কান্ধা নেহি দেতা
নিজের হাতে কেবিনের পর্দা টেনে দিয়ে আইভি বলল, আমাকে ফোন না করলে হত না।
খুন হয়েছে শনিবার। সোমবার দুপুরে আইভিকে আমি বাম্বু-ভিলায় ওর অফিসে ফোন করে ওয়ান-টানে আসতে বলি। এবং এর বেশি কিছু ফোনে বলিনি। নিশ্চয় কাগজে সব পড়ছে।
যোধপুর পার্ক থেকে ট্যাক্সি নিয়ে লেক গার্ডেনস-এ ঢুকে ল্যান্সডাউন-মার্কেটে আমি ট্যাক্সি ছেড়ে দিই। ফোর-সেভেন এক্সচেঞ্জের বুথ থেকে ডায়াল করেছি। কেউ আমাকে ফলো করেনি। কেউ জানবে না।
খুনের কথা শুনতে শুনতে সেই একবার যা একপলক আমাকে দেখে নিয়েছিল আইভি, তারপর আর চোখের দিকে তাকায়নি। আস্তে আস্তেবলে উঠে দাঁড়িয়ে টেনে দিয়েছিল পর্দা, যেন সারা পৃথিবী আমার কথা শুনতে পাচ্ছে, যদিও আমি কথা বলছিলাম ফিসফিসিয়ে, শুধু ওর জন্যে।
আইভি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। নিজের কাপে চিনি মিশিয়ে নাড়তে লাগল। আমারটায় দিতে ভুলে গেল এই প্রথম।
মাথা নিচু করে সে বলল, তাহলেও…
আইভি থাকে দাদা-বৌদির সঙ্গে। বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে। দেখতে দেখতে ৪০ তো হলই। (বিয়ের পর তো আর দাদা দাদা থাকে না। হয়ে যায় স্বামী, জামাই, জামাইবাবু, ভায়রাভাই, এইসব। —আইভি।) এদিকে আমার কাছেও তার পাবার কিছু নেই।
আজ থেকে ১০ বছর আগে আলাপের প্রথম দিনেই আমি ওকে বলে দিয়েছিলাম, আমাদের বাড়িতে এক ৫ বছরের মেয়ে–তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে চৈতি আছে। ওই মেয়ের মা আমাদের বাড়িতে থাকে। এক কথায়, আমি বিবাহিত।
আরও স্পষ্ট করে বলা যেত, আমার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরির মতো, টিল সুপারঅ্যানুয়েশন, আমি এটাও ছাড়তে পারব না। আরও স্পষ্ট করে বলা যেত, আমি গাছেরও খাব এবং তলারও কুড়োব। তবে, এসব ক্ষেত্রে পুরোটা বলতে হয় না। বোঝা যায়। মোট কথা, আমার কাছে আইভির কোনও প্রত্যাশা নেই। এক, আমি দীপ্তিকে ভালবাসি না—এ ছাড়া। সে শুধু সেই কুটোটুকু সম্বল করে ভেসে আছে।
কিন্তু খুন হয়েছেদুপুরে। সারা দুপুর তুমি তো আমার সঙ্গে। সদর স্ট্রিটের হোটেল রিলাক্স এর রুম নম্বর থার্টিনে। আমি তো জানি, তুমি খুন করোনি। আইভি জানাতে চাইল, তোমাকে সন্দেহ করছে কী করে?
যা চাইছিলাম। এত তাড়াতাড়ি আইভি স্বীকার করবে আমি আশা করিনি।
আমি বললাম, আইভি, তুমি আমার সঙ্গে চলো। এই কথাটা তুমি পুলিসকে বল।
আইভি আঁতকে উঠল, কোন কথাটা?
আমরা সারা দুপুর ১৩ নম্বর ঘরে ছিলাম। হোটেল রিলাক্স-এ৫টায় চেক আউট করি।
ছিঃ। এ কী করে বলছ তুমি। ও যেন ভূত দেখে পিছিয়ে যাচ্ছে, এ আমি কী করে বলব। দাদা-বৌদির কাছে শেষ আশ্রয়টুকুও যাবে। তাছাড়া…
আইভি দ্রুত হাঁটে। যেখানেই সে উপস্থিত হোক না কেন, মনে হবে, সে বুঝি দৌড়ে এল। এতক্ষণ কেউ তাকে তাড়া করেছিল। পৌঁছে সে হাঁফায়। তার গোল চোখদুটি জ্বরো রুগীর মতো সব সময় বিস্ফারিত আর ছলছলে হয়ে থাকে। তার চোখের তারা আরও বড় হয়ে উঠল যখন সে বলল, তা-ছাড়া সবাই জানবে। কাগজে তো রোজ বেরুচ্ছে। সব বেরুবে। আমি চাকরি করব কী করে?
যা ভেবেছিলাম। প্রাণের চেয়েও বেশি ভয় ওর চাকরি যাবার। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকরি। পুলিস কেসে জড়ালেই সাসপেনশন। আর এ তো খুনের মামলা। অবশ্য, চাকরি ছাড়া ওর আছেই বা কী।
গত দশ বছরের একটানা নিরবচ্ছিন্ন চেনাশোনা। সুদীর্ঘ গোপন যোগাযোেগ। ভালবাসে বলেই তো। কেবিনের ভারি নিচ্ছিদ্র পর্দার এদিকে ওর কোমরের পেটি, ঊরুর রাং বা বাঁটের মাংসের বদলে অনেক দিনের মধ্যে এই প্রথম–৪০ বছরের বাড়ি মহিলার ১০ বছর আগেকার যুবতী হাত আমি কোলে টেনে নিই। দুই হাতে তার পাণিগ্রহণ করে আমি বলি, প্লিজ ডু নট। ডু নট লেট মি ডাউন। ব্যাপারটা চুকে গেলে আমি তোমাকে বিয়ে করব। এখন তো আর কোনও বাধা নেই।
আমার মুখ বিবর্ণ। কিন্তু, আইভি সেদিকে এখনও তাকাল না। আমার কাঁপা কাঁপা হাতের ভেতর থেকে সে ধীরে খুলে নিল তার দক্ষিণ বাহু।
তা-ছাড়া, আইভি পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে গেল, ব্যাপারটা আরও জটিল হবে। আমার অস্তিত্বের কোনও মূল্যই তোমার কাছে এতদিন ছিল না। কিন্তু, পুলিসের কাছে আজ এর মূল্য অনেক। পুলিস তোমার মতো কামু পড়েনি। ভাল না বেসেও একটা অ্যাবসার্ড সম্পর্ক থাকতে পারে নরনারীর মধ্যে–যা তুমি বল–এতে তারা বিশ্বাস করে না। আমার চেয়ে কনুই থেকে কাঁধ পর্যন্ত নিজের গায়ে হাত বুলিয়ে আইভি বলল, আমার চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য খুনের মোটিভ আর কী হতে পারে পুলিসের কাছে? নিজের স্বার্থেই আমার ব্যাপারটা তোমার সম্পূর্ণ গোপন রাখা উচিত।
কিন্তু আমার তো একটা অ্যালিবাই দরকার আইভি। আর পুলিস তো সেটাই চাইছে।
আর বেঁচে-থাকার জন্যে আমার বুঝি অ্যালিবাই দরকার নেই, আইভি ঝঝর করে কেঁদে ফেলল, তুমি যখন যা বলেছ, করেছি। সেখানে নিয়ে গেছ, গেছি। মেরি স্টোপস-এ গিয়ে একা একা প্রেগন্যান্সি টার্মিনেট করিয়ে এসেছি। প্রেগন্যান্সি টার্মিনেট! রুমাল বের করে বিশ্রীভাবে সে বেপরোয়া নাক ঝাড়তে থাকে, হাঃ। এর চেয়ে হিপোক্রিট কয়েনেজ তুমি আর-একটা দেখাতে পারবে? আমি তো, আমি তো, দু-হাত দেখিয়ে খুনই করেছি আমার চার মাসের ছেলেকে। তখন প্লাসেন্টা ফর্ম করে গেছে। তুমি সঙ্গে যাওনি! যে কাজ দুজনে মিলে করেছি, তার শাস্তি আমি একা মাথা পেতে নিয়েছি। তুমি আর কী চাও?
ওয়েটার লি ইয়ং পর্দা তুলেছে। আইভি তাকে আর একপট চা দিতে বলল। টেবিলে এক প্লেট চিলি প্রন সেই থেকে পড়ে আছে।
এই ওয়ান টান রেস্তোরাঁর প্রত্যেকটি ওয়েটার আমাদের চেনে। বিশেষত, এখন যে চা দিয়ে যাবে, সেই লি ইয়ং। এখানে আমরা গত দশ বছর ধরে আসছি। আমাদের বিলম্বিত চুম্বনের সময় লি ইয়ং যে কতবার পর্দা তুলে নিঃশব্দে নামিয়ে দিয়ে গেছে, আমরা তা জানি না। তবে একদিন, যেদিন সরি বলে ফেলেছিল, সেদিন আমি আইভির খোলা বুকের নীপ সাক করছিলাম, যেজন্যে, সেই সেদিন থেকে, সার্ভিসে থাকলে, সে আইভির কাছ থেকে ৫ টাকা টিপ্স পেয়ে আসছে। গোড়ার দিকে কত কাণ্ডই না হয়েছে ওয়ান টানের জোনাকির মতো ঝরঝবে এই ছোট ছোট সাদা ঘরে।
আমার চায়ে চিনি দিয়ে ও নাড়তে নাড়তে আইভি শান্ত করল নিজেকে। বলল, জানি, আমার ফেঁসে যাবার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানো তোমার পক্ষে এখন সম্ভব নয়। কিন্তু, তুমি ডুববে। অন্তত নিজের স্বার্থে তোমার আমার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ চেপে যাওয়া উচিত।দুজনেই চুপচাপ। বোধহয় আর কিছু বলার নেই আমাদের। আমি চুলের মধ্যে মাথা নিচু করে আঙুল চালাতে থাকি। পাখা ঘুরে চলেছে। চা ঠান্ডা হচ্ছে।
তুমি খুন করেনি। যেন ভূত-ভবিষ্যৎ সব দেখতে পাচ্ছে এমন অকম্পিত স্থিরনিশ্চিত গলায় আইভি বলল, অ্যালিবাই থাক না থাক, তুমি শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে যাবে। হোটেলের কথা বলে, মাঝখান থেকে আমাকে ধ্বংস করে দিও না, প্লিজ।
কিন্তু, আমি তো তোমাকে বিয়ে করব?
কুমারী-মাতা গলা টিপে ভ্রণ-হত্যা সম্পূর্ণ করে উঠে দাঁড়াল। এই প্রথম চোখে চোখ রাখল আমার। কখনও কখনও চোখ থেকে তারা সরে যায়। থাকে শুধু দুটি সাদা প্রস্তরখন্ড।
কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করব না। আইভি উঠল, চলি।
এই, পূর্বাপর সস্নেহে ভ্যানিটিতে হাত রেখে ঘুরে দাঁড়াল একবার, তোমার কিছু টাকা লাগবে?
কাউন্টারে আইভি বিল পে করছে।
সো আর্লি মিস সোম?ম্যাডাম হুয়া জানতে চাইছেন। উনি আইভিকে খুব ভাল চেনেন। ওঁর ইনকাম ট্যাক্স ফাইল আপডেটেড করার ব্যাপারে আইভির অবদান আছে।
আই অ্যাম ইন আ হারি। হ্যাভ টু গো টু অফিস।
আমি মনে মনে দেখতে পেলাম যথারীতি একগাল হেসে ও কথাগুলো বলল। ভুলে গেছে, ও এসেছে সাড়ে পাঁচটায়। এখন সাতটা বাজে।
আমি কেবিনে বসে রইলাম। বুঝলাম, আমার কেউ নেই। এ সময় কেউ পাশে দাঁড়ায় না।
কেউ কান্ধা দেয় না।