পুষ্প ও যতীন দুজনে নিজেদের বাড়ীর সামনে বাগানে বসে গল্প করচে। যতীন পুষ্পকে পৃথিবীতে যাওয়ার কথা কিছুই বলেনি। তবুও পুষ্প সব ব্যাপার জানে। পাছে মনে কষ্ট পায় এই জন্যে যতীনকে সে বলেনি যে সে জানে। হঠাৎ আকাশের এক কোণে নীল উজ্জ্বল আলো দেখা গেল–গঙ্গার এপার ওপার, ওদের বাড়ী, ঘর, বাগান, বুড়োশিবতলার ঘাট, এমন কি ওপারের শ্যামাসুন্দরীর ঘাট পর্যন্ত সে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। পুষ্প শশব্যস্তে দাঁড়িয়ে উঠে বল্ল দ্যাখো, দ্যাখো, কোনো দেবতা হচ্চেন চেয়ে দ্যাখো।–
পরক্ষণেই যতীনের মনে হোল একটা বিরাট প্রজ্বলন্ত উল্কা তাদের বাড়ীর অদূরে উন্মুক্ত বনজ লিলির ঝোঁপের ধারে এত প্রখর আলো বিকাশ করে এসে পড়লো যে, দুজনেরই চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল তীব্রতায়।
ওরা আশ্চর্য হয়ে ছুটে গিয়ে দেখলে যে এক মহাজ্যোতির্ময়দেহধারী পুরুষ ঝোঁপের ধারে বসে পড়েচেন। অমন মহিমময় শ্রী যে পৃথিবীর মানুষের হয় না–তা দুবার দেখে বুঝতে হয় না।
দুজনেই বিস্ময়ে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দূরে থেকে চেয়ে দেখছে, এমন সময় দেবতার নিকট থেকে পুস্পের নিকট পৰ্য্যন্ত একটা ম্যাজেন্টা রঙের আলোর চওড়া শিখা সাপের মত কুটিল বক্র আকৃতি ধরে একবার খেলে গেল। একটা বড় দশ ব্যাটারির টর্চের আলো কে যেন একবার টিপে তখনি বন্ধ করলে।
পুষ্প বুঝলে এটা কি। অতি উচ্চশ্রেণীর দেবতাদের বিদ্যুতের ভাষা!
পঞ্চম স্তরের সেই আত্মার কাছে পুষ্প একথা শুনেছিল।
তিনি বলেছিলেন, উৰ্দ্ধতন লোকে–নবম বা দশম স্তরের ওপরেও যে সব উচ্চ স্তর, সেখানে দেববিবর্তনের জীবেরা বাস করেন। মানুষের সৰ্ব্বপ্রকার ধারণার অতীত তাঁদের ক্রিয়াকলাপ–তাঁদের সে। বিরাট জীবনের সম্বন্ধে পৃথিবীর লোকই বা কি, সাধারণ প্রেতলোকের আত্মারাই বা কি, কোনো খবর জানে না। মুখের ভাষায় তাঁরা কথা বলেন না–তাঁদের প্রকাশের ভঙ্গি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আগুনের বা বিদ্যুতের ভাষায় চলে তাঁদের কথাবার্তা।
পুষ্প হাতজোড় করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। পুনরায় মহাব্যস্ত ও ক্ষিপ্র আর একটা তীব্র বিদ্যুৎ-শিখা ওকে এসে স্পর্শ করতেই ওর মনের মধ্যের চিন্তায় এই প্রশ্ন জাগলো–আমি কোথায়?
দেবতাকে দেখা যায় না। তাঁর স্থানে শুধু একটা আলোর মণ্ডলী পরিদৃশ্যমান। পুষ্প বল্লে–দেব, আপনি পৃথিবীর আত্মিক লোকে।
আবার বিদ্যুতের শিখা। পুষ্পের মনে পুনরায় প্রশ্ন জাগালো– পৃথিবী কি?
পুষ্প বল্লে–পৃথিবী একটা ক্ষুদ্র গ্রহ, সূর্যের চারিদিকে ঘোরে।
পুষ্পের এ কথাগুলো কি ভাবে দেবতা বুঝলেন, পুষ্প জানে না। বোধ হয় এ উত্তরগুলো চিন্তারূপে দেবতার নিজের মনে জাগছিল। পৃথিবীর ভাষায় অনুবাদ করলে দুজনের কথাবার্তা খানিকটা নিম্নোক্তরূপ দাঁড়ায়। পুনরায় প্রশ্ন হোল
–বিশ্বের কোন্ অংশে?
পুষ্প বিপদে পড়ে একমনে সেদিনকার সেই দেবতাকে স্মরণ করলে। এ সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তার সাধ্যের অতীত।
আশ্চর্য্যের উপর আশ্চর্য্য! সেদিনকার সেই শৈলশিখরারূঢ় দেবতা তখনই তার সম্মুখে তাঁর জ্যোতির্ময় দেহ নিয়ে আবির্ভূত হোলেন। পুষ্প প্রণাম করে বল্লে–দেব, আমি সামান্যা মানবী। উনি যে প্রশ্ন করছেন, আমি তার কি উত্তর দেবো? আমায় বিপদ থেকে উদ্ধার করুন। তারপর সে দ্বিতীয় দেবতাটির, পানে কৃতজ্ঞতা ও বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তিনি সেদিন বলেছিলেন বটে ‘স্মরণ করলেই আমি আসবো,’ পুস্প একথা বিশ্বাস করেনি। সে মহা অপরাধী দেবতার কাছে ছি ছি, কি অবিশ্বাসী তার আত্মা!
কিন্তু এ চিন্তা চাপা পড়ে গেল আর এক আশ্চর্য ব্যাপারে। দুই দেবতার মধ্যে যেন তীব্র বিদ্যুৎশিখার ক্ষিপ্র আদানপ্রদান চলচে পৃথিবীর কোনো ঘটনার উপমাদ্বারাই তার স্বরূপ বোঝানো যাবে না। দুখানা বড় যুদ্ধজাহাজ যেন পরস্পর পরস্পরের ওপর তীব্র অক্সি হাইড্রোজেন আলোর সার্চলাইট বিক্ষেপ করচে! দুই বিরাট দেবতার কথাবার্তা চলছিল। পরে এই কথাবার্তা পৃথিবীর ভাষায় অনুবাদ করে পুষ্পের দেবতা-বন্ধু তাকে যা বলেছিলেন, তা এইরূপ
পুষ্পের দেবতাবন্ধু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন–আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনি কে দেব?
আগন্তুক দেবতা বল্লেন–আমি কোথায় আগে বলুন।
–পৃথিবীর আত্মিক লোকে।
–পৃথিবী কি?
–ক্ষুদ্র গ্রহ, সূৰ্য্য নামে একটা নক্ষত্রের চারিধারে ঘোরে।
–বিশ্বের কোন্ অংশে?
–এ প্রশ্নের কি জবাব দেবো? ছায়াপথ দ্বারা সীমাবদ্ধ যে নক্ষত্রজগৎ তারই এক অংশে। আপনি কোন্ অংশের অধিবাসী?
এর উত্তরে আগন্তুক দেবতা বল্লেন–আমার কথা শুনে হয়তো আপনি বিশ্বাস করবেন না। আমি বহু, বহু দূরের অন্য নক্ষত্রজগতের অধিবাসী। আমি বহু কোটি বৎসর পূৰ্ব্বে ভ্রমণে এবং নতুন দেশ আবিষ্কারে বেরিয়েছিলাম। আমার চৈতন্য যতদিন হয়েছে আমার মনে। এক অদম্য পিপাসা ছিল বিশ্বের প্রত্যন্ততম সীমা আবিষ্কার করবো। কি কি নতুন দেশ এতে আছে দেখবো। এতকাল ধরে বেগমান বিদ্যুতের অপেক্ষাও দ্রুততর গতিতে শুধু শূন্যে বেড়িয়ে বেড়াচ্চি। সম্প্রতি নক্ষত্রের, গ্রহের, নানা জগতের ও বিভিন্ন লোকের গোলকধাঁধার অরণ্যে দিশাহারা হয়ে এখানে শক্তিহীন, অবসন্ন ও বিমূঢ় অবস্থায় এসে পড়েচি। নক্ষত্র ও বস্তুজগৎ এখানে এত বেশী কেন? এ দুটি প্রাণী কোথাকার লোক?
–এই দুই জীব পৃথিবীর তৃতীয় স্তরের অধিবাসী। পুরুষটি সম্প্রতি বস্তুস্তর থেকে আত্মিক স্তরে এসেচে। ওরা নিতান্ত নিরীহ, অজ্ঞ। মেয়েটি কিছু উন্নত–তাও জ্ঞানে, নয়, প্রেমে।
যতীন এতক্ষণ শ্রদ্ধায় ভয়ে ও গভীর বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে পিছন দিকে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এই কথাবার্তার বিন্দুবিসর্গও বুঝছিল না–তার মনে অত উচ্চ দেবাত্মাদের চিন্তা প্রতিফলিত হবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। পুষ্প ওর দিকে চেয়ে কথা বলতে সে বুঝলে যে তার সম্বন্ধে কোনো কথা বলা হচ্চে। সে এগিয়ে এসে প্রণাম করে চুপ করে রইল। এত বড় জ্যোতির্ময় আত্মা সে আর কখনো দেখেনি। দেবতা বল্লেন–উঃ কোথায় এসে পড়েচি। বিশ্বের কোন অংশে যে আছি তা কিছুই বুঝতে পারচি নে। তুমি কোন্ একটা গ্রহের নাম করলে? যে নক্ষত্রটার চারিধারে ঘোরে সেটা আমি নতুন দেখলাম। নক্ষত্রটা খুব বড় নক্ষত্রের দলে পড়ে না। এবং ওর আলোও পরিবর্তনশীল, আমি বার কয়েক ওর আলোকে বাড়তে-কমতে দেখেচি। ওর নাম কি বল্লে–সূৰ্য্য!
পুষ্প তার নিজের চিন্তার কিছু অংশ এবার যতীনের মনে চালনা করলে। সে বেচারী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, বুঝচে না কোন্ ভীষণ মহাপুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে পুষ্প পোড়ারমুখী কথা বলছে। জানুক ও বুঝুক কিছু।
পুষ্পের মনের মধ্যে দিয়ে ওদের কথাবার্তা যতীন বুঝতে পারলে এবং বুঝে অবাক হয়ে গেল। পুষ্প ভাবছিল–এ আবার কত উচ্চস্তরের, কি ধরনের লোক রে বাবা, যে সূর্যের নামটাই শোনেনি কখনো, পৃথিবী তো দূরের কথা!
কথাটা মনে হয়ে তার বড় হাসি পেল। ছিঃ–হাসি সামলে নিয়ে সে বল্লে–আপনার কথা শুনতে বড় আগ্রহ হচ্চে। আপনি আমাদের বাড়ীতে বসে একটু বিশ্রাম করুন। আর দয়া করে বলবেন কি, কি দেখলেন এতকাল ধরে?
আগন্তুক ওদের বাড়ীর বাইরে পাথরের বেঞ্চিতে এসে বসলেন।
যতীন সম্ভ্রমে উদভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে হঠাৎ বিনীতভাবে বলে বসলো, একটু চা খাবেন কি সার?
পুষ্প মুখে আঁচল চাপা দিয়ে অতিকষ্টে হাসি দমন করে বল্লে–কি যে তুমি করো যতুদা! পৃথিবীর অভ্যেস তোমার এখনও গেল না। চা খাবে কে? আর ‘সার’ বলচো কাকে?
যতীন অপ্রতিভ হয়ে অধিকতর বিনীত ভাব ধারণ করলে।
এই দুই নবদৃষ্ট আত্মার কান্ড দেখে আগন্তুক দেবতার মন কৌতুকে ও আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠলো। কোথাকার জীব এরা, অথচ দ্যাখো কি সুন্দর হাসে! মহামহেশ্বরের বিচিত্র সৃষ্টি শুধু বিরাটতার দিক থেকেই নয়, আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য্যেও এর কি রহস্যময় মূর্তি। এরা কেন হাসছে, কি নিয়ে কথা বলছে তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। আর একটা কথাও তিনি বোঝেননি, তাই এখন পুষ্পকে প্রশ্ন করলেন–গ্রহের জড়লোক আর আত্মিকলোক কি বলছো, বুঝতে পারলাম না তো? কি সেটা?
পুষ্প বল্লে–প্রভু, আমরা যখন পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করি, তখন। আমাদের দেহ অন্য পদার্থ দিয়ে তৈরী হয়। সে দেহ স্থল, সেখানকার সব জিনিসই সেই ধরনের স্থল পদার্থে গড়া। তারপর একটা সময়। আসে, যখন সেই স্থূল দেহটা নষ্ট হয়ে যায়–তখন আমরা এই আত্মিক লোকে আসি। কেন, প্রভু, আপনি কি এ জানেন না?
দেবতা বল্লেন–শুনেচি বটে এমন হয় কোনো কোনো গ্রহের জীবের ক্ষেত্রে, আমার অভিজ্ঞতা নেই। আমায় সেখানে একবার নিয়ে যাবে তোমাদের এই পৃথিবী গ্রহের জড়লোকে?
–কিন্তু সেখানে আপনি যেতে পারবেন দেব অত স্থূল রাজ্যে?
দেবতা হেসে বল্লেন–আমি পথিক। কত বিরুদ্ধ ভাবের মধ্যে দিয়ে চলা অভ্যেস করতে হয়েছে আমাকে, তবে বিশ্বভ্রমণ করা সম্ভব হয়েছে। নইলে তোমাদের এই যে যাকে বলচো আত্মিকলোক, এখানেই কি আমি আসতে পারতাম? জড়বস্তুর নিবিড় প্রকাশ আত্মার ক্ষেত্রে আমি দেখেচি অন্য অনেক গ্রহে। চল, যাই।
একটু পরে ওরা তিনজনে পৃথিবীর দিকে চললো। পৃথিবীর নিকটে এসে দেবতা বল্লেন–উঃ, মেঘের মত কি সব বিশ্রী চিন্তার ধোঁয়া চারিদিকে! তোমরা দেখতে পাচ্ছ না?
যতীন তো কিছুই দেখতে পায় না–পুষ্প জানে, পৃথিবীর মানুষের পাপের ও দুঃখের নানারকম চিন্তার মেঘ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে জমা হয়ে মাঝে মাঝে পৃথিবীতে যাতায়াতের সময় তাকে কষ্ট দিয়েছে। তবুও সে পৃথিবীরই জীব, তার ততটা কষ্ট হয় না, যতটা ইনি পাবেন।
যেখানে ওরা গিয়ে নামলো সেটা ভারতবর্ষের বিহার অঞ্চলের একটা ছোট গ্রাম। মহিষদল মাঠে চরাচ্চে রাখালরা। তিনজন মেয়েমানুষ একটা ভুট্টাক্ষেতের ধারে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করচে। পৃথিবীতে ভাদ্রমাস। শরতের বেশ পরিষ্কার নীল আকাশ, বন্যার জল এসে নেমে গিয়েছে, গ্রামের মধ্যে গৃহস্থবাড়ীর উঠানে পচা কাদা। একটা বাড়ীতে মকাই এর মরাই-এর মধ্যে জল ঢুকে মকাই-এর দানা পচিয়ে ফেলেছে বলে বাড়ীর মেয়েরা মকাইগুলো নামিয়ে ঝাড়চে।
দেবতা বল্লেন–কি আশ্চর্য্য! এদের গতি এতটুকু জায়গায় সীমাবদ্ধ! এর চেয়ে দ্রুত যেতে পারে না?
কাটিহার থেকে মুঙ্গেরগামী একখানা ট্রেন এসে পড়লো। দেবতা। বিস্ময়ের সুরে বল্লেনও ব্যাপারটা কি?
–মানুষে ওই গাড়ীটা তৈরি করেছে। ওকে বলে রেলগাড়ী। খুব জোরে মানুষকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যায়, প্রভু।
দেবতা কৌতুকের দৃষ্টিতে চেয়ে বল্লেন–ওই কি দ্রুত যাওয়ার নমুনা? নমুনা দেখে তো খুব আশা হয় না এদের দ্রুতগামিতার ভবিষ্যৎ ইতিহাস সম্বন্ধে। ওর নাম কি জোরে যাওয়া?
এক জায়গায় দুটি ছোট ছেলেমেয়ে ভুট্টাক্ষেত থেকে ভুট্টা চুরি করে খাতে গিয়ে ক্ষেত্র স্বামীর হাতে পড়ে খুব মার খাচ্ছে দেখে দেবতা বল্লেন–আহা, কচি ছেলেমেয়ে দুটিকে অমন করে মারচে কেন? পরে তিনি ক্ষেত্রস্বামীর মনে সদয় চিন্তা বিক্ষেপ করতে চেষ্টা করলেন। স্কুল দেহের স্থূল মনে প্রথমেই কোনো কার্যকরী হোল না–কিন্তু অসাধারণ শক্তিশালী দেবতার মনের জোরে তাকে সৎ চিন্তার প্রেরণা স্পর্শ করলে। সে ছেলেমেয়ে দুটিকে ছেড়ে দিয়ে বল্লে–আচ্ছা, যা নিয়েচিস্ যা তা এবারকার মত নিয়ে যা–আর কখনো আসিসনে।
দেবতা বল্লেন–আহা, এদের তো বড় কষ্ট! কি অদ্ভুত এই সৃষ্টি! যত দেখছি ততই এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। আমার কি ইচ্ছে হচ্চে জানো–এদের মধ্যে মানুষ হয়ে থাকি। এদের দুঃখ দূর করবার। চেষ্টা করি।
পুষ্প বল্লে–দেব, নিকটের এই পাহাড়ের চূড়াটাতে বসে আপনার ভ্রমণের গল্প একটু করবেন দয়া করে? শুনবার বড় ইচ্ছে হচ্চে।
ভাদ্র মাসের গঙ্গা কূলে কূলে ভরা। বিকেল হয়েছে। পশ্চিম দিগন্তে জামালপুরের পাহাড়ের পিছনে রঙীন্ মেঘস্কৃপের আড়ালে সূর্য অস্ত যাচ্চে।
পাহাড়ের মাথায় ছোট ছোট জঙ্গল। একটা ফাঁকা জায়গায় বন্য হরীতকী গাছের তলায় ওরা বসলো। নীচে গঙ্গার ধারে একটা পাট বোঝাই ভড়ের মাঝিমাল্লারা রান্নাবান্নার উদ্যোগ করছিল। যতীন ভাবছিল–এই তো বৃহত্তর জীবন, মৃত্যুর পরে যা সে লাভ করেছে। কোথায় বাংলাদেশের এক ছোট্ট গ্রামে সে ছিল বন্দী, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেল তার জীবন–পৃথিবীর অতীত কত লোকে কত স্তরে এমনি কত নিস্তব্ধ শরৎ দুপুরে, অপরাহ্নে, কত বসন্তদিনের আসন্ন বেলায়, কত জ্যোৎস্নারাত্রিতে তার ইচ্ছামত অভিযান ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে জমা রয়েছে! এমন সব সখের দিনে শুধু মনে হয় সেই হতভাগী–
দেবতা তাঁর ভ্রমণের কাহিনী বলতে লাগলেন।
সে ভারি চমৎকার কথা। তাঁর সব কথা পুষ্প বা যতীন বুঝতে পারছিল না তবুও তারা মুগ্ধ হয়ে গেল তাঁর উৎসাহদীপ্ত মুখের ভঙ্গীতে, কথার সুরে। কত লক্ষ বৎসর পূর্বে তিনি বেরিয়েছেন বিশ্বভ্রমণে। কত গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্রজগৎ, কত ছায়াপথ, নীহারিকাপুঞ্জ মানসগতিতে ভ্রমণ করেছেন। আলো বা বিদ্যুতের সেখানে পৌঁছতে লক্ষ লক্ষ বৎসর লাগে–সে সব সুন্দর নক্ষত্রমন্ডলী পার হয়েও লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের অঞ্চলে চলে গিয়েছেন–তখনও দেখেছেন বহু দুরে আর এক অজানা বিশ্বের সীমা মহাশূন্যের প্রান্তে আবছায়া দেখা যায়। আবার সে বিশ্বেও পৌঁছেচেন, আবার অগণিত নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, নীহারিকারাজির মধ্যে দিয়ে দেবতার অমিত গতিতে বহু শত বৎসর ধরে ছুটে গিয়ে যেমন তার সীমা ছাড়িয়েছেন, আবার দূরে দেখতে পেয়েচেন আর এক রহস্যময় অজ্ঞাত বিশ্বের ক্ষীণ সীমান্তবর্তী ক্ষীণালোক তারকামণ্ডলী। কত প্রজ্বলন্ত নক্ষত্র, কত স্বয়ম্প্রভ বাষ্পমন্ডলী লক্ষ লক্ষ যোজন। গ্রহনক্ষত্রের গোলকধাঁধার মধ্যে কিছু দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন।
পুষ্প বল্লে–আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন?
দেবতা বল্লেন–তা অসম্ভব। এই গ্রহের বিভিন্ন আত্মিক স্তর ছেড়ে তোমরা কোথাও যেতে পারবে না। এর আকর্ষণে টেনে রাখবে। সে দেহ তোমাদের তৈরী হয়নি। তবে আর কিছুকাল অপেক্ষা কর। কাছাকাছি বহু অদ্ভুত জগৎ আছে, সেখানে তোমাদের নিয়ে যাবো; আমায় স্মরণ ক’রো না–তাতে আমি আসবো না। যখন তোমরা তার উপযুক্ত হয়েচ বুবঝো–আমি নিজেই আসবো। এখন আমি যাই। আর একটা বিষয়ে সাবধান থেকো, তোমরা দেখতে পাচ্চ না, আমি পাচ্চি, তোমাদের এই গ্রহটার চারিদিক ঘিরে একটা বিরাট শক্তিশালী চৌম্বক ঢেউ বইছে, সেটা সব সময় তোমাদের ঐ পৃথিবীর দিকে টানচে। এই ঢেউ-এ পড়লে ঘুরিয়ে নিয়ে এসে ঐ পৃথিবীর জড়লোকে তোমাদের ফেলে পুনরায় জড়দেহ ধারন করতে বাধ্য করবে। এটাকে পুনর্জমের ঢেউ বলা যেতে পারে। খুব সাবধান। বিশ্বের সীমা আবিষ্কার করবার যার আগ্রহ, সে যেন ক্ষুদ্র গ্রহের স্থূলস্তরে আবার স্কুল জড়দেহ ধারণ করে।
পুষ্প ও যতীন দুজনে প্রণাম করলে। পুষ্প বল্লে–আবার যেন। আপনার দেখা পাই, দেব।
পরমুহূর্তে দেবতা অন্তর্হিত হলেন।
পুষ্প বল্লে–দেখলে তো? শুনলে? ওই সেই চুম্বকের ঢেউ। আমাকে এক দেবতা বলেছিলেন অনেক দিন আগে। তোমাকে একবার পঞ্চম স্তরে নিয়ে যেতে যেতে বিপদে পড়েছিলুম, তুমি অজ্ঞান হয়েছিলে– মনে আছে? সেইবার তাঁর সঙ্গে দেখা।