একদিন গঙ্গার ঘাটে বসে থাকার সময় যতীন দেখে অবাক হয়ে গেল যে দিব্যি চমৎকার জ্যোৎস্না উঠলো। একেবারে পৃথিবীর পূর্ণিমার জ্যোৎস্না। তার শুভ্র আলোর ঢেউ পড়লো গঙ্গাবক্ষে, পড়লো গিয়ে ওপারের শ্যামাসুন্দরী মন্দিরের সব্বাঙ্গে, তীরের প্রাচীন বটের মাথায় ডালের ফাঁকে ফাঁকে।
যতীন ভাবলে–এ আবার কি? জ্যোৎস্না তো কখনো এখানে দেখিনি! এখানে রাত্রিই বা কি, দিনই বা কি!
এমন সময়ে পুষ্প হাসতে হাসতে পাশে বসে বল্লে–কেমন জ্যোৎস্না হয়েচে দেখ; মনে পড়ে তুমি আর আমি কেওটার বুড়োশিবতলার ঘাটে এমনি জ্যোৎস্নারাতে কত বসে ইলিশমাছ ধরা দেখতাম?
-কিন্তু জ্যোৎস্না উঠলো কোথা থেকে? চাঁদ এল কি করে?
–তৈরী করলুম জ্যোৎস্নাটা। ভাবলুম তোমার সঙ্গে একদিন। জ্যোৎস্নারাতে ঘাটে বসা যাক। কেমন, বেশ হয়নি?
–আচ্ছা পুষ্প, যে কোনো ঋতু, যে কোনো সময়কে তৈরী করতে পারো? এ তো অদ্ভুত!
–সময় এখানে মনের দ্বারা সৃষ্টি করা যায়, যেমন অন্য সব জিনিস। করা যায়। সে তো তুমি চোখের ওপর দুবেলা দেখচো। আচ্ছা যতুদা, সাগঞ্জ-কেওটার কথা মনে পড়ে?
–খুব পড়ে পুষ্প! সেই একবার আমি গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম মনে আছে? তোর কি কান্না! সত্যি আমি এক একবার ভাবি জীবনে কি পুণ্য না জানি করেছিলাম যে তোর মত মেয়ের সঙ্গ পেয়ে ধন্য হয়েছি। আমার এখনও মনে হয় এ সব স্বপ্নই বা।
পুষ্প লজ্জিত সুরে বল্লে–আহা!
পুষ্প বুঝতে পারে যে, যতীন আশার কথা ভাবচে, ঘাটে এসে বসেই তার কথা ওর মনে হয়েছে। যত উচ্চ স্তরের আত্মাই হোক, পুষ্প মেয়েমানুষ, তার মনটা হু হু করে ওঠে। যতুদাকে সে আবাল্য ভালবাসে, প্রাণ দিয়ে ভালবাসে কিন্তু যতুদা তার চেয়ে যে আশা। বৌদিকে বেশী ভালবাসে, একথা সে জেনেও মনে স্থান দেয় না বেশীক্ষণ। উপায় কি? এই তার অদৃষ্টলিপি, নইলে সে ছেলেবেলায় পৃথিবী ছেড়ে, যতুদাকে ছেড়ে আসবে কেন? যতীনের গত তেরো বছরের জীবনে পুষ্প ছিল না, ছিল আশা–এ অবস্থায় আশার সঙ্গেই যতীনের মনের যোগ অনেক গাঢ়বদ্ধ। কারো কোনো দোষ নেই।
পুষ্পের মনে দুঃখের ছায়া এসে পড়তেই বাইরের জ্যোৎস্না ক্রমশ ম্লান হয়ে এল। মন প্রফুল্ল না থাকলে মানসিক সৃষ্টি ক্ষুণ্ণ হবেই।
হঠাৎ পুষ্প যতীনের দিকে চেয়ে বলে–একটা কথা ভুলে গিয়েছিলুম, যতুদা। আজ কল্প-পৰ্ব্বতের গান বাজবার দিন। চল তোমাকে শুনিয়ে আনি। সে এক অদ্ভুত জিনিস।
ওদের স্বর্গ থেকে বেরিয়ে ওরা শূন্য বেয়ে চললো। বহুদূরে একটা সবুজ নক্ষত্রের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে পুষ্প বল্লে–ওইখানে আমাদের যেতে হবে। ওই দিকে একদৃষ্টে চোখ রেখে ভাবো যে আমরা ওখানে। যাবো।
নক্ষত্রটা যেন ক্রমে বড় হচ্চে, যতীনের মনে হোল সে সবেগে ওর দিকে নীত হচ্চে। কি অদ্ভুত এ যাত্রা। যতীন অবাক হয়ে চেয়ে দেখছিল অনেক দূরে অন্ধকারের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড গ্রহ ডুবে ডুবে ঘুরচে।
পুষ্প বল্লে–এই হচ্চে শুক্রগ্রহ–সন্ধ্যাবেলা সেটাকে পশ্চিম আকাশে দেখা যায়।
আকাশের রং এখানে নীল নয়, অনেকটা ধূসরমিশ্রিত বেগুনী। শূন্যপথে অনেক আত্মা তাদের মতই যাওয়া আসা করছে, তবে তাদের মধ্যে কেউই উচ্চশ্রেণীর নয়, ওদের রং দেখে শ্রেণী ঠিক করতে শিখে গিয়েচে যতীন। এ সব আত্মার রং খানিকটা খানিকটা মেটে সিঁদুরের মত লাল। খুব সাধারণ শ্রেণীর আত্মা। তবে নিম্ন শ্রেণীর আত্মা এখানে আসে না। তাদের দ্বিতীয় স্তরের নিম্ন পৰ্য্যায় ছাড়িয়ে ওঠবার সাধ্যই নেই।
হঠাৎ যতীন বল্লে–সে পাহাড় তো চতুর্থ স্তরে, সেখানে পৌঁছে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়বো না পুষ্প?
পুষ্প হেসে বল্লে–তাহলে তোমায় কি আনতুম যতুদা? সেবার তুমি যেখানে অজ্ঞান হয়েছিলে, সেটা চতুর্থ স্তরের ঊর্ধ্বলোক। চতুর্থ স্তরে ঠিকই ছিলে। চতুর্থ স্তরে সেই নীল হ্রদ দেখেছিলে, যেখানে দেব দেবীরা স্নান করছিলেন।
যতীন বল্লে–কই, কোথায় দেবদেবীরা স্নান করছিলেন আমি তো দেখিনি? তখন থেকেই আমার জ্ঞান চলে যাচ্ছিল তাহলে।
ওদের কথা শেষ হতে না হতেই যতীন দেখলে তারা একটা অত্যন্ত সুন্দর দেশে এসে পৌঁছেছে।
দেশটার চারিদিকেই চক্রবাল রেখার কূলে কূলে নীল পাহাড়। গাছপালা সেখানে আদৌ তৃতীয় স্তরের মত নয়–কোনোটার রং নীল, কোনোটার বেগুনী, কোনোটার সোনালী; ফুলফল যেন রঙীন আলো দিয়ে গড়া। পাহাড়ের মাথায় মাথায় যেন জ্বলন্ত রঙীন আলোর মেলা। পুষ্প একটা গাছের ফুল তুলে ওকে দেখালে, তুলবা মাত্র বোঁটায় আর একটা ফুল কোথা থেকে এসে শূন্যস্থান পূর্ণ করলে। আরও একটা আশ্চর্য ব্যাপার, প্রান্তরের ও শৈলসানুর সব ফুল মুহূর্তে মুহূর্তে স্পন্দিত হচ্চে, যেন চারিদিকে রাশি রাশি লক্ষ লক্ষ নানা বিচিত্র বর্ণের জোনাকি নিবচে জ্বলচে। পাখীগুলো যখন আকাশে উড়চে, তাদের ডানায় যেন সাতরঙা রামধনুর খেলা। এদেশে বাতাসে একটা অদ্ভুত শান্তি ও আনন্দের বার্তা–একটা বিচিত্র জীবন-উল্লাসের ইঙ্গিত।
যতীন একটা জিনিস লক্ষ্য করলে, এখানকার দৃশ্য যে রকম, পৃথিবীতে এ দৃশ্য কল্পনাও করা যায় না। এর কোনো জিনিস পৃথিবীতে নেই।
পুষ্পকে সে কথাটা বল্লে।
পৃথিবীর সঙ্গে খুবই কম মিল এ দেশের, না, পুষ্প?
পুষ্প বল্লে–যতুদা, এর একটা সহজ কারণ আছে। দ্বিতীয় বা তৃতীয়। স্তরের আত্মারা পৃথিবী থেকে সদ্য এসেচে। পৃথিবীর স্মৃতি তখনও তাদের কাছে ম্লান হয়নি। যখন তারা মানসলোক সৃষ্টি করে, পৃথিবীর সেই স্মৃতি তাদের অনেকখানিই সাহায্য করে। কাজেই তাদের তৈরী স্বর্গ হয় পৃথিবীরই অবিকল নকল। কিন্তু এই সব স্তরের আত্মাদের মনে পৃথিবীর স্মৃতি অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে এসেচে–অনেকের নেই বল্লেই হয়। কাজেই তারা যখন গড়ে–নিজেদের কল্পনোক নিজেদের কল্পনা থেকে গড়ে। তাই সব হয় নতুন, সবই হয় আজগুবি। এ সবই যা দেখচো এ স্তরের অধিবাসীদের সৃষ্টি–ওই পাহাড়পৰ্বত, গাছপালা, ফুল, পাখী, সাধারণ দৃশ্য–সব।
–কিন্তু তোমার মানুষজন কই? একজনেরও তো সাক্ষাৎ নেই।
–তাঁরা ইচ্ছে না করলে এ স্তরের আত্মাকে তুমি সহজে দেখতে পাবে না যতুদা। কল্পপর্বতের কাছে যাকে আমরা চুম্বকশক্তির ঢেউ বলি–তা অত্যন্ত প্রবল। সেখানে গেলে তোমার দেহ শক্তিমান হবে, তখন খুব উচ্চ স্তরের আত্মাকেও অল্পক্ষণের জন্যে–মানে মাত্র যতক্ষণ সেই পৰ্ব্বতের কাছে থাকবে ততক্ষণের জন্যে–দেখতে পাবে।
অল্প পরেই একটা অনুচ্চ পৰ্বত সামনে দেখা গেল, তার ওপরটা। অনেকখানি সমতল। সেই সমতল জমিটুকুর ওপর যে দৃশ্য চোখে পড়ল যতীনের, তাতে সে বিস্মিত, মুগ্ধ ও স্তম্ভিত হয়ে গেল।
সেখানে বহু দেবদেবী একত্র হয়েছেন। তাঁদের অঙ্গের জ্যোতি ও রূপে সমস্ত ভূমিশ্ৰী আলোকিত হয়ে উঠেচে, সমগ্র বায়ুমণ্ডল (যদি এখানে বায়ুমণ্ডল বলে কোনো কিছু থাকে) তাঁদের দেহনিঃসৃত উচ্চ বৈদ্যুতিক শক্তির স্পন্দনে মৃত্যুঞ্জয়ী অমৃতের নিঝর হয়ে উঠেছে যেন, দেহগন্ধের সুরভিতে বহুদূর পর্যন্ত আমোদিত।
যতীন এ পর্যন্ত এত উচ্চ জীবের একত্র সমাবেশ কখনো দেখেনি। সে চুপি চুপি বল্লে–এ যে ওঁদের দস্তুরমত ভিড় লেগে গিয়েচে দেখচি, পুষ্প! উঃ–
সবাই যেন কিসের অপেক্ষা করছে। সকলের চোখ বাঁ দিকের একটা খুব উঁচু পাহাড়ের দিকে নিবদ্ধ। যতীন বল্লেও পুষ্প, এ যেন ফোর্টের রামপার্টে দাঁড়িয়ে মোহনবাগানের ম্যাচ দেখতে এসেচে সব–আহা, টিকিট কিনতে পায়নি বেচারীরা!
পুষ্প তিরস্কারের সুরে বল্লেনাঃ, তুমি জ্বালালে যতুদা-চুপ করে থাকো না কেন ছাই।
যতীন কি বলতে গিয়ে হঠাৎ চুপ করে গেল।
বাঁ ধারের সেই পাহাড়ের চূড়া থেকে এক অপূৰ্ব্ব, মধুর শব্দের ঢেউ উত্থিত হোল। দেবদেবীরা সকলে অবনতমস্তকে শুনতে লাগলেন। কেউ কেউ পাহাড়ের ঢালুর রঙীন স্বয়ম্প্রভ তৃণদলে শুয়ে পড়লেন অলসভাবে। কেউ বসে দুহাতে মুখ ঢাকলেন। বেশীর ভাগই কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলেন।
সে মধুর শব্দ কণ্ঠসঙ্গীত নয়, যন্ত্রসঙ্গীতের মত শব্দটা। কিন্তু পরিচিত কোনো যন্ত্রে বাদিত সঙ্গীত নয়। অত্যন্ত রহস্যময় তার উৎপত্তিস্থল। যেন গঙ্গার ধারা–কোন্ উচ্চ পৰ্ব্বতের তুষারপ্রবাহে তার জন্ম, কেউ খবর রাখে না। যতীনের সর্বাঙ্গ বার বার শিউরে উঠতে লাগলো।
শুনতে শুনতে যতীনের মনে হোল সে আর পৃথিবীতে বদ্ধ আত্মা নয়–সে উচ্চ অমৃতের অধিকারী দেবতা হয়ে গিয়েছে, সে মুক্ত, সে বিরাট–তার আত্মা সারা বিশ্বকে ব্যেপে সচেতন হতে চায়, তার বিরাট হৃদয়ে সকল পাপী তাপী, মূর্খ ও নিন্দুকের স্থান আছে, পতিতের উদ্ধার করতে যুগে যুগে পৃথিবীতে জন্মেচে, তাদের দুঃখে যুগে যুগে করেচে মৃত্যুবরণ। বিশ্বের মহাদেবতার প্রেমিক পার্শ্বচর সে–সে নৃত্যশীল গ্রহনক্ষত্রের বিচিত্র নৃত্যচ্ছন্দে লীলাময়, পবিত্র, প্রেমিক, মুক্ত দেবতা। একি আনন্দ! একি শিল্পমাধুৰ্য্য! একি অভিনব অননুভূতপূর্ব অমরতা!
কোনো দিকে কেউ আর দাঁড়িয়ে নেই–সবাই বসে পড়েছে…নিস্তব্ধ চারিদিক..মধুর অশরীরী রহস্যময় মোহিনী সঙ্গীতলহরী কখনও উচ্চে, কখনও মৃদুসুরে একটানা বয়ে চলেচে…বিরাম নেই…বিরতি নেই, পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই তার বর্ণনা নেই…কতক্ষণ সময় কেটে গেল তার লেখাজোখা নেই–অনন্তকাল ধরে অমন সঙ্গীতপ্ৰবাহিণী গোমুখী নির্গত ভাগীরথীধারার মত বয়ে চলেচে…চলেচে। যতীনের মনের কোন্ গুপ্ত কক্ষের গভীর অনুভূতির দ্বার খুলে গেল। সে দেখতে পেলে তার পৃথিবীতে যাপিত আরও অনেক পূৰ্ব্ব জীবন…এই অনন্ত জীবনপ্রবাহে সে যুগযুগান্তর ধরে ভাবের ও প্রেমের স্রোতে বয়ে আসছে…আশা কি এক জন্মের আশা, না পুষ্প এক জন্মের পুস্প? কত যুগ ধরে ওরা যে ওর নিত্যসঙ্গিনী, ওর জীবনে ছন্দে গাঁথা ওদের জীবন-কতবার কত বিরহ-মিলন হাসি-অশ্রুর মধ্যে দিয়ে ওদের সঙ্গে কতবার দেখাশোনা, কতবার আবার ছাড়াছাড়ি–কত বিস্মৃত মরুদ্বীপে, কত শ্যামল পল্লীর কুঞ্জে কুঞ্জে, কত ক্ষুদ্র গ্রাম্য নদীর তীরের কুটীরে, কত পাহাড়ের। নীচেকার আদিম কালের গুহায়…কত রাজার রাজপ্রাসাদ..কত দশার্ণ গ্রামে ব্যাধরূপে, কত শারদ্বীপে ক্রৌঞ্চমিথুন রূপে, কত কুরুক্ষেত্রে বেদগায়ক ব্রাহ্মণরূপে।
যতীন দেখলে পুষ্প কাঁদচে…ও নীরবে পুষ্পের হাতে হাত দিয়ে তাকে নিজের কাছে সস্নেহে নিয়ে এল…
তারপর কখন সে অপূৰ্ব্ব সঙ্গীত থেমে গিয়েছে, বিচিত্ররূপী জ্যোতির্ময় জীবেরা মহাশূন্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েচেন…কখন জ্যোৎস্নার আলোতে সারা দেশ ভরে গিয়েচে যতীনের খেয়াল নেই…জ্যোৎস্না, জ্যোৎস্না…বহু পূর্ণিমার সম্মিলিত জ্যোৎস্নালোক চারিদিকে.. যতীন বল্লে–পুষ্প, চল ওঠো।