১৩. অপারেশন ফান মাঞ্চ

অপারেশন ফান মাঞ্চ

ভোরের স্বপ্ন।

স্বপ্নটা আমি এই নিয়ে কমপক্ষে দশবার দেখলাম। ঘাটশিলায় ফুলডুংরি পাহাড়ের ওপাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যার অস্তিত্ব আমার স্বপ্ন বাস্তবে রয়েছে (অনেকটা আমাদের কলকাতার নদী তীরে গোয়ালিয়র মনুমেন্টের মতন), কিন্তু, বাস্তবে যা কোনওদিন দেখতে পাইনি। আজকের স্বপ্নে যোগ হয়েছিল একটা নতুন মাত্রা। স্বপ্নের দীপ্তি আজ আমাকে ঠেলে ঠেলে ডাকছিল : এই শুনছ। উনি আবার দেখা দিয়েছেন। অর্থাৎ, স্মৃতিস্তম্ভটি।

দুঃস্বপ্নের তুলনায় সুখস্বপ্নগুলি কত ক্ষণস্থায়ী!

শনিবার,৩০ মে স্বপ্নভঙ্গ হল নৃপেনের বাড়ির চারতলার সেই সিলি ঝুমঝুমিটার ত্রিকালজ্ঞ আওয়াজে : ঝিকি-ঝিনি, ঝিকি-ঝিনি, ঝিনিক-ঝিনি… চারতলার চিলেকোঠায় যে থাকে, তার ঘুম ভাঙাতে বা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, একতলা থেকে সিল্কের কর্ড টেনে পুলি-সংলগ্ন এই ঝুমঝুমিটা বাজানো হয়। আমি সহ্য করতে পারি না এর ঠাট্টার সুর। মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত গম্ভীর ঘটনাকে ব্যঙ্গ করার জন্যেই এমন চোখ-মারা ফিচেলভাবে এটা বাজে। এর ফানি . আওয়াজ আমি সহ্য করতে পারি না। কতবার আমি নৃপেনকে বলেছি, এটা হাটাও। এ শুধু। টুনটুনির সেই কেয়া মজা, কেয়া মজা/রাজা খাবে ব্যাঙ ভাজার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হতে পারে। নৃপেন কর্ণপাত করেনি। তার মতে এটা একটা মিড-ভিক্টোরিয়ান পিরিয়ড পিস, এমনকি এর দড়িটিও নাকি ওরিজিনাল। (হ্যাঁ, আর তুমি ছিলে রানীর সেই খাসবেয়ারা ভারতবর্ষীয় আবদুল, রাত দুপুরে বুড়ি মাগির দরজায় দাঁড়িয়ে দড়ি খেচতে আর কি! আমি তাকে উত্তরে বলেছি, মনে-মনে।)

 

দরজা খুলতেই নিচে থেকে চৈতির ব্যাকুল কণ্ঠস্বর কানে এল, বাবা! বাবা! শিগগির নিচে এস। খুনিরা ধরা পড়েছে।

কদিন ধরে আবহাওয়া সংবাদে ৯০ কিলোমিটার বেগে আসন্ন সাইক্লোনের কথা বলা হচ্ছিল। ছাদে বেরিয়ে দেখি, সারা আকাশ জুড়ে শোল মাছের গায়ের মত পাঁশুটে মেঘ। বৃষ্টি এখনও দুর্বল, কিন্তু হাওয়া জোরালো। দক্ষিণ-সমুদ্র থেকে উড়ে আসছে মেঘের পরে মেঘ। তারা, জলভারে, হুস হুস করে খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।

একদিন নৃপেন সমস্ত কাগজ নিচ্ছিল। কেউ পারেনি, শুধু আজকাল-ইখটি এক্সকুসিভ করেছে। তবে, খবরটি ছোট।

খুনি চারজন। চারজনই নাবালক। জানা গেছে, তারা সকলেই শিক্ষিত, সচ্ছল পরিবারের ছেলে। তারা সবাই এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে। স্কুলে কৃতী ছাত্র হিসেবে তাদের নাম আছে। তাদের ধরা হয়েছে বদ্রীনাথের পথে। বাড়ি থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর, কেদারবদ্রী যাবার পাথেয় সংগ্রহের জন্য এরা খুন করে বলে জানা গেছে। বদ্রীনাথ থেকে ২৩ কিলোমিটার আগে, গোবিন্দঘাটে নেমে পড়ে, এরা গিয়েছিল সেখান থেকে ১৭ কিলোমিটার দূর ও ১৫০০০ ফুট উঁচু হেমকুণ্ড সাহেব গুরুদোয়ারায়। তুষার হ্রদ হেমকুণ্ড থেকে দুর্লভ ব্ৰহ্মকমল তুলে আনাই ছিল এদের সঙ্কল্প। যাত্রী সেজে পুলিস গোবিন্দঘাটে অপেক্ষা করছিল। আজ কালকা মেলে এদের কলকাতায় আনা হচ্ছে।

রিপোর্টে খুনিদের নাম, ছবি এ-সব কিছুই নেই। পুলিস দেয়নি। এক্সক্লসিভ বলে, এইটুকু খবর বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে আজকাল। চার কলমের অ্যাঙ্কার স্টোরি করেছে। হেডিং: দীপ্তি বসুরায়ের খুনিরা ধরা পড়ল মহাপ্রস্থানের পথে।

এতদিন অনেকেই খোঁজখবর নেয়নি। সকাল থেকে ফোনের পর ফোন। অফিস ইউনিয়নের সেক্রেটারি হিল্লোল রায় বললেন, আপনি আজই জয়েন করতে পারেন। হিরোজ ওয়েলকাম অ্যাওয়েটস ইউ।

সব শেষে সত্যবান মণ্ডলের ফোন এল। তখন বেলা ১০টা। বললেন, সকাল থেকে চেষ্টা করছি। লালবাজারে চলে আসুন। কালপ্রিটরা এসে গেছে।

ফোনে সত্যবানের সঙ্গে প্রথমে আমার, তারপর নৃপেনের অনেকক্ষণ কথা হল। আমি আগাগোড়া হুঁ-হাঁ করে গেলাম। কারণ, আমার সঙ্গে সত্যবান শুধু আইভির কথা বলছিলেন। সেদিনের পর আইভির সঙ্গে আর দেখা হয়নি। দেখলাম, আমার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে জল গড়িয়েছিল বহুদুর।

সেদিন ওয়ান-টান থেকে বেরনো মাত্র আইভি সোমকে ধরা হয়। পুলিস আগাগোড়া শ্যাডো করেছিল। অ্যান্ড, শি কনফেসড এভরিথিং। আপনার ছবি এবং মিস সোমকে নিয়ে আমি হোটেল রিলাক্স-এ যাই।সো, ফ্রম দা ভেরি থার্ড ডে অফ দা ইনসিডেন্ট অফ মার্ডার, ইউ হ্যাভ বিন এনজয়িং অ্যান ইমপ্রেগনেবল অ্যালিবাই, ইউ সি! আপনি খুন করেননি, এটা আমি অবশ্য তার আগে থেকেই জানতাম।

যখন নৃপেন কথা বলছিল, এই প্রথম আইভির সঙ্গে আমার বিয়োগান্ত নাটকের কয়েকটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আইভি, পর্দা তুলে, সে সবও দৃশ্য সত্যবানকে দেখিয়েছে নাকি! খুনের তদন্তে সেসব তো কোনও কাজেই লাগবে না। বরং যা বলেছিল সত্যবান, সাইক্রিয়াট্রিস্টদের উৎসাহ থাকতে পারে। সে মরা খাঁড়ি ধরে এগিয়ে গেলে যে কোনও অসুখী দম্পতির ম্যাল-অ্যাডজাস্টমেন্টের উৎসে পৌঁছনো যেতে পারে। সেই সব রোমহর্ষক প্রাপ্তবয়স্ক বিছানা-দৃশ্যের জন্য আমি আইভির কাছে কৃতজ্ঞ।

যখন হোটেল ছিল না, আইভি সেই গোড়ার দিকে দু-একবার আমাদের ফ্ল্যাটেও এসেছে। একবার হল কী, বাড়ি ফিরে, বিছানার পাশে দীপ্তি একটা ছোট্ট টিপ কুড়িয়ে পেল। এটা কোথা থেকে এল, এ তো আমাদের টিপ নয় জানতে চাইলে আমি খুব রাগ করে তাকে বলেছিলাম, তা আমি কী করে জানব। নন্দর-মা ঘর মোছে, তার হতে পারে।

পুরুষ মানুষের রাগ। দেখে ভড়কি খাবে না, এমন মেয়ে পৃথিবীতে কমই। কিন্তু, দীপ্তি তাদেরই একজন।

কিন্তু এ তো বেশ দামি টিপতর্জনীর ডগায় টিপ-পর্যবেক্ষণ করে তার ভ্রূ কুঁচকে আসে, শিপার। নন্দর-মা তো সিঁদুরের টিপ পরে।

আশ্চর্য তো। তোমার বীণাদি-মনোরমাদি কত লোক আসে, অন্য ফ্ল্যাটের মেয়েরা আসে, বাসনউলি আসে, চৈতির স্কুলের বন্ধুরা আসে টিপটা পা দিয়ে সরিয়ে মোজা পরতে পরতে আমি বলেছিলাম, খেতে দেবে না বাইরে খেয়ে নেব? আমাকে অফিস যেতে হবে। এটা মেয়েদের কলেজ নয় যে আজ দিদি এ ক্লাসটা নেবে না। এটা ব্যাঙ্ক।

তা, এরাও তো এক-একটা অ্যালিবাই। এই বীণাদি-মনোরমাদি এরা। মায়, নন্দর-মা কি বাসনউলি। এরা না থাকলে ওর অন্তত একটা বিশ্বাসকে দশ বছর ধরে খুন করে যাবার ইতিহাসটা সেদিনই ধরা পড়ে যেত।

ঘরে জানালার শার্সি সব বন্ধ। তোড়ে বৃষ্টি নেমেছে। সাইক্লোন শুরু হয়েছে। হাওয়ায় মোটর-গ্যারেজের টিনের চাল বাজছে ঝনঝন করে। গলি দিয়ে মাঝে মাঝে গাড়ি যাবার ছা শুনে বোঝা যায়, জল জমেছে। যাই বলি, অল সেড অ্যান্ড ডান, আমার এই একটা ব্যাপার—এই ফাইডেলিটির ব্যাপারটায়–সে খুবই আস্থা রাখত। ভেবে, আমার মনে মৃতা স্ত্রীর জন্য স্বামীর সহানুভূতি জাগে।

ফান মাঞ্চ? আঁ-আঁ, বলেন কি, আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে, গিয়ে সব শুনব, রেখে দিচ্ছি, বলে রিসিভার নামিয়ে রেখে নৃপেন আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ডেডবডির পাশে ফান মাঞ্চের একটা খালি প্যাকেট দেখেছিলে?

লাল চালচিত্র। তাতে গাঁথা কয়েকটি ওয়েফার্স। সে-যাবৎ অদেখা, অশাস্ত্রীয় প্রতিমার সেই গলাকাটা মুণ্ডু!সহসা আমি আবার সেই মুহূর্তে গিয়ে দাঁড়াই যখন হৃৎপিণ্ড জমে বরফ। যখন, টেকনিক্যালি, আমি মৃত। আমার মাথার মধ্যে ইলেকট্রন মেঘ। তার তড়িৎচৌম্বক-ক্ষেত্র থেকে ভরশূন্য সমুদ্রপাখির ডাক–কোয়ার্ক! কোয়ার্ক! কোয়ার্ক!

এই যে, আমার মাথার চুলের গোড়ায় ফের ঘাম জমছে।

 

ওগো তোমরা কে কে চা খাবে উঠে পড়। কারণ, এরপর সাড়ে আটটার আগে আর চা হবে না…

 

হ্যাঃ হ্যাঃ-হ্যাঃ-হ্যাঃ। আর ওই ফান মাঞ্চই কিনা তোমাকে বাঁচাল, আঁ! নৃপেন হাসতে হাসতে বলল, নাও, চটপট তৈরি হয়ে নাও। আমার সঙ্গে বেরুবে। আই শ্যাল ড্রপ ইউ ডাউন। কোর্ট অ্যাডজোন করে যত তাড়াতাড়ি পারি, আমি লালবাজারে আসছি।

 

গাড়িতে নৃপেন বলল, লোকটা জিনিয়াস। ওই ফান মাঞ্চের প্যাকেট দেখেই ও বুঝে গিয়েছিল, তুমি খুনি নও। কোনও প্রফেসনালের কাজও এ হতে পারে না। কারণ, কোনও স্বামী স্ত্রীকে খুন করে, বা ফর দ্যাট ম্যাটার কোনও প্রফেসনাল, ডেড বডির পাশে দাঁড়িয়ে ফান মাঞ্চ খেতে পারে না। এ নিশ্চয়ই কোনও জুভেনাইল ডেলিংকোয়েন্টের কাজ এবং তারা একজন নয়–ফার্স্ট স্পট এনকোয়ারিতে ও বুঝে গিয়েছিল।

লোকটির পুলিস মেডেল পাওয়া উচিত নৃপেন জানাল।

ল্যান্সডাউন মার্কেটের পর থেকে হাঁটুজল। গাড়ি ঘুরে রমেশ মিত্র দিয়ে চলল। পূর্ণ-য় উঠবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *