যদিও তৃতীয় স্বর্গে দিন নেই রাত নেই, সময় অবিভাজ্য ও মাত্ৰাস্পর্শহীন তবুও যতীনের সুবিধার জন্যে পুষ্প বুড়োশিবতলার ঘাটে পৃথিবীর মতই দিনরাত্রি সৃষ্টি করতো। ঘুমের আবশ্যক না। থাকলেও নিজের সৃষ্ট রাতে ঘুমোতো।
দিন কয়েক পরে।
পুষ্প ঘুম ভেঙ্গে উঠেচে। ওর শয়নকক্ষের বাইরের প্রকাণ্ড মুচুকুন্দ চাঁপার গাছটাতে পাখীরা কি কি করচে। ও দেখলে জানালা দিয়ে নতুন-ওঠা প্রভাত-সূর্যের আলোর রং কেমন অদ্ভুত ধরনের সবুজ ও গোলাপী। আরও বিস্মিত হোল দেখে যে সেই রঙীন আলোর মৃদু জ্যোতিটা বাষ্পকারে তার খাটটা ঘিরে রয়েছে যেন। যতীন বুঝতে পারতো না ব্যাপারটা। পুষ্প বুঝলে ওপরের স্বর্গ থেকে কোনো উচ্চতর আত্মা তাকে স্মরণ করেছেন।
যতীনকে কথাটা বলতেই সে বল্লে–চল আমিও যাই।
পুষ্প দুঃখিত সুরে বল্লে–পারবে না যতুদা, নইলে তোমায় ফেলে যেতে কি আমার সাধ? আমার মনে হচ্চে ইনি সেদিনকার সেই দেবী, করুণাদেবী যাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। তা যদি হয়, সে স্বর্গে যাওয়া তোমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। তুমি থাকো, আমি যাই, কাজ শেষ হলেই চলে আসবো।
গোলাপী আলোর সরল জ্যোতিরেখা অনুসরণ করে সে মহাশূন্যপথে উঠলো। পুষ্প চতুর্থস্তরের আত্মা, তার শক্তি গতিবেগ যতীনের চেয়ে অনেক বেশী। কিন্তু যতীন সঙ্গে থাকলে পুষ্প নিজেকে সংযত করে চলে ওর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে। নইলে লক্ষ লক্ষ মাইল চোখের নিমিষে অতিক্রম করবার শক্তি ধরে সে।
পুষ্প যে স্বর্গে পৌঁছুলো, পৃথিবীর ভাষায় তার হয়তো বাইরের রূপের অনেকখানিই বর্ণনা করা যায়, কেবল করা যায় না তার অন্তঃপ্রবিষ্ট সুগভীর শান্তি ও বহুগুণে বদ্ধিত সুখদুঃখের অনুভূতির স্পন্দমান। তীব্রতার। সে কি ভয়ানক জীবনছন্দ! সেখানকার মাটিতে পা দিলেই মনের সুখ, দুঃখ, শোক, স্নেহ, প্রেম কল্পনা সব শতগুণ বেড়ে যায়। অনুভূতির তীব্রতা যারা সহ্য না করতে পারে, তারা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে সেই মুহূর্তেই। বলহীন মন স্বর্গলাভ করতে পারে না।
পুষ্প শক্তিময়ী, পুষ্প চতুর্থ স্তরের উচ্চ থাকের আত্মা–তাকেও রীতিমত চেষ্টা করতে হোল প্রাণপণে সংজ্ঞা বজায় রাখবার জন্যে।
চারিপাশের অদৃশ্য ইথারের তরঙ্গ যেন তার দেহের কোন্ অজানা ইন্দ্রিয়কে স্পর্শ করে তাকে সক্রিয় করে তুলেচে। সে অজ্ঞাত ইন্দ্রিয়ের কাজ যে-অনুভূতিরাজিকে মনের মুকুরে প্রতিভাত করা–পৃথিবীতে, এমন কি নিম্নতর স্বর্গগুলিতেও, সে সব অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় ঘটে না।
অথচ প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই তারা থাকতে পারে এবং আছেও, কেবল আস্বাদ করবার ইন্দ্রিয় ঘুমিয়ে আছে। উচ্চ জগতের তীব্রতর স্পন্দন-তরঙ্গ তাকে জাগিয়ে তুলতে পারে–কিন্তু যেমন গঙ্গা যখন মর্তে অবতরণ করেন, তখন কেউ তার তাল সামলাতে পারেনি, ঐরাবত পৰ্য্যন্ত ভেসে গিয়েছিল–উচ্চ স্বর্গের দেবতা মহাদেব নেমে এসে জটাজাল বিস্তার করে না দাঁড়ালে কারো সাধ্য ছিল না সে বেগবতী স্রোতোধারার মুখে দাঁড়ায়–ঐ সব অনুভূতির বেগ তেমনি সহ্য করতে পারে একমাত্র উচ্চস্তরের দেবতারাই। চারিদিকে ফুল ফুটে আছে সে সব ফুলের রঙই বা কত রকম, কিন্তু আলোর মত কি একটা অজানা পদার্থে সে সব গাছ, সে সব ফুল তৈরী–একটা ছিঁড়ে নিলে তার জায়গায় তখনি আর একটা ঐ রকম ফুল গজাবে। বড় বড় জলাশয় আছে, তার নীলাভ নিস্তরঙ্গ বক্ষের উপর দিয়ে লোকেরা হেঁটে যাতায়াত করচে, যেমন মাটির ওপর দিয়ে পৃথিবীর লোক যায়। অথচ সেখানে নৌকাও আছে–যাদের ইচ্ছে, নৌকা করেও বেড়াতে পারে।
এক জায়গায় স্ফটিক প্রস্তরের মত স্বচ্ছ কোনো পদার্থে তৈরী একটা বাড়ীর সামনে গিয়ে ঐ রঙীন জ্যোতিরেখা বাড়ীর মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। পুষ্প সেখানে ঢুকে দেখলে প্রণয়দেবী একটা বড় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কি যেন দেখছেন।
পুষ্প ঘরে ঢুকতেই ওর দিক চেয়ে বল্লেন–তোমায় ডেকেচি বড় বিপদে পড়ে। আমায় একটু সাহায্য করো।
পুষ্প বল্লে–বলুন কি করতে হবে।
দেবী বল্লেন–বোসো। পৃথিবীতে গিয়ে কাজ করতে পারে, এমন লোকই চাইছিলাম। তুমি ভিন্ন আর কারো কথা মনে উঠলো না। যতীন কোথায়, তাকে আনলে না কেন?
পুষ্প সলজ্জসুরে বল্লে–যতুদা এখানে আসতে পারবে না। আসতে চেয়েছিল, আমি আনিনি।
দেবী প্রসন্ন সহাস্য মুখে বল্লেন–আচ্ছা, এবার থেকে আমি তাকে নিয়ে আসবো।
–আপনি পারেন, আমার শক্তি কতটুকু, আমার কাজ নয়। একবার পঞ্চম স্বর্গে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলাম, চতুর্থ স্তরেই অজ্ঞান হয়ে পড়লো। আর আমি চেষ্টা করিনি।
পুষ্প একটা জিনিস লক্ষ্য করলে।
প্রথমদিন সে প্রণয়দেবীকে যে মূর্তিতে দেখেছিল এ ঠিক সে মূর্তি নয়। প্রণয়দেবীকে আরও তরুণী দেখাচ্ছে, মুখশ্রী আরও সুন্দর। শরীর স্বচ্ছ, সুন্দর, নীলাভ শুভ্র।
–দেবী বল্লেন–কি ভাবচ?
-আপনি জানেন কি ভাবচি।
–আমার চেহারা এখন যে রকম দেখচো, তখন অন্যরকম দেখেছিলে–এই তো?
পুষ্প কথাটা জানতো। সে শুনেছিল বহু উচ্চ স্বর্গে অধিবাসীদের কোন নির্দিষ্ট রূপ নেই। অধিকাংশ সময়েই তাঁরা একটা ডিম্বাকৃতি সোনালী আলোর মত–যখন কারো সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন হয় না। বা মূৰ্ত্তি গ্রহণ করবার বিশেষ কোনো আবশ্যক থাকে না–তখন তাঁরা শুধু একটা চৈতন্য-বিন্দুতে পর্যবসিত হয়ে এই ডিম্বাকৃতি আলোর মূর্তিতে অবস্থান করেন। কিন্তু প্রয়োজন উপস্থিত হোলে তাঁরা যে। কোন মূৰ্ত্তি ইচ্ছামত ধারণ করতে পারেন–অতি সুন্দর তরুণের রূপ বা মহিমময় গম্ভীর বয়স্ক লোকের রূপ বা পৃথিবী-প্রচলিত নানা শাস্ত্র ও ধর্ম গ্রন্থাদিতে বর্ণিত দেব, দেবী, দেবদূত প্রভৃতির রূপ–যাতে মানুষেরা স্বজাতীয় ও স্বদেশীয় ট্রাডিশন অনুযায়ী মূৰ্ত্তিতে তাঁদের ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারে, প্রাণে বল ও উৎসাহ পেতে পারে– ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবুও ভাল করে দেবীর মুখে শোনবার জন্যে তার কৌতূহল হোল। প্রণয়দেবী বল্লেন–দেখ, পৃথিবীতেও এই একই ব্যাপার হয়। আত্মার অবস্থার সঙ্গে বাইরের আকৃতি বদলায়। সাধুর একরকম চেহারা, নিম্নস্তরের লোকের আর একরকম। কিন্তু পৃথিবীর স্থল পদার্থের ওপর আত্মার প্রভাব তত কার্যকর হয় না। এখানে তা নয়। এমন কি এবেলা। ওবেলা রূপের পরিবর্তন হয় এখানে। খুব প্রেম বা সহানুভূতির সময়। এখানে মুখশ্রী দেখতে দেখতে অপূর্ব সুন্দর হয়ে ওঠে, ঠিক পৃথিবীর খুব ভাবপ্রবণ, কল্পনাময়ী, অপরূপ রূপসী কিশোরীর মত। আবার অন্য অবস্থায় অন্য রূপ ফুটে ওঠে মুখে। ইচ্ছামত যেমন পৃথিবীতে পোশাক বদলায়, এখানে তেমনি মূর্তি বদলানো যায়–
পুষ্প সকৌতুকে ভাবলে–অর্থাৎ কিনা আটপৌরে গেরস্থালী মূৰ্ত্তি, পোশাকী মূৰ্ত্তি, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করার মূর্তি, প্রিয়ের সঙ্গে মিলনের মূর্তি, ভক্তের কাছে পূজো নেওয়ার মূৰ্ত্তি–এরা আছে বেশ মজায়।
প্রণয়দেবী পৃথিবীর এই প্রগল্ভা বালিকার চিন্তা বুঝতে পেরে স্নেহের হাসি হাসলেন। বল্লেন–আমি পৃথিবীতে এখন যেতে পারচিনে। তুমি যাও, যতীনকে সঙ্গে নিয়ে যাও। এখানে সরে এসো, যে ব্যাপারের জন্যে পাঠাচ্চি এখানে এসে দেখ দাঁড়িয়ে।
ওদিকের যে প্রকাণ্ড বড় ফরাসী বে-উইন্ডোর মত জানালার ধারে তিনি পুষ্প আসবার আগে দাঁড়িয়ে কি দেখছিলেন, পুষ্প গিয়ে সেখানে দাঁড়ালো।
দাঁড়াবামাত্র তার দৃষ্টিশক্তি যেন সহস্রগুণে বেড়ে গেল। লক্ষ কোটি যোজন দূরবর্তী এক অতি ক্ষুদ্র গ্রহ–পৃথিবীর এক ক্ষুদ্র গ্রাম ওর নয়নপথে পতিত হোল। দেখেই বুঝলে, বাংলাদেশ। সন্ধ্যা নেমে আসচে।
নারিকেল সুপারি গাছে ঘেরা ছোট্ট একটা একতালা কোঠাবাড়ী। বাড়ীতে বিবাহ হচ্চে উঠোনে ক্ষুদ্র শামিয়ানা টাঙানো, বাইরের বৈঠকখানায় ফরাস বিছানো, বরযাত্রীরা এখনও আসে নি, কন্যাপক্ষ ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করচে। সকলের একটা ব্যস্ততা ও উৎসাহের ভাব। কিন্তু সরুপাড় ধুতি পরনে একটি সতেরো আঠারো বছরের কিশোরী নিরানন্দ মুখে ঘরের এক কোণে চুপ করে বসে আছে। যেন আজকের উৎসবের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই–মাঝে মাঝে চোখের উদ্গত অশ্রু আঁচল দিয়ে মুছে ফেলে ভয়ে ভয়ে চকিতদৃষ্টিতে চারিদিকে চাইচে, কেউ দেখতে না পায়।
দেবী বল্লেন–ওই যে মেয়েটা দেখচো, ওর নাম সুধা, বিয়ে ওর ছোট বোনের। ওই মেয়েটার দুঃখে আমি এত কষ্ট পাচ্ছি যে স্বর্গে থাকা আমার দায় হয়ে উঠেছে। ও অত্যন্ত প্রেমিকা মেয়ে–অত অল্প বয়সে অত ভাবপ্রবণ প্রেম-পাগলিনী মেয়ে বড় একটা দেখা যায় না। ও আজ বছর-দুই বিধবা হয়েছে–তের বছরে বিবাহ হয়েছিল। স্বামী বেঁচে ছিল বছর দুই। এই দু-বছরে স্বামীকে ও প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল। রোজ রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। আজ ওর ছোট বোনের বিয়ে। ওর কেবলই মনে হচ্চে ওর বিয়ের দিনটির কথা। আজ সারাদিন লুকিয়ে কাঁদছে পাছে মা বাবা মনে কষ্ট পায়। আমার আর সহ্য হয় না ওর দুঃখ–কি যে করি! তার চেয়েও করুণ ব্যাপার হচ্চে এই যে, মেয়েটিকে আমি তিনজন্ম ধরে লক্ষ্য করেচি, তিন জন্মই ওর এই অবস্থা, বিয়ের অল্পদিন পরেই বিধবা হচ্চে। অথচ কি ভালবাসার পিপাসা ওর! কি প্রেমপ্রবণ হৃদয়!…আর দেখচো তো, গরীব ঘরের মেয়ে!
পুষ্পের হৃদয় গলে গেল অভাগী বালিকার জীবনের ইতিহাস শুনে। চোখে জল এল। সে বল্লে–কিন্তু আপনার তো অসীম শক্তি, আপনি তো ইচ্ছে করলেই ওর উপায় হয়।
দেবী বিষণ্ণ মুখে বল্লেন–তা হয় না, পুষ্প। কেন হয় না, চল তোমায়। দেখাবো। তুমি আগে যাও–আমি কিছু পরেই যাবো। যতীনকে নিয়ে তুমি চলে যাও।
লক্ষ লক্ষ মাইল চোখের পলকে অতিক্রম করে পুষ্প এল ওদের বুড়োশিবতলার বাড়ীতে। যতীনকে সঙ্গে নিয়ে তারপর সে চলে এল। সুধাদের বাড়ী। সুধাদের বাড়ী তখন বর এসেচে। মেয়েরা হুলু দিয়ে শাঁক বাজিয়ে বরকে এগিয়ে নিয়ে এল। সুধার সেখানে যাবার উপায় নেই। বাড়ীর বিধবা মেয়ে, মাঙ্গলিক কোনো অনুষ্ঠানে আজ তার সামনে থাকবার জো নেই। তবুও সে কৌতূহলদৃষ্টিতে ঘরের জানালার গরাদে ধরে উঠোনের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে বর দেখচে। কৌতূহল অল্পক্ষণের জন্য তার শোককে জয় করেচে।
পুষ্প এসে সুধার পাশে দাঁড়ালো। সুধা যে আত্মা হিসাবে উচ্চশ্রেণীর তা তখনি বুঝলে পুষ্প, কারণ পুষ্পের প্রভাব সে তখনি নিজের মনের মধ্যে অনুভব করলে–তার ভারী মনটা তখনি হালকা হয়ে। গেল। জীবনে সব যেন শেষ হয়ে যায় নি, আরও অনেক কিছু আছে, জীবনের তো সবে শুরু, বহুদূরের পথ কোথায় কোন্ বাঁকে নক্ষত্রের মত সারারাত জেগে আছে বনফুলের দল, চাঁদের আলোয়। জ্যোৎস্নাময় হয়ে আছে সে জায়গা–আবার আশা ফুটে ওঠে মনে– অতীত বাসররাত্রির স্মৃতির আনন্দের মত পবিত্র অনুভূতিতে মন ভরে ওঠে।
যতীন দেখলে একটি আত্মা অনেকক্ষণ থেকে বিবাহসভার এদিক। ওদিক ঘোরাঘুরি করচে। যতীনকে দেখে সে কাছে এল। বল্লে– আপনি কে? আপনি এখানে কেন?
যতীন বল্লে–আপনি কে?
-আমি এই বিধবা মেয়েটির স্বামী।
–ওকে একটু সান্ত্বনা দিন আজ।
-আমি চেষ্টা করছি কিন্তু পারচি নে। আপনাকে দেখে বুঝেচি আপনি উচ্চ স্বর্গের মানুষ, আপনি যা পারবেন, তা আমি পারবো না। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করছিলাম আপনি এখানে কেন।
–এই মেয়েটির দুঃখে একটি দেবীর মন গলে গিয়েছে। তিনি পাঠিয়েচেন এখানে আমাদের।
-কই, আর কেউ তো নেই এখানে? আপনি তো একা
যতীন পুষ্পের পাশেই ছিল, সুধার স্বামী খুব উঁচুদরের আত্মা নয়, ওরা দেখেই বুঝেছিল, সে দেখতে পেলে না পুষ্পকে।
যতীন বল্লে কথাটা। সুধার স্বামী বিনীতভাবে তাকে এবং উদ্দেশে পুষ্পকে প্রণাম করলে। বল্লে–আমি বড় কষ্ট পাচ্চি ওর জন্যে। কিন্তু কিছু করবার নেই, ও যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি–কিন্তু আমার চেয়ে ওর অবস্থা উন্নত, আমার ক্ষমতা নেই কিছু করবার
যতীন বল্লে–উচ্চস্বর্গের একজন দেবী আপনার স্ত্রীর ওপর কৃপাদৃষ্টি রেখেচেন–তিনি আমাদের এখানে পাঠিয়েছেন। তিনি নিজে এখুনি। আসবেন
পুষ্প বল্লে–তিনি এসেছেন, এই তো এলেন–
সুধার স্বামী পুষ্পের কথা শুনতে পেলে না, যতীন প্রণয়দেবীকে দেখতে পেলে না। কিন্তু প্রণয়দেবীর শান্ত কোমল প্রভাব সে মনের মধ্যে অনুভব করতে পারলে। প্রণয়দেবী নিজে সব সময় সুধার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন, বল্লেন–এদের ফেলে আমার কোথাও থেকে সুখ নেই। এবারও এদের ওই রকম ভুগতে হবে, সুধার স্বামী তত উচ্চ অবস্থার নয়–তা ছাড়া কেন এরা এ রকম ভুগচে তা আমি ঠিক জানি না। জগতে এইসব ঘটে যে অদৃশ্য বিরাট শক্তির নির্দেশ অনুসারে, সে শক্তি বড় রহস্যময়। তার কৰ্ম্মপ্রণালী বা প্রকৃতি সম্বন্ধে কিছুই বুঝি না, জানিও না।
পুষ্প বল্লে–তিনিই তো ভগবান?
প্রণয়দেবী চমকে উঠে বল্লেন–ও নাম কানে গেলে মন অন্যরকম হয়ে যায়। যখন তখন ও নাম নিও না। ভগবান যে কি, তা আমরা জানিনি এখনও। যে শক্তির কথা বলচি, হয়তো তাকেই তোমরা ওই নামে ডাকো।
সুধার বোনের বিয়ে হয়ে গেল, বরকনে বাসরঘরে চলে গিয়েছে। এই মাত্র। গরীবের ঘরের বিয়ে, তবুও উঠানে ছোট শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে প্রতিবেশীর বাড়ী থেকে চেয়ে এনে, আধমণটাক ময়দার লুচি ভাজা হয়েচে বরযাত্রী ও প্রতিবেশীদের খাওয়ানোর জন্যে, তারা খেতেও বসেচে। গ্রামের বৌ-ঝির দল সেজেগুঁজে বাসরঘরে ঢুকে বরের চারিপাশে ভিড় জমিয়ে তুলেচে। প্রণয়দেবী ঘরে ঢুকে এক কোণে। দাঁড়িয়ে প্রসন্নদৃষ্টিতে চারিদিকে চাইলেন, যেন মনে মনে সকলকে আশীৰ্বাদ করলেন। আজকার দিন এবং সময় তাঁর চরণপাতের শুভ সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়ে গেল।
কিন্তু যতীন বিষণ্ণ মনে এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল–আজকার বিবাহ উৎসবের দৃশ্যে তার মনে হচ্ছিল, আশার সঙ্গে এমন এক উৎসবের। মধ্যে তার বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু আজ কোথায় সে আর কোথায় আশা! সুধার মত আজ সে বিধবা, জীবনের সব সাধ তারও আজ ফুরিয়ে গিয়েচে–পরের সংসারে পরের হাততোলা খেয়ে
পুষ্প ধমক দিয়ে বল্লে–যতীন-দা!
এই সময় প্রণয়দেবী বল্লেন–সুধা রান্নাঘরের কোণে বসে কাঁদচে, একটু ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াও পুষ্প।
পুষ্প এসে দেখলে সুধার স্বামীও সেখানে উপস্থিত। তারও চোখে জল। মরণের যবনিকার আড়ালে প্রেমের এই লীলা পুষ্পকে মুগ্ধ করলে। প্রেম মরণজয়ী, এই সত্যটা এই দৃশ্যে যেন পুষ্পের মনে। ভাল করে অঙ্কিত হয়ে গেল।
একটু পরে প্রণয়দেবী নিজে সেখানে এসে দাঁড়ালেন। সুধার মাথায় তাঁর হাত রেখে বল্লেন–কোনো দুঃখ কোরো না। আমি মিলন করিয়ে দেবো। তোর মত মেয়ে লক্ষ লক্ষ রয়েছে আমার পৃথিবীতে–তাদের ছেড়ে স্বর্গেও যেতে পারি নে।
পুষ্প বল্লে–আপনার মত দেবী ইচ্ছে করলে সুধার কোনো উপকার হয় না?
–আমি সেবা করতে পারি, বিশ্বের শক্তি নিয়ন্ত্রণ করবার আমি কে? আমার মত হাজার হাজার আছেন দেবদেবী। তা ছাড়া পৃথিবীর মানুষদের নিয়ে আমার কারবার। অগণ্য জীবলোক রয়েচেবিশ্বব্রহ্মান্ডে তাদের জন্যে অন্য সব দেবদেবী আছেন।
–তাঁদের আপনি জানেন?
–জানি তাঁরা আছেন–পরিচয় সকলের সঙ্গে নেই। আমাদের শক্তি মানুষের চেয়ে হয়তো বেশী, তবুও সীমাবদ্ধ। চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই।
সেদিন যতীন বুড়োশিবতলার ঘাটে একা বসে অন্যমনস্কভাবে আশালতার কথা ভাবলে অনেকক্ষণ। পুষ্প ওকে সব কথা বলেচে, প্রণয়দেবীর মুখে যা কিছু শুনেছিল। তিনিই যখন অদৃষ্টকে উল্টে দিতে পারেন না, সে তো অতি তুচ্ছ ওঁর কাছে–কি করতে পারে সে? আশাকে তার নিজের ভাগ্যের পথে চলতে হবে।
পশ্চিমাকাশে অস্তসূর্য্যের রাঙা আভা। গঙ্গার বুকে পাল তুলে ছোট বড় নৌকার দল চলেচে। দু-একটা মাছরাঙা পাখী ছোঁ মেরে মাছ ধরচে ডাঙা থেকে অনতিদূরে। নৈহাটির গঙ্গা, কেওটা-সাগঞ্জের গঙ্গা।
কতক্ষণ সে এ রকম বসে ছিল জানে না, হঠাৎ সে চমকে উঠে দেখলে একজন জ্যোতির্ময় পুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে। যতীন শশব্যস্ত উঠে তাঁকে প্রণাম করলে।
আগন্তুক বল্লেন–বেশ করে রেখেচ হে তুমি! পৃথিবী থেকে অল্পদিন এসেচ?
–আজ্ঞে হাঁ।
–তাই দেখচি। হুগলী জেলায় বাড়ী ছিল? তাই গঙ্গার ধার-টার ঠিক এই রকম করেচ। এ সব মায়া। জগৎ বা বিশ্বটাও তেমনি মায়া–সেই এক অখণ্ড সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম ছাড়া সব মায়া। কোন কিছুর মধ্যে বাস্তবতা নেই।
যতীন মনের মধ্যে হাতড়াতে লাগলো। এই ধরনের একটা মতের কথা সে শুনেছিল, একবার একটা বইয়েও পড়েছিল যেন। মনে এনে বল্লে–অদ্বৈতমত বলছেন?
মহাপুরুষ যেন একটু বিস্ময়ের ভাবে বল্লেন–অদ্বৈত বেদান্ত সম্বন্ধে তুমি জানো? তবে বই পড়লে কি হয়? প্রত্যক্ষ অনুভূতি চাই। অখণ্ড সচ্চিদানন্দের অনুভূতি চাই। তুমি মরে এখানে এসেচ, কিন্তু জ্ঞান জন্মায়নি ভেতরে। এখানে হুগলীর জেলার গঙ্গার ঘাট তৈরী করে রেখেচ। এমনি করেচে অনেকেই এখানে। সব মায়া। আবার পৃথিবীতে জন্ম নিতে হবে গিয়ে–অদ্যবাব্দশতান্তেবা–আজই হোক, দুশো বছর। কি হাজার বছর পরেই হোক। অখণ্ড সচ্চিদানন্দের অনুভূতি ভিন্ন। মুক্তি নেই।
যতীন ভয়ে ভয়ে বল্লে–আজ্ঞে, মুক্তি মানে কি?
–ভগবানের সঙ্গে একাত্মবোধ। যোগসাধনা ভিন্ন তা সম্ভব নয়। উপনিষদে দুটি পাখীর রূপক বর্ণনা আছে। একটি গাছের দুটি ডালে ওপরে নীচে দুটি পাখী বসে রয়েচে। নীচের পাখীটা মিষ্ট ফল খাচ্চে, কটু ফল খাচ্চে,–ওপরের পাখী নির্বিকার অবস্থায় বসে আছে, সুখ দুঃখে উদাসীন, নিজ মহিমায় মগ্ন। একটি পরমাত্মা, অপর পাখীটি ইন্দ্রিয়সুখমগ্ন জীবাত্মা। নীচের পাখীটি যখন ওপরে উঠে ওপরের পাখীটির সঙ্গে মিশে এক হয়ে যাবে–তখনই তার মুক্তি।
তদা বিদ্বান্ পুণ্যপাপে বিধূয় নিরঞ্জনঃ পরমং সাম্যমুপৈতি–
যতীন এমন কথা কখনো শোনেনি। বিস্ময়মুগ্ধের মত চেয়ে রইল সন্ন্যাসীর দিকে। সে ভেবেছিল মরণের পর যখন বেঁচে আছে, তখন। তার আর ভাবনা কি? কিন্তু এখন ওর মনে হোল কোথায় যেন কি গলদ রয়ে গিয়েছে। সে বিনীতভাবে বল্লে–আজ্ঞে তবে আমাদের উপায়? আমাদের কে যোগ-শিক্ষা দেবে, কি হবে–শুনেচি সে বড় খটমট ব্যাপার–ওসব কি আমাদের জন্যে?
সন্ন্যাসী হেসে বল্লেন–খুব সোজা নয়, শক্তও নয়। আমি পৃথিবীতে তোমারই মত মানুষ ছিলাম। যৌবনে স্ত্রী-বিয়োগ হোল, সংসার মিথ্যা মনে হোল। তবুও পাঁচ বছর সংসারেই রয়ে গেলাম। তারপর সন্ন্যাস। গ্রহণ করলাম। সদ্গুরুর সন্ধান পেলাম। আসামের এক জঙ্গলে পনের বছর যোগ অভ্যাস করবার পর একদিন গুরুর কৃপায় নির্বিকল্প সমাধি হোল।
যতীন রুদ্ধনিশ্বাসে বল্লে–তারপর।
সন্ন্যাসী হেসে বল্লেন-তারপর? তারপর আর কিছুই না। মুখে সে অবস্থার কথা বলা যায় কি? সে তুমি কি বুঝবে? এখনও তুমি ছেলেমানুষ মাত্র। বড় উচ্চ অবস্থার কথা সে সব। তুমি আর নিষ্ঠুণ ব্রহ্ম এক। মায়া তোমার স্বরূপ আবরণ করে বসেচে। তুমি কেন, পৃথিবীর সব কিছু। ছোট কেউ নও। তোমরা সবাই অজর অমর, শাশ্বত আত্মা–তুমিই এ জগতের কর্তা, এ জগৎকে সৃষ্টি করেচ–তবে ছোট হয়ে আছ কেন? এই লোকে এসেচ–এও উপাধির লোক। এর। আরও ওপরে উচ্চতর লোক আছে–মহা জ্যোতির্ময় লোক, দেবদেবীরা সেখানে বাস করেন। তোমার মত লোক তার ধারণা করতে পারবে না। জগৎকে সৃষ্টি ও লয় করতে তাঁরা সমর্থ। কিন্তু সেও অনিত্য। সেখানে পৌঁছনো মানুষের জগৎ। তারও ওপরে নিরুপাধি নির্গুণ। ব্ৰহ্ম বিরাজ করেন। সেখানে পৌঁছুনো মানুষের আগ্রহ থাকলেই হয়। আসলে তোমার সঙ্গে তার অভিন্নতা কোথায়? এ জগতে দুঃখ নেই, পাপ নেই, শোক নেই, ভয় নেই, মৃত্যু নেই, সে তো দেখেই নিলে, ক্ষুদ্রত্ব নেই, এসব কিছু নেই–আছে শুধু আনন্দ, অমরত্ব, বিরাটত্ব। আর তুমিই তার অধিকারী। অতএব ওঠো, জাগো–তং ত্বমসি তুমিই সেই।
সন্ন্যাসীর সৰ্ব্বদেহ দিয়ে একপ্রকার নীল বিদ্যুতের মত জ্যোতি যেন ঠিকরে বেরুচ্চেতাঁর দিকে চাওয়া যায় না। যতীন তাঁর পদস্পর্শ করবার জন্য মাথা নীচু করতেই তিনি বল্লেন–উঁহু–ছোট ভেবে আমার পা ছুঁয়ে তোমার কি হবে? ছোট তুমি নও। তুমিই দেব, তুমিই দেবী, তুমিই সগুণ ঈশ্বর–তুমিই জগকারণ নিরুপোধি অখণ্ড সচ্চিদানন্দ ১৩৭।
একই আছে, আর কিছু নেই জগতে–একস্ এব, অদ্বিতীয়–পৃথিবী বা পরলোক সব দুদিনের খেলা, আবার জন্ম, আবার মৃত্যু–বার বার। আসা-যাওয়া–সব অনিত্য–জেগে ওঠো–ঘুম ভেঙে জেগে ওঠো।
সন্ন্যাসী এত জোরে জোরে কথাগুলো বল্লেন–যতীনের মনে হোল তার সমস্ত শরীরে হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে গেল–সন্ন্যাসীর দেহ থেকেই যেন সে বিদ্যুৎতরঙ্গ ছুটে এল তার দেহে। সে চোখের সামনে কতকগুলো গোল গোল জড়ানো জড়ানো গোলকধাঁধাঁ খেলার মত কি দেখলে–তারপর আর তার জ্ঞান রইল না। যেন হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমের মধ্যে সে যেন কোথায় চলেচে!
নীল আকাশ, সোম-সূর্য-তারকাচিহ্নিত–তার আশেপাশে, ঊর্ধে, নামোতে। বহু দূরে নীল সমুদ্রে ডুবে একটা কুণ্ডলীকৃত নীহারিকা পাক খাচ্চে–লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি নক্ষত্র, সূৰ্য্য, কুয়াসার ঢেউএর মত উল্কাপিণ্ডদল বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের বহির্দেশে ভ্রাম্যমান–লক্ষ লক্ষ জীবজগৎ, কোটি কোটি জীবজগৎ, লক্ষ কোটি লক্ষ কোটি আত্মিক লোক–কত লীলা, কত খেলা, কত সুখদুঃখের অনন্ত প্রবাহ-অনন্ত জীবজগৎ…
এ সবও ছাড়িয়ে এক জ্যোতির্ময় রাজ্যের প্রান্তে গিয়ে একটি অপূৰ্ব্ব শান্তির অনুভূতি সে অনুভব করলে..সুগভীর আনন্দ ও শান্তি, আর যেন মনে কোনো আশা নেই, কোনো তৃষ্ণা নেই, সুখ নেই, দুঃখ নেই, পাপের ভয় নেই, পুণ্যের স্পৃহা নেই, স্বৰ্গভোগের আকাঙ্ক্ষা নেই, পুষ্পের প্রতি প্রেম নেই, আশালতার প্রতি অনুকম্পা নেই– মনই নেই–যেন শুধু আছে ‘আমি আছি’ এই অনুভূতি, আর আছে তার সঙ্গে মিশে এক অতি উচ্চস্তরের আনন্দ, শান্তি, মহা উচ্চ জ্ঞান ও স্বয়ম্ভু স্বপ্রতিষ্ঠ অস্তিত্বের গভীর অনির্বচনীয় আনন্দ।
যতীনের মনে হোল সেই সন্ন্যাসী যেন কোথায় তার আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেচেন..কখনও তাঁর জ্যোতির্ময় দেহ দেখা যায়, কখনও যায় না।
তারপর সেই জ্যোতিৰ্ম্ময় দেশের অপূৰ্ব্ব শান্তি ও আনন্দময় আবেষ্টনীর মধ্যে সে প্রবেশ করলে..সঙ্গে সঙ্গে সেই সুগভীর পুলকে তার মন আবার ভরে উঠলো–উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় দেহধারী দেবদেবীরা সে রাজ্যের মণ্ডলে বিচরণ করছেন, তাঁরা যে আসনপীঠে ঠাকুর সেজে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছেন তা নয়, তাঁরা যেন সে জগতের সাধারণ অধিবাসী, নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত আছেন, তাই কেউ আকাশপথে বায়ুভরে চলেচেন, সমতল ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল পৃথিবীর মানুষের মত নন তাঁরা–ঊর্ধ্বে, নিম্নে–সবদিকে সমান গতি তাঁদের দু’একজনকে কাছে থেকে দেখবারও অবসর সে পেলে… পৃথিবীর মানুষের মত দেহ বটে, কিন্তু যেন বিদ্যুৎ দিয়ে গড়া, দেবীদের মুখের সৌন্দর্য অতুলনীয়, তাদের পৃথিবীর বাড়ীতে ছেলেবেলায় একটি প্রাচীন পটুয়ার আঁকা রাজরাজেশ্বরী মূর্তি ছিল দেওয়ালে টাঙানো, তার বৃদ্ধা ঠাকুরমা রোজ স্নান সেরে সেই পটের পূজো করতেন, খানিকক্ষণের জন্যে যেন পটের মুখ হাসতো–এতদিনের মধ্যে জীবনে সে সেই পটে আঁকা। রাজরাজেশ্বরীর মুখশ্রীর মত সুন্দর ও কমনীয় মুখশ্রী আর দেখেনি.. এখানে সে দু-একটি দেবীর মুখ যা দেখবার সুযোগ পেলে, পটের সে ছবির মুখের চেয়ে অনেক, অনেকগুণে সুশ্রী, আরও মহিমময়ী, বক্ৰ চাহনির মধ্যে ত্রিভুবন-বিজয়ী শক্তি…অথচ মুখে অনন্ত করুণার বাণীমূৰ্ত্তি।
কোথায় যেন রাশি রাশি বনপুষ্প ফুটেছে, নিৰ্ব্বাত ব্যোম তাদের সম্মিলিত সুবাসে ভরপুর…
এসবও ছাড়িয়ে চললো সে..মহাবিদ্যুতের মত তার গতি, কোথাও অনন্ত ব্যোমে, মহাশূন্যের সুদূরতম প্রান্তে, অনন্তের জ্যোতি-বাতায়ন। যেখানে চারিদিকে উন্মুক্ত…দেবদেবীর বাসস্থান এ সব মহাদেশও যেন আপেক্ষিক চৈতন্যের রাজ্য; বাসনার রাজ্য…এদেরও দূর, বহুদূর পারে, সব আকাশ ও সময়ের পারে, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যেখানে এক হয়ে মিলিয়ে গিয়েছে–সোম সূর্য নেই, তারকা নেই, অন্ধকার নেই, আলোও নেই–সেই এক বহুদূর দেশে সে গিয়ে পৌঁছেচে…এদেশ আকারধারী জীব বা দেবদেবীর রাজ্য নয়, সৰ্ব্ববিধ আকার এখানে জ্যোতিতে লোপ পেয়েচে, অথচ এ জ্যোতিও দৃশ্যমান আলোকের জ্যোতি নয়, আগুন নয়, বিদ্যুৎ নয়–কি তা সে জানে না…তার সবদিকে, তাকে চারিধার থেকে ঘিরে এই জ্যোতি…আর কি একটা বিচিত্র, অনির্বচনীয় অনুভূতি…ওর মন লোপ পেয়েছে অনেকক্ষণ, চৈতন্যও যেন লোপ পেতে বসেছে…অথচ যতীনের মনে হোল এই তার আপন স্থান, এতদিনে আপন স্থানে সে ফিরে এসেচে..এই তার বহুপরিচিত স্বদেশ..যুগ-যুগান্ত, কত মহাযুগ ধরে সে এখানে আবার ফেরবার অপেক্ষায় ছিল। মহাব্যোমে আর কেউ নেই, আশালতা না, পুষ্প না, তার যতীনও না, সন্ন্যাসী, তাদের এ লোকে বাঁধা কত সাধের ঘর বা বুড়োশিবতলার ঘাট না, দেব না, দেবী না, পরলোক না, এমন কি ঈশ্বরও না…
মহাব্যোমের মহাশূন্যে অনাদি, অনন্ত স্বয়ম্ভু, স্বপ্রকাশ, নিৰ্ব্বিকার, নির্বিকল্প সে শুধু আছে–পাপহীন, পুণ্যহীন, মণ্ডলহীন, অমঙ্গলহীন, সুখহীন, দুঃখহীন সর্বপ্রকার উপাধিহীন…
সে-ই আছে মাত্র একা।
নিঃসঙ্গ মহাব্যোমে আর কোথাও কিছু নেই, কেউ নেই!
সে-ই সব।
এমন কি, এ মহাব্যোমও তার সৃষ্টি-সৃষ্টি নয়–সে নিজেই।
যতীন আর কিছু জানে না।
যখন ওর চৈতন্য হোল তখন সে দেখলে সেই মহাসন্ন্যাসী পাশেই বুড়োশিবতলায় ঘাটের রাণাতে বসে আছেন–সে তাঁর এপাশে বসে। যেন সে ঘুম ভেঙে উঠেচে এইমাত্র।
সন্ন্যাসী হেসে বল্লেন–কি হোল? দেখলে?
যতীন মূঢ় ও অভিভূতের মত তাঁর মুখের দিকে চেয়ে বল্লে–কি দেখলাম বলুন দিকি?
–আমি চলোম। যা দেখলে, দেখলে। মুখে কি বোঝাবো? মন। নিম্নস্তরের ইন্দ্রিয় মাত্র, ওর চেয়ে বড় অনুভূতির দরজা যেদিন খুলবে, সেদিন আমায় বোঝাতে হবে না, নিজেই বুঝবে। তোমার সে অবস্থার। এখনও বহু বিলম্ব। দু-চার জন্মে হবে না। অনেকবার এখনও পৃথিবীতে যাতায়াত করতে হবে।
তিনি যাবার উদ্যোগ করচেন দেখে যতীন ব্যাকুলভাবে বল্লে–প্রভু, যাবেন না, যাবেন না। পুষ্প বলে একটি মেয়ে আছে, তাকে একবার দেখা দিয়ে যাবেন দয়া করে?
সন্ন্যাসী হেসে বল্লেন–সময় হোলে দুজনেই দেখা পাবে আবার। তবে স্ত্রীলোকের পথ ভক্তির, জ্ঞানের নয়। আমি তোমাদের দুজনকেই জানি, গত তিন জন্ম তোমরা আমার দেখা পেয়ে, তোমাদের ভালবাসি।
কিন্তু তাতে কি হবে? সময় হয়নি। চক্রপথে ঘুরতে হবে অনেকদিন।
আমি আছি তোমাদের পেছনে। নতুবা আমার দেখা পেতে না।
সন্ন্যাসী অন্তর্হিত হলেন।