা প্রায় শূন্য একটি কাগজ। এর মানে এই না যে এখানে সম্ভাব্য কোনো ভ্রান্তি নেই– সেটি কদাচিৎ ঘটতে পারে এমন কোনো কাজে, যেখানে অনুমান নির্ভর ধারণা এক অর্থে অপরিহার্য মূল বিষয়বস্তু– কিন্তু সামগ্রিকভাবে এর জীববিজ্ঞান দৃঢ়ভাবে সঠিক এবং এর প্রশ্নবিদ্ধ প্রস্তাবণাগুলো নিদেনপক্ষে মতবাদর্নিভর নয়। নিজের ধারণাগুলো সম্বন্ধে লেখকের বিনয়ী পর্যালোচনা সমালোচকদের নিরস্ত্র করার প্রবণতা আছে এবং বইটির নানা জায়গায় পাঠক নিজেই তৃপ্তি খুঁজে পান লেখকের প্রস্তাবনায়, যেমন পাঠকের উচিৎ হবে আরো উত্তম মডেল নিয়ে কাজ করা, যদি প্রদত্ত মডেলটি তাকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। এ ধরনের কোনো আমন্ত্রণ যে আন্তরিক গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করা যেতে পারে কোনো জনপ্রিয় বইয়ে, এই বিষয়টি প্রাণবন্তভাবে প্রতিফলিত করে বইটির বিষয়বস্তুর নতুনত্বকে। বিস্ময়করভাবে, আসলেই বেশ কিছু সম্ভাবনা আছে প্রস্তাবিত সরল ধারণাগুলো যা এখনও পরীক্ষা করে দেখা হয়নি, তারা হয়তো খুব শীঘ্রই বিবর্তনের পুরোনো কিছু ধাঁধার সমাধান করবে।
বেশ, তাহলে বিবর্তনের নতুন রুপটি কি? একটি নির্দিষ্ট পর্যায় অবধি এটি অনেকটাই শেক্সপিয়ারের নতুন ব্যাখ্যার মত: মূল পাণ্ডুলিপি পুরোটাই ঠিকই আছে, কিন্তু কোনো না কোনোভাবে গবেষকদের নজর এড়িয়ে গেছে। আমার এখানে সংযুক্ত করা উচিৎ, যদিও, ডকিন্সের আলোচনার সেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গিটি কিন্তু তেমন সুপ্ত ছিলনা। ডারউইনের বিবর্তনের পাণ্ডুলিপিতে যেমন, প্রকৃতির পাণ্ডুলিপিতেও তেমন; এবং সময়ের মাত্রায় এই বিষয়টির উপর মনোযোগ দেবার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা শত বছরের প্রাচীন নয় বরং বিশ বছরে কাছাকাছি হবে। যেমন, ডকিন্স শুরু করেছিলেন, সেই সব বৈচিত্র্যময় সর্পিলাকার অণুগুলো থেকে, যে বিষয়ে আমরা এখন খুব ভালো করেই জানি। ডারউইন এমনকি ক্রোমোজোম সম্বন্ধে অথবা যৌন প্রজনন প্রক্রিয়ায় তাদের অদ্ভুত নৃত্য সম্বন্ধে তার কিছুই জানা ছিলনা। কিন্তু এমনকি বিশ বছরও যথেষ্ট দীর্ঘ সময় বিস্ময় সৃষ্টি করার জন্য।
প্রথম অধ্যায়ে, বইটি যে প্রাকৃতিক ঘটনাটি ব্যাখ্যা করতে চাইছে, সাধারণভাবে সেটির বৈশিষ্ট্যগুলোর বর্ণনা উপস্থাপন করা হয়েছে এবং মানব জীবনে তাদের দার্শনিক এবং প্রায়োগিক গুরুত্ব প্রদর্শন করেছে। কিছু কৌতূহদ্দেীপক এবং শঙ্কা উদ্রেককারী প্রজাতির উদাহরণ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা তাদের সেই আদিম মিশ্রণ বা সুপে প্রথম রেপ্লিকেটর বা অনুলিপনকারীদের আলোচনায় ফিরে যাই। আমরা দেখি এরা সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং আরো বিস্তৃত হয়। তারা সীমিত কাঁচামাল উপাদানের জন্য পরস্পরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, যুদ্ধ করে, এবং একে অপরকে পরিপাক কিংবা খেয়ে ফেলে। তারা নিজেদের এবং তাদের অর্জন আর অস্ত্রগুলো প্রতিরক্ষা মূলক প্রাচীরের পেছনে লুকিয়ে রাখে; এটাই পরবর্তীতে ব্যবহৃত হয় আশ্রয় হিসাবে, শুধুমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বীদের পাল্টা কৌশল বা আগ্রাসী শিকারীদের কাছ থেকেই নয়, পরিবেশের নানা প্রতিকূল চাপ থেকেও, অনুলিপনকারীরা ক্রমশ যাদের এড়াতে আরো দক্ষ হয়ে ওঠে। এভাবেই তারা গড়ে ওঠে, স্থিতিশীল হয়, অদ্ভুত সব রুপের কাঠামো গঠন করে, সাগর পাড়ে ছিটকে পরে, স্থল অতিক্রম করে, মরুভূমি আর চিরন্তন বরফে। এই সব সীমানাগুলোর মধ্যে, যা অতিক্রম করে, জীবন বেশীক্ষণ টিকতে পারেনা। আমি সেই সুপ বার বার ঢালা হয়েছে লক্ষ কোটি বছর বিচিত্র থেকে ক্রমশ বিচিত্ৰতর ছাঁচে। অবশেষে, এটি ঢালা হয়েছে পিপড়ায় এবং হাতিতে, মানড্রিল ও মানুষে। দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ হয়, এইসব আদি অনুলিপিকারকদের কিছু চূড়ান্ত সেই উত্তরসূরি জোট। সংক্রান্ত ভাবনায়: “তাদের সুরক্ষা করার আমাদের অস্তিত্বের চূড়ান্ত যৌক্তিকতা, তারা এখন পরিচিত জিন নামে আর আমরা হচ্ছি তাদের টিকে থাকার যন্ত্র।
শক্তিশালী এবং চিন্তা উদ্রেককারী, পাঠক হয়তো ভাববেন, কিন্তু এটি খুব নতুন কোনো ধারণা? বেশ, আপাতত হয়তো না, কিন্তু অবশ্যই বিবর্তন শেষ হয়ে যায়নি আমাদের শরীরগুলোয় এসে। আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, জনাকীর্ণ এই জগতে টিকে থাকার কৌশল দেখা গেছে অপ্রত্যাশিতভাবে সূক্ষ্মতাপূর্ণ, জীববিজ্ঞানীরা সেই প্রাচীন অপসৃয়মান প্রজাতির কল্যাণের জন্য অভিযোজন মতবাদের অধীনে যতটুকু কল্পনা করতে প্রস্তুত তার চেয়েও বেশী সূক্ষ্ম। এই সূক্ষ্মতা, জুলভাবে, বাকি বইটির মূল বক্তব্য। পাখিদের গানের সরল উদাহরণটির কথা ভাবুন। মনে হতে পারে খুবই অদক্ষ একটি বন্দোবস্ত : কোনো একজন সরল বস্তুবাদী যিনি সেই কৌশলগুলোর অনুসন্ধান করছেন, যার মাধ্যমে কিভাবে টুরডুস (৫) এর কোনো একটি প্রজাতির পাখি কঠোর শীতকাল, খাদ্য স্বল্পতা, এবং ইত্যাদি নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে টিকে থাকে, তিনি হয়তো এদের পুরুষ সদস্যদের বর্ণিল সঙ্গীত পরিবেশনকে মনে করতে পারেন অশরীরী আত্মার সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করার অনুষ্ঠান বা সিয়ন্সে এক্টোপ্লাজমের (৬) মতই কোনো অসম্ভাব্য কিছু। (যদি আরো খানিকটা চিন্তা করেন, তিনি হয়তো এমনকি কোনো প্রজাতিতে পুরুষ সদস্যরাই বা কেন আছে সেই বিষয়টিকেও সমানভাবে অসম্ভাব্য মনে করতে পারেন, এবং এটি আসলেই এই বইয়ের আরেকটি প্রধান বিষয়: পাখিদের গানের মতই, লিঙ্গের ভূমিকা খুব সরলভাবেই যুক্তিযুক্ত করা হয়েছে অতীতে); তারপরও কোনো একটি পাখি প্রজাতির মধ্যে অনুলিপনকারীদের একটি পুরো দল এই কর্মটি সম্পাদনের জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। কোনো একটি জায়গায় ডকিন্স হাম্পব্যাক তিমিদের এমনকি আরো অসাধারণ সঙ্গীতের কথা উল্লেখ করেছেন, যা নিজেকে শ্রাব্য করে তোলে পুরো মহাসাগর জুড়ে। কিন্তু টুরডুসদের গানের চেয়ে এই সঙ্গীতের ব্যপারে আমরা আরো কম জানি, যেমন, এটি কিসের জন্য, কি বিষয়ে, কার প্রতি নির্দেশিত। আপাতত প্রমাণ যা বলছে তা হলো এটি হয়তো মানব জাতির বিরুদ্ধে সিটাসিয়ান বা তিমিদের ঐক্যতা, যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সেটি তিমিদের জন্য কল্যাণকর হতো। অবশ্যই, অনুলিপনকারীদের টিমগুলোর অন্য টিমগুলো এখন সিম্ফোনী কনসার্ট সৃষ্টি করছে, এবং সেই সঙ্গীতগুলো অবশ্যই মাঝে মাঝে বহু সাগর পাড়ি দেয়– মহাশূন্যে থাকা বিশেষ যন্ত্রে প্রতিফলিত হয়ে, যা তারা নিজেরাই তৈরী করেছে এবং যেটি প্রদক্ষিণ করছে আরো জটিল কিছু দলের নির্দেশনায়। জাদুকর আয়না নিয়ে যা করেন, তা প্রকৃতি যা করতে পারে তার কাছে কিছুই না, যখন প্রকৃতি, যদি ডকিন্স ঠিক হয়ে থাকেন, শুরু করেছিল জমাট বাঁধা আদিম সুপের মত প্রতিশ্রুতিশীল নয় এমন কোনো সূচনা দ্রব্য থেকে। এটি তার দ্বায়িত্ব পালন করবে এই বইয়ের মধ্যে, যে জীববিজ্ঞান আছে তার নতুন রুপ হিসাবে এবং কিছু সাম্প্রতিক বইকে (যেমন, ই, ও, উইলসনের সোসিওবায়োলজি (৭)) বলার সুযোগ দেবে, এটি দুত্যি ছড়ায় এমন একটি আশা নিয়ে যা এসবই জীবনের সবচেয়ে দূরবর্তী সম্প্রসারণ হয়তো খুব শীঘ্রই বোধগম্যভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এর মূল বক্তব্যে, যদি খুঁটিনাটি বিষয়ে নাও হতে পারে (ধর্মীয় ব্যক্তি এবংনব্য-মার্কসবাদীরা হয়তো সেই বাক্যটিকে উল্টে দেবেন, যদি সেটি তাদের জন্য বেশী সুবিধাজনক মনে হয়, এটি একটি সাধারণ প্যাটার্নের সৃষ্টি করবে যার মধ্যে আছে সাধারণত কোষের পর্দা, সাধারণতম বহু কোষী শরীর এবং ব্ল্যাকবার্ডদের (টুরডুস জিনাসের পাখিরা) গান।
যে ধারণাটি এড়ানো উচিৎ হবে, সেটি হচ্ছে, এই বইটি একধরণের অবিশেষজ্ঞ পাঠকদের সোসিওবায়োলজী বই হিসাবে ভাবা। প্রথমত, এখানে অনেক মৌলিক ধারণা আছে এবং দ্বিতীয়ত, এটি উইলসনের সেই সুবিশাল সৃষ্টির কিছু সুনির্দিষ্ট কিছু ভারসাম্যহীনতাকে স্থিতিশীল করে গেম-থিওরী নির্ভর সামাজিক আচরণের উপর শক্তভাবে গুরুত্বারোপ করে। যা উইলসন উল্লেখ করেননি বললেই চলে।গেম থিওরী নির্ভর সঠিক শব্দ নয় পুরোপুরি, বিশেষ করে সামাজিক বিবর্তনের অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে, কারণ জিনরা নিজেরা তাদের কর্মপ্রক্রিয়ায় কোনো যৌক্তিকতা খোঁজে না। তবে যাইহোক, এটি এখন স্পষ্ট যে, প্রায় সব স্তরেই উপযোগী সমরুপতা আছে: গেম তত্ত্বের ধারণাগত এবং সামাজিক বিবর্তনের কাঠামোতে। এই আন্তনিষিক্তকরণ এখানে ইঙ্গিত দেয় এটি নতুন এবং এবং এখনও এর প্রক্রিয়া চলমান: শুধুমাত্র সাম্প্রতিক সময়ে, যেমন, আমি জেনেছি যে গেম থিওরী ইতিমধ্যে এমন ধারণার একটি নতুন নাম দিয়েছে, ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম (Nash equilibrium)। যা মোটামুটি evolutionary stable strategy ধারণার সমতুল্য। বিবর্তনের স্থিতিশীলতার বিষয়টি ডকিন্স সঠিকভাবেই দেখেছেন তার সোস্যাল বায়োলজি ব্যাখ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে। সামাজিক আচরণে ও সামাজিক অভিযোজনের গেম সুলভ উপকরণগুলো আসে নির্ভরতা থেকে, যেকোনো সামাজিক পরিস্থিতিতে, কোনো একটি একক সদস্যের কৌশলের সাথে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকারীদের কৌশলগুলোর বিরুদ্ধে এর সফলতার উপর। অভিযোজনের অন্বেষণ, সার্বিক মঙ্গলের কথা চিন্তা না করে যা কোনো একটি পরিস্থিতি থেকে যতটুকু সম্ভব ততটুকু সুবিধা আদায় করে নেয়, সেটি খুব বিস্ময়কর ফলাফলের জন্ম দিতে পারে। কে ভেবেছিল, যেমন, সেই ভারী বিষয়টি, কেন মাছদের নানা প্রজাতির মধ্যে, অন্যান্য প্রায় সব প্রাণীদের ব্যতিক্রম, পুরুষরাই সাধারণত ডিম ও বাচ্চাদের পাহারা দেয়, যদি দুটি লিঙ্গের কেউ সেই কাজটি আদৌ করে থাকে, হয়তো নির্ভর করে কিছু তুচ্ছ বিষয়ের উপর যেমন কোন লিঙ্গটি বাধ্য পানিতে তার জনন কোষ আগে ছড়াবার জন্য? তারপরও ডকিন্স এবং তার এক সহকর্মী, আর, এল, ট্রিভার্স এর একটি ধারণাকে অনুসরণ করে চমৎকার একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন যে, সময়ের সূক্ষ্মতম বিষয়, এমনকি সেকেন্ড পরিমান তারতম্য, এই পুরো বিষয়টির জন্য একান্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আবারো, আমরা কি এমন প্রত্যাশা করতাম না যে, একগামী পাখি প্রজাতির স্ত্রী সদসদ্যের, যারা সঙ্গীর সাহায্যে আশীর্বাদপুষ্ট, তারা বেশী ডিম পাড়বে, বহুগামী প্রজাতির স্ত্রী সদস্যদের চেয়ে? আসলে এর উল্টোটাই সত্য। ডকিন্স, তার খানিকটা শঙ্কা জাগানো অধ্যায়,আন্তঃলিঙ্গ যুদ্ধে আবারো সেই বিবর্তনীয় স্থিতিশীলতার ধারণাটি প্রয়োগ করেছেন, কারো দ্বারা ব্যবহৃত হবার প্রতিরোধ হিসাবে ( এই ক্ষেত্রে পুরুষ) এবং হঠাৎ করেই এই অদ্ভুত যোগসূত্রতাকে স্বাভাবিক হিসাবে প্রতীয়মান করেছেন। তার ধারণাটি, তার বেশীর ভাগ অন্য ধারণার মত, অপ্রমাণিত, হয়তো আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ থাকতে পারে, কিন্তু তিনি যা প্রস্তাবনা করেছেন, সেটি তার নতুন করে দেখার অবস্থান থেকে এত সহজেই দেখা যায়, যে এটি দৃষ্টি আকর্ষণের দাবী রাখে।
গেম থিওরী একটি পাঠ্যপুস্তকে কেউ বেশী গেম দেখবেন না, আধুনিক জ্যামিতির বইয়ে যেমন কেউ বৃত্ত আর ত্রিভুজ দেখে না তার। চেয়ে। হঠাৎ দৃষ্টিতে সবই শুধুমাত্র বীজগণিত: গেম তত্ত্ব শুরু থেকেই জটিল কারিগরী একটি বিষয়। সেকারণেই আসলেই একটি সাহিত্যিক অর্জন এই বইতে এত বেশী কিছু উপস্থাপন করার বিষয়টি, শুধু বাইরের ভাব কিংবা গুণাবলী নয়, এর অভ্যন্তরীণ ব্যাখ্যাতো বটেই, কোনো সমীকরণের সাহায্য ছাড়াই গেম থিওরীর পরিস্থিতিগুলো ব্যাখ্যা করা। আর, এ. ফিশার, তার বিখ্যাত বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “আমার কোনো চেষ্টাই সফল হয়নি এই বইটিকে সহজপাঠ্য করার জন্য। সেই বইয়ে অসংখ্য গাণিতিক সূত্র এবং বাক্যগুলো যেমন বাহুল্যবর্জিত, তেমনই সুগভীর, যেখানে পাঠক খুব দ্রুতই বাধ্য হয় নতি স্বীকার করে নিতে। দ্য সেলফিশ জিন পড়ে আমি এখন অনুভব করতে পারি যে, ফিশার আরো ভালো কাজ করতে পারতেন, যদিও স্বীকার করতে হবে, তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি বই লিখতে হতো। মনে হয় যেন বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে আছে, এমনকি ধ্রুপদী জনসংখ্যা জিনতত্ত্বে নির্ধারণী সব ধারণাগুলোও হয়তো আরো বেশী সুখপাঠ্য বোধগম্য হতো সাধারণ গদ্যে। বাস্তবিকভাবে হলডেন ফিশারের চেয়ে আরো উত্তম কিছু করতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু এত সুগভীর ছিলনা)। কিন্তু যা আসলেই অসাধারণ সেটি হলো কতো বেশী বরং বিরক্তিকর গণিত অনুপ্রবেশ করেছে পপুলেশন জেনেটিক্সের মূলধারায়, রাইট, ফিশার এবং হলডেন এর নেতৃত্বে সেটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব নতুন, জীবনের বাস্তবতার প্রতি আরো বেশী সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। আমি বরং বিস্মিত হয়েছি ডকিন্স আমার মতই ফিশারকে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম জীববিজ্ঞানী হিসাবে মনে করেন জেনে। (একটি দূর্লভ দৃষ্টিভঙ্গি, যেমনটি আমি ভেবেছিলাম, কিন্তু আমি বিস্মিত হয়েছি আরো লক্ষ করে যে কত সামান্যই তিনি ফিশারের বইটির পুনরাবৃত্তি করেছেন তার এই বইটিতে।
পরিশেষে, তার শেষ অধ্যায়ে, ডকিন্স সংস্কৃতির বিবর্তনের বিস্ময়কর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি মিম শব্দটি (মাইমিম এর সংক্ষিপ্ত রুপ) প্রচলন করেন জিন এর সমতুল্য সাংস্কৃতিক একককে। যদিও খুব কঠিন শব্দটি সংঙ্গায়িত করা– নিশ্চয়ই জিন এর সংজ্ঞার চেয়ে কঠিন– আমি সন্দেহ করি খুব শীঘ্রই এটি জীববিজ্ঞানীদের কাছে প্রচলিত একটি শব্দ হয়ে উঠবে এবং, আমরা আশা করি, দার্শনিক,ভাষাতত্ত্ববিদ এবং অন্যরাও শব্দটিকে আত্মস্থ করে নেবেন, প্রাত্যহিক ভাষায় যেমন জিন শব্দটি আত্মীভূত হয়েছে।
.
জিন এবং মিম : জন মেনার্ড স্মিথ।
(দ্য লন্ডন রিভিউ অব বুকস, ৪-১৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮২, দ্য এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপের পর্যালোচনা থেকে বাছাইকৃত কিছু অংশ)।
বই হিসাবে ‘দ্য সেলফিশ জিন’ অসাধারণ, কারণ যদিও সাধারণ পাঠকদের কথা ভেবেই এটি লেখা হয়েছে, কিন্তু এটি জীববিজ্ঞানে মৌলিক একটি অবদান রেখেছে। উপরন্তু, সেই অবদানটি খুবই অসাধারণ ধরনের। সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখা ডেভিড ল্যাকের ধ্রুপদী বই ‘দ্য লাইফ অব দ্য রবিন’(৮) বইটিরও মৌলিক অবদান ছিলো। দ্য সেলফিশ জিন কোনো নতুন বাস্তব তথ্য জানায়নি, বইটিতে কোনো গাণিতিক মডেলও নেই– আসলেই এই বইটিতে আদৌও কোনো গণিত নেই। এটি যা নিবেদন করেছে তা হচ্ছে একটি নতুন বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি।
যদিও ব্যাপকভাবে বইটি পড়া হয়েছে এবং উপভোগ করা হয়েছে, কিন্তু খুব শক্তিশালী বৈরিতারও উদ্রেকও করেছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এই বৈরিতা উদ্ভব হয়, আমি বিশ্বাস করি, ভুল বোঝাবুঝি থেকে অথবা বরং, বেশ কিছু ভুল বোঝাবুঝি থেকে। এদের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক ভ্রান্তিটি হচ্ছে এই বইটি আসলে কি বিষয়ে সেটি বুঝতে ব্যর্থ হওয়া। এটি বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া নিয়ে একটি বই, এটি নৈতিকতা বিষয়ে না অথবা রাজনীতি সংক্রান্ত নয় অথবা কোনো মানবিক বিজ্ঞান বিষয়কও না। যদি আপনি আগ্রহী না হন কিভাবে বিবর্তন ঘটেছে, এবং বুঝতে ব্যর্থ হন যে কিভাবে কেউ এত গভীরভাবে মানুষের কর্মকাণ্ড ছাড়াও অন্য কিছু নিয়ে চিন্তিত হতে পারে,তাহলে বইটি পড়ার দরকার নেই আপনার: এটি শুধুমাত্র আপনাকে অপ্রয়োজনীভাবে ক্ষুদ্ধ করবে।
তবে, ধরে নিচ্ছি যে আপনি বিবর্তন সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী, ডকিন্স কি করছেন সেটি বোঝার একটি ভালো উপায়, সেই বিতর্কের প্রকৃতিটিকে অনুধাবন করা, যা বিবর্তন জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে চলমান ছিল, ষাটের এবং সত্তরের দশকে। এটি দুটি সম্পর্কযুক্ত বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট– গ্রুপ সিলেকশন এবং কিন সিলেকশন। গ্রুপ সিলেকশন বিতর্কটির সূচনা করেছিলেন ওয়েইন-এডওয়ার্ড (যিনি প্রস্তাব করেছিলেন আচরণগত অভিযোজন) বিবর্তিত হয়েছে গ্রুপ সিলেকশনের মাধ্যমে, যেমন কিছু গ্রুপের টিকে থাকা আর কিছু গ্রুপের বিলুপ্তির মাধ্যমে…
প্রায় একই সময়ে কিভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে সেই প্রসঙ্গে ডাবলিউ. ডি. হ্যামিলটন আরো একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। তিনি দেখান যে বেশ কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে বাঁচানোর জন্য যদি কোনো জিনের বাহকের আত্মবিসর্জন দেবার কারণ হয়, পরবর্তীতে এই জিনের বেশ কয়েকটি অনুলিপি হয়তো থেকে যাবে জনগোষ্ঠীতে, আত্মবিসর্জন যদি না দেয়া হয় সেই পরিস্থিতি অপেক্ষা। এই প্রক্রিয়াটির গাণিতিক মডেল হিসাবে দেখানোর জন্য, হ্যামিলটন ‘ইনকুসিভ ফিটনেস’ ধারণাটির প্রস্তাবনা করেন– যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কোনো একটি সদস্যের নিজের সন্তানরাই শুধু নয়, বরং যেকোনো বাড়তি সন্তানও যাদের প্রতিপালন করে তার নিকটাত্মীয়রা সেই সদস্যের সাহায্য নিয়ে, যে সঠিক প্রযোজ্য মাত্রা নির্ধারিত হয় আত্মীয়তার সম্পর্কের মাত্রা হিসাবে।
ডকিন্স, হ্যামিলটনের প্রতি আমাদের ঋণ স্বীকার করার পর, প্রস্তাব করেন যে তিনি ভুল করেছিলেন ফিটনেসের ধারণাটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য চূড়ান্ত একটি প্রচেষ্টা করে, এবং তার জন্য আরো ভালো হতো যদি তিনি সম্পূর্ণভাবে জিনের দৃষ্টিতে বিবর্তনের ধারণাটিকে গ্রহন করতেন। তিনি আমাদের তাড়না দেন– রেপ্লিকেটর’ বা অনুলিপনকারী– যে সত্তাদের সঠিক গঠন প্রজনন প্রক্রিয়ায় অনুলিপি হয়, এবং ভেহিকল’ বা বাহক– সে সত্তারা মরণশীল ও তাদের কোনো অনুলিপি হয়না কিন্তু তাদের বৈশিষ্ট্যাবলী নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করে রেপ্লিকেটররা– এই দুটির মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটিকে শনাক্ত করার জন্য। প্রধান যে রেপ্লিকেটর’ এর সাথে আমরা পরিচিত, তারা নিউক্লিক অ্যাসিড অণু- যেমন ডিএনএ অণু– যাদের দিয়ে জিন এবং ক্রোমোজোম তৈরী হয়। সাধারণ সব ভেহিকল বা বাহকরা হচ্ছে জীব শরীর, যেমন, কুকুর, ফুট ফ্লাই এবং মানুষ। ধরুন, আমরা একটি অঙ্গ যেমন চোখের কথা ভাবি, যারা সুস্পষ্টভাবেই কোনো কিছু দেখার জন্য অভিযোজিত হয়েছে। আমরা হয়তো যুক্তিসঙ্গতভাবে জিজ্ঞাসা করতে পারি কার সুবিধার জন্য চোখ বিবর্তিত হয়েছে। একটি মাত্র যুক্তিসঙ্গত উত্তর হতে পারে, ডকিন্স প্রস্তাব করেন, এটি বিবর্তিত হয়েছে সেই সব অনুলিপনকারীদের জন্য যারা এর ভ্রূণগত বিকাশের জন্য দায়ী। যদিও গ্রুপের সুবিধার চেয়ে একক কোনো সদস্যের সুবিধা হয় এমন ব্যাখ্যাকে তিনি আমার মতই অনেক বেশী শ্রেয়তর মনে করেন, তবে তার কাছে শুধুমাত্র অনুলিপনকারীদের সুবিধা হয় এমন চিন্তা করা আরো বেশী শ্রেয়তর মনে হয়।
নোটস (পর্যালোচনা থেকে বাছাইকৃত কিছু অংশ)
১. লেমিং (Lemming)- একধরনের রোডেন্ট বা ইঁদুর জাতীয় প্রাণী, যাদের বাস মূলত আর্কটিক বা উত্তর মেরু অঞ্চলে।
২. Konrad Lorenz: On Aggression (German: Das sogenannte Böse zur Naturgeschichte der Aggression), 1963
৩. Robert Ardrey, The Social Contract: A Personal Inquiry into the Evolutionary Sources of Order and Disorder,1970
8. Irenaus Eibl-Eibesfeldt, Love and Hate: A Natural History of Behavior Patterns (Zur Naturgeschichte elementarer Verhaltensweisen), 1970
৫. কমন ব্ল্যাকবার্ড যেমন Turdus merula, এই জিনাসের পাখিদের ট্রু গ্রাসও বলা হয়।
৬. এক্টোপ্লাজম শব্দটি ব্যবহার করা আধ্যাত্মিক শক্তিপূর্ণ কিছু দিয়ে তৈরী বস্তু, সাধারণত আত্মা নামানোর অনুষ্ঠানে এই ধারণাটি ব্যবহার করা হয় আত্মার শরীরি উপস্থিতি জানান দেবার জন্য। এটি মূলত একটি প্রতারণা।
৭. E. O. Wilson, Sociobiology: The New Synthesis, 1975
৮. David Lack, The life of the Robin. 1943
.
লেখক পরিচিতি
রিচার্ড ডকিন্স
ক্লিনটন রিচার্ড ডকিন্স সুপরিচিত রিচার্ড ডকিন্স নামেই। তাঁর প্রশিক্ষণ আর পেশাগত ক্ষেত্র প্রাণিবিজ্ঞান, বিশেষ করে ইথোলজী (প্রাণিবিজ্ঞানের যে শাখায় বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক ও নৈর্ব্যাক্তিকভাবে প্রাণীদের আচরণ নিয়ে গবেষণা করে থাকেন) এবং বিবর্তন জীববিজ্ঞান। ব্রিটিশ সরকারের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা বাবার কাজের সুবাদে তাঁর জন্ম এবং শৈশব কাটে আফ্রিকায়। বাবা এবং মা, দুজনেরই আগ্রহ ছিল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে, আর পারিবারিক সেই আগ্রহটিও সঞ্চারিত হয়েছিল শিশু ডকিন্সের মনে। জীবজগতের দৃশ্যমান নানা রুপ আর বৈচিত্র্যময়তার একটি বিকল্প ব্যাখ্যা হিসাবে মধ্য কৈশোরেই চার্লস ডারউইনের প্রস্তাবিত বিবর্তন তত্ত্বটি তাঁকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল; উচ্চশিক্ষার বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন জীববিজ্ঞান। অক্সফোর্ডের ব্যালিওল কলেজে প্রাণিবিজ্ঞানে ১৯৬২ সালে স্নাতক এবং বিশ্বসেরা ইথোলজিষ্ট ও জীববিজ্ঞানী নিকোলাস টিনবার্গেন (১) এর তত্ত্বাবধানে তিনি পিএইচডি শেষ করেন ১৯৬৬ সালে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বাকলীতে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে ডকিন্স তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন, কিন্তু শিক্ষক ‘নিকো’ টিনবার্গেন তাঁর প্রিয় মেধাবী ছাত্রটিকে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অক্সফোর্ডে ফিরিয়ে আনেন। ১৯৭০ সালে অক্সফোর্ডে প্রাণিবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি, পরবর্তীতে এই বিভাগের রিডারও (২) হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে বিখ্যাত সফটওয়্যার প্রকৌশলী চার্লস সিমোনী (৩) বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য আর জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে অক্সফোর্ডে রিচার্ড ডকিন্সের জন্য একটি বিশেষ অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করেন, Simonyi Professorship for the Public Understanding of Science (৪), এই পদ থেকে ২০০৮ এ অবসর গ্রহন করেন তিনি।
পেশাগত জীবনের শুরুতেই তিনি অনুভব করেছিলেন যে, চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্তন বিষয়টি নিয়ে বহু জীববিজ্ঞানীর মধ্যেই কিছু মৌলিক ভ্রান্ত ধারণার অস্তিত্ব আছে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কয়েকজন তাত্ত্বিক বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, জর্জ ক্রিস্টোফার উইলিয়ামস (৫), জন মেনার্ড স্মিথ(৬ ), ডাবলিউ, ডি, হ্যামিলটন(৭) ও রবাট ট্রিভার্স (৮) এর কিন সিলেকশন, অ্যালটুইজম বা পরার্থবাদীতা, পারস্পরিক পরার্থবাদীতা, সন্তান প্রতিপালনে পিতামাতার বিনিয়োগ সংক্রান্ত গাণিতিক ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলো বিষয়গুলি নিয়ে একটি সহজবোধ্য ব্যাখ্যা উপস্থাপন করার জন্য। ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ডে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘটের ফলে সৃষ্ট বিদ্যুত সরবাহ ঘাটতির সময় যখন তার ঝিঁঝি পোকা (ক্রিকেট) নিয়ে গবেষণার কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না, সেই অবসরে ধারণাগুলো তিনি লিখে ফেলেছিলেন একটি বহনযোগ্য ছোট টাইপরাইটারে, ১৯৭৬ সালে সেই ভাবনাগুলো তাঁর প্রথম বই ‘দ্য সেলফিশ জিন (The Selfish Gene)’ রুপে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘দ্য সেলফিশ জিন’ খ্যাতি এনে দিয়েছিল তাঁকে।এখানেই প্রথমবারের তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনী চাপের শক্তি যে ইউনিট বা এককের উপর তার প্রভাব ফেলে ক্রম বিবর্তনের প্রক্রিয়ায়, সেই জিন-কেন্দ্রিক বিবর্তনের ধারণাটি সুপরিচিত করার প্রচেষ্টা করেছিলেন, একই সাথে তিনি সাংস্কৃতিক বিবর্তনের একক হিসাবে মিম (Meme) ধারণাটিও প্রস্তাব করেছিলেন। তার এই বইটির নামকরণ নিয়ে ভিত্তিহীন বিতর্ক চলেছে বহুদিন, তারই প্রত্যুত্তরে ১৯৮২ সালে বিবর্তন জীববিজ্ঞানে তিনি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা করেন, “দি এক্সটেণ্ডেড ফেনোটাইপ (The Extended Phenotype) বইয়ে, জিনের ফেনোটাইপিক (পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব এমন বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য) প্রভাব শুধু সেই জিন বাহকের শরীরেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি সম্প্রসারিত হতে পারে। প্রাকৃতিক পরিবেশে এবং এমনকি অন্য কোন জীবের শরীরেও। অতিপ্রাকৃত কোন পরিকল্পক, সৃষ্টিকারী সত্তার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ডকিন্স ব্রিটিশ হিউম্যানিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন(৯ ) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ব্রাইটস মুভমেন্টের(১০) সমর্থক। তিনি সুপরিচিত ধর্মভিত্তিক সৃষ্টিতত্ত্ববাদ আর এর ছদ্মরুপে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন মতবাদের বিরুদ্ধে তার সুদৃঢ় অবস্থানের জন্য। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর দ্য ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার (The Blind Watchmaker) বইটিতে তিনি উইলিয়াম পেইলির (১১) ‘ওয়াচমেকার’ বা ঘড়ি নির্মাতা রুপকটির বিপক্ষে তাঁর যুক্তি উপস্থাপন করে ব্যাখ্যা করেন, জীবজগতে দৃশ্যমান সব গঠনগত জটিলতা ব্যাখ্যা করার করার জন্য কোনো অতিপ্রাকৃত সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই। তিনি বিবর্তন প্রক্রিয়ার মূল চালিকা শক্তি প্রাকৃতিক নির্বাচনকেই চিহ্নিত করেন ‘অন্ধ’ ওয়াচমেকার হিসাবে।
বিবর্তন জীববিজ্ঞান, বিজ্ঞান ও দর্শন, ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে টানাপোড়েন ইত্যাদি নানা বিষয় বোধগম্য করার লকেব তিনি আরো বেশ কিছু বই লিখেছেন, যেমন, River Out of Eden: A Darwinian View of Life (Jade), Climbing Mount Improbable (১৯৯৬), Unweaving the Rainbow (১৯৯৭), A Devil’s Chaplain (Rooy), The Ancestor’s Tale (২০০৪)। ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্য গড ডিলুশন (The God Delusion) বইটি। যেখানে তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, অতিপ্রাকৃত কোনো সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নেই এবং ধর্মীয় বিশ্বাস একটি ডিলুশন বা বিভ্রান্তি বা স্থির ভ্রান্ত একটি বিশ্বাস মাত্র। ২০১০ সালের মধ্যেই বইটির বিক্রি দুই মিলিয়ন কপি ছাড়িয়ে যায় এবং তাকে বিশ্বব্যাপী বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
ডারউইন জন্মদ্বিশতবার্ষিকীতে বিবর্তনের সপক্ষে গবেষষালব্ধ প্রমাণগুলো হালনাগাদ করে তিনি প্রকাশ করেন The Greatest Show on Earth: The Evidence for Evolution (Roos); ২০১১ সালে কিশোরদের উপযোগী করে লেখেন The Magic of Reality: How We Know What’s Really True; আত্মজীবনীর প্রথম পর্ব An Appetite for Wonder: The Making of a Scientist প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ সালে, যার fauty á Brief Candle in the Dark: My Life in Science প্রকাশিত হবার কথা ২০১৫র শেষে। তাঁর সর্বশেষ বই Science in the Soul: Selected Writings of a Passionate Rationalist প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালে অক্টোবরে কিশোরদের জন্য লেখা তার Outgrowing God: A Beginner’s Guide to Atheism বইটি প্রকাশ হবে।
রেডিও ও টেলিভিশনের নানা অনুষ্ঠান ও বিতর্কে তাঁর উপস্থিতি একসময় ছিল বেশ নিয়মিত, এছাড়াও লিখেছেন বহু প্রবন্ধ। বহু পুরস্কারে সম্মানিত রিচার্ড ডকিন্স বিবর্তন জীববিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা, ছদ্মবিজ্ঞান, ধর্মীয় ও অন্যান্য নানা কুসংস্কার নিয়ে তার আজীবন যুদ্ধের অংশ হিসাবে তৈরী করেছেন বেশ কিছু প্রামাণ্য চিত্র, যার সাম্প্রতিকতমটি হচ্ছে ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত The Unbeleivers। তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি বই বিশ্বের সব প্রধান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিজ্ঞানমনষ্কতা আর মুক্ত চিন্তার প্রসারে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাওয়া ডকিন্স প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান রিচার্ড ডকিন্স ফাউন্ডেশন ফর সায়েন্স অ্যান্ড রিজন (Richard Dawkins Foundation for Reason and Science) (১২)। ফাউেন্ডশনটি ২০১৬ সালে সেন্টার ফর ইনকোয়ারীর (Center for Inquiry) সাথে একীভুত হয়েছে।
.
অনুবাদক: কাজী মাহবুব হাসান
পেশাগত প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র চিকিৎসা বিজ্ঞান, চিকিৎসা। অণুজীববিজ্ঞান, রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য। অনুবাদক, আগ্রহের ক্ষেত্র জীববিজ্ঞান, বিজ্ঞানের ও শিল্পকলার ইতিহাস, সভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞান ও শিল্পকলার মিথস্ক্রিয়া। ব্যক্তিগত ব্লগ: জীবনের বিজ্ঞান (১৩)। প্রকাশিত অনুবাদ: দ্য গড ডিল্যুশন (অনার্য এবং সেইবই ইবুক সংস্করণ), ওয়েজ অব সিইং (অনার্য), দর্শনের সহজ পাঠ (দিব্য প্রকাশ), সভ্যতা: একটি ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি (দিব্য প্রকাশ), দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ (দিব্য প্রকাশ), দেখার দৃষ্টিভঙ্গি (দিব্য প্রকাশ), দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং (সেইবই, ইবুক), ইসলাম ও সহিষ্ণুতার ভবিষ্যৎ: একটি সংলাপ (সেইবই, ইবুক)।
নোটস (লেখক পরিচিতি)
(১) নিকোলাস ‘নিকো’ টিনবার্গেন, ডাচ জীববিজ্ঞানী (১৯০৭ ১৯৮৮), কার্ল ভন ফ্রিশ, কনরাড লরেন্ড এর সাথে ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরষ্কার জিতেছিলেন।
(২) যুক্তরাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রিডার’ পদটি নির্দিষ্ট কোন ঊর্ধ্বতন গবেষকের জন্য, যার গবেষণা ও পাণ্ডিত্যের আন্তর্জাতিক সুখ্যাতি আছে।
(৩) চার্লস সিমোনী, হাঙ্গেরীয় আমেরিকান এই প্রকৌশলী মাইক্রোসফট-এর সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন বিভাগের প্রধান ছিলেন, এবং তার তত্ত্বাবধানে মাইক্রোসফট অফিস স্যুইটটির জন্ম হয়েছিল।
(৪) এই পদে বর্তমানে আসীন গণিতজ্ঞ মার্কাস পিটার ফ্রান্সিস দ্যু সোয়।
(৫) জর্জ ক্রিস্টোফার উইলিয়ামস (১৯২৬-২০১০) আমেরিকার বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক অ্যাট স্টোনি ব্রুক এর অধ্যাপক ছিলেন। তিনি সুপরিচিত ছিলেন গ্রুপ সিলেকশন ধারণাটির ঘোরতর বিরোধী হিসাবে। তার গবেষণা ৬০ এর দশকে জিন-কেন্দ্রিক বিবর্তনের ধারণাটিকে সংগঠিত হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
(৬) জন মেনার্ড স্মিথ (১৯২০-২০০৪) ব্রিটিশ তাত্ত্বিক বিবর্তন জীববিজ্ঞানী এবং জিনতাত্ত্বিক। মূলত তিনি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও সময়, পরে জীববিজ্ঞানী জে. বি. এস. হলডেনের অধীনে জিনতত্ত্ব নিয়ে পড়েন। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে বিবর্তনের তাত্ত্বিক ধারণায় গেম থিওরীর প্রয়োগ, এবং তিনি লিঙ্গ বিবর্তন ও সিগনালিং তত্ত্ব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রস্তাবও। করেন।
(৭) উইয়িলাম ডোনাল্ড ‘বিল’ হ্যামিলটন (১৯৩৬-২০০০) ব্রিটিশ বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা বিবর্তন তাত্ত্বিক হিসাবে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়। হ্যামিলটনের সবচেয়ে বড় অবদান প্রকৃতিতে দৃশ্যমান কিন সিলেকশন (একই জিন বহনকারীদের মধ্যে পারস্পরিক পরার্থবাদীতা) এবং অ্যালটুইজিম বা পরার্থবাদীতার জিন ভিত্তিটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা। এবং এই অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টিটি পরবর্তীতে জিন-কেন্দ্রিক বিবর্তনীয় ধারণাটি সুসংগঠিত করেছিল। তাকে সোসিওবায়োজলজীর অগ্রদূত হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়, যে ধারণাটি পরে ই, ও, উইলসন জনপ্রিয় করেছিলেন। হ্যামিলটন লিঙ্গ অনুপাত এবং বিবর্তন নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৯৮৪ থেকে তার মৃত্যু অবধি তিনি অক্সফার্ডের রয়্যাল সোসাইটি রিসার্চ অধ্যাপক ছিলেন।
(৮) রবার্ট লুডলো ‘বব’ ট্রিভার্স (জন্ম ১৯৪৩) আমেরিকার বিবর্তন জীববিজ্ঞানী ও সোসিওবায়োলজিষ্ট, রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং লেখক। ৭০ এর দশকের শুরুতে ট্রিভার্স রেসিপ্রোকাল অ্যালটুইজম (পারস্পরিক পরার্থবাদ) ও প্যারেন্টাল ইনভেষ্টমেন্ট (সন্তান প্রতিপালনে পিতামাতার বিনিয়োগ), প্যারেন্ট অফস্প্রিং কনফ্লিক্ট ( পিতামাতা ও সন্তানের দ্বন্দ্ব), ফ্যাকালটেটিভ সেক্স রেশিও ডিটারমিনেশন (প্রয়োজানুসারে লিঙ্গ অনুপাত নির্ধারণ) নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি সেলফ ডিপেশন। বা আত্মপ্রবঞ্চনাকে একটি অভিযোজনীয় কৌশল চিহ্নিত করে বেশ কিছু তাত্ত্বিক প্রস্তাবনাও করেছেন।
(৯) British Humanist Association
(১০) ব্রাইট মুভমেন্টস, প্রকৃতিবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন মানুষদের একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন (http://www.the brights.net/ movement/)।
(১১) উইলিয়াম পেইলী, ১৭৪৩-১৮০৫, ইংলিশ যাজক, দার্শনিক, তিনি সুপরিচিত তার প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব বা ন্যাচারাল থিওলজীর জন্য যেখানে তিনি টেলিওলজিকাল বা পরমকারণ যুক্তি ব্যবহার করেছিলেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য তার Natural Theology or Evidences of the Existence and Attributes of the Deity, যেখানে আমরা তার ওয়াচমেকার বা ঘড়ি নির্মাতার উদাহরণটি পাই।
(১২) https://richarddawkins.net/
(১৩) http://kmhb.wordpress.com/