০৯. মহাজগৎ

মহাজগৎ

23. মহাজাগতিক ক্যালেন্ডার

খুব বড় একটি সংখ্যা অনুভব করা সহজ নয়। পৃথিবীতে এমনকি আমাদের দেশেও আজকাল টাকার ছড়াছড়ি, আমাদের আশপাশেই আমরা কোটিপতি দেখতে পাই। কিন্তু কোটি সংখ্যাটি কত বড় সেটা কি অনুভব করা খুব সহজ? একটা উপায় হচ্ছে সেটাকে কোনোভাবে আমাদের জীবনের সাথে সম্পর্ক আছে এ-রকম কোনো কিছুর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া। আমরা সবাই মনে করি টাকা খরচ করতে পারাটা খুব আনন্দের ব্যাপার, কাজেই যদি মনে করি প্রতিদিন হাজার টাকা খরচ করতে পারব তাহলে এক কোটি টাকা খরচ করে শেষ করতে কতদিন লাগবে? একটু হিসেব করলেই আমরা দেখব সময়টা অনেক দীর্ঘ প্রায় সাড়ে সাতাইশ বছর! আমি নিশ্চিত এক কোটি সংখ্যাটি কত বড় এবারে সেটা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেল। প্রতিদিন এক হাজার টাকা করে খরচ করলেও এক কোটি টাকা শেষ করতে যদি টানা সাড়ে সাতাইশ বছর লাগে তাহলে সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে অনেক বড়।

বলা হয়ে থাকে আমাদের এই পরিচিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হয়েছিল 15 বিলিওন বছর আগে। এর আগে কী ছিল বিজ্ঞানীরা সেই প্রশ্নটি শুনতে রাজি নন। বিশাল এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে (যেটাকে বলে বিগ ব্যাং) এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হবার আগে কিছুই ছিল না, সময়েরও শুরু হয়েছে এই বিগ ব্যাংক থেকে এটা হচ্ছে প্রচলিত বিশ্বাস। কিন্তু এই 15 বিলিওন বছরটি কত বড় সেটা কি আমরা অনুভব করতে পারি? আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলো (এস.এস.সি পরীক্ষা, সন্তানের বড় হওয়া) সাধারণত বছরের হিসেবে আসে, জীবন কয়েকটি দশকে শেষ হয়, কাজেই এর চাইতে দীর্ঘ কোনো সময় আমরা হয়তো কাগজে চট করে লিখে ফেলতে পারব কিন্তু সেই সময়টা কি সত্যিকারভাবে অনুভব করতে পারব? কাজটি সহজ নয়। তাই এই বিশাল মাপের সময়কে অনুভব করার জন্যে বিজ্ঞানীরা পুরো সময়টিকে এক বছরের একটা ক্যালেন্ডারের মাঝে প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ আমরা একটা মহাজাগতিক ক্যালেন্ডারের কথা বলছি যেটাতে জানুয়ারি মাসের এক তারিখে বিগ ব্যাং হয়েছিল এবং বর্তমান সময়টি হচ্ছে ডিসেম্বর মাসের একত্রিশ তারিখ রাত বারোটা, নূতন বছর মাত্র শুরু হতে যাচ্ছে।

15 বিলিওন বছর সময়টিতে এক বছরের একটি ক্যালেন্ডারে প্রকাশ করা হলে কিছু চমকপ্রদ ব্যাপার দেখা যায়, যেমন মানুষের জন্ম হয়েছে ডিসেম্বরের একত্রিশ তারিখ রাত সাড়ে দশটায়, অর্থাৎ মাত্র দেড়ঘণ্টা আগে!

মহাজাগতিক ক্যালেন্ডারে যাবার আগে আমরা সংখ্যার হিসেবটি একবার ঝালাই করে নিই। আমরা দৈনন্দিন কথাবার্তায় সংখ্যাকে হাজার, লক্ষ কোটি হিসেবে প্রকাশ করে থাকি, কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় সংখ্যাকে এক হাজার গুণ হিসেবে প্রকাশ করা হয়। লক্ষ সংখ্যাটি বিজ্ঞানের জনপ্রিয় নয়, এক হাজারের হাজার গুণ, অর্থাৎ, দশ লক্ষ বেশ জনপ্রিয়, এই সংখ্যাটির নাম মিলিওন। উনিশ শ একাত্তরে এই দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যায় তিন মিলিওন লোক মারা গিয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা একশ পঞ্চাশ মিলিওনের কাছাকাছি। পরবর্তী বড় সংখ্যা হচ্ছে বিলিওন, সেটি হচ্ছে এক হাজার মিলিওন। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বয়স পনেরো বিলিওন, পৃথিবীর জনসংখ্যা পাঁচ বিলিওন। এক হাজার বিলিওনকে বলা হয় ট্রিলিওন, বাংলাদেশের মজুত গ্যাসের পরিমাণ ধরা হয় বারো থেকে ষোল ট্রিলিওন কিউবিক ফুট।

মিলিওন, বিলিওন এবং ট্রিলিওন সংখ্যাগুলো ব্যাখ্যা করার পর আমরা আমাদের মূল বিষয়টিতে যাই। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হবার পর পনেরো বিলিওন বৎসরকে যদি এক বছরের একটি মহাজাগতিক ক্যালেন্ডারের মাঝে আটিয়ে দেয়া যায় তাহলে মহাজাগতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ঘটেছে এভাবে:

(ক) বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি : জানুয়ারি 1.

(খ) আমরা যে গ্যালাক্সিতে আছি, ছায়াপথ নামে সেই গ্যালাক্সির জন্ম : মে 1 এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে জানুয়ারির এক তারিখে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হবার পরও গ্যালাক্সিগুলোর জন্ম নিতে পাঁচ মাস সময় লেগেছে।

(গ) সৌরজগতের জন্ম : সেপ্টেম্বরের 9 তারিখ । গ্যালাক্সি জন্ম নেবার পরও চার মাস থেকে বেশি সময় লেগেছে সৌর জগতের জন্ম হতে।

(ঘ) পৃথিবীর জন্ম : সেপ্টেম্বরের 14 তারিখ। সৌরজগৎ জন্ম নেবার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় পৃথিবীর জন্ম হয়েছে।

(ঙ) পৃথিবীতে প্রথম আদিম প্রাণের বিকাশ : সেপ্টেম্বরের 25 তারিখ । পৃথিবী জন্ম নেবার পর দুই সপ্তাহ থেকেও কম সময়ে প্রাণের আবির্ভাব হয়েছে।

(চ) প্রাচীনতম পাথরের জন্ম : 2 অক্টোবর।

(ছ) ব্যাক্টেরিয়া এবং নীল সবুজ এলজির প্রাচীনতম ফসিল : অক্টোবরের 9 তারিখ।

(জ) জন্ম প্রক্রিয়ার জন্যে ভিন্ন লিঙের উদ্ভব (জীবাণুদের ভেতর) : 1 নভেম্বর।

(ঝ) সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে এ-রকম গাছের জন্ম: নভেম্বরের 12 তারিখ।

(ঞ) উন্নত প্রাণীর জন্যে নিউক্লিয়াসসহ কোষের (ইউক্যারিওটস) আবির্ভাব :

দেখাই যাচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হয়েছে জানুয়ারির এক তারিখে কিন্তু নভেম্বরের 15 তারিখ পর্যন্ত, বছরের প্রায় বড় সময়টাই চলে গেছে এতদিনে মাত্র উন্নত প্রাণী জন্ম নেয়ার উপযোগী কোষ তৈরি হতে শুরু করেছে। পুরো সময়টা আরো সঠিকভাবে অনুভব করার জন্যে মনে রাখতে হবে মহাজাগতিক এই ক্যালেন্ডারে এক সেকেন্ড প্রায় পাঁচশ বৎসর (নিখুঁতভাবে বলতে গেলে 475 বৎসর) একদিন হচ্ছে চল্লিশ মিলিওন বৎসর (কিংবা চার কোটি বৎসর)!

মহাজাগতিক ক্যালেন্ডারে নভেম্বর মাস শেষ হয়ে ডিসেম্বর মাস আসার পর পৃথিবীর ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করেছে বলা যায়। তাই ডিসেম্বর মাসের ক্যালেন্ডারটা আলাদাভাবে লেখা যেতে পারে:

ডিসেম্বর 1 পৃথিবীতে অক্সিজেন সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডলের শুরু।

ডিসেম্বর 16 কেঁচো জাতীয় প্রাণীর উদ্ভব ।

ডিসেম্বর 17 মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর বিকাশ।

ডিসেম্বর 18 সামুদ্রিক প্লাংকটন, শামুক জাতীয় ট্রাইলোবাইটের জন্য ।

ডিসেম্বর 19 প্রথম মাছ এবং মেরুদণ্ডী প্রাণীর উদ্ভব

ডিসেম্বর 20 পৃথিবীর স্থলভাগ গাছ দিয়ে ঢেকে যেতে শুরু করা ।

ডিসেম্বর 21 পোকামাকড়ের জন্ম। স্থলভাগে প্রাণীদের বিচরণ।

ডিসেম্বর 22 প্রথম উভচর প্রাণীর উদ্ভব।

ডিসেম্বর 23 প্রথম বৃক্ষ এবং সরীসৃপের জন্ম।

ডিসেম্বর 24 ডাইনোসরের জন্ম।

ডিসেম্বর 26 স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্ম।

ডিসেম্বর 27 প্রথম পাখির জন্ম।

ডিসেম্বর 28 ডাইনোসরের জন্মের চারদিন পর তাদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার শুরু।

ডিসেম্বর 29 বানর জাতীয় প্রাণীর উদ্ভব।

ডিসেম্বর 30 বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্ম।

ডিসেম্বর 31 পৃথিবীতে প্রথম মানুষের জন্ম।

দেখাই যাচ্ছে ডিসেম্বর মাসটি ছিল খুব ঘটনাবহুল । সৃষ্টি জগতের পুরোটুকু এক বছরের মাঝে সাজিয়ে দিতে হলে দেখা যায় শেষ দুই সপ্তাহটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ঘটেছে। এবং তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে মানুষের জন্ম হয়েছে একেবারে শেষ দিনে। কিন্তু আমরা আগেই বলেছি মহাজাগতিক ক্যালেন্ডারে একদিন হচ্ছে চল্লিশ মিলিওন বা চার কোটি বছর। কাজেই শেষ । দিনটিকেও একটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা যেতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি ডিসেম্বর মাসের শেষ দিনটি সারা দিন পার হয়ে সূর্য ডুবে যাবার পর যখন রাত সাড়ে দশটা বাজে তখন প্রথম মানুষের জন্ম হয়েছিল। কাজেই মহাজাগতিক ক্যালেন্ডারে মানুষের বয়স মাত্র দেড় ঘণ্টা! মানবের জন্মের পর তাদের ইতিহাসটুকু তাহলে দেখা যাক:

রাত 10: 30 মানুষের জন্ম

রাত 11: 00 মানুষের পাথরের অস্ত্র ব্যবহার

রাত 11:46 আগুন আবিষ্কার

রাত 11:59 ইউরোপের গুহায় মানুষের ছবি আঁকা

দেখাই যাচ্ছে আমরা বছর শেষ হবার একেবারে শেষ মিনিটে পৌঁছে গেছি এখন সেকেন্ড হিসেব করে দেখা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে এখানে প্রতি সেকেন্ড হচ্ছে পাঁচশত বছর।

20 সেকেন্ড চাষ আবাদ শুরু

35 সেকেন্ড প্রথম শহরের পত্তন

50 সেকেন্ড মানুষের জ্যোতিবিদ্যার জ্ঞান অর্জন, মিশরের সভ্যতা

52 সেকেন্ড ব্যাবিলনের সভ্যতা

53 সেকেন্ড কম্পাস আবিষ্কার, ট্রজানের যুদ্ধ

54 সেকেন্ড লোহার ব্যবহার শুরু

55 সেকেন্ড গৌতম বুদ্ধের জন্ম

56 সেকেন্ড ইউক্লিডের জ্যামিতি। যিশুখ্রিস্টের জন্ম।

57 সেকেন্ড হজরত মুহম্মদ (স:) এর জন্ম। শূন্য আবিষ্কার।

58 সেকেন্ড মায়া সভ্যতা, ক্রুশেডের যুদ্ধ।

59 সেকেন্ড । ইউরোপে রেনেসাঁ। নূতন বিজ্ঞানের জন্ম।

60 সেকেন্ড বা বর্ষ-শেষ মুহূর্ত — বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিকাশ। মানুষ কর্তৃক নিজেকে ধ্বংস করার ক্ষমতা অর্জন । মহাকাশ অভিয়ান, সারা পৃথিবীর সকল মানুষ নিয়ে বিশ্বসংস্কৃতির জন্ম।

মহাজাগতিক বছরের শেষে এখন আমাদের দেখার সময় নূতন বছরে আমাদের জন্যে কী অপেক্ষা করছে।

.

24. হারিয়ে যাওয়া ভর

আমরা সবাই কখনো না কখনো একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে তার কোমল শিখাঁটির দিকে তাকিয়ে থেকেছি। আমরা না চাইলেও লক্ষ করেছি যে মোমবাতিটি আলো দিতে দিতে ছোট হয়ে আসছে। যখন মোমটুকু শেষ হয়ে গেছে শেষবারের মতো বার কয়েক দপদপ করে জ্বলে সেটি নিভে গেছে।

মানুষ একসময় সূর্যের দিকে তাকিয়ে এ-রকম একটা দুর্ভাবনা করতো। সূর্য যেহেতু “জ্বলছে নিশ্চয়ই সেখানে মোমের মতো কোনো এক ধরনের জ্বালানী “পুড়ছে”। একসময় জ্বালানী যখন শেষ হয়ে যাবে তখন কি সূর্যটাও শেষবারের মতো দপদপ করে জ্বলে চিরদিনের মতো নিভে যাবে? সারা পৃথিবী ঘন কালো অন্ধকার ডুবে যাবে?

বিজ্ঞানীরা আমাদের নিশ্চিত করেছেন, তারা বলেছেন–এধরনের কোনো দুর্ভাবনা নেই। সূর্য প্রায় পাঁচ বিলিওন বছর (পাঁচশ কোটি) থেকে আলো, তাপ আর শক্তি দিয়ে আসছে। আরো পাঁচ বিলিওন বছর এটি টিকে থাকবে। তার কারণটা সহজ সূর্য তার আলো আর তাপ মোমের মতো জ্বালানী থেকে পায় না। সূর্য তার শক্তিটুকু পায় ফিউসান নামের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া থেকে। এই শক্তি প্রায় অফুরন্ত!

সূর্য এক ধরনের নক্ষত্র, নক্ষত্রের জীবন অনেকটা বেহিসেবী মানুষের মতো। যেই নক্ষত্রের আকার যত ছোট সেটা তত বেশিদিন টিকে থাকে। যে নক্ষত্রের আকার বড় সেটা তত বেশি উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। সূর্যের নিউক্লিয়ার জ্বালানী যখন শেষ হয়ে যাবে তখন তার মৃত্যুটি হবে মোটামোটি সাদামাটা, নিষ্প্রভ একটা হোয়াইট ডোয়ার্ফ হয়ে সেটি বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। তবে নক্ষত্রের আকার যদি সূর্য থেকে কমপক্ষে দেড়গুণ বড় হয় তাহলে নক্ষত্রের মৃত্যুটি হয় চমকপ্রদ। নিউক্লিয়ার জ্বালানী শেষ হবার পর তার ভেতরটা প্রবল মহাকর্ষ বলের কারণে সংকুচিত হয়ে যায়, এই ভয়াবহ সংকোচনের কারণে যে প্রচণ্ড শক্তির জন্ম হয় সেই শক্তি পুরো নক্ষত্রের বাইরের অংশটুকু ভয়ংকর বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। এই ধরনের নক্ষত্রকে বলে সুপার নোভা এবং একটা সুপার নোভা সূর্য থেকে কোটি কোটি গুণ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকে। সুপার নোভার ঔজ্জ্বল্য খুবই ক্ষণস্থায়ী, মাত্র কয়েক সপ্তাহ–তারপর সেটি তার ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে নিষ্প্রভ হয়ে যায়।

পৃথিবীর মানুষ মাঝে মাঝেই সুপার নোভা দেখেছে। সর্বশেষ সুপার নোভার বিস্ফোরণ ঘটেছে 1987-এর 24 ফেব্রুয়ারিতে (আমি তখন উইসকনসিনে একটি পদার্থবিজ্ঞানের কনফারেন্সে, মনে আছে সেই বিস্ফোরণের খবর পেয়ে সব বিজ্ঞানীদের সে কী উত্তেজনা!)। এটি শুধু যে একটা চমকপ্রদ বিস্ফোরণ তাই নয়–আমাদের অস্তিত্বের পেছনেও রয়েছে এই সুপার নোভা! আমাদের শরীরের, গাছপালা বা প্রাণিজগতের এমনকি সারা পৃথিবীর সকল কিছু যে পরমাণু দিয়ে তৈরি তার কেন্দ্রের নিউক্লিয়াসগুলো এসেছে সুপারনোভার বিস্ফোরণ থেকে।

প্রকৃতিতে 92 (বিরানব্বই) টি ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু রয়েছে। সবচেয়ে সহজ পরমাণুটি হচ্ছে হাইড্রোজেন, তার কেন্দ্রে একটা মাত্র প্রোটন এবং তাকে ঘিরে ঘুরছে একটা মাত্র ইলেকট্রন। এর পরের পরমাণুটি হচ্ছে হিলিয়াম, তার কেন্দ্রে দুটি প্রোটন এবং তাকে ঘিরে ঘুরছে দুটি ইলেকট্রন। তবে শুধু দুটি প্রোটন একসাথে থাকতে পারে না, তাদের চার্জের কারণে প্রবল শক্তিতে এরা একে অপরকে বিকর্ষণ করে। এগুলোকে আটকে রাখতে হলে নিউট্রন নামে এক ধরনের কণা দরকার, যার ভর প্রোটনের কাছাকাছি কিন্তু কোন চার্জ নেই। নিউট্রনগুলো অনেকটা আঠার মতো কাজ করে প্রোটন দুটিকে আটকে রাখে। নক্ষত্রের ভেতরে প্রোটন এবং নিউট্রন প্রবল শক্তিতে একটা আরেকটাকে ধাক্কা দিয়ে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার শুরু করে সহজ হাইড্রোজেন থেকে শুরু করে প্রথমে হিলিয়াম এবং তারপর পরবর্তী নিউক্লিয়াসগুলো তৈরি করতে শুরু করে।

একটা হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসে রয়েছে দুইটা প্রোটন এবং দুইটা নিউট্রন। আলাদা আলদাভাবে দুইটা প্রোটন এবং দুইটা নিউট্রনের যত ভর, হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর তার থেকে অল্প একটু কম, সঠিকভাবে বলতে হলে বলা যায় 0.007 ভাগ (বা 0.7%) কম। যখন দুটি প্রোটন এবং দুটি নিউট্রন মিলে একটা হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করে তখন যে ভরটুকু কমে যায় সেটাই আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত সূত্র E = mc^2 অনুযায়ী শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। নিউক্লিয়ার শক্তি রাসায়নিক শক্তি থেকে শতকোটি গুণ বেশি, তাই সূর্য অচিরেই মোমবাতির মতো জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে যাবার কোনো আশঙ্কা নেই। সূর্যের শক্তির বড় অংশ আসে হাইড্রোজেনের হিলিয়ামে রূপান্তরিত হওয়া থেকে। এর মাঝে খুব বড় একটা ভূমিকা পালন করে নিউক্লিয়াসের হারিয়ে যাওয়া 0.007 ভাগ ভর।

একটা খুব সহজ প্রশ্ন করা যায়, সূর্যে (কিংবা অন্যান্য নক্ষত্রে) যখন হাইড্রোজেন (নিউট্রনের সাহায্যে) হিলিয়ামের পরিণত হয় তখন তার 0.007 ভাগ ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই সংখ্যাটি যদি 0.007 না হয়ে 0.006 বা 0.008 হতো তাহলে কী হতো? প্রশ্নটি খুবই সহজ কিন্তু এর উত্তরটি ভয়াবহ। সংখ্যাটির এই ক্ষুদ্রতম বিচ্যুতি হলেই এই বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড, সৃষ্টিজগৎ, গাছপালা, প্রাণী কিছুই থাকত না!

ধরা যাক সংখ্যাটি 0.006 বা তার থেকে কম। যার অর্থ নিউক্লিয়ার বিক্রিয়াতে শক্তি খানিকটা কম তৈরি হচ্ছে, সূর্যের উত্তাপ খানিকটা কম, এবং সূর্যের আয়ুও খানিকটা কম। কিন্তু এ কারণে আসলে এর থেকেও অনেক গুরুতর ব্যাপার ঘটতে পারে।

সূর্য বা অন্য নক্ষত্রে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম সরাসরি তৈরি হয় না, এটা ধাপে ধাপে তৈরি হয়। প্রথম ধাপে একটি প্রোটন (হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস) এবং একটা নিউট্রন একত্র হয়ে ডিউটোরিয়াম তৈরি হয়। এই ডিউটেরিয়াম বিক্রিয়া করে হিলিয়াম তৈরি করে। যদি হিলিয়ামের হারিয়ে যাওয়া ভরের অংশ 0.006 বা তার কম হতো তাহলে নক্ষত্রের বা সূর্যের ভেতর ডিউটেরিয়ামগুলো টিকে থাকতে পারত না। আর ডিউটেরিয়াম যদি টিকে থাকতে না পারে তাহলে সেটা পরবর্তী ধাপে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস কেমন করে তৈরি করবে? যার অর্থ হাইড্রোজেন কখনোই হিলিয়ামে পরিণত হতে পারবে না। নক্ষত্রগুলো হবে আলোহীন এবং নিষ্প্রভ। সূর্য থেকে দেড়গুণ বড় নক্ষত্র যেভাবে প্রচণ্ড সুপারনোভা বিস্ফোরণ করে নানা ধরনের নিউক্লিয়াস ছড়িয়ে দেয় সেই প্রক্রিয়াটি বন্ধ থাকত। যার অর্থ এই বিশ্বজগতে হাইড্রোজেন ছাড়া আর কিছুই থাকত না। কোথাও কোনো জটিলতা নেই, কোনো জটিল অনু পরমাণু নেই, গ্রহ নেই, ই গাছপালা নেই, প্রাণ নেই– সমস্ত বিশ্বজগতে মাত্র একটি পরমাণু, বৈচিত্রহীন হাইড্রোজেন।

হিলিয়ামের হারিয়ে যাওয়া ভর 0.006 থেকে কম হওয়ার কারণে পুরো বিশ্বজগৎ যদি বৈচিত্রহীন হয়ে পড়ে তাহলে অনেকের ধারণা হতে পারে সম্ভবত সেটি যদি 0.009 কিংবা তার থেকেও বেশি হতো তাহলে সম্ভবত সমস্ত বিশ্বজগৎ আরো অনেক চমকপ্রদ হতো, আরো বিচিত্র সব অনু আরো । বিচিত্র যৌগিক পদার্থ, আরো বিচিত্র রসায়ন, বৃক্ষলতা প্রাণীর জন্ম হতো। কিন্তু ব্যাপারটি মোটেও সে-রকম নয়। বিশ্বজগৎ সৃষ্টির প্রথম ধাপ হচ্ছে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামের সৃষ্টি। আগেই বলা হয়েছে সেটা তৈরি করার জন্যে প্রথমে ডিউটোরিয়ামের জন্ম হতে হয়। যদি হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের হারিয়ে যাওয়া ভর 0.007 থেকে বেশি হয়ে 0.008 বা তার থেকে বেশি হয়ে যায় তাহলে আর ডিউটেরিয়াম তৈরি হতে হয় না, দুটি হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস (অর্থাৎ, দুটো প্রোটন) নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া করে একত্র হয়ে যেতে পারতো। এই সম্পূর্ণ নূতন ধরনের নিউক্লিয়াস তৈরি হতো বিশ্বজগৎ সৃষ্টির একেবারে গোড়ার দিকে, আর এভাবে সমস্ত হাইড্রোজেন খরচ হয়ে যেত। নক্ষত্রের জ্বালানী হবার জন্যে কোনো হাইড্রোজেন আর বাকি থাকত না। আর হাইড্রোজেনই না থাকে তাহলে পানি আসতো কোথা থেকে?

কাজেই বিজ্ঞানীরা দেখেছেন হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের হারিয়ে যাওয়া ভর যদি 0.006 থেকে 0.008 এর ভেতরে না হতো তাহলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরিই হতো না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার শুধু এই সংখ্যাটি নয় প্রকৃতিতে আরো অনেক সংখ্যা আছে যেগুলো অল্প একটু পরিবর্তন হলেই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটি হয় এভাবে তৈরি হতো না, আর যদিও বা তৈরি হতো সেটি হতো এমন বিদঘুঁটে জগৎ যে সেই জগতে বুদ্ধিমান প্রাণী দূরে থাকুক প্রাণের বিকাশই ঘটা সম্ভব হতো না! দেখে-শুনে মনে হয় প্রকৃতি বুঝে খুব সতর্কভাবে এই সংখ্যাগুলো বেছে নিয়েছে যেন বিবর্তনের ভেতর দিয়ে মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণী এই পৃথিবীতে জন্ম নিতে পারে।

সহায়ক গ্রন্থ : Just six numbers Martin Rees

.

25. নক্ষত্রের সন্তান

মানুষের শরীরের বেশিরভাগই পানি, যদি পানিটুকু আলাদা করা যেত তাহলে দেখা যেত পায়ের তলা থেকে বুক পর্যন্ত পুরোটুকুই পানি। পানিকে আমরা পানি হিসেবেই দেখে অভ্যস্ত, যদিও আসলে সেটা হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে তৈরি। পরমাণুর সংখ্যা দিয়ে হিসেব করলে মানুষের শরীরে সবচেয়ে বেশি রয়েছে হাইড্রোজেনের পরমাণু কিন্তু হাইড্রোজেন যেহেতু সবচেয়ে হালকা পরমাণু তাই সংখ্যায় বেশি থেকেও তার ওজন বেশি নয়, মানুষের শরীরে ওজন হিসেবে হাইড্রোজেন হচ্ছে শতকরা দশভাগ। সেই হিসেবে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে অক্সিজেন শতকরা পঁয়ষট্টি ভাগ। এরপর হচ্ছে কার্বন শতকরা আঠারো ভাগ। এই বড় তিনটি পরমাণুর পরই হচ্ছে নাইট্রোজেন, শতকরা তিন ভাগ। বাকি চার ভাগ তৈরি হয় ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লোহা, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ক্লোরিন, ফ্লোরিন এই ধরনের আরো নানা পরমাণু দিয়ে। পরিমাণে তুলনামূলকভাবে কম হলেও এদের গুরুত্ব কিন্তু মোটেও কম নয়। যেমন লোহার পরিমাণ শতকরা অর্ধ শতাংশেরও কম হলেও আমাদের রক্তে অক্সিজেন নেয়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করে লোহা। কাজেই হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন ছাড়া অন্যান্য পরমাণুগুলো ছাড়া মানবদেহ সম্পূর্ণ হতে পারে না।

এবারে একটা সহজ প্রশ্ন করা যাক, আমাদের শরীরে এগুলো এসেছে কোথা থেকে? একটা ছোট শিশু মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে, সেগুলো পেয়েছে মায়ের শরীর থেকে। মা তার সারা জীবনে বড় হওয়ার সময়ে নানা রকম খাবার থেকে পেয়েছেন। কিন্তু আমরা আসলে প্রশ্নটা আরো গভীরভাবে করতে চাই। আমাদের শরীরের এই যে বিভিন্ন পরমাণুগুলো এসেছে সেগুলো তৈরি হয়েছে কোথায়?

প্রশ্নটা ঠিকভাবে অনুভব করার জন্যে আমাদের হঠাৎ করে একটু পরমাণুবিজ্ঞান জানা দরকার। সবচেয়ে সহজ পরমাণু হচ্ছে হাইড্রোজেন যার কেন্দ্রে একটা প্রোটন এবং সেই প্রোটনকে ঘিরে ঘুরছে একটা ইলেকট্রন। প্রোটনের চার্জ পজিটিভ, ইলেকট্রনের নিগেটিভ তাই দুইয়ে মিলে একটা হাইড্রোজেন পরমাণু চার্জবিহীন। হাইড্রোজেনের পরের পরমাণু

হিলিয়াম, হিলিয়াম পরমাণুতে দুটি ইলেকট্রন কাজেই আমরা অনুমান করতে পারি তার কেন্দ্রে নিউক্লিয়াসে দুটি প্রোটন থাকবে। নিউক্লিয়াস হয় খুবই ছোট, যদি একটা মানুষকে চাপ দিয়ে তার পরমাণুগুলো ভেঙে নিউক্লিয়াসের ভেতর ঠেসে রাখা যেত তাহলে মানুষটিকে মাইক্রোস্কোপ দিয়েও দেখা যেত না! এত ছোট জায়গায় পাশাপাশি দুটি প্রোটন থাকতে পারে না, একই চার্জ হওয়ার কারণে একটি আরেকটিকে ঠেলে বের করে দিতে চায়। ব্যাপারটি নিরুপদ্রব করার জন্যে সেখানে প্রোটনের সমান ভর কিন্তু চার্জহীন নিউট্রন থাকে। একটা পরমাণুকে তার ইলেকট্রন (এবং প্রোটনের) সংখ্যা দিয়ে নির্দিষ্ট করা হয় কিন্তু নিউট্রন কতগুলো হবে সেটা এ-রকম জোর দিয়ে বলা যায় না। নিউট্রনের সংখ্যা প্রোটনের সংখ্যার সমান কিংবা বেশি হতে পারে। এবং এ ধরনের নিউক্লিয়াসকে আইসোটপ বলে। নিউক্লিয়াস যত বড় হয় নিউট্রনের সংখ্যা তত বেশি হয়। মানুষের শরীরে যে সব পরমাণু পাওয়া যায় তার ইলেকট্রন এবং প্রোটনের সংখ্যা 1 নং তালিকায় দেয়া হলো। বিভিন্ন আইটেপের গড় করে পারমাণবিক ভর বের করা হয়েছে। তালিকাটি একনজর দেখে আমরা আমাদের আগের প্রশ্নে ফিরে যাই, মানুষের শরীরে পাওয়া যায় বলে যে পরমাণুগুলোর নাম লিখেছি সেগুলো কোথা থেকে এসেছে? যে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে সেখানেই এই পরমাণুগুলো ছিল কিন্তু পৃথিবীতে এগুলো কোথা থেকে এসেছে? প্রশ্নটি সহজ কিন্তু উত্তরটি সহজ নয়!

পরমাণুর নামইলেকট্রন বা প্রোটন সংখ্যাপারমানবিক ভর
হাইড্রোজেন11.00
কার্বন612.01
নাইট্রোজেন714.01
অক্সিজেন816.00
ফ্লোরিন919.00
সোডিয়াম1122.99
ম্যাগনেসিয়াম1224.31
ফসফরাস1530.98
ক্লোরিন1735.46
পটাশিয়াম1939.10
ক্যালসিয়াম2040.08
লোহা2655.85

সৃষ্টিজগতে এই পৃথিবী বা সৌরজগৎ আসার অনেক আগে নক্ষত্রগুলোর জন্ম হতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বের করেছেন সৃষ্টি জগতে প্রথম নক্ষত্রগুলোর জন্ম হয়েছিল 13 থেকে 14 বিলিওন (13 থেকে 14 শতকোটি) বৎসর আগে। সৃষ্টির আদিমুহূর্তে সবকিছু ছিল সহজ-সরল তাই শুরু হয়েছিল সবচেয়ে সহজ পরমাণু হাইড্রোজেন দিয়ে। মানুষ হত্যা করার জন্যে এখন যে হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করা হয় নক্ষত্রের শক্তি তৈরি করার প্রক্রিয়াটি আসলে সেই একই প্রক্রিয়া। নক্ষত্রের ভেতরে হাইড্রোজেন অন্য হাইড্রোজেনের সাথে যুক্ত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে এবং সেই হিলিয়াম তৈরি করার প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন করে। সেই শক্তি নক্ষত্রকে ঔজ্জ্বল্য দেয়, তাপ দেয়। একটা নক্ষত্র যে কী পরিমাণ তাপ, আলো বা অন্য শক্তি দিতে পারে সেটি বোঝার জন্যে আমাদের সূর্যকে একনজর দেখলেই হয়, এত ঘরের কাছে এ-রকম একটা নক্ষত্র আছে বলেই পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এত সহজে নক্ষত্র সম্পর্কে এত কিছু জানতে পেরেছেন।

নক্ষত্রের ভেতরে হাইড্রোজেন এক ধরনের জ্বালানী হিসেবে কাজ করে। হাইড্রোজেন ফুরিয়ে হিলিয়াম তৈরি হয় (হিলিয়ামের ইলেকট্রন বা প্রোটন সংখ্যা 2, পারমাণবিক ভর 4), সেই হিলিয়াম থেকে তৈরি হয় কার্বন আর এভাবে নক্ষত্রের ভেতরে বিভিন্ন নিউক্লিয়াসগুলো তৈরি হতে থাকে। আমাদের পৃথিবীতে আমরা এখন যে পরমাণুগুলো দেখি তার সবগুলো এভাবে কোনো না কোনো নক্ষত্রের ভেতরে তৈরি হয়েছে। আজকাল বিজ্ঞানীরা বিশাল কোনো গবেষণাগারে এক্সেলেরেটর ব্যবহার করে এক দুটি নিউক্লিয়াস তৈরি করতে পারেন, কিন্তু আমাদের পৃথিবীর বা সৌরজগতের জটিল পরমাণুর সবগুলোই তৈরি হয়েছে কোনো না কোনো নক্ষত্রের ভেতরে । শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু আমরা সবাই আসলে কোনো না কোনো নক্ষত্রের অংশ। স্বাভাবিকভাবেই পরের প্রশ্নটি চলে আসে, যদি সত্যি সত্যি আমাদের শরীরের জটিল পরমাণুগুলো কোনো না কোনো নক্ষত্রের ভেতর তৈরি হয়ে থাকে তাহলে সেগুলো সেখান থেকে এই পৃথিবীতে এলো কেমন করে?

1987 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি যুক্তরাষ্ট্রের উহসকনসিন স্টেটে একটা কনফারেন্স গিয়েছি–সারা পৃথিবী থেকে ছোট-বড় অনেক পদার্থবিজ্ঞানীরা এসেছেন, তাদেরকে আনন্দ দেবার জন্যেই কিনা জানি না ঠিক তখন সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনাটি ঘটে গেল। সকালে কনফারেন্সে এসে শুনতে পেলাম আগেরদিন একটা সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটেছে। এর আগে সুপারনোভা বিস্ফোরণ শুধুমাত্র তার আলো থেকে দেখা যেত, এই প্রথমবার বিজ্ঞানীরা আলো ছাড়াও অদৃশ্য নিউট্রিনো ডিটেক্টর তৈরি করেছেন এবং প্রথমবার সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকে বের হওয়া নিউট্রিনোকে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন। সারা পৃথিবীতে বিশাল হইচই পড়ে গেল!

সুপারনোভা বিষয়টি বোঝা খুব কঠিন নয়। মানুষের যেরকম জন্ম মৃত্যু হয় নক্ষত্রের সেরকম জন্ম মৃত্যু হয়। অপঘাতে মৃত্যু বা খুন জখমকে যদি বাদ দিই তাহলে মানুষের জন্ম মৃত্যুর একটা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে। নক্ষত্রের সেই প্রক্রিয়াটি নির্ভর করে তার ভরের উপর। নক্ষত্রের ভর যদি সূর্যের ভরের কাছাকাছি হয় তাহলে তার মৃত্যু হয় মোটামুটি বৈচিত্র্যহীন। নক্ষত্র তার জ্বালানী নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া করে শেষ করে ফেলে, মহাকর্ষের আকর্ষণে গ্রহটা সংকুচিত হয়ে ছোট হয়ে পৃথিবীর আকারের কাছাকাছি হয়ে থাকে। কিন্তু নক্ষত্রের ভর যদি সুর্যের ভর থেকে 1.4 গুণ বা তার বেশি হয় তাহলে তার মৃত্যুটি হয় চমকপ্রদ! নক্ষত্রটি তার জ্বালানী শেষ করে ফেলতে থাকে এবং নক্ষত্রের কেন্দ্রটি সংকুচিত হতে থাকে। জ্বালানী যেহেতু শেষ হয়ে আসছে নক্ষত্রকে ধরে রাখার কিছু নেই। কেন্দ্রটি হঠাৎ করে তখন সংকুচিত হয়ে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকার নিয়ে নেয়। বলা যেতে পারে।

পরমাণুগুলো ভেঙে তার নিউক্লিয়াসটিতে সমস্ত ভর এসে জমা হয়। কেন্দ্রে যেটি তৈরি হয়। তার নাম নিউট্রন স্টার। পুরো ব্যাপারটি ঘটে মাত্র সেকেন্ড দশেকের মাঝে। নিউক্লিয়াসটির ভরের শতকরা দশ ভাগ তখন শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে ভয়ংকর একটা বিস্ফোরণের জন্ম। দেয়, সেই বিস্ফোরণে পুরো নক্ষত্রটি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। (ছবি নং 1) 1987 সালের 24 ফেব্রুয়ারি ঠিক এ-রকম একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটতে দেখেছিল পৃথিবীর মানুষ।

এই বিস্ফোরণে নক্ষত্রের ভেতরে তৈরি হওয়া জটিল পরমাণুগুলো মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সেগুলো লক্ষ কোটি বছর পর মহাজাগতিক ধূলিকণা এবং অন্য সবকিছুর সাথে মিলে হয়তো কোথাও সৌরজগতের জন্ম দেয়। সেই সৌরজগতে সূর্য থাকে, থাকে পৃথিবীর মতো গ্রহ। পৃথিবীতে থাকে মানুষ জন্ম দেয়ার প্রয়োজনীয় অনু-পরমাণু যার জন্ম হয়েছে নক্ষত্রে এবং সুপারনোভা বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়েছিল মহাবিশ্বে।

তাই পৃথিবীর মানুষ যখন কখনো নিজের দিকে তাকায় তার বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে থাকার কথা। তার রক্তের ভেতরকার লৌহ পরমাণু, দাঁতের ক্যালসিয়াম, মস্তিষ্কের পটাশিয়াম সবগুলোর জন্ম হয়েছিল মহাজগতের কোনো এক নক্ষত্রে। অলৌকিক উজ্জ্বল আলোর ছটা ছড়িয়ে সেগুলো ছড়িয়ে পড়েছিল মহাজগতে। সেই হিসেবে আমরা সবাই কোনো না কোনো নক্ষত্রের অংশ।

যে মানুষ নক্ষত্রের অংশ সে কি কখনও কোনো ছোট কাজ করতে পারে? করা কি উচিৎ?

.

26. অদৃশ্য জগতের সন্ধানে

আকাশের দিকে তাকানোর ব্যাপারটি আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছি। নগরজীবনে ‘আকাশ’ শব্দটি ধীরে ধীরে অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে। অল্প জায়গায় অনেক মানুষকে জায়গা দেবার জন্যে উঁচু উঁচু বিল্ডিং মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। সেগুলো ধীরে ধীরে আকাশকে আড়াল করে দিচ্ছে । তারপরও কেউ যদি আকাশের দিকে তাকায় দেখবে সেটি সৌন্দৰ্য্যহীন বিবর্ণ। শহরের ধুলোবালিতে ধূসর। রাতের বেলা সেই আকাশ আমাদের চোখে পড়ে না, শহরের লক্ষ লক্ষ আলোর বিচ্ছুরণে আকাশ ঢাকা পড়ে থাকে। আকাশে গোপনে প্রায় অপরাধীর মতো চাঁদ ওঠে একসময় বড় হতে হতে পূর্ণিমা হয় আবার ছোট হতে হতে অমাবস্যার অন্ধকারে ঢেকে যায়। শহরের মানুষ কি কখনো সেটা দেখেছে? অনুভব করেছে?

আকাশের মতো এত চমৎকার একটি জিনিস আমাদের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে তার থেকে দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে? আমাদের কৃত্রিম জীবনে আকাশকে নির্বাসন দিয়েছি কিন্তু তবু সেটা আছে। কেউ যদি কখনো শহর থেকে দূরে প্রকৃতির কাছাকাছি কোনো গ্রামে, বিদ্যুহীন কোনো বনবাদাড়ে, নদীতে, খোলা প্রান্তরে রাতের বেলা এসে হাজির হয় এখনো সেই আকাশকে দেখতে পাবে। যদি আকাশে চাঁদ থাকে সেটা আমাদের দৃষ্টির অনেকখানি দখল করে রাখবে। যদি চাঁদ না থাকে তাহলে আমরা আকাশের নক্ষত্র দেখে মুগ্ধ হব। পরিষ্কার আকাশে ঝকঝকে নক্ষত্রের মতো অপূর্ব দৃশ্য আর কী আছে? কোন নক্ষত্র উজ্জ্বল, কোন নক্ষত্র অনুজ্জল, কোনটি মিটমিট করে জ্বলছে কোনটি স্থির । কোন কোন নক্ষত্রের আলোতে হালকা কোন একটি রংয়ের স্পর্শ। বছরের কোন সময় দেখছি তার উপর নির্ভর করে আমরা আবিষ্কার করতে পারি আকাশ-জোড়া ছায়াপথ! সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে এই নক্ষত্ররাজিকে দেখে আসছে, দৃশ্যটির খুব পরিবর্তন হয় নি। আকাশের সেই নক্ষত্রকে দেখে প্রাচীনকালের গুহাবাসী মানুষের মনে যে অনুভুতি হতো এতকাল পর এখনও আমাদের সেই অনুভূতি হয়। পার্থক্য শুধু এক জায়গায়, এখন আমরা এই রহস্যের খানিকটা বুঝতে পারি। হ্যাঁ, খানিকটা।

রাতের বেলা পরিষ্কার আকাশে আমরা কয়েক হাজার নক্ষত্র দেখতে পারি। মোটামুটি একটা বাইনোকুলার চোখে দিলে তার সংখ্যা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আবছা ধোয়ার মতো নক্ষত্ররাজি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বছরের ঠিক সময় ঠিক জায়গায় তাকাতে পারলে এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিটিও দেখা যায়। বাইনোকুলার ব্যবহার না করে ভালো টেলিস্কোপ ব্যবহার করলে হঠাৎ চোখের সামনে অসংখ্য নূতন নক্ষত্রের সাথে সাথে নূতন নূতন গ্যালাক্সি স্পষ্ট হয়ে উঠে। এরপর কোনো শেষ নেই মহাকাশের যত গভীরে দৃষ্টি দেয়া যায় সেখানে তত নূতন নূতন গ্যালাক্সি, তত নক্ষত্রপুঞ্জ, নেবুলা, কোয়াজার।

আমরা এই নক্ষত্ররাজির কথা জানি, গ্যালাক্সির কথা জানি কারণ আমরা সেগুলো দেখতে পাই। মানুষের চোখ নামে অপূর্ব এক জোড়া সম্পদ রয়েছে, দেখা নামক অভূতপূর্ব এক ধরনের প্রক্রিয়া রয়েছে। সেই চোখ আলোকে দেখতে পায় আর সেই আলো থেকে আমরা এই নক্ষত্ররাজি এই গ্যালাক্সির কথা জানি। যদি নক্ষত্র থেকে আলো বের না হতো তাহলে আমরা এই নক্ষত্রদের দেখতে পেতাম না, হয়তো তাদের কথা এত সহজে জানতে পারতাম না।

বিজ্ঞানীরা এই নক্ষত্ররাজি এবং গ্যালাক্সিমণ্ডলীকে দেখে অনুমান করার চেষ্টা করেছেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আকার কত বড়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল গ্রহ নক্ষত্র গ্যালাক্সি সবকিছু মিলিয়ে তার ভর কত। সেটা করতে গিয়েই তারা আবিষ্কার করলেন যে, তাদের হিসেব মিলছে না। আমরা আমাদের চোখে যে নক্ষত্ররাজি যে গ্যালাক্সি দেখছি সেটুকু যথেষ্ট নয়। তার বাইরেও আরও বিশাল কিছু থাকতে হবে, যেগুলো আমরা দেখতে পাই না। যেটা দেখতে পাই না সেটা আছে কিংবা নেই সেই প্রশ্নটাই আমরা করি কী করে?

একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে আমরা বোঝাতে পারি, আমরা চাঁদের কথা ধরি। ধরা যাক কোনো একটা কারণে চাঁদ আমাদের কাছ অদৃশ্য, আমরা চাঁদকে দেখতে পাই না। তাহলে পৃথিবীর মানুষ কি চাঁদের কথা জানতে পারত না? নিশ্চয়ই পারত এবং সেটা জানতে পারত নদী এবং সমুদ্রের পানিতে জোয়ার-ভাটা দেখে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে পরে কেন সমুদ্রের পানিতে জোয়ার এবং ভাটা হয় তার ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে, বিজ্ঞানীরা সুনমান করতেন পৃথিবীর কাছাকাছি নিশ্চয়ই কোনো একটা উপগ্রহ রয়েছে সেই উপগ্রহের আকর্ষণে সমুদ্রের পানি ফুলে-ফেপে ওঠে জোয়ারভাটার জন্ম দিচ্ছে। হিসেবপত্র করে তারা এই উপগ্রহের আকার আকৃতি বের করে ফেলতে পারবেন, পৃথিবীটাকে কতদিন পরপর প্রদক্ষিণ করছে। সেটাও অনুমান করে ফেলতে পারতেন।

ঠিক সেরকম মহাজগতে নানা নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জের গতি দেখে তারা অনুমান করার চেষ্টা করেন তাদের আশপাশে যে সব মহাজাগতিক বস্তু আছে তাদের ভর কত। গত কয়েক দশকে তারা আবিষ্কার করছেন যে, তাদের অনুমান মিলছে না। নক্ষত্র বা নক্ষত্রপুঞ্জ বা মহাজাগতিক গ্যাসের গতিবিধি দেখে আশপাশে যে ভর থাকা উচিত বলে অনুমান করা হচ্ছে প্রকৃত ভর তার থেকে অনেক কম। তাদের মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোনো ভর লুকিয়ে আছে যেটা তারা দেখতে পাচ্ছেন না।

আমাদের চোখ যে আলোকে দেখতে পায় তার বাইরেও কিন্তু আলো রয়েছে। আলো হচ্ছে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। এই তরঙ্গের দৈর্ঘ্য যখন একটা নির্দিষ্ট সীমার ভেতর থাকে শুধুমাত্র তখন সেটা আমরা দেখতে পাই, তার বাইরে চলে গেলে আমরা সেটা দেখতে পাই না। বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের বিশাল ব্যাপ্তির মাঝে আমরা যেটুকু দেখতে পাই সেটা খুবই ছোট, ধর্তব্যের মাঝেই আনার কথা নয়! কাজেই আমরা যেটাকে দৃশ্যমান আলো বলছি তার বাইরেও অদৃশ্য আলোর একটা বিশাল জগৎ রয়েছে। অতি বেগুনি রশ্মি বা আন্ট্রাভায়োলেট রে সেরকম আলো, এক্স-রে সে রকম আলো। এই অদৃশ্য আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থেকে ছোট। ফাইবার অপটিক্সে তথ্য পাঠানোর জন্যে যে আলো ব্যবহার করা হয় সেটিও অদৃশ্য আলো, আমরা তাকে বলি ইনফ্রারেড বা অবলাল আলো। এর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থেকে বেশি। মাইক্রোওয়েভ বা রেডিও, টেলিভিশন কিংবা মোবাইল টেলিফোনে তথ্য আদান প্রদান করার জন্যে আমরা যে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করি সেগুলোর তরঙ্গ দৈঘ্যও দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থেকে অনেক বেশি।

আমরা যে আলোকে দেখতে পাই তার বাইরেও বিশাল অদৃশ্য আলোর জগৎ জানার পর স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে সেই জগৎটা কেমন? আকাশের যে অংশ আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না সেটা দেখার জন্যে বিজ্ঞানীরা নতুন ধরনের টেলিস্কোপ তৈরি করেছেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অনেক আলো শোষিত হয়ে যায় বলে মহাকাশে টেলিস্কোপ পাঠিয়েছেন। পৃথিবীর বিশাল এলাকা নিয়ে অতিকায় রেডিও টেলিস্কোপ তৈরি করেছেন এবং মহাকাশকে তন্নতন্ন করে পর্যবেক্ষণ করেছেন। দৃশ্যমান জগতের বাইরে বিশাল অদৃশ্য জগৎ তারা খুঁজে পেয়েছেন কিন্তু আবার যখন হিসেব করতে বসেছেন তারা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছেন যে, এখনো হিসাব মিলছে না। এই মহাজগতে যে পরিমাণ বস্তু থাকার কথা সেই পরিমাণ বস্তু দেখা যাচ্ছে না। তারা নিশ্চিতভাবেই বলছেন এই মহাজগতে আমাদের চোখের কাছে অদৃশ্য এক ধরনের বস্তু রয়ে গেছে। খালি চোখে বা বিশেষ টেলিস্কোপে কোনোভাবেই সেটা দেখা যায় না বলে এর নাম দিয়েছেন অন্ধকার বস্তু বা ইংরেজিতে ডার্ক ম্যাটার । বর্তমান বিজ্ঞানের যে কয়টি রহস্য রয়েছে তার মাঝে সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক রহস্যের একটি হচ্ছে এই ডার্ক ম্যাটার রহস্য।

সৃষ্টিজগতের কতটুকু এই ডার্ক ম্যাটার বা অন্ধকার বস্তু? শুনলে নিশ্চয়ই চমকে যাবার কথা যে শতকরা 93 ভাগ আমাদের চোখে এখনো অদৃশ্য। আমরা যেটুকু দেখছি সেটি হচ্ছে মাত্র দশ ভাগ, বাকি অংশটুকু আমরা দেখছি না, সোজাসুজি দেখার কোনো উপায়ও নেই।

ডার্ক ম্যাটার কী দিয়ে তৈরি সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা দ্বিধাবিভক্ত। এক দলকে বলা যায় বেরিওনবাদী। তারা মনে করেন এই ডার্ক ম্যাটার আমাদের পরিচিত বেরিওন (নিউট্রন প্রোটন) দিয়ে তৈরি। যেহেতু তাদের থেকে আলো বের হয় না তাই আমরা তাদের দেখতে পারি না–কিন্তু তারা আছে। সোজাসুজি না দেখলেও তাদের প্রভাবটুকু অনুভব করা যায়। তাদের প্রবল মাধ্যাকর্ষণের কারণে কখনো-কখনো আলো বেঁকে যায়। কখনো বিশেষ অবস্থায় সেটা লেন্সের মতো কাজ করে। স্লান কোনো আলোকে উজ্জ্বল আলো হিসেবে দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা আমাদের ছায়াপথে পর্যবেক্ষণ করে অনুমান করছেন ডার্ক ম্যাটারের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ এরকম। মৃত নক্ষত্র এবং আলোহীন নানা ধরনের গ্যাস বা পদার্থ দিয়ে এসব তৈরি ।

ডার্ক ম্যাটার কী দিয়ে তৈরি তার দ্বিতীয় দলের মানুষদের বলা যায় বৈচিত্র্যবাদী! তারা মনে করেন বিশাল এই ডার্ক ম্যাটারের জগৎ আসলে আমাদের পরিচিত বেরিওন দিয়ে তৈরি নয়, সেগুলো তৈরি হয়েছে এমন কোন বিচিত্র পদার্থ দিয়ে আমরা এখনো যার খোঁজ পাই নি। তারা সেটার একটা গালভরা নাম দিয়েছেন (Weackly Interacting Massive Particles) WIMP এবং অনুমান করছেন আমাদের চারপাশে এগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিন্তু যেহেতু এগুলো আমাদের পরিচিত কিছু নয় তাই আমরা সেগুলো দেখতে পাচ্ছি না। সেগুলো খোঁজার জন্যে বিশেষ ধরনের ডিটেক্টর তৈরি করা হয়েছে। চরম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রায় রাখা সিলিকনের সেই ডিটেক্টর এ ধরনের বিচিত্র বস্তুর অস্তিত্ব নিয়ে পরীক্ষা করে যাচ্ছে। যদি সত্যি সেরকম কিছু খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে পদার্থবিজ্ঞানের সম্পূর্ণ নূতন একটি অধ্যায়ের সূচনা হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নূতন অধ্যায়ের সূচনা হোক আর পুরাতন অধ্যায় দিয়েই ব্যাখ্যা করা হোক মহাজগতের অদৃশ্য এই বিশাল ভর কোথা থেকে এসেছে সেটি জানার জন্যে বিজ্ঞানীরা নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে কাজ করে যাচ্ছেন। বিশাল এই জগতের কত ক্ষুদ্র অংশই না আমরা জানি এবং ভবিষ্যতের জন্যে আমাদের না জানি কত বিস্ময় লুকিয়ে আছে।

.

27. ব্ল্যাক হোল

ব্ল্যাক হোল (Black Hole) শব্দটা তুলনামূলকভাবে বেশ নূতন। 1969 সালে জন হুইলার প্রথম এটা ব্যবহার করেছিলেন। যদিও ব্ল্যাক হোল বিষয়টি মাত্র কিছুদিন থেকে পদার্থবিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে বসেছে কিন্তু মজার ব্যাপার হলো দুশ বছরেরও আগে ক্যামব্রিজের একজন বিজ্ঞানী, জন মিসেল প্রথম এর একটি ধারণা দিয়েছিলেন।

একটা সময় ছিল যখন কোনো কোনো বিজ্ঞানী ভাবতেন আলো হচ্ছে এক ধরনের কণা, অন্যেরা ভাবতেন এটা হচ্ছে তরঙ্গ। (মজার ব্যাপার হচ্ছে এখন দেখা গেছে দুটিই সত্যি, আলোকে কণা হিসেবে দেখা যায় আবার তরঙ্গ হিসেবেও দেখা যায়!) আলোকে তরঙ্গ হিসেবে দেখা হলে মহাকর্ষ বল কীভাবে এর উপর কাজ করবে সেটা অনুমান করা যায় না। কিন্তু এটাকে কণা হিসেবে দেখলে বিষয়টা খুব সহজ হয়ে যায়। একটা টেনিস বল উপরে ছুঁড়ে দিলে মধ্যাকর্ষণের কারণে এটা যে-রকম নিচে ফিরে আসে ব্যাপারটা অনেকটা সে রকম হয়ে যায়। জন মিশেল সেটাই করলেন–হিসেব করে দেখালেন, একটা নক্ষত্র যদি যথেষ্ট বড় হয়, তার ঘনত্ব যদি নির্দিষ্ট ঘনত্ব থেকে বেশি হয় তাহলে তার থেকে যে আলোটা বের হবে (যে আলোর কণা বের হবে। সেটা নক্ষত্র ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। নক্ষত্রের প্রবল আকর্ষণে আলোর কণা ঠিক উপরে ছুঁড়ে দেওয়া টেনিস বলের মতো নিচে ফিরে আসবে। এ-রকম কোনো নক্ষত্র যদি থাকে সেটাকে কেউ দেখতে পাবে না, কারণ সেখান থেকে কোনো আলো বের হবে না, উল্টো মনে হবে সব আলো বুঝি শুষে নিচ্ছে, মনে হবে অন্ধকারের গোলক বা ব্ল্যাক হোল।

জন মিশেলের ব্ল্যাক হোলের অবশ্যি একটা বড় সমস্যা রয়েছে, সেটা তখন কেউ জানত না। আলোর গতিবেগ সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশী হাজার মাইল এবং সেটা কখনোই কমে না। বা বাড়ে না! সব সময়েই এটা সমান–কাজেই নক্ষত্রের প্রবল আকর্ষণে আলোর কণার গতিবেগ কমে একসময় থেমে যাবে তারপর আবার নক্ষত্রের প্রবল আকর্ষণে আবার নক্ষত্রের বুকে ফিরে আসবে, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। মহাকর্ষ বল কীভাবে আলোর কণার উপর কাজ করে সেটা পুরাপুরি বোঝার জন্যে পৃথিবীর মানুষকে 1915 সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, যখন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তার জেনারেল থিউরি অব রিলেটিভিটি দিয়ে প্রথমবার সেটা ব্যাখ্যা করলেন। সত্যি কথা বলতে কি বিশাল নক্ষত্র কীভাবে তার মহাকর্ষ বল দিয়ে পরিবর্তিত হয়, কীভাবে আলোর কণার উপর কাজ করে সেটা পুরাপুরি বুঝতে বুঝতে আরো কয়েক দশক কেটে গেছে।

ব্ল্যাক হোল কীভাবে তৈরি হয় সেটা বোঝার জন্যে আগে একটা নক্ষত্র কীভাবে কাজ করে সেটা বুঝতে হবে। একটা নক্ষত্র তৈরি হয় যখন মহাকাশের কোথাও হাইড্রোজেন গ্যাসের বিশাল একটা ভাণ্ডার একত্র হয়। মহাকর্ষের কারণে হাইড্রোজেন গ্যাস সংকুচিত হতে শুরু করে, যতই এটা সংকুচিত হয় ততই এর তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। (গ্যাসকে সংকুচিত করা হলে তার তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াই খুবই পরিচিত ব্যাপার, এর উল্টোটাও সত্যি, সংকুচিত বাতাসকে যুক্ত করে দেওয়া হলে সেটা শীতল হয়ে যায়। রেফ্রিজিরেটর বা এয়ার কন্ডিশনারে এই প্রক্রিয়াটা ব্যবহার করা হয়। বাতাসকে সংকুচিত করার সময় সেটা যে বেশ গরম হয়ে যায় সেটা রেফ্রিজিরেটরের বা এয়ার কন্ডিশনারের পিছনে গেলেই আমরা টের পাই।) সংকুচিত হাইড্রোজেন গ্যাসের তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে যখন একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছায় তখন একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে পরমাণুর গতিবেগ বেড়ে যাওয়া কাজেই নক্ষত্রের ভেতরের হাইড্রোজেন পরমাণু প্রবল বেগে একটা আরেকটাকে ধাক্কা দিতে শুরু করে। গতিবেগ যদি খুব বেশি হয় তখন একটা হাইড্রোজেন পরমাণু অন্য পরমাণুকে ভেঙেচুড়ে একেবারে তার নিউক্লিয়াসে আঘাত করে। হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসগুলো একত্র হয়ে যখন হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস হয়ে মোট ভর কমে যায় তখন সেই বাড়তি ভরটুকু আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E = mc^2 অনুযায়ী শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। (সত্যি কথা বলতে কী হাইড্রোজেন বোমাটি আসলে এই একই ব্যাপার। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এখনো এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখেন নি –নক্ষত্রে সেটা নিয়ন্ত্রিতভাবে হয়!) একটা নক্ষত্রে যখন হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি শুরু হয় তখন সেটা শক্তি বিচ্ছুরণ করতে থাকে, আমরা তার আলোকে দেখতে পাই। নক্ষত্র যখন শক্তি দিতে শুরু করে তখন প্রথমবার সেই তাপশক্তি মহাকর্ষের প্রবল আকর্ষণকে ঠেকিয়ে রাখতে সম্ভব হয়। নক্ষত্রের সংকুচিত হওয়া হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়।

খুব স্বাভাবিকভাবেই এর পরের প্রশ্নটি এসে যায়, সেটি হচ্ছে যখন নক্ষত্রের সব হাইড্রোজেন এবং অন্যান্য নিউক্লিয়ার জ্বালানী শেষ হয়ে যাবে তখন কী হবে? যতক্ষণ ভেতর থেকে শক্তি তৈরি হচ্ছিল ততক্ষণ মহাকর্ষের প্রবল আকর্ষণকে ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছিল, যখন সেই শক্তি শেষ হয়ে যাবে এক অর্থে নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটবে, তখন মহাকর্ষ বলকে ঠেকিয়ে রাখার কেউ নেই সেটা আবার সংকুচিত হতে শুরু করবে। আমাদের সূর্য এ-রকম একটা নক্ষত্র তার সব জ্বালানী শেষ হতে এখনো পাঁচ বিলিয়ন বছর বাকী, যে সব নক্ষত্র আকারে বড় হয় তাদের জ্বালানী কিন্তু শেষ হয় তাড়াতাড়ি। তার কারণ বড় নক্ষত্রের তাপমাত্রা হয় বেশি তাই জ্বালানী খরচও হয় অনেক বেশি।

একটা নক্ষত্রের মৃত্যুর পর অর্থাৎ, ভেতরের জ্বালানী শেষ হবার পর যখন ভেতর থেকে আর তাপ সৃষ্টি হয় না, তখন মহাকর্ষের প্রচণ্ড আকর্ষণে নক্ষত্রের কী অবস্থা হয় সেটা প্রথম বের করেছিলেন ভারতবর্ষের বিজ্ঞানী সুব্রামানিয়ান চন্দ্রশেখর। তিনি তখন ছাত্র, 1928 সালে জাহাজে করে যাচ্ছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্যে। জাহাজে যেতে-যেতে বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেবে বের করলেন একটা নক্ষত্র সবচেয়ে বেশি কতটুকু বড় হতে পারে যেন নিউক্লিয়ার জ্বালানী শেষ হবার পরেও সেটা সংকুচিত হতে হতে এক জায়গায় এসে থেমে যায়! নক্ষত্র সংকুচিত হতে হতে একসময় এমন একটা পরিস্থিতি হবে যখন পরমাণুগুলো একেবারে গায়ে গায়ে লেগে যাবে। তখন সেটা আর ছোট হতে পারবে না । (পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এই প্রক্রিয়াটির একটা গালভরা নাম আছে সেটা হচ্ছে পলির এক্সক্লশান প্রিন্সিপাল)। একটা নক্ষত্র যখন এভাবে “মৃত্যুবরণ করে সেটাকে বলা হয় হোয়াইট ডোয়ারফ (White Dwarf) বা শ্বেত বামন। আজ থেকে পাঁচ বিলিয়ন বৎসর পরে আমাদের সূর্য হোয়াইট ডোয়ারফ হিসেবে মৃত্যুবরণ করবে। চন্দ্রশেখর হিসেব করে দেখালেন কোনো নক্ষত্র যদি সূর্য থেকে প্রায় দেড় গুণ পর্যন্ত বড় হয় সেটি শান্তিতে এবং নিরাপদ হোয়াইট ডোয়ারফের মৃত্যুবরণ করতে পারে এবং এটাকে বলা হয় চন্দ্রশেখর লিমিট বা চন্দ্রশেখর সীমা।

কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে সব নক্ষত্রই যে চন্দ্রশেখরের দেয়া সীমার ভেতরে থাকবে সেটা কে বলেছে? এটা তো বড়ও হতে পারে, যদি এটা এই বড় হয় তখন কী হবে? চন্দ্রশেখর দেখালেন তখন এই নক্ষত্রের মৃত্যু আর শান্তিময় নিরাপদ মৃত্যু নয়–এর মৃত্যু তখন ভয়ংকর একটি মৃত্যু। নক্ষত্রটি মহাকর্ষের প্রবল আকর্ষণে ছোট হতে হতে এত ছোট হতে শুরু করবে যে, কেউ তার সেই ভয়ংকর সংকোচন থামাতে পারবে না। সে রকম সংকোচনের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে না, শেষ পর্যন্ত কী হবে কারো কোনো ধারণা নেই। অল্প বয়েসী চন্দ্রশেখর যেদিন রয়াল এস্ট্রনমিক্যাল সোসাইটির সভায় তার এই যুগান্ত কারী আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেছিলেন সেদিন বিজ্ঞানের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত নৃশংস ঘটনা ঘটেছিল। তার ঘোষণার পরপরই চন্দ্রশেখরের শিক্ষক পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ছাত্রকে সকলের সামনে তুলোধূনো করতে শুরু করলেন। এডিংটন তখন ডাকসাইটে বিজ্ঞানী, চন্দ্রশেখর অল্পবয়সী তরুণ বিজ্ঞানী, কাজেই এডিংটনের সেই ভয়ংকর বক্তৃতার ফলাফল হলো ভয়ানক। এডিংটন প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন চন্দ্রশেখরের গবেষণার ফলাফল ভুল এবং অর্থহীন। একটা নক্ষত্র লাগামছাড়া ভাবে ছোট হতে হতে বিলীন হয়ে যাবে এটা এক ধরনের পাগলামো, বাতুলতা।

এডিংটনের সেই ভাষণের পর চন্দ্রশেখর মনের দুঃখে নক্ষত্রের মৃত্যু ‘হোয়াইট ডোয়ার্ফ’ এই ধরনের গবেষণা থেকেই সরে এলেন। শুধু তাই নয়, তিনি কেমব্রিজ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলেন। মজার কথা হচ্ছে 1983 সালে তাকে যখন নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় সেটা ছিল মূলত তার অভিমান ভরে ছেড়ে দেয়া নক্ষত্রের মৃত্যুর উপর গবেষণার জন্যে ।

চন্দ্রশেখর দেখিয়েছিলেন কোনো নক্ষত্র যদি চন্দ্রশেখর লিমিট থেকে বড় হয় সেটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে সংকুচিত হতে শুরু করে। প্রকৃত অর্থে কী হয় সেটা নিয়ে অভিমান করে তখন তিনি আর গবেষণা করেন নি। সেটা নিয়ে গবেষণা করে আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি ব্যবহার করে 1939 সালে প্রথম যিনি একটা সমাধান দিলেন তিনি হচ্ছেন তরুণ মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার। ঠিক তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ওপেনহাইমার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যুদ্ধের ডামাডোলে মানুষ নক্ষত্রের সংকোচন বা এই ধরনের বিষয় প্রায় ভুলেই গেল । নিউক্লিয়ার বোমা আবিষ্কারের পর সবার কৌতূহল দানা বাঁধল পরমাণু আর নিউক্লিয়াসের গঠনের উপর। 1960 সালের দিকে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আবার প্রায় ভুলে যাওয়া এই বিষয়টাতে ফিরে এলেন এবং অনেকেই নূতন করে ওপেনহাইমারের সমাধানটি নূতন করে আবিষ্কার করলেন।

ওপেনহাইমারের সমাধান থেকে আমরা একটা নক্ষত্রের সংকুচিত হয়ে ব্ল্যাক হোলে পরিবর্তিত হবার বিষয়টা কল্পনা করতে পারি। ধরা যাক একটা নক্ষত্র সংকুচিত হতে শুরু করেছে। এটা যতই সংকুচিত হচ্ছে ততই আরো ছোট জায়গার ভেতরে নক্ষত্রের পুরো ভরটুকু আঁটানো হচ্ছে। কাজেই মহাকর্ষ বল ততই বেড়ে যাচ্ছে। সূর্যগ্রহণের সময় দেখা যায় দূর নক্ষত্রের আলো মহাকর্ষের কারণে বেঁকে যায় ।

কাজেই নক্ষত্রের প্রবল মহাকর্ষের কারণে তার থেকে বের হওয়া আলোটুকুও ধীরে ধীরে ম্রিয়মান হতে শুরু করে। বাইরে থেকে কেউ যদি দেখে তাহলে দেখবে নক্ষত্রের আলো কমেছে এবং ধীরে ধীরে তার শক্তি, কমে আসছে। নক্ষত্র সংকুচিত হতে হতে যখন একটা বিশেষ আকারে সংকুচিত হয়ে যাবে তখন তার থেকে আলো বের হওয়াই বন্ধ হয়ে যাবে। জেনারেল রিলেটিভিটির সূত্র অনুযায়ী কোনো কিছুই আলোর গতিবেগ থেকে বেশি হতে পারে না, তাই নক্ষত্র থেকে যখন আর আলো বের হতে পারে না তখন তার থেকে আর কোনো কিছুই বের হতে পারে না। বাইরের জগতের সাথে তার আর কোনো যোগাযোগই থাকে না।

এ-রকম একটা অবস্থা যখন হয় সেটাকেই বলে ব্ল্যাক হোল। বিজ্ঞানের জগতে এর চাইতে চমকপ্রদ আর কিছু আছে বলে আমার জানা নেই!

.

28. বারো হাত কাকুড়ের তেরো হাত বিচি

একটা বিশাল নক্ষত্রের সকল জ্বালানী যখন শেষ হয়ে যায় তখন তার প্রবল মহাকর্ষ বলকে ঠেকিয়ে রাখার কিছু থাকে না। সেই মহাকর্ষ বল তখন পুরো নক্ষত্রটিকে একটা বিন্দুতে সংকুচিত করে আনে, আর এভাবেই ব্ল্যাক হোলের জন্ম হয়। যদিও কাগজে-কলমে পদার্থবিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের কথা অনেক আগেই প্রমাণ করেছেন কিন্তু মহাকাশে তাকিয়ে সত্যিকার ব্ল্যাক হোল খুঁজে পাওয়া খুব সহজ হয় নি। কারণটি সহজ–ব্ল্যাক হোল সত্যি আছে তার একেবারে একশভাগ বিশ্বাসযোগ্য সিগন্যালের খুব অভাব। অন্য অনেক মহাজাগতিক বস্তু আছে (যেমন নিউট্রন স্টার) যাদের সিগন্যালটি এত চমকপ্রদ যে সেটা অবিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই-–ব্ল্যাক হোলের বেলায় সে-রকম কিছু নেই।

ব্ল্যাক হোল আমাদের সব রকম কল্পনাকে হার মানায় সত্যি, কিন্তু একটা ব্ল্যাক হোলকে বর্ণনা করতে মাত্র তিনটি বিষয়ের প্রয়োজন। প্রথমটি হচ্ছে তার ভর, দ্বিতীয়টি হচ্ছে তার ঘূর্ণনের পরিমাণ (বিজ্ঞানের ভাষায় কৌণিক ভরবেগ) এবং তৃতীয়টি তার বৈদ্যুতিক চার্জ। ব্ল্যাক হোলের ভর থাকতেই হবে–সত্যি কথা বলতে কি বিশাল একটা ভরের কারণেই ব্ল্যাক হোলের জন্ম হয় কিন্তু অন্য দুটো বিষয়, ঘূর্ণন বা বৈদ্যুতিক চার্জ, থাকতেই হবে তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, নাও থাকতে পারে। কাজেই আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটির ভয়ংকর জটিল হিসেব করে যে ব্ল্যাক হোল পাওয়া যায় সেটাকে বর্ণনা করতে হলে শুধু তার ভরটুকু বলে দিলেই হয়। আর কিছু বলতে হয় না–এটা একটা অসাধারণ ব্যাপার।

কোথাও যদি একটা ব্ল্যাক হোল থাকে তাহলে তার আশপাশের যত গ্যাস ধূলিকণা অনু পরমাণু সবকিছু ব্ল্যাক হোলের আকর্ষণে সেদিকে ছুটে যেতে থাকবে। সেগুলো যতই ব্ল্যাক হোলের কাছে যেতে থাকবে ততই নিজেদের ভেতরে ধাক্কাধাক্কি হতে থাকবে। যার ফলে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করবে। তাপমাত্রা বাড়লে যে সেখান থেকে আলো বের হয় সেটা আমরা সবাই জানি মোমবাতির আলো থেকে লাইট বাল্বের ফিলামেন্ট সবকিছুতেই সেটা আমরা দেখেছি। কাজেই ব্ল্যাক হোলের আশপাশেও সেটা আমরা দেখব। ব্ল্যাক হোলের দিকে দ্রুত ধাবমান গ্যাস থেকে তীব্র উজ্জ্বল আলো বের হতে শুরু করছে। গ্যাস যত ব্ল্যাক হোলের কাছে যাবে সেটা তত বেশি উত্তপ্ত হবে আর সেখান থেকে তত বেশি শক্তিশালী আলো বের হবে। আলো এক ধরনের তরঙ্গ সেটা যত শক্তিশালী হয় তার তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য তত ছোট হতে থাকে, কাজেই ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি অনু, পরমাণুর তাপমাত্রা যখন কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে যাবে সেখান থেকে খুব ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের প্রচণ্ড শক্তিশালী এক ধরনের আলো বের হবে। ছোট তরল দৈর্ঘ্যে এই আলোকে আমরা খালি চোখে দেখি না। তবে এর নামটা সবাই জানি, এটাকে বলে এক্স-রে। ব্ল্যাক হোলের কাছে থেকে বের হয়ে আসা এক্স-রে দেখে বিজ্ঞানীরা মহাকাশে প্রথম একটা ব্ল্যাক হোলকে খুঁজে পেয়েছিলেন। পৃথিবী থেকে ছয় হাজার আলোকবর্ষ দূরে সেই ব্ল্যাক হোলটি সিগনাস এক্স ওয়ান (Cygnus X-1) নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীরা প্রায় শতকরা পঁচানব্বই ভাগ নিশ্চিত যে এটা সত্যিই একটা ব্ল্যাক হোল, শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিত নন। অনেকের ধারণা ব্ল্যাক হোলের ব্যাপারে কেউই কখনো শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিত হতে পারবে না। যে জিনিসটি শুধু যে চোখে দেখা যায় না তা নয়, তার ভেতর থেকে কোনো কিছু বের হতে পারে না। সেটার অস্তিত্ব সম্পর্কে শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিত হওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়।

কেউ যদি কখনো কোনো একটা ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি যায় তাহলে তারা যেটা দেখবে সেটা হচ্ছে একেবারে মিশমিশে কালো রংয়ের একটা গোলক। এই কালো গোলকটিকে বলে ব্ল্যাক হোলের দিগন্ত। আমরা পৃথিবীতে যখন দাঁড়াই তখন বহুদূরে দিগন্ত রেখা দেখতে পাই। দিগন্ত রেখার অন্য পাশে কিছু আমরা দেখতে পাই না। ব্ল্যাক হোলের দিগন্তের বেলাতেও সেটা সত্যি। দিগন্তের বাইরের অংশটুকু থেকে আলো বের হতে পারে কিন্তু দিগন্তের ভেতরে মহাকর্ষ বলের আকর্ষণ এত তীব্র সেখান থেকে আলো পর্যন্ত বের হতে পারে না। ব্ল্যাক হোলের দিগন্তের ভেতরে কী আছে সেটি কেউ কখনো দেখতে পাবে না!

ব্ল্যাক হোলের দিগন্তের আকার কত হবে সেটা বের করার খুব সহজ একটা সূত্র রয়েছে। একটা ব্ল্যাক হোলের ভর সূর্য থেকে যত গুণ বেশি তার দিগন্তের পরিধিটি হবে 18.5 কিলোমিটার থেকে ততগুণ বেশি। অর্থাৎ, যদি একটি ব্ল্যাক হোলের ভর হয় সূর্যের ভরের দশ গুণ তাহলে তার দিগন্তটি দিয়ে যে মিশমিশে কালো গোলক তৈরি হবে তার পরিধি হবে মাত্র 185 কিলোমিটার, ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দূরত্ব থেকেও কম! যদি ব্ল্যাক হোলের পুরো ভরটুকু এই ব্ল্যাক হোলের দিগন্ত দিয়ে তৈরি করা গোলকের মাঝে থাকত তাহলে এর ঘনত্ব হতো প্রতি এক সিসিতে 200 মিলিয়ন টন! সেটা কত বড় সেটা নিয়ে আর আলোচনার দরকার নেই। তবে সবচেয়ে যে বিস্ময়ের ব্যাপার সেটা হচ্ছে ব্ল্যাক হোলের বিশাল ভরটুকু কিন্তু দিগন্তের গোলকের মাঝে ছড়িয়ে থাকে না। সেটা একেবারে আক্ষরিক অর্থেই একটা বিন্দুর মাঝে সংকুচিত হয়ে থাকে। এই বিন্দুটিকে বলে ‘সিংগুলারিটি’ (Singularity) আর এর আকার হচ্ছে 10-33 সেন্টিমিটারের কাছাকাছি। এটি কত ছোট সেটা অনুভব করাও কঠিন। তুলনা করার জন্যে বলা যায় একটা পরমাণুর আকার থেকে একশত বিলিয়ন বিলিয়ন ভাগ ছোট। (যাদের মনে নেই তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া যায় এক বিলিয়ন হচ্ছে একশ কোটি!) দশটি সূর্যের সমান ভর কেমন করে এত ছোট একটি বিন্দুর মাঝে সংকুচিত হয়ে থাকে সেটি সম্ভবত এই জগতের সবচেয়ে বড় বিস্ময়গুলোর একটি।

কেউ লক্ষ করেছে কি না জানি না ব্ল্যাক হোলের দিগন্ত দিয়ে তৈরি গোলকটির কথা বলার সময় তার পরিধির কথা বলা হয়েছে। তার ব্যাসার্ধের কথা বলা হয় নি। আমরা একটা গোলককে বোঝাতে সব সময়েই তার ব্যাস কিংবা ব্যাসার্ধ দিয়ে প্রকাশ করি, কখনোই তার পরিধি দিয়ে প্রকাশ করি না! কিন্তু ব্ল্যাক হোলের দিগন্তের বেলায় তার পরিধির কথা বলা হয়েছে ব্যাসার্ধের কথা বলা হয় নি –এটি কোনো ত্রুটি নয়, আসলে ইচ্ছে করে করা হয়েছে। তার কারণ ব্ল্যাক হোলের দিগন্তের গোলকটির পরিধি কত সেটা আমরা জানি কিন্তু সেই গোলকের ব্যাসার্ধ কত সেটা আমরা জানি না।

আমি নিশ্চিত অনেকেই তার ভুরু কুঞ্চিত করে ফেলেছেন। সেই স্কুলে শেখানো হয়েছে একটা গোলকের ব্যাসার্ধ যদি হয় R তাহলে পরিধি হচ্ছে 2πR। কাজেই ব্ল্যাক হোলের দিগন্তের গোলকটির পরিধিকে 2π (6.28 এর কাছাকাছি) দিয়ে ভাগ করলেই পেয়ে যাব। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এটি সত্যি নয়। যে গোলকটির পরিধি মাত্র 185 কিলোমিটার তার কেন্দ্রটি কিন্তু গোলকের পৃষ্ঠে থেকে লক্ষ কোটি মাইল দূরে হতে পারে। ব্ল্যাক হোলের বিশাল ভরের কারণে তার চারপাশের এলাকাটুকুও (Space) ভয়াবহভাবে সংকুচিত হয়ে যেতে পারে। কাজেই দূরত্ব বলতে আমাদের যে পরিচিত ধারণা আছে তার কোনোটিই এখানে খাটবে না।

বিষয়টা কীভাবে ঘটে সেটা একটা অন্য উদাহরণ দিয়ে বোঝানো সম্ভব। মনে করা যাক, একটা বৃত্তাকার রবারের পাতলা পর্দাকে টানটান করে রাখা হয়েছে। তার ঠিক কেন্দ্রে আমরা একটা বিন্দু একেছি। এই বিন্দু থেকে বৃত্তের পরিসীমা পর্যন্ত দূরত্ব হচ্ছে R1 এবং বৃত্তের পরিসীমা হচ্ছে 2πR1 আমরা সেই স্কুলে এটা শিখেছি।

এবারে ছোট একটা পাথর এনে আমরা রবারের তৈরি বৃত্তের কেন্দ্রে রাখতে পারি । পাথরের ভরের কারণে রবারের এই পৃষ্ঠটির কেন্দ্রটি খানিকটা ঝুলে যাবে। এবারে কেন্দ্র থেকে বৃত্তের পরিসীমা পর্যন্ত দূরত্ব হচ্ছে R, এবং দেখাই যাচ্ছে R2 হচ্ছে R1 থেকে বেশি। বৃত্তের পরিসীমা হচ্ছে 2πR1কিন্তু “ব্যাসার্ধ” R1নয়, ব্যাসার্ধ 1R থেকে বেশি R2।

যদি আরো ভারী একটা পাথর রাখা হয় তাহলে কেন্দ্রটি আরো নিচে নেমে আসবে এবং যদিও পরিধির কোনো পরিবর্তন হয়নি, “ব্যাসার্ধ R; হবে আরও অনেক বেশি। আমরা প্রচলিতভাবে ব্যাসার্ধ বলতে যা বোঝাই এখানে সেটি আর ব্যবহার করা হচ্ছে না । কিন্তু ব্যবহার করার উপায়ও নেই! ব্ল্যাক হোলের বেলাতেও তাই হয়। পাথরের ভরের কারণে যে রকম রবারের পাতলা পর্দা ঝুলে পড়ে ব্ল্যাক হোলের ভরের কারণেও ঠিক সেরকম চারপাশের এলাকা বা ক্ষেত্র ঝুলে পড়ে। রবারের পদার্থ ছিল দ্বিমাত্রিক । ব্ল্যাক হোলের বেলায় সেটা হবে ত্রিমাত্রিক, এটাই পার্থক্য।

শৈশবে রূপকথার গল্পে আমরা পড়েছিলাম বারো হাত কাকুড়ের তেরো হাত বিচি। সেটা সম্ভব হবে কেউ কখনো কল্পনা করে নি–কিন্তু ব্ল্যাক হোলের বেলায় সেটা সত্যি। গোলকের পরিধি ছোট কিন্তু তার ব্যাসার্ধ বিশাল।

ব্ল্যাক হোলের প্রকৃত ব্যাসার্ধ কত সেটা বের করা সহজ নয়। কারণ, এক ক্ষুদ্র বিন্দুতে সীমাবদ্ধ বিশাল ভর কিন্তু শান্ত হয়ে বসে নেই, সেখানে ক্রমাগত প্রলয়কাণ্ড চলছে। তার কারণে তার চারপাশের ক্ষেত্রে এক বিশাল আলোড়ন সঠিকভাবে পরিধি থেকে কেন্দ্রের দূরত্ব বের করার কোনো উপায় নেই। কেউ একজন যে কখনো সেখানে ঢুকে কী হচ্ছে দেখে আসবে তারও কোনো উপায় নেই। প্রকৃতি অনেক আগেই সেটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রেখেছে।

ব্ল্যাক হোলের ভেতরে কী হচ্ছে সেটা কেউ কখনো জানবে না। কিন্তু কল্পনা করতে পারবে না সেটা তো কেউ বলে নি–এই হিসেবে মানুষের ভাবনার জগৎ থেকে বড় কিছু আর নেই–সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।

.

29. মহাজাগতিক সংঘর্ষ

কোনো জিনিস আকারে খুব বড় হলে সেটা সাধারণত আমাদের ভেতরে এক ধরনের মুগ্ধ। বিস্ময়ের জন্ম দেয়। মাঝে মাঝে অবশ্য আমরা তার ব্যতিক্রম খুঁজে পাই, এমন কোনো জিনিস আমাদের চোখে পড়ে যার আকারটি অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিশাল এবং তার বিশালত্ব নিজের কাছে ক্ষতিকর, অনেক সময় দৃষ্টিকটু এবং এ-রকম জিনিসকে আমরা ডাইনোসর বলে উপহাস করি। তার কারণ পৃথিবীতে একসময় ডাইনোসর বলে এক ধরনের বিশাল সরীসৃপ রাজত্ব করত এবং আজ থেকে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বৎসর আগে পৃথিবীতে টিকে থাকতে না পেরে তারা পুরাপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কোনো প্রাণী যদি পৃথিবীতে টিকে থাকতে না পারে তাহলে আমরা সেটাকে তার সীমাবদ্ধতা মনে করে উপহাস করতেই পারি, আমাদের কারো কাছে সেটা মোটেও বিচিত্র মনে হয় না।

তবে যে জিনিসটা আমরা একবারও চিন্তা করি না সেটা হচ্ছে–ধ্বংস হয়ে যাবার আগে ডাইনোসর পৃথিবীর বুকে একশ ত্রিশ মিলিয়ন বৎসর বেঁচেছিল। একশ ত্রিশ মিলিয়ন বৎসর সুদীর্ঘ সময় তুলনা করার জন্যে বলা যায় পৃথিবীতে আমরা (হোমোস্যাপিয়েন) এসেছি মাত্র চল্লিশ হাজার বৎসর আগে। এই চল্লিশ হাজার বৎসরেই পৃথিবীটাকে আমরা এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছি যে আমাদের সন্তানদের কাছে এটা বাসযোগ্য রেখে যেতে পারব কী না সেটা নিয়ে আমাদের নিজেদের ভেতরেই সন্দেহের জন্ম হয়েছে। যদি পরিবেশ পুরাপুরি ধ্বংস না করেও কোনোভাবে টিকে যেতে পারি তারপরেও পৃথিবীর যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রপতিরা লোভ এবং গোয়ার্তুমি করে পুরো পৃথিবীটা ধ্বংস করে দিতে পারে। পৃথিবীতে মানুষ এক লক্ষ বছর বেঁচে থাকবে কিনা আমরা জানি না, ডাইনোসর একশ ত্রিশ মিলিয়ন। বৎসর বেঁচেছিল। যেটা এক লক্ষ থেকে একশ ত্রিশ হাজার গুণ বেশি। কাজেই কেউ যদি সাইনোসরকে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার অযোগ্য একটা প্রাণী ভেবে থাকে সে খুব বড় ভুল করবে।

তবে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, পৃথিবীর অত্যন্ত সফল একটা প্রাণী যারা দোর্দণ্ড প্রতাপে সারা পৃথিবীতে রাজত্ব করত তারা বিস্ময়করভাবে আজ থেকে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বৎসর আগে পুরাপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কীভাবে এটা ঘটেছে সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক চিন্তাভাবনা করে একটি ব্যাখ্যা বের করেছেন। সেটি এ রকম :

আজ থেকে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বৎসর আগে কোনো একদিন যখন পৃথিবীর বুকে বিশাল ডাইনোসরেরা গাছের মাথা থেকে পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছে এবং আমাদের পূর্বপুরুষ ইঁদুরের মতো ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী জঙ্গলের ফাঁক-ফোকড়ে ছোটাছুটি করছে তখন হঠাৎ আকাশ থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার বড় একটি গ্রহকণা পৃথিবীর বুকে ছুটে এসেছিল। সেই বিশাল গ্রহকণার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় একশ হাজার কিলোমিটার থেকে বেশি। সেই বিশাল গ্রহকণার গতিবেগ এত বেশি ছিল যে, বলা যেতে পারে বায়ুমণ্ডলে একটা ফুটো তৈরি করে মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপ এলাকায় এসে আঘাত করেছিল। সেই ভয়ংকর গতিবেগ ছিল অপ্রতিরোধ্য। সেটা সমুদ্রের তলদেশে আঘাত করেও কঠিন পাথর ভেঙে কযেক কিলোমিটার ঢুকে গেল। এই ভয়ংকর আঘাতে যে বিস্ফোরণ হলো সেটি পৃথিবীর সকল নিউক্লিয়ার বোমা থেকেও দশ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল। সমুদ্রের তলদেশে যে গর্তের জন্ম হয়েছিল তার ব্যস ছিল 150 কিলোমিটার। বিস্ফোরণের পাথর ধুলাবালি বায়ুমণ্ডলের সেই গর্তের ভিতর দিয়ে উপরে উঠে গেল এবং কিছু বোঝার আগে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। সমুদ্রে ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাসের জন্ম হলো, সেটা সমুদ্র মহাসমুদ্র দিয়ে পৃথিবীর উপকূলে আছড়ে পড়ল। বিস্ফোরণের ধুলাবালি পাথর ধীরে ধীরে পৃথিবীতে পড়তে শুরু করে এবং দেখতে দেখতে সারা পৃথিবী কালো ধুলাবালিতে ঢেকে গেল। বায়ুমণ্ডলে যে ধুলাবালি ছড়িয়ে পড়েছে সেটা সূর্যের আলোকে ঢেকে দিল। সারা পৃথিবী তখন অন্ধকারে ডুবে গেল। মাসের পর মাস পৃথিবীতে ঘন অন্ধকার, তাপমাত্রা দেখতে-দেখতে নিচে নেমে এলো, সারা পৃথিবীতে তখন এক হিমশীতল পরিবেশ। বিস্ফোরণের সময় প্রচণ্ড তাপে যে নাইট্রোজেন অক্সিজেনের সাথে সংযুক্ত হয়েছে পানির সাথে মিশে সেটি ভয়ংকর এসিডের জন্ম দিলো, পুরো একটা মহাদেশ সেই এসিডের বৃষ্টিতে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল। বিস্ফোরণের প্রবল ধাক্কায় পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ফাটলের জন্ম হয়ে শত শত আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত করতে শুরু করে। অন্ধকার, এসিড-বৃষ্টি, শীত এবং অগ্ন্যুৎপাত–সব মিলিয়ে পৃথিবীতে যে নারকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হলো সেটি সব ডাইনোসরকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিল। শুধু যে ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হলো তা নয়–সেই ভয়ংকর দুর্ঘটনার ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর সকল জীবিত প্রাণী গাছপালা সবকিছুর দুই-তৃতীয়াংশ পৃথিবীর বুক থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল।

এই ঘটনাটি কী শুধু বিজ্ঞানীদের অনুমান নাকি তার পিছনে যুক্তি আছে সেটি পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব। পৃথিবীর বুকে খোদাই করে পাথরের যে স্তরটি পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বৎসর আগে জমা হয়েছিল সেখানে ইরিডিয়াম নামে একটা ধাতু দেখা গেছে। এই ধাতু পৃথিবীর উপরে থাকার কথা নয়, মহাকাশ থেকে কোনো একটি গ্রহকণা পৃথিবীতে ভয়ংকর গতিবেগে আঘাত করলেই তার বিস্ফোরণে সারা পৃথিবীতে যে ধূলিকণা ছড়িয়ে পড়বে সেখানে এটি থাকবে। শুধু তাই নয় মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপে সমুদ্রের নিচে গ্রহকণার সংঘাতে তৈরি প্রায় দেড়শ কিলোমিটার ব্যাসের গর্তটিকে খুঁজে পাওয়া গেছে। পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বৎসর আগের গাছপালার যে ফসিল পাওয়া গেছে সেগুলো থেকেও প্রমাণ পাওয়া গেছে হঠাৎ করে সারা পৃথিবী হঠাৎ করে ভয়াবহভাবে শীতল হয়ে গিয়েছিল! বিজ্ঞানীরা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত আজ থেকে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বৎসর আগে সত্যি সত্যি এই পৃথিবীর বুকে মহাকাশ থেকে মৃত্যুদূতের মতো একটি গ্রহকণা নেমে এসেছিল।

যদি আমরা বিজ্ঞানীদের এই তত্ত্ব মেনে নিই, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবে পরের প্রশ্নটি এসে যায়। আবার কি পৃথিবীর বুকে এ-রকম সাক্ষাৎ-মৃত্যু নেমে আসতে পারে? উত্তর হচ্ছে হাঁ পারে। সত্যি কথা বলতে কি ইতোমধ্যেই এ-রকম আরো ঘটনা ঘটে গেছে। আজ থেকে মাত্র পনেরো থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে প্রায় পঁচিশ মিটার বড় একটা উল্কা এসে যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনা অঙ্গরাজ্যকে আঘাত করেছিল। তার চিহ্ন হিসেবে সেখানে প্রায় দেড় কিলোমিটার ব্যাস এবং দুইশ মিটার গভীর গর্তের চিহ্নটি এখনো সেখানে রয়ে গেছে। অতি সাম্প্রতিক ঘটনাটি ঘটেছে 1908 সালের 30 জুন সাইবেরিয়ার তুঙ্গুসকাতে। সেদিন ভোররাতে আকাশের বুক চিরে একটা উল্কা পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছিল। তার ভয়ংকর বিস্ফোরণে প্রায় তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার একটা পুরো বনাঞ্চলের সব গাছ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন প্রায় একশ মিটার বড় একটি উল্কা মাটির কাছাকাছি পৌঁছে ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। এই বিস্ফোরণে বায়ুমণ্ডলে যে ধুলোবালি জমা হয়েছিল সারা পৃথিবীর  মানুষ সেটা দেখেছে। সৌভাগ্যক্রমে সাইবেরিয়াতে কোনো মানুষজন থাকে না, তাই কোনো মানুষের জীবন নষ্ট হয় নি। কিন্তু ঘটনাটি যদি কোনো লোকালয়ে হতো তাহলে কী হতো সেটা চিন্তা করে মানুষ এখনো আতঙ্কে শিউরে ওঠে।

পৃথিবীর কক্ষপথ আর গ্রহাণুপুঞ্জের কক্ষপথ একটি আরেকটিকে ছেদ করে তাই মাঝে মাঝেই এধরনের ঘটনা ঘটবে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থাকার কারণে এই উল্কাগুলো মাটিতে পৌঁছানোর আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। উল্কাগুলোর আকার যদি বড় হয় তাহলে মাটিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পুড়ে শেষ হতে পারে না। বিজ্ঞানীদের হিসেবে প্রতি একশ বছরে একটা পঞ্চাশ থেকে ষাট মিটারের উল্কা পৃথিবীতে আঘাত করতে পারে। তবে তার বেশির ভাগই সমুদ্রে পড়বে, আমরা হয়তো বুঝতেই পারব না। প্রতি মিলিয়ন বছরে দশ কিলোমিটারের একটা সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত পৃথিবীতে নেমে আসতে পারে। সেটি যদি পৃথিবীতে আঘাত করে তার ফলাফল হবে ভয়ানক, পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর প্রাণিজগৎ সেটা টের পেয়েছিল। 1972 সালে এক হাজার টনের একটা উল্কা পৃথিবীর কাছাকাছি দিয়ে উড়ে গিয়েছিল। অল্পের জন্য সেটা পৃথিবীকে আঘাত করে নি। 1991 সালে প্রায় দশ মিটার বড় একটা গ্রহকণা পৃথিবী এবং চাঁদের মাঝখান দিয়ে উড়ে গিয়েছিল।

কাজেই ধরে নেয়া যেতে পারে মহাজাগতিক এধরনের সংঘর্ষ হওয়া এমন কিছু বিচিত্র নয়। রাতের আকাশে আমরা যখন হঠাৎ করে একটা উল্কাকে নীলাভ আলো ছড়িয়ে উড়ে যেতে দেখি তখন আমরা এক ধরনের বিস্ময় মেশানো আনন্দ অনুভব করি। কথিত আছে তখন মনে-মনে যে ইচ্ছাটা করা হয় সেটাই পূরণ হয়। কিন্তু হঠাৎ করে এই উল্কাগুলো যদি কয়েক কিলোমিটার বড় হয়ে যায় তাহলে পৃথিবীর পুরো সভ্যতা এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তাই পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এই বিষয়টাকেও গুরুত্বের দিয়ে দেখছেন। পৃথিবীর কিছু বড় বড় টেলিস্কোপকে আকাশমুখী করা হয়েছে পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা বিভিন্ন গ্রহকণাগুলো খুঁজে বের করতে। এ রকম একটি টেলিস্কোপ ছিল হাওয়াইয়ের মনাকীতে। সেটাই 1991 সালের দশ মিটার বড় গ্রহকণাটিকে খুঁজে বের করেছিল। স্পেস গার্ড নামে নূতন একটা প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছে, পঁচিশ বছরে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার খরচ করে পৃথিবীর এক কিলোমিটারের কাছাকাছি সবগুলো গ্রহকণাকে খুঁজে বের করে তার তালিকা করা হচ্ছে। সেগুলোকে চোখে চোখে রাখা হবে। হঠাৎ করে কোনো একটা যদি পৃথিবীমুখী রওনা দেয় সেটাকে কীভাবে মহাকাশে নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হবে সেটা নিয়েও গবেষণা হচ্ছে। এই মুহূর্তে আমাদের প্রযুক্তি হয়তো পুরাপুরি প্রস্তুত হয় নি, কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে আমাদের প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে, কাজেই তখন সেটি এমন কিছু অসম্ভব কাজ বলে মনে হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *