অসুখী শৈশব
সে দেখেছিল তার বাবা ফ্যান থেকে একটা দড়িতে ঝুলছে। জিভ অল্প বেরিয়ে ছিল। পা দুটো দোমড়ানো। সে অবাক হয়ে ভেবেছিল, বিছানা থাকতে বাবা কেন সিলিং ফ্যানে দুলতে দুলতে ঘুমোচ্ছে? বাবাও কি তারই মতো নাগরদোলায় দুলতে চায়?
লোকজন বাবাকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। সিধুদাদু তাকে কোলে তুলে বলল, “তোর বাবা মরে গেল রে! তোর মা-ই ওকে খেল!”
মা কী করে বাবাকে খায়? সে গিয়ে বাবাকে দেখছিল। বাবা, বাবা! ডাকল দু’বার। কথা বলল না। মা ছিল পাশের ঘরে, কাঁদছিল না, চুপ করে গালে হাত রেখে বসে ছিল।
সে বলল, “মা, তুমি বাবাকে খেলে কেন? তুমি কি রাক্ষসী?”
মা ঠাস করে মারল! সে কাঁদতে লাগল, “বাবা, তুমি মরে যেয়ো না, মাকে বকে দাও, আমায় মেরেছে! ও বাবা! মা আমায় মেরেছে!”
কিন্তু বাবা আর চোখই খুলল না। সে বুঝল, মরা, মানে আর নেই। সব ছাইভস্ম! বাবা ছাইভস্ম! কেননা, একদিন পর বাবাকে কাঠে শুইয়ে, তার জ্যেঠু প্যাকাটিতে আগুন দিয়ে, তার হাতে দিয়ে বলল, বাবার মুখে আগুন দে।
সে তো ছোট। সে মুখে আগুন দিয়ে দিল। কারণ, জ্যেঠুকে ভয় পায়। সকলেই ভয় পায়। কিন্তু বাবার মুখে আগুন ছোঁয়াতে সে একটুও চায়নি। তারপরেই সব দাউ দাউ! কী আগুন!
সিধুদাদু তাকে কোলে করে বলল, “তুমি আর দেখো না।”
“বাবা আর আসবে না?”
“না। তোমার ভিতরে থাকবে।”
“আমার ভিতরে? চাইলেই দেখতে পাব?”
“মনে মনে পাবে।”
“কত আগুন!”
“আগুন দেখো না।”
আর আগুনে পুড়ে বাবা ছাইভস্ম!
একদিন ছাতে খেলছিল। একা একা। খিদে পাচ্ছিল। নেমে এল। মা, মা, খেতে দাও। ও মা!
মায়ের ঘরে দরজাটা বন্ধ। সে জোর ধাক্কা দিল। দরজা হাট। মা ন্যাংটো উদোম। জেঠু ন্যাংটো উদোম। মায়ের হাঁটু ধরে দোল খাচ্ছে। সে হাঁ! নড়তে পারছে না! এ কেমন খেলা! মা আবার উঃ আঃ করছে!
হঠাৎ, দোল দোল খেলাটা ওরা থামিয়ে দিল। জেঠু লাফিয়ে নামল। এক টানে লুঙ্গি পরে চিৎকার, “কেন ঢুকেছ এই ঘরে? কেন?”
“মা! খিদে!”
“একটা আওয়াজ করবে না।”
“মা!”
“চো ও ও প! কী দেখছিলে হাঁ করে? কী দেখছিলে? যাও! কান ধরো! ধরো কান! দেবে না? দেবে না? বেআদব! বদমাইশ!”
দেওয়ালে ঝোলানো বেল্ট নিল। বাবার বেল্ট। চামড়ার।
শপাং! মারল!
“মা!”
শপাং!
“আর করব না! আর কখনও করব না!”
শপাং!
“আ আ আ!”
‘‘আবার মুখে আওয়াজ! কান ধরে ওঠবোস না করলে তোর রেহাই নেই!”
সে করতে লাগল। চোখের জল, মারে পিঠ হাত পা কেটে ঝরা রক্ত, মুখে নাল, স্বেদ এবং ভয়ের প্রস্রাব সমেত ওঠ-বোস, ওঠ-বোস, ওঠ-বোস!
কী যে হল তার, মায়ের দরজা বন্ধ হলেই গিয়ে হাঁ করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত! মার খাবে জেনেও!
কেউ তাকে রক্ষা করেনি। মা-ও নয়। সে শুধু বইয়ের ভিতর ডুবে থাকত। মা সরস্বতী তাকে কোলে তুলে নিলেন। সে আপনা-আপনি বড় হয়ে গেল। কবে? একদিন জেঠুর হাত চেপে ধরল। এগারো বছর বয়স। একদলা থুতু ফেলল গায়ে। বলল, “আর-একদিন যদি মারো, তোমাকে খুন করব। আমাকে জেলে নিয়ে যাবে। আ বেটার প্লেস দ্যান দিস হোম!”
আর-একটু বড় হয়ে মাকে বলল, “চলো, কলকাতায় চলে যাই।”
মা বলল, “এখানেই আমি ভাল আছি। তোমার জেঠুই তোমার অভিভাবক। আমারও।”
“তুমি থাকো। আমি সন্ন্যাস নেব। আমার আর সহ্য হয় না।”
মা ভয় পেল এবার। কিন্তু তারা জুড়ল না।
সে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি আর জেঠুই কি বাবাকে মেরে ফেলেছিলে?”
মা চড় মেরেছিল।
চড় কোনও উত্তর হতে পারে না! সত্যিই বাবার ক্যান্সার হয়েছিল কি না জানে না। ওই রোগ ছিল ওই বাড়িটায়। সম্পর্কে। বিশ্বাসে। আস্থায়।
মাকে সে ভালবাসে। কেননা নাড়ির বন্ধন। মা-ও তাকে ভালবাসে। কেননা সে নাড়ি-ছিন্ন ধন।
তবু, সে ছিল একা।
মা বলে, জেঠু তোমাকে ভালবাসেন। তিনি পিতৃসম!
ছেলেটা চুপ করে থাকে। কাউকে ঘৃণা করতে নেই। তাই চুপ করে থাকে।
মা বলে, সব সত্য জানতে নেই। সব সত্যই সুন্দর নয়। এমনও সত্য আছে, যা সহ্য করা যায় না।
সত্য আর মিথ্যা! ন্যায় আর অন্যায়! অভিভাবকত্ব ও অত্যাচার! গঙ্গায় সব ভেসে গিয়েছে। কত জল। চিতাভস্ম। কচুরিপানার মতো কত আলগোছ পল, যায়নি শুধু তিনটে বছর অপমান, অত্যাচারের স্মৃতি!
বড় হয়ে ওঠা ছেলেটা ওই ছোট্ট ছেলেটার জন্য রোজ নির্জল কাঁদে। রোজ কষ্ট পায়। কাউকে বলেনি। মনে থাকতে থাকতে, পচে পচে, বিকার হয়ে গেছে!
চাবুকের আস্ফালন।
বিকার, বিকার!
ওঠ-বোস, ওঠ-বোস, ওঠ-বোস!
বি-কা-আ-আর বি-কা-আ-আর!