০৪. রসায়ন

রসায়ন

8. অক্সিজেন : নিত্যকালের সঙ্গী

একটু যদি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা হয় তাহলে দেখা যায় আমরা আসলে অত্যন্ত নাজুক সৃষ্টি। এই সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে জটিল বিষয়টি হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক, সেটাকে করোটির ভেতরে সাবধানে রেখে শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে সাবধানে একটা ‘সিস্টেম’ দাঁড় করানো হয়েছে। সিস্টেমটা চালু রাখার জন্যে আমাদের দিনে কয়েক বার খেতে হয়। না খেয়ে কতদিন থাকা যায়–ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছায় হোক সেই পরীক্ষা অনেকবার হয়ে গেছে।

মেক্সিকোর ভূমিকম্পের পর কয়েক জন নবজাতক শিশুকে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে নয়দিন পর উদ্ধার করা হয়েছিল, আমার জানামতে সেটাই হচ্ছে দীর্ঘ সময় কিছু না খেয়ে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় রেকর্ড। কোনো পানীয় কিংবা কোনো খাবার না খেয়ে মানুষ কয়েক দিন বেঁচে থাকতে পারলেও নিশ্বাস না নিয়ে সে কিন্তু কয়েক মিনিটও বেঁচে থাকতে পারে না। আমাদের মিনিটে বিশ থেকে ত্রিশবারের মতো নিশ্বাস নিতে হয়। নিশ্বাস নেবার অর্থ হচ্ছে বাইরের বাতাসকে বুকের ভেতরে ফুসফুসে টেনে নেয়া। বাতাসে অনেক ধরনের গ্যাস রয়েছে তার মাঝে সবচেয়ে বেশি রয়েছে নাইট্রোজেন, শতকরা 77 ভাগ। অক্সিজেন রয়েছে শতকরা 21 ভাগ, এই দুই মিলেই শতকরা আটানব্বই ভাগ। বাকি দুই ভাগ এসেছে আরও অনেক গ্যাস থেকে, সেগুলো হচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইড, আরগন, হিলিয়াম, নিওন, ক্রিপ্টন, জিনন, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন ঋতু বা জলবায়ুর উপর নির্ভর করে বাতাসে সব সময় খানিকটা জলীয় বাষ্প থাকে। আরগন হিলিয়াম, আর নিওন হচ্ছে পুরাপুরি নিষ্ক্রীয় গ্যাস আবার কার্বন মনোঅক্সাইড সবচেয়ে বিষাক্ত গ্যাসগুলোর একটি। বাতাসে এদের পরিমাণ খুব কম তাই আমরা বেঁচে থাকি।

নিশ্বাস নেবার সময় সবগুলো গ্যাসই আমাদের বুকের ভেতর টেনে নিই কিন্তু ব্যবহার করি শুধুমাত্র অক্সিজেনকে। এই অক্সিজেনই আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। একজন মানুষ যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে অনেক সময় তার নিজে থেকে নিশ্বাস নেবার ক্ষমতা থাকে না তখন তাকে আলাদা করে অক্সিজেন দিতে হয়। অনেক সময় সময়ের আগে শিশুদের জন্ম হয়ে যায়, তার শরীর তখন পুরাপুরি গঠিত হয় নি। প্রথম প্রথম ইনকুবেটরে রাখতে হয়। ইনকুবেটরে তাদের নিশ্বাস দেবার জন্যে যে বাতাস দেয়া হয় সেখানে অক্সিজেন থাকে অনেক বেশি শতকরা ত্রিশ থেকে চল্লিশ ভাগ। নিশ্বাস নিতে খুব সমস্যা এ-রকম নবজাতকদের একেবারে পুরাপুরি শতকরা একশভাগ অক্সিজেনের মাঝে রেখে দেওয়ারও নজির আছে, তবে সেটি করতে হয় খুব সাবধানে। কারণ, কম অক্সিজেন যে-রকম বিপজ্জনক, প্রয়োজন থেকে বেশি অক্সিজেনও ঠিক সেরকম বিপজ্জনক। রক্তে বেশি অক্সিজেন চলে গেলে চোখের শিরা-উপশিরা ফেটে গিয়ে নবজাতকদের চোখের দৃষ্টির বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

আমরা নিশ্বাসে নিশ্বাসে অক্সিজেন গ্রহণ করি বলে এই গ্যাসটিকে খুব আপন একটা গ্যাস হিসেবে ধরে নিয়েছি। কিন্তু যদি একটাকে শুধুমাত্র রাসায়নিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতাম তাহলে অত্যন্ত সভয়ে এই গ্যাসটাকে বিবেচনা করতে হতো। প্রকৃতিতে যত উপাদান আছে তার মাঝে সবচেয়ে বেশি বিক্রিয়া করতে পারে যে কয়টি গ্যাস আছে তার মাঝে অক্সিজেন একটি। কঠিন লোহার মতো ধাতু জং পড়ে শেষ হয়ে যায় সেটাও অক্সিজেনের কারণে। যখনই দেখি আগুন জ্বলছে সেটি আর কিছুই নয় সেটা হচ্ছে অক্সিজেনের বিক্রিয়া। এ-রকম ভয়ংকর বিক্রিয়াশীল একটা গ্যাস আমরা আমাদের শরীরে শক্তি তৈরি করার জন্যে ব্যবহার করি, সেটা প্রকৃতির জন্যে একটা বিশাল কৃতিত্বের ব্যাপার। আমরা যেটাকে বলি “পোড়া” তার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে অক্সিডেশান অর্থাৎ, অক্সিজেনের সাথে সংযোগ। পোড়ানো বলতে আমরা যেটা বোঝাই সেটা ঘটে খুব দ্রুত কিন্তু সেটা আস্তে আস্তেও ঘটতে পারে। লোহার জং ধরা হচ্ছে তার উদাহরণ, সেটা অক্সিডেশান কিন্তু সেটা কয়েকমিনিটের মাঝে ঘটে না সেটা ঘটতে সময় নেয়। আপেল কেটে রেখে দিলে তার মাঝে একটা লালচে রং চলে আসে সেটাও অক্সিডেশান। কাগজ পুরানো হলে সেটা বাদামি রং নেয় সেটাও অক্সিডেশান। এই অক্সিজেশানগুলো হয় খুব ধীরে ধীরে। আগুন ধরে কিছু পুড়ে যাবার সময় অক্সিডেশানের কারণে প্রচণ্ড তাপ বের হয় তার কথা আমরা সবাই জানি যখন সেটা ধীরে ধীরে হয় তখনও কিন্তু তাপ বের হয় কিন্তু সেটা খুব কম বলে আমরা ধরতে পারি না।

আমাদের শরীরে শক্তি তৈরি করার জন্যে অক্সিডেশান হয় এবং সেটাও দাউদাউ করে আগুন জ্বলার মতো হয় না সেটা হয় খুব ধীরে ধীরে। আমরা যখন নিশ্বাস নেই তখন ফুসফুসের ভেতর যে বাতাসটুকু ঢুকে তার অক্সিজেনটুকু ফুসফুসের বিশেষ ধরনের টিস্যুর মাধ্যমে রক্তের লোহিত কণিকার উপর চেপে বসে। লোহিত কণিকা সেই অক্সিজেনকে বহন করে নিয়ে যায় শরীরের সর্বত্র। একেবারে আনাচে কানাচে। আমরা যা খাই সেগুলোও শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, লোহিত কণিকা দিয়ে বহন করে আনা অক্সিজেন সেই খাবারকে অক্সিডেশান করে। বাইরে জৈব পদার্থ পোড়ালে সব সময়েই কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি হয়, শরীরের ভেতরে সেটা ঘটে। অক্সিডেশান করে শক্তির জন্ম দেবার পর, সেই কার্বন ডাই অক্সাইড়কে আবার লোহিত কণিকা ফুসফুসে ফেরত আনে। আমাদের প্রশ্বাসের সাথে সেই কার্বন ডাই অক্সাইড বের হয়ে আসে। এবং নিশ্বাস আর প্রঃশ্বাসের এই সমন্বয় বজায় না রাখলে আমরা কয়েক মিনিটের মাঝে মারা পড়ব।

আমাদের বেঁচে থাকার জন্যে অক্সিজেনের প্রয়োজন। প্রতিমুহূর্তে আমরা এবং আমাদের মতো অন্যান্য প্রাণীরা নিশ্বাসের সাথে সাথে অক্সিজেন গ্রহণ করে সেটাকে শরীরে ব্যবহার করে কার্বন ডাই অক্সাইড বের করে দিচ্ছি। শুধু যে আমরা অক্সিজেন ব্যবহার করি তা নয়, গাড়ি কলকারখানা যন্ত্রপাতি সবজায়গাতেই কয়লা, তেল, গ্যাস পুড়িয়ে শক্তি তৈরি করার সময় অক্সিজেন ব্যবহার করা হয় এবং সেখান থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বের হয়ে আসে। তাহলে অত্যান্ত সঙ্গত প্রশ্ন পৃথিবীর অক্সিজেন কি ধীরে ধীরে কমে আসছে? এমন একটা কি সময় আসবে যখন পৃথিবীতে আমাদের নিশ্বাস নেবারও অক্সিজেন থাকবে না?

আমাদের প্রকৃতি আসলে অত্যন্ত কৌশলী, প্রাণিজগৎ যেন অক্সিজেনের অভাবে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা না যায় সেটা নিশ্চিত করার জন্যে ক্রমাগত অক্সিজেন তৈরি করার একটা বিশাল প্রাকৃতিক ফ্যাক্টরি তৈরি করে রেখেছে। সেই ফ্যাক্টরির নাম হচ্ছে গাছ। মানুষ বা

অন্যান্য প্রাণী নিজের খাবার নিজে তৈরি করতে পারে না, গাছ পারে। তারা মাটি থেকে পানি, বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড আর আকাশ থেকে সূর্যের আলো নিয়ে একটা জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া করে নিজের খাবারটা নিজে তৈরি করে নেয়। এই খাবার তৈরি করার প্রক্রিয়ায় খানিকটা বর্জ্য পদার্থ বের হয়ে আসে। সেই মহামূল্যবান বর্জ্য পদার্থটাই হচ্ছে অক্সিজেন । আলোকে নিয়ে সংশ্লেষণ করে খাবার তৈরি করার এই চমকপ্রদ প্রক্রিয়াটির একটা চমকপ্রদ নাম আছে, সেটা হচ্ছে সালোক সংশ্লেষণ। পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ গাছ সালোক সংশ্লেষণ করে ক্রমাগত অক্সিজেন তৈরি করে যাচ্ছে বলে আমাদের অক্সিজেনের অভাব হয় না। আমরা যখন আহতুক একটা গাছ কেটে ফেলি আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা তখন আমাদের বেঁচে থাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অক্সিজেনের সরবরাহ হতে (যত কমই হোক) একটু হস্তক্ষেপ করছি। আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আমরা অন্য যা কিছুর উপর নির্ভর করি না কেন, সবার উপরে কিন্তু গাছ।

অক্সিজেন শুধু যে আমাদের নিশ্বাসে প্রয়োজন হয় তা নয়, তার আরেকটা . গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যারা একটু হলেও বিজ্ঞান পড়েছে তারা জানে পৃথিবীর সবকিছু তৈরি হয়েছে বিরানব্বইটা মৌলিক পদার্থ দিয়ে। এই বিরানব্বইটা মৌলিক পদার্থের একটা হচ্ছে অক্সিজেন। মৌলিক পদার্থগুলোর পরমাণু একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৈরি করে অনু, আর সেগুলিই হচ্ছে পৃথিবী কিংবা সৃষ্টি জগতের মূল উপদান। পানির অনুতে আছে দুটো হাইড্রোজেন এবং একটা অক্সিজেনের পরমাণু। সেরকম অক্সিজেনের অনুতে আছে দুটো অক্সিজেনের পরমাণু । এটাই অক্সিজেনের মূল রূপ এবং প্রকৃতিতে এভাবেই অক্সিজেন থাকে, একসঙ্গে দুটো অক্সিজেনের পরমাণু।

তবে সূর্যালোকের অতি বেগুনি রশি (বা আলট্রা ভায়োলেট রে) এই অক্সিজেনে একটা বিচিত্র কাণ্ড ঘটাতে পারে, অক্সিজেনের অনুকে ভেঙে দুটো পরমাণুতে আলাদা করে ফেলতে পারে। আলাদা হয়ে যাওয়া পরমাণু কাছাকাছি একটা অক্সিজেন অনুর সাথে যুক্ত হয়ে হঠাৎ একটা নূতন রূপ নিয়ে নেয়। যেটাতে থাকে দুটোর বদলে তিনটি অক্সিজেন পরমাণু। তখন সেটাকে আর অক্সিজেন বলে না সেটাকে বলে ওজোন। এমনিতে ওজোন আমাদের জন্যে খুব ক্ষতিকর, ফুসফুসের বারোটা বাজিয়ে দেয়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের উপরে খুব সূক্ষ্ম ওজোনের একটা আস্তরণ রয়েছে সেটা কিন্তু আমাদেরকে সূর্যালোকের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করে আসছে। তার কারণ ওজোন খুব ভালোভাবে অতিবেগুনী রশ্মি শোষণ করতে পারে। যে অক্সিজেন পৃথিবীর প্রাণিজগৎকে নিশ্বাস নিতে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে তারই একটা ভিন্ন অনু আবার বায়ুমণ্ডলে থেকে আমাদেরকে অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করে আসছে। কোনো একটা গ্যাসের প্রতি যদি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকার প্রশ্ন আসে, নিশ্চিতভাবেই সেটা হবে অক্সিজেন!

তবে মানব জাতি খুব দায়িত্বশীল নয়। পৃথিবীতে আরাম আয়েশে থাকার জন্যে তারা যে এয়ারকন্ডিশন, ফ্রিজ বা নানা ধরনের স্প্রে তৈরি করেছে তার ভেতরে ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (সি.এফ.সি) নামে এক ধরনের গ্যাস তৈরি করে। সেই গ্যাসটি যখন মুক্ত হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যায় তখন একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটে। প্রথমে সূর্যালোক ক্লোরোফ্লোরোকার্বনকে ভেঙে তার ভেতর থেকে ক্লোরিন নামে ভয়ংকর বিক্রিয়াশীল একটা গ্যাসকে আলাদা করে ফেলে। সেই ক্লোরিন তখন ওজোন গ্যাসকে আক্রমণ করে তাকে সাধারণ দুই পরমাণুর অক্সিজেন অনুতে পাল্টে দেয়। নিশ্বাস নেবার জন্যে এই অক্সিজেন কাজে লাগতে পারে কিন্তু সূর্যালোকের অতি বেগুনি রশ্মিকে সেটা আটকাতে পারে না। পৃথিবীর অবিবেচক মানুষের কারণে এই ব্যাপারটা ঘটতে শুরু করেছে এবং বিজ্ঞানীরা আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে যে সূক্ষ্ম ওজোনের স্তর ছিল সেটা ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। শুধু যে ক্ষয় হচ্ছে তা নয় জায়গায় জায়গায় বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে। যার ফলে পৃথিবীর মানুষ ভয়ংকর অতি বেগুনি রশ্মিতে আক্রান্ত হতে শুরু করেছে–চামড়ার ক্যান্সার তার প্রথম লক্ষণ। ভবিষ্যতে আরও কী হবে আমরা সেটা এখনো জানি না।

বিজ্ঞানীরা এটা নিয়ে অনেকদিন থেকেই চেঁচামেচি করছেন, আমরা আশা করছি পৃথিবীর অবিবেচক মানুষ একদিন বিজ্ঞানীদের চেঁচামেচি শুনে পৃথিবীটাকে রক্ষা করার জন্যে এগিয়ে আসরেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *