হৃদয়ে কে জাগে
নিজের পড়া আজকাল লাইব্রেরিতে করছে দেবু। এর আগেও জিতুদিদি তাকে বলেছে, ঘর ছেড়ে তাদের পাঠাগারে গিয়ে পড়ার কথা। কতবার ভেবেছে যাবে, এই কাল থেকে যাবে, পরশু থেকে, হয়ে ওঠেনি। পড়ার সময় বলতে রাতে দশটা থেকে দুটো। তা-ও শেষ এক ঘণ্টা কেবল ক্লান্ত হাই তোলা। চোখে ঘুম নেমে আসে, মস্তিষ্কে জট পাকিয়ে যায়। পুরো রবিবার সে পড়াশোনাই করে। তাদের অলি পাবের আড্ডা ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার নেই, অন্য কিছুই করার নেই।
শানু অনেকটা সময় পারিবারিক গ্রন্থাগারে কাটায়। কম্পিউটার নিয়মিত ব্যবহার করে।
এখন তার মনে হল, কেন সে আসেনি এতকাল? এই দিককার ঝুলবারান্দা থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। উঁচু বাড়ির বাধা কম। কলকাতার গা ঘেঁষাঘেঁষি জীবনযাপন যেন সমবেত সংগীত গাইতে গাইতে দিগন্তে বিলীন! আকাশ পরম মমতায় ঢেকে রেখেছে শহরকে। শহর পরিবর্তে কী দিচ্ছে আকাশকে? ময়লা, ধোঁয়া, দূষিত পূতিগন্ধময় বায়ু!
শহর মানে জনবসতি, বসতি মানে মানুষ। মানুষ ও আকাশ। মানুষ ও বায়ু। মানুষ ও নদী। এমন সব সম্পর্ক, যা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ব্যক্তিগত আকাশ, ব্যক্তিগত নদী, জল, বায়ু। সমষ্টি মানুষ বোঝে না কিছুই। সম্পর্ক বোঝে না। শুধু ক্ষয় করে মহাপৃথিবীর পরমায়ু!
নরম অনুভবে ছেয়ে আছে মন। আগে চোখে পড়ত উড়ন্ত বিন্দুবৎ চিল। আজকাল কোথায় ডেকে উঠল কোকিল, খুঁজতে চলে আসে।
সম্পর্ক! গড়ে। ভেঙে যায়। একরূপে সেজে ওঠে, অন্য রূপ নেয়। সম্পর্ক রূপান্তরিত হয়। এমনকী, নিজের সঙ্গে যেটুকু নিজের। এবং সম্পর্ক অসীম অগণ্য সংজ্ঞা বয়ে চলে। যদি রাজর্ষির সঙ্গে দেখা না হত, যদি অসীমচন্দ্র পাগলাস্যারের সন্ধান কখনও না পেত, হয়তো এখনই, তার কাছে সম্পর্কের রূপাতিরূপ ধরা পড়ত না।
পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে সম্পর্ক হল মাটির মধ্যেকার রসের মতো। যা আছে। যা থাকে। মানুষ আপনি তার স্বাদ নিতে শেখে। কিন্তু যে সম্পর্ক চেনা ভুবনের বাইরে থেকে এনে আদল দিতে হয়, তার মাটি থাকে চিন্তায়, রস থাকে মনের ভিতর। এককে, তাই দিয়ে কিছুই গড়ে ওঠে না। অন্তত দু’জন মিলে সেই মনের রসে উপলব্ধির মাটি ফেলে গড়ে তোলে নতুন ভুবন। নতুন আস্বাদন। কখনও তা ভঙ্গুর, স্বল্পকালস্থায়ী। কখনও তা অটুট ও পরম সুন্দর! তার মধ্যেকার মৌলিক উপাদানগুলি হল পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও বিশ্বাস!
সম্পর্কের সেই পরম রমণীয় মন্দিরসম ঘরে শ্রদ্ধার আসন রচনা কঠিন নয়। বিশ্বাসের আধারগুলিও পূর্ণ করা, হয়তো কঠিনতর, তবু দুঃসাধ্য নয়, সবচেয়ে কঠিন ভালবাসার যথার্থ রচনা। যা নিয়ে জীবন বারবার পরীক্ষার চক্রে ফেলে দেয়। যা এক পলে বিনষ্ট হতে পারে, এক দণ্ডে দগদগে ঘৃণা হয়ে যায়!
ভালবাসা কী? কেমন?
এক বোধ। যা নিজের হৃদয়ে, আত্মায়, চিন্তায় ব্যাপৃত হয়ে যায়। নিজেকেই তা উপলব্ধি করতে হয়।
দেবাদৃতা রায় নামে এক ব্যর্থ, বিষণ্ণ, স্নেহসিক্ত কিন্তু প্রেমানুভূতি অনাস্বাদিত পঁচিশ বছরের তরুণীর জীবনে, গ্রীষ্মশেষে দূরাগত শ্যামল মেঘের মতো ধীরে ধীরে ছেয়ে যাচ্ছে ভালবাসা। হিসেবশাস্ত্রের অভ্যস্ত পথে, কত শত নতুনতর সরুপথ, গলি, সমান্তরাল রাস্তা পেয়ে যাচ্ছে সে আর দিনান্তে, প্রত্যহ, বুকের তলায় রাখা গোপন প্রার্থনার মতো নেড়েচেড়ে দেখছে এই কি ভালবাসা? এই কি প্রেম? এই যে একটি ই-মেল বার বার পড়ার আকাঙ্ক্ষা, এই যে উদ্বেল হৃদয়দশা, যা প্রতীক্ষা করে কবে দেখা হবে, এই যে গোপনতম ইচ্ছা স্পর্শ করার, চোখে ভেসে ওঠে চোখ, কানে বাজে কণ্ঠস্বর, ভাবতে ভাবতে পেরিয়ে যায় পথ, এই কি ভালবাসা? এই কি প্রেম?
জীবনে অভিজ্ঞ, মনোবিদ দিদি বলল, “হতে পারে, না-ও হতে পারে। জলে চুন গোলা দেখেছিস তো? প্রবল আলোড়নে প্রথমে দুধের মতো সাদা, তারপর মিশ্রণের ঘূর্ণগতি হ্রাস পেতে থাকে, সাদা চুন থিতোয়, ক্রমশ ক্রমশ ক্রমশ পাত্রের তলায় সাদা পুরু স্তর! উপরে জল টলটল করে। মুগ্ধতার মিশ্রণ, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে আলোড়নের পরীক্ষা, অবশেষে টলটলে জলের মতো উঠে আসে ভালবাসা! তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কেউ পরীক্ষা দিতেই চায় না। কেউ মাঝপথে হাল ছেড়ে দেয়?”
“আমাদের মতো। আমাদের সিএ হওয়ার স্বপ্নের মতো।”
“স্বপ্ন তো সুন্দর। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। স্বপ্ন ও লক্ষ্য মেলাতে পারলে সাফল্যের পথ সহজ হয়।”
“দুটো কি আলাদা?”
“নিশ্চয়ই। স্বপ্ন হল ইচ্ছা বা বাসনার আকার। আমার স্বপ্ন আমি বিমান ওড়াব। ওই বাসনায় বুঁদ হয়ে থাকা যায়। কোনও উদ্যোগ না নেওয়া স্বপ্নের বিলাস। একদিন তা মুছে যাবে রামধনুর মতো। আর লক্ষ্য হল ইচ্ছাপূরণের পথ চলার শুরু। অর্থাৎ, বিমানচালক হওয়ার জন্য আমি প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলাম।”
“তুমি যখন কোনও কিছু বোঝাও, তোমাকে ডাক্তারের চেয়ে বেশি একজন দার্শনিক বলে মনে হয়।”
“যে-কোনও তত্ত্ব ও জ্ঞান আসলে দার্শনিকতা। দার্শনিকতা বলতে আমরা এক ধরনের ভাববিভোর দশা বুঝি, জটিল ও দুর্বোধ্য, এমনকী, অহৈতুকী বাগবিস্তার বুঝি। কিন্তু দার্শনিকতা আসলে সমস্ত কার্যকারণ সম্পর্কিত জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়ার পথ। মানুষ আগে চিন্তা ও কল্পনার মধ্যে দিয়ে কার্যকারণ সম্পর্ক অবধারণ করে, সেটাই দর্শন, এবার তার প্রায়োগিক পর্ব হল বিজ্ঞান। তাই আগে দর্শন, তারপর বিজ্ঞান। কথায় আছে, বিজ্ঞান যেখানে থেমে যেতে বাধ্য হয়, দর্শনের শুরু সেইখানে। আমি তা মানি না। আগে দর্শন, পরে বিজ্ঞান। তাই বিজ্ঞান যেখানে নিরুত্তর, সেখানেও দর্শনের অভিগতি থামে না। দর্শন একটা নিরবচ্ছিন্ন চিন্তন প্রক্রিয়া, বিজ্ঞান তার অনুসরণকারী! জগতে সমস্ত বিষয়ই আসলে এক বোধ। সমস্ত বস্তু, সব অনুভূতি, সকল অস্তিত্ব এক বোধ।”
জিতুদিদির কথার সঙ্গে দেবু সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছে অসীমচন্দ্রস্যারের কথার। সব বিষয় দার্শনিকতার অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। পড়ানোর পদ্ধতি একেবারেই অনন্য, বিস্তৃত এবং মনোগ্রাহী।
প্রথমদিন যখন তারা পৌঁছল, তিনি স্নানে গিয়েছিলেন আর রাজর্ষি দাশগুপ্ত তাদের অভ্যর্থনা করেছিল। তার দ্বিতীয়বারের গমন বাবার সঙ্গে, গাড়িতে। এক রবিবারের সকালে! শুভায়ন সঙ্গে ছিল। শুধু অরুণাংশুর সঙ্গে পরিচয় করানোই নয়, তাদের উদ্দেশ্য ছিল, শনিবারগুলোয় তারা ফার্মে কাজ করতে চায়, এই প্রস্তাব উত্থাপন করা!
অরুণাংশু অসীমচন্দ্রের বাড়ি দেখে স্তম্ভিত। এমন ভগ্নপ্রাসাদে মানুষটি বসবাস করেন! দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তারা অসীমচন্দ্রের গীতাপাঠ শুনতে পাচ্ছিল। পরিষ্কার উচ্চারণ। উদাত্ত কণ্ঠ।
আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম কারণমুচ্যতে।
যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে ।।
শুভায়ন প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘‘সংস্কৃত পড়ছেন। ডাকা ঠিক হবে না।”
দেবু: গীতা পাঠ করছেন।
শুভ: তুই বুঝিস?
দেবু: বুঝতে পারার বড়ি খাওয়ানো হত। আমাদের স্কুলে প্রার্থনার সমাবেশে প্রতিদিন ফাইভ টু টুয়েলভ, এই আটটি ক্লাসের আটজন বেছে নেওয়া হত। বিজ্ঞপ্তি দেওয়া থাকত আগামী কাল, পরশু, তরশু কে কে পাঠ করবে। কী পড়বে, সেটা টিচাররা ঠিক করে রাখতেন। সোম থেকে শুক্র পাঁচদিন টানা গীতা, বাইবেল, কোরান, গ্রন্থসাহেব, ত্রিপিটক। শনিবার ছিল অমর বাণীর দিন। অর্থাৎ এই পাঁচটি ধর্মপুস্তকের বাইরে, অন্য কোনও মনীষীর বাণী, কোনও ঋষিবাক্য! প্রথমে বাণী পাঠ, তারপর দু’জন বিশেষ বিশেষ খবর বলবে। একজন দেশ, একজন বিদেশ। তারপর কোনও প্রার্থনা গীতি। তার মধ্যে রবীন্দ্রসংগীত ও কবীর ভজন বেশি ছিল। শেষ হত জাতীয় সংগীত দিয়ে। তখন এসব নিয়ে মজা করতাম। এখন বুঝতে পারি, মনের উপর ওই সমস্তই কত প্রভাব ফেলে!
শুভ: খুব সুন্দর! এই জন্যই তুই অন্যরকম।
দেবু: বাজে বকবি না! অন্যরকম আবার কী!
শুভ: সেটা না জানলে তোর ক্ষতি নেই। একটা গান আছে শুনেছিস? মান্না দে-র? ‘বাজে গো বীণা?’
দেবু: তার সঙ্গে ‘অন্যরকম’-এর কী সম্পর্ক?
শুভ: কিছু না। মনে পড়ল। আমি ওটা ভাবতাম, তুম না তুম না তানা তুম না না না! বাজে বকবি না!
দেবু সশব্দে হেসে উঠতে যাচ্ছিল। সামলে নিল।
প্রায় পনেরো মিনিট তারা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের অরুণাংশুর কথা ভেবে অস্বস্তি হচ্ছিল। মা-ই একরকম জোর করল। না হলে বাবার আসার দরকার ছিল না। স্কুল ছাড়ার পর বাবা একবারই গিয়েছিল তার সঙ্গে, যেদিন সে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি কলেজে কমার্সে ভর্তি হল। আর যেতে হয়নি। প্রথম বর্ষে অ্যাকাউন্টেন্সি অনার্স-সহ ভর্তির সময় থেকে সিএ পর্যন্ত সে সবই নিজে করতে পেরেছে। কোচিংগুলিতে বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছে। মাঝে মধ্যে বাড়িতে না জানিয়ে অলি পাবে গিয়ে বিয়ার বা ভদকা পান ছাড়া, গতানুগতিক, বাধ্য, নিয়ন্ত্রিত জীবনের বাইরে সে কিছুই করেনি। একগুচ্ছ ছেলের সঙ্গে ক্লাস করেছে, পড়াশোনা করেছে, প্রেমের হাঙ্গামা টেনে বাড়ির কাউকে দুশ্চিন্তায় ফেলেনি। এখন সে এই সুভাষগ্রামে পড়তে আসবে বলে মা উতলা হয়ে উঠল। এর কারণ কি এই নয় যে, তার নিরন্তর ব্যর্থতা, পাঁচবার সিএ ফাইনাল পাশ করতে না পারা, তাকে সর্বত্রই অক্ষম, অসফল ও দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রতিপন্ন করছে! এই পরীক্ষাগুলির আগে তার প্রত্যেক ক্ষেত্রে ফলাফল ভাল। এমনকী, কর্মক্ষেত্রেও সে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছে। জেউয়ের দৌলতে সে মুখার্জিস্যারের ফার্মে আর্টিকলশিপের সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু সবাই জানে, সুযোগ পাবার পর নিজের দক্ষতার পরিচয় দিলে তবেই স্বীকৃতি ও সম্মান মেলে!
গীতা পাঠের আওয়াজ শেষ হল। এরই মধ্যে অরুণাংশু খানিক ঘুরে এলেন। হেসে বললেন, “বাড়িটা বিশাল। পেছনে পুরো ঘন বনের মতো ফলের বাগান। অনেক লোক কাজ করছে। বলল, ঘরে ঢুকে যান। কিছু হবে না। ওরকমই সকলে ঢোকে!”
প্রায় আধঘণ্টা ছিল তারা। অরুণাংশু এবং অসীমচন্দ্র নানা বিষয়ে কথা বলেছিলেন। অরুণাংশু ঘুরে ঘুরে বইয়ের সংগ্রহ দেখলেন। একটুও ব্যক্তিগত কৌতূহল প্রকাশ না করে যথোচিত সৌজন্যে সাক্ষাৎ সম্পন্ন করলেন। বাবার মুখে সুপ্রসন্ন ঔজ্জ্বল্য দেখে দেবু বুঝতে পারছে, অরুণাংশু এই ব্যক্তি, এই পরিবেশ পছন্দ করেছেন। আপত্তিকর কিছু যদি মনে হত, তাঁর দৃষ্টিতে লেখা সেই বার্তা দেবু পড়ে ফেলতে পারত।
তাদের জন্য নানাবিধ ফল এল। শুভায়ন শনিবারের প্রস্তাবটি পেশ করল। অসীমচন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “প্রাচীনকালে শিষ্যরা এসে গুরুগৃহে বসবাস করত কেন জানো? গুরু পরিবেশ রচনা করতেন। যাকে বলা হত তপোবন। যে-বন তপস্যার জন্য নির্মিত। সেখানে প্রকৃতির নিবিড় শান্তি ও সৌন্দর্য, সান্নিধ্য, জীবনযাপনের বিলাসবিহীন প্রকরণ, সংসারের নানাবিধ প্রলোভন ও বিঘ্ন থেকে দূরে, একাগ্রে নির্জন সরস্বতী সাধনা। ওই একাগ্রতার জন্য আমি চাকুরি ছাড়তে বলেছিলাম। তোমাদের সততার এই পুরস্কার যে, আমি অনুমতি দিলাম। আমাকে না জানিয়ে যা কিছুই করার অবকাশ তোমাদের আছে।”
“আপনি রাগ করলেন স্যার?”
“আমি প্রীত নই, অপ্রীতও নই। ক্রুদ্ধ নই, প্রসন্নও নই।”
তা হলে কী? অবিকার?
দ্বিতীয় দিনের সাক্ষাতে রাজর্ষি বলেছিল, “স্যার যা যা বলেন, পড়ানোর বাইরে, বিচার করতে বসবেন না। উনি একজন অসামান্য শিক্ষক, আর কিছু না ভাবাই ভাল। উনি অবিকার নন। আমি ওঁর ক্রোধ দেখেছি। সেই সময় ওঁকে কোদাল দিয়ে মাটি কোপাতে দেখা যায়। রোজ রোজ এমন ঘটে না।”
দেবু বলেছিল, “আমাদের মধ্যে দোটানা চলছে। ওই ফার্মের সঙ্গে থাকতে আমাদের ভাল লাগে। মুখার্জিস্যার আমাদের কাছে প্রধানশিক্ষকের মতো! আবার অসীমচন্দ্রস্যারের কথায় বুঝেছি, উনি মন থেকে অনুমতি দেননি।”
রাজর্ষি: কিন্তু অনুমতি দিয়েছেন। কেউ সপ্রসন্ন অনুমতি দিতে পারলেন কি না, এটা তাঁর যুদ্ধ নয় কি? আপনারা অনুমতি চাইতে গিয়েছিলেন, প্রসন্নতা নয়।
দেবু: ঠিক। আপনার সঙ্গে স্যারের মতবিরোধ হয়েছে কখনও?
রাজর্ষি: অনেকবার! স্যারের সব ধ্যানধারণার সঙ্গে একমত হওয়া কি সম্ভব? আর প্রত্যেকটি মানুষ আলাদা, তার মত, দর্শন, অভিজ্ঞতা আলাদা। সুতরাং মতপার্থক্য স্বাভাবিক।
দেবু: উনি পড়ানও এই দার্শনিক দৃষ্টি নিয়ে। প্রত্যেকটি সংস্থা একক ও অনন্য। সেই সংস্থার প্রত্যেকটি দিক বিশেষ। অডিট করতে গিয়ে আমাদের প্রতিবারই নতুনতর অভিজ্ঞতা হয়। আমাদের একটা বিষয় হল, অ্যাডভান্স অডিটিং অ্যান্ড প্রফেশনাল এথিক্স। উনি বলছেন, পেশাগত নীতি কেবল হিসেব পরীক্ষকের প্রেক্ষিতে দেখলে চলবে না। প্রত্যেক সংস্থার নিজস্ব নৈতিকতা থাকে। তাকে বুঝতে হবে। প্রতিষ্ঠানকে এক ব্যক্তি হিসেবে দেখতে হবে। তার ইতিহাস, সংবেদনশীলতা, দুর্বলতা, প্রবণতা– সমস্ত! ধরে নিতে হবে, প্রতিষ্ঠান একটি জাগ্রত সত্তা, যার মন ও হৃদয় আছে। হিসেবশাস্ত্রকে সম্পূর্ণ নীরস ও নৈর্ব্যক্তিক বলে ধরে নেওয়া মস্ত বড় ভুল। যে-কোনও সচল প্রতিষ্ঠান মানেই তার মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। সম্যক ধারণা থাকলে যে-কোনও প্রশ্ন কাল্পনিক দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব। সেখান থেকেই উত্তর বেরিয়ে আসে! জিজ্ঞাসার প্রথম এবং প্রধান সমাধান-নীতি হল ‘কেন’ এই প্রশ্নটি করা।
একটানা এত কথা সে বিশেষ বলে না। অসীমচন্দ্রের শিক্ষণ পদ্ধতি তাকে অভিভূত করেছে। পরিচিত বিষয়গুলি নবরূপে আবিষ্কার করছে সে। অনেকদিন পর, সিএ পড়ার প্রথমদিকের মতো আগ্রহ ও উদ্দীপনা ফিরে পাচ্ছে! তার চোখে, হাতের ভঙ্গিতে, মুখের রেখায়, তপ্ত চকোলেটে অন্যমনস্ক চুমুক দিয়ে ছ্যাঁকা খেয়ে চমকে ওঠার মধ্যে, তার উৎসাহের দীপ্তি ও নিমগ্নতা তাকে ভারী সুন্দর করে তুলেছিল। রাজর্ষি অপলক দেখছিল তাকে। তার কেশরাজি সামান্য বেড়েছে। কিন্তু গালের নিবিড় কালো শ্মশ্রুস্তর ফিরিয়ে দিয়েছে তার নরম মুখশ্রী! সে বলল, “খুব সুন্দর।”
দেবু: কী?
রাজর্ষি: আপনার বর্ণনা।
দেবু: ধন্যবাদ।
রাজর্ষি: এবারে আপনি পাশ করে যাবেন।
দেবু: কী জানি।
রাজর্ষি: আমি জানি।
দেবু: কী করে?
রাজর্ষি: আমি জানি। দেবাদৃতা, আপনার ডাকনাম কী?
দেবু: ওই, দেবু।
রাজর্ষি: মজার ব্যাপার। দেবু ছেলের নামই শুনেছি।
দেবু: আমার দিদির নাম জিতু। অপরাজিতা থেকে।
রাজর্ষি: আমরা কি একটু ব্যক্তিগত পরিসরে যেতে পারি?
দেবু: ব্যক্তিগত মানে কী? এবং কেন?
রাজর্ষি: এই তো, আপনি স্যারের মন্ত্রশিষ্য হতে শুরু করেছেন! আপনার সিদ্ধি ঠেকায় কে! দেখুন, হঠাৎ দেখা না হয়ে গেলে আপনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা কোথায় হত, আদৌ হত কি না, জানি না। আমি বিয়ে করব না, এমনটাই ঠিক করেছিলাম।
দেবু: কেন?
রাজর্ষি: নারী বা বিবাহিত জীবনের প্রতি আকর্ষণ বোধ করিনি। ভাবিইনি এই নিয়ে! গতবছর এগারো মাসের জন্য আমেরিকায় প্রিন্সটনে কাজ করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে ছাত্রীরা আছে, আমার সঙ্গে সহগবেষক ছিলেন কয়েকজন, মহিলা, তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলেছি। মায়ের তাতে মাথায় ঢুকল, আমি হয়তো কোনও সাদা আমেরিকান বিয়ে করে ফেলব। ওখানে থেকেও যেতে পারি। এবার মা উঠে-পড়ে লাগল আমার বিয়ের জন্য। আমার মা এমনিতে আধুনিক। নিজের মতো থাকতে পছন্দ করেন। অপরের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন না। কিন্তু মনের তলায় কোথাও সংস্কার আছে। তিনি তো দেবী নন। আমার রোজকার জীবনযাপনে তাঁর আগ্রহ নেই, কিন্তু আমার বিবাহ বিষয়ে তাঁর অধিকারবোধ আত্যন্তিক! তিনি আমাকে কাছছাড়া হতে দিতে নারাজ। আমার মাকে আমিও বড়ই ভালবাসি। তাই তাঁর ইচ্ছেগুলো গুরুত্ব সহকারে দেখতে হয়।
দেবু: আপনি কি আবার আমেরিকা যাচ্ছেন?
রাজর্ষি: এই অগস্ট থেকে পরবর্তী এপ্রিল।
দেবু: আপনার মা যেমনটি ভাবছেন, তেমন কাউকে ওদেশে যদি আপনার ভাল লাগে, প্রিন্সটনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগ যদি পান, সে তো খুবই ভাল!
রাজর্ষি: ওদেশে বসবাস করার মানসিকতা আমার নেই। আবার যাচ্ছি আমার আরব্ধ কাজটির জন্য। গেলাম, কয়েক মাস থাকলাম, সে পর্যন্ত ঠিক আছে। ওখানে পাকাপাকি থাকতে পারব না।
দেবু: কেন?
রাজর্ষি: কারণ, ওখানকার বৈভব দেখে হীনমন্যতা আসে। নিজের দেশের জন্য দুঃখ হয়। ওদের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষ আমি অনুভব করেছি। আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী, দরদী, কিন্তু ভিতরে প্রবল জাত্যভিমান!
দেবু: আমাদের দেশেও তো আছে।
রাজর্ষি: তবু এ আমার নিজের দেশ। এখানে আমার গায়ের রঙের জন্য কোনও সমস্যা হয় না। খুব ধনীগৃহে কখনও গিয়েছেন? এমন ধনী, যাদের জীবনযাত্রার মধ্যে থেকে সোনা-রুপো-জহরতের গন্ধ বেরোয়?
দেবু: না। তা যাইনি। তবে অবস্থার বৈষম্য উভয়পক্ষেই অস্বস্তিকর! ওদেশের মানুষেরাও হয়তো আমাদের ধরণধারণে বিস্মিত বোধ করেন। আপনার যে সমস্যা, সে বিষয়ে মাকে বুঝিয়ে বলুন, অমনটা করবেন না। তাঁকে আশ্বস্ত করুন। আপনাকে তিনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন।
রাজর্ষি: বিয়ের ব্যাপারে নয়।
দেবু: কেন?
রাজর্ষি: বারো ক্লাসে পড়ার সময় আমি সন্ন্যাস নেব স্থির করেছিলাম। মা-র মধ্যে সেই শঙ্কা আছে। আমার পরিবার সম্পর্কে কিছু জানেন?
দেবু: এটা শুনেছি, ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। আমাদের মতো যৌথ পরিবার। জ্যাঠামশাই আপনাকে মানুষ করেছেন।
রাজর্ষি: নিজের গল্প করতে আমি স্বচ্ছন্দ নই। হয়তো এই স্বল্প পরিচয়ে সবটা বলে উঠতেও পারব না।
দেবু: আপনার ইচ্ছে করলে বলবেন। কোনও বাধ্যতা নেই।
রাজর্ষি: আমি বলার তাগিদ বোধ করছি। কারণ, কারণ, …মানে আপনি যেমন বললেন, মাকে বুঝিয়ে বললেই চুকে যায়, তেমনটাই করতাম, কিন্তু…
দেবু: মা বিশ্বাস করবেন না! তাই তো? কেন? আপনি তো সন্ন্যাস নিতে যাচ্ছিলেন। সেটা তো হঠাৎ কাউকে বিয়ে করে ফেলার সম্পূর্ণ বিপরীত!
রাজর্ষি: মায়ের ধারণা, আমেরিকায় মেয়েরা ছেলে পাকড়ানোর জন্য হন্যে হয়ে আছে!
দেবু: যেন এখানকার মেয়েরা ছেলে পাকড়ানোর জন্য হন্যে হয়ে নেই!
রাজর্ষি: ঠিক! সব দেশেই একরকম। কিন্তু সব জায়গাতেই সুশীলতা আছে, সৌজন্য আছে। ওখানে সমাজে স্বাধীনতা অনেক বেশি, কিন্তু মায়ের ধারণামতো অমন সহজলভ্যও ওরা নিজেকে করে না। এটা মায়ের সংস্কার। কিন্তু মা আমেরিকা নিয়ে কী ভাবল, তা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি বলতে চাইছিলাম, আপনাকে দেখার পর ভেবেছি অনেক, মনে হয়েছে আই নিড সামওয়ান লাইক ইউ! টু বি মোর প্রিসাইজ়, আই নিড ইউ অ্যাজ় মাই ফ্রেন্ড, মাই কম্প্যানিয়ন, যার কাছে আমার নিজেকে লুকোতে হবে না।
দেবু: আপনি বলেছিলেন আপনি ভণিতা করেন না। তা হলে নিজেকে লুকোনোর প্রশ্ন আসে কী করে?
রাজর্ষি: আসে। কারণ, মনের ভিতরেও একটা মন থাকে। তার একজন সঙ্গী চাই। আ ট্রু কম্প্যানিয়নশিপ ইজ় এ রিলেশন উইদাউট এনি প্রেজুডিস অ্যান্ড প্রিটেনশন। উই প্রিটেন্ড, ডোন্ট উই? ভণিতা করি না। তবুও কি করি না? গভীর দুঃখের গোপন কান্না গিলে ফেলে নিজেকেই প্রতারণা করে হেসে বলি না কি, ভাল আছি? খুব ভাল আছি?
দেবু: মানলাম। কিন্তু আমাকে তো কিছুই জানেন না আপনি!
রাজর্ষি: জানি না। তবু এটাই সত্য যে, আপনাকে দেখার পর আমার মধ্যে এক আলো জ্বলে উঠেছে। আলো নিয়েই আমার গবেষণা, জানেন তো! আলোকতরঙ্গের সঙ্গে অন্যান্য শক্তিতরঙ্গের সম্পর্ক! এ নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু আরও অনেক কাজ বাকি আছে। আলো আমার বড় প্রিয়। আমি হয়তো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি। একে নিছক প্রেমে পড়া বলে দেখবেন না প্লিজ়! আবেগ সত্য ও সুন্দর। আলোর মতোই! আমার জীবনে আপনিই প্রথম, যাঁকে দেখে আমার অন্তরের অন্তরতম প্রকোষ্ঠে আলো জ্বলে উঠেছে। কেন, আমি জানি না। আমি ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ! হয়তো এ কোনও ঐশ্বরিক তরঙ্গ! আমার বাবা যখন মারা যান, আমার বয়স আট বছর। তিনিও ফিজ়িক্স পড়াতেন। বাবাকে মনে রেখে আমি ফিজ়িক্স নিয়েছি। আমার মূল আকর্ষণ ছিল অঙ্কে। তার জন্য আমি কিছু হারাইনি। ফিজ়িক্স আর অঙ্ক হল ওইরকম সঙ্গী। পরস্পর পরিপূরক। এমনকী, এক জায়গায় পৌঁছে সব একাকার হয়ে যায়।
দেবু: ওঁর কী হয়েছিল?
রাজর্ষি: সবাই জানে ক্যান্সার! বাট হি হ্যাংড হিমসেলফ!
দেবু: ওঃ! ওঃ! ইস! ক্যান্সারের জন্যই?
রাজর্ষি: হয়তো। হয়তো নয়। আমি বাবার চিকিৎসার কাগজ চেয়েছিলাম। শুনলাম, সব বাবার সঙ্গে দাহ করে ফেলা হয়েছে। একটা চিরকুট ছিল বাবার হাতে লেখা। ‘তোমরা ভাল থেকো। রাজাকে দেখো।’
দেবাদৃতার বুকের অতল থেকে কান্না উঠে আসছিল। প্রাণপণ ঠোঁট চেপেও আটকাতে পারেনি। চোখ জলে ভরে উঠল। ডান হাত বাড়িয়ে আলতো চাপ দিল সে রাজর্ষির হাতে। বাঁ হাতে, সাদা জর্জেট দোপাট্টা টেনে মুখ মুছল। ভারী গলায় বলল, “স্যান্ডউইচ ঠান্ডা হয়ে গেল।”
রাজর্ষি স্যান্ডউইচে অন্যমনস্ক কামড় দিয়ে বলল, “উত্তরপাড়ায় আমাদের বিরাট বাড়ি। গঙ্গার ধারে। আমার নদী খুব ভাল লাগে। গঙ্গা দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। রোজ মনে হত, ওই গঙ্গায় আমার বাবার চিতাভস্ম, অস্থি ভেসে গেছে। তবু বাবা আছে। মানুষ তো আসলে মনে বাঁচে! যে জীবিত, অথচ কেউ যাকে স্মরণ করে না, তার জীবনের কী অর্থ? অনেক আশ্রিত ও বাড়িতে। জ্যাঠামশাই আর মা আমার অভিভাবক ছিলেন। নিঃসন্তান বলে আমার জেঠিমার মধ্যে খানিক পাগলামি আছে। গঙ্গাদর্শন ছাড়া ওই বাড়িতে আমার কিছুই ভাল লাগত না। তাই ছেড়ে এসেছি।”
কিছুক্ষণ নীরবতা। দেবু বুঝতে পারছে রাজর্ষির আরও কিছু বলার আছে। সে কোনও প্রশ্ন করল না। আরও একটি উষ্ণ তরল দুধে মিশ্রিত চকোলেট দিতে বলল। রাজর্ষি প্লেটে পড়ে থাকা চিকেনের কণাগুলি স্টিলের ছুরি দিয়ে একত্র করতে করতে বলল, “বাবা কোনও অভাব রেখে যায়নি। সহকর্মী অধ্যাপকদের একটা সমবায় কসবার এই প্রান্তে জমি নিয়ে গৃহপ্রকল্প করছিল। বাবা তাতে দুটো ফ্ল্যাট নেয়। একটা বাবার নিজের নামে, আর-একটা আমার ও বাবার নামে। আমার মাকে আমি খুবই ভালবাসি। কিন্তু আমাদের একরকম দ্বন্দ্ব আছে। সোজা কথায় মায়ের সঙ্গে আমার বনে না। আবার আমাকে ছাড়া মায়ের চলেও না। মা তার নিজের পছন্দমতো সেবা, ভক্তি, পূজাপাঠ নিয়ে থাকে। আমি আমার পড়া নিয়ে। এসব, আপনাকে বললাম, ইচ্ছে হল, নিজেকে চেনাই। আপনি কী ভেবেছেন, কী ভাবছেন জানি না।”
দেবু বলেছিল, “দেখুন, আজ তৃতীয় দিন আমাদের দেখা হল। প্রথম দু’বার আকস্মিকতা। আজ পরিকল্পিত। আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বলার কিছুই নেই। আমার বাবারা তিন ভাই। আলাদা ফ্ল্যাটে থাকি, কিন্তু যৌথ পরিবারই বলা যায়। খুবই সুসংবদ্ধ। পরস্পর কোনও দ্বন্দ্ব-বিরোধ নেই। জিতুদিদি, আমি, শানু খুব ভাল বন্ধু। কোথাও সমস্যা নেই। জিতুদিদি আর মনোময়দা আনন্দে আছে। শানু কেরিয়ার তৈরি করছে। উপদ্রব যদি বলি তো আমি নিজে।
রাজর্ষি: কেন?
দেবু: কী বলব! সবাই বলেছিল সায়েন্সের বাড়ি, কমার্স যেন না নিই। কিন্তু আমি সিএ হতে চাইলাম। আমাদের বাড়িতে সবাই সফল, প্রতিষ্ঠিত। ফেল করা, বছরের পর বছর ফেল করা, অনেকটা ওই বর্ণবিদ্বেষের মতো ব্যাপার যেন! একদিকে উজ্জ্বল উত্তীর্ণ, দৃঢ় প্রতিষ্ঠিতের দল, অন্যদিকে, ব্যর্থ, অসফল, নড়বড়ে! দুই দলে মেলানো মুশকিল। সামাজিক চাপ আছে। মেয়ে পাশ করেনি? তা হলে এবার… বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ না কেন! যেন বিয়ে হলেই সব ল্যাঠা চুকে যায়।
রাজর্ষি: কারা এই সামাজিক চাপ?
দেবু: হয়তো সহকর্মীরা, আত্মীয়রা, যাদের কিছুমাত্র গুরুত্ব নিশ্চয়ই আমার পরিবারে রয়েছে! কিন্তু আমি তো প্রেম-বিয়ে, এসব ভাবিনি! নাকি সময়মতো সংসার করতে হবে। কেন? আমি যদি যেমন আছি, তেমনটাই ভাল থাকি, তা হলে কার কী ক্ষতি? সংসার করা বলতেই বা ঠিক কী বোঝায়? আসলে কি যৌনসম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার পর্দা-ঢাকা উচ্চারণ সংসার করা? হয়তো আমি ঠিকই ভাবছি। কিন্তু তার জন্যও তো মানসিক প্রস্তুতি দরকার। ইচ্ছে দরকার। আমার নিজের কাছে নিজের জন্য ‘সংসার’ এখনই জরুরি যদি না হয়, তবে যা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে থাকতে পারব না কেন?
রাজর্ষি: নিশ্চয়ই! সকলেরই নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে।
দেবু: কিন্তু আমি বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারব না।
রাজর্ষি: কেন? আপনাকে নিশ্চয়ই জোর করা হবে না!
দেবু: না না। আমাদের বাড়িতে জোরজবরদস্তি একেবারে নেই। জেউ, বাবা, কাকুন তো জোর করার সম্পূর্ণ বিরোধী। কিন্তু এই যে আমার অকৃতকার্যতার গ্লানি সকলের পক্ষে বোঝা হয়ে উঠেছে, তা আমাকেই একটা দায় করে তুলছে। সত্বর, আমার সম্পর্কে কোনও সুখবর দিতে না পারলে অনেকের অসুবিধে হচ্ছে। কী জানেন, জোর করার অনেক রকম আছে। আমার জন্য কেউ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন, দুঃখিত বা বেদনাতুর, এই নিরন্তর প্রকাশও পরোক্ষ জোর সৃষ্টি করে। যাকে বলা হয় চাপ। তখন নিজের উপর বিরক্তি আসে। মনে হয়, চলো, মেনে নিই। আমিও মেনে নেবার দিকে এগোচ্ছিলাম। ঠিক আছে। আমি মে মাস পর্যন্ত সময় চেয়েছিলাম এই ভেবে যে, মে মাসে আবার পরীক্ষায় বসব। এখন পরীক্ষায় বসা নভেম্বর হয়ে যাওয়ায় মা-কাম্মা আর দেরি করতে চায় না। আপনি তাঁদের খুবই পছন্দের পাত্র।
রাজর্ষি: তা হলে?
দেবু: টু বি অনেস্ট, দ্য ডে আই স ইউ ফর দ্য ফার্স্ট টাইম, সামথিং হ্যাপেনড ইন মাই হার্ট টু! সাম ফিলিংস দ্যাট আই হ্যাড নট হ্যাড বিফোর। নতুন রকম। ব্যাখ্যাতীত। অপ্রকাশ্য।
রাজর্ষি: তা হলে, তা হলে, উই আর ইন লাভ? লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট?
দেবু: আমি নিশ্চিত নই। এসব ক্ষণস্থায়ী মুগ্ধতাও হতে পারে। জিতুদিদি বলে, সত্যিকারের ভালবাসা অনেক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যায়। কিন্তু সমস্ত পরীক্ষার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করাও ঠিক বাস্তবসম্মত নয়।
রাজর্ষি: তা হলে?
দেবু: আমি ভাবতেই পারছিলাম না একজন অচেনা মানুষের সঙ্গে কীভাবে থাকতে শুরু করব! যদিও চেনা মানুষও অচেনা হয়ে উঠতে পারে। তবু। আসলে পুরো বিষয়টাই বড়ই বিভ্রান্তিতর! আমি যেন আমার অজ্ঞাতেই অন্য এক জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়ছি।
রাজর্ষি: জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই অজ্ঞাত দেবাদৃতা। সেটা মেনে নিলে আর সমস্যা নেই। যা ঘটবে তা-র সঙ্গে যুঝে চলতে হবে। আমাদের কাছে বিবাহ কাম্য নয়। কিন্তু দেখা হয়ে যাওয়া অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সম্পূর্ণ অচেনা ছিলাম। সেই থেকে তবু আমাদের পরিচয় তো হল। একটা সূচনা ঘটল। মা আরও কয়েকটি ছবি সংগ্রহ করেছে। আমার পক্ষে ভারী ক্লান্তিকর! টেবিলে তাসের মতো ছবিগুলো সাজিয়ে রাখে। আমার কেমন গা গুলোয়। একদিন খুব রাগ করলাম।
দেবু: আমার কাছে এটাই প্রথম, ইয়ে, কী বলে, সম্বন্ধ! মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, অচেনা মানুষ ইত্যাদি। মা বলল, তোমার জেম্মা, আমি– এভাবেই জীবন শুরু করেছিলাম। আমরা যথেষ্ট আনন্দে আছি! রাজর্ষি, আপনার বা আমার টেবিলে আবারও নতুন কোনও সাহেব-বিবি আসার চেয়ে ভাল…
রাজর্ষি: এবারে ‘কেন’ প্রশ্নটা হবে চূড়ান্ত অপরিণামদর্শিতা!
সেই প্রথম তারা একত্রে প্রাণ খুলে হেসেছিল! এবং কখনও কখনও উদাত্ত অবাধ হাসির শুভান্বয় মানুষকে নিমেষে বহু যোজন দূরত্ব পার করিয়ে কাছাকাছি এনে ফেলে। কান্নার মধ্যেও সেই সমন্বয়ী শক্তি আছে। কিন্তু হাসি অনেক বেশি ক্ষমতাময়ী।
রাজর্ষি: আজ আমি নির্বাচিত ছবিটির কথা মাকে জানাব।
দেবু: আমিও জানাব কাম্মাকে।
রাজর্ষি: জানাব না যে, আপনাকে দেখেছি।
দেবু: জিতুদিদি জানে। শানুকেও বলব। আর কাউকে নয়।
রাজর্ষি: মা হয়তো দেখতে যাবে, মানে আপনার বাড়ি।
দেবু: আমি দেখা দেব। তবে বিশেষ পোশাক, সাজগোজ নয়।
রাজর্ষি: আপনি স্বাধীন। যে-কোনও দিন, এমনকী আমার বিষয়েও ‘না’ বলার পূর্ণ অধিকার আপনার আছে।
দেবু: আপনারও আছে। আরও পছন্দসই কোনও হরতনির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কোথাও।
রাজর্ষি: সে আশা করবেন না।
দেবু: অন্য কেউ তো আমাকে নাকচ করে দিতে পারে।
রাজর্ষি: নাকচ করার প্রশ্নে আপনি নিজে ছাড়া বিশ্বের আর কারও মতামতের কোনও মূল্য নেই আমার কাছে। আমি হৃদয়ে বিশ্বাস করি।
দেবু: আবার যদি ফেল করি!
রাজর্ষি: করবেন না! যদি করেন, তা হলেও আপনার সুযোগ ফুরিয়ে যাচ্ছে না।
দেবু: আমেরিকা যাওয়ার আগেই কি চান?
রাজর্ষি: হ্যাঁ। আপনি চান না?
দেবু: না। আমার আশঙ্কা, নতুন জীবন আমার অধ্যয়নে বিঘ্ন ঘটাবে।
রাজর্ষি: ঘটাবে না, তা বলা যায় না। কিন্তু দেবাদৃতা, সম্ভাবনা বলে একটি শব্দ আছে। অজ্ঞাত, অজানিত ঘটনার অসংখ্য সম্ভাবনা আমাদের ঘিরে সারাক্ষণ পাক খেয়ে চলেছে। আমার কারণে বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা নাশ করার পরেও যে কোনও আকস্মিকতা সেই উপদ্রব হয়ে উঠতে পারে। আমি এটুকু বলতে পারি, পাঠে মনোনিবেশ করার অবকাশ ও নিভৃতি, সময় ও সুযোগ, সব আপনার থাকবে। পরীক্ষা পর্যন্ত আপনার বাবা-মায়ের কাছে থাকতে চাইলেও আপত্তি নেই!
দেবু: কেন? কিসের এত তাড়া? শুধু মায়ের আশঙ্কা দূর করবেন বলে?
রাজর্ষি: আমার আশঙ্কা, অতদিনের জন্য বাইরে চলে যাব, যদি আর কেউ আপনাকে নিতে চলে আসে! প্রাথমিক মুগ্ধতার ঘোর যদি কেটে যায়!
দেবু: বিয়ের পরেও কি তা হতে পারে না? আপনার? আমার?
রাজর্ষি: আপনার যেমনটি ইচ্ছে, তাই হবে। আমি জোর করব না।
দেবু: আরও একটু ভাবি, মানে সময়টা নিয়ে।
রাজর্ষি: আশ্বস্ত হলাম। আচ্ছা বলুন, স্যারের বাড়িতে সবকিছুই ঠিক আছে তো? আপনার বন্ধুদের কেমন লাগছে?
দেবু: স্যারের বাড়ি নিয়ে সমস্যা নেই। বন্ধুরাও অভিভূত! স্যার এবং স্যারের বাড়ির পরিবেশ, সব মিলিয়ে খুব মায়াটান রয়েছে। স্বপ্নের মতো। সাজানো, বানানো, শহুরে কৃত্রিমতার সঙ্গে এতটুকু মিল নেই। পড়াতে পড়াতে উনিও এক স্বপ্নলোকে চলে যান। মাঝে-মাঝে কেমন ঘোর ভেঙে যায়। উনি ছটফটিয়ে ওঠেন! চলে যান ঘরের মধ্যে। কিছু পরে আবার ফিরে আসেন। সেই যাওয়ার মধ্যে একরকম উদ্বেগ থাকে, যেন কোনও কাজ ভুলে গিয়েছেন! আচ্ছা, সুমা কে?
রাজর্ষি: স্যারের বোন।
দেবু: তাঁকে কখনও দেখিনি।
রাজর্ষি: স্যারের ফলের বাগান দেখেছেন?
দেবু: হ্যাঁ তো! উনি নিয়ে গিয়েছিলেন। উনি যখন পরীক্ষা নেবেন, যদি পাশ না করি, ওই ফলবাগানে পাতা কুড়ানো শাস্তি!
রাজর্ষি: হাঃ হাঃ! আপনি এখনও বড়ই ছেলেমানুষ!
দেবু: না। মোটেই না। আমরা ভুটানরাজার রাজত্বে গিয়ে হিসেব পরীক্ষা করে প্রশংসা পেয়েছি!
রাজর্ষি: অভিনন্দন! অ্যাম প্রাউড অফ ইউ!
দেবু: ধন্যবাদ। আচ্ছা, স্যারের বাগানে অত জবা গাছ, ফুল ফোটে না কেন? শীতকালে জবা কমই ফোটে, তবু বন্ধ তো হয়ে যায় না!
রাজর্ষি: ফুল ব্যবসায়ীরা কুঁড়ি নিয়ে যায়। ওঁর ফলফুলের ব্যবসাই মূল আয়। পড়িয়ে যা দক্ষিণা পান, তার দ্বিগুণ বই কিনে খরচ করেন।
দেবু: আর জয়নাথ ভ্যানওয়ালা? তাঁকে চেনেন?
রাজর্ষি: চিনি। কেন?
দেবু: তিনি নিজে সরস্বতীর মূর্তি গড়েছেন। সারেঙ্গি সাধনা করেন। তাঁকে নিয়ে কাগজে নিবন্ধ লেখা হয়েছে।
রাজর্ষি: নির্জন সরস্বতী। উনি ওই কথা সকলকে বলতে ভালবাসেন।
দেবু: আমার খুব অবাক লাগে জানেন, কলকাতার কাছেই, কত গুণী মানুষ সব! অর্থের লোভ নেই, খ্যাতির বাসনা নেই, দেখনদারি বিজ্ঞাপন নেই। মনে হয়, গ্রাম না দেখলে দেশ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা হয় না।
রাজর্ষি: গ্রাম দেখার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। গুণী, সরল মানুষের সন্ধানও মেলে। কিন্তু গ্রামে ঈর্ষা, ছিদ্রান্বেষ, স্বার্থবুদ্ধি, নির্মমতা এবং লোভের রাজনীতি, সমস্তই বিদ্যমান! ভাল-মন্দ দুই-ই শহরে যেমন আছে, গ্রামেও আছে।
দেবু: ঠিকই। আচ্ছা, আপনি জয়নাথের সরস্বতী মন্দিরে গিয়েছেন?
রাজর্ষি: না। অসীমচন্দ্র-মন্দিরই আমার সব।
দেবু: আমার দেখতে ইচ্ছে করে।
রাজর্ষি: দেখবেন তো।
দেবু: কী করে? স্যার ঠিক পাঁচটায় ছাড়েন। তখন ফেরার তাড়া।
রাজর্ষি: আমি নিয়ে যাব একদিন। যাবেন আমার সঙ্গে? আমার বাইকে চেপে?
দেবু: যাব। রাস্তাটা খুব সুন্দর। মসৃণ নয়। কিন্তু ক্ষেতের পাশ দিয়ে, ঘন বনের মতো ফলের বাগান, বাঁশের বাগানের পাশ দিয়ে রাস্তা, ভারী স্নিগ্ধ! স্যারের বাড়ি যেতে একটাই সমস্যা। ট্রেনটা।
রাজর্ষি: ভিড়? ময়লা?
দেবু: খুব ঘেন্না করে। আর খারাপ লোকে ভর্তি। সায়ন আর শুভায়ন আমাকে সারাক্ষণ ঘিরে থাকে। তবু আমি অভ্যস্ত হতে পারিনি!
রাজর্ষি: আপনি তো ড্রাইভিং জানেন। লাইসেন্স আছে?
দেবু: নিশ্চয়ই।
রাজর্ষি: শিগগির আপনার জন্য গাড়ি কিনব আমি। ওইভাবে, লোকাল ট্রেনে… ও আপনার জন্য নয়। কেমন গাড়ি পছন্দ আপনার?
দেবু: আপনি এত তাড়া করবেন না। গাড়ি তো আমার বাড়িতেও চারখানা!
রাজর্ষি: তাড়া তো করতেই হবে। আমি চাই যে, আপনার একটুও কষ্ট না হয়!
দেবু: আমার বাড়িতেও কেউ আমার কষ্ট চায় না রাজর্ষি। এ তো আমারই সিদ্ধান্ত যে, লোকাল ট্রেনে যাব।
রাজর্ষি: আমি গাড়ি কিনে রাখব। ব্যবহার করার জন্য জোর করব না!
রাজর্ষির কথা ভাবতে ভাবতে মাঝে-মাঝে মন উদাস হয়ে ওঠে তার। ভেতরে ব্যাকুলতা, ছটফটানি। কবে দেখা হবে? কথা হবে কবে?
ছোট ছোট ই-মেল করে রাজর্ষি। প্রায় রোজ দৈনন্দিন যাপন থেকে পাওয়া টুকরো অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি! ভিখিরি বালক দেখে দুঃখবোধ, বাইক নিয়ে সেই কোন দূরের গাঁয়ে নদীর পাড়ে সূর্যাস্ত দর্শন, অসাধারণ কোনও গবেষণাপত্র পাঠ– সবই তার ই-পত্রর বিষয়। খুব ছোট, কিন্তু যথাযথ। এমনভাবে লেখে, দেবু তার ছবি দেখতে পায়। যেন লেখা ও পড়ার মধ্যে দিয়ে দু’জনের দৃষ্টি মিলিত হচ্ছে। একজনের দেবনিন্দিত দুই চোখের আলোর তরঙ্গ এসে পড়ছে আর-একজনের শান্ত, নিবিড় দুই চক্ষে! পত্রবিনিময়ে সে লেখে না প্রায় কিছুই! শুধু ‘ভাল থাকবেন।’ কিংবা ‘সাবধানে বাইক চালাবেন।’ ‘উইন্ড চিটার ও হেলমেট পরতে ভুলবেন না।’ একদিন লিখল, ‘আজ মায়ের বারান্দা-বাগানে প্রথম জারবেরা ফুটল।’ এ তার লেখা দীর্ঘপত্র বলা চলে!
এক-একদিন ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন তার মনখারাপ করে। শানু তাকে উত্যক্ত করতে থাকে। বেশ হয়েছে! প্রেমপত্রের জন্য একেবারে হাঁ করে আছে! সত্যি দেবুদিদি! তুমিও প্রেমে পড়লে!
শেষপর্যন্ত, অনেক ভেবে সে স্থির করল, এপ্রিল বা মে মাসে বিয়েটা সেরে ফেলবে। মন সংহত করে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য অনেকটা সময় হাতে থাকবে তার। সিদ্ধান্ত নিতে পেরে তার ভাল লাগল। সে এখন অনেক নির্ভার, খুশিয়াল। নতুন সেই জীবন নিয়ে তার বিশেষ কোনও কল্পনা নেই। এখানে যেন সবাই দুর্বহ বিস্ময়ে তার দিকে চেয়ে আছে। সেই দৃষ্টিপাতের অবসান হোক! পাঠমগ্ন রাজর্ষি তার বাকি জীবনের সঙ্গী হোক! তার চোখ দুটি মনে পড়লে বুক শিরশির করে। সে নিজের ভাবনা অন্যদিকে বইয়ে দিতে চায়। অসীমচন্দ্রস্যার শুনে কতখানি বিস্মিত হবেন, বন্ধুরা কেমন অবাক হবে, ভাবলে তার হাসি পেয়ে যায়।
পাত্রের ছবি পছন্দ জানার পর থেকে, মায়ের মুখে আজকাল নরম ভাব দেখতে পাচ্ছে সে। কেমন রুক্ষ হয়ে যাচ্ছিল মা! কথায় কথায় বাবার সঙ্গে তর্ক বাঁধাচ্ছিল। হয়তো, বিয়ে বিষয়ে, মেয়ের সঙ্গে আরও বড় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল মনে-মনে। ওই অসহিষ্ণুতা তারই প্রকাশ।
কেবল জিতুদিদি সব শুনে পুরোপুরি খুশি হতে পারল না। বলল, “একেবারে রাজি হয়ে গেলি! প্রেমের শুরুয়াত এমনই বাঁধ না-মানা হয় অবশ্য।”
দেবু: সমস্যা কোথায়? কত পাত্র দেখব? কতজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করে বাজিয়ে দেখব?
জিতু: তুই অন্যায় কিছু করিসনি। ছেলেটিও ব্রিলিয়ান্ট। সুদর্শন। কিন্তু অসুখী শৈশব!
দেবু: অসুখী নয়। দুঃখী।
জিতু: দুঃখের আড়ালে কোনও অ-সুখ থাকতেও পারে দেবু। ওর কথাগুলো লক্ষ কর। বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন। ও বড় হয়ে বাবার ক্যান্সার বা চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র খুঁজেছিল। পায়নি। কেন খুঁজেছিল? ওর মনে কি সন্দেহ আছে, বাবার আদৌ ক্যান্সার হয়নি! মনে অবিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছে ছেলেটা। অসুখী শৈশব মনকে জটিল করে দেয়। তুই বলছিস বন্ধুবান্ধবও বেশি নেই!
দেবু: অমিশুক নয় কিন্তু। দ্যাখো, ওকে হঠাৎ করেই মিট করেছিলাম। দেখে, কথা বলে, ভাল লেগেছে। সুপ্রতিষ্ঠিত, মেধাবী। অজ্ঞাত যাকেই বিয়ে করি, তারও অসুখী শৈশব থাকতে পারে। অজানিত ঘটনার অসংখ্য সম্ভাবনা আমাদের ঘিরে সারাক্ষণ পাক খেয়ে চলেছে।
জিতু: ঠিক। যুক্তি অকাট্য। হয়তো ভালই হয়েছে। মনস্তত্ত্বের সূত্র মেনে সম্পর্ক গড়তে গেলে শেষপর্যন্ত তত্ত্বটাই পড়ে থাকবে। মন যাবে হারিয়ে! আসলে আমারই স্বভাব খারাপ হয়ে গিয়েছে। সবকিছুর চুলচেরা বিশ্লেষণ চাই।
দেবু: যেমন?
জিতু: যৌথ পরিবারের জ্যাঠামশাইয়ের অভিভাবকত্ব ছেড়ে অত কম বয়সে চলে এল কেন?
দেবু: সবার জ্যাঠামশাই আমার জেউয়ের মতো হবে, তার কোনও নিশ্চয়তা আছে?
জিতু: মায়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব কেন? বাবাকে হারিয়েছে। মাকে তো আঁকড়ে থাকার কথা!
দেবু: আঁকড়ে তো আছে। প্রত্যেকটি মানুষ আলাদা। দ্বন্দ্ব হতেই পারে।
জিতু: সন্ন্যাস নিতে চেয়েছিল কেন?
দেবু: আমি জিজ্ঞেস করিনি। নিজে থেকে যতটুকু বলেছে, তার বাইরে ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমরা প্রশ্ন করতে পারি কি?
জিতু: তুই রেগে উঠছিস। ভীষণরকম প্রেমে পড়েছিস রে তুই! দেবুমণি!
দেবু: বিয়ের সিদ্ধান্ত যে-কোনও সময় প্রত্যাহার করতে পারি আমি।
জিতু: একদম পাগলি! সে-ও তো তোর প্রেমে পড়েছে। এমন এক জমজমাট প্রেম, বিয়ে বাতিল করবি কেন? আমি নিজেই কি সমস্ত জেনে বিয়ে করতে পেরেছি? তবে কী জানিস, যে-কোনও বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর সবরকম মেডিক্যাল টেস্ট করিয়ে নেওয়া উচিত। যেগুলো যথাযথ না থাকলে ভবিষ্যতে সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়। যেমন থ্যালাসেমিয়া, এডস, যৌন সক্ষমতা– সব!
দেবুর মনে হল, জিতুদিদি জীবনটাকে মনস্তত্ত্বের সারণি সমূহে ফেলে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রায় গোয়েন্দার মতো সন্দিগ্ধ ও রহস্যভেদী মন! আবেগহীনভাবে বলল, “অসুখী শৈশব!” সহানুভূতি নেই, সমবেদনা নেই, নিশ্চল, কঠোর বিচার!
সে নিজেও কি এমন হয়ে যাবে একদিন? হিসেবের খতিয়ান দেখতে দেখতে জীবনের সম্পর্ক ও দেওয়া-নেওয়া লাভ-ক্ষতি, দায়-সম্পদ দিয়ে পরিমাপ করবে?
তার বুকের মধ্যে হু-হু করে উঠল। রাজর্ষি দাশগুপ্তর সমস্ত দুঃখ-বেদনার ইতিহাস জিতুদিদিকে বলে সে অন্যায় করেছে। তাদের দু’জনের মধ্যে যে-অনুচ্চারিত সত্যরক্ষা ও পারস্পরিক বিশ্বাসের অঙ্গীকার, তা লঙ্ঘন করেছে সে!
রাজর্ষির জন্য তার হৃদয় পুড়তে লাগল। মনে হল, এ জগতের যে-কোনও কষ্ট, আঘাত, অপমান থেকে সে চিরকাল রাজর্ষিকে আড়াল করে রাখবে। সে রাজর্ষিকে ভালবাসে। গভীর ভালবাসে।