অধ্যায় ১৩ : জিনের দীর্ঘ হাত
অস্বচ্ছন্দ একটি টানাপোড়েন স্বার্থপর জিন তত্ত্বের কেন্দ্রীয় প্রস্তাবটির ধারণায় একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরী করে। এটি হচ্ছে জীবনের মৌলিক এজেন্ট হিসাবে জিন এবং একক প্রজাতি সদস্যদের শরীরের মধ্যকার টানাপোড়েন। একদিকে আমাদের সামনে স্বতন্ত্র ডিএনএ অনুলিপনকারীদের বিস্ময়কর ছবি, শামোয়া হরিনের মত লাফিয়ে লাফিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যা হস্তান্তরিত হচ্ছে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই, মুক্ত, সাময়িকভাবে যাদের একই জায়গায়। জড়ো করে ব্যবহারের-পর-পরিত্যাগ করার মত শরীর নামের সারভাইভাল মেশিনগুলো। অমর সেই কুণ্ডলী, নিজেদের জন্য পৃথক একটি অনন্তকাল রচনা করার লক্ষ্যে অশেষ ধারাবাহিকতায় ক্রম প্রবাহমান মরণশীল জীব শরীর সে রদবদল করে। আর অন্যদিকে আমরা একক প্রজাতি সদস্যদের শরীরের দিকে তাকাই এবং তাদের প্রত্যেকটি, সুস্পষ্টভাবে একটি সঙ্গতিপূর্ণ, পূর্ণাঙ্গ, সুসংহতভাবে সামগ্রিক, অতিমাত্রায় জটিল কোনো যন্ত্র, যা সুস্পষ্টভাবে উদ্দেশ্যপুরণে একীভুত হয়ে আছে। কোনো শরীরকে ‘দেখলে মনে হয়না তারা যুদ্ধরত জিনগত এজেন্টদের একটি শিথিল এবং সাময়িক কোনো জোট, শুক্রাণু বা ডিম্বাণুতে সওয়ার হয়ে পরবর্তীতে বিশাল জিনগত ডায়াস্পোরার অংশ হবার আগে যাদের একে অপরের সাথে পরিচিত হবার সময় নেই বললেই চলে। এর একটি একক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি একাগ্র মনের মস্তিষ্ক আছে, যা একটি লক্ষ্য অর্জনে হাত-পা এবং অনুভব করার ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার সমন্বয় সাধন করে। শরীর দেখতে এবং আচরণে তার নিজের যোগ্যতায় যথেষ্ট বিস্ময়কর একটি এজেন্ট।
এই বইয়ের কিছু অধ্যায়ে আমরা আসলেই কোনো একটি একক জীবকে এজেন্ট হিসাবে ভেবেছিলাম, যারা তাদের সব জিনগুলোকে পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সফলতা নিশ্চিৎ করার চেষ্টা করছে। আমরা কল্পনা করেছি, বিভিন্ন পদক্ষেপের সম্ভাব্য জিনগত সুবিধাগুলো নিয়ে একক জীব সদস্যরা জটিল অর্থনৈতিক “কি হতে পারে যদি’ হিসাব নিকাশ করছে। এছাড়া অন্য অধ্যায়ে জিনদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মৌলিক যুক্তিটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। জিনদের দৃষ্টি দিয়ে জীবনের দৃশ্য ব্যতীত সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, কেনই বা কোনো জীব তার নিজের ও তার নিকটাত্মীয়দের প্রজনন সাফল্য নিয়ে চিন্তা করবে বরং, যেমন ধরুন, তার নিজের দীর্ঘায়ু হবার কথা চিন্তা করা বাদ রেখে।
জীবনের দিকে দুটি উপায়ে তাকানোর এই ধাঁধাটি আমরা কিভাবে সমাধান করতে পারি? আমার নিজের সেই প্রচেষ্টাটিকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছি ‘দি এক্সেটেন্ডেড ফেনোটাইপ’ বইটিতে, যে বইটি পেশাগত জীবনে আমি যা কিছু অর্জন করেছি তার থেকে অনেক বেশী, আমার গর্ব এবং আনন্দ। এই অধ্যায়টি সেই বইয়ের মূল কিছু ধারণার একটি সংক্ষিপ্ত পরিশোধিত রুপ, কিন্তু আসলেই আমি প্রায় না বলে থাকতে পারছি না, আপনি বরং এই বই পড়া বন্ধ করে ‘দি এক্সেটেন্ডেড ফেনোটাইপ’ পড়া শুরু করুন এই মুহূর্তেই!
ডারউইনীয় নির্বাচন যেকোনো অর্থপূর্ণ বোধগম্য দৃষ্টিভঙ্গিতেই জিনদের উপর সরাসরি কাজ করে না। ডিএনএকে আবৃত করে রাখে প্রোটিন, যাকে ঘিরে থাকে পর্দা, পৃথিবীর সব কিছু থেকে সুরক্ষিত এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের দৃষ্টিতে অদৃশ্য। যদি নির্বাচন সরাসরি চেষ্টা করে কোনো ডিএনএ অণুকে নির্বাচন করতে, তার পক্ষে আসলেই সেই কাজটি করার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। কারণ সব জিনই দেখতে একই রকম, যেমন, সব রেকর্ডিং টেপ দেখতে একই রকম। জিনদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যগুলো দৃশ্যমান হয় শুধুমাত্র তাদের প্রভাবের পরিণতিতে। সাধারণত এটি বলতে আমরা যা বুঝি সেটি হচ্ছে, জণগত বিকাশের সময় আরোপিত প্রভাবসমূহ, এবং এভাবেই শরীরের রুপ, আকার, আকৃতি এবং আচরণে। সফল জিনগুলো হচ্ছে সেই জিনগুলো যারা একই সাথে ভাগ করে নেয়া কোনো একটি ভ্রূণের মধ্যে, বাকী সব জিন দ্বারা প্রভাবিত পরিবেশে, সেই ভ্রূণের উপর তার উপকারী প্রভাব ফেলে। উপকারী মানে, তারা দ্রুণটিকে একটি সফল পূর্ণবয়স্ক জীবে পূর্ণবিকশিত হতে সহায়তা করে, একটি প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য, যার প্রজনন এবং সেই একই জিনগুলো পরবর্তী প্রজন্মগুলোয় হস্তান্তর করার সম্ভাবনা থাকবে। কোনো একটি জিনের শারীরিক বহিঃপ্রকাশকে বোঝাতে যে কারিগরী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, সেটি হচ্ছে ‘ফিনোটাইপ’:ভ্রুণ বিকাশ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমরুপ অ্যালিল জিনের প্রভাবের তুলনায় কোনো শরীরের উপর একটি জিনের কি প্রভাব আছে। কোনো সুনির্দিষ্ট জিনের ফিনোটাইপিক প্রভাব হতে পারে যেমন, ধরুন, সবুজ রঙের চোখ। বাস্তব ক্ষেত্রে অধিকাংশ জিনের একাধিক ফিনোটাইপিক প্রভাব আছে, যেমন, সবুজ চোখ এবং কোকড়া চুল। প্রাকৃতিক নির্বাচন কোনো কোনো জিনকে সুবিধা দেয় অন্যান্য জিনের তুলনায়, এর কারণ কিন্তু জিনদের নিজেদের প্রকৃতিগত কোনো বৈশিষ্ট্য না, বরং এদের সৃষ্ট ফলাফল বা পরিণতির জন্য– তাদের ফিনোটাইপিক প্রভাব।
ডারউইনবাদীরা সাধারণত সেইসব জিনগুলো নিয়ে আলোচনা করতে বাছাই করেন যাদের ‘ফিনোটাইপিক প্রভাব পুরো শরীরগুলোর টিকে থাকা এবং প্রজননের ক্ষেত্রে সহায়তা করে অথবা শাস্তি দেয়। তারা সাধারণত কোনো একটি জিনের কি উপকার হচ্ছে বা হচ্ছে না, সেই বিষয়টি বিবেচনা করেন না। আংশিকভাবে এটাই কারণ, কেন এই তত্ত্বটির কেন্দ্রের সেই প্যারাডক্স বা আপাত স্ববিরোধী বিষয়টি নিজেকে সেভাবে প্রকট করে ধরা দেয় না। যেমন, একটি শিকারী প্রাণীর দৌড়ের গতিবেগ বাড়ানোর মাধ্যমে কোনো একটি জিন হয়তো সফল; শিকারী প্রাণীটির পুরো শরীর, তার সব জিনসহ, আরো বেশী সফল, কারণ এটি দ্রুত দৌড়াতে পারে। এর গতি একে সাহায্য করে টিকে থাকতে ও বেশী সন্তানের জন্ম দিতে এবং সেকারণে এর সবগুলো জিনের আরো অনুলিপি, দ্রুত দৌড়াবার জিনসহ, পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়। এখানে প্যারাডক্সটি সুবিধাজনকভাবে অপসারিত হয় কারণ যা কোনো ‘একটি জিনের জন্য ভালো, সেটি ‘সব’ জিনের জন্য ভালো।
কিন্তু কি হতে পারে, যদি কোনো একটি জিন এমন কোনো ফিনোটাইপিক প্রভাব সৃষ্টি করে, যা তার নিজের জন্য ভালো হতে পারে, কিন্তু সেটি শরীরের বাকী সব জিনগুলোর জন্য খারাপ হয়? এটি কোনো কল্পনা নয়। এ ধরনের উদাহরণ আমাদের জানা আছে, যেমন, অদ্ভুত সেই বিষয়টি, যাকে বলে মাইওটিক ড্রাইভ। মাইওসিস, আপনার হয়তো মনে পড়বে, একটি বিশেষ ধরণের কোষ বিভাজন, যেখানে ক্রোমোজোমের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যায় এবং জনন কোষ, যেমন, শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু তৈরী করে। সাধারণ মাইওসিস একটি লটারীর মত পুরোপুরিভাবে নিরপেক্ষ। প্রতি জোড়া অ্যালিলদের মধ্য থেকে, একটি মাত্র জিন সৌভাগ্যবান হবে যা কিনা কোনো একটি ডিম্বাণু বা শুক্রাণুতে প্রবেশ করবে। এবং একইভাবে সমপরিমান সম্ভাবনা থাকে যে জোড়ার যেকোনো একটি এবং যদি আপনি গড় করেন বহু সংখ্যক শুক্রাণুর ( বা ডিম্বাণুর) দেখা যাবে এর অর্ধেকটিতে থাকে একটি অ্যালিল ও অর্ধেকটিতে অন্য আরেকটি। মাইওসিস তাই নিরপেক্ষ, কোনো একটি পয়সা টসের জন্য উপরের দিকে ছোঁড়ার মতই। যদিও প্রথাগতভাবেই আমরা সেই পয়সাকে লটারীর জন্য উপরের দিকে ছুঁড়ে মারাটা র্যানডোম হিসাবে ভাবছি, এমনকি সেটাও একটি ভৌতিক প্রক্রিয়া যাকে প্রভাবিত করে বহু সংখ্যক পরিস্থিতি, যেমন, বাতাস, ঠিক কিভাবে পয়সাটি ছুঁড়ে মারা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মাইওসিসও, একটি ভৌত প্রক্রিয়া এবং এটিও জিনদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। কি হতে পারে যদি কোনো মিউট্যান্ট বা পরিবর্তিত জিনের উদ্ভব হলো, যার ঘটনাচক্রে সেই প্রভাবটি আছে, চোখের রং বা কোকড়ানো চুলের মত কোনো স্পষ্ট কোনো কিছুর উপর নয়, বরং মাইওসিস প্রক্রিয়াটির উপর? ধরুন এটি মাইওসিসকে পক্ষপাতদুষ্ট করতে পারে এমন একটি উপায়ে যে, মিউট্যান্ট জিন নিজেই, তার অ্যালিল রুপটির তুলনায় জনন কোষে প্রবেশ করার জন্য অনেক বেশী সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। এধরনের কিছু জিন আছে, যাদের বলে ‘সেগ্রেগেশন ডিসটার’, যারা পৃথকীকরণ প্রক্রিয়াকে বিকৃত করে। তাদের ভয়াবহ অশুভ একটি একটি সরলতা আছে। যখন কোনো সেগ্রেগেশন ডিসটার জিনের উদ্ভব হয় মিউটেশনের মাধ্যমে, এটি কোনো বাধা ছাড়াই অবশ্যম্ভাবীভাবে জনগোষ্ঠীতে তার অ্যালিলের পরিবর্তে ছড়িয়ে পড়ে। এটাই পরিচিত মাইওটিক ড্রাইভ হিসাবে। এটি ঘটে এমনকি যখন শরীরের কল্যাণের উপর এবং শরীরের বাকী সব জিনদের কল্যাণের উপর এর প্রভাব অনেক বেশী ক্ষতিকর।
পুরো বই জুড়ে সেই সম্ভাবনা সম্বন্ধে আমরা সতর্ক যে, একক জীবসদস্যরা তাদের সামাজিক সঙ্গীদের বিরুদ্ধে সূক্ষ্মভাবে ‘প্রতারণা করতে পারে। এখানে আমরা একক জিনের অন্য সব জিনের বিরুদ্ধে প্রতারণা করার বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি, যাদের সাথে এটি একই শরীরে বসবাস করে। জিনতাত্ত্বিক জেমস ক্রো তাদের চিহ্নিত করেছিলেন, সেই জিনগুলো যা সিস্টেমের বিরুদ্ধে জয়ী হয়। একটি সুপরিচিত সেগ্রেগেশন ডিসটটার হচ্ছে ইঁদুরদের ‘টি (t) জিন। যখন কোনো ইঁদুরের দুটি ‘টি জিন থাকে এটি হয় অল্পবয়সে মারা যায়, নয়তো কোনো সন্তান উৎপাদন করতে পারেনা, সে কারণে এটাকে বলা হয় লিথাল বা প্রাণঘাতী, যখন এটি হোমাজাইগাস অবস্থায় বিদ্যমান থাকে (বা ক্রোমোজোমে একই জিনের দুটি কপির উপস্থিতি থাকে); যদি কোনো পুরুষ ইঁদুরের শুধুমাত্র একটি ‘টি জিন থাকে, এটি সুস্থ ও স্বাভাবিক ইঁদুর হবে শুধুমাত্র একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছাড়া। আপনি যদি এই পুরুষ ইঁদুরটির শুক্রাণু পরীক্ষা করে দেখেন, আপনি দেখবেন যে প্রায় ৯৫ শতাংশেই ‘টি’ জিনটি আছে, শুধু ৫ শতাংশের মধ্যে আছে এর স্বাভাবিক অ্যালিলটি। এটি অবশ্যই আমদের প্রত্যাশিত ৫০ শতাংশ অনুপাতের একটি বড় মাপের বিকৃতি। যখনই, কোনো বন্য জনগোষ্ঠীতে, মিউটেশনের মাধ্যমে একটি ‘টি’ জিনের অ্যালিলের আবির্ভাব ঘটে, তাৎক্ষণিকভাবে এটি ‘দাবানলের মতো দ্রুত জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ে। কেনই বা সেটি হবে না, যখন মাইওটিক লটারীতে এটি এত বেশী মাত্রায় পক্ষপাতিত্বমূলক সুবিধা পায়? এটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে যে, খুব শীঘ্রই জনগোষ্ঠীতে বেশ বড় মাপের একটি জনগোষ্ঠী ‘টি জিন উত্তরাধিকার সূত্রে পায় দ্বিগুণ মাপে (মা ও বাবা দুজনের কাছ থেকে)। এই একক সদস্যগুলো মারা যায় অথবা তারা সন্তান উৎপাদনক্ষম থাকে না, এবং খুব পুরো জনগোষ্ঠীটি বিলুপ্ত হয়ে যাবার জন্য বেশী সময় লাগেনা। বেশ কিছু প্রমাণও আছে যে ইঁদুরদের বন্য জনগোষ্ঠী অতীতে ‘টি’ জিনের মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েকবার বিলুপ্ত হয়েছিল।
সব ‘সেগ্রেগেশন ডিসটৰ্টারের’ এ-ধরণের বিধ্বংসী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, তাসত্ত্বেও তাদের বেশীর ভাগ সদস্যেরই নিদেনপক্ষে কিছুটা ক্ষতিকর পরিণতি আছে। (প্রায় সব জিনগত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ক্ষতিকর, এবং একটি নতুন মিউটেশন সাধারণত বিস্তার করে শুধুমাত্র যদি এর খারাপ প্রভাবের চেয়ে এর ভালো প্রভাব বেশী হয়। যদি ভালো এবং খারাপ দুটি প্রভাবই পুরো শরীরের উপর আরোপ করা যায়, এর সর্বমোট প্রভাব তারপরও শরীরের জন্য ভালো। কিন্তু যদি খারাপ প্রভাবটি শরীরের উপর পড়ে এবং ভালো প্রভাবটি শুধুমাত্র জিনের উপর এককভাবে পড়ে, শরীরের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর সর্বমোট প্রভাব হচ্ছে সবটুকু খারাপ); এর এই ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও, যদি কোনো সেগ্রেগেশন ডিসটার মিউটেশনের মাধ্যমে উদ্ভব হয় এটির অবশ্যই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা থাকবে। প্রাকৃতিক নির্বাচন (যা, সর্বোপরি কাজ করে জিন পর্যায়ে) সেগ্রেগেশন ডিসটর্টারের সমর্থন করে, এমনকি যখন একক কোনো জীব সদস্যর উপর এর প্রভাব খারাপ হবার সম্ভাবনাই বেশী।
যদিও সেগ্রেগেশন ডিসটর্টারের অস্তিত্ব আছে, তবে তাদের সচরাচর দেখা যায় না। আমরা জিজ্ঞাসা অব্যাহত রাখতে পারি কেন তাদের এত সচরাচর দেখা যায় না এই বিষয়ে, সেটি মূলত আরেকটি উপায়ে জিজ্ঞাসা করা, কেন মাইওসিস প্রক্রিয়া সাধারণত পক্ষপাতমুক্ত, খুব নিখুঁতভাবে কোনো একটি পেনীকে উপরে ছুঁড়ে টস করার মতই পক্ষপাতহীন। আমরা দেখবো যে, এর উত্তর কিভাবে বেরিয়ে আসে যদি আমরা বুঝতে পারি কেনই বা জীবদের অস্তিত্ব আছে।
প্রতিটি একক জীবই হচ্ছে এমন কিছু যাদের অস্তিত্ব বেশীর ভাগ জীববিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছেন খুব স্বাভাবিক একটি ব্যপার হিসাবে, কারণ, সম্ভবত এর নানা অংশগুলো একসাথে নিজেদের এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত উপায়ে ধরে রাখে। জীবন সংক্রান্ত সব প্রশ্নগুলোই প্রথাগতভাবে জীবদের প্রসঙ্গে প্রশ্ন। জীববিজ্ঞানীরা জিজ্ঞাসা করেন কেন জীবরা এটা বা ওটা করে। তারা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেন, কেন জীবরা তাদের নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠী সৃষ্টি করে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। তারা জিজ্ঞাসা করেন না– যদিও যে প্রশ্নটি তাদের করা উচিৎ– প্রথমে কেনই বা জীবিত পদার্থগুলো একসাথে জড়ো হয়ে কোনো জীব সৃষ্টি করছে। কেন সমুদ্র এখনও মুক্ত আর স্বাধীন অনুলিপনকারীদের আদিম যুদ্ধক্ষেত্র নয়? কেন প্রাচীন অনুলিপনকারীরা একসাথে জড়ো হয়, রবোটের মত শরীর বানাতে ও তার মধ্যে বসবাস করার জন্য এবং কেন ঐসব রোবোটগুলো– একক শরীরগুলো, আপনি এবং আমি– কেন এত বড় আর এত বেশী জটিল?
বহু জীববিজ্ঞানীর জন্য এমনকি কঠিন অনুধাবন করা যে, এখানে আদৌ কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে। এর কারণ এটি যে একক জীব পর্যায়ে সাধারণত প্রশ্ন করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিছু জীববিজ্ঞানী এমনকি এভাবে ভাবেন যে ডিএনএ হচ্ছে জীবদের প্রজননের জন্য ব্যবহৃত কোনো যন্ত্র, ঠিক যেমন চোখ হচ্ছে কোনো অঙ্গ যা ব্যবহার করা হয় দেখার জন্য। এই বইয়ের পাঠকরা শনাক্ত করতে পারবেন যে এই দৃষ্টিভঙ্গিটি একটি বড় মাপের বোঝার অক্ষমতার কারণে সৃষ্ট ভুল, সত্যটাকে পুরোপুরিভাবে না বুঝতে পারা। তারা একই সাথে শনাক্ত করতে পারবেন যে এর বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিটি, জীবনের স্বার্থপর জিনের দৃষ্টিভঙ্গির নিজস্ব কিছু গভীর সমস্যা আছে। সেই সমস্যাটি প্রায় বিপরীত হচ্ছে কেন একক প্রাণীদের আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে, বিশেষ করে এমন একটি রুপে, যা এত বড় এবং সংগঠিত এর উদ্দেশ্যে যে, জীববিজ্ঞানীদের সত্যটাকে পুরোপুরি উল্টোভাবে অনুধাবন করার জন্য বিভ্রান্ত করে। এই সমস্যা সমাধান করতে, আমাদের শুরু করতে হবে মনের মধ্য থেকে পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গিকে পুরোপুরি বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেবার মাধ্যমে, যা খুব গোপনেই একটি একক জীবের অস্তিত্বকে খুব স্বাভাবিক হিসাবে মেনে নিয়েছে। অন্যথায় আমরা আরো প্রশ্নের জন্ম দেবো। যে কৌশলটি ব্যবহার করে আমরা আমাদের মনকে পরিচ্ছন্ন করতে পারি সেই ধারণাটিকে আমি বলবো এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপ বা “সম্প্রসারিত’ ফিনোটাইপ। এই ধারণাটি কি, এর অর্থই বা কি, সেই দিকে আমি এবার দৃষ্টি ফেরাবো।
কোনো জিনের ফিনোটাইপিক প্রভাব মানে সাধারণত এটি যে শরীরে অবস্থান করছে সেই শরীরের উপর এর সবগুলো প্রভাবকে একত্রে যেভাবে দেখা হয়। এটাই প্রচলিত সংজ্ঞা। আমরা এখন দেখবো, কেন কোনো একটি জিনের ফিনোটাইপিক প্রভাবগুলোকে, ‘পৃথিবীতে সেই জিনটির সামগ্রিক প্রভাবসমুহ’ হিসাবে ভাবা প্রয়োজন। হতে পারে কোনো একটি জিনের প্রভাব, বাস্তবিকভাবে, একের পর এক শরীরের ধারাবাহিকতায় যে শরীরগুলোয় জিনটি অবস্থান করে সেখানে সীমাবদ্ধ। কিন্তু তাই যদি হয়, এটি শুধুমাত্র একটি বাস্তব তথ্য হবে। তবে এটি এমন কিছু হবে না, আমাদের এই বিশেষ সংজ্ঞার যা অংশ হওয়া উচিৎ। এই সব কিছুর মধ্যে, মনে রাখবেন যে, কোনো একটি জিনের ফিনোটাইপিক প্রভাবগুলো হচ্ছে সেই কৌশল, যা দিয়ে সে পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হবার জন্য তার নিজের জন্য সুবিধা করে নেয়। আমি শুধু যোগ করবো যে এই কৌশলগুলো একক কোনো জীব শরীরের বাইরেও সম্প্রসারিত হতে পারে। ব্যবহারিক পর্যায়ে এর কি অর্থ হতে পারে, যখন বলা হয় কোনো একটি জিন, সে যে শরীরের বাস করে, সেই শরীরের বাইরের পৃথিবীতে এটি সম্প্রসারিত ফিনোটাইপিক প্রভাব ফেলতে পারে? মনের মধ্যে যে উদাহরণগুলো জেগে উঠছে সেগুলো হচ্ছে, যেমন, বিভার ড্যামের মত কোনো নির্মাণ,পাখির বাসা, ক্যাডিস মাছির বানানো ঘর।
ক্যাডিস ফ্লাইরা দেখতে তেমন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নয়, বিবর্ণ বাদামী রঙের একটি পতঙ্গ, আমরা বেশীর ভাগ মানুষরাই হয়তো যাদের লক্ষই করিনা যখন সেগুলো নদীর পানির উপর এলোমেলোভাবে উড়ে বেড়ায়। এটি ঘটে যখন তারা প্রাপ্তবয়স্ক। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বের হয়ে আসার আগে জন্মের পর তাদের জীবনকালের একটি দীর্ঘ সময় লার্ভা হিসাবে নদীর তলদেশে হাটাহাটি করে কাটাতে হয়। এই ক্যাডিস লার্ভা চোখে পড়ার মত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, পৃথিবীর সব আকর্ষণীয় প্রাণীদের মধ্যে তারা অন্যতম। তাদের নিজেদের শরীরের মধ্যে সৃষ্টি করা সিমেন্ট ব্যবহার করে দিয়ে খুব দক্ষতার সাথে নদীর তলদেশে খুঁজে পাওয়া যেকোনো উপাদান দিয়ে তারা তাদের নিজেদের জন্য টিউবের মত ঘর তৈরী করে। এই ঘরগুলো এক জায়গায় স্থির নয়, ক্যাডিসরা যখন হাটে তারা সেটি সঙ্গে করে নিয়ে চলে; কোনো শামুকের খোলস বা হার্মিট ক্র্যাবদের মত শুধুমাত্র পার্থক্য এটা তাদের শরীরে নিজেরা গজিয়ে তোলার বদলে বা খুঁজে পাওয়া কোনো কিছু ব্যবহার করার ব্যতিক্রম এই ঘরগুলো তারা নিজেরা বানায়। ক্যাডিসদের কোনো কোনো প্রজাতির সদস্যরা নির্মাণ সামগ্রী হিসাবে কাঠি ব্যবহার করে, কেউ মরা পাতার টুকরো, কেই হয়তো শামুকের ছোট খোলস ব্যবহার করে। কিন্তু হয়তো সবচেয়ে বিস্ময়কর ক্যাডিস বাড়ি হচ্ছে যা স্থানীয়ভাবে খুঁজে পাওয়া পাথর ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়। খুব সতর্কতার সাথে ক্যাডিসরা পাথর বাছাই করে, খুব ছোট বা বড় পাথরগুলো যা দেয়ালের বর্তমান ছিদ্রটিকে ঢাকতে সম্ভব না সেই পাথরগুলোকে তারা বাদ দেয়, এমনকি প্রতিটি পাথরকে তারা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরীক্ষা করে দেখে যতক্ষণ না দেয়ালে যে জায়গাটা তারা ঢাকতে চাইছে সেটি পুরোপুরিভাবে খাপ খায়।
কিন্তু ঘটনাটি আমাদের কেন এত মুগ্ধ করে? আমরা যদি বাধ্য হই নির্মোহ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে, তাহলে আমাদের তো ক্যাডিসের চোখের স্থাপত্য বা এর কনুইয়ে অস্থিসন্ধি নিয়ে আরো বেশী বিস্মিত হওয়া উচিৎ হবে, কারণ সেই তুলনায় তাদের বানানো পাথরের বাড়ির স্থাপত্য মাঝারী মানের। আর যাই হোক না কেন, সর্বোপরি তাদের বানানো ঘরের চেয়ে চোখ আর অস্থিসন্ধি অনেক বেশী জটিল আর ‘পরিকল্পিত’। তারপরও হয়তো তাদের চোখ আর কনুইয়ের অস্থিসন্ধি আমাদের নিজেদের চোখ এবং কনুই যেভাবে বিকশিত হয়েছে সেভাবেই বিকশিত হয়েছে ভ্রূণ থেকে, মায়ের গর্ভে বিকশিত হয়ে ওঠা এই নির্মাণ প্রক্রিয়ার জন্য আমরা কোনো কৃতিত্ব দাবী করি না, সে কারণে আমরা অযৌক্তিকভাবে আরো বেশী মুগ্ধ আর বিস্মিত হই তাদের বানানো ঘরগুলো দেখে।
প্রসঙ্গান্তরে অনেক কিছু বলার পর, আমি বিস্তারিতভাবে খানিকটা বাড়তি আলোচনা করার প্রলোভন এড়াতে পারছি না, ক্যাডিসদের বানানো বাসা দেখে আমরা যতই মুগ্ধ আর বিস্মিত হইনা কেন, তবুও বেশ ধাঁধার মতই একটি ব্যপার যে, আমাদের নিকটবর্তী একটি প্রাণীর সমরুপ অর্জন দেখে কিন্তু আমরা অপেক্ষাকৃত কম বিস্মিত হই। শুধু কল্পনা করুন কোনো পত্রিকার প্রধান শিরোনাম কি হতে পারে, যদি কোনো সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন যে ডলফিনের কোনো একটি প্রজাতি অনেক বড়, জটিল বুনানিসহ মাছ ধরার জাল বানাতে পারে, যার দৈর্ঘ্য বিশটি ডলফিনের সমান! অথচ, মাকড়শার বোনা জটিল জালগুলো আমরা খুব স্বাভাবিক একটি ব্যপার হিসাবে ধরে নেই, পৃথিবীর অন্যতম বিসয় নয় বরং ঘরবাড়িতে সৃষ্ট হওয়া বাড়তি কোনো ঝামেলা হিসাবে। এবং সেই হট্টগোলটির ভাবুন যদি জেন গুডল গমবে স্ট্রিম থেকে এমন কোনো আলোকচিত্র নিয়ে ফিরে আসেন, যেখানে বন্য শিম্পাঞ্জিকে দেখা যায় নিজেদের জন্য ছাদসহ এবং পরিবেশ থেকে সুরক্ষিত করে সুন্দর বাড়ি বানাচ্ছে, খুব কষ্ট করে পাথর নির্বাচন করে, তারপর একটার পর একটা সাজিয়ে সিমেন্ট সদৃশ কিছু দিয়ে সেগুলো পরস্পর সংযুক্ত করছে! কিন্তু দেখুন, ক্যাডিস লার্ভা ঠিক সেই কাজটি করছে, যা সামান্য এক ঝলক মুগ্ধ হয়ে তাকানোর চেয়েও আরো বেশী আগ্রহ আমাদের কাছে প্রত্যাশা করে। মাঝে মাঝে বলা হয়, যেন এই সব দ্বিমুখী মানদণ্ডের সমর্থনে, মাকড়শা আর ক্যাডিসরা তাদের ‘ইন্সটিঙ্কট বা সহজাত প্রবৃত্তির মাধ্যমে তাদের এই স্থাপত্য নির্মাণের দক্ষতা অর্জন করে। কিন্তু তাহলেই বা কি আসে যায়? একটি উপায়ে এই সবকিছুই তো তাদের আরো বেশী মুগ্ধ করে তোলে আমাদের কাছে।
মূল যুক্তিতে আবার আমরা ফিরে আসি। ক্যাডিসদের ঘর, কেউই সন্দেহ করতে পারবেন না, একটি অভিযোজন, যা বিবর্তিত হয়েছে ডারউইনীয় নির্বাচনের মাধ্যমে। অবশই এটি সহায়তা পেয়েছে নির্বাচনের, সেই একই উপায়ে যেভাবে লবস্টারের মোটা কঠিন খোলশ নির্বাচনী সুবিধা পেয়েছে। এটি তাদের শরীরের সুরক্ষা দানকারী একটি আবরণ, এটি এমন যে পুরো জীবকে এটি সুবিধা দেয় এবং অবশ্যই তার সব জিনকেও। কিন্তু আমরা এখন কোনো জীবের জন্য সুবিধার বিষয়টি আকস্মিক হিসাবে দেখতে শিখিয়েছি, যতক্ষণ সেটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিষয়। যে সুবিধাগুলো আসলে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো ঐসব জিনগুলোর সুবিধা, যা এর খোলশকে এর সুরক্ষাকারী বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। লবস্টারের ক্ষেত্রে এটাই প্রচলিত স্বাভাবিক কাহিনী। লবস্টারের খোলশ অবশ্যই তার শরীরের একটি অংশ। কিন্তু ক্যাডিসের বাড়ীর ক্ষেত্রে বিষয়টা তাহলে কি?
প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই সব পূর্বসূরি ক্যাডিস জিনদের সুবিধা দেয় যা তাদের বহনকারীদের কার্যকরী ঘর নির্মাণ করানোর কারণ হয়। জিনগুলো কাজ করে আচরণের উপর, খুব সম্ভবত স্নায়ুতন্ত্রের জণগত বিকাশকে প্রভাবিত করার মধ্যে। কিন্তু কোনো একজন জিনতাত্ত্বিক যা আসলে দেখেন, সেটি হচ্ছে ঘরের আকার ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যাবলীর উপর জিনগুলোর প্রভাব হিসাবে। একজন জিনতাত্ত্বিকের উচিৎ হবে ঘরের আকার-আকৃতির জন্য দায়ী সেই জিনগুলো শনাক্ত করা, ঠিক সেই একই অর্থে যেমন, ধরুন পায়ের আকৃতির জন্য দায়ী কোনো জিনের ক্ষেত্রে করা হয়। স্বীকার করতেই হবে কেউই আসলে ক্যাডিসদের বানানো ঘরের জিনতত্ত্ব নিয়ে কোনো গবেষণা করেননি। সেটা করতে হলে আমাদের খুব সতর্কভাবে ল্যাবরেটরীতে বন্দী দশায় ক্যাডিসদের বংশধারা বা পেডিগ্রি রেকর্ড রাখতে হবে এবং তাদের কৃত্রিমভাবে প্রজনন করার প্রক্রিয়াটি খুবই কঠিন। কিন্তু আপনার জিনতত্ত্ব পড়ার দরকার হবেনা নিশ্চিৎ হবার জন্য যে, বিভিন্ন ক্যাডিসদের বানানো ঘরগুলোর পারস্পরিক ভিন্নতাকে প্রভাবিত করার জন্য জিন আছে বা নিদেন পক্ষে একসময় ছিল। বিশ্বাস করার জন্য আপনার যা দরকার সেটি হচ্ছে খুব ভালো একটি কারণ যে, ক্যাডিসদের বানানো বাড়িগুলো আসলেই ডারউইনীয় অভিযোজন। সেই ক্ষেত্রে সেখানে অবশ্যই জিন ছিল যারা ক্যাডিসদের বাড়ির বৈচিত্র্যটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, কারণ নির্বাচন কোনো অভিযোজন সৃষ্টি করতে পারেনা যদি না বংশগতির ক্ষেত্রে কোনো ভিন্নতা না থাকে, যেখান থেকে প্রক্রিয়াটি নির্বাচন করতে পারে।
যদিও জিনতাত্ত্বিকরা হয়তো ভাবতে পারেন এটা খুব অদ্ভুত একটি ধারণা, সে-কারণে আমাদের জন্য যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত হবে পাথরের আকার,আকৃতি, কাঠিন্য ইত্যাদির জন্য জিনদের কথা বলা। কোনো জিনতাত্ত্বিক, যিনি এই ভাষার প্রতিবাদ করেন, তার অবস্থানে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হলে, তাকে চোখের রঙের জন্য জিন, মটরশুটির কুচকানো চামড়ার জন্য জিন ইত্যাদি বিষয়েও আপত্তি জানাতে হবে। একটি কারণ হচ্ছে পাথরের ক্ষেত্রে এই ধারণাটি মনে হতে পারে অদ্ভুত এবং পাথর জীবিত কোনো পদার্থ নয়। উপরন্তু, পাথরের প্রকতির উপর জিনের প্রভাব মনে হতে পারে বিশেষভাবে পরোক্ষ। কোনো জিনতাত্ত্বিক হয়তো এমন কোনো দাবী করার ইচ্ছা করতে পারেন, স্নায়ুতন্ত্রের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে জিনগুলো ক্যাডিসদের পাথর বাছাই করার আচরণটি মধ্যস্থতা করে, এরা সরাসরি পাথরের উপর কাজ করছেনা। কিন্তু আমি এই সব জিনতাত্ত্বিকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি খুব সতর্কতার সাথে সেই বিষয়টি লক্ষ করতে, আসলেই কি বোঝায়, যখন বলা হয় জিনগুলো স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রভাব বিস্তার করছে। জিনগুলো শুধুমাত্র যা আসলেই করতে পারে সরাসরিভাবে সেটি হচ্ছে প্রোটিন সংশ্লেষণ। স্নায়ুতন্ত্রের উপর কোনো জিনের প্রভাব, অথবা, সেই অর্থেই, চোখের রঙের উপর বা মটরশুটির বীজের গায়ের চামড়া কুচকানোর উপর তার প্রভাব সবসময়ই পরোক্ষ। জিন নির্ধারণ করে একটি প্রোটিন। অনুক্রম যা প্রভাবিত করে ‘ক’ কে, যা প্রভাবিত করে ‘খ’ কে, যা প্রভাবিত করে ‘গ’ কে, যা পরিশেষে মটরশুটির বীজের চামড়ার কুচকানো বৈশিষ্ট্য অথবা স্নায়ুতন্ত্রের আন্তঃকোষীয় সংযোগকে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যাডিস লার্ভাদের বানানো বাড়ি শুধুমাত্র এই ধরনের কোনো ধারাক্রমের সামান্য সম্প্রসারণ। পাথরের কাঠিন্য হচ্ছে ক্যাডিস জিনের একটি ‘এক্সটেন্ডেড’ বা সম্প্রসারিত ‘ফিনোটাইপিক’ প্রভাব। যদি এটা বৈধ হয় বলা যে, একটি জিন মটরশুটির কুচকানো বৈশিষ্ট্য বা কোনো একটি প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করছে (সব জিনতাত্ত্বিকরাই তা ভাবেন) সুতরাং অবশ্যই কোনো জিন যা ক্যাডিসদের বাসার পাথরের কাঠিন্যের উপর প্রভাব ফেলছে এমন কিছু বলাও বৈধ হবে। চমকে দেবার মত ভাবনা, তাইনা? তারপরও এই যুক্তিটি এড়ানো সম্ভব না।
এবার আমরা প্রস্তুত এর পরের পর্বের যুক্তিটির জন্য কোনো একটি জীবের জিনগুলো আরেকটি জীবের শরীরের উপর সম্প্রসারিত ফিনোটাইপিক প্রভাব ফেলতে পারে। ক্যাডিসদের বাড়িগুলো আমাদের এর আগের ধাপটি নিতে সাহায্য করেছে, শামুকের বানানো খোলস এর পরের ধাপটি নিতে আমাদের সহায়তা করবে। ক্যাডিস লার্ভাদের জন্য তাদের বানানো পাথরের বাড়ি যে কাজ করে, শামুকের খোলস শামুকের জন্য সেই একই ভূমিকা পালন করে। শামুকদের শরীরের কোষ থেকে এই খোলসটি নির্মাণের প্রয়োজনীয় উপাদান নিঃসৃত হয়। সুতরাং কোনো প্রচলিত জিনতাত্ত্বিক খুশী হবেন খোলসের বৈশিষ্ট্য, যেমন, এর পুরুত্ব, নির্ধারণকারী জিনদের কথা বলতে। কিন্তু এই খোলসের বাড়তি পুরু হওয়ার বিষয়টি আমাদের কি বোঝাতে পারে? যদি পরজীবি আক্রান্ত শামুকে বাড়তি রকম পাতলা খোলস থাকে, আমরা আনন্দের সাথে এটিকে ব্যাখ্যা করি শামুকটির শরীরের সুস্পষ্ট অসুস্থতার প্রভাব হিসাবে। কিন্তু বেশী পুরুত্বের খোলস? ধারণা করা যেতে পারে বেশী মোটা খোলস শামুককে বেশী সুরক্ষা দেবে, দেখে মনে হচ্ছে যে পরজীবিতা তাদরে পোষক-বাহকদের খোলসে উন্নতি করার জন্য সাহায্য করছে। কিন্তু তারা কি আসলেই সেটি করছে?
আমাদের আরো একটু সতর্কতার সাথে ভাবতে হবে। যদি মোটা খোলসগুলো আসলেই শামুকদের জন্য ভালো হয়, তাহলে তারা নিজেরাই সেটি তৈরী করছেনা কেন, পরজীবি থাকুক বা না থাকুক। এর উত্তর সম্ভবত আছে অর্থনীতিতে। খোলস বানানো কোনো একটি শামুকের জন্য শক্তি খরচের ভাষায় বেশ ব্যয়সাপেক্ষ একটি প্রকল্প। কারণ এর জন্য বাড়তি শক্তিরও প্রয়োজন। এর জন্য দরকার ক্যালসিয়াম এবং অন্য রাসায়নিক দ্রব্য যা সংগ্রহ করতে হয় কঠোর পরিশ্রম করে অর্জন করে সংগৃহীত খাদ্য থেকে। এই সব সম্পদ, যদি খোলস নির্মাণে ব্যবহৃত না হয়, তাদের অন্য কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো, যেমন, আরো বেশী সন্তান সৃষ্টি। কোনো শামুক যে অনেক বেশী সম্পদ ব্যবহার করেছে বাড়তি পুরুত্বের খোলস বানানো জন্য, সে অবশ্যই তার নিজের শরীরের জন্য নিরাপত্তা ক্রয় করে ঠিকই; কিন্তু কি মূল্যে? এটি হয়তো দীর্ঘদিন বাঁচবে, কিন্তু এটি অপেক্ষাকৃতভাবে প্রজননে কম সফল হবে অথবা হয়তো তার জিনগুলো পরের প্রজন্মের হস্তান্তরিত করতে ব্যর্থ হবে। যে সকল জিনগুলো হস্তান্তরিত হতে ব্যর্থ হবে সেগুলো হচ্ছে বাড়তি মোটা খোলস বানানোর জিন। অন্যভাবে বললে, কোনো খোলসের পক্ষে খুব বেশী মোটা এবং খুব বেশী (আরো সুস্পষ্টভাবে) পাতলা হওয়া সম্ভব হতে পারে। সুতরাং, যখনই পরজীবি ফ্লক কোনো একটি শামুককে বাধ্য করে বাড়তি মোটা খোলস বানানোর জন্য, সেই ফুকটি শামুকের জন্য উপকারী কোনো কাজ করছে না, যদি না ফুক নিজেই এই বাড়তি মোটা খোলস বানাবার অর্থনৈতিক ব্যয়ভারটি বহন না করে থাকে। এবং আমরা নিরাপদে বাজি রাখতে পারি খুব একটি উদারতার কোনো কাজ সে এখানে করছে না। ফুকটি কোনো গোপন রাসায়নিক প্রভাব ফেলছে শামুকের উপর যা শামুককে বাধ্য করে তার পছন্দমত’ আর ‘সূবিধাজনক’ পুরুত্বসহ শামুকের খোলসটি থেকে দুরে সরে আসার জন্য। এটি হয়তো শামুকের জীবন দীর্ঘ করে, কিন্তু এটি শামুকের জিনদের কোনো উপকার করছে না।
এই হিসাব নিকাশের মধ্যে ফুকের কি লাভ? কেন সে এটি করছে? আমরা প্রস্তাবনা হচ্ছে এমন: শামুকের জিন ও ফ্লক জিন, উভয় জিনই শামুকের শরীর দীর্ঘায়ু হওয়ার কারণে সুফল পাবার অবস্থানে থাকে যদি শামুকটি দীর্ঘসময় ধরে বেঁচে থাকে, বাকি সবকিছু যদি অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তু টিকে থাকা আর প্রজনন এক কথা না, এখানে একটি লাভক্ষতির হিসাব নিকাশ আছে। যখন শামুকের প্রজনন থেকে শামুকের জিন লাভ করবে, ফুকের জিন কোনো লাভ করবে না। এর কারণ একটি ফ্লকের বিশেষভাবে নিশ্চিৎ কোনো সম্ভাবনা নেই যে এর জিনগুলো বর্তমান পোষকের সন্তানদের শরীরে বাস করবে। তারা সেটি করতে পারে, এবং একইভাবে সেটি করতে পারে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য ফুকরা। যেহেতু শামুকের দীর্ঘায়ু কিনতে হবে শামুকের প্রজনন সাফল্যর খানিকটা ক্ষতি সাধন করে, সেকারণে। ফুক জিনরা খুশী’ শামুকের জিনদের এর মূল্য পরিশোধ করিয়ে। যেহেতু তাদের নিজেদের এই শামুকের প্রজননের ব্যপারে সহায়তা করার কোনো আগ্রহ নেই। শামুকের জিনগুলো খুশী না এর মূল্য পরিশোধ করার ব্যপারে, কারণ শামুকের প্রজননের উপর তাদের দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। সুতরাং, আমি প্রস্তাব করছি যে, ফুক জিনরা শামুকের খোলস নিঃসরণকারী কোষগুলোর উপর একধরনের প্রভাব ফেলে, এই প্রভাবটি পরজীবিদের উপকার করে, কিন্তু এটি শামুকের জিনের জন্য বেশ ব্যয়সাধ্য একটি ব্যপার। এই তত্ত্বটি পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে, যদিও এখনও তা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।
আমরা এখন এমন একটি অবস্থানে আছি, যেখানে ক্যাডিসদের থেকে পাওয়া শিক্ষাকে সাধারণীকরণ করতে পারি। যদি আমি সঠিক হই ফুক জিনরা কি করছে সেই বিষয়ে, এর মানে যে আমরা বৈধভাবেই বলতে পারি, ফুক জিনরা শামুকদের শরীরকে প্রভাবিত করছে, ঠিক সেই একই অর্থে যে অর্থে শামুকদের জিন শামুকদের শরীরে প্রভাব ফেলে। এটি যেন জিনরা তাদের নিজেদের বাহক শরীরের বাইরের পৃথিবীকে প্রভাবিত করছে। ঠিক যেমন ক্যাডিসদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, এই ভাষা জিনতাত্ত্বিকদের খানিকটা অস্বস্তিতে ফেলে। তারা সাধারণত অভ্যস্ত শুধুমাত্র একটি শরীরের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো জিনের কাজ সম্বন্ধে। কিন্তু, ক্যাডিসের ক্ষেত্রে
যেমন আবার, যদি খুব ভালোভাবে লক্ষ করার হয় জিনতাত্ত্বিকরা সাধারণত জিনের প্রভাব আছে বলতে কি বোঝান, সেটি প্রদর্শন করছে এধরণের ইতস্ততার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের শুধুমাত্র মেনে নেয়া দরকার, শামুকের খোলসের পুরুত্ব পরিবর্তন হচ্ছে ফ্লুকদের অভিযোজন। যদি তাই হয়, এটি ঘটেছে ফুক জিনের উপর কাজ করা ডারউইনীয় নির্বাচনের কারণে। আমরা দেখিয়েছি যে কোনো একটি জিনের ফিনোটাইপিক প্রভাব সম্প্রসারিত হতে পারে, শুধু প্রাণহীন কোনো বস্তু, যেমন, পাথরই শুধু না, অন্য জীবন্ত শরীরেও।
শামুক আর ফ্লুকদের গল্প শুধুমাত্র শুরু। সব ধরণের পরজীবি, যাদের সাথে আমার বহুদিন ধরে পরিচিত তারা প্রত্যেকেই বিস্ময়কর দক্ষতার সাথে অশুভ প্রভাব খাটাতে পারে তাদের পোষকের শরীরে। আণুবীক্ষণিক প্রোটোজোয়া পরজীবির একটি প্রজাতি আছে, ‘নোসেমা’, ফ্লাউয়ার বীটলদের লার্ভাদের যারা আক্রমণ করে, তারা ‘আবিষ্কার করেছে কিভাবে একটি রাসায়নিক দ্রব্য আবিষ্কার করা যায়, যা এই সব বীটলদের জন্য খুবই বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অন্যান্য কীটপতঙ্গের মত, এই সব বীটলগুলোর শরীরে এক ধরনের হরমোন থাকে যাদের বলে ‘জুভেনাইল’ হরমোন, যার কাজ লার্ভাকে লার্ভা স্তরে রাখা। লার্ভা থেকে পূর্ণবয়স্ক হওয়ার স্বাভাবিক পরিবর্তনটির সূচনা করে যখন লার্ভা এই জুভেনাইল হরমোনটির উৎপাদন করা বন্ধ করে দেয়। নোসেমা পরজীবি সফল হয়েছে এই হরমোনটি সংশ্লেষণ করতে ( এর খুব কাছের রাসায়নিক একটি সমরুপ যৌগ)। লক্ষ লক্ষ নোসেমা একসাথে হয়ে বীটল লার্ভার শরীরে এই হরমোনটি ব্যাপক হারে উৎপাদন করে। ফলে লার্ভা থেকে পূর্ণবয়স্ক বীটল হওয়া থেকে এটি বাধা দেয়। এর পরিবর্তে এটি আকারে বাড়তেই থাকে, এবং অবশেষে পূর্ণবয়স্ক বীটলের চেয়ে দ্বিগুণ ওজনের দানবাকৃতির একটি লার্ভায় রূপান্তরিত হয়। বীটলের জিন প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরের যা ভালো না, বরং নোসেমা পরজীবিদের জন্য এটি একটি করনুকোপিয়া। বীটল লার্ভার দানবীয় আকার প্রোটোজোয়া জিনদের একটি সম্প্রসারিত ফিনোটাইপিক প্রভাব।
এবং আমি আরো উদাহরণ এখানে বর্ণনা দিচ্ছি যা ‘পিটার প্যান’ বীটলদের চেয়ে এমন কি আরো বেশী ফ্রয়েডীয় উদ্বেগ শুরু করে –পরজীবি-নির্ভর নপুংসকরণ। ক্র্যাবদের পরজীবি হিসাবে আক্রমণ করে ‘সাককুলিনা নামের একটি প্রজাতি। সাককুলিনারা বার্নাকলদের আত্মীয়, যদিও আপনি তাই ভাববেন যদি এদের দেখেন, কিন্তু এটি আসলে একটি পরজীবি উদ্ভিদ। এটি বিস্তারিত শাখা-প্রশাখাসহ মূল হতভাগ্য ক্র্যাবদের শরীরে গভীরে প্রবেশ করায় এবং এর শরীর থেকে পুষ্টি শুষে খায়। সম্ভবত সে-কারণে এটি কোনো দূর্ঘটনা নয়, শরীরের প্রথম যে অঙ্গটিকে এটি আক্রমণ করে, সেটি হচ্ছে ক্র্যাবদের ডিম্বাশয় এবং অণ্ডকোষ, এটি ক্র্যাবদের সেই অঙ্গগুলোকে প্রথমে আক্রমণ করে না ক্র্যাবদের টিকে থাকার জন্য যা প্রয়োজন (প্রজননের বিপরীত); সুতরাং ক্র্যাবরা কার্যত নপুংসকরণের স্বীকার হয়। স্বাস্থ্যবান মেদবহুল ষাড়ের মত, নপুংসক ক্র্যাব তার প্রয়োজনীয় শক্তি এবং পুষ্টি প্রজননের বদলে তার শরীরের গঠনের কাজে ব্যয় করে। ক্র্যাবদের প্রজননের বিনিময়ে পরজীবি বেশ লাভবান হয়ে ওঠে। প্রায় একই কাহিনী যেমন, আমি ফ্লাওয়ার বীটলদের শরীরে আক্রমণকারী ‘নোসেমা’ এবং শামুকের ‘ক্ষুকদের জন্য কল্পনা করেছিলাম। এই তিনটি উদাহরণের প্রত্যেকটিতে পোষকের শরীরে পরিবর্তনগুলো, যদি আমরা মেনে নেই যে তারা ডারউইনীয় অভিযোজন যা পরজীবির জন্য সুবিধাজনক, তাহলে এদের অবশ্যই দেখতে হবে পরজীবি জিনদের সম্প্রসারিত ফিনোটাইপিক প্রভাব হিসাবে। অন্য আরেকটি শরীরের ফিনোটাইপিক বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করার জন্য জিনরা তাহলে তাদের নিজের শরীরের বাইরে পৌঁছাতে পারে।
মোটামুটি বেশ খানিকটা অবধি পরজীবি জিনদের স্বার্থ আর পোষক জিনের স্বার্থ পরস্পর সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে। স্বার্থপর জিনের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা ভাবতে পারি ফুক জিন এবং শামুকের জিন ‘উভয়ই’ শামুকের শরীরে বাস করা পরজীবি। উভয়ই সুবিধা তাদের পরিবেষ্টনকারী একটি সুরক্ষাদানকারী খোলসের দ্বারা আদায় করে নেয়। যদিও খোলসটি ঠিক কতটুকু পুরুত্বের হবে সেই বিষয়ে তাদের পছন্দে’ ভিন্নতা আছে। এই ভিন্নতার উদ্ভব হয়, মৌলিকভাবে, সেই বাস্তব সত্যটি থেকে যে শামুকের শরীর থেকে বের হয়ে অন্য শামুকের শরীরে তাদের প্রবেশ করার উপায়গুলো খুব ভিন্ন। বিস্তারিত কোন ব্যাখ্যায় না গিয়ে (কারণ সেটি মনোযোগ নষ্ট করার মতই জটিল) বলা যায় তাদের জিনগুলো শামুকের শুক্রাণু বা ডিম্বাণু মাধ্যমে শামুকের শরীর ত্যাগ করেনা।
আমি প্রস্তাব করছি যে, কোনো একটি পরজীবি সম্বন্ধে আমরা সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি করতে পারি সেটি হচ্ছে এরকম। এর জিনগুলো কি পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হচ্ছে পোষকদের জিন যেভাবে হস্তান্তর হচ্ছে সেই একই ‘বাহনের মাধ্যমে? যদি তারা সেটি না করে, আমি প্রত্যাশা করবো সেই পরজীবি প্রকাশককে ক্ষতি করবে কোনো না কোনোভাবে। কিন্তু যদি তারা একই বাহন ব্যবহার করে, তাহলে পরজীবি তার সাধ্যমত সব কিছুই করবে তার পোষককে সাহায্য করার জন্য, শুধু টিকে থাকার জন্য না, প্রজনন করার জন্যেও। বিবর্তনীয় সময়ের ব্যাপ্তিতে এটি একসময় আর। পরজীবি থাকবে না, পোষকের সাথে সহযোগিতা করবে এবং হয়তো কোনো একসময় পোষকের কোষের সাথে মিশে যায়, এবং পরজীবি হিসাবে তাদের আর তখন শনাক্ত করা যায়না। হয়তো, ২৩৭ পৃষ্ঠায় ( মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ২৩৭) যেমন আমি প্রস্তাব করেছিলাম, আমাদের কোষগুলো বিবর্তনের এই স্পেকট্রাম থেকেই বহু দুর অতিক্রম করে এসেছে: আমরা সবাই প্রাচীন পরজীবিদের এধরণের একত্রীকরণের স্মারক।
দেখুন কি হতে পারে যখন পরজীবি জিন এবং পোষক জিনরা একটি সাধারণ বহিঃর্গমনের পথ ব্যবহার করে। কাঠ ছিদ্রকারী ‘আমব্রোজিয়া’ বীটলরা (Xyleborus ferrugineus প্রজাতি) একটি ব্যাকটেরিয়া পরজীবির দ্বারা আক্রান্ত হয়, তারা শুধু তাদের পোষকদের শরীরেই বাস করেনা, তার পোষকের ডিম্বাণু ব্যবহার করে নতুন একটি পোষকের শরীরে প্রবেশ করার জন্য বাহন। হিসাবে। এই ধরণের কোনো পরজীবিদের জিনদের সে কারণে সুযোগ আছে এর পোষকের জিনদের মতই ভবিষ্যৎ পরিস্থিতিতে সুবিধা লাভ করার। দুই সেট জিন নিয়ে প্রত্যাশা করা যেতে পারে তারা একে অপরকে টেনে ধরবে’ ঠিক সেই একই কারণে ঠিক যেভাবে কোনো একটি জীবের সবগুলো জিন সাধারণত একই সাথে জোটবদ্ধ থাকে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ না যে তাদের কোনোটা হতে পারে ‘বীটল জিন’, যখন অন্য ক্ষেত্রে সবগুলো হতে পারে ব্যাকটেরিয়ার জিন’। দুই সেট জিনই ‘বিশেষভাবে আগ্রহী বীটলদের টিকে থাকার জন্য এবং বীটল ডিমের প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরের জন্য, কারণ উভয় জিন সেট ‘দেখছে’ যে, বীটলের ডিম্বাণু হচ্ছে তাদের ভবিষ্যতের অভিমূখে পাসপোর্ট। সুতরাং ব্যাকটেরিয়ার জিন একটি সাধারণ নিয়তি ভাগ করে নেয় তাদের পোষকের জিনের সাথে এবং আমার ব্যাখ্যায় আমাদের প্রত্যাশা করা উচিৎ যে ব্যাকটেরিয়ারা তাদের বীটলদের সাথে সহযোগিতা করবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
দেখা গেছে শুধু সহযোগিতা করে বললে খুব হালকাভাবে বলা হয়ে যাবে। তারা বীটলদের জন্য যে ভূমিকা পালন করে যার চেয়ে কোন কিছু বেশী ঘনিষ্ট হবার কথা না। এই বীটলগুলো ঘটনাচক্রে ‘হ্যাপলোডিপলয়েড’, মৌমাছি বা পিপড়াদের মত ( অধ্যায় ১০ দেখুন)। যদি কোনো ডিম্বাণু পুরুষের দ্বারা নিষিক্ত হয়, সবসময়ই একটি স্ত্রী লিঙ্গের সদস্য হিসাবে বিকশিত হবে। অনিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে জন্ম নেয় পুরুষ সদস্য, অন্যার্থে পুরুষদের কোনো পিতা নেই। যে ডিম থেকে তাদের জন্ম হয় তাদের বিকাশ হয় স্বতঃস্ফুর্তভাবে, কোনো শুক্রাণুর প্রবেশ ছাড়াই। কিন্তু মৌমাছি ও পিপড়ার ডিম্বাণুর ব্যতিক্রম আমব্রোজিয়া বীটলরে ডিমে কোনো কিছু দ্বারা প্রবেশ করার দরকার নেই। এখানেই ব্যাকটেরিয়া তার সুযোগ নেয়। তারা অনিষিক্ত ডিমকে খোঁচা মেরে সক্রিয় করে তোলে, তাদেরকে প্ররোচিত করে পুরুষ বীটল হবার জন্য। এইসব ব্যাকটেরিয়াগুলো, অবশ্যই, সেই ধরণের পরজীবি যা আমি যুক্তি দিয়েছিলাম, যারা বিরত হয় পরজীবি হওয়া থেকে এবং রূপান্তরিত হয় পারস্পরিক সহযোগিতাকারী মিথোজীবিতায়। সঠিকভাবে এর কারণ তারা বাহিত হয় পোষকের ডিমের মধ্যে দিয়ে, পোষকের নিজস্ব জিন সহ। পরিশেষে তাদের নিজেদের শরীরের অপসৃয় হবার সম্ভাবনা আছে, যা ‘পোষকের শরীরে পুরোপুরিভাবে একত্রীভুত হয়।
একটি উন্মোচনকারী স্পেকট্রাম বা বিস্তার এখনও আমরা খুঁজে পেতে পারি হাইড্রা প্রজাতিদের মধ্যে– ক্ষুদ্র, অলস, টেন্টাকল যুক্ত প্রাণীরা, মিঠা পানির সি-অ্যানিমোনদের মত তারা দেখতে। তাদের কোষের মধ্যে সাধারণত পরজীবি হিসাবে বাস করে শৈবাল বা আলগি ( এখানে আলগি ইংরেজী বানানের ‘জি’ টি উচ্চারণ করতে হবে গভীরভাবে ‘গ’ এর মত, অজানা কোনো কারণে শুধুমাত্র আমেরিকাতেই না, কিছু প্রাণীবিজ্ঞানী তারা আলজি উচ্চারণ করছেন, যেমন, আলজেরনন, বহুবচন ‘আলগির ক্ষেত্রে শুধু মাত্র না- যা হয়তো ক্ষমাযোগ্য হতে পারে, এমনকি একবচনে ‘আলগা’র ক্ষেত্রে এই উচ্চারণ গ্রহনযোগ্য নয়।) হাইড্রাদের Hydra vulgaris এবং Hydra attenuate প্রজাতিতে আলগি আসলেই সত্যিকারের পরজীবি, যা তাদের অসুস্থ করে ফেলে। কিন্তু Chlorohydra viridissima প্রজাতিতে আলগি হাইড্রাদের কোষে কখনোই অনুপস্থিত না এবং তারা হাইড্রার বেঁচে থাকার জন্য উপযোগী কিছু ভূমিকা পালন করে –যেমন, তাদের অক্সিজেন সরবরাহ করে। এবং যে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়টি আমাদের নজরে পড়ে যেমনটি আমাদের প্রত্যাশিত হবার কথা, ক্লোরোহাইড্রা প্রজাতিতে আলগি তাদের নিজেদেরকে পরবর্তী পোষকের শরীরের বাহিত করতে হাইড্রার ডিম্বাণু ব্যবহার করে। অন্য দুটি প্রজাতিতে তারা সেটি করতে পারেনা। আলগি জিনের স্বার্থ এবং ক্লোরোহাইড্রাদের জিনের স্বার্থ একই সাথে মিলে যায়। তাদের ক্ষমতায় সর্বোচ্চ করা সম্ভব এমনভাবে তারা ক্লোরোহাইড্রাদের ডিমের উৎপাদন বাড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু অন্য দুটি প্রজাতির জিনের সাথে তাদের বহন করা আলগির স্বার্থ ‘মেলে না, যাই হোক না কেন, একই রকম পর্যায় অবধি। হাইড্রার শরীরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দুই সেট জিনেরই স্বার্থ আছে। কিন্তু শুধুমাত্র হাইড্রা জিনের হাইড্রা প্রজননের জন্য স্বার্থ আছে। সুতরাং, নিরীহ সহযোগিতা গড়ে তোলার দিকে বিবর্তিত হবার পরিবর্তে আলগি সেখানে টিকে থাকে ক্ষতিকারক পরজীবি হিসাবে। এখানে মূল বিষয়টি হচ্ছে, আবারো পুনরাবৃত্তি করছি, কোনো একটি পরজীবি যা তার পোষকের জিনের মত একই নিয়তি অর্জন করা চেষ্টা করে, সে তার পোষকের সব স্বার্থের সাথে একাত্মতা বোধ করে, এবং একপর্যায়ে সেটি আর সেই পোষকের শরীরে পরজীবি হিসাবে কোন সমস্যা সৃষ্টি করেনা।
নিয়তি, এই ক্ষেত্রে মানে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ক্লোরোহাইড্রা জিন এবং আলগি জিন, বীটল জিন এবং ব্যাকটেরিয়া জিন, শধুমাত্র এর পোষকের ডিমের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মে যেতে পারে। সুতরাং, পরজীবি জিন যে হিসাব নিকাশই করুক না কেন, উপযুক্ত নীতি হিসাবে, জীবনের যে-কোনো অংশে, সেগুলো হুবহু কিংবা প্রায় হুবহু মিলে যাবে পোষক জিনের গৃহীত উপযুক্ত নীতির সাথে, কারা তারাও একই ধরনের হিসাব নিকাশ করবে। শামুক এবং তার ফ্লুক পরজীবির ক্ষেত্রে, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, খোলসের পুরুত্বের ব্যপারে তাদের পছন্দের ভিন্নতা আছে। অ্যামব্রোসিয়া বীটল ও তার পরজীবি ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে, পোষক এবং পরজীবি একমত হবে পাখার একই দৈর্ঘ্য এবং বীটলদের শরীরের অন্য সব বৈশিষ্ট্যগুলোর ব্যাপারে। আমরা এটি অনুমান করতে পারি বীটল তার পাখা বা অন্য যে কোনো কিছুই কি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে সেগুলো সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে কোনো কিছু জানা ছাড়াই। ঠিক কিভাবে বীটলরা তাদের পাখা ব্যবহার করবে সেই বিষয়ে বিস্তারিত না জেনেও আমরা এই পূর্বধারণা করতে পারি। শুধুমাত্র যুক্তি থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি, বীটল জিন এবং ব্যাকটেরিয়া জিন, উভয় ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতার মধ্যে সব ধরনেরই পদক্ষেপ নেবে একই ভবিষ্যৎ ঘটনাকে সৃষ্টি করার প্রচেষ্টায়– যে ঘটনাগুলো যা বীটলের ডিম্বাণু বিস্তারে জন্য সহায়ক।
আমরা এই যুক্তিটিকে একটি যৌক্তিক উপসংহারে নিয়ে যেতে পারি এবং এটিকে স্বাভাবিক, ‘নিজস্ব’ জিনের উপর প্রয়োগ করতে পারি। আমাদের নিজেদের জিনও পরস্পরের সহযোগিতা করে, এর কারণ কিন্তু তারা আমাদের নিজস্ব, তা নয় বরং এর কারণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মে যাবার জন্য তারা একই বের হবার মাধ্যম ব্যবহার করে– শুক্রাণু অথবা ডিম্বাণু। যদি একটি জীবের যে-কোনো জিন, যেমন, মানুষ, নিজেদের বিস্তার লাভ করার এমন কোনো একটি উপায় আবিষ্কার করতে পারে যা প্রচলিত শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর উপর নির্ভরশীল নয়, তারা ঠিক সেটাই গ্রহন করতো এবং অপেক্ষাকৃত কম সহযোগিতাপূর্ণ হতো। এর কারণ তাদের সেখানে সুযোগ থাকে শরীরের অন্য জিনের তুলনায় একগুচ্ছ ভিন্ন ভবিষ্যৎ পরিণতিতে লাভবান হবার। আমরা ইতিমধ্যেই এমন জিনের সাথের পরিচিত হয়েছি যারা মাইওসিস প্রক্রিয়াকে পক্ষপাতদুষ্ট করে তাদের নিজেদের সুবিধা আদায় করতে। হয়তো এমন কোন জিনও আছে যারা শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর ‘সঠিক’ চ্যানেলের বাধ্যবাধকতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয় এবং সম্পূর্ণ নতুন কোনো পাশ কাটানো পথ তারা আবিষ্কার করে নেয়।
কোষের মধ্যে ডিএনএ এর বহু খণ্ডাংশ থাকে যারা ক্রোমোজমের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকেনা বরং তারা সাইটোপ্লাজমে স্বাধীনভাবে ভেসে বেড়ায় এবং কোষের তরল পরিবেশেই এটি বিভাজিত হয়, বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়াদের কোষে। তাদের নানা নামে ডাকা হয়,যেমন, ভাইরয়েড অথবা প্লাসমিড। প্লাসমিড এমনকি একটি ভাইরাসের চেয়েও ছোট, সাধারণত এটি অল্প কিছু জিন বহন করে। কিছু প্লাসমিড দক্ষ অনায়াসে কোনো ক্রোমোজোমের সাথে তাদের নিজেদের সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে। এবং এই সংযুক্তি এতই মসৃণ যে আপনি তাদের যোগ হবার সেই অংশটি দেখতে পাবেন নাঃ কারণ প্লাসমিড ক্রোমোজোমের অন্য যে অংশের মতই দেখতে। এই একই প্লাসমিড তাদের নিজেদেরও আবারো সেখান থেকে বিযুক্ত করতে পারে। ডিএনএ এর এই কাটা এবং যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা, ক্রোমোজোমের বাইরে ভিতরে নিজের মর্জিমত যাতায়াত যা খুব অনায়াসে ঘটতে পারে এটি অন্যতম চমকপ্রদ একটি ঘটনা যা বিজ্ঞানীরা উদঘাটন করেছিলেন এই বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হবার পর। বাস্তবিকভাবে প্লাসমিড গবেষণায় সাম্প্রতিক কিছু অগ্রগতিকে আমরা দেখতে পারি সুন্দর সহায়ক প্রমাণ হিসাবে, যে সম্ভাব্য ধারণা নির্ভর প্রস্তাবগুলো দেয়া হয়েছে পৃষ্ঠা ২৩৭’র (মূল বইয়ে পৃষ্ঠা ২৩৭) নীচের দিকে ( সেই সময় এই ধারণাগুলো খানিকটা বেশী কল্পনাপ্রবণ ছিল)। এইসব খণ্ডিত ডিএনএ-গুলো আসলে কীভাবে উদ্ভব হয়েছে, আগ্রাসনকারী কোনো পরজীবি, নাকি দলছুট বিদ্রোহী হিসাবে, কিছু দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি খুব একটা সমস্যা করে না। তাদের সম্ভাব্য আচরণ একই হবে। আমি এই ডিএনএ থেকে বিযুক্ত হওয়া খণ্ডিত ডিএনএ নিয়ে কথা বলবো আমার দৃষ্টিভঙ্গিটি বোঝানোর জন্য।
মানব ডিএনএ-এর একটি বিদ্রোহী অংশের কথা ভাবুন, যারা এর ক্রোমোজোম থেকে নিজেদের কেটে বিযুক্ত করতে পারে, এবং কোষের মধ্যে তারা মুক্তভাবে ভাসমান থাকে, হয়তো অসংখ্য অনুলিপি তৈরী করে তাদের নিজেদের, তারপর তারা অন্য কোনো ক্রোমোজোমের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করে। কোন ধরনের অপ্রচলিত বিকল্প পথ এই বিদ্রোহী অনুলিপনকারী ব্যবহার করতে পারে পরবর্তী প্রজন্মে যাবার জন্য? আমরা সারাক্ষণই আমাদের শরীরের চামড়া থেকে কোষ হারাচ্ছি, আমাদের বাসার ধুলোর বেশীর ভাগ অংশ তৈরী করে আমাদের ত্বকের ঝরিয়ে ফেলা কোষগুলো। আমরা অবশ্যই একে অন্যের কোষ শ্বাসের সাথে গ্রহন করছি সবসময়ই। আপনি যদি হাতের নোখ ব্যবহার করে আপনার মুখের ভিতরটা একটু হালকা করে আচড় কাটেন, আপনি শত শত জীবন্ত কোষ সংগ্রহ করতে পারবেন। প্রেমিক প্রেমিকা চুমু এবং শারীরিক আদরে অবশ্যই আরো অসংখ্য সংখক কোষ উভয় দিকে হস্তান্তরিত হয়। ডিএনএর একটি বিদ্রোহী অংশ এদের যে কোনো একটি কোষে তার জায়গা করে নিতে পারে, যদি জিনরা আবিষ্কার করে একটি অপ্রচলিত পথের কোনো ফাঁকফোকড় যার মাধ্যমে অন্য একটি শরীরে স্থানান্তরিত হয় ( একই সাথে বা প্রচলিত শুক্রাণু বা ডিম্বাণু পথ বাদ দিয়ে), আমাদের অবশ্যই প্রত্যাশা করতে হবে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন তাদের এই সুবিধাবাদীতাকে সয়াহতা করবে এবং আরো উন্নীত করবে। আর নির্দিষ্ট যে পদ্ধতি যা তারা ব্যবহার করে, কোনো কারণ নেই কেন তাদের ভিন্ন হওয়া উচিৎ হবে ভাইরাসদের ষড়যন্ত্রগুলো থেকে– একজন স্বার্থপর জিন/সম্প্রসারিত ফিনোটাইপ তাত্ত্বিকদের পক্ষে খুব সহজেই যা পূর্বধারণা করা সম্ভব।
যখন আমাদের সর্দি বা কাশি হয়, আমরা সাধারণত এটাকে ধরে নেই ভাইরাসের আক্রমণের বিরক্তিকর একটি উপসর্গ হিসাবে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হতে পারে খুবই সম্ভবনা আছে এই সব উপসর্গগুলো খুবই পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করে ভাইরাস, যা তাকে সাহায্য করে একটি পোেষক থেকে অন্য একটি পোষকের শরীরে প্রবেশ করার জন্য। শুধুমাত্র বাতাসে ভেসে কারো শরীরের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করার পথ নিয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে, ভাইরাস আমাদের হাঁচি বা কাশি দিতে বলে, যার বিস্ফোরণের মত শক্তি বাতাসে আরো দ্রুত ছড়িয়ে যেতে সাহায্য করে ভাইরাসটিকে। র্যাবিসের ভাইরাসটি বাহিত হয় মুখের লালার মধ্যে, যখন কোনো প্রাণী আরেকটা প্রাণীকে কামড় দেয়। কুকুরদের মধ্যে এই রোগের একটি উপসর্গ হলো সাধারণ শান্তিপ্রিয় বন্ধুসুলভ এই প্রাণীটি হঠাৎ করে হিংস্র কামড় দিতে উৎসাহী প্রাণীতে রূপান্তরিত করে, যার মুখে আমার লালার ফেণা দেখতে পাই।বিপদজ্জনকভাবে স্বাভাবিক কুকুরদের মত সাধারণত ঘরের এক মাইল বা তার আশে পাশে থাকার বদলে, তারা রূপান্তরিত হয় অস্থির এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো কোনো প্রাণীতে, যা বহনকারী ভাইরাসটিকে অনেক দুরে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। প্রস্তাব করা হয়েছে সুপরিচিত জলাতঙ্ক বা পানিকে ভয় পাবার উপসর্গটি কুকুরদের সহায়তা করে তাদের মুখ থেকে ফেনাগুলো ঝাঁকুনি দিয়ে ফেলে দেবার জন্য, যার মধ্যে ভাইরাসও বিদ্যমান। যৌন রোগে আক্রান্তদের কারো যৌনাকাঙ্খ বেড়ে যায় কিনা এমন কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ সম্বন্ধে আমার জানা নেই, কিন্তু আমি ধারণা করছি বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা সময়ের অপচয় হবে না। অবশ্য অন্তত একটি অভিযুক্ত যৌনউদ্দীপক, স্প্যানিশ ফ্লাই, কাজ করে চুলকানীর মত একটি উপসর্গ সৃষ্টি করে। আর কোনো চুলকানী সৃষ্টি করতে ভাইরাসও সিদ্ধহস্ত।
বিদ্রোহী মানব ডিএনএ-এর সাথে আগ্রাসী কোনো পরজীবির জিনের তুলনা করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের মধ্যে আসলে উল্লেখযোগ্য কোনো পার্থক্য নেই সেটা স্পষ্ট করা। খুব ভালো সম্ভাবনা আছে যে ভাইরাসরা নিজেরাও উদ্ভব হয়েছে বিযুক্ত হয়ে আসা একগুচ্ছ খণ্ডিত জিন হিসাবে। আমরা যদি কোনো পার্থক্য প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করি, সেটা হওয়া উচিৎ সেই সব জিন যারা শরীর থেকে অন্য শরীরে বাহিত হয় শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর প্রথাগত পথে এবং সেই সব জিন যারা শরীর থেকে অন্য শরীরে বাহিত হয় অপ্রচলিত ভিন্ন কোন পথে, তাদের মধ্যে। দুই শ্রেণীর মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে সেই সব জিনগুলো যাদের উদ্ভব হয়েছে নিজস্ব ক্রোমোজোম সংশ্লিষ্ট জিন হিসাবে। এবং দুটি শ্রেণীতে সেই সব জিনও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে যাদের উৎপত্তি আক্রমণকারী পরজীবি থেকে। অথবা হয়তো, আমি যেমনটি ধারণা করেছি ২৩৭ পৃষ্ঠায় (মূল বইয়ের ২৩৭ পৃষ্ঠায়), সব ‘নিজস্ব ক্রোমোজোমের জিন আমাদের গণ্য করতে হবে পারস্পারিকভাবে একে অপরের পরজীবি হিসাবে। একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আমার এই দুটি শ্রেণীর জিনদের মধ্যে নিহিত বৈষম্যমূলক পরিস্থিতির জন্য, যেখান থেকে তাদের ভবিষ্যতে লাভবান হবার সম্ভাবনা আছে। একটি সর্দিজ্বরের ভাইরাসের জিন এবং মানব ক্রোমোজোম থেকে বিযুক্ত কোনো জিন এক অপরের সাথে ঐক্যমত হয় তারা দুজনেই তাদের পোষককে হাঁচি দেওয়াতে ‘চায়। একটি প্রচলিত ক্রোমোজোমাল জিন এবং এবং যৌনবাহিত ভাইরাস ঐক্যমতে পৌঁছায় তাদের পোষককে সঙ্গম আগ্রহী করে তুলতে ‘চাওয়ার জন্য। খুবই কৌতূহলোদ্দীপক একটি ভাবনা যে উভয়ে চাইবে তাদের পোষকরা যেন যৌন আকর্ষণীয় হয়। এছাড়া প্রচলিত ক্রোমোজোমের জিন এবং ভাইরাসের জিন যা বাহকের ডিমের মাধ্যমে বাহিত হয় তারা একমত হবে চাইতে যে তাদের পোষক যেন শুধু সঙ্গীনি জয় করতে না, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সফল হয়, যেমন সে যেন অনুগত সঙ্গী, যত্নবান পিতামাতা এমনকি পিতামহ পিতামহী হতে পারে।
ক্যাডিসরা তাদের নিজেদের বানানো ঘরের মধ্যে বাস করে, এবং পরজীবিরা, যাদের কথা আমি এযাবৎ আলোচনা করেছি তারা তাদের পোষকের মধ্যে বাস করে। জিনগুলো, তাহলে, শারীরিকভাবে তাদের সম্প্রসারিত ফিনোটাইপিক প্রভাবে নিকটে বসবাস করে, ঠিক ততটা কাছে যতটা জিনরা সাধারণত তাদের প্রচলিত ফিনোটাইপের নিকটে থাকে। কিন্তু জিনরা দূর থেকেও তাদের প্রভাব ফেলতে পারে, সম্প্রসারিত ফিনোটাইপও সম্প্রসারিত হতে পারে বেশ কিছু দূর। সবচেয়ে দীর্ঘ যে ফিনোটাইপের কথা আমি এই মুহূর্তে ভাবতে পারছি সেটি একটি হৃদের পুরো প্রশস্ততা জুড়ে বিস্তৃত। কোনো মাকড়শার জাল বা ক্যাডিসদের ঘরের মত, বিভারদের বানানো ড্যাম বা বাধও পৃথিবীর সত্যিকারের বিস্ময়কর জিনিসগুলোর একটি। পুরোপুরিভাবে স্পষ্ট নয় এই ধরনের কোনো একটি স্থাপনার আসলেই ডারউইনীয় উদ্দেশ্যটি কি হতে পারে, কিন্তু অবশ্যই এর উদ্দেশ্য আছে, কারণ এটি নির্মাণ করার জন্য বিভারদের প্রচুর পরিমান সময় আর শক্তি ব্যবহার করে। তাদের বানানো এই বাধটি যে হ্রদের সৃষ্টি করে সেটি সম্ভবত শিকারী প্রাণীদের আক্রমণ থেকে বিভারদের বাসস্থান রক্ষা করে। এছাড়াও এটি বেশ সুবিধাজনক একটি পানির পথ সৃষ্টি করে তাদের যাতায়াত এবং এবং কাঠ বহন করে আনার জন্য। বিভারও ভাসিয়ে বহন। করার কৌশল ব্যবহার করে ঠিক একই কারণে কানাডার লাম্বার কোম্পানিগুলো যেমন ব্যবহার করেছিল নদী এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে কয়লা ব্যবসায়ীরা যেমন করে ইংল্যান্ডের খাল ব্যবহার করতেন। এর সুবিধা যাই হোক না কেন, কোনো বিভার হৃদ একটি চিহ্ন ভূদৃশ্যের উপর চোখে পড়ার মত বৈশিষ্ট্যসূচক। এটি একটি ফিনোটাইপ, কোনো অংশেই যা বিভারদের দাঁত এবং তাদের লেজ থেকে কম নয়, এবং এটিও বিবর্তিত হয়েছে ডারউইনিয় প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রভাবে। ডারউইনীয় নির্বাচনের কাজ করার জন্য প্রয়োজন ইতিমধ্যে বিদ্যমান জিনগত ভিন্নতা বা প্রকরণ। এখানে বাছাই করার বিষয় অবশ্যই ভালো হৃদ বনাম কম ভালো হৃদ। নির্বাচন সেই সব বিভার জিনগুলোকে সুযোগ করে দেয় যারা গাছ বহন করার জন্য সুন্দর হৃদ সৃষ্টি করে, ঠিক যেমন করে এটি সেই জিনগুলোকে বাছাই করে যারা ভালো দাঁত সৃষ্টি করে সেই গাছগুলো কাটার জন্য। বিভারদের বানানো এই সব হৃদগুলো বিভার জিনের সম্প্রসারিত ফিনোটাইপিক প্রভাব, এবং তাদের বিস্তৃতি হতে পারে বেশ কয়েকশত গজ, সত্যি দীর্ঘ এর প্রভাব!
পরজীবিদের তাদের পোষকের শরীরের বাস করতেই হবে এমন কথা নেই। তাদের জিন তাদের এমনভাবে প্রকাশ করে যখন তাদের পোষকের অবস্থান দূরে। কোকিলের বাচ্চারা রবিন বা রিড ওয়ার্কলারদের শরীরের ভিতরেই বাস করেনা, তারা শরীরের ভিতর বসে রক্ত চুষে খায় না তাদের কোষ খায়না, তারপরও আমাদের কোনো ইতস্ততা নেই তাদের পরজীবি হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য। কোকিলের অভিযোজনগুলা তাদের দত্তক পিতামাতার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে তাদের স্বার্থে, এই বিষয়টিতে দেখা যেতে পারে কোকিলের জিনের দুর থেকে প্রভাবিত করা সম্প্রসারিত ফিনোটাইপিক প্রভাব হিসাবে।
সহজেই সমবেদনা অনুভব করা যায় দত্তক পিতামাতার সাথে যাদের বোকা বানানো হয় কোকিলের ডিমে তা দেবার জন্য। মানব ডিম সংগ্রহকারীরাও প্রায়শই বোকা বনেছেন কোকিলের ডিমের সাথে– ধরুন মিডো-পিপিট এর ডিম বা রিড ওয়ালারের ডিমের সাথে (ভিন্ন ভিন্ন কোকিল প্রজাতির স্ত্রী সদস্যরা বিশেষায়িত ভিন্ন ভিন্ন পোষক প্রজাতির সাথে); কিন্তু দত্তক পিতামাতার যে আচরণটি বেশ কঠিন বোঝ সেটি হচ্ছে পরবর্তীতে কোকিলের বাচ্চাদের প্রতি তাদের আচরণ, যখন কোকিলের বাচ্চা ডানায় উড়বার উপযোগী যথেষ্ট পরিমান পালক জন্মায়। কোকিলের বাচ্চারা সাধারণত আকারে বেশ বড়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশ অদ্ভুত মাত্রায় বড় তাদের পোষক ‘পিতামাতার তুলনায়। আমি প্রাপ্তবয়স্ক একটি ডানোক এর ছবির প্রতি তাকিয়ে আছি, যা এর দানবাকৃতির পোষ্য বাচ্চার তুলনায় আকারে খুবই ঘোট, এতই ছোট যে কোকিলের বাচ্চার পিঠের উপর উঠে বসতে হয়েছে তাকে খাওয়ানোর জন্য। এখানে আমরা এই দত্তক পিতামাতা বা পোষকের সাথে কম সহমর্মিতা অনুভব করি। আমরা তাদের নির্বুদ্ধিতা, তাদের বিশ্বাসপ্রবণতা দেখে বিস্মিত হই। নিশ্চয়ই যে কেন নির্বোধেরই তো বোঝা উচিৎ এই আকারের বাচ্চা মানে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে।
আমি মনে করি কোকিলের বাচ্চারা নিশ্চয়ই কিছু করছে তাদের পোষকদের শুধু ‘বোকা’ বানানো ছাড়াও, তারা যা না সেটি সাজার ভান করা ছাড়াও। মনে হচ্ছে তারা পোষকের স্নায়ুতন্ত্রের উপরও কাজ করছে, কোনো আসক্তি সৃষ্টিকারী মাদকদ্রক্য যেমন করে কাজ করে ঠিক তেমন করে। এমনকি যাদের আসক্তি উদ্রেককারী কোনো মাদক দ্রব্য সেবনের অভিজ্ঞতাও নেই, তাদেরও বিষয়টির সাথে সহমর্মিতা অনুভব করতে খুব একটা কষ্ট হবে না। একটি পুরুষকে যেমন যৌন উত্তেজিত করা যাবে, এমনকি পুরুষাঙ্গও দৃঢ় করা যেতে পারে কোনো ছাপানো নারী শরীরের ছবি দেখিয়ে। সে কিন্তু ‘বোকা’ হচ্ছে না এমন ভেবে যে এই ছাপানো ছবিটা সত্যিকারের কোনো রমণী। সে জানে সে কাগজে শুধুমাত্র কালির প্যাটার্নের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তারপরও তার স্নায়ুতন্ত্র এমনভাবে এর প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে ঠিক যেমন করে এটি সত্যি কোনো রমণীর প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাতো। আমরা হয়তো বিপরীত লিঙ্গের সদস্যদের কোনো একটি বৈশিষ্টর প্রতি তীব্র অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ বোধ করি। এমনকি যখন আমাদের বুদ্ধি বিবেচনা সতর্ক করে দেয় সেই সদস্যটির সাথে কোনো সম্পর্ক আমাদের দুজনের দীর্ঘমেয়াদী কোনো স্বার্থ পরিপন্থী। একইভাবে এটি সত্যি হতে পারে অস্বাস্থকর খাদ্যের প্রতি আমাদের দুর্দমনীয় আকর্ষণও। ডানোক এর হয়তো তার দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের ব্যপারে কোনো সচেতনতা নেই। সুতরাং এমনকি এটি আরো সহজ বোঝা যে তার স্নায়ুতন্ত্র হয়তো বিশেষ কিছু ধরণের উদ্দীপককে অনুভব করতে পারে অপ্রতিরোধ্য হিসাবে।
কোকিল বাচ্চার উন্মুক্ত হয়ে থাকা লাল মুখ এত বেশী আকর্ষণীয় যে পাখিবিশারদরা প্রায়শই দেখেছেন, অন্য বাসায় বসে থাকা কোকিল বাচ্চা হা করে থাকা মুখে পাখিদের খাবার ফেলতে। কোনো পাখি হয়তো বাসায় যাচ্ছে উড়ে, তার নিজের শিশুর জন্য খাওয়া বহন করে, হঠাৎ করে, চোখের এক কোনা দিয়ে সে কোকিল বাচ্চার লাল বিশাল হা করা মুখ দেখে, কোনো একটি ভিন্ন প্রজাতির পাখির নীড়ে। এটি সেই অপরিচিত পাখির নীড়ের দিকে তার গতি পরিবর্তন করে, তার নিজের বাচ্চাদের জন্য বহন করা খাদ্যটি কোকিলের বাচ্চার মুখে ফেলে দেয়। এই ‘ইররেজিস্টিবিলিটি বা অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ’ তত্ত্বটি খুব ভালোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল আদি জার্মান পাখি বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে যারা এই সব পোষক পিতামাতার আচরণকে তুলনা করেছেন ‘মাদকত্সক্তদের আচরণের সাথে এবং কোকিলের বাচ্চা হচ্ছে তাদের জন্য সেই মাদক। এই ধরনের ভাষার ব্যবহার যে আধুনিক গবেষকরা খুব একটা গ্রহন করেননি সেটা উল্লেখ করাই উচিৎ হবে আমার জন্য। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই যে যদি আমরা ধরে নেই যে কোকিলের হা করা মুখ হচ্ছে খুব শক্তিশালী মাদকের মত কোনো উদ্দীপক, খুবই সহজ হয়। কি ঘটছে তা ব্যাখ্যা করা। অনেক সহজ হয় সহমর্মিতা প্রকাশ করা সেই ক্ষুদ্রকায় পিতামাতার জন্য যা এর দানবাকৃতির সন্তানের পিঠে দাঁড়িয়ে আছে তার মুখে খাবার তুলে দেবার জন্য। এটা কিন্তু বোকা হওয়া না। বোকা বানানো এখানে ব্যবহার করা জন্য ভুল শব্দ। এর স্নায়ুতন্ত্র অপ্রতিরোধ্যভাবে নিয়ন্ত্রিত, যেন তারা অসহায় মাদকসক্ত অথবা কোকিল হচ্ছে যে কোনো বিজ্ঞানী যে এর মস্কিষ্কের মধ্যে ইলেক্ট্রোড ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু এমনকি যদি আমরা এখন আরো বেশী ব্যক্তিগত সমবেদনা ব্যবহার করি এইসব দুরভিসন্ধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পোষক পিতামাতাদের সাথে, আমরা তারপরও জিজ্ঞাসা করতে পারি কেন প্রাকৃতিক নির্বাচন কোকিলদের সুযোগ দিয়েছে এ ধরনের কাজ করে পার পেয়ে যাবার জন্য, তাহলে কেন পোষকের স্নায়ুতন্ত্র সময় পায়নি তার কাজ করার জন্য। হয়তো কোকিলরা তাদের পোষক পরিবারে পরজীবিতা শুরু করেছে সাম্প্রতিক শতাব্দীতে এবং আরো কয়েক শতাব্দী পরে হয়তো বাধ্য হবে তাদের পরিত্যাগ করে নতুন কোনো পোষক প্রজাতি অনুসন্ধান করার জন্য। বেশ কিছু প্রমাণ আছে এই তত্ত্বটিকে সপক্ষে। কিন্তু আমি যা অনুভব না করে পারছি না, সেটি হচ্ছে এখানে অবশ্যই এর চেয়ে আরো কিছু ব্যপার আছে।
কোকিল এবং কোনো পোষক প্রজাতির মধ্যে বিবর্তনীয় অস্ত্র প্রতিযোগিতার ভিতরেই থাকে এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব, যার কারণ ব্যর্থতার মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে অসাম্যতা। প্রতিটি কোকিল বাচ্চা এসেছে বংশানুক্রমিকভাবে কোকিল বাচ্চাদের পূর্বসুরীদের দীর্ঘ বংশতালিকায়, তাদের প্রত্যেকেই অবশ্যই তাদের পোষক পিতামাতাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে সফল হয়েছে। কোনো কোকিল ছানা যারা কিনা তাদের এই প্রভাবটি এক মুহূর্তের জন্য শিথিল করেছে সে মারা যাবে এর পরিণতিতে। কিন্তু প্রতিটি একক পোষক পিতামাতা এসেছে পূর্বসূরীদের দীর্ঘ বংশধারায় যাদের অনেকেই জীবনে কখনো কোনো কোকিল বাচ্চা দেখেনি। কিন্তু যারা তাদের নীড়ে কোনো কোকিলকে পেয়েছে তারা তার শিকার হয়েছে এবং আরো কিছু বাচ্চা জন্ম দেবার জন্য পরবর্তী প্রজনন কাল অবধি বেঁচে ছিল। মূল বিষয়টি হচ্ছে ব্যর্থতার জন্য যে মূল্য পরিশোধ করতে হয় তার একটি অসাম্যতা। জিন যা ব্যর্থ হয়। কোকিলের আরোপিত দাসত্বকে প্রতিরোধ করার জন্য, সেগুলো খুব সহজেই রবিনস অথবা ডানোকস-এর পরবর্তী প্রজন্মে বিস্তার লাভ করতে পারে। কিন্তু পোষক পিতামাতাকে দাসত্ব করাতে ব্যর্থ জিন কোকিল প্রজন্মের মধ্যে বিস্তার লাভ করতে পারেনা। এটাই আমি বোঝাতে চেয়েছি ‘অন্তর্গত পক্ষপাতিত্ব’ কথাটা বোঝাতে। এই বিষয়টি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছে ঈশপের একটি উপকথা: ‘খরগোশ শিয়ালের চেয়ে জোরে দৌড়ায়, কারণ খরগোশ তার জীবনের জন্য দৌড়ায় যখন শিয়াল শুধু তার রাতের খাবারের জন্য দৌড়ায়। আমি এবং আমার সহকর্মী জন ক্রেবস এর নাম দিয়েছিলাম, ‘লাইফ/ডিনার প্রিন্সিপাল।
এই লাইফ/ডিনার প্রিন্সিপালের কারণে প্রাণীরা হয়তো কখনো কখনো এমনভাবে আচরণ করে যা তাদের স্বার্থের জন্য সবচেয়ে ভালো নয়, যে আচরণগুলো নিজেদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করে অন্য কোনো প্রাণী। আসলেই এক অর্থে, তারা কেবল তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে সেরা উপায়টি বেছে নিচ্ছে। এই লাইফ/ডিনার প্রিন্সিপলটির মূল বক্তব্য হচ্ছে যে তারা তাত্ত্বিকভাবে কোনো ধরণের অন্যের স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়া থেকে নিজেদের সুরক্ষা করতে পারবে কিন্তু সেটি করা তাদের জন্য বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। হয়তো কোকিলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধ করার জন্য দরকার হয় বড় চোখ অথবা বড় আকারে মস্তিষ্কের, সেগুলো সব বাড়তি খরচের হিসাবে পড়ে। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী যার জিনগত প্রবণতা আছে এই ধরনের কোকিলের স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়াটি প্রতিরোধ করতে পারে, তারা আসলেই কম সফল হবে এই জিনগুলো পরের প্রজন্মে হস্তান্তর করার জন্য, কারণ এই প্রতিরোধ করার অর্থনৈতিক মূল্যটি।
কিন্তু আরো একবার আমরা ফিরে গেছি জীবনকে জিন নয় বরং একক কোনো জীব সদস্যের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার ক্ষেত্রে। আমরা যখন ফুক আর শামুক নিয়ে কথা বলেছিলাম তখন আমরা সেই ধারণার সাথে নিজেদের অভ্যস্ত করিয়ে নিয়েছিলাম পোষকের শরীরে উপর কোনো একটি পরজীবীর জিনের ফিনোটাইপিক প্রভাব থাকতে পারে ঠিক একই উপায়ে, যেমন কোনো প্রাণীর জিনের ফিনোটাইপিক প্রভাব আছে তার নিজের শরীরের উপর। একটি অর্থে কোনো শরীরের মধ্যে বাস করা সব জিনই ‘পরজীবি’ জিন, আমরা তাদের শরীরের নিজস্ব জিন বলি কিংবা না বলি। কোকিলের প্রসঙ্গটি আলোচনায় এসেছিল সেই সব পরজীবিদের উদাহরণ হিসাবে তারা তাদের পোষকের শরীরের ভিতরে না বাইরে বসবাস করে। তারা তাদের পোষককে নিজেদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত করে, ঠিক যেমন ভাবে শরীরে অভ্যন্তরে বাস করা কোনো পরজীবি করে থাকে। এবং এই নিয়ন্ত্রণ, যেমন এখন আমরা দেখেছি খুবই শক্তিশালী ও অপ্রতিরোধ্য হতে পারে যে কোনো মাদকদ্রব্য কিংবা হরমোনের প্রভাবের মতই। আভ্যন্তরীণ পরজীবিদের ক্ষেত্রের মতই, আমাদের উচিৎ হবে পুরো ব্যপারটি আবারো জিন এবং সম্প্রসারিত ফিনোটাইপের ভাষায় ব্যক্ত করা।
কোকিল ও তার পোপাষকের মধ্যে বিবর্তনীয় অস্ত্র প্রতিযোগিতায়, উভয়-পাশের অগ্রগতিগুলো জিনগত মিউটেশন রুপ নেয়, যার উদ্ভব ঘটে ও বিশেষ সুবিধা পায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে। কোকিলের হা করা মুখের ব্যপারে এটি যাই হোক না কেন, এটি পোষকের স্নায়ুতন্ত্রে কাজ করে মাদকের মত, এটি অবশ্যই শুরু হয়েছে জিনগত মিউটেশন থেকে। এই মিউটেশন কাজ করে, ধরুন, কোকিল বাচ্চার হা করে থাকা মুখের রঙ ও আকারের উপর তার প্রভাব ফেলে। কিন্তু এমনকি এটাও তার সবচেয়ে তাৎক্ষণিক প্রভাব নয়। সবচেয়ে তাৎক্ষণিক প্রভাব হচ্ছে কোষের অভ্যন্তরে অদৃশ্য রাসায়নিক কর্মকাণ্ড। রঙ এবং আকারের উপর জিনের প্রভাব নিজেই পরোক্ষ। এবং এখানেই আমার মূল বক্তব্য। তাদের মন্ত্রমুগ্ধ পোষকের আচরণের উপর কোকিলে একই জিনগুলোর প্রভাব শুধুমাত্র এর থেকে খানিকটা পরোক্ষ। এটি ঠিক একই অর্থে যেমন আমরা বলতে পারি কোকিলের জিনের (ফিনোটাইপিক প্রভাব আছে কোকিলের হা করে থাকা মুখের রঙ আর আকারের উপর। সুতরাং আমরা কোকিলের জিনদের কথা বলতে পারি এভাবে যে, তাদেরও ( সম্প্রসারিত ফিনোটাইপিক) প্রভাব আছে পোষকের আচরণে। পরজীবি জিনগুলো তার পোষকের শরীরে প্রভাব ফেলতে পারে, শুধুমাত্র তখনই না যখন পরজীবি কোনো পোষকের শরীরের ভিতরে বাস করে যখন সে এটিকে সরাসরি নিয়ন্ত্রিত করে রাসায়নিক উপায়ে, বরং যখন পরজীবি বাস করে তার পোষকের শরীরের বাইরে, পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে, এবং পোষককে নিয়ন্ত্রণ করে দূর থেকে। বাস্তবিকভাবেই যেমনটি আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখবো, এমনকি রাসায়নিক প্রভাবও কাজ করতে পারে শরীরের বাইরে।
শিক্ষা দেবার মাধ্যম হিসাবে কোকিলরা আসলেই আকর্ষণীয় প্রাণী। কিন্তু মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে এরকম যে কোনো বিস্ময়কে অনায়াসে পেরিয়ে যাবে কীটপতঙ্গরা। তাদের সেই সুবিধা আছে, কারণ তারা সংখ্যায় বিশাল। আমার সহকর্মী রবার্ট মে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, ‘খুব ভালো করে হিসাব করে দেখলে, সব প্রজাতি আসলে কীটপতঙ্গ। পতঙ্গ ‘কোকিলদের সংখ্যা তালিকা করা প্রায় অসম্ভব। তারা সংখ্যায় অনেক বেশী এবং তাদের আচরণ প্রায়শই পুনরাবিষ্কার করা হয়েছে। কিছু উদাহরণ যা আমরা দেখবো সেগুলো পরিচিত কোকিলসুলভ আচরণকে ছাড়িয়ে যাবে আমাদের সবচেয়ে লাগামছাড়া কল্পনাকে পূর্ণ করে, যা সম্প্রসারিত ফিনোটাইপের’ ধারণা হয়তো অনুপ্রাণিত করতে পারে।
একটি কোকিল তার ডিম পাড়ে এবং অদৃশ্য হয়ে যায়, কিন্তু কিছু পিপড়া কোকিল স্ত্রী সদস্যরা আরো নাটকীয়ভাবে তাদের উপস্থিতির জানান দেয়। আমি সাধারণত ল্যাটিন নাম ব্যবহার করিনা, কিন্তু Bothriomyrmex regicidus এবং B. decapitans এই নাম দুটি আসলেই কাহিনী বর্ণনা করে। এই দুটি প্রজাতি অন্য প্রজাতির পিপড়াদের সাথে পরজীবির মত আচরণ করে। সব পিপড়াদের মধ্যে, অবশ্যই, শিশু প্রজন্মকে সাধারণত প্রতিপালন করে তাদের পিতামাতা নয় বরং কর্মীরা। সুতরাং এই সব কর্মীদেরকে বোকা বানাতে হবে কোকিলের মত পরজীবি হতে ইচ্ছুক এমন কাউকে। একটি উপযোগী প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে কর্মীদের মাকেই সরিয়ে ফেলা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে এমন কর্মী সন্তান পালের জন্ম দেবার যার প্রবণতা আছে। এই দুটি প্রজাতিতে, পরজীবি রাণি, একাকী, লুকিয়ে অন্য প্রজাতির পিপড়াদের ঘরে ঢুকে পড়ে। সে খুঁজে বের করে তার এই পোষক ঘরের রাণিকে, এরপর তার পিঠের উপর চড়ে বসে, এবংনীরবে সে তার কাজ সম্পন্ন করে, যে কাজটি কি সেই সম্বন্ধে এডওয়ার্ড উইলসনের কৌশলী রক্ত হিম করা উনোক্তি যদি উদ্ধৃত করি: ‘একটি কাজ যার জন্য সে অনন্যভাবে বিশেষায়িত হয়েছে: ধীরে ধীরে তার শিকারের মাথা কেটে ফেলা। এই খুনীকে এরপর এতিম হয়ে যাওয়া কর্মীরা তাদের রাণী হিসাবে গ্রহন করে, যারা কোনো কিছু সন্দেহ না করে তার ডিম ও লার্ভাকে প্রতিপালন করতে শুরু করে। তাদের কেউ কেউ পালিত হয়ে নিজেরাই কর্মী হিসাবে গড়ে ওঠে, যারা ধীরে ধীরে সেই নেস্টের মূল প্রজাতিকে প্রতিস্থাপিত করে। অন্যরা রূপান্তরিত হয় রাণী হিসাবে, যারা উড়ে যায় নতুন কোনো পিপড়ার নীড়ে তাদের আগ্রাসণ সূচনা করতে, নুতন কোনো রাজকীয় মাথার খোঁজে, যা এখনও বিচ্ছিন্ন করা হয়নি।
কিন্তু মাথা কাটার কাজটা বেশ শ্রমসাপেক্ষ। পরজীবিরা নিজেরা কষ্ট করতে অভ্যস্ত নয়, যদি তারা পরিশ্রম এড়িয়ে কাজটি অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারে। উইলসনের ‘দ্য ইনসেক্ট সোসাইটিস বইটির আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্রটি হচ্ছে Monomorium santschil; এই প্রজাতিটি, বিবর্তনের সময়ের পরিক্রমায় পুরোপুরিভাবে তাদের কর্মী শ্ৰেণীটাকে হারিয়েছে। পোষকের কর্মী বাহিনী তাদের সব কাজ করে দেয়, এমনকি সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম কাজটি। আগ্রাসনকারী পরজীবি রানির পক্ষে, তারা আসলেই তাদের নিজেদের মাকে হত্যা করার মত কাজটি সম্পাদন করে। আগ্রাসনকারী রানির নিজের চোয়াল ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন। নেই। সে মন নিয়ন্ত্রণ করে। কিভাবে সে এই কাজটি করে তা একটি রহস্য; সম্ভবত এখানে সে-কোনো রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে, কারণ পিপড়াদের স্নায়ুতন্ত্র নানা ধরণের রাসায়নিক দ্রব্যের প্রতি বিশেষ সংবেদী। যদি তার অস্ত্র সত্যি রাসায়নিক হয়ে থাকে, এটি বিজ্ঞানে পরিচিত যে কোনো ড্রাগ অপেক্ষা ভয়ঙ্কর অশুভ প্রকৃতির। কারণ, একটু ভেবে দেখুন সেটি কি করাতে পারছে। এটি কর্মী পিপড়া মস্তিষ্ক প্লাবিত করে, তার মাংসপেশীর দখল নেয়, তাকে তার মস্তিষ্কে গভীরে প্রোথিত নির্দেশনা মোতাবেক কাজ থেকে সরিয়ে এনে নিজেদের মায়ের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করায়। পিপড়াদের জন্য মাতৃহত্যা বিশেষ একধরণের জিনগত পাগলামী এবং তাদের এমন কোন কাজ করতে প্ররোচিত করতে সেই ড্রাগটিকে অবশ্যই খুব শক্তিশালী হতে হবে। সম্প্রসারিত ফিনোটাইপের জগতে, জিজ্ঞাসা করবেন না কিভাবে কোনো জীবের আচরণ এর জিনদের সুবিধা দেয়, বরং জিজ্ঞাসা করুন কার জিনের উপকার সে করছে।
বিস্ময়ের আসলেই কিছু নেই যে নানা পরজীবি তাদের নিজেদের স্বার্থে পিপড়াদের সফলভাবে ব্যবহার করে। শুধু অন্য পিপড়া প্রজাতি নয়, বিশেষায়িত পরজীবিদের একটি বিস্ময়কর মিশ্রণ তাদের পরজীবি হিসাবে ব্যবহার করে। কর্মী পিপড়া বেশ প্রশস্ত একটি এলাকা থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহের সমৃদ্ধ চালান নিশ্চিৎ করে তাদের নেস্টের কেন্দ্রীয় গুদামে, যা ফ্রিলোডার বা বিনা পরিশ্রমে যারা অন্যদের পরিশ্রমের ফসলে ভাগ বসাতে চায়, তাদের পক্ষে দখল করার জন্য এটি খুব সহজ একটি লক্ষ্য। এছাড়া পিপড়া প্রতিরক্ষা দেবার জন্য বেশ ভালো প্রহরী হতে পারে, তারা যেমন সংখ্যায় বেশী, তেমনি অস্ত্রেও সুসজ্জিত। অধ্যায় ১০ এর এফিড দেখা যেতে পারে নেকটার পরিশোধ করার বিনিময়ে তাদেরকে পেশাজীবি দেহরক্ষক হিসাবে ভাড়া করছে। বেশ কিছু প্রজাপতি প্রজাতিরা তাদের ক্যাটারপিলার স্তরটি কাটায় কোনো না কোনো পিপড়া প্রজাতির নেস্টে। কেউ পুরোপুরিভাবে শুধু আদায় করে নেয়। তাদের স্বার্থটা, অন্যরা তাদের দেয়া প্রতিরক্ষার বিনিময়ে কিছু প্রদান করে। কখনো আক্ষরিক অর্থেই তাদের শরীরে চুলের মত সাজানো থাকে নানা যন্ত্র যা দিয়ে তারা তাদের প্রতিরক্ষাকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। Thisbe irenea নামের একটি প্রজাপতির ক্যাটারপিলারদের শব্দ তৈরীর একটি বিশেষ উপাঙ্গ থাকে তাদের মাথার কাছে, যার কাজ পিপড়াদের ডাকা, এবং একজোড়া লম্বা টেলিস্কোপের মত উপাঙ্গ থাকে এর পেছনের দিকে, পিপড়াদের জন্য যা মোহাবিষ্ট করে রাখার মত নেকটার বা রস নিঃসরণ করে। এর ঘাড়ে আরো এক জোড়া নলসহ ছিদ্র আছে, যা আরো সূক্ষ্ম
যাদুকরী সম্মোহনী প্রভাব ফেলে। তাদের নিঃসরণ কোনো তরল রস নয় বরং উদ্বায়ী একটি রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণ যা পিপড়াদের আচরণের উপর আরো নাটকীয় প্রভাব ফেলে। যখনই কোন পিপড়া এর কাছাকাছি আসে দেখা যায় সে রীতিমত উত্তেজিত হয়ে ওঠে, এর চোয়াল পুরো খুলে এটি হয়ে ওঠে তীব্র আক্রমণাত্মক। আক্রমণ করার জন্য তার মধ্যে দেখা যায় স্বাভাবিক পরিস্থিতির আরো বেশী আকুলতা, যে-কোন চলমান বস্তুকে সে কামড় বা হুল ফোঁটাতে তেড়ে যায়, শুধু ব্যতিক্রম, এবং গুরুত্বপূর্ণভাবে, সেই ক্যাটারপিলারদের সে কিছু করেনা, যারা তাকে এই রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে উত্তেজিত করে। উপরন্তু, কোনো পিপড়া, যা এই মাদক বিতরণকারী ক্যাটারপিলারের প্রভাবে আওতায় থাকবে সে ধীরে ধীরে এমন একটি পর্যায়ে প্রবেশ করে যাকে বলা যায় ‘বাইন্ডিং’, যেখানে এটি এর ক্যটারপিলার এর সাথে পুরোপুরিভাবে অবিচ্ছিন্ন একটি বন্ধনে আবদ্ধ হয় বেশ কিছু দিনের জন্য। সুতরাং আফিডদের মত, কিছু ক্যাটারপিলার, পিপড়াদের দেহরক্ষী হিসাবে ব্যবহার করে, কিন্তু এটি আরো খানিকটা বেশী কিছু করে। যখন আফিডরা পিপড়াদের শিকারী প্রাণীদের প্রতি সহজাত আগ্রাসী মনোভাবের উপর ভরসা করে, সেখানে ক্যাটারপিলার তাদের আরো আগ্রাসী করে তোলার জন্য বিশেষ রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে, যা মাদকের মত সেই পিপড়াদের নিজেদের সাথে বেধে ফেলে তাদের আসক্ত করে তুলে।
আমি কিছু চরম উদাহরণ বেছে নিয়েছি। কিন্তু আরো বেশ মৃদু উপায়ে, প্রকৃতি জুড়েই আছে বহু প্রাণী আর উদ্ভিদের উদাহরণ, যারা একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করে, যারা তাদের একই প্রজাতি কিংবা অন্য প্রজাতির সদস্য। প্রতিটি ক্ষেত্রে যেখানে প্রাকৃতিক নির্বাচন এই নিজেদের স্বার্থে অন্য প্রজাতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জিনহগুলোকে সুবিধা দেয়। সুতরাং এটি বৈধ হবে যদি বলা হয় এই সব একই জিনদের (সম্প্রসারিত ফিনোটাইপিক) প্রভাব আছে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এমন জীবের শরীরের উপর। কোন শরীরের মধ্যে জিনটি সত্যিকার শারীরিকভাবে বসে আছে, সেই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর নিয়ন্ত্রণের নিশানা হতে পারে একই শরীর কিংবা ভিন্ন কোনো শরীর। প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই সব জিনদের সহায়তা করে যারা পরিবেশকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে তাদের বংশ বৃদ্ধির জন্য। এটাই নির্দেশ করে সেই প্রস্তাবনাটির প্রতি যাকে আমি বলেছি সম্প্রসারিত ফিনোটাইপের সেন্ট্রাল থিওরেম বা কেন্দ্রীয় মূলনীতি: ‘একটি প্রাণীর আচরণের প্রবণতা আছে সেই আচরণের জন্য নির্দিষ্ট জিনগুলোর টিকে থাকার ব্যপারটি সর্বোচ্চভাবে নিশ্চিৎ করার, সেই জিনগুলো যে জীবটি সেই আচরণ করছে তার শরীরে থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। আমি প্রাণীদের আচরণের প্রসঙ্গেই কথাটি বলেছি, তবে এই মূলনীতিটি আমরা আরোপ করতে পারি, অবশ্যই রঙ, আকার, আকৃতি ইত্যাদি তো বটেই, যে-কোনো কিছুর ব্যপারে।
সেই সমস্যাটি নিয়ে আলোচনায় ফিরে আসার অবশেষে সময় এসেছে, যা দিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম, একক কোনো জীব এবং জিনের মধ্যে সেই টানাপোড়েনটির বিষয়ে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মূল ভূমিকা পালন করার ক্ষেত্রে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। আগের অধ্যায়গুলোয় আমি ধরে নিয়েছিলাম যে এখানে কোনো সমস্যা নেই, কারণ একক ব্যক্তির প্রজনন জিনের টিকে থাকার সমার্থক। আমি সেখানে ধরে নিয়েছিলাম যে, আপনি বলতে পারেন, কোনো একটি জীব কাজ করে তার সব জিনকে পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর করার জন্য ‘ অথবা, ‘জিনরা ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছু জীবকে বাধ্য করে তাদের প্রজন্মান্তরে হস্তান্তর করার জন্য। এই বাক্যদুটিকে দুটি সমরুপ উপায়ে একই কথা বলার মতই মনে হয়, এবং শব্দের কোন রুপটি আপনি বাছাই করবেন তা নির্ভর করবে আপনার রুচির উপর, কিন্তু তারপরও কোন না ভাবে টানাপোড়েনটি রয়ে যায়।
পুরো ব্যাপারটি ভালোভাবে সুবিন্যস্ত করার উপায় হচ্ছে ‘রেপ্লিকেটর’ বা অনুলিপনকারী এবং ভেহিকল’ বা ‘বাহক’ শব্দগুলো ব্যবহার করা। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মৌলিক একক, সে মূল জিনিসটি যা টিকে থাকে বা টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়, যা হুবহু প্রতিলিপিদের একটি বংশধারা সৃষ্টি করে কখনো কখনো ঘটা র্যানভোম মিউটেশন সহ, তাদেরকে বলা হচ্ছে রেপ্লিকেটর। ডিএনএ অণুরা হচ্ছে রেপ্লিকেটর বা অনুলিপিকারক। তারা সাধারণত, সেই সব কারণে যা আমরা আলোচনা করবো কিছুক্ষণের মধ্যে, একসাথে জোট বাধে সুবিশাল সমাজবদ্ধ টিকে থাকার মেশিন অথবা ‘বাহক হিসাবে। যে বাহকগুলোকে আমরা সবচেয়ে ভালো চিনি একক কোনো জীব সদস্যদের শরীর হিসাবে, যেমন, আমাদের শরীর। একটি শরীর তাহলে, কোনো রেপ্লিকেটর বা অনুলিপনকারী নয়, বাহক। আমাকে এই বিষয়টির উপর খানিকটা জোর দিতে হবে, কারণ এই বিষয়টি আমরা প্রায়ই ভুল বুঝি। বাহকরা তাদের নিজেদের প্রতিলিপি করতে পারেনা, অনুলিপনকারীদের প্রজন্মান্তের হস্তান্তর করার জন্য। তারা কাজ করে রেপ্লিকেটররা কোনো আচরণ করেনা, তারা পৃথিবীটাকে অনুভব করতে পারেনা, তারা কোনো শিকার ধরেনা বা শিকারী প্রাণীদের আক্রমণ এড়াতে তারা পালায়না। তারা বাহক সৃষ্টি করে, আর সেই বাহকরাই সেই কাজটি করে। নানা কারণেই জীববিজ্ঞানীদের জন্য সুবিধাজনক ছিল তাদের মনোযোগ বাহকের স্তরে নিবদ্ধ রাখা। আর অন্য কিছু কারণে হয়তো তাদের জন্য সুবিধাজনক রেপ্লিকেটরদের স্তরে মনোযোগ দেয়া। জিন আর একক কোনো জীব সদস্য ডারউইনীয় নাটকে একই ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। সেখানে তাদের ভূমিকা ভিন্ন, পরস্পরের সম্পূরক, এবং বহুভাবেই তাদের দুজনেরই ভূমিকা একই ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, রেপ্লিকেটরের ভূমিকা এবং বাহকের ভূমিকা।
অনুলিপিকারকবাহক শব্দের ব্যবহার নানা কারণে সহায়ক। যেমন, প্রাকৃতিক নির্বাচন কোন স্তরে কাজ করছে এটি সেই ক্লান্তিকর বিতর্কটির অবসান করে। উপরিদৃষ্টিতে যুক্তিসঙ্গত মনে হতে পারে ‘একক সদস্যদের উপর নির্বাচনটিকে’, জিন নির্বাচন যা সমর্থন করা হয়েছে অধ্যায় ৩ এ এবং অধ্যায় ৭ এর সমালোচিত গ্রুপ সিলেকশনের মাঝামাঝি কোনো স্তরে নির্বাচনের একটি মইয়ের মত কোনো এক ধাপের উপর রাখা যেতে পারে। একক কোনো সদস্যের উপর নির্বাচন’ মনে হয় অস্পষ্টভাবে এই দুটি চূড়ান্ত পর্যায়ের মাঝামাঝি কোনো অবস্থানে, আর বহু জীববিজ্ঞানী এবং দার্শনিক এই সহজ পথে ভাবতে প্ররোচিত হয়েছেন এবং এটিকে এভাবে দেখে এসেছেন। কিন্তু আমরা এখন দেখতে পারি যে বিষয়টি আসলে এরকম নয়। আমরা এখন দেখতে পারি যে কোনো জীব এবং জীবদের কোনো গ্রুপ এই গল্পে ‘বাহক’ দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু তাদের কেউই এমনকি কোনভাবেই ‘অনুলিপনকারী ভূমিকা পালন করার প্রার্থী নয়। একক জীবের নির্বাচন এবং গ্রুপ নির্বাচনের মধ্যে বিতর্ক সত্যিকারভাবে দুটি বিকল্প বাহকের মধ্যে ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক। একক সদস্য নির্বাচন এবং জিন নির্বাচনের মধ্যে বিতর্কটি আদৌ কোনো বিতর্ক নয়, কারণ। জিন এবং একক কোনো জীব সদস্য আসলে ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব পালনের প্রার্থী এবং এই কাহিনীতে তারা একে অপরের পরিপুরক ভূমিকা পালন করে, অনুলিপনকারী এবং বাহক।
কোনো একক সদস্য এবং এক গ্রুপ জীব সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাহকের ভূমিকার জন্য, এবং এটি যেহেতু সত্যিকারের দ্বন্দ্ব, এটির সমাধান করা যেতে পারে এবং দেখা গেছে এর পরিণতি, আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে, একক প্রাণীদের জন্য সুনির্দিষ্ট একটি বিজয়। সত্তা হিসাবে গ্রুপ খুবই অস্পষ্ট ধারণা। হরিণদের একটি পাল, সিংহদের একটি গ্রুপ বা প্রাইড, এক দল নেকড়ে, তাদের কিছু নির্দিষ্ট প্রাথমিক পর্যায়ে উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে একাত্মতা আর সংশ্লিষ্টতা আছে। সেটি খুবই তুচ্ছ যখন আমরা কোনো একক সিংহ কিংবা নেকড়ে বা হরিণের শরীরের সংগঠন আর উদ্দেশ্যের একাত্মতা লক্ষ্য করি। এবং এই সত্যটি এখন ব্যাপকভাবে গৃহীত কিন্তু কেন এটি সত্যি? সম্প্রসারিত ফেনোটাইপ এবং পরজীবিরা আবার আমাদের সাহায্য করতে পারে বিষয়টি বুঝতে।
আমরা দেখেছিলাম যে যখন কোনো একটি পরজীবির জিনগুলো একে অপরের সাথে একসাথে কাজ করে, কিন্তু পোষকের জিনের বিরোধিতা করে ( যারা আবার নিজেরা সবাই একই সাথে কাজ করে) এর কারণ হচ্ছে এই দুই সেট জিনের ভিন্ন ভিন্ন উপায় আছে। তাদের একই সাথে ভাগ করে নেয়া বাহকের শরীরের বাইরে আসার জন্য। শামুকের জিনগুলো শুক্রাণু কিংবা ডিম্বাণুর মাধ্যমে তাদের এই ভাগ করে নেয়া বাহন ত্যাগ করে। কারণ সব শামুক জিনই প্রতিটি শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর সাথে একই পরিমান স্বার্থ জড়িত, কারণ সবাই একই নিরেপক্ষ একটি মাইওসিস কোষ-বিভাজন প্রক্রিয়া অংশগ্রহন করে, তারা সবাই একই কাজ করে একটি সার্বিক মঙ্গলের জন্য এবং সেকারণে তারা শামুকের শরীরকে একটি সংগঠিত এবং উদ্দেশ্যময় বাহক হিসাবে নির্মাণ করার প্রবণতা বহন করে। সত্যিকার যে কারণটি ব্যাখ্যা করে কেন ফুক তার পোষক থেকে শনাক্তযোগ্যভাবে ভিন্ন, কেন এটি পোষকের উদ্দেশ্য আর পরিচয়ের সাথে একীভুত হয়ে যায় না– সেটি হচ্ছে ফ্লক জিনগুলো শামুকের জিনগুলোর মত তাদের বাহনের বাইরে আসার একই পদ্ধতি ব্যবহার করেনা। তারা শামুকের মাইওটিক লটারীর সাথে সংশ্লিষ্ট নয়– কারণ তাদের নিজেদের এমন একটি লটারীতে অংশ নিতে হয়। সুতরাং, সেই পর্যায় অবধি, এবং শুধুমাত্র সেই পর্যায় অবধি, দুটি বাহক বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখে, শামুক এবং তাদের মধ্যে বসবাসরত শনাক্ত করা সম্ভব ফুকরা। যদি ফুক জিনরা শামুকের ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু দ্বারা বাহিত হয়, দুটি শরীরই বিবর্তিত হয় এমনভাবে যেন তারা একই শরীর। আমরা হয়তো বলতে পারবো না যে এখানে কোনদিনও দুটি ‘বাহক ছিল।
‘একক’ কোনো জীব, যেমন, আমরা, এধরনের বহু একীভুত হবার প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত একটি উদাহরণ। কোনো জীবদের একটি গ্রুপ– যেমন পাখিদের ঝাক, নেকড়েদের দল– এভাবে একটি বাহকে কখনো একীভুত হয় না, সুনির্দিষ্টভাবে এর কারণ কোনো একটি ঝাক বা দলে জিনরা তাদের বর্তমান বাহকের শরীর ত্যাগ করার একই সাধারণ পদ্ধতি ভাগ করে নেয়না। নিশ্চয়ই পাখিদের এক ঝাক থেকে ছোট এক ঝাক (কন্যা) পাখি সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু পিতামাতা ঝাকের জিনগুলো কন্য ঝাঁকে হস্তান্তরিত হয়না একক কোনো বাহকে যেখানে তাদের সবার সমপরিমান ভাগ আছে। এক পাল নকড়ের জিনগুলোর ভবিষ্যতে একগুচ্ছ একই ঘটনা থেকে সমান সুবিধা পাবার সম্ভাবনা থাকে না। একটি জিন তার ভবিষ্যত কল্যাণের দেখাশোনা করে একক কোনো নেকড়ে সদস্যের কল্যাণের প্রতি লক্ষ করে, যা বঞ্চিত করতে পারে অন্য নেকড়ে সদস্যদের। সুতরাং কোনো একক নেকড়ে সদস্য, তাদের নামের সুনাম রক্ষাকারী একটি বাহক হবার যোগ্য, কিন্তু একপাল নেকড়ে নয়। জিনগতভাবে বললে, এর কারণ ছিল প্রজনন কোষ ছাড়া নেকড়ের শরীরের বাকী সব কোষেই একই জিন থাকে এবং প্রজনন কোষের ক্ষেত্রে যেখানে সব জিনের সমান সম্ভবনা থাকে তাদের যে কোনো একটার মধ্যে থাকার। কিন্তু এক পাল নেকড়ের কোষে একই জিন থাকে না, এবং এমনকি তাদের একই সুযোগ থাকেনা যদি এই পাল থেকে ছোট কোনো পাল সৃষ্টি হয়, সেই পালের নেকড়ের কোষদের মধ্যে হস্তান্তরিত হওয়ার। তাদের লাভ করার সব উপায়ই থাকে অন্যান্য নেকড়ে শরীরের সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করার মাধ্যমে (যদিও সেই বাস্তব তথ্যটি একই থাকে যে একটি নেকড়ের পালের সম্ভাবনা থাকে আত্মীয় গ্রুপ হবার, যা এই সংগ্রামকে প্রশমন করে)।
গুরুত্বপূর্ণ যে গুণটি কোনো সত্তার প্রয়োজন, যদি সেটিকে কোনো একটি কার্যকর জিন বাহকে রূপান্তরিত হতে হয়, সেটি হচ্ছে এটি, এর বাহিত সব জিনের জন্য অবশ্যই ভবিষ্যৎ অভিমুখে বের হবার একটি নিরপেক্ষ পথ থাকে। এটি সত্য কোনো একক নেকড়ের জন্য। এই চ্যানেলটি হচ্ছে শুক্রাণু অথবা ডিম্বাণুর ক্ষীণ ধারা, যা সে তৈরী করে মাইওসিস প্রক্রিয়ায়। কিন্তু পুরো একপাল নেকড়ের সাথে এটি সত্যি নয়। এক পাল নেকড়ের ক্ষেত্রে এটি সত্য নয়। তাদের নিজেদের শরীরের কল্যাণের জন্য স্বার্থপর হবার প্রচেষ্টায় জিনদের আসলেই কিছু লাভ করার থাকে, নেকড়ের পালে অন্যান্য জিনদের ক্ষতির বিনিময়ে। একটি মৌচাক,যখন মৌমাছিতে পূর্ণ থাকে, মনে হয় তারা প্রজনন করছে কোনো প্রশস্ত মাথার উপাঙ্গ কোনো মুকুলের মত বের হয়ে এসে, অনেকটাই নেকড়ে পালের মত। কিন্তু আমরা যদি সতর্কভাবে বিষয়টি লক্ষ করি, আমরা দেখবো, জিনদের ক্ষেত্রে যখন আমাদের প্রস্তাবটি সীমাবদ্ধ থাকতে, তাদের নিয়তি বহুলাংশেই ভাগবাটোয়ারা হয়ে যায়, যা থাকে একটি মাত্র রানির ডিম্বাশয়ে। এই মৌমাছির ঝাঁকে জিনগুলোর ভবিষ্যৎ অনেকাংশে অবস্থানে করছে একটি রানির ডিম্বাশয়ের উপর। আর সে কারণেই– এটি শুধুমাত্র আরেকটি উপায় এর আগের অধ্যায়ের মূলবার্তাগুলো প্রকাশ করা করার জন্য– মৌমাছিদের এই কলোনী দেখতে এবং আচরণে একটি সত্যিকারের সন্নিবিষ্ট একক বাহকের মত।
সব জায়গায় আমরা খুঁজে পাই, বাস্তবিকভাবেই, জীবন সুনির্দিষ্টভাবে আলাদা, একক ভাবে উদ্দেশ্যপূর্ণ বাহনসমষ্টি হিসাবে জড়ো হয়ে আছে, নেকড়ে বা মৌচাকের মত। কিন্তু সম্প্রসারিত ফিনোটাইপের মতবাদ আমাদের শিখিয়েছে, এটি এমন হবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। মৌলিকভাবে আমাদের তত্ত্ব থেকে আমরা প্রত্যাশা করার অধিকার রাখি সেটি হচ্ছে, অনুলিপনকারীদের একটি যুদ্ধক্ষেত্র, ধাক্কাধাক্কি, যারা যুদ্ধরত পরবর্তী জিনগত ভবিষ্যতে নিজেদের জায়গা করে নেবার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতারত। এই যুদ্ধের অস্ত্র হচ্ছে জিনদের ফিনোটাইপিক প্রভাবগুলো। প্রাথমিকভাবে কোষের উপর সরাসরি রাসায়নিক প্রভাবসমষ্টি এবং পরিশেষে, পালক এবং দাঁতের উপর এবং এমনকি আরো দূরবর্তী কোনো প্রভাব। অনস্বীকার্যভাবে এই সব ফিনোটাইপিক প্রভাবগুলোর ক্ষেত্রে এটি ঘটে, যারা প্রধানত একসাথে যুথবদ্ধ একটি পৃথক বাহনে, প্রত্যেকে তাদের জিন বহন করছেন যারা শৃঙ্খলিত এবং সুবিন্যস্ত শুক্রাণুদের অথবা ডিম্বাণুদের প্রবেশের সরু প্রবেশপথে একই সাথে ভাগ করে নেয়া সম্ভবনার সম্মুখে যা তাদের ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে। এবং এই বাস্তব সত্যটিকে এমনই হয়ে থাকে বলে গ্রহন করার কোনো অবকাশ নেই। এটি হচ্ছে বাস্তব সত্য যাকে প্রশ্ন করতে হবে এবং কল্পনা করতে হবে, এর নিজের অধিকারে যা এটি পাবার অধিকার রাখে। জিনরা কেনই বা একটি বড় বাহনে একসাথে জড়ো হয়েছে, যাদের প্রত্যেকের একটি মাত্র একক জিনগত বহির্গমনের পথ আছে? কেন জিনরা এমন দল বাধে এবং তাদের বসবাসের জন্য এমন বড় আকারের শরীর তৈরী করে? ‘দি এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপ’ বইটিতে আমি এই কঠিন সমস্যাটির একটি উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টা করেছি। এখানে আমি সেই উত্তরগুলোর আংশিক বিবরণ দিচ্ছি– যদিও, সাত বছর পরে যেমনটি প্রত্যাশা করা যেতে পারে, আমি এটিকে আরো খানিকটা সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আমি প্রশ্নটিকে মোট তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি। কেন জিনরা একটি কোষের মধ্যে একসাথে দল বেধে থাকে? কেন কোষরা একসাথে দল বেধে বহুকোষী শরীর তৈরী করে? এবং কেনই সেই শরীর এমন একটি কৌশল বেছে নিয়েছে যাকে আমরা বলবো বোতলের মুখের মত সংকীর্ণ বা ‘বোটলনেক’ জীবন চক্র?
প্রথমে তাহলে, জিনরা কেন এক সাথে দল বেধে কোষের মধ্যে বসবাস করে? কেন এই প্রাচীন রেপ্লিকেটর আদিম সুপে তাদের ভাবনাহীন স্বাধীনতা পরিত্যাগ করে এবং সুবিশাল কলোনি নির্মাণের জন্য একসাথে জড়ো হয়? কেনই বা তারা একে অপরের সাথে সহযোগিতা করে? এই প্রশ্নের আংশিক উত্তর আমরা দেখতে পাই আমাদের আধুনিক ডিএনএ অণু জীবন্ত কোষ নামের রাসায়নিক কারখানায় কিভাবে সহযোগিতা করছে সেটি দেখে। ডিএনএ অণুগুলো প্রোটিন তৈরী করে, প্রোটিন উৎসেচক হিসাবে কাজ করে, কোনো একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অনুঘটকের দ্বায়িত্ব পালন করে। কোনো উপযোগী রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনের জন্য প্রায়শই একটি মাত্র রাসায়নিক বিক্রিয়া যথেষ্ট নয়। মানুষের ঔষধ কারখানায় কোনো একটি কার্যকরী রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুতে প্রয়োজন একটি প্রোডাকশন লাইন। একেবারে শুরু রাসায়নিক দ্রব্যটিকে কিন্তু একেবারে শেষের কাঙ্খিত দ্রব্যে রুপান্তর করা যাবে না অন্তবর্তীকালীন পর্যায়গুলো বাদ দিয়ে। ধারাবাহিকভাবে বেশ একটি অন্তবর্তীকালীন রুপকে অবশ্যই সংশ্লেষণ করতে হবে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ধারাবাহিকতায়। কোনো একজন গবেষক রসায়নবিদের উদ্ভাবনপটুতার অনেকটুকুই ব্যয় হয় শুরুর রাসায়নিক দ্রব্যটি থেকে শেষের কাঙ্খিত দ্রব্যটি নির্মাণে মধ্যবর্তী অন্তর্বতীকালিন দ্রব্যগুলো নির্মাণ করতে। একই ভাবে একটি জীবন্ত কোষে কোনো একক উৎসেচক সাধারণত একা একাই কোনো উপযোগী কাঙ্খিত দ্রব্য সংশ্লেষণ করতে পারেনা শুরুর রাসায়নিক দ্রব্য বা কাঁচামাল থেকে। কাজটি করার জন্য প্রয়োজন পুরো একগুচ্ছ উৎসেচক, একটি হয়তো কোনো কাঁচামাল দ্রব্যেকে প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন দ্রব্যতে রূপান্তরিত করার বিক্রিয়ায় অনুঘটক হিসাবে কাজ করে, অন্যটি হয়তো প্রথম অন্তবর্তীকালীন দ্রব্যকে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন দ্রব্যতে রূপান্তরিত করার বিক্রিয়ায় অনুঘটক হিসাবে কাজ করে, এবং এভাবে ধাপে ধাপে এটি চলমান।
এই উৎসচেকগুলোর প্রত্যেকটি তৈরী হয় একটি করে জিনের নির্দেশনায়। যদি ছয়টি উৎসচেকের একটি ধারাবাহিক অনুক্রমের প্রয়োজন হয় একটি বিশেষ সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায়, তাদের বানানোর জন্য ছয়টি জিনকে অবশ্যই থাকতে হবে। যদিও খুবই সম্ভাব্য যে একই শেষ-দ্রব্যে পৌঁছানোর জন্য এখানে দুটি বিকল্প পথ আছে, প্রত্যেকটি প্রক্রিয়ায় আমাদের দরকার ছয়টি করে এনজাইম, এবং তাদের দুটোর মধ্যে থেকে কোনো একটিকে বাছাই করার বিশেষ কোনো নির্দেশনা নেই। এই ধরণের ব্যপারগুলো রাসায়নিক কারখানায় হয়ে থাকে। কোন পথটি বেছে নেয়া হয়েছে সেটি হয়তো ঐতিহাসিক একটি আকস্মিক কোনো ঘটনা অথবা, এটি হতে পারো রসায়নবিকদের আরো কোন বড় বিস্তারিত পরিকল্পনার অংশ। প্রকৃতির রসায়নে কোনো একটি নির্দিষ্ট বাছাই, অবশ্যই, কখনো একটি পরিকল্পিত বাছাই হবে না। বরং এটি ঘটবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু কিভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন এই দুটি রাসায়নিক পদ্ধতিকে আলাদা করে কোন ধরণের মিশ্রণ না ঘটিয়ে এবং সেই সব পরস্পরকে সহযোগিতাকারী জিনগুলোর গ্রুপের উদ্ভব হয়। এটি খুব বেশী সেই একই উপায়ের মত যা আমি প্রস্তাব করেছিলাম জার্মান এবং ইংলিশ নৌকা চালকদের উদাহরণে ( অধ্যায় ৫)। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে প্রথম পদ্ধতির রাসায়নিক ধাপে একটি জিন সফলভাবে কাজ করে সেই প্রথম পদ্ধতির অন্য জিনদের উপস্থিতিতে, কিন্তু দ্বিতীয় পদ্ধতির জিনগুলোর উপস্থিতিতে না। এবং যদি জনগোষ্ঠীতে ইতিমধ্যেই প্রথম পদ্ধতির জিন দ্বারা প্রাধান্য বিস্তারের কোন পরিস্থিতি থাকে, তাহলে নির্বাচন প্রথম পদ্ধতির অন্য জিনগুলোকে সহায়তা করবে, এবং দ্বিতীয় পদ্ধতির জিনগুলোকে সহায়তা বঞ্চিত করবে, এবং বিপরীত পরিস্থিতিতেও এটি সত্য একইভাবে। যতই প্রলুব্ধকর মনে হোক না কেন, খুব দৃঢ়ভাবে ভুল এমন কিছু বলা যে, দ্বিতীয় পদ্ধতির ছয়টি এনজাইমের জিন নির্বাচিত হয় কোনো একটি গ্রুপ হিসাবে। প্রত্যেকেটি নির্বাচিত হয় একটি পৃথক স্বার্থপর জিন হিসাবে। কিন্তু এটি সফলভাবে বিকশিত হয় শুধুমাত্র যখন অন্য সঠিক সেট জিনের উপস্থিতিতে এটি থাকে।
বর্তমানে এই জিনদের মধ্যে এই সহযোগিতা চলে কোষের অভ্যন্তরে। এটি অবশ্যই শুরু হয়েছিল সেই প্রাথমিক সহযোগিতা থেকে যা বিদ্যমান ছিল আদিম সেই সুপে স্ব-অনুলিপনকারী জিনগুলোর মধ্যে (অথবা যে আদিম মাধ্যমই সেখানে থাকুক না কেন); হয়তো কোষ ঝিল্লীর আবির্ভাব হয়েছিল এই সব উপযোগি রাসায়নিক দ্রব্যগুলোকে একসাথে ধরে রাখার জন্য এবং সেগুলো যেন ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে না যেতে পারে, সেটি ঠেকাতে। কোষের বহু রাসায়নিক বিক্রিয়া আসলে সংঘটিত হয় কোষ ঝিল্লীর নিজস্ব গঠনের মধ্যেই, একটি ঝিল্লী একই সাথে কনভেয়ার বেল্ট এবং টেস্ট টিউব র্যাক হিসাবে কাজ করে। কিন্তু জিনদের মধ্যে এই সহযোগিতা শুধুমাত্র কোষের মধ্যে সংঘটিত জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকে না। কোষরা একে অপরে নিকটে আসে (বা কোষ বিভাজনের পর পৃথক হয় না) বহু-কোষী শরীর নির্মাণ করার জন্য।
এটাই আমাদের নিয়ে আসে আমরা করা সেই তিনটি প্রশ্নের দ্বিতীয়টিতে। কেন কোষগুলো একত্রে জোট বাধে, কেন এই অদ্ভুত রোবট? এটি সহযোগিতা সংক্রান্ত আরেকটি প্রশ্ন। কিন্তু এই ক্ষেত্রটি পরিবর্তিত হয় অণুদের ক্ষুদ্র জগত থেকে আরো বড় ক্ষেত্রে। বহুকোষী শরীরগুলো আণুবীক্ষণীক জগতের সীমানাকে অতিক্রম করে। তারা এমনকি রুপ নেয় হাতি কিংবা তিমির। কিন্তু আকারে বড় হওয়া আবশ্যিকভাবে একটি ভালো বিষয় নাঃকারণ বেশীর ভাগ জীব আসলে ব্যাকটেরিয়া, সেই তুলনায় হাতির সংখ্যা খুব অল্প। কিন্তু ক্ষুদ্র জীবদের জন্য উন্মুক্ত জীবন ধারণের সব পন্থাই ব্যবহৃত হবার পরও আকারে বড় জীবদের টিকে থাকার সুব্যবস্থা আছে। যেমন, বড় জীবরা ছোট জীবদের খেতে পারে বা তাদের খাদ্য হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে।
কোষদের এই ক্লাব গঠন করার সুবিধা এর আকারেই সীমাবদ্ধ নয়। এই ক্লাবের কোষগুলো বিশেষায়িত হতে পারে, প্রত্যেকে সেভাবে আরো বেশী দক্ষ হয়ে ওঠে তার সুনির্দিষ্ট কাজগুলো সম্পাদন করার জন্য। বিশেষায়িত কোষগুলো সেই ক্লাবের অন্য কোষদেরও সেবা দেয় এবং তারা ক্লাবের অন্যান্য বিশেষায়িত সদস্যদের মাধ্যমেও উপকৃত হয়। যদি সেখানে অনেক কোষ থাকে, এদের কিছু বিশেষায়িত হতে পারে সংবেদনশীল সেন্সর হিসাবে যারা কোনো শিকার শনাক্ত করে, অন্যরা বিশেষায়িত হয় স্নায়ু হিসাবে যারা সেই বার্তাটিকে বহন করে নিয়ে যায়, অন্যরা সেই হুল ফোঁটানো উপাঙ্গে যার তাদের শিকারকে অবশ করে দিতে পারে, কিংবা মাংসপেশীতে যারা টোকল নাড়াতে সহায়তা করে যা শিকার ধরার জন্য ব্যবহৃতম হয়, নিঃসরণ কোষে যা এটিকে দ্রবীভুত করতে পারে এবং এর রসগুলো শুষে নিতে পারে। আমাদের অবশ্যই ভোলা উচিৎ না, নিদেনপক্ষে আধুনিক শরীর, আমাদের যেমন, সেখানে কোষগুলো আসলে ক্লোন। সবাই এই জিনসমষ্টী বহন করে,যদিও ভিন্ন ভিন্ন। জিনগুলো ভিন্ন ভিন্ন বিশেষায়িত কোষে সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রতিটি ধরনের কোষে জিনগুলো সরাসরি তাদের নিজেদের অনুলিপিগুলোকে সহায়তা করছে, যারা খুব সংখ্যালঘু কোষে থাকে, যে কোষগুলো বিশেষায়িত প্রজননের জন্য, অমর জার্ম লাইনের কোষগুলো।
সুতরাং, এবার আমরা আসি তৃতীয় প্রশ্নটিতে, কেন শরীর এই ধরনের বটোলনেক বা বোতলের গলার মত সংকীর্ণ জীবন চক্রে অংশগ্রহন করে?
শুরুতেই বলতে হবে বটোলকে বলতে আমি কি বোঝাচ্ছি? কোনো একটি হাতির শরীরে যত বেশী সংখ্যক কোষই থাকুক না কেন, এটি তার জীবন শুরু করেছিল মাত্র একটি কোষ দিয়ে– নিষিক্ত ডিম্বাণু। নিষিক্ত ডিম্বাণু হচ্ছে সংকীর্ণ সেই বোতলের ঘাড়, যা জ্বতাত্ত্বিক বিকাশের সময়, একজন প্রাপ্তবয়স্ক হাতির বহু ট্রিলিয়ন কোষে বিস্তৃত হয়। এবং কত সংখ্যক কোষ তাতে কিছু যায় আসেনা, কতগুলো। বিশেষায়িক ধরণ তাও কিছু যায় আসে না, তারা সহযোগিতা করে একটি পূর্ণ বয়স্ক হাতির শরীরের অকল্পনীয়ভাবে জটিল কাজগুলো সম্পাদন করার জন্য। ঐসব কোষগুলোর সব প্রচেষ্টা একই দিক বরাবর একত্রিত হয় আবারো একক কোষদের তৈরীর সবশেষ লক্ষ্য সৃষ্টিতে– শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু। হাতির শুধু সূচনাই হয় না একটি মাত্র কোষ থেকে, একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু, এর শেষ, মানে এর উদ্দেশ্য বা শেষ উৎপাদনটিও হচ্ছে একক কোষ তৈরী করা, পরবর্তী প্রজন্মের নিষিক্ত ডিম্বাণু। বিশালাকৃতির হাতির জীবন চক্র শুরু আর শেষ হয় সংকীর্ণ বটোলনেকে। এই বোতলের ঘাড়ের মত সংকীর্ণতা বিষয়টি বহুকোষী প্রাণী আর বেশীর ভাগ উদ্ভিদের জন্য বৈশিষ্ট্যসূচক। কেন? এর গুরুত্ব আসলে কি? আমরা এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারবো না, এটি ছাড়া জীবন কেমন দেখতে হতে পারে সেটি বিবেচনা না করা ছাড়া।
সহায়ক হতে পারে, দুটি কাল্পনিক প্রজাতির সমুদ্র শৈবালের কথা ভাবুন, ধরুন তাদের নাম ‘বটল-রেক’ এবং ‘স্প্লার্জ-উইড’। স্প্লার্জ উইড সাগরে বৃদ্ধি পায় এলোমেলোভাবে নির্দিষ্ট কোনো আকারহীন। শাখা প্রশাখা হিসাবে। মাঝে মাঝে তাদের শাখা ভেঙ্গে যায় এবং তারা দুরে ভেসে চলে যায়। এই ভেঙ্গে যাওয়া উদ্ভিদের যে কোন অংশে হতে পারে, এই টুকরো আকার ছোট কিংবা বড় হতে পারে। বাগানে গাছের কাটিং বা কলমের মত, তারা মূল উদ্ভিদের মত গড়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে। এই নানা অংশের ঝরে যাওয়া হচ্ছে প্রজাতির প্রজনন করার একটি পদ্ধতি। আপনি পরে লক্ষ করবেন, বেড়ে উঠবার প্রক্রিয়া থেকে এই প্রক্রিয়াটি ভিন্ন না, শুধুমাত্র যে অংশটি বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটিকে মূল অংশ থেকে শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন হতে হবে।
বটোল-র্যাক একই রকম দেখতে একই এলেমেলোভাবে এটি বাড়ছে। কিন্তু এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে যদিও। এটি প্রজনন করে একটি এককোষী জননকোষ বা স্পোর ছেড়ে দেবার মাধ্যমে, যা সমুদ্রের পানিতে ভেসে দুরে চলে যায় এবং সেখান থেকে নতুন একটি উদ্ভিদের জন্ম নেয়। এই স্পোরগুলো উদ্ভিদের আর যে কোষের মতই দেখতে একটি কোষ। স্প্লার্জ-উইডের ক্ষেত্রে যা ঘটে, কোনো যৌন প্রজনন এখানে ঘটে না। কোনো একটি উদ্ভিদের কন্যা হচ্ছে সেই কোষগুলো যারা মূল উদ্ভিদের কোষেরই ক্লোন। শুধুমাত্র পার্থক্য এই দুই প্রজাতির মধ্যে স্প্লার্জ-উইড তাদের বংশ বিস্তার করে তাদের শরীরের অনির্দিষ্ট সংখ্যক কোষ সমন্বয়ে তৈরী খণ্ডাংশ তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে, আর বটোল-ব্ল্যাক প্রজনন করে তার নিজের একটি অংশকে বের করে দিয়ে, যেখানে কোষ সংখ্যা মাত্র একটি।
এই দুই ধরনের উদ্ভিদ কল্পনা করার মাধ্যমে আমরা বটোলনেক এবং বটোলনেক নয় এমন জীবন চক্রের মধ্যে মূল পার্থক্যটি দেখলাম। বটোল-র্যাক প্রজনন করে প্রতিটি প্রজন্মে একটি এককোষী বটোলনেকের মধ্য দিয়ে। স্প্লার্জ-উইড শুধু বাড়ে এবং ভেঙ্গে যায় দুটি টুকরোয়। খুব কঠিন হয়ে যায় বলা এর কি ‘পৃথক’ প্রজন্ম আছে নাকি এটি পৃথক “জীবদের দ্বারা গঠিত। কিন্তু বটোল র্যাকদের ক্ষেত্রে কি হচ্ছে? আমি শীঘ্রই সেটি ব্যাখ্যা করবো, কিন্তু আমরা ইতিমধ্যে উত্তরের হালকা আভাস পাচ্ছি। বটোল ব্ল্যাকদের কি ইতিমধ্যেই মনে হচ্ছে না আরো বেশী সুস্পষ্ট পৃথক জীবের মত কিছু?
স্প্লার্জ-উইড, যেমনটি আমরা দেখেছি, যেভাবে এটি বৃদ্ধি পায়, সেই একই উপায়ে এটি প্রজননও করে। আসলেই এটি প্রজনন করে এমন কিছু বলা কঠিন। অন্যদিকে বটোল-ব্ল্যাকদের ক্ষেত্রে, বৃদ্ধি, প্রজনন দুটি ভিন্ন প্রক্রিয়া। আমরা হয়তো পার্থক্যটা প্রায় খুঁজে পেয়েছি, কিন্তু কি আসে যায় সেটিতে? এর গুরুত্বটি কি? কেন এটি আমাদের ভাবতে হবে? আমি বহু সময় ধরে বিষয়টি ভেবেছিলাম এবং আমি মনে করি আমার এর উত্তর জানা আছে। (ঘটনাক্রমে, এখানে যে কোনো প্রশ্ন আছে সেটি বরং এর উত্তর অপেক্ষা খুঁজে বের করা কঠিনতর!)। এই উত্তরটিকে মোট তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যার প্রথম দুটি হচ্ছে বিবর্তন আর ভ্রণতাত্ত্বিক বিকাশ প্রক্রিয়ার সম্পর্কের সাথে জড়িত।
প্রথম, একটি সরল থেকে জটিলতর অঙ্গের বিবর্তনের সমস্যাটি নিয়ে ভাবুন। আমাদের উদ্ভিদের উদাহরণে সীমাবদ্ধ না থাকলেও চলবে। এবং যুক্তির এই পর্বের জন্য, আমাদের জন্য ভালো হবে প্রাণীদের উদাহরণ নিয়ে বিষয়টি আলোচনা করা, কারণ তাদের অনেক বেশী জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে। আবারো যৌন প্রজননের ভাষায় কোনো কথা না বললেও চলবে, কারণ এখানে যৌন বনাম অযৌন প্রজনন রেড হেরিং এর মত মূল আলোচনাকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে ফেলার জন্য। আমরা কল্পনা করতে পারি আমাদের প্রাণীরা প্রজনন করছে অযৌন স্পোর উৎপাদন ও বিস্তার করে, যে কোষগুলো মিউটেশন ব্যতিরেকে জিনগতভাবে শরীরের অন্য সব কোষের সদৃশ।
কোনো একটি অগ্রসর প্রাণী, যেমন, মানুষ বা একটি উডলাউস এর জটিল অঙ্গগুলো বিবর্তিত হয়েছে পূর্বসূরীদের সরল অঙ্গ থেকে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে। কিন্তু পূর্বসূরীদের অঙ্গগুলো আক্ষরিকার্থে তাদের নিজেদের পরিবর্তন করেনা উত্তরসূরীদের অঙ্গ হিসাবে, যেমন, তলোয়ারকে পিটিয়ে লাঙ্গল-ফলা বানানোর মত। শুধুমাত্র তারা সেটি তো করেই না, আমি যে বিষয়টি বোঝাতে চাইছি বেশীর ক্ষেত্রে তারা সেটি করতেও পারে না। শুধুমাত্র সীমিত পরিমান কিছু পরিবর্তন অর্জন করা যেতে পারে তলোয়ার থেকে লাঙ্গলের ফলায় রুপান্তর করার প্রক্রিয়ায়। আসলেই বড় কোনো পরিবর্তন অর্জিত হতে পারে শুধুমাত্র পরিকল্পনার স্তরে বা ড্রইং বোর্ডে ফিরে যাবার মাধ্যমে, যেখানে এর আগের ডিজাইন পরিবর্তন করে নতুন করে শুরু করা যেতে পারে। যখন প্রকৌশলীরা ড্রইং বোর্ডে ফিরে যান এবং নতুন কোনো একটি ডিজাইন তৈরী করেন, তারা কিন্তু আবশ্যিকভাবে এর আগের ডিজাইন থেকে সব ধারণাই ছুঁড়ে ফেলে দেননা। কিন্তু তারা আক্ষরিকভাবে পুরোনো ভৌতিক কোনো বস্তুকে বিকৃত করে নতুন কোনো বস্তুতে রুপান্তর করার চেষ্টাও করেননা। কারণ পুরোনো সেই বস্তুটি ইতিহাসের নানা জঞ্জালের ভারে ইতিমধ্যে ভারাক্রান্ত। হতে পারে আপনি কোনো তলোয়ারকে পিটিয়ে লাঙ্গলের ফলা বানাতে পারেন, কিন্তু চেষ্টা করে দেখুন তো কোনো প্রোপেলার ইঞ্জিনকে জেট ইঞ্জিনের রুপান্তর করার জন্য। আপনি সেটি করতে পারবেননা, আপনাকে প্রপেলার ইঞ্জিনটাকে বাদ দিতে হবে এবং আবারো ড্রইং বোর্ডে ফিরে যেতে হবে পরিকল্পনার স্তরে।
জীবিত সব কিছুই, অবশ্যই, কখনো এমন কোনো প্রকৌশলীর ড্রইং বোর্ডে পরিকল্পনা করা হয়নি। কিন্তু তাদের একটি একেবারে নতুন সূচনা পর্ব আছে। তারা প্রতিটি প্রজন্মেই আবারো নতুন করে শুরু করে। প্রতিটি নতুন জীব একটি এককোষী হিসাবে যাত্রা শুরু করে নতুন করে গড়ে ওঠে। তারা পূর্বসূরীদের পরিকল্পনা বা ডিজাইনটি উত্তরাধিকার হিসাবে পায়, ডিএনএ প্রোগ্রাম রুপে, কিন্তু এটি এর পূর্বসূরীদের সত্যিকারের অঙ্গটি পুরোপুরি উত্তরাধিকার হিসাবে পায় না। সে তার পিতামাতার হৃৎপিন্ডটি উত্তরাধিকার হিসাবে পায় না, যাকে যে নতুন করে গড়ে পিটে একটি নতুন (সম্ভবত আরো উন্নত) অঙ্গে পরিণত করেনা। একেবারে শূন্য থেকে এটি শুরু করে, এককোষী হিসাবে এবং সেখান থেকেই সে তার নিজের হৃদপিণ্ড গড়ে তোলে, তার পিতামাতার হৃদপিণ্ডের সেই একই ডিজাইন প্রোগ্রাম ব্যবহার করে, যেখানে হয়তো কোনো উন্নতি সংযুক্ত হতে পারে। আপনি হয়তো উপসংহারটি বুঝতে পারছেন যার দিকে আমি অগ্রসর হচ্ছি। একটি “বটোলনেক’ জীবনচক্রের ব্যপারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এটি সেই ড্রইং বোর্ডের কাছে ফিরে যাবার মত সমতুল্য একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
জীবনচক্রের এই বোটলনেক পরিস্থিতির দ্বিতীয় এবং সম্পর্কযুক্ত একটি পরিণতি আছে। এটি একটি ক্যালেন্ডার প্রদান করে, যা জণগত প্রক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো একটি বটোলনেক জীবন চক্রে, প্রতিটি নতুন প্রজন্ম মোটামুটি প্রায় একই ঘটনা পালাক্রম অতিক্রম করে। জীব শুরু করে এককোষী হিসাবে, যা কোষ বিভাজনের মাধ্যমে সংখ্যায় বাড়ে। এবং এটি প্রজনন করে কন্যা কোষ তৈরী করে। এবং একসময় এটি মারা যায় কিন্তু সেটি কম গুরুত্বপূর্ণ আমাদের মত মরণশীলদের কাছে যা অনুভূত হয় তার চেয়ে। এই আলোচনায় আপাতত যা আমি বর্ণনা করেছি, প্রতিটি চক্রের শেষে এটি প্রত্যাবর্তন করে যখন বর্তমান জীবটি প্রজনন করে এবং নতুন প্রজন্মের চক্রটি শুরু হয়। যদিও তাত্ত্বিকভাবে জীব প্রজনন করতে তার বেড়ে ওঠার যে কোন পর্যায়ে, তবে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি একসময় প্রজননের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়ের আবির্ভাব হবে। জীবরা যারা স্পের ছেড়ে দেয় যখন তারা খুব তরুণ কিংবা খুব বৃদ্ধ, সাধারণত তাদের অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক উত্তরসূরি থাকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় যারা তাদের শক্তি ধীরে ধীরে তৈরী করে এবং অসংখ্য স্পোর তৈরী করে ছড়িয়ে দেয়, যখন তাদের জীবনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় আসে সেটি করার জন্য।
এই যুক্তিটি বৈশিষ্ট্যসূচক এবং নিয়মিতভাবে পুনরাবৃত্তি হওয়া জীবন চক্রে ক্রমশ সরে যাচ্ছে। শুধুমাত্র প্রতিটি প্রজন্ম শুরুই করে না এককোষী বটোলনেক দিয়ে- এরটি আরো একটি বৃদ্ধি পর্ব আছে– শৈশব– যা বরং নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী স্থায়ী। এই নির্দিষ্ট ব্যাপ্তিকাল, বৈশিষ্ট্যসূচক, বৃদ্ধিপর্বের জন্য, যা সম্ভব করে জণগত বিকাশের সময় কোনো নির্দিষ্ট কিছু সুনির্দিষ্ট সময়ে ঘটার জন্য, মনে হয় তারা। কঠোর ভাবে পরিচালিত হচ্ছে কোনো ক্যালেন্ডার অনুসারে। বিভিন্ন ধরণের প্রাণীদের মধ্যে নানা ধরনের পর্যায় অবধি, বিকাশ প্রক্রিয়ার সময় কোষ বিভাজন ঘটে কঠোরভাবে অনুসারিত ক্রম বিন্যাসে, যে ক্রমটির বারবার পুনরাবৃত্তি হয় জীবন চক্রের প্রতিটি পুনরাবৃত্তির সময়ে। প্রতিটি কোষের তাদের নিজেদের অবস্থান এবং কোষ বিভাজনের পঞ্জীতে তাদের আবির্ভাব সময়ও নির্দিষ্ট। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, ঘটনাক্রমে, এটি এতবেশী সুনির্দিষ্টভাবে নিখুঁত যে, ক্ৰণতাত্ত্বিকরা প্রতিটি কোষের নামকরণ করেছেন এবং বলা যেতে পারে কোনো একক জীবের কোনো একটি কোষের অন্য কোনো একটি জীবের ঠিক হুবহু কাউন্টারপার্ট বা অপরপক্ষ থাকে।
সুতরাং কোনো বৈশিষ্ট্যসূচক এই বৃদ্ধিপর্ব একটি ঘড়ির যোগান দেয়, অথবা একটি ক্যালেন্ডার, যার মাধ্যমে দ্রুণগত ঘটনাগুলোকে সূচনা করা যেতে পারে। চিন্তা করে দেখুন কত বেশী স্বাভাবিকভাবে আমরা পৃথিবীর দৈনন্দিন ঘুর্ণনের চক্রকে, এবং সুর্যের চারপাশে এর বাৎসরিক প্রদক্ষিণ ব্যবহার করি আমাদের জীবনকে সংগঠন আর শৃঙ্খলিত করতে। একই ভাবে, পুনরাবৃত্তি হওয়া বৃদ্ধিপর্বের অবিরাম ছন্দ যা সংকীর্ণ বটোলনেক জীবন চক্র আরোপ করে সেটি– মনে হতে পারে এটা অবশ্যম্ভাবী– ব্যবহার করা হবে ভ্রূণতত্ত্ববিদ্যার শৃঙ্খলা আর সংগঠন করার জন্য। কোনো নির্দিষ্ট জিনকে সক্রিয় করা যাবে আবার নিষ্ক্রিয় করা যাবে নির্দিষ্ট সময়ে কারণ বটোলনেক/বৃদ্ধি চক্র ক্যালেন্ডার নিশ্চিৎ করে এমন কোনো কিছু আছে যাকে আমরা বলতে পারি একটি নির্দিষ্ট সময়। এধরনের জিনের কর্মকাণ্ডের উপর সুসংগঠিত নিয়ন্ত্রণ জণতত্ত্বের বিবর্তনের পূর্বশর্ত যারা জটিল কোষ এবং অঙ্গ গঠন করতে সক্ষম। কোনো একটি ঈগলের চোখের জটিলতা ও সূক্ষ্ম সংগঠন অথবা সোয়ালো পাখির ডানার কখনোই উদ্ভব হতো না এই ঘড়ির কাটার ধরে চলা সময়ের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া যা নির্দেশ দেয় কোনটি কখন সৃষ্টি করা হবে।
বটোলনেক জীবন ইতিহাসের তৃতীয় পরিণতিটি হলো, জিনগত। এখানে, বটোল-ব্যাক এবং স্প্লার্জ-উইডের উদাহরণটি এখানে আবার আমাদের উপকারে আসবে। ধরে নেই, আবারো সহজবোধ্যতার কারণে, দুটি প্রজাতি প্রজনন করে অযৌন উপায়ে, চিন্তা করুন কিভাবে তারা বিবর্তিত হতে পারে। বিবর্তনের প্রয়োজন জিনগত পরিবর্তন, মিউটেশন। মিউটেশন হতে পারে যে কোনো কোষ বিভাজনের সময়। স্প্লার্জ-উইড এর ক্ষেত্রে কোষের বংশধারা প্রশস্ত প্রান্তের, যা বটোলনেকের সংকীর্ণতার বিপরীত। প্রতিটি শাখা যা কিনা ভেঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয় এবং ভেসে চলে যায় তারা বহুকোষী। সুতরাং খুবই সম্ভাবনা আছে যে-কোন কন্যার দুটি কোষ তারা প্রত্যেকটা যতটা তাদের মূল পিতামাতা উদ্ভিদ থেকে যতটা দূরবর্তী তারচেয়ে তারা একে অপরের দুরবর্তী ( আত্মীয় বলতে, আমি আক্ষরিকার্থে কাজিন, নাতি নাতনি ইত্যাদি বোঝাচ্ছি। কোষদের একটি নির্দিষ্ট বংশ ধারা আছে, এই বংশধারাও শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট, সুতরাং সেকেন্ড কাজিন এর শব্দগুলো শরীরের কোষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে কোনো ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া)। বটোল-র্যাক স্প্লার্জ–উইড থেকে খুব সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন। কোনো একটি কন্যা উদ্ভিদের সব কোষই একটি একক স্পোর কোষ থেকে উদ্ভূত, সুতরাং কোনো একটি উদ্ভিদের সব কোষই একে অপরের নিকটাত্মীয় (বা যে নামেই ডাকুন না কেন), অন্য কোনো উদ্ভিদের যে কোনো কোষের তুলনায়।
দুটি প্রজাতির মধ্যে পার্থক্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনগত পরিণতি আছে। নতুন মিউটেশন হয়েছে এমন একটি জিনের কথা ভাবুন, প্রথমে স্প্লার্জ-উইড, তারপর বটল-র্যাকে। স্প্লার্জ-উইড এ, নতুন মিউটেশন যে কোনো কোষেই উদ্ভব হতে পারে, উদ্ভিদের যে কোন শাখায়। কন্যা উদ্ভিদ যেহেতু সৃষ্টি হয়েছে প্রশস্ত মুকুল সৃষ্টি হবার মাধ্যমে, মিউটেশন হওয়া কোষের সরলরৈখিক উত্তরসুরীরা তাদের খুঁজে পায় মিউটেশন হয়নি এমন কোষের সাথে একটি কন্যা ও কন্যার কন্যা কোষে, যারা তাদের নিজেদের অপেক্ষাকৃতভাবে দুরের আত্মীয়। বটোল-র্যাকের ক্ষেত্রে,অন্যদিকে, উদ্ভিদটির সব কোষের সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম সাধারণ পূর্বসুরী স্পোরের চেয়ে পুরোনো নয়, যা সেই উদ্ভিদটির ‘বটোলনেক’ সূচনা দিয়েছিল। যদি সেই স্পোরটি মিউটেশন হওয়া কোনো জিন ধারণ করে, নতুন উদ্ভিদের সব কোষই সেই মিউটেশন হওয়া জিনটি বহন করবে। যদি স্পোর কোনো মিউটেশন বহন না করে, তারাও তা বহন করবে না। বটোল র্যাক এর কোষগুলো কোনো একটি উদ্ভিদের মধ্যে জিনগতভাবে বেশী সুষম হবে স্প্লার্জ–উইডের কোষগুলোর তুলনায় (যদি কিছু অকস্মাৎ রিভার্স-মিউটেশন মেনে নেই)। বটোল-র্যাকে, একক উদ্ভিদ কাজ করে একটি একক হিসাবে যার একটি জিনগত পরিচয় আছে, এবং তারা একক উদ্ভিদ সদস্য হিসাবে এই নামটি পাওয়ার দাবী রাখে। স্প্লার্জ-উইড উদ্ভিদে অপেক্ষাকৃত কম জিনগত পরিচয় থাকবে, তাদের তত কম যোগ্যতা থাকে একক হিসাবে চিহ্নিত হবার জন্য, যদি আমরা বটোল-র্যাক এর সদস্যদের সাথে তুলনা করি।
এটি শুধুমাত্র পরিভাষার ব্যপার না। মিউটেশন যখন থাকবে, কোনো একটি স্প্লার্জ–উইড উদ্ভিদের মধ্যে সব কোষগুলোর মনে একই জিনগত স্বার্থ থাকে না। কোনো একটি স্প্লার্জ–উইড এর একটি জিন তাদের নিজেদের কোষে প্রজননকে পক্ষপাতিত্ব করলে সে লাভবান হয়। আবশ্যিকভাবে এটি ‘একক’ উদ্ভিদের প্রজননকে সমর্থন করে বিশেষভাবে লাভবান হবার কোনো আশা করেনা। কোনো একটি উদ্ভিদের মধ্যে কোষগুলো জিনগতভাবে হুবহু হবার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয় মিউটেশনের উপস্থিতি, সুতরাং পুরোপুরিভাবে তারা পারস্পরিক সহযোগিতা করেনা নতুন অঙ্গ এবং নতুন উদ্ভিদ সৃষ্টিতে। প্রাকৃতিক নির্বাচন কোষদের মধ্যে বাছাই করে, উদ্ভিদের মধ্যে না। বোটল-র্যাকের ক্ষেত্রে অন্যদিকে, উদ্ভিদের মধ্যে বিদ্যমান সকল কোষগুলোর সম্ভাবনা থাকে একই জিন বহন করার, কারণ শুধুমাত্র সাম্প্রতিক মিউটেশনই তাদের বিভাজিত করতে পারে। সুতরাং দক্ষ সারভাইভাল মেশিন নির্মাণে তারা আনন্দের সাথে সহযোগিতা করে। ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিদের শরীরে কোষগুলোর ভিন্ন ভিন্ন জিন বহন করার সম্ভাবনা থাকে। সর্বোপরি কোষগুলো যারা ভিন্ন ‘বটোল-নেক’ অতিক্রম করেছে তারা বিশেষভাবে চিহ্নিত সাম্প্রতিক মিউটেশনের কারণে এবং এর অর্থ হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সেকারণে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বী উদ্ভিদদের মধ্যে বিচার করে, একটি স্প্লার্জ–উইডের মধ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী কোষদের নয়। সুতরাং আমরা প্রত্যাশা করতে পারি যে সেই সব অঙ্গ এবং প্রত্যঙ্গগুলো বিবর্তন দেখার জন্য যা পুরো উদ্ভিদটির সেবা করবে।
প্রসঙ্গক্রমে, পেশাগতভাবে যারা উৎসাহী শুধুমাত্র তাদের জন্য, এখানে গ্রুপ সিলেকশন বিতর্কে যুক্তি প্রস্তাবনার সমরুপ একটি উদাহরণ আছে। এই যুক্তির সাথে আমরা একটি একক জীবের কথা ভাবতে পারি কোষদের একটি গ্রুপ বা গোষ্ঠী হিসাবে। গ্রুপ সিলেকশনের একটি রুপ এখানে আমরা কাজে লাগাতে পারবো ব্যাখ্যায়, শর্ত শুধু কোনো না কোনো একটি উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে অন্তঃগ্রুপ প্রকরণের সাথে আন্তঃগ্রুপ প্রকরণে অনুপাত বৃদ্ধি করা। বটোল-ব্ল্যাকদের প্রজনন অভ্যাসের অনুপাত বৃদ্ধি করার ঠিক সেই অভ্যাসটি আছে। স্প্লার্জ–উইডের প্রজনন অভ্যাসের প্রভাব ঠিক এর বিপরীত। বটোলনেকিং এবং অন্য দুটি ধারণা মধ্যে মিলও আছে, যা বেশ কিছু বিষয় হয়তো উন্মোচন করে কিন্তু সেই বিষয়গুলো নিয়ে আমি এখানে আলোচনা করবো না, যে ধারণাগুলো এই অধ্যায়ে আলোচনায় প্রাধান্য বিস্তার করেছে। প্রথমত, সেই ধারণাটি যে পরজীবিরা তাদের পোষকদের সাথে সহযোগিতা করে সেই পর্যায় অবধি যে তাদের জিনগুলো পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয় একই জনন কোষের মাধ্যমে, যেমন করে পোষকদের জিনগুলো হস্তান্তরিত হয় একই বটোল-নেকের সংকীর্ণ পথে এবং দ্বিতীয়ত, সেই ধারণাটি, যৌন প্রজননের মাধ্যমে প্রজনন করা শরীরে কোষগুলো সহযোগিতা করে একে অপরের সাথে শুধুমাত্র যার কারণ মাইওসিস খুবই সতর্ক পক্ষপাতিত্বহীন একটি প্রক্রিয়া।
পুরো বিষয়টির সারাংশ যদি করি, দেখবো আমাদের কাছে যে তিনটি কারণ আছে কেন একটি বটোলনেক জীবনচক্র কোনো একটি জীবের বিবর্তনকে লালন করে একটি পৃথক এবং একক বাহক হিসাবে। এই তিনটি কারণকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি, যথাক্রমে, ‘আবারো সেই ড্রইং বোর্ডে ফিরে যাওয়া’, ‘নিয়মিতভাবে ঘটা সময়চক্র এবং কোষের সমরুপতা। কোনটি আগে আসে, জীবন চক্রের ‘বটোলনেকিং’ নাকি ‘স্বতন্ত্র জীব? আমি ভাবতে পছন্দ করি যে তারা একই সাথে বিবর্তিত হয়। সত্যিই আমি সন্দেহ করেছি, কোনো একটি একক জীবের অত্যাবশ্যক ও নির্ধারণী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একটি একক, যার শুরু এবং শেষ হয় এককোষী বটোলনেকের মাধ্যমে। যদি জীবনচক্র বটোলনেকে রূপান্তরিত হয়, জীবন্ত উপাদানগুলো স্বতন্ত্র, একক জীবের মধ্যে বাক্সবন্দী হতে বাধ্য হবে, এবং যত বেশী জীবনের উপাদান সেই স্বতন্ত্র জীবের মধ্যে আবদ্ধ হয়, তত বেশী সেই সারভাইভাল মেশিনের কোষগুলো তাদের প্রচেষ্টার মনোযোগ ঘনীভূত করতে পারে বিশেষ শ্রেণীর কোষের উপর যারা তাদের ভাগ করা জিন বহন করার জন্য নিয়তি নির্ধারিত হয়ে আছে, যাদের মধ্য দিয়ে বটোলনেকিং এর মাধ্যমে তারা পরবর্তী প্রজন্মে প্রবেশ করে। এই দুটি প্রপঞ্চ, বটোল-নেক জীবনচক্র এবং স্বতন্ত্র জীব, একই সাথেই থাকে। প্রতিটি যখন বিবর্তিত হয়, একে অপরকে এরা শক্তিশালী করে। তারা পরস্পরকে আরো শক্তিশালী করে, অনেকটাই কোনো প্রেম কাহিনীর অগ্রসর হবার সাথে সাথে মানব মানবীর মধ্যে যেমন করে ক্রমশ বাড়তে থাকে অনুভূতির তীব্রতা।
‘দি এক্সটেন্ডেড ফিনোটাইপ’ আসলেই একটি দীর্ঘ বই, এবং সেখানে বর্ণিত সব যুক্তিগুলো সহজে একটি অধ্যায়ে বর্ণনা করা সম্ভব না। আমি বাধ্য হয়েছি এখানে একটি সংক্ষিপ্ত, কিছুটা বরং অন্তজ্ঞান লব্ধ, এমনকি বলা যাবে ইম্প্রেশনিষ্ট বা প্রতিচ্ছায়াবাদী একটি শৈলীকে বর্ণনার জন্য বেছে নিতে। তাসত্ত্বেও আমি আশা করি, আমি মূল যুক্তিগুলোর সার বিষয়বস্তুটি এখানে ব্যাখ্যা করতে সফল হয়েছি।
একটি সংক্ষিপ্ত ম্যানিফেস্টো দিয়ে আমাকে আলোচনা সমাপ্ত করতে সুযোগ দেয়া হোক, জীবনের স্বার্থপর জিন/সম্প্রসারিত ফিনোটাইপ সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিও একটি সংক্ষিপ্তরুপ। এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি, আমি মনে করি, যা এই মহাবিশ্বের যে কোনো জীবের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। মৌলিক একক, জীবনের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে ‘রেপ্লিকেটর’ বা স্ব-অনুলিপনকারী। কোনো রেপ্লিকেটর হচ্ছে এই মহাবিশ্বে এমন কোনো কিছু যার অনুলিপি তৈরী হয়। একেবারে শুরুতে, অনুলিপনকারীদের আবির্ভাব হয়েছিল, আপতন বা চান্সের মাধ্যমে, অনেক ক্ষুদ্রকার নানা পদার্থের এলোমেলো সংমিশ্রণের ফলাফল হিসাবে। একবার যখন অনুলিপনকারীদের অস্তিত্ব নিশ্চিৎ হয়েছিল, এটি অনির্দিষ্ট পরিমান বিশাল সংখ্যক নিজেদের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু অনুলিপি করার কোনো প্রক্রিয়াই একেবারে ত্রুটিহীন নয়, তবে, এই অনুলিপনকারীদের জনগোষ্ঠীতে এমন কিছু প্রকরণ থাকে যারা একে অপর থেকে আলাদা। এইসব নানা প্রকারের অনুলিপনকারীদের কিছু নিজেদের প্রতিলিপি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং তাদের সেই প্রকারটিও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না যখন তারা নিজেরাই পারেনা টিকে থাকতে। অন্যরা যারা তখনও প্রতিলিপি করতে স্বক্ষম কিন্তু কিছুটা কম দক্ষতার সাথে। তারপরও অন্য প্রকারগুলোও ঘটতে দেখা যায় যারা ঘটনাচক্রে নতুন কোনো কৌশল আবিষ্কার করে, তাদের দেখা যায় পূর্বসূরী এবং সমসাময়িক অনুলিপনকারীদের তুলনায় অনেক বেশী দক্ষ অনুলিপনকারী। এবং দেখা যায় তাদের উত্তরসূরিরাই ক্রমেই জনগোষ্ঠীতে প্রাধান্য বিস্তার করে। কালে অতিক্রমণে, এই পৃথিবী পূর্ণ হয় সবচেয়ে শক্তিশালী আর উদ্ভাবনপটু অনুলিপনকারীদের দ্বারা।
ধীরে ধীরে, ক্রমশ আরো বেশী উত্তম অনুলিপনকারী হবার উপায় আবিষ্কৃত হয়। অনুলিপনকারীরা টিকে থাকে, শুধুমাত্র তাদের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যাবলীর জন্যই নয়, বরং এই পৃথিবীর উপর তাদের আরোপিত পরিণতির প্রভাবের কারণে। এই সব পরিণতিগুলো হতে পারে খুবই পরোক্ষ। যা প্রয়োজন শুধু সেটি হলো, শেষ অবধি পরিণতিগুলো, যতই তা পরোক্ষ কিংবা বাঁকা বা দুরবর্তী হোক না কেন, সেটি তার ফলাফলটি মূল প্রক্রিয়াকে জানান দেয়, সেই অনুলিপনকারীর নিজের প্রতিলিপি হবার সফলতার উপর প্রভাব ফেলে।
এই পৃথিবীতে একটি অনুলিপনকারীর সফলতা নির্ভর করে কোন। ধরনের পৃথিবী এটি– এর পূর্ববর্তী শর্তাবলীর উপর। এই সব শর্তাবলীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তাবলী হবে, অন্যান্য অনুলিপনকারীরা এবং তাদের সৃষ্ট পরিণতিগুলো। ইংরেজ এবং জার্মান নৌকাচালকদের মত, অনুলিপনকারীরা যারা পারস্পরিকভাবে একে অপরের জন্য উপকারী তারা একে অপরের উপস্থিতিতে প্রাধান্য বিস্তার করবে। কোনো এক সময় আমাদের পৃথিবীতে জীবনের বিবর্তনে এইসব পারস্পরিক সহযোহিগতাকারী সম্পুরক রেপ্লিকেটররা দল বেধে পৃথক পৃথক বাহন সৃষ্টির ব্যাপারটি সুসংগঠিত করে– যে বাহনটি হচ্ছে কোষ এবং পরবর্তীতে বহুকোষী শরীর। বাহনগুলো, যারা একটি ‘বটোলনেক’ জীবনচক্র বিবর্তিত করেছিল, তারা সফলভাবে টিকে থাকে এবং আরো বেশী স্বতন্ত্র আর বাহক সরুপ হয়।
স্বতন্ত্র বাহকের মধ্যে জীবিত উপাদানগুলোর ‘প্যাকেজিং’ বা ‘মোড়কজাত করন’ আরো বশী সুস্পষ্ট এবং প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে যে যখন জীববিজ্ঞানীরা সেই দৃশ্যে এসে উপস্থিত হন এবং জীবন সংক্রান্ত তাদের প্রশ্নগুলো করতে শুরু করেন, তাদের প্রশ্নগুলো মূলত হয় সেই বাহনকে ঘিরে– একক জীব সদস্য। জীববিজ্ঞানীদের সচেতনতায় প্রথমেই আসে একক জীব সদস্য, অন্যদিকে অনুলিপনকারীরা– এখন যাদের আমরা ‘জিন’ নামে চিনি– তাদের দেখা হয় একক জীবসদস্যদের ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ হিসাবে। জীববিজ্ঞানে সঠিক উপায়ে আবার তাকানোর জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত মানসিক প্রচেষ্টা এবং আমাদের নিজেদের স্মরণ করিয়ে দেয়া যে রেপ্লিকেটররা প্রথমেই আসে, তাদের গুরুত্বে এবং একই সাথে ইতিহাসেও।
আমাদের নিজেদের মনে করিয়ে দেবার একটি উপায় হচ্ছে, ভাবা যে, এমনকি আজও, কোনো একটি জিনের সব ফিনোটাইপিক প্রভাব তারা যে শরীরে বাস করে সেই পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অবশ্যই নীতিগত ভাবে এবং অবশ্যই বাস্তব সত্যে, জিন একক শরীরের সীমানার বাইরে তাদের প্রভাব বিস্তাব করে এবং বাইরের জগতে নানা কিছুর উপরও এর প্রভাব খাটায়, যাদের কিছু ‘জীবন্ত’ নয়, এবং কিছু অন্যান্য ‘জীব’, যাদের কারো কারো অবস্থান আবার বহু দুরে। শুধুমাত্র সামান্য কল্পনা শক্তির প্রভাবে একটি চতুর্দিকে জালের বিস্তৃত সম্প্রসারিত ফিনোটাইপিক শক্তির কেন্দ্রে আমরা জিনকে দেখতে পারি। এবং পৃথিবীর কোনো একটি অবজেক্ট বা বস্তু বসে আছে, বহু জীবের শরীরে বহন করা বহু জিনের সমকেন্দ্রাভিমুখী প্রভাবের একটি জালের কেন্দ্রে। জিনের দীর্ঘ হাত সুস্পষ্টভাবে কোনো সীমানা চেনে না। পুরো পৃথিবী জুড়েই ছড়িয়ে আছে কার্যকারণের তীর যা জিনদের তাদের ফিনোটাইপিক প্রভাবের সাথে যুক্ত করেছে, কাছে এবং দূরে।
এটি একটি বাড়তি বাস্তব সত্য, শুধুমাত্র আনুষঙ্গিক বা প্রাসঙ্গিক হিসাবে চিহ্নিত হবার চেয়ে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যথেষ্ট আবশ্যিক নয় তত্ত্বে অবশ্যম্ভাবী হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে যে এইসব কার্যকারণের তীরগুলো একই সাথে আঁটি বাধে, জমায়েত হয়। সাগরে আর অনুলিপনকারীরা মুক্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে না। তারা একসাথে জমায়েত হয়ে থাকে বিশাল কলোনি হিসাবে– স্বতন্ত্র একক জীব সদস্যদের শরীরে। এবং ফিনোটাইপিক পরিণতিগুলো, সারা পৃথিবীজুড়ে খুব সুষমভাবে বন্টন হবার বদলে,বহু ক্ষেত্রে এটি সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ হয় ঐসব একই শরীরে। কিন্তু একক শরীরগুলো, আমাদের এই গ্রহে যারা সুপরিচিত, তাদের অস্তিত্ব থাকার বাধ্যবাধকতা ছিলনা। শুধুমাত্র একটি সত্তা জীবনের উদ্ভবের জন্য যার অস্তিত্ব থাকতেই হবে, সেটি মহাবিশ্বের যে-কোনো জায়গায় হোক না কেন, সেটি হচ্ছে অমর অনুলিপনকারী।