জুহরের সময় জিবরীল (আ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলেন। তাঁর মাথায় ছিল রেশমের পাগড়ী। তিনি রেশমী কাপড়ে আবৃত জীনধারী খচ্চরে আরোহণ করে ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি অস্ত্র ত্যাগ করেছেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ‘হ্যাঁ।’ জিবরীল বললেন, “কিন্তু ফেরেশতারা এখনও অস্ত্র ত্যাগ করেনি। আর আপনিও রণাঙ্গন থেকে মুসলমানদের দাবীতেই ফিরছেন! হে মুহাম্মাদ আল্লাহ আপনাকে বনু কুরাইযার বিরুদ্ধে অভিযান যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমিও সেখানে যাবো এবং তাদের তছনছ করে ছাড়বো।”
এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজনকে এই মর্মে ঘোষণা করতে বললেন, “যেসব লোক আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের কথা মানবে, তারা যেন বনু কুরাইযার এলাকায় গিয়ে আছরের নামায পড়ে।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু তালিবের পুত্র আলীকে (রা) নিজের পতাকা নিয়ে বনু কুরাইযার এলাকা অভিমুখে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণও তাঁর অনুসরণ করলেন। আলী (রা) রওনা হয়ে তাদের দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে একটা যঘন্য উক্তি শুনতে পেলেন। এসব শুনে তিনি ফিরে চললেন, পথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এসব জঘন্য লোকদের কাছে আপনার যাওয়া উচিত নয়।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “কেন? মনে হয়, তুমি তাদের কাছ থেকে আমার সম্পর্কে কোন কটু ও অশ্রাব্য কথা শুনেছো।” আলী (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, সত্যই তাই।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমাকে দেখলে তারা ঐ ধরনের কিছুই বলতো না।” অতঃপর তিনি বনু কুরাইযার দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছে বললেন, “হে বানরের ভাইয়েরা, আল্লাহ তোমাদের লাঞ্ছিত করেছেন তো? তাঁর শাস্তি ভোগ করছো তো?” তারা বললো, “হে আবুল কাসিম, (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি প্রচলিত ডাক নাম) তোমার তো কিছুই অজানা নেই।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার ‘আত্তা’ নামক কূপের কাছে এসে তাঁবু স্থাপন করলেন। মুসলমানরা দলে দলে এসে তাঁর সাথে মিলিত হতে লাগলো। কেউ কেউ ইশার শেষ জামাতের পরেও এলেন। তারা তখনও আছর পড়েননি। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন বনু কুরাইযার এলাকায় গিয়ে আছরের নামায পড়তে। অনন্যোপায় হয়েই তাঁরা যুদ্ধের খাতিরে নামায বিলম্বিত করেছিলেন। তাই তাঁরা এশার পরে আছর পড়েন। এ জন্য কুরআনে তাঁদেরকে তিরস্কার করেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পঁচিশ দিন পর্যন্ত অবরোধ করে রাখলেন। ফলে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছিলো। আর আল্লাহ তায়ালা তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছিলেন।
কুরাইশ ও গাতফান গোত্রের লোকজন স্বদেশ অভিমুখে রওনা হয়ে যাওয়ার পর হুয়াই ইবনে আখাতাব বনু কুরাইযার সাথে তাদের দুর্গে অবস্থান করতে থাকে। বনু কুরাইযা দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনের উদ্দেশ্যেই সে সেখানে অবস্থান করতে থাকে। বনু কুরাইযা সুনিশ্চিতভাবে যখন বুঝতে পারলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে যুদ্ধ না করে কিছুতেই ফিরে যাবেন না, তখন কা’ব ইবনে আসাদ গোত্রের লোকদের ডেকে বললো, “হে ইহুদীগণ শোনো! তোমাদের ওপর কি মুসিবত এসেছে দেখতে পাচ্ছো, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমি তোমাদের কাছে তিনটি প্রস্তাব রাখছি। এর যে কোন একটা গ্রহণ করতে পার।” তারা বললো, “সে প্রস্তাবগুলো কি?” সে বললো, “মুহাম্মাদকে আমরা সবাই অনুসরণ করি ও মেনে নেই। আল্লাহর কসম, তিনি যে নবী তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট। আমাদের ধর্মগন্থেও তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। এভাবে আমরা আমাদের নিজের এবং স্ত্রী ও সন্তানÑসন্তিতির জান ও মালের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ হতে পারবো।” তারা বললো, “আমরা কখনো তাওরাতের কর্তৃত্ব অস্বীকার করবো না এবং তার বিকল্পও গ্রহণ করবো না।” সে বললো, “এটা যদি না মানো তাহলে এসো আমরা আমাদের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের সাবইকে হত্যা করি। তারপর তরবারী নিয়ে মুহাম্মাদ ও তঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে লড়াই করি। তখন আমাদের পেছনে কোন ঝামেলা ও দায়দায়িত্ব থাকবে না। তারপর আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মধ্যে একটা চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে থাকবো। যদি আমরা নিহত হই তাহলে আমাদের বংশধরদের পরিণাম সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়েই মরতে পারবো। আর যদি জয়লাভ করি তাহলে নতুল করে স্ত্রী এবং সন্তানাদিও লাভ করতে পারবো।” সবাই বললো, “এই নিরীহ প্রিয়জনদেরকে মেরে ফেলবো এও কি সম্ভব? ওরাই যদি না থাকলো তাহলে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কি?” কা’ব বললো, “এটাও যদি অস্বীকার করো তাহলে আর একটা উপায় অবশিষ্ট থাকে। আজ শনিবারের রাত। সম্ভবতঃ মুহম্মাদ ও তাঁর সাহবীগণ আজকে আমাদের ব্যাপারে নিশ্চন্ত থাকবে। তাই, এসো, আমরা আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে মুহাম্মাদ ও তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করি।” তারা বললো, “আমরা কি এভাবে শনিবারটার অমর্যাদা করবো? এ দিনে আমাদের পূর্ববর্তীরা যা করেনি, তাই করবো? অবশ্য কিছুসংখ্যক লোক করেছিলো। তার ফলে তাদের চেহারাও বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো তা তোমাদের অজানা নেই।” কা’ব বললো, “আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে একটি লোকও এমন জন্মেনি, যে সারা জীবনে একটি রাতের জন্যও স্থির ও অবিচল সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।”
তারপর কোন সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়ে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট দূত পাঠিয়ে অনুরোধ করলো যে, “আপনি আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযিরকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন। তার সাথে আমরা কিছু পরামর্শ করবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে পাঠিয়ে দিলেন। আবু লাবাবা গেলে সমগ্র গোত্রের লোক তার পাশে জমায়েত হলো এবং নারী ও শিশুরা তার কাছে গিয়ে কাঁদতে লাগলো। সে দৃশ্য দেখে আবু লুবাবার হৃদয় বিগলিত হলো। তারা বললো, “হে আবু লুবাবা তুমি কি মনে করো, মুহাম্মাদের ফায়সালাই আমাদের মেনে নেয়া উচিত?” তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সেই সাথে নিজের গলায় হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝালেন যে, সে ফায়সালা হত্যা ছাড়া আর কিছু নয়।
আবু লুবাবা বলেন, “আমি তৎক্ষনাৎ উপলব্ধি করলাম যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকরা করে বসেছি।”[৭০. বনু কুরাইযাকে অবরোধ করা হলো তারা নিজেদের ধ্বংস অনিবার্য মনে করে শাস ইবনে কায়েসকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠালো। সে গিয়ে তাঁর কাছে বনু নাযীরকে যে শর্তে প্রাণভিক্ষা দেয়া হয়েছে সেই শর্তে প্রাণভিক্ষা দেয়ার সুপারিশ করলো অর্থাৎ শুধুমাত্র সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী ও উটের পিঠে যতটা মালপত্র নেয়া যায়, তাই নিয়ে যেতে দেয়া। আর অবশিষ্ট সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তারা রেখে যাবে। অস্ত্রশস্ত্র আদৌ নেবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অনৃরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর সে বললো, “তাহলে শুধু আমাদের প্রাণভিক্ষা দিন এবং আমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিকে আমাদের হাতে সমর্পণ করে বিতাড়িত করে দিন। উটের পিঠে করে মালপত্র মোটেই নিতে চাই না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাঁর ফায়সালা মেনে নেয়ার ওপরই গুরুত্ব দিলেন। শাস ইবনে কায়েস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই জবাব নিয়েই ফিরে গেল। (জারফানী প্রণীত শরহুল মাওয়াহেব) শরহুল মাওয়াহেযে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, প্রাণভিক্ষার অনুরোধ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যাখ্যান করায় আবু লুবাবা মনে করেছিলেন যে, বনু কুরাইযা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালা মেনে নিলে তাদেরকে হত্যাই করবেন। তাই তাদেরকে ইংগিতে সেই বিষয়টাই অবহিত করেন।]আবু লুবাবা পরক্ষণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে না গিয়ে মসজিদে নববীতে চলে গেলেন এবং মসজিদের একটি খুঁটির সাথে নিজেকে বেঁধে বললেন, “আমি যে ভুল করেছি তা আল্লাহ মাফ করে না দেয়া পর্যন্ত আমি এই স্থান থেকে নড়বো না, যে মাটিতে আমি আল্লাহ ও আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, সেখানে আমি আর কখনো কাউকে মুখ দেখাবো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন আবু লুবাবার জন্য। পরে সমস্ত ব্যাপার শুনে বললেন, “সে যদি আমার কাছে আসতো তাহলে আমি তার জন্য ক্ষমা চাইতাম। কিন্তু সে যখন এরূপ প্রতিজ্ঞা করেই ফেলেছে তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত তাকে মুক্ত করতে পারি না।”
উম্মে সালামা (রা) বলেন, আবু লুবাবাকে ক্ষমা করা হলে আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কি তাকে এ সুসংবাদ জানাবো?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “জানাতে পার।” অতঃপর উম্মে সালামা তাঁর ঘরের দরজার ওপর দাঁড়িয়ে বললেন, “হে লুবাবা, সুসংবাদ! তোমাকে ক্ষমা করা হয়েছে।” উল্লেখ্য যে, তখনো পর্দার আয়াত নাযিল হয়নি।
এরপর তাকে মুক্ত করার জন্য মুসলমানগণ তার কাছে ছুটে গেল। কিন্তু আবু লুবাবা বললেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে মুক্ত করে না দিলে আমি নিজেক মুক্ত করবো না।” একথা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফযরের নামাযে যাওয়ার সময় তাঁর বাঁধন খুলে দিলেন।
ইবনে হিশাম বলেন, আবু লুবাবা ছ’দিন খুঁটির সাথে আবদ্ধ ছিলেন। প্রত্যেক নামাযের সময় তাঁর স্ত্রী এসে নামাযের জন্য বাঁধন খুলে দিত। তারপর আবার খুঁটির কাছে এসে তিনি নিজেকে বেঁধে নিতেন।
পরদিন সকাল বেলা বনু কুরাইযা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালা মেনে নিতে প্রস্তুত হলো। খবর শুনে আওস গোত্রের লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ছুটে এলো। বললো, “হে আল্লাহর রাসূল, বনু কুরাইযা আমাদের মিত্র। খাযরাজ গোত্রের মুকাবিলায় তারা আমাদের সহায়তা করে থাকে। খাযরাজের মিত্রের (বনু কাইনুকার) ক্ষেত্রে আপনি কি আচরণ করেছেন তাতো আপনার জানাই আছে।” বনু কুরাইযার পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কাইনুকা গোত্রকে অবরোধ করেছিলেন। তারা খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল। তারাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলুল তাদের প্রাণভিক্ষা চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রাণভিক্ষা মঞ্জুর করেছিলেন। আওস গোত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বনু কুরাইযার প্রাণরক্ষার অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, “হে আওস গোত্রের লোকজন, আমি তোমাদের একজনকে সালিশ নিয়োগ করি তবে তাতে তোমরা রাজী আছ তো?” তারা বললো, ‘হ্যাঁ।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সা’দ ইবনে মুয়াযকে আমি সালিশ নিযুক্ত করলাম।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ ইবনে মুয়াযকে জনৈক মুসলমানের স্ত্রী রুফাইদার নিকট মসজিদে নববীর একটা তাঁবুতে রেখেছিলেন। এই মহিলা আহতদের চিকিৎসা এবং আর্ত মুসলমানদের সেবা করতেন। সা’দ খন্দক যুদ্ধে তীরের আঘাতে আহত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের বললেন, “সা’দকে রুফাইদার তাঁবুতে রাখ যাতে সে আমার কাছেই থাকে এবং আমি তার খোঁজ খবর নিতে ও সেবা-যত্ন করতে পারি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বনু কুরাইযার ব্যাপারে সালিশ নিয়োগ করলে তাঁর গোত্রের লোকজন তাঁকে একটা গাধার পিঠে চড়িয়ে নিয়ে গেল। গাধার পিঠে তারা চামড়ার গদি স্থাপন করেছিল। তিনি ছিলেন খুব মোটাসোটা সুদর্শন পুরুষ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে বলতে থাকে, “হে সা’দ, তোমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ করো। তোমাকে সালিশ নিয়োগ করেছেন এই জন্য যাতে তুমি তাদের প্রতি সহৃদয় আচরণ কর।” তারা খুব বেশী অনুনয় বিনয় করছে দেখে তিনি বললেন, “সা’দের জন্য সময় এসেছে সে যেন আল্লাহর দ্বীরেন ব্যাপারে কারো তিরস্কার বা ভর্ৎসনার তোয়াক্কা না করে।” একথা যারা তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলো তাদের কেউ কেউ বনু আবদুল আশহালের বস্তিতে ফিরে গেল। তখন বনু কুরাইযার কিছু লোক তাদের কাছে এলো। সা’দ তাদের কাছে পৌঁছার আগেই তারা তাদের কাছে সবকিছু শুনে নিজেদের মৃত্যু অবধারিত মনে করে কাঁদতে লাগলো।[৭১. “সা’দের জন্য সময় এসেছে, সে যেন আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কারো তিরস্কার বা ভর্ৎসনার তোয়াক্কার না করে”- সাদের এই উক্তি শুনে তারা বুঝলো যে, তিনি হয়তো তাদের হত্যার রায় দেবেন। তাই মৃত্যুর আগেই নিশ্চিত মৃত্যুর আভাস পেয়ে তারা কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিল।]
সা’দ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের কাছে পৌঁছলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমাদের নেতাকে স্বাগত জানাও।” তখন কুরাইশরা ও মুহাজিরগণ বলতে লাগলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ নির্দেশ ও কেবল আনাসারদের জন্য।” আনসারগণ বললেন, “এ নির্দেশ সবার জন্য।” এরপর সবাই তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, “হে সা’দ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে আপনার মিত্রদের ব্যাপারে ফায়সালা করার দায়িত্ব দিয়েছেন।” সা’দ বললেন, “আমি যে ফায়সালা ঘোষণা করবো সেটাই ফায়সালা বলে স্বীকৃতি হবেÑতোমরা সবাই আল্লাহর নামে তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ?” তাঁরা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তারপর যে পার্শ্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সে দিকে ইশারা করে বললেন, “এখানে যারা আছেন তাঁরাও কি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?” সা’দ অবশ্য শ্রদ্ধাবশতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা উল্লেখ করলেন না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তখন সা’দ ঘোষণা করলেন, “আমার ফায়সালা এই যে, বনু কুরাইযার সব পুরুষকে হত্যা করা হোক, সমস্ত ধনসম্পদ বণ্টন করে দেয়া হোক এবং স্ত্রী ও সন্তানদের বন্দী করা হোক।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, “তোমার ফায়সালা সাত আসমানের ওপর থেকে আল্লাহর যে ফায়সালা এসেছে তারই অনুরূপ।”
এরপর বনু কুরাইযার সবাইকে তাদের ঘরবাড়ী থেকে বের করে এনে মদীনার কাইস বিনতে হারিসার বাড়ীতে আটক করে রাখা হলো। পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার বাজারে গেলেনÑযেখানে আজও মদীনার বাজার অবস্থিত। এক দলে ভাগ করে আনলেন এবং ঐ সব পরিখার ভেতরে তাদেরকে হত্যা করা হলো। আল্লাহর দুশমন হুয়াই ইবনে আখতাব এবং বনু কুরাইযার গোত্রপতি কা’ব ইবনে আসাদকেও হত্যা করা হলো। তাদের সংখ্যা ছিল সর্বমোট ছয় বা সাত শ’। যারা তাদের সংখ্যা আরো বেশী মনে করেন তাদের মতে তাদের সংখ্যা ছিল আট থেকে নয় শ’য়ের মধ্যে। তাদেরকে যখন দলে দলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন তারা গোত্রপতি কা’ব ইবন আসাদকে জিজ্ঞেস করেছিল, “হে কা’ব, আমাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করা হবে বলে আপনি মনে করেন?” কা’ব বললো, “তোমরা কি কিছুই বুঝ না? দেখছো না, যে ডেকে নিচ্ছে সে কেমন নির্লিপ্ত, নির্বিকার? দেখছো না তোমাদের যে যাচ্ছে সে আর ফিরে আসছে না? আল্লাহর কসম, সবাইকে হত্যা করা হবে।”
এভাবে এক এক করে সবাইকে হত্যা করা হলো।
ইসলামের জঘন্যতম দুশমন হুয়াই ইবনে আখতাবকে আনা হলো। তার গায়ে গোলাপী রংয়ের একটা পোশাক ছিল। সে এর সব জায়গায় ছোট ছোট করে ছিঁড়ে রেখেছিলো যাতে তা কেড়ে নেয়া না হয়। তার দু’হাত রশি দিয়ে ঘাড়ের সাথে বাঁধা ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দৃষ্টি পড়তেই সে বললো, “তোমার শত্রুতা করে আমি কখনোই অনুতপ্ত হইনি। তবে আল্লাহকে যে ত্যাগ করে তাকে পর্যুদস্ত হতেই হয়।” এরপর সে উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে বললো, হে জনম-লী, আল্লাহর হুকুম অলংঘনীয়। বনী ইসরাইলের জন্য আল্লাহ ভাগ্যলিপি ও মহা হত্যাকা- নির্ধারিত করে রেখেছিলেন।” এ কথাগুলো বলে সে বসে পড়লো এবং এরপর তার শিরচ্ছেদ করা হলো।
উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রাদিয়ল্লাহু আনহা বলেন, বনু কুরাইযার একজন মহিলা ছাড়া আর কোন মহিলাকে হত্যা করা হয়নি। সেই মহিলাটি আমার কাছে নির্দ্বিধায় কথাবার্তা বলছিল আর হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিল। অথচ ঠিক সেই মুহূর্তেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে তার গোত্রের লোক নিহত হচ্ছিলো। সহসা জনৈক ঘোষক উচ্চস্বরে বলল, “সে কি? তোমার কি হয়েছে?” সে বলল, “আমাকে হত্যা করা হবে।” আমি বললাম “অমুক মহিলা কোথায়?” একথা শুনে সে বললো, এই তো আমি।” “কেন?” সে বললো, “একটা কা- ঘটিয়েছি সে জন্য।” এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো এবং হত্যা করা হলো।[৭২. ইবনে হিশাম বলেন, এই মহিলাই যাঁতার পাথর ছুঁড়ে সাহাবা খাল্লাদ ইবনে সুয়াইদকে হত্যা করেছিলো।]
আয়িশা (রা) বলতেন, “সেই মহিলাটির কথা আমি ভুলতে পারি না। আমার এই ভেবে বিস্ময় লাগে যে, সে নিহত হবে জেনেও প্রফুল্লচিত্তে ও হাসিখুশীতে ডুবে ছিল।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আতিয়া কুরাযী বলেন, “ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমি তখন কিশোর। আমাকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক পেয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো।”
আইয়ুব ইবনে আবদুর রহমান বলেন, সালমা বিনতে কায়েস নাম্নী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জনৈকা খালাÑ যিনি তাঁর সাথে উভয় কিবলামুখী হয়ে নামায পড়েছেন এবং মহিলাদের বাইয়াতে অংশগ্রহণ করেছিলেনÑ রাসূলুল্লাহর নিকট রিফায়া ইবনে সামুয়েল কুরাযীর জীবন রক্ষার আবেদন করেন। তিনি বলেন, “রিফায়া নামায পড়া ও উটের গোশত খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন ও তাঁর জীবন রক্ষা করেছিল। এই লোকটি (রিফায়া) প্রাপ্তবয়স্ক ছিল এবং সালমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলে। সে আগে থেকেই সালমার পরিবারকে চিনতো। এভাবে সালমা রিফায়ার জীবন রক্ষা করেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার ধন-সম্পদ, স্ত্রী ও সন্তানদেরকে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করেন। তারপর সা’দ ইবনে যায়িদ আনসারীকে বনু করাইযার কিছু সংখ্যক দাসদাসীকে দিয়ে নাজদ পাঠিয়ে দেন। তাদের বিনিময়ে তিনি সেখানে থেকে মুসলমানদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও ঘোড়া খরিদ করে আনেন।
বনু কুরাইযার মহিলাদের মধ্য থেকে রায়হানা বিনতে আমর বিন খুনাফাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের জন্য মনোনীত করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকাল পর্যন্ত সে তাঁর মালিকানায় ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বিয়ে করে পর্দার আড়ালে নেয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সে বলে, “হে আল্লাহর রাসূল, তার চেয়ে বরং আমাকে আপনি দাসী হিসেবে আশ্রয় দেন। এটা আমার ও আপনার উভয়ের জন্যই অপেক্ষাকৃত নির্ঝঞ্ঝাট হবে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা মতই কাজ করলেন তাকে দাসী হিসেবে গ্রহণ করার সময় সে ইসলাম গ্রহণের ঘোর বিরোধিতা করেছিল এবং ইহুদী ধর্মকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিল। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে দূরে রইলেন এবং মর্মাহত হলেন। একদিন তিনি সাহাবীদের সাথে বৈঠকে আছেন এমন সময় পিছনের দিকে জুতার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই সালাবা ইবনে সাইয়া আমাকে রায়হানার ইসলাম গ্রহণের খবর দিতে আসছে। ” সত্যই সালাবা এলেন এবং জানালেন, রায়হানা ইসলাম গ্রহণ করেছে। এমে তিনি খুশী হলেন।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবে খন্দক যুদ্ধ ও বনু কুরাইযার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কিভাবে মুসলমানগণ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন এবং তাদের ওপর কি অপার অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন এবং কিভাবে তিনি তাদেরকে সকল বিপদ থেকে উদ্ধার করে উভয় যুদ্ধে বিজয় দান করেছেন, তা বর্ণনা করেছেন। অথচ তার আগে মুনাফিকরা অবাঞ্ছিত কথাবার্তা বলেছিল। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, বিশাল এক বাহিনী তোমাদের ওপর চড়াও হলে আল্লাহ তোমাদের ওপর যে অনুগ্রহ বর্ষণ করেন তা স্মরণ কর। তখন আমি তাদের ওপর প্রচ- ঝটিকা এবং এমন এক সেনাবাহিনী (ফিরিশতা) পাঠিয়েছিলাম যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি। আর তোমাদের কার্যকলাপও আল্লাহ প্রত্যক্ষ করছিলেন। তারা যখন সবদিক থেকে তোমাদের ওপর আক্রমণ চালালো, যখন অনেকের চোখ ভয়ে বিষ্ফোরিত ও প্রাণ কণ্ঠনালীতে উপনীত হলো এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা রকমের ধারণা করতে লাগলে তখন মুমিনদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছিল এবং তাদেরকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়া হলো। মুনাফিক ও অসুস্থ মনের লোকেরা বলছিলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছেন তা ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের একটা দল বললো: হে ইয়াসরিববাসীগণ, তোমাদের এখন অবস্থানের অবকাশ নেই, কাজেই ফিরে যাও। তখন তাদের কোন কোন দল নবীর কাছে এই বলে অনুমতি চাচ্ছিলো যে, আমাদের পরিবার পরিজন বিপদের সম্মুখীন। আসলে তা বিপদের সম্মুখীন ছিল না। তারা শুধু পালাবার বাহানা খুঁজছিল।”
আওস ইবনে কায়যী ও তার সমমনাদের সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়।
“যদি (মদীনার) সকল দিক দিয়ে শত্রু ঢুকে পড়তো এবং তাদেরকে ফিৎনায় লিপ্ত হওয়ার অর্থাৎ শিরক করার আহ্বান জানানো হতো তাহলে তারা অবশ্যই তা করতো। এরূপ করতে তারা কদাচিৎ দ্বিধা করতো। ইতিপূর্বে তারা আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছিলো যে, রণেভঙ্গ দিয়ে পালাবে না। আল্লাহর ওয়াদা সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে। ( এই বনু সালামা ও বনু হারেসা গোত্রদ্বয় উহুদ যুদ্ধে পশ্চাদপসরণ করার পর ওয়াদা করেছিল যে, আর কখনো তার এরূপ কাজ করবে না। সেই ওয়াদার কথা আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিলেনÑ যা তারা আপনা থেকেই করেছিল।) হে নবী, তুমি বল, মৃত্যু বা হত্যা থেকে পালিয়ে তোমাদের কোন লাভ হবে না। সেক্ষেত্রে অল্প কিছুদিন জীবনকে ভোগ করার সুযোগ পাবে মাত্র। বল, আল্লাহ যদি তোমাদেরকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করা কিংবা তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে আল্লাহর সে সিদ্ধান্ত থেকে কে তোমাদের রক্ষা করতে পারে? আল্লাহ ছাড়া কাউকেই তার অভিভাবক বা সহায় হিসেবে পাবে না। তোমাদের মধ্যে কারা বাধা সৃষ্টিকারী এবং কারাই বা তাদের ভাইদেরকে বলে, ‘আমাদের সাথে এসো’। এসব মুনাফিকরা খুব কমই যুদ্ধে যেয়ে থাকে। (অর্থাৎ আত্মরক্ষা ও দায় সারার প্রয়োজন ছাড়া) শুধুমাত্র তোমাদের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ চরিতার্থ করাই তাদের উদ্দেশ্য। যুদ্ধ যখন সমাগত হয় তখন তাদেরকে তুমি দেখবে, তোমার দিকে ভয়ে এমনভাবে তাকাবে, মুমূর্ষ চেতনাহীন ব্যক্তির চোখ যেমন মৃত্যুর ভয়ে ঘুরতে থাকে। তারপর বিপদ কেটে গেলে তারা গণিমতের সম্পদের লোভে উচ্ছাসিত ভাষায় তোমাদের কাছে গিয়ে বড় বড় বুলি আওড়াবে। (অর্থাৎ এমন সব কথা বলবে যা তোমরা পছন্দ করো না। কেনান তারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না এবং কোন সওয়াবও পাবে না। তাই মৃত্যুকে তার ঠিক তেমনি ভয় পায় যেমন ভয় পায় মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে যারা বিশ্বাসী নয় তারা)। তারা ঈমান আনেনি ফলে আল্লাহ তাদের সকল সৎকাজ বিনষ্ট করে দিয়েছেন। বস্তুতঃ এটা আল্লাহর কাছে খুবই সহজ কাজ। তারা মনে করে, দলগুলো (অর্থাৎ হানাদার কুরাইশ ও গাতফান ) চলে যায়নি। আর যদি তারা পুনরায় হামলা করে বসে তাহলে তারা মরুভূমির বুকে বেদুঈনের মাঝে গিয়ে আশ্রয় নেবে এবং সেখান থেকেই তোমাদের খোঁজÑখবর নিতে থাকবে, আর তোমাদের মধ্যে থাকলেও তারা খুব কমই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতো।”
এরপর আল্লাহ মু’মিনদেরকে সম্বোধন করে বলেন, “তোামাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে উত্তম আদর্শ রয়েছে। আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসীদের জন্য।” [অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে থেকে কিংবা তার মর্যাদা থেকে স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট যারা তাদের জন্য নয়] এরপর মু’মিনদের সত্যনিষ্ঠা ও আল্লাহর প্রতিশ্রুত পরীক্ষাকে স্বীকার করে নেয়ার ও মেনে নেয়ার যে মনোভাব তাদের রয়েছে, তার উল্লেখ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “মু’মিনরা যে সময় হানাদার দলগুলোকে দেখলো তখন বললো: এ হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দেয়া প্রতিশ্রুতি। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য প্রতিশ্রুতিই দিয়ে থাকেন। এ রকম পরিস্থিতি তাদের ঈমানকে ও আত্মনিবেদনকেই বাড়িয়ে দেয়।” (অর্থাৎ বিপদে ধৈর্য, অদৃষ্টের আছে আত্মসমর্পণ এবং সত্যকে মেনে নেয়ার মনোভাব)।
“অনেক মু’মিন আছে যারা আল্লাহর কাছে দেয়া অংগীকার পূরণ করেছে। তাদের কেউ তো কর্তব্য সমাধান করে ফেলেছে। (অর্থাৎ কাজ শেষ করে আল্লাহর কাছে ফিরে গেছেন, যেমন বদর ও উহুদের শহীদগণ) আবার কেউ কেউ প্রতীক্ষমান আছে। (অর্থাৎ আল্লাহর সাহয্যের জন্য এবং রাসূল ও সাহাবীগণ যা করে গেছেন তা করার জন্য তারা এতে আদৌ কোন পরিবর্তন সাধন করেনি। (অর্থাৎ কোন সন্দেহ-সংশয় বা সংকোচ পোষণ করেননি কিংবা বিকল্প পথ খোঁজেননি) আল্লাহ তায়ালা সত্যনিষ্ঠদেরকে তাদের সত্যনিষ্ঠার পুরষ্কার দেবেন এবং ইচ্ছা করলে মুনাফিকদের আযাব দেবেন, কিংবা মাফ করে দেবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়ালু। আর আল্লাহ কাফিরদেরকে (অর্থাৎ কুরাইশ ও গাতফানীদেরকে) তাদের ক্রোধ ও আক্রোশসহ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। কোন কল্যাণই তাদের ভাগ্যে জোটেনি। মু’মিনদের হয়ে লড়াই করা জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। কেননা তিনি তো শক্তিমান পরক্রমশালী। আহলে কিতাবদের যে গোষ্ঠটি (অর্থাৎ বনু কুরাইযা) তাদের সাহয্য করেছিল আল্লাহ তাদের সুরক্ষিত জায়গাগুলো থেকে তাদেরকে বের করে এনেছেন এবং তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দিয়েছেন। ফলে তোমরা তাদের একাংশকে হত্যা ও অপরাংশকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছো। (অর্থাৎ পুরুষদের হত্যা করেছো এবং নারী শিশুদের বন্দী বানিয়েছ।) আর আল্লাহ তাদের ভূমি, ঘরবাড়ী, ধন-সম্পদ এবং যে জায়গা আদৌ পায়ে মাড়াওনি (অর্থাৎ খাইবার) সে জায়গাও তোমাদের অধিকারভুক্ত করে দিয়েছেন। বস্তুত আল্লাহ সবকিছুই করতে পারেন।”
বনু কুতাইবার সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে সা’দ ইবনে মুয়াযের জখমটির হঠাৎ অবনতি ঘটে এবং তিনি শাহাদাত লাভ করেন।
হাসান বাসরী (রাহ) বলেন, সা’দ খুব মোটাসোটা ও ভারী লোক ছিলেন। কিন্তু তাঁর লাশ বহনকারীরা তাঁকে অস্বাভাবিক রকম হালকা বোধ করে। তখন মুনাফিকদের কেউ কেউ বললো, সা’দ তো খুব ভারী ছিলেন। অথচ আমরা এত হালকা লাশ আর দেখিনি।”একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হালকা মনে হয়েছে তার কারণ এই যে, তার লাশ বহনকারীদের মধ্যে তোমরা ছাড়াও অনেকে ছিল (অর্থাৎ ফেরেশতা)। আল্লাহর কসম, সা’দের রূহ পেয়ে ফেরেশতারা উল্লাসিত ও আনন্দিত হয়েছে। তার ইনতিকালে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছে।”
খন্দক যুদ্ধে তিনজন মুশরিক নিহত হয়েছিল। মুনাব্বিহ ইবনে উসমান তাদের একজন। সে তীরবিদ্ধ হয় এবং আহত অবস্থায় মক্কায় গিয়ে মারা যায়। আর একজন বনু মুখযুমের নওফেল ইবনে আবদুল্লাহ। সে খন্দক ডিঙ্গিয়ে এসেছিল। ধরা পড়ে নিতহ হয়। সে তীরবিদ্ধ। তার লাশ মুসলমানদের অধিকারে ছিল। মুশরিকরা তার লাশ কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তার লাশ বা তার মূল্য দিয়ে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই।” অতঃপর তার লাশ দিয়ে দেয়া হলো। তৃতীয় ব্যক্তি ছিল বনু আমের গোত্রের আমর ইবনে আব্দ উদ। আলী ইবনে আবু তালিব (রা) তাকে হত্যা করেন।
বনু কুরাইযার বিরুদ্ধে অভিযানে কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে খাল্লাদ ইবনে সুয়াইদকে যাঁতার পাথর ছুড়ে মেরে হত্যা করা হয়। বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বললেন, “খাল্লাদ দু’জন শহীদের সওয়াব পাবে।” সাহাবী আবু সিনান মারা যান বনু কুরাইযাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবরোধ করার সময়। তাঁকে বনু কুরাইযার গোরস্থানে দাফন করা হয়। খন্দকের দু’পাশে সেনা সমাবেশের অবসান ঘটলে এবং কাফিররা পরিখা ত্যাগ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এরপর কুরাইশরা আর কখনো তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাবে না বরং এরপর তোমরাই তাদের ওপর আক্রমণ চালাবে।”
বস্তুত তারপর কুরাইশ পক্ষ থেকে মুসলমানদের ওপর আর কোন আক্রমণ হয়নি। বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেছেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাঁকে মক্কা বিজয়ের সুযোগ দেন।
ভাই এই ঘটনাটা আমি সহীহ বুখারী থেকে পড়েছি, যদি আপনি সহীহ বুখারীর মাগাদি অধ্যায়ের এই হাদিস নম্বরটা দিতে পারতেন তাহলে খুব উপকৃত হতাম