০৫. প্রাণীজগৎ

প্রাণীজগৎ

9. জীবনের নীল নকশা

বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড বলেছিলেন, তুমি যদি বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব তোমার কজের বুয়াকে বোঝাতে না পার তাহলে বুঝতে হবে ব্যাপারটি তুমি নিজেই বোঝ নি! কাজের বুয়া কিংবা মহিলাদের বুদ্ধিমত্তাকে উপহাস করার জন্যে কথাটি বলা হয় নি, বিজ্ঞানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও যে বিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলো বোঝা সম্ভব সেই বিষয়টাকে এখানে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। বিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলো সব সময়েই আশ্চর্য রকম সহজ এবং সরল–এটি কোন দুর্ঘটনার নয়। প্রকৃতি জটিলতা পছন্দ করে না, সে সবচেয়ে সহজ এবং সুন্দর উপায়ে সবকিছু গড়ে তুলেছে। বিজ্ঞানীরা সেটা খুঁজে বের করছেন এবং তাদের মাথার ভেতর সব সময়েই এটা কাজ করে যে, বিজ্ঞানের যে অজানা জটিল বিষয়টি নিয়ে এখন তারা হাবুডুবু খাচ্ছেন, যখন তার সমাধানটি তারা পাবেন সেটি হবে আশ্চর্য রকম সহজ এবং সরল। প্রাচীনকালে মানুষ ধরে নিয়েছিল চাঁদ সূর্য গ্রহ নক্ষত্র সবকিছু পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরে (ধর্মগ্রন্থে সেটা লেখা আছে, কার ঘাড়ে দুটি মাথা সেটি অস্বীকার করবে?) সে সময়কার বিজ্ঞানীরা যখন চাঁদ সূর্য গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে সেগুলো ঠিক কিভাবে পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে বের করার চেষ্টা করছিলেন তখন তাদের মাথা খারাপ হবার অবস্থা। চাঁদ এবং সূর্যের বিষয়টা নিয়ে সমস্যা নেই কিন্তু গ্রহগুলোর গতিপথের কোনো নিয়ম শৃঙ্খলা নেই, কখনো সেটা যাচ্ছে জোরে, কখনো আস্তে। শুধু তাই নয় কখনো-কখনো একদিকে খানিকটা গিয়ে আবার গতিপথ পাল্টে উল্টো দিকে ফিরে আসছে! কারো সাথে কারো মিল নেই, সর মিলিয়ে একটা বিশাল জগাখিচুড়ি। চাঁদ সূর্য এবং গ্রহ নক্ষত্রের এই জটিল গতিবিধি ব্যাখ্যা করা পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের জন্যেও ছিল অসম্ভব একটি ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত কোপার্নিকাস যখন বললেন আসলে পৃথিবী নয় সূর্যকে ঘিরে সব গ্রহগুলো ঘুরছে, সাথে সাথে প্রায় চোখের পলকে সব জটিলতা দূর হয়ে গেল। বিজ্ঞানী এবং সাধারণ মানুষ একই সাথে অবাক হ্রয়ে। দেখল সবকিছুর মূলে আছে মহাকর্ষ বল, সেই মহাকর্ষ বলের আকর্ষণে সূর্যকে ঘিরে সবগুলো গ্রহ ঘুরছে! খুব সহজ-সরল একটি বিষয়, কাজের বুয়ারাও সেটা বুঝবেন।

জীবিত প্রাণীর মূল ব্যাপারটিও সেরকম আশ্চর্য রকম সহজ এবং সরল। একটা জীবিত প্রাণী কীভাবে জন্ম হবে এবং বিকশিত হবে তার একটা নীল নকশা থাকে। ক্ষুদ্র একটা জীবাণু থেকে শুরু করে মানুষের মতো জটিল একটা প্রাণীর সবার ভেতরেই সেই নীল নকশাটি একই প্রক্রিয়ায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে এই তথ্যটিই কী আমাদের অবাক করে দেয় না? একটা নীল নকশা মানে কিছু তথ্য, কিছু নির্দেশ। সেগুলো আমরা আগে রাখতাম কাগজে লিখে, আজকাল রাখি কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভ কিংবা সিডি রমে। আপাতঃদৃষ্টিতে পুরো বিষয়টাকে অনেক জটিল মনে হলেও তথ্য সংরক্ষণের সময় সেটা রাখার জন্যে আশ্চর্য রকম সরল একটা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তার নাম বাইনারী পদ্ধতি এবং সেটা করার জন্যে। এবং 0 এই দুটি অংককে ব্যবহার করা হয়। জীবিত প্রাণীরা তাদের নীল নকশার তথ্য সংরক্ষণ করার জন্যে প্রায় এ-রকম একটা পদ্ধতি বেছে নিয়েছে “ডি.এন.এ” এর ডাবল হেলিক্সে সেই তথ্য রাখা হয় মাত্র চার ধরনের বেস পেয়ার দিয়ে, শর্ট কাটে তাদের নাম হচ্ছে A, C, G এবং T। শুধু তাই নয় ডি.এন এতে A এর বিপরীতে থাকে সব সময় T এবং C এর বিপরীতে থাকে G। যারা পৃথিবীর একটু খোঁজখবর রাখে তারা নিশ্চয়ই জানে বর্তমান জগতে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট হচ্ছে মানব জিনোম প্রজেক্ট, কেউ যদি আক্ষরিক অর্থে সেটি দেখতে চায় তাহলে সে দেখবে ATCGCCTGATTCCGT এ-রকম মাইলের পর মাইল চার অক্ষরের সাড়ি। এটি হচ্ছে মানব দেহের নীল নকশা, এর মাঝে লুকিয়ে আছে মানব দেহের সকল রহস্য!

মানুষ কিংবা অন্য যে কোনো জীবিত প্রাণীর জন্যেই এই নীল নকশাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো খুব যত্ন করে সংরক্ষণ করা দরকার। তাই জীবিত প্রাণী এগুলো সংরক্ষণ করার জন্যে যে পদ্ধতি বেছে নিয়েছে সেটি খুবই চমকপ্রদ। শরীরের বিশেষ কোনো এক জায়গায় বিশেষ যত্ন করে না রেখে সেটাকে শরীরের লক্ষ লক্ষ কোষের প্রত্যেকটা কোষের নিউক্লিয়াসের ভেতর রেখে দেয়া হয়েছে। শরীরের যে কোষের জন্যে যে নির্দেশটি প্রয়োজন সে তার প্রয়োজনমত হাতের কাছে নীল-নকশা থেকে সেটি পেয়ে যাচ্ছে।

একটি জীবিত কোষের নিউক্লিয়াসের যেখানে এই নীলনকশাকে রাখা হয় তার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ক্রোমোজম। ফুট ফ্লাই নামক পতঙ্গের ক্রোমোজম হচ্ছে 4 টি, বিড়ালের 34 টি এবং মানুষের 46 টি । কেউ যেন মনে না করে যে প্রাণী যত উন্নত তার ক্রোমাজমের সংখ্যা তত বেশি, কারণ কুকুরের ক্রোমোজমের সংখ্যা মানুষ থেকে বেশি, 78 টি।

অল্প কয়েকটা প্রাণীর ক্রোমোজমের সংখ্যা বলা হয়েছে বলে কেউ হয়তো আলাদাভাবে লক্ষ করে নি যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেগুলো জোড় সংখ্যাক। মানুষের বেলাতেও তাই, মোট ক্রোমোজমের সংখ্যা 46 হলেও সেটি আসলে 23 জোড়া ক্রোমোজম এবং প্রকৃতির সহজ-সরল নিয়মে সন্তানের 23 জোড়া ক্রোমোজমে 23 টি আসে বাবার কাছ থেকে বাকি 23 টি আসে মায়ের কাছ থেকে। 9.3 নং ছবিতে মানুষের 23 জোড়া ক্রোমোজমকে দেখানো হয়েছে, কেউ যদি একটু মনোযোগ দিয়ে ছবিটা লক্ষ করে তাহলে তার কাছে ছবিটার কয়েকটা বৈশিষ্ট্য নজরে পড়বে। প্রথমত, দেখা যাচ্ছে ক্রোমোজমগুলোকে সাজানোর সময় বড় থেকে ছোট ক্রোমোজমে সাজানো হয়েছে। এটি নেহায়েতই তালিকাভুক্তি করার ব্যাপার এর মাঝে কোন বিজ্ঞান নেই। একটা কোষের নিউক্লিয়াসের ভেতরে যখন ক্রোমাজেমগুলো থাকে তখন কিন্তু সেগুলো এ-রকম সাজানো গোছানো থাকে না, ডি.এন.এ. তন্তুগুলো খোলা অবস্থায় পুরো, নিউক্লিয়াসের ভেতরে এলোমেলো অবস্থায় থাকে। শুধুমাত্র কোষ বিভাজনের সময় সাময়িকভাবে এগুলো ছোট এবং মোটা হয়ে আসে, সেগুলো তখন আলাদাভাবে দেখা সম্ভব হয়। ছবির ক্রোমোজমগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে আমরা যে জিনিসটি দেখব সেটা হচ্ছে 23 জোড়া ক্রোমোজমের সবগুলো এক ধরনের জোড়া, তাদের নামকরণ করা হয়েছে 1, 2, 3। এ-রকম সংখ্যা দিয়ে, শুধুমাত্র শেষ জোড়াটিকে 23 নম্বর না বলে বলা হয়েছে XY। শুধু তাই নয় x এবং Y দেখতে ভিন্ন। বিশাল X ক্রোমোজমের পাশাপাশি Y রীতিমতো ক্ষুদ্র এবং খর্বকায়। আমরা আগেই বলেছি 23 জোড়া ক্রোমোজমের একটি এসেছে বাবার কাছ থেকে অন্যটি মায়ের কাছ থেকে। যার অর্থ XY এই জোড়ার ভেতরে একটি বাবার অন্যটি মায়ের। কাউকে যদি অনুমান করতে বলা হয় কোনটি বাবা থেকে এসেছে আমি নিশ্চিত সে বলবে বৃহদাকৃতি X ক্রোমোজমটি বাবার, আমরা পুরুষশাসিত সমাজে থাকি যা কিছু বড়, যা কিছু ক্ষমতাশালী সেটাকেই পুরুষের সাথে তুলনা করতে ভালোবাসি। প্রকৃতপক্ষে Y ক্রোমোজমটি এসেছে বাবার কাছ থেকে। একজন মানুষের প্রত্যেকটা কোষের প্রত্যেকটা নিউক্লিয়াসে এই তেইশ জোড়া ক্রোমোজম রয়েছে এবং এর মাঝেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে সেই মানুষটির দেহ গঠনের নীল নকশা। কারো নীল নকশায় যদি কালো চুলের নির্দেশনা থাকে তাহলে সে হবে কালো চুলের মানুষ, যদি নীল নকশায় নীল চোখের নির্দেশনা থাকে তাহলে সে হবে নীল চোখের মানুষ। যদি গায়ের রং শ্যামলা হওয়ার নির্দেশনা থাকে তাহলে সে জন্ম নেবে কোমল শ্যামলা রং নিয়ে। আবার কোনো দুর্ভাগ্যের কারণে যদি তার নীল নকশায় থাকে হেমোফিলিয়া রোগের নির্দেশনা নিয়ে তাহলে সে অবধারিতভাবে বড় হবে হেমোফিলিয়া রোগ নিয়ে। শুধু যে চুল বা চোখের রঙ বা গায়ের রঙ এবং কখনো-কখনো দুরারোগ্য রোগের নির্দেশনা এই ক্রোমোজমের ভেতর ডি.এন.এ’র সুদীর্ঘ তন্তুতে লুকিয়ে থাকে তা নয় একজন মানুষ পুরুষ হবে না মেয়ে হবে সেটিও থাকে এই ক্রোমোজমগুলোর ভেতরে, আরও স্পষ্ট ভাবে। একজন মানুষ যদি পুরুষ ক্রমোজম XY দুটিই থাকতে পারে। বাবার xটি পেলে হয় তাহলে তার 23তম জোড়ার সন্তান হয় মেয়ে, ৮টি পেলে সন্তান হয় ছেলে। ক্রোমোজমগুলো হয় x এবং Y যেরকম এই ছবিতে দেখানো হয়েছে। ছবিটি যদি পুরুষমানুষের না হয়ে একটি মেয়ের ক্রোমোজম হতো তাহলে 23 তম জোড়ার দুটিই হতো একই ধরনের, সেখানে থাকত XX! খুব সঙ্গত কারণেই এখন কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারে মেয়েরা পচ্ছে দুটি দীর্ঘ X ক্রোমোজম অথচ ছেলেরা পাচ্ছে একটি দীর্ঘ x এবং একটি রীতিমতো বেটেখাটো Y ক্রোমোজম তাহলে কী বলতে হবে ছেলেদের প্রতি প্রকৃতি খানিকটা অবিচার করেছে? কথাটি একেবারে মিথ্যে নয়, আমরা আমাদের চারপাশে অনেক টাকমাথার পুরুষ দেখেছি কিন্তু কখনো কী কোনো টাকমাথার মহিলা দেখেছি? এর কারণটাও লুকিয়ে আছে X এবং Y ক্রোমোজমের ভেতর।

এর মাঝে বেশ কয়েক বার বলা হয়ে গেছে মানব দেহের প্রত্যেকটা কোষে 23 জোড়া ক্রোমোজম থাকে, আসলে কথাটা পুরাপুরি সত্য নয়। সন্তান জন্মের জন্যে পুরুষের শুক্রাণু এবং মেয়েদের ডিম্বাণুতে থাকে ঠিক অর্ধেক অর্থাৎ 23টি করে ক্রোমোজম। নারী দেহের কোষের 23 জোড়া ক্রোমোজমকে দুইভাগে ভাগ করে 23টি আলাদা করে ডিম্বাণু তৈরি করা হয় বলে আমরা বলে দিতে পারি সেখানে 1 থেকে 22 পর্যন্ত 22টি ক্রোমোজম এবং একটি X সব মিলিয়ে 23 টি ক্রোমোজম থাকবে। কিন্তু পুরুষের বেলায়? তাদের তো X এবং Y দুটিই আছে, তাহলে তাদের শুক্রাণুতে কী X না Y ক্রোমোজম, কোনটি থাকবে? উত্তরটি সহজ। তাদের সাধারণ কোষ থেকে আলাদা করে দুটি তৈরি হয় বলে শুক্রাণুতে X এবং Y দুটিই থাকতে পারে। কাজেই তাদের শুক্রাণুর অর্ধেকের মাঝে থাকে X ক্রোমোজম বাকি অর্ধেকে থাকে Y ক্রোমোজম। মায়ের গর্ভে সন্তানের জন্মের সময় যদি ডিম্বাণুর সাথে X ক্রোমোজমের শুক্রাণু মিলিত হয় তাহলে সন্তানেরা সর্বমোট 23 জোড়া ক্রোমোজমের 23 জোড়াটি হয় XX অর্থাৎ সন্তান ঝন্ম নেয় মেয়ে হিসেবে। যদি তা না হয়ে শুক্রাণুটিতে থাকে Y ক্রোমোজম তাহলে সন্তানের 23 তম জোড়াটি হয় XY অর্থাৎ সন্তান জন্ম হয় পুরুষ হিসেবে। যেহেতু অন্য সবগুলো ক্রোমোজমই বাবার এবং মা দুজনের কাছ থেকেই এসেছে তাই সন্তানেরা মাঝে বাবা এবং মা দুজনেরই ছাপ পাড়ে।

আমাদের দেশে এখনো অনেকের মাঝে ছেলে সন্তানের একটা আলাদা গুরুত্ব থাকে। ইতিহাসে পুরুষ সন্তান জন্ম দিতে না পারার জন্যে অনেক নারীকেই অপমান এবং হেনস্থা সহ্য করতে হয়েছে। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে একটি সন্তানকে পুরুষ হবার জন্যে প্রয়োজনীয় Y ক্রোমোজমটি মেয়েদের থাকে না, সেটি আসতে পারে শুধুমাত্র পুরুষদের ভেতর থেকে! কাজেই কাউকে যদি দায়ী করতেই হয় তাহলে বাবাকেই দায়ী করতে হবে, কোনোভাবেই মা’কে নয়।

এবারে আমরা আরো একটা মজার জিনিস দেখতে পারি। একজন মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলো এই 23 জোড়া ক্রোমোজমে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। যে বৈশিষ্ট্যগুলো প্রথম 22 জোড়াতে পড়েছে সেগুলোর একটা সুবিধা আছে প্রত্যেকটাই দুটো করে থাকার কারণে কোনো একটাতে সমস্যা থাকলে অন্যটা থেকে পুষিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু সেই সমস্যাটি যদি আসে X ক্রোমোজম থেকে তাহলে মেয়েরা তাদের দ্বিতীয় X ক্রোমোজম থেকে সেটা পুষিয়ে নিতে পারে, ছেলেরা পারে না। টাক মাথা সেরকম একটা ব্যাপার, মেয়েদের একটি X ক্রোমোজমে টাক পড়ার নির্দেশনা থাকলেও ক্ষতি নেই অন্য X ক্রোমোজমে সেই বিপদটুকু কাটিয়ে উঠতে পারে। ছেলেরা পারে না। তাই আমাদের চারপাশে এত টাক মাথা পুরুষমানুষ, টাক মাথা মেয়ে একজনও নেই!

সব ব্যাপারে পুরুষেরা মেয়েদের উপর একটা সুবিধে নেবে প্রকৃতি মনে হয় সেটা পছন্দ করে না তাই তাদেরকে ছোট একটা শিক্ষা দেবার জন্যে সম্ভাব্য এ-রকম ব্যবস্থা করে রেখেছে!

.

10. একটি জীবাণুর বক্তৃতা

আমরা জানি জীবাণুরা কথা বলতে পারে না, বক্তৃতাও দিতে পারে না। যদি পারতো তাহলে তারা নিশ্চয়ই সভা-সেমিনারে এ-রকম একটা বক্তৃতা দিতো : আমার প্রিয় জীবাণু বন্ধুগণ, আজকে আমার বক্তব্য শুনতে আসার জন্যে আপনাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনারা সবাই আমাদের অতীত ঐতিহ্যের কথা জানেন, সেই সৃষ্টির আদিকালে আমাদের জন্ম এবং বিবর্তনের ভেতর দিয়ে আমরা এই পৃথিবীর সবচেয়ে সফল একটি জীবনধারার সৃষ্টি করতে পেরেছি। পৃথিবীতে নানা ধরনের জীবন রয়েছে। আমাদের মতো আকারে ক্ষুদ্র জীবাণু থেকে শুরু করে আমাদের থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি গুণ বড় মানুষ নামের স্তন্যপায়ী প্রাণীও এই পৃথিবীতে রয়েছে। অন্যান্য প্রাণীর কথা না বলে মানুষ নামক এই প্রাণীটির কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করছি কারণ তারা সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের ভেতরে “গণহত্যা” সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বন্ধুগণ, আপনারা নিরুৎসাহিত হবেন না, অতীত ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করুন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমাদের সংগ্রামী ইনফ্লুয়েঞ্জা জীবাণু ভাইয়েরা এই পৃথিবীর দুইকোটি দশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল। 1346 থেকে 1352 সালের ভেতরে ইউরোপের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ আমাদের বুবোনিক প্লেগ জীবাণু ভাইয়েরা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। কোনো কোনো শহরের শতকরা সত্তর ভাগ মানুষকে তারা সাফল্যের সাথে হত্যা করতে সম্ভব হয়েছিল। 1880 সালে আমাদের যক্ষ্মা রোগের জীবাণু ভাইয়েরা শ্বেতাঙ্গ মানুষের ভেতর দিয়ে আদিবাসী স্থানীয় বাসিন্দাদের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে তাদের শতকরা দশ জনকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল । আপনাদের অনুপ্রাণিত করার জন্যে আমি এ-রকম অসংখ্যা উদাহরণ দিতে পারি সেটি না করে আমি আমার মূল বক্তব্য ফিরে যাই।

প্রিয় বন্ধুগণ, বিবর্তনের ভেতর দিয়ে আমরা একটি উন্নত জীবনধারায় পরিণত হয়েছি। আমরা আমাদের পুষ্টি এবং বংশ বিস্তারের জন্যে মাঝে মাঝেই অত্যান্ত কৌশলে মানুষ নামক স্তন্যপায়ী প্রাণীটির দেহ ব্যবহার করে থাকি। যেহেতু মানুষের এই দেহ আমাদের অন্ন বাসস্থান এবং বংশবৃদ্ধির সুযোগ করে দেয় আমরা তাই তাদেরকে শুরুতেই হত্যা করতে চাই না। তাহলে আমরা আমাদের অন্ন এবং বাসস্থান হারাবো। আমরা তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই যেন তারা আমাদের বংশধরদের। অন্য মানুষদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। যত দ্রুত তারা আমাদের বংশধরদের অন্য মানুষে ছড়িয়ে দেবে আমরা তত দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারব এবং যারা যত সাফল্যের সাথে এটা করতে পেরেছে তারা বিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবীতে তত দীর্ঘজীবী হয়েছে।

প্রিয় বন্ধুগণ, একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার জন্যে অনেক সময় আমাদের কিছুই করতে হয় না, মানুষের লোভ এবং নির্বুদ্ধিতা দিয়েই আমাদের বংশ বিস্ত রের কাজটি হয়েছে। আমাদের প্রিয় সালমোনিলা ব্যাক্টেরিয়া ডিম বা মাংসকে আক্রান্ত করে চুপচাপ বসে থাকে, মানুষ সেটি খেয়ে সালমোনিলাকে নিজের শরীরে গ্রহণ করে। ঠিক সেভাবে শূকরের মাংসের ভেতর দিয়ে ট্রাইকিনোসিস এবং কাঁচা মাছের (সুশি) ভেতর দিয়ে এনিসাকিয়াসিস মানুষের শরীরে বংশ বিস্তারের জন্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। নিউগিনির পার্বত্য অঞ্চলের মানুষেরা কুরু নামের বিচিত্র ব্যাধিটির ভাইরাস গ্রহণ করে অন্য মানুষকে কেটে কুটে খাওয়ার মাধ্যমে।

প্রিয় বন্ধুগণ, আপনারা মনে করবেন না আমাদের সকলেই মানুষের নির্বুদ্ধিতার উপর ভরসা করে অপেক্ষা করে থাকি। আমরা একটি রোগাক্রান্ত মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে যাবার জন্যে অনেক সময় মশা মাছি বা উকুনের মতো কীট-পতঙ্গকে ব্যবহার করি। উদাহরণ দেবার জন্যে আপনাদের মনে করিয়ে দেয়া যায় আমাদের সুপরিচিত মশা, মাছি এবং টাইফাস জীবাণু তাদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এই কীট-পতঙ্গগুলোকে আমাদের বংশ বিস্তারের জন্যে ব্যবহার করছে। রোগাক্রান্ত একজনকে কামড় দেয়ার সময় এই কৌশলী জীবাণুগুলো মশা, মাছি বা উকুনের লালায় আশ্রয় গ্রহণ করে এবং তারা যখন। অন্য সুস্থ মানুষকে কামড় দেয় সেই লালার ভেতর দিয়ে সুস্থ মানুষটির শরীরে প্রবেশ করে। ‘ প্রিয় বন্ধুগণ! আপনারা মনে করবেন না বংশ বিস্তারের জন্যে আমরা শুধুমাত্র তুচ্ছ কীট পতঙ্গের উপর নির্ভর করে থাকি। সেটি সত্যি নয়, আমাদের সবচেয়ে সৃজনশীল জীবাণু বন্ধুরা মানুষকেই এই কাজে ব্যবহার করে থাকে। এই প্রসঙ্গে আমাদের প্রিয় বন্ধু সিফিলিসের জীবাণুর কথা বলা যায়, একজন মানুষকে আক্রান্ত করে সে তার শরীরের সবচেয়ে গোপনীয় অংশে ঘা সৃষ্টি করে সেখানে লক্ষ লক্ষ জীবাণু নিয়ে অপেক্ষা করে। এবং এই দগদগে ঘা অন্য মানুষের সংস্পর্শে আসা মাত্রই সেখানে অপেক্ষারত আমাদের সৃজনশীল সিফিলিস, জীবাণু বন্ধুরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। সুস্থ মানুষটির শরীরে বাসস্থান সৃষ্টি করে, বংশ বিস্তার শুরু করে।

কুচক্রী মানুষ আমাদের প্রিয় বসন্ত (স্মল পক্স) রোগের ভাইরাসটিকে পৃথিবীর মানুষের ভেতর থেকে অপসারণ করে এখন কিছু ল্যাবরেটরিতে বন্দি করে রেখেছে। তারা সেখান থেকে মুক্ত হতে পারছে না, আজকের এই সভায় আমরা গভীর মমতার সাথে এই বন্দি ভাইরাসদের কথা স্মরণ করছি। প্রিয় বন্ধুগণ! যখন এই ভাইরাসগুলো মানুষের শরীরে বসবাস করতো, বংশবিস্তার করতো তখন তারা মানুষের শরীরে ফুসকুড়ির সৃষ্টির করতো এবং সেখানকার তরল বা পূজে বাসস্থান তৈরি করে বাসবাস করতো। ফুসকুড়ি থেকে তৈরি ক্ষতের মাধ্যমে আমাদের সৃজনশীল ভাইরাসগুলো একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়তো। প্রিয় বন্ধুগণ! আপনারা সম্ভবত জানেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গরা স্থানীয় আদিবাসীদের হত্যা করার জন্যে বসন্ত রোগীর ব্যবহৃত কম্বলগুলো উপহার হিসেবে তাদের কাছে পাঠাত। আদিবাসীরা সরল বিশ্বাসে এই কম্বলগুলো গ্রহণ করতো, ব্যবহার করতো এবং বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়তো।

আমাদের প্রিয় জীবাণু বন্ধুরা বংশ বিস্তারের জন্যে আরও নানা ধরনের কৌশল গ্রহণ করে থাকে। সর্দি কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা বা হুপিং কাশির জীবাণুরা মানুষের ভেতরে ক্রমাগত হাঁচি, কাশি, নাক দিয়ে তরল নির্গমন এই ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু করে দেয়। তার কারণে একজন রোগাক্রান্ত মানুষকে ঘিরে অসংখ্য জীবাণু ভেসে বেড়ানোর সুযোগ পায় এবং একজন সুস্থ মানুষ ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত হলেই তাকে আক্রান্ত করা সম্ভব হয়। এই মুহূর্তে আমি যদি আমাদের কলেরা জীবাণুর গৌরব গাঁথার কথা না বলি তাহলে আমার বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই দুঃসাহসী জীবাণু একজন মানুষের দেহে সাফল্যের সাথে আশ্রয় নিতে পারলেই তাকে বমি এবং ডায়রিয়াতে বাধ্য করে। তার শরীর থেকে বের হওয়া বর্জ্য পদার্থে আমাদের দুঃসাহসী কলেরা জীবাণু আশ্রয় নেয় এবং প্রথম সুযোগ এই এলাকার পানি সরবরাহকে দখল করে নেয়। কলেরা জীবাণুতে টইটুম্বর এই পানি যখন একজন সুস্থ মানুষ পান করে সাথে সাথে আমাদের দুঃসাহসী কলেরার জীবাণু তার শরীরটি দখল করার চেষ্টা শুরু করে দেয়। ইদানীং আমাদের কলেরা জীবাণুর বড়

কোনো সাফল্যের কথা জানা না থাকলেও অতীতে সেটি ছিল ঈর্ষণীয় একটি গৌরব গাঁথা।

তবে আমার মনে হয় জলাতঙ্ক বা র‍্যাবিজ ভাইরাসের জীবনকাহিনী সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ। এই ভাইরাস যখন কুকুরকে আক্রান্ত করে তখন কুকুরের ব্যবহার সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। এটি অপ্রকৃতস্থ হয়ে সুস্থ মানুষকে কামড় দিতে শুরু করে কারণ আমাদের কৌশলী জলাতঙ্ক ভাইরাস কুকুরের লালার মাঝে স্থান করে নেয় এবং যখন জলাতঙ্ক আক্রান্ত কুকুর একটি সুস্থ মানুষকে কামড় দেয় প্রকৃতপক্ষে সে আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কৌশলী জলাতঙ্ক ভাইরাসকে বংশ বিস্তারের জন্যে অন্য মানুষের শরীরে স্থানান্তর করার দায়িত্বটুকু পালন করছে, তার বেশি কিছু নয়।

প্রিয় বন্ধুগণ! আপনারা শুনে অবাক হবেন, আমরা যখন অত্যন্ত কৌশলে বংশবিস্তার করার জন্যে একজন মানুষের আচার ব্যবহার, শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন করি, মানুষ সেটাকে মনে করে রোগের উপসর্গ। তারা ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে না বিবর্তনের ভেতর দিয়ে কোটি কোটি বৎসরের প্রচেষ্টায় আমরা এই কৌশলগুলো আয়ত্ত করেছি।

প্রিয় বন্ধুগণ! আপনারা মনে করবেন না, আমাদের। বংশবিস্তারের এই পথ কুসুমাস্তীর্ণ। মানুষের শরীর প্রতিনিয়ত আমাদের বংশবিস্তারে বাধা দিতে চেষ্টা করছে। আমরা যখনই একজন মানুষের শরীরে অবস্থান নেই, মানুষের শরীর প্রায় সব সময়েই তার দেহের তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে তুলে। এই উঁচু তাপমাত্রার কারণে আমাদের প্রিয় জীবাণু বন্ধুদের অনেক সময়েই অকাল মৃত্যু ঘটে থাকে। মানুষ অনেক সময়েই বুঝতে পারে না আমাদের আক্রমণের জন্যে তার দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, তারা সেটাকে বলে জ্বর এবং নানাভাবে এই জ্বর কমানোর চেষ্টা করে।

মানুষেরা আমাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্যে শুধু যে তাদের দেহের তাপমাত্রা বাড়িয়ে তুলে তাই নয়, অনেক সময়েই তার দেহের শ্বেত কণিকাগুলোকে আমাদের প্রতিরোধ করার জন্যে লেলিয়ে দেয়। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আমাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। যখন প্রতিরোধ করতে পারে তখন তাদের শরীরে আমাদের প্রতিরোধ করার জন্যে বিশেষ প্রতিষেধক তৈরি হয়ে যায়, ভবিষ্যতে তখন আমরা বিশেষ সুবিধে করতে পারি না। প্রিয় বন্ধুগণ! মানুষের দেহের এই চাতুর্যপূর্ণ চক্রান্তকে আমরা মাথা নিচু করে মেনে নিই নি। আমাদের সংগ্রামী সর্দিকাশির ভাইরাসের কথা আমরা গর্ব করে বলতে চাই। তাদের পরাস্ত করে যখন শরীরে একধরনের প্রতিষেধক বা এন্টিবডি তৈরি হয় তখন আমাদের এই সর্দিকাশির সংগ্রামী ভাইরাসেরা তাদের রূপ পরিবর্তন করে ফেলে। যখন তারা নূতন করে মানুষকে আক্রমণ করে তখন আগের প্রতিষেধক কোনো কাজে আসে না। তাই মানুষের শরীরে একবার জলবসন্ত হাম বা মাম্পস হলে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মে যায় এবং সে আর দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয় না। কিন্তু মানুষের শরীর কখনোই সর্দিকাশিকে পরাস্ত করতে পারে নি।

প্রিয় বন্ধুগণ! আপনারা ধৈর্য্য ধরে আমার বক্তব্য শুনেছেন সে জন্যে আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আমি আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধু এইডস ভাইরাসের কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করব। এই ভাইরাস মানুষের শরীরে বসে মানুষের নিজের প্রতিরোধ ক্ষমতাকেই ধ্বংস করে দেবার ক্ষমতা রাখে। শুধু তাই নয় এই প্রচণ্ড ক্ষমতাধর ভাইরাস মায়ের শরীরে অবস্থান নিতে পারলে তার গর্ভের সন্তানের দেহে পর্যন্ত আক্রান্ত করতে পারে। পৃথিবীর মানুষ এই ভাইরাসের আক্রমণে দিশেহারা। সরাসরি ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে মানুষ তাদের জীবন ধারণ পদ্ধতির মাঝে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করছে। আমাদের সাথে এই সংগ্রাম চলবেই তো, দেখা যাক কে বিজয়ী হয়।(১)

১. Guns, Germs and Steel, Jared Diamond এর বই থেকে সংগ্রহিত তথ্য ব্যবহৃত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *