১০. ভবিষ্যৎ

ভবিষ্যৎ

30. টাইম মেশিন

সময় সম্পর্কে আমাদের ধারণা আইনস্টাইন পাল্টে দিয়ে গিয়েছিলেন। একসময় ধারণা করা হতো সময় সবার জন্যে এক। আমার বয়স যদি এক বৎসর বাড়ে তাহলে আমার বন্ধু আমার পরিচিত সব মানুষজন এমনকি অপরিচিত সব মানুষের বয়সও এক বৎসর বেড়ে যাবে! কিন্তু আইনস্টাইন দেখিয়েছেন সেটা সত্যি নয়, যে মানুষটি বেশি ছোটাছুটি করছে তার বয়স একটু হলেও কম বেড়েছে, কারণ সময় সবার জন্যে এক নয়, যার যার সময় তার কাছে। আমরা বিষয়টা ধরতে পারি না কারণ পৃথিবীর মানুষ যারা ছোটাছুটি করে তাদের গতিবেগ খুবই কম, সুপারসনিক প্লেনে বড় জোর তারা শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে যেতে পারে। কিন্তু সময়ের এই ব্যাপারটা চোখে পড়তে হলে একজনকে আলোর বেগের কাছাকাছি ছোটাছুটি করতে হবে। একজন মানুষ আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে যেতে পারে না কিন্তু অনেক মহাজাগতিক কণা সহজেই সেটা পারে। এর সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণ হচ্ছে মিউওন, মহাজাগতিক কণা বায়ুমণ্ডলের উপরে আঘাত করে এই মিউওনের জন্ম দেয়। মিউওনের আয়ু খুবই কম। এই কম সময়ের ভেতরে একটা মিউওনের পুরো বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীর পৃষ্ঠে উপস্থিত হওয়ার কোনো উপায় নেই, কিন্তু এটি সব সময় ঘটে থাকে (আমি একটা টাইম প্রজেকশন চেম্বার তৈরি করেছিলাম, সেখানে বসে বসে কংক্রীটের ছাদ, পুরু সীসার আস্তরন, ধাতব দেওয়াল সবকিছু ভেদ করে আসা মিউওনগুলো দেখতাম) বায়ুমণ্ডলের উপর থেকে পৃথিবীর পৃষ্ঠে আসতে যেটুকু সময় দরকার সেই সময়টুকু বেঁচে না থেকেই মিউওন কেমন করে চলে আসে তার ব্যাখ্যা খুবই সহজ। মিউওন তার হিসেবে বেঁচে থাকে ক্ষুদ্র একটি সময়, কিন্তু আমাদের সময়টি মিউওনের ব্যক্তিগত সময় থেকে ভিন্ন। যেটি অনেক দীর্ঘ। এই সময়ের ভেতর মিউওন দিব্যি বায়ুমণ্ডলের উপর থেকে পৃথিবী-পৃষ্ঠে চলে আসতে পারে।

সময় সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল দীর্ঘদিনের। টাইম মেশিনে করে সময় পরিভ্রমণ করা সম্ভব কিনা সেটা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন। সময় পরিভ্রমণ করে ভবিষ্যতে চলে যাওয়াটা তুলনামূলকভাবে সহজ। কেউ যদি একটা মহাকাশযানে করে প্রচণ্ড বেগে (আলোর বেগের কাছাকাছি) ছয় ঘণ্টা ভ্রমণ করে কোথাও যায় তারপর দিক পরিবর্তন করে আবার ছয় ঘণ্টা ভ্রমণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসে, তা হলে সে দেখবে পৃথিবীতে হয়তো দশ বছর হয়ে গেছে। অর্থাৎ, সে দশ বছর ভবিষ্যতে চলে গেছে। এটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর বিষয় নয়–এটি আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির ভবিষ্যদ্বাণী।

কিন্তু অতীতে কী যাওয়া সম্ভব? শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু টাইম মেশিনে করে সময় পরিভ্রমণ করার ওপরে একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে। কিপ থর্ন(১) নামে একজন পদার্থবিজ্ঞানী এই বিষয়ের উপর একটা গবেষণাপত্র (Wormholes, Time Machines, and The weak Energy Condition, Physical Review, Le Hers, 61, 1446, 1488) প্রকাশ করেছেন, যেটি সময় পরিভ্রমণের মতো একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বিষয়কে বৈজ্ঞানিক বিষয়ে পরিণত করেছে।

সময় পরিভ্রমণ করে অতীতে যাওয়ার বিষয়টি বোঝার আগে ওয়ার্ম হোল নামের বিষয়টি আগে বুঝতে হবে। ওয়ার্ম হোল হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দুটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গার ভেতরে একটি শর্ট কাট। ত্রিমাত্রিক জগতের ভেতরে একটি ওয়ার্মহোল কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু আমরা যদি বোঝার সুবিধার জন্যে ত্রিমাত্রিক জগৎটিকে দ্বিমাত্রিক জগৎ হিসেবে কল্পনা করে নিই তাহলে বিষয়টা বোঝা সহজ হয়। 30.2 নং ছবিতে এ-রকম একটি ওয়ার্মহোল দেখানো হয়েছে। সব ওয়ার্মহোলের দুটি মুখ থাকে, ছবিতে দেখানো হয়েছে এই ওয়ার্মহোলের একটি মুখ পৃথিবীর কাছাকছি। অন্য মুখটি 26 আলোকবর্ষ (সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার বেগে আলো এক বৎসরে যে পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করে সেটি হচ্ছে এক আলোকবর্ষ দূরে ভেগা নক্ষত্রের কাছাকাছি। ওয়ার্মহোল ব্যবহার না করে কেউ যদি পৃথিবী থেকে ভেগা নক্ষত্রে যেতে চায় তাহলে তার ছাব্বিশ আলোকবর্ষ দূরে যেতে হবে। কিন্তু সে যদি ওয়ার্মহোলের ভেতরের টানেলটি দিয়ে যেতে চায় সে হয়তো মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে সেই একই জায়গায় পৌঁছে যাবে। এই টানেলটা হাইপার স্পেস ব্যবহার করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দুটি ভিন্ন জায়গার ভেতর একই শর্টকার্ট তৈরি করে দিয়েছে।

কেউ যেন মনে না করে ওয়ার্মহোলের এই বিষয়গুলো গালগল্প। আইনস্টাইনের সূত্রের সমাধান করে 1916 সালে প্রথমে এর অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। আইনস্টাইন, রোজেন, হুইলারের মতো বড় বড় বিজ্ঞানীরা এর উপর গবেষণা করেছেন। টাইম মেশিন তৈরি করতে এ-রকম একটা ওয়ার্মহোল তৈরি করতে হবে। এই মুহূর্তে ওয়ার্মহোলের অস্তিত্ব হয়তো কাগজ-কলমে (বড় জোর কম্পিউটারের) সীমাবদ্ধ কিন্তু দূর ভবিষ্যতে মানুষ যখন জ্ঞানে বিজ্ঞানে প্রায় লাগাম ছাড়া উন্নতি করে ফেলবে তখন হয়তো তারা ইচ্ছেমতো ওয়ার্ম হোল তৈরি করতে পারবে। মানুষ যখন সেরকম পর্যায়ে পৌঁছে যাবে তখন তারা একটা টাইম মেশিন তৈরি করার কথা ভাবতে পারবে।

এটা তৈরি করার জন্যে প্রথমে দরকার হবে একটা মহাকাশযানের। তারপর একটা ওয়ার্ম হোল তৈরি করে তার একটা মুখ রাখতে হবে মহাকাশযানের ভেতরে, অন্যটা থাকবে ধরা যাক কারো ঘরের বৈঠকখানায়। টাইম মেশিন তৈরি করার প্রস্তুতি শেষ এখন সেটা ব্যবহার করা শুরু করা যেতে পারে। বিষয়টা বোঝার জন্যে আমরা কল্পনা করে নেই ঘরের বৈঠকখানায় একজন এসে বসেছে, তার নাম মৃত্তিকা। আর যে মহাকাশযানে বসে আছে তার নাম হচ্ছে আকাশ। এখন আমরা দেখি টাইম মেশিন চালু করার সময় মৃত্তিকা আর আকাশ কে কী বলবে :

মৃত্তিকা : “আমি বসে আছি আমার বৈঠকখানায়। ঘরের বাইরেই দেখতে পাচ্ছি মহাকাশযানটি দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে আছে আকাশ। সত্যি কথা বলতে কি আমি আমার বৈঠকখানার ভেতরে ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে মহাকাশযানের ভেতরে দেখতে পাচ্ছি। এই ওয়ার্মহোলটা কয়েক সেন্টিমিটার লম্বা। আমি এর ভেতর দিয়ে আমার হাতটা ঢুকিয়ে আকাশকে ধরতে পারি। আমি আর আকাশ ঠিক করেছি মহাকাশযানটা যখন রওনা দেবে আমরা একজন আরেকজনের হাত ধরে রাখব।”

আকাশ : “আমি আর মৃত্তিকা একজন আরেকজনের হাত ধরে রেখেছি। আজকে 3000 সালের জানুয়ারি মাসের এক তারিখ । ঠিক সকাল নয়টার সময় মহাকাশযানটি রওনা দেবে। আমি ঠিক করেছি প্রচণ্ড গতিবেগে, প্রায় আলোর গতিবেগের কাছাকাছি ছয়ঘণ্টা ছুটে যাব। তারপর পৃথিবীর দিকে ফিরে আসতে থাকব পরের ছয় ঘণ্টায়। অর্থাৎ, সকাল নয়টায় রওনা দিয়ে ঠিক রাত নয়টার মাঝে ফিরে আসব।”

মৃত্তিকা : “এখন বাজে ঠিক নয়টা, মহাকাশযানটি আকাশকে নিয়ে মহাকাশে ছুটে যেতে শুরু করেছে। যেহেতু ওয়ার্মহোলটি মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার লম্বা আমি এখনো আকাশকে

ধরে রাখতে পারছি কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সত্যি কথা বলতে কি আমি ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আকাশকে দেখতেও পাচ্ছি। আকাশ মহাকাশ ভ্রমণ করে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি তার হাত ধরে রাখব। অর্থাৎ, বারো ঘণ্টা তার হাত ধরে থাকতে হবে।”

আকাশ : “আমি ছয় ঘণ্টা আলোর বেগের কাছাকাছি গতিবেগে আমার মহাকাশযানে ছুটে গিয়েছি। তারপর মহাকাশযানের দিক পরিবর্তন করে আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছি। আমি যখন রওনা দিয়েছিলাম তখন আমার মহাকাশযানের ঘড়িতে বেজে ছিল সকাল  নয়টা। আমি যখন ফিরে এসেছি তখন আমার ঘড়িতে বাজে রাত নয়টা।”

মৃত্তিকা : “আমি ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আকাশ যে মহাকাশযান দিয়ে ভ্রমণ করে এসেছে সেই ঘড়িটাতে এখন বাজে রাত নয়টা। বারো ঘণ্টা টানা আমরা হাত ধরে রেখেছিলাম। এখন হাতটা ছেড়ে দিই। আমার হাতের ঘড়িতেও বাজে রাত নয়টা। এতক্ষণ আমি ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে আকশকে দেখছিলাম। এখন তার হাত ছেড়ে দিয়েছি, ঘড়িতে বাজে রাত নয়টা এক মিনিট, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছি। কী আশ্চার্য! মহাকাশযানটি তো নেই, গেল কোথায়?

“আমার একটি খুব ভালো টেলিস্কোপ আছে, সেটা দিয়ে মহাকাশে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে দেখলাম মহাকাশযানটি ছুটে যাচ্ছে!”

“তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। শুধু দিন নয়, সপ্তাহ কেটেছে মাস কেটেছে এমনকি বহুর কেটেছে। আমার বয়স বেড়েছে দশ বছর। চুলে একটু পাক ধরেছে, মুখের চামড়ায় বয়সের রেখাও পড়েছে।

“ঠিক দশ বছর বছর পর 3010 সালের জানুয়ারি মাসের এক তারিখ হঠাৎ দেখি গর্জন করে আকাশের মহাকাশযানটি আমার বৈঠকখানার কাছে নেমে এসেছে। আমি ছুটে গিয়েছি দেখি মহাকাশযানের ভেতরে আকাশ একজনের হাত ধরে বসে আছে। আমার দশ বৎসর বয়স বেড়েছে কিন্তু আকাশের বয়স বেড়েছে মাত্র বারোঘণ্টা। আমি আকাশকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি কার হাত ধরে রেখেছ? সে বলল, কেন তোমার? আমি মহাকাশযান ওঠে তার ওয়ার্মহোলের মুখে উঁকি দিয়ে দেখি সত্যি সত্যি সে একজন মানুষের হাত ধরে রেখেছে। মানুষটি আর কেউ নয়, মানুষটি স্বয়ং আমি। দশ বৎসর আগে যেমন ছিলাম!

“আমি ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে বৈঠকখানায় এসে হাজির হয়েছি। আমি দেখছি আমার নিজেকে। দশ বৎসর আগে আমি ফিরে গেছি আমার নিজের কাছে!”

আমি জানি পুরো ব্যাপারটি একটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়–কিন্তু এটা ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন একটি জার্নালে প্রকাশিত একটা প্রবন্ধের মূল বিষয়। সেখানে যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে সেটা আসলে ঠিক এ-ধরনের একটা সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে।

বলা বাহুল্য এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবার পর সারা পৃথিবীতে প্রবল হইচই শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানীরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখছেন। এটি আসলে সম্ভব নাকি অন্য কিছু ঘটে যেতে পারে সেটা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা পাল্টা আলোচনা চলছে। স্টিফেন হকিংও এর উপরে মন্তব্য করেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন একটি ওয়ার্মহোল ঠিক যখন টাইম মেশিন হিসেবে কাজ করতে শুরু করে তখন ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশান (Vacuam Fluctuation) এর ক্রম আবর্তনের কারণে সেটি ধ্বংস হয়ে যাবে! সেটি কি সত্যি, নাকি আসলেই টাইম মেশিন তৈরী করা সম্ভব সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো কেউ জানে না। কোয়ান্টাম গ্রেভিটি সম্পর্কে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আরো ভালো করে না জানা পর্যন্ত কেউই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না!

আমাদের সেই জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।

————-
১. Black Holes and Time warps, Kip S. Thorne. (আমি যখন ক্যালটেকে ছিলাম কিপ থর্ন ঠিক আমার ফ্লোরের কাছাকাছি ছিলেন, আমার অফিসের খুব কাছেই ছিল তার অফিস। কিপ থর্ন বাজী ধরতে খুব পছন্দ করতেন। তার অফিসের দেওয়ালে পৃথিবীর বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীদের সাথে বাজী ধরে বিচিত্র সব অঙ্গীকারনামা তৈরি করে টানিয়ে রাখতেন। কিপ থর্ন খুব আমুদে একজন মানুষ!)

.

31. আমরা কি একা?

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষ ছাড়াও অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী আছে কিনা এই বিষয়টি থেকে অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে নিউট্রিনোর ভর আছে কিনা এবং যদি থেকে থাকে সেটা কত। কিন্তু আমি বাজী ধরে বলতে পারি নিউট্রিনোর ভর বিষয়ক আলোচনা হলে সাধারণ মানুষ হাই তুলে অন্য একটা বিষয়ে চলে যাবেন। কিন্তু এই সৃষ্টিজগাতে মানুষ ছাড়া অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী আছে কী না সেটা নিয়ে আলোচনা হলে নিশ্চিতভাবে কৌতূহলী হয়ে আলোচনাটি শুনবেন।

পৃথিবীর মানুষের এই বিষয় নিয়ে কৌতূহল অনেক দিনের। একসময় ধারণা করা হতো সূর্যের প্রখর উত্তাপ বাইরে, ভেতরে পৃথিবীর মতো শান্তিময় পরিবেশ। সেখানে বুদ্ধিমান প্রাণীরা বসবাস করে। সূর্যের গঠনটা বুঝে নেবার পর এখন আর সেটা কেউ বিশ্বাস করে না। পৃথিবীর কাছাকাছি ছোট গ্রহগুলো হচ্ছে বুধ, শুক্র, পৃথিবী এবং মঙ্গল। পৃথিবীতে আমরা সবাই আছি এবং সব সময়েই কল্পনা করছি অন্য গ্রহগুলোতে হয়তো আমাদের মতো কেউ আছে। এখন আমরা জেনেছি ভয়ংকর উত্তপ্ত বুধ গ্রহে প্রাণের বিকাশ ঘটা সম্ভব না। শুক্র গ্রহও মেঘে ঢাকা উত্তপ্ত প্রাণ সৃষ্টির অনুপযোগী একটা গ্রহ। মঙ্গল গ্রহ প্রতিযোগিতায় খুব দুর্বলভাবে টিকে আছে। বড় বড় চোখ, কিলবিলে হাত পা, ধারালো দাঁত এই ধরনের পূর্ণ বিকশিত প্রাণীর আশা সবাই ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু জীবাণু আকারের কিছু একটা আছে কী না কিংবা এখন না থাকলেও অতীতে কখনো ছিল কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা এবং গবেষণা মাঝে মাঝেই চাঙ্গা হয়ে উঠে।

মানুষ ছাড়া সৃষ্টি জগতে অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী আছে কিনা সেটা নিয়ে মানুষের কৌতূহল যুক্তিসম্মত এবং সেটা বের করার জন্যে একটি প্রতিষ্ঠানও আছে, তার নাম Search for Extra Terrestrial Intelligence সংক্ষেপে SETI এবং তারা কোটি কোটি ডলার খরচ করে মহাজগতে ক্রমাগত প্রাণের সন্ধান করে যাচ্ছে। মূলত মহাজগৎ থেকে যে বিভিন্ন ধরনের সংকেত আসে তার মাঝে কোনো প্যাটার্ন বা বুদ্ধিমত্তা আছে কিনা সেটাই খোঁজা হয়। ধারণা করা হয়, যদি সেরকম কিছু পাওয়া যায় বুঝে নিতে হবে সেটা পাঠাচ্ছে।

কোন বুদ্ধিমান প্রাণী। এটা নিয়ে অনেক বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখা হয়েছে। কিন্তু এখনো কিছু পাওয়া যায় নি। তবে বিজ্ঞানীরা যে মহাজাগতিক প্রাণী বলে কিছু নেই সেটা পুরাপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন তা নয়। ভয়েজার মহাকাশযানগুলো আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলো পর্যবেক্ষণ করে সৌরজগতের বাইরে চলে গেছে। সেখানে মানব-মানবীর ছবিসহ আরও অনেক কিছু পাঠানো হয়েছে, কোনো একটি বুদ্ধিমান প্রাণী কোনো একদিন সেটা খুঁজে পাবে সেই আশায়!

পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও প্রাণ খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সেটা নিয়ে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা করা হয় নি, তা নয়। এর মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ড্রেকের সমীকরণ। এই সমীকরণে বলা হয়েছে এই মুহূর্তে যে কয়টি বুদ্ধিমান প্রাণীর জগৎ থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে তার সংখ্যা N হচ্ছে : N = RxPxEXLxIxT

এখানে R হচ্ছে গ্যালাক্সিতে নক্ষত্রের সংখ্যা, P হচ্ছে একটা নক্ষত্রকে ঘিরে গ্রহ পাবার সম্ভাবনা, E হচ্ছে এ-রকম গ্রহ থেকে থাকলে প্রাণ বিকাশের উপযোগী গ্রহের সংখ্যা, L হচ্ছে প্রাণ বিকাশের উপযোগী থেকে থাকলে তার ভেতরে সত্যি সত্যি প্রাণের বিকাশ হবার সম্ভাবনা, I হচ্ছে সত্যি সত্যি প্রাণের বিকাশ হয়ে থাকলে সেগুলো বিবর্তনে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উন্নত হয়ে অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করার মতো বুদ্ধিমত্তা অর্জনের সম্ভাবনা এবং T হচ্ছে যে সময় পর্যন্ত সেই বুদ্ধিমান প্রাণী টিকে থাকতে পারে। এর কিছু-কিছু সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের বেশ ভালো ধারণা আছে, কিছু-কিছু অনুমান করতে হয়। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী কার্ল সাগান ড্রেক সমীকরণ ব্যবহার করে দেখিয়েছেন এই গ্যালাক্সিতেই লক্ষ লক্ষ বুদ্ধিমান প্রাণীর সভ্যতার জন্ম হওয়ার কথা। আবার অনেক বিজ্ঞানী সেটা মোটেও বিশ্বাস করতে রাজী নন, তাদের ধারণা ড্রেকের সমীকরণ ব্যবহার করে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ত্ব প্রমাণ করা এত সোজা না। আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী হচ্ছেন এনরিকো ফার্মি, তিনি ড্রেকের সমীকরণ দেখে বিখ্যাত ফার্মির বিভ্রান্তি জন্ম দিয়েছিলেন, সেটা এরকম :

(ক) সত্যি যদি মহাজগতে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ত্ব থেকে থাকত তাহলে এতদিনে তাদের পৃথিবীতে দেখা পাওয়ার কথা।

(খ) তাদের যদি পৃথিবীতে দেখা না পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে মহাকাশযান তৈরি করে পৃথিবীতে আসার তাদের কোনো গরজ নেই।

(গ) সেটা যদি সত্যি না হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে এই বুদ্ধিমান প্রাণীর সভ্যতা খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাদের জন্ম হয় এবং কিছু বোঝার আগেই তারা নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলে!

এনরিকো ফার্মি যে খুব চিন্তাভাবনা করে তার এই বিভ্রান্তিটির জন্ম দিয়েছিলেন তা নয়, বলা হয়ে থাকে দুপুরের খাবার খেতে খেতে ঠাট্টার ছলে কথাগুলো বন্ধুদের বলেছিলেন এবং এখন যারাই মহাজাগতিক প্রাণী নিয়ে চিন্তাভাবনা করে তার কোনো না কোনোভাবে এনরিকো ফার্মির বিভ্রান্তির কথা জানে। প্রথম দুটোর কথা ছেড়ে দিয়ে আমরা তৃতীয়টা নিয়ে একটু ভাবতে পারি।

আমরা মানুষেরা নিজেদের খুব উন্নত এবং বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করি। কিন্তু ইতিহাস পড়লে সেটাকে খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। যুদ্ধবিগ্রহ করে মানুষ একে অন্যকে কতভাবে খুন করেছে সেটি কেউ চিন্তা করে দেখেছে? পুরো একটি সভ্যতাকে অন্য একটি সভ্যতা এসে ধ্বংস করে দিয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি আমাদের মনে হয় এই মুহূর্তে আমরা ঠিক এ-রকম একটা সময়ের মাঝে আছি। চেঙ্গিস খান বা হালাকু খানের আমলে মানুষ খুন করা পরিশ্রমের ব্যাপার ছিল, কারণ তখন তরবারি দিয়ে আরেকজনকে কাটতে হতো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনী সেটাকে আধুনিক করে ফেলেছিল। গ্যাস চেম্বারে মারা থেকে শুরু করে মৃতদেহকে ভস্মীভূত করার অনেক বিজ্ঞানসম্মত উপায় তারা আবিষ্কার করেছিল। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিধ্বংসী নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে এক মুহূর্তে কয়েক লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলে হত্যাকাণ্ডের একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। তার সাথে সাথে এই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকবে কিনা সেটা নিয়ে একটা প্রশ্নও প্রথমবার তৈরি হয়েছে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা করে পৃথিবীর নানা দেশের কাছে এখন যে পরিমাণ মানব বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে সেই অস্ত্র দিয়ে এই পৃথিবীর সকল প্রাণীকে একবার নয় অসংখ্যবার ধ্বংস করে ফেলা যায়। তারপরেও আমরা কি মানুষকে সভ্য মানুষ বলতে পারি?

আমাদের পছন্দ হোক আর না হোক এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে এ-রকম একটা পরিস্থিতি হওয়া সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্যে। চেঙ্গিস খান হালাকু খান ধারালো তরবারি দিয়ে কুপিয়ে পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে শেষ করতে পারত না কিন্তু জর্জ বুশ কিংবা টনি ব্লেয়ার ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে শেষ করে ফেলতে পারে। একবার নয়, বহুবার। তার কারণ চেঙ্গিস খান হালাকু খানের কাছে নিউক্লিয়ার বোমা ছিল না। জর্জ বুশ কিংবা টনি। ব্লেয়ারের কাছে আছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তার আপেক্ষিক সূত্র থেকে যখন বের করেছিলেন E = mc^2 তখন কি তিনি সন্দেহ করেছিলেন এটা দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর মরণাস্ত্র তৈরি হবে? পরমাণুর বড় একটি নিউক্লিয়াস ভেঙে দু টুকরো করা হলে তার বাড়তি ভরটুকু শক্তি হিসেবে বের হয়ে আসে। ভর বা m কে E বা শক্তি তৈরি করা হলে সেটাকে c বা আলোর বেগ দিয়ে দুইবার গুণ করতে হয়, তাই একটুখানি ভর দিয়ে অনেকখানি শক্তি পাওয়া যায়। সাধারণ বোমার ধ্বংস করার ক্ষমতা থেকে নিউক্লিয়ার বোমার ধ্বংস করার ক্ষমতা তাই.এত বেশি। যে পরমাণুর নিউক্লিয়াস দিয়ে এটা প্রথমে করা হয়েছিল সেটি ছিল ইউরেনিয়ামের। ইউরেনিয়ামের পরমাণু সংখ্যা হচ্ছে 92। তাই এই সংখ্যাটির একটা অন্যরকম গুরুত্ব রয়েছে। মানুষ যখন জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উন্নত হয়ে প্রথমবার 92 নম্বর পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে ভয়ংকর শক্তিটা বের করতে পেরেছে ঠিক তখনই তারা সারা জীবনের জন্যে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কারণ, ঠিক তখন প্রথমবার তারা পৃথিবীকে ধ্বংস করার ক্ষমতাটি অর্জন করেছে। মানুষ তাদের নিজেদের ধ্বংস করে ফেলবে কিনা সেটি কেউ এখনো জানে না। কিন্তু সেই ক্ষমতাটি যে তাদের আছে সেটি সবাই জানে। একটি বুদ্ধিমান প্রাণীর সভ্যতা যখন বিকশিত হয় তাদের অস্তিত্বের প্রথম বিপদটি আসে এই 92 নম্বর পরমাণু থেকে। এর থেকে উত্তরণ হবার পরেই বলা যায় তারা 92-এর বাধা থেকে মুক্তি পেয়েছে।

পৃথিবীতে মানুষ যেভাবে বিবর্তনের ভেতর দিয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে বিকশিত হয়ে একসময় 92-এর ভয়ংকর বিপদের মুখোমুখি হয় ঠিক সেরকম অন্য কোনো গ্যালাক্সির অন্য কোনো নক্ষত্রে অন্য কোনো গ্রহে যদি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর উদ্ভব হয় তাহলে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উন্নত হয়ে তারাও এক সময় 92 নম্বর পরমাণু থেকে শক্তি বের করার রহস্যটি জেনে যাবে। মানুষ যেভাবে তাদের নিজেদের অস্তিত্বকেই ধ্বংস করার মুখোমুখি হয়েছে সে-রকম তারাও সেই নিজেকে ধ্বংস করার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াবে। তারপর কী হয় আমরা জানি না। এনরিকো ফার্মি ভয় পেয়েছেন বুদ্ধিমান প্রাণী হয়তো নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে। মানুষও বুদ্ধিমান প্রাণী, তাই হয়তো আমরাও নিজেদের ধ্বংস করে ফেলব! হয়তো সৃষ্টিজগতে অনেক প্রাণের উদ্ভব হয়েছে কিন্তু বুদ্ধিমত্তার জন্যে তাদের খুব বড় মূল্য দিতে হয়েছে। সে কারণে হয়তো বুদ্ধিমান প্রাণীরা সব সময়ই একা। সব সময়েই নিঃসঙ্গ।

1 Comment
Collapse Comments

kichu kichu boie photo thake .
segulo dile valo hoto.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *