যে রাজা সেই ঋষি
পার্ক স্ট্রিটে কার্লেকর ম্যানসনে তিনটে ঘর নিয়ে দেবাদৃতার অফিস। যাওয়ার পথে অরুণাংশু তাকে পোঁছে দিয়ে যান। ফেরার সময় দেবু সুবিধেমতো পথ বেছে নেয়।
এতকাল, সপ্তাহে বেশ কয়েকটি দিন তাকে অফিসের পর হাঁপাতে হাঁপাতে কোনও কোচিং ক্লাসে যেতে হত। এখন তার দৈনন্দিনতা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যাবে!
রোজকার অভ্যেস অনুযায়ী অরুণাংশু গাড়িতে বই পড়তে পড়তে চলেছেন। দেবু গভীর ভাবনায় ডুবে আছে। বাবার উপদেশ অনুসরণ করে সে আপাতত ফেব্রুয়ারির প্রথম দু’টি সপ্তাহের জন্য পড়ার ছুটি আবেদন করবে। তারপর? যদি চাকরি ছাড়তে হয়? সে আর শুভায়ন একই সঙ্গে ছুটি চাইবে, একই সঙ্গে কাজে ইস্তফা দেবে। ফার্ম কিছুকালের জন্য অসুবিধেয় পড়বে। কারণ, তারা দু’জনে যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়েছে এই ক’বছর!
ফার্মের প্রধান মুখার্জিস্যার তাদের স্নেহ করেন। প্রচুর ভরসা জোগান তিনি। দরাজ প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন, পাশ করলেই তোমাদের অংশীদার করে নেব। তিনি দেবাদৃতার জেউয়ের বন্ধু। তাই শুধু সে-ই এই স্নেহের অধিকারী হলে কিছুই বলার ছিল না। কিন্তু দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে শুভায়নও সমান গুরুত্ব পেয়েছে।
তার মধ্যে অস্বস্তি হচ্ছে। যেন একটা অন্যায় করতে যাচ্ছে সে। যেন মুখার্জিস্যারকে ঠকানো হবে এমন আকস্মিক ইস্তফায়। কথাটি সে সরাসরি বাবাকে বলল। অরুণাংশু বললেন, “তুই কী করতে চাইছিস?”
দেবু: আমার মনে হয় অসীমচন্দ্রস্যারের শর্তগুলো ওঁকে বলে দিই।
অরুণ: যদি শেষপর্যন্ত সুভাষগ্রামের পড়া চালিয়ে যেতে হয়, তখন তো বলতেই হবে। কিন্তু যদি অসীমবাবুর পড়ানো পছন্দ না হয়, তখন পুরনো ব্যবস্থাই বহাল থাকবে, নাকি মায়ের কথামতো ফার্ম ছেড়ে দেওয়াই সাব্যস্ত করবি, সেটা আগে ঠিক করে নে।
দেবু: মুখার্জিস্যার এত ভাল…
অরুণ: উনি খুবই ভালমানুষ। তবে তুই আর শুভায়ন কাজ ছেড়ে দিলে উনি অন্য কাউকে ঠিক তৈরি করে নেবেন। আবার খোলাখুলি কথা বলে নিলে একটি সুবিধে আছে। উনি চাইলে, নভেম্বরের পরীক্ষার পর আবার কাজের সুযোগ দিতে পারেন। তোর যুক্তিই ঠিক। খোলাখুলি কথা হওয়াই ভাল। আসল কথা হল, আগামী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। তার জন্য যে-ব্যবস্থা সর্বোত্তম, তাই করা উচিত। ফার্মের কাজের প্রতি মায়া সঙ্গত, কিন্তু তার জন্য প্রস্তুতির যেন কোনও ত্রুটি না হয়।
বেলা প্রায় তিনটে নাগাদ সে আর শুভায়ন মুখার্জিস্যারের সঙ্গে কথা বলার অবকাশ পেল। তাঁর বয়স প্রায় সত্তর। গৌরবর্ণ, দীর্ঘাঙ্গ, প্রাণবন্ত হাস্যময় মানুষ। রাগ হলে কড়ারকম বকুনি দেন। কিন্তু তারপরই আবার স্বাভাবিক।
তিনি প্রত্যেকটি কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন, “সুভাষগ্রামের অসীমচন্দ্র! চৌধুরী! জমিদার! আচ্ছা। দাঁড়াও। এই নামটা কার কাছে শুনলাম? ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে। দীপনারায়ণ! ওর ফার্মে একজন, কী নাম ছেলেটির, উমঙ্গ, উমঙ্গ আগরওয়াল, আমি তাকে দেখেছি, আরে সে উনিশবার ফেল করেছে!
দেবু: উনিশ বার!
শুভ: উনিশ!
মুখার্জি: একদম উনিশ! বেশিও না, কমও নয়। ওই যে সুকুমার রায়ের কবিতা? কী? উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে ঘায়েল হয়ে থামল শেষে! তবে এ থামেনি। কোত্থেকে সুভাষগ্রামের অসীমচন্দ্রের খবর পেয়ে, পড়ে, পাশ করে গেছে।
দেবু: পাশ!
শুভ: একবারে পাশ!
মুখার্জি: একেবারে! উনিশ প্লাস এক! দীপনারায়ণ এত খুশি, ছেলেটাকে পার্টনার করে নিয়েছে! ছেলে আর নেই সে। বিয়ে-টিয়ে করে বাপ হয়ে গেছে!
দেবু: দীপনারায়ণ কে স্যার?
মুখার্জি: তোমরা বোধ হয় দ্যাখোনি। আমার চেয়ে বয়সে ছোট। খুব বড় ফার্ম করেছে। সেও জমিদার বংশের ছেলে। বরিশাল না কুমিল্লার জমিদার ছিল। ও খুব খুশি, কারণ ও আগে অঙ্ক অনার্স পড়ত, তারপর ফেল করে সিএ পড়তে গেল। একেবারে টপ র্যাঙ্ক! আর তোমাদের অসীমচন্দ্রও আগে অঙ্ক পড়াতেন, এখন সিএ পড়াচ্ছেন! ভাল পড়ান নিশ্চয়ই। উমঙ্গ আগরওয়াল পাশ করেছে তো! শোনো তোমাদের এখন লক্ষ্য হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাশ করা। তার জন্য যদি কাজ ছেড়ে পড়তে চাও, নিশ্চয়ই পড়বে। পরীক্ষার পরে যদি আসতে ইচ্ছে করে আসবে। আমার দরজা খোলা। আর পাশ করে গেলে তোমাদের সামনে হাজার দুয়ার খুলে যাবে। আমাকে আর প্রয়োজন না-ও হতে পারে। তা, এ মাসটা আছ? আর তো ক’টা দিন!
শুভ: নিশ্চয়ই স্যার! আমি আর দেবু বেশি করে খেটে হাতের কাজ যতটা পারি তুলে দিয়ে যাব।
দেবু: আপাতত দু’সপ্তাহ স্যার। ভাল না লাগলে ফিরে আসব।
মুখার্জি: দ্যাখোই না কী হয়! দু’হপ্তায় কী বুঝবে? দীপনারায়ণের অফিসটা অনেক দূরে। কাছেপিঠে হলে বলতাম গিয়ে উমঙ্গের সঙ্গে একবার কথা বলে এসো!
দেবু: কোথায় অফিস স্যার?
মুখার্জি: বেহালা তারাতলা। বহুদূর। ও যেতে হবে না। আমি কাল ফোনে ধরিয়ে দেব এখন! কালই-বা কেন? দেখি, এখন যদি পাই!
মুখার্জি নম্বর লেখা ছোট নোট বই খুলে দেখতে লাগলেন। দেবাদৃতা টেবিলে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটছে। আর নাকের হিরেফুলের গয়না নাড়াচাড়া করছে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় সে নাসিকামল মন্থনে ব্যস্ত! সে জানে, ইনিই সেই দীপনারায়ণ। তার সিএ হওয়ার প্রথম প্রেরণা! এত বছর পর তাঁকে আর-একবার দেখতে পাওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। হল না। এমন নয় যে, দীপনারায়ণকে দেখার বিপুল বাসনা তার আছে। তবু যদি যেত, দেখত তিনি কোথায় বসেন। নিজের চেয়ারটিতে তাঁকে কেমন দেখায়! সহসা তার বোধ হল, নিজেকে সে যতখানি বাস্তববাদী ও যুক্তিনিষ্ঠ বলে মনে করে, যেভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করে, সে যেন ঠিক তেমনটি নয়। তার মধ্যে একজন আবেগপ্রবণ ও খেয়ালি মানুষ আছে! না হলে, সেই কোন প্রাক্- বয়ঃসন্ধিতে দেখা একজন সপ্রতিভ, দেবোপম পুরুষ, যিনি তার পিতৃবন্ধু, তাকে মুগ্ধ করেছিলেন, এত গভীরভাবে মুগ্ধ করেছিলেন যে, তাঁর পেশাটিই দেবু নিজস্ব পেশা হিসেবে গ্রহণ করে এবং অদ্যাবধি সেই লক্ষ্যে অবিচল!
সে আজও বুঝল না, দীপনারায়ণের কোন কোন দিক তাকে প্রভাবিত করেছিল! তাঁর রূপ? তাঁর প্রাণবান ঔজ্জ্বল্য? তাঁর পেশার ওজনদার ‘চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট’ শব্দগুলি? নাকি সব মিলিয়ে এক ব্যাখ্যাতীত আবেশ! তিনি যদি অঙ্কে পাশ করতেন এবং ওইদিন অঙ্কের অধ্যাপক হিসেবে আবির্ভূত হতেন, তা হলে কি সে অঙ্ক নিয়ে পড়তে চাইত? কেন তিনি অঙ্কবিদ হলেন না? তা হলে আজ দেবাদৃতা রায় হয়তো অঙ্কে মাস্টার্স করে গবেষক হয়ে যেত! আর তা হলে মাকে সে চূড়ান্ত আনন্দ দিতে পারত!
আফশোস?
সিএ সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকার মনে কি অনুতাপ, পরিতাপ, আফশোস?
না। কখনও নয়। সে হার মানবে না। সে সফল হবে। পূর্বাপর, নিরবচ্ছিন্ন ব্যর্থতা বা সফলতা বলে কিছু হয় না। এক জায়গায় যে ব্যর্থকাম, সে-ই অন্যত্র সফলকাম। দীপনারায়ণ নিজেও তাই!
মুখার্জিস্যার নম্বর খুঁজে পেলেন।
“এই দ্যাখো! ডি এন সিংহরায় লিখে দীপনারায়ণ খুঁজছি। দাঁড়াও।”
তিনি ফোনের বোতামে নম্বর তুলছেন। কুঁক কুঁক শব্দে পেজার বার্তা গ্রহণ করল! তিনি একঝলক দেখলেন। এই পুঁচকে যন্তরটি আজকাল অনেকেই ব্যবহার করে। কোমরে বেল্টে আটকে রাখে। যাদের খরচের পরোয়া নেই কিংবা সর্বক্ষণ যোগাযোগ প্রয়োজন, তারা মোবাইল কিনছে। মোবাইল ফোন। ওয়াকিটকির মতো দেখতে কতকটা।
পেজারে টুক টক করে একটু বর্ণ চেপে জবাব লিখে মুখার্জি বললেন, “বুড়ো বয়সে কত কী!” পুনরায় নম্বর তুলে রিসিভার কানে নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, “তোমরা তো কম্পিউটার অপারেটিং জানো, এক্সেলে কাজ করো, অসীমচন্দ্র না জানলে, পালটা ক্লাস নিয়ে নিয়ো!… হ্যালো, হ্যালো, দীপনারায়ণ প্লিজ়! আমি বীরেন মুখার্জি বলছি।”
ট্যাক্স, শেয়ার, সরকারের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, মিউচুয়াল ফান্ড বিষয়ে কথা বলে, কিছুক্ষণ, কোনও গোপন আলোচনায় একতরফা হুঁ, হাঁ, কারেক্ট, নো ওয়ে, অ্যাবসোলিউটলি– এইসব বলে, অবশেষে পেশ করলেন, “এই দীপ, তোমার ওই উমঙ্গ আগরওয়াল আছে? আরে, আমার ছেলে-মেয়ে দুটো, হ্যাঁ হ্যাঁ, আরে আমার অ্যাসেট, কোত্থেকে অসীমচন্দ্রের খবর পেয়েছে, সেই সুভাষগ্রামের। আমি বললাম লেগে পড়ো। তোমার উনিশ উমঙ্গের সঙ্গে একবার কথা বলিয়ে দিতাম।”
কিছুক্ষণ বিরতি। মুখার্জিস্যার রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে বললেন, “তোমরা থাকবে না, মনটা খারাপ লাগবে গো! আমার ছোট সংসার! … হ্যালো… হ্যাঁ, এক সেকেন্ড!”
উমঙ্গের সঙ্গে কে কথা বলবে? ভাবার সময় নেই। শুভায়ন উঠে ফোনের কাছাকাছি চলে গেল। রিসিভার নিয়ে বলল, “নমস্কার। আমি শুভায়ন।”
উমঙ্গ আগরওয়াল পরিষ্কার বাংলায় বলল, “বলুন স্যার।”
“স্যার, আপনি কি অসীমচন্দ্র চৌধুরী স্যারের ছাত্র ছিলেন?”
“নিশ্চয়ই। এখনও আছি। ওয়ান্স এ স্টুডেন্ট, ইজ় এ স্টুডেন্ট ফর এভার।”
“আমরা তিন বন্ধু তাঁর কাছে পড়ব ভাবছিলাম। তিনি অনেকগুলো শর্ত দিয়েছেন। আসলে…”
একটু বিরতি। অতঃপর সে বলল, “আমি কি একটু পরে ফোন করতে পারি? নম্বর বলুন প্লিজ়!”
শুভায়ন ফোন রেখে বলল, “আমরা আসি স্যার! এতখানি সময় দিলেন, এত কিছু করলেন, তার জন্য ধন্যবাদ।”
মুখার্জি বললেন, “শোনো, বোসো এখানে, আমার তো অনেক বয়স হল, অনেক ছেলেমেয়ে দেখলাম। কেউ-কেউ রয়েছে। বেশির ভাগই চলে গিয়েছে! কেউ পড়াটাই ছেড়ে দিয়েছে। আজকাল সবাই একসঙ্গে অনেক কিছু করে। চার্টার্ড পড়ছে, সঙ্গে পিএসসি, ইউপিএসসি, ব্যাঙ্কিং, কিছু বাদ দিচ্ছে না। সব পরীক্ষায় বসছে। কী করবে? চাকরি চাই। চাকরিই লক্ষ্য। ওভাবে সিএ হয় না। ডাক্তারি পড়তে পড়তে কি ব্যাঙ্কের কেরানিগিরির পরীক্ষায় বসা উচিত? না। লক্ষ্য স্থির রাখতে হয়। তোমরা লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওনি। তোমরা সফল হবে। বিচলিত হয়ে যেয়ো না। হতাশ হয়ে যেয়ো না। ওই উমঙ্গকে দেখো। উনিশবার হয়তো বাড়াবাড়ি। কিন্তু ওর আনুগত্য দেখো। তোমরা একটা সিএ ফার্মের কাজে দক্ষ হয়ে উঠেছ। তোমাদের ভুটানে পাঠিয়েছি, রাজা কত খুশি হয়ে আমাকে চিঠি লিখেছেন! কী নাম? জিগমে সিংঘে ওয়াংচুক!”
“ধন্যবাদ স্যার।”
“আমার দুই কন্যা। তারা কেউ এ পথে এল না। আমার বাবা এই ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমি আরও বড় করেছি। আমি না থাকলেও ফার্ম থাকবে। একটা সিএ ফার্ম কত বড়, তার মাপকাঠি এই নয় যে, তাতে কত লোক কাজ করে। তার মূল্যায়ন হয় কোন কোন কোম্পানির কাজ সেখানে হয়। কোন মাপের মানুষ ভরসা করে ব্যক্তিগত বিষয়-আশয়, করদানের সমস্ত তথ্য সেই ফার্মকে দেয়। তার জন্য আস্থা, সুনাম এবং বিশ্বাস অর্জন করতে হয়। আমাদের ফার্ম কাজে বড়। লোকে বলে বড় ফার্ম। সেই সুনামে তোমাদেরও অবদান আছে। ঠিক আছে? এসো তা হলে। উমঙ্গের সঙ্গে কথা বলো।”
দেবু: স্যার, আপনি এক্সেল ব্যবহারের কথা কেন বললেন? শুধুই রসিকতা, না আর কিছু!
মুখার্জি: রসিকতা। কিন্তু এটাও ঠিক, কাজের জায়গায় সফল হতে গেলে প্রগতিশীল হতে হয়। আমি ফার্মে কম্পিউটার এনেছি। চেষ্টা করছি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। শুনেছি, অ্যাকাউন্টেন্সির বিভিন্ন প্রোগ্রামিং বাজারে এসে গিয়েছে। সেসব তোমাদের শিখে ফেলা উচিত। হিসাবশাস্ত্রর সঙ্গে যা কিছু সম্পৃক্ত বুঝবে, শিখে নেবে। যে-কোনও বিষয়ের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। প্রোগ্রেস মেকস দি এক্সেলেন্স!
শুভ: মনখারাপ হয়ে যাচ্ছে স্যার!
দেবু: আমারও।
মুখার্জি: আরে, আমারও তো হচ্ছে! না হলে এত কথা বলি! মঙ্গল হোক! তোমাদের মঙ্গল হোক! অনেক বড় হও!
শুভ: স্যার, একটা কথা বলব?
মুখার্জি: নিশ্চয়ই।
শুভ: স্যার, আমরা তো শনিবারগুলোয় আসতে পারি। কিছু কাজ তো করতে পারি। একটা যোগাযোগ রইল তা হলে।
দেবু: খুব ভাল হয় স্যার।
মুখার্জি: কিন্তু তোমাদের স্যার চাকরি ছাড়তে বলেছেন। এ তো তাঁকে প্রতারণা করা হবে!
দেবু: কেন স্যার? আমরা পয়সা নেব না। এমনি আসব।
মুখার্জি: আরে, তাই কখনও হয় নাকি?
শুভ: তা ছাড়া স্যার, চাকরি না করার শর্ত হয়তো এ কারণে যে, তিনি প্রায় সারা দিন ব্যাপী পড়াবেন! শনি-রবিবার আমরা কোথায় যাচ্ছি, কী করছি, তা কেন তাঁর নির্দেশমতো হবে?
বীরেন মুখার্জি সশব্দে হেসে উঠলেন। বললেন, “তার চেয়ে তোমরা বরং ওঁকে সত্য বলো।”
দেবু: উনি যদি বারণ করেন?
মুখার্জি: সহজে হার মানবে না। যুক্তি দেবে। যিনি অঙ্ক ভালবাসেন, তাঁকে যুক্তিনিষ্ঠ হতেই হবে। তোমাদের কাছেও এটা রণকৌশল আয়ত্ত করার পথ। জীবনের সব জায়গায়, এমনকী ক্ষমতাশালী বড় ক্লায়েন্টের সঙ্গেও পেশাদারি মতবিরোধ হতে পারে। তখন ভদ্রভাবে, শান্তভাবে, নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করা শিখতে হবে। অডিট ফার্মের বড় জ্বালা! বোঝো না?
দেবু: নিশ্চয়ই স্যার। আমরা কথা বলব।
মুখার্জি: দু’জনে নয়। একজন বলবে। যদি এমন হয়, জয়লাভের জন্য আর-একজনের যুক্তি প্রয়োগ অনিবার্য, তখন বিনীতভাবে, অনুমতি চেয়ে, মতপ্রকাশ করবে। বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্, বিনয়ম্ দদতে জয়োজয়ঃ!
মুখার্জিস্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে তারা নিজেদের আসনে ফিরে এল। যে যার নিজের কাজে ডুবে গেল কোনও একসময়। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর উমঙ্গ আগরওয়ালের ফোন পেল শুভায়ন। দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে সে বলল, “হিন্দি মে এক কহাবত অব চল্ রহা হ্যায়! গলতি সে মিসটেক! এক ভুল আমাদের অন্য ভুলে নিয়ে যায়! আপসে মেরা বিন্তি হ্যায় কি অসীমস্যারকে পাস নেহি যানে কা ফয়সলা মত লিজিয়ে! গলতি সে মিসটেক হো জায়গা! হি ইজ় এ ম্যাথস টিচার। যব উনহোনে সিএ কোচিং কি সূচনা করনেকা সিদ্ধান্ত লিয়া, অউর মুঝে পতা চলা, আই বিকেম হিজ় ফার্স্ট সিএ স্টুডেন্ট!”
শুভ: কিয়া আপ কা উনসে পহচান থা। আপ জানতে থে উনহে?
উমঙ্গ: ইউ ক্যান স্পিক ইন বেঙ্গলি। বাংলায় আমার অসুবিধে নেই। অসীমচন্দ্রস্যার সম্পর্কে একটু একটু জানতাম। আমার ভাঞ্জে, কী বলে, মাই নেফিউ…
শুভ: ভাগনে।
উমঙ্গ: ইয়েস! ভাগনে! তো আমার ভাগনে হচ্ছে… তার ফলের আড়ত আছে বড়বাজারে। ওর সঙ্গে খুব জানাশোনা। উনি জমিনদার আছেন। বিশাল ফলের বাগান। আমার ভাগনের সঙ্গে ব্যবসা চলে। কিন্তু এমন পণ্ডিত আর ধার্মিক লোক খুব কম আছে! উনিশ বার সিএ ফেল হয়েছি স্যার! মনে হতো, মরে যাই। কোই উমিদ নেহি থি। উনি পড়াবেন শুনে মনে হল, হোয়াই ডোন্ট আই গিভ এ ট্রাই! সব তো দেখে নিয়েছি। মানুষ কী করে বলেন স্যার? যখন একশোটা ডাক্তার দেখিয়ে নিল, আর রোগটা সারল না, তখন তাবিজ-কবচ-জলপড়া-তেলপড়া সব ট্রাই করে! সাধু-সন্ন্যাসী-পির-ফকির সব একাকার হয়ে যায়! আমিও সেইরকম গিয়েছিলাম। অ্যান্ড আই হ্যাড অ্যান ইউনিক এক্সপিরিয়েন্স! আজ আমি সিএ তো বনেছি। ফিরে পেয়েছি আত্মবিশ্বাস! মাপ করবেন, আমি আপনার লম্বা সময় নিয়ে ফেললাম।
শুভ: আরে না। কী বলছেন! আপনি তো আমাদের সাহায্যই করছেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!
উমঙ্গ: উনি একটু অন্যরকম। লোকে বলে পাগলাস্যার। আমি শুনেছি, বাজারে রটেছে, উনি অঙ্কের ছাত্র পাচ্ছেন না তাই টাকার জন্য সিএ পড়াচ্ছেন। এটা ঠিক নয়। পাগলা লোক! কেন সিএ নিয়ে মেতে উঠেছেন, আমরা বুঝতে পারব না। বেশি ছাত্র ওঁর কোনওদিন নেই। কারণ, উনি প্রচার চান না। বিজ্ঞাপন করেন না। পাঁচ মাস, ডিসেম্বর টু মে, উনি আমাকে একা পড়িয়েছেন। ঠিক আছে। বেস্ট অফ লাক অ্যান্ড উইশ ইউ অ্যান এক্সেলেন্স!
ফোন রেখে শুভায়ন ভাষাহীন চোখে তাকিয়ে রইল দেবাদৃতার দিকে।
দেবু: কী হল?
শুভ: খুব উৎসাহ দিলেন।
দেবু: মুখার্জিস্যারকে বলে আয় কথা হয়েছে। তারপর চল বেরোই।
শুভ: আমাকে আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।
দেবু: কেন?
শুভ: মা বেরোবে। ঠাম্মাকে পাহারা দেব।
দেবু: যা যা। বুড়োদের সেবা করলে আশীর্বাদ পাবি।
শুভ: সেবা কিছু না। ঠাম্মা সারাক্ষণ বই পড়ে। দেখাশোনার আয়া আছে। তবু মা বলে একলা রাখা যাবে না। আয়ার উপর ভরসা নেই তো। তুই কী করবি? বাড়ি যাবি?
দেবু: বাড়ি তো যাবই। একবার অক্সফোর্ড বুক স্টোর হয়ে যাই। কাম্মা কয়েকটা বই আনতে দিয়েছে। তা ছাড়া বইয়ের সেল চলছে। দেখি যদি ভাল কিছু পাই!
শুভ: তুই তো সব আঁতেলমার্কা বই পড়িস! ফেমিনিজ়ম, ক্যাপিটালিজ়ম বনাম সোশ্যালিজ়ম, আরও কী সব!
দেবু: তুই কম আঁতেল? উমবের্তো একো, অমর্ত্য সেন, অম্লান দত্ত, অশোক মিত্র, ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি!
শুভ: পত্রিকাটা নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। পড়ার সময় কোথায়?
দেবু: সেটাই আসল। আমাদের কোনও কিছুর সময় নেই।
শুভ: তা হলে আর বই কিনছিস কেন?
দেবু: জমিয়ে রাখি। সময় পেলে পড়ব।
শুভ: বই কিনে জমিয়ে রাখা অ্যাসেট না লায়াবিলিটি?
দেবু: যে পড়ে তার অ্যাসেট। যে ধুলো ঝাড়ে তার লায়াবিলিটি। যে জোর করে পড়ে, মানে পড়তে বাধ্য হয়, তার কাছে পুরোটাই লায়াবিলিটি!
শুভ: বই পড়া হয়ে গেলে কি ডেপ্রিসিয়েশন হল?
দেবু: যদি বইটা আবার পড়ার দরকার হয় তবে একটু পুরনো হওয়ার দরুণ সামান্য অবমূল্যায়ন হবে। যদি কেজি দরে বেচে দেওয়ার বই হয় তো ধরতে হবে বইটা আপাতদৃষ্টিতে সম্পদ মনে হলেও আসলে আপদ। কারণ, তার ব্যবহারযোগ্যতা বা ফলপ্রদায়িনী ক্ষমতা শূন্য। সেটা শুধু তোর আর্থিক ক্ষতি, তাই নয়, তোর সময়ের অপব্যয়!
শুভ: অন্য কোনও উদাহরণ! ব্যবহারযোগ্যতা বা সম্ভাব্য ব্যবহারযোগ্যতাই কোনও বস্তুর অধিকার সম্পদ বা আপদ হিসেবে গণ্য করে!
দেবু: একটি সরকারি হাসপাতালে একটি অত্যাধুনিক যন্ত্র কেনা হয়েছে। তার নাম স্ক্যানার। কোটি টাকার জিনিস। সেটা পড়ে আছে, কারণ যন্ত্র ব্যবহার করার উপযুক্ত কর্মী নেই। ইউটিলিটি পোটেনশিয়াল বাট প্র্যাকটিক্যালি ইউটিলিটি জ়িরো!
শুভ: অনেক হয়েছে। চ’, বেরোই।
দেবু: দাঁড়া। বাথরুম থেকে আসি।
বুক স্টোরের দরজা ঠেলে নিরাপত্তা কর্মীর হেপাজতে নিজস্ব ব্যাগ বইখাতা জমা দিচ্ছিল একজন। শার্ট-ট্রাউজ়ার পরা। লম্বা। নির্মেদ কিন্তু সুন্দর অবয়ব। মাথার চুল খুব ছোট করে ছাঁটা!
তার ঠিক পেছনেই দেবাদৃতা ব্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কোনও একটি বই সঙ্গে থেকেই যায়। অনেকদিন হল, সলঝেনিৎসিনের ‘দ্য গুলাগ আর্কিপেলাগো’ বইটি সঙ্গে নিয়েছিল ফাঁকে ফাঁকে পড়ে ফেলবে বলে। মাত্র পঁচিশ পাতা হয়েছে। আর সব জরুরি বস্তুর মতো বইটিও রয়ে গিয়েছে!
লম্বা ছোট চুল যুবক টোকেন ও ওয়ালেট পকেটে পুরে সরে দাঁড়াল। দেবু বই হাতে অপেক্ষা করছিল। সে-ও টোকেন নিল। তার কাম্মার বইয়ের তালিকায় একবার চোখ বুলিয়ে সে দোতলার সিঁড়ির দিকে যেতে লাগল।
এই দোকানে তারা এত আসে যে, সব চেনা হয়ে গিয়েছে। কর্মীরাও তাদের চেনে। যেমন চেনে অলি পাবের ওয়েটাররা। সে লক্ষও করছিল না, এক দীর্ঘকায় শ্যামল যুবক তার কাছাকাছি থাকছে।
সে যখন বন্ধুদের সঙ্গে থাকে না, একা, তখন এমন আশপাশে ঘোরা লোকের উপদ্রব থেকেই যায়!
খুঁজে খুঁজে কাম্মার বইগুলো সংগ্রহ করে সে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল স্বল্পমূল্যে বিকনোর জন্য সাজিয়ে রাখা বই দেখবে বলে। এক গাঢ় স্বর সে শুনতে পেল। তাকে ডাকছে। খুব নিচু স্বরে, প্রায় ফিসফিস করে, কিন্তু এই স্বর তার পরিচিত। তার পূর্বশ্রুত।
সে ফিরে তাকাল। কয়েক পল! আপাদমস্তক কেঁপে গেল তার। ঝলক দিল বুকে। কানের লতিকাদ্বয়ে আগুন জ্বলার অনুভূতি, সে বলতে চাইল, “আপনি!” কিন্তু ঠোঁট নড়ল কেবল। স্বর ফুটল না।
যুবকটি বলল, “সরি! হঠাৎ ডাকলাম!”
দেবাদৃতা খানিকটা সামলে নিয়েছে। বলল, “না! আসলে প্রথমে চিনতে পারিনি!”
“স্বাভাবিক! চলুন, নামি!”
নীচে পৌঁছে রাজর্ষি জিজ্ঞেস করল, “আপনার বই নেওয়া হয়ে গিয়েছে?”
“না। আমি ওই ফর্টি পার্সেন্ট ছাড় দেওয়া বইগুলো দেখব।”
“আমি বিলিং কাউন্টারে যাচ্ছি। আপনার বই কেনা হলে কোথাও বসে একটু কফি খেতে পারি?”
“কফি? ঠিক আছে।”
“আপনার সঙ্গে কেউ আছেন? তাঁকেও বলব তা হলে।”
“না।”
“ঠিক আছে। আপনি আসুন।”
বইয়ের দুনিয়ায় মগ্ন হয়ে গিয়েছিল দেবাদৃতা। সেই একাগ্র ভুবন এখন হঠাৎ ঝড় লাগা দেবদারু শাখার মতো এলোমেলো! সে নিজেকে প্রাণপণে সংহত করতে লাগল। তবু কিছুতে বইয়ের সম্ভারে মন লাগাতে পারল না। অ্যারিস্টটলের সৌন্দর্য-তত্ত্ব এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র নিয়ে আলোচনামূলক দু’খানি বই তুলে নিল। এই ধরনের জটিল ও প্রাচীন তত্ত্বের বই বাংলায় পড়াই সুবিধেজনক। কিন্তু এই মুহূর্তে সে অধীর ও বিস্ময়াহত! অজস্র জিজ্ঞাসা মনে আসছে! পাগলাস্যারের বাড়িতে রাজর্ষি দাশগুপ্তর উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে সমাপতন। কিন্তু আজকের সাক্ষাৎ?
বিগত কয়েকটি বছর সে বহু সংস্থায় অডিট করেছে। সে অতি তরুণ বলেই সময়োপযোগী গাম্ভীর্য ও মুখের কাঠিন্য বজায় রাখা আয়ত্ত করেছে। এ সবই তার আত্মরক্ষার অস্ত্র। তার নিরাপত্তা। সে পছন্দমতো সঙ্গী পেলে মন খুলে কথা বলে। কিন্তু অধিক সময় স্বল্পভাষী। অতীব সতর্ক এবং সপ্রতিভ। রাজর্ষির দর্শনে এতটুকু আবেগ যাতে প্রকাশ না পায়, তার জন্য প্রস্তুত হয়ে সে দাম দেওয়ার জায়গায় পৌঁছল। বইগুলো রেখে রাজর্ষি দাশগুপ্তকে খুঁজতে লাগল। দেখে চমকে গেল একেবারে! দোকানের কোণে, একটি বই কোলে নিয়ে মেঝেয় বসে পড়ছে রাজর্ষি। লোকে, বই দেখতে দেখতে, তার প্রায় গায়ে পা লাগিয়ে দাঁড়াচ্ছে, হুঁশ নেই। অদ্ভূত! ওখানে ওভাবে বসতে হয়!
চৌম্বকশক্তি প্রত্যাহার করে নিলে আলপিনের গুচ্ছ যেমন ঝুরঝুর করে পড়ে যায়, তেমনই, রাজর্ষির এই বালকোচিত সারল্যে, দেবাদৃতার সমস্ত কঠিন রেখাগুলি গাল থেকে, ঠোঁট থেকে, চোখ থেকে খসে পড়তে লাগল।
বিল মিটিয়ে, টোকেনের বিনিময়ে জমা রাখা বই সংগ্রহ করে সে নিরাপত্তাকর্মীকে বলল– ওঁকে ডেকে দিন তো!
“ওই ওঁকে? মাটিতে বসে পড়ছেন?” তিনি হাসলেন, “সবসময় ওইরকম করেন।”
নিরাপত্তা কর্মীর ডাকে চমকে উঠল রাজর্ষি। দেবুকে দেখে বলল, “আরে! আপনার হয়ে গেছে? এক মিনিট। এই বইটা বিল করিয়ে নিই।”
বাইরে জনবহুল পার্ক স্ট্রিট। সন্ধের আলোয় ঝলমল করছে। শীতের সময় পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে উৎসবমুখরতা থাকে। পঁচিশে ডিসেম্বরের পর পয়লা জানুয়ারি, পরপর দু’টি পর্বে পার্ক স্ট্রিটের আলোকসজ্জা প্রায় পুরো জানুয়ারি মাস জুড়ে থেকে যায়।
রাস্তায় গাড়ি ছুটছে। এখন গৃহে ফেরার সময়। আবার বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও ব্যক্তিগত সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষারও সময়। লোকে এখন রেস্তরাঁ, পাব, ক্লাব অথবা কোনও গৃহস্থের বৈঠকখানায় আড্ডা জমাবে!
রাজর্ষি আর দেবাদৃতা মুখোমুখি দাঁড়াল। চুল-দাড়ি কেটে রাজর্ষিকে একেবারে অন্যরকম লাগছে! নতুন মানুষ! গোঁফ রেখেছে মোটা করে। চোখ দু’টি ছাড়া, বাকি মুখের অংশ থেকে নরম মায়াবী ভাবটি চলে গিয়ে তাকে অনেকটা দক্ষিণ ভারতীয় কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের মতো লাগছে। এই রাজর্ষির ছবি দেখে শানু কখনও বলবে না, যিশুর মুখে কালো রঙের পোচ! দেবুর মনে হল, লম্বা চুল ও বড় বড় দাড়িসমেত রাজর্ষি দাশগুপ্ত অনেক বেশি সুন্দর!
রাজর্ষি বলল, “কোথায় বসা যায়? পিটার ক্যাট যাবেন?”
“ওখানে আমার ভাল লাগে না।”
“ফ্লুরিজ়? কিংবা রাসেল স্ট্রিটে একটা চিনে রেস্তরাঁ আছে, সেখানেও যেতে পারি। রাসেল স্ট্রিট? চেনেন?”
“চিনি। চলুন ফ্লুরিজ়েই যাই। আপনি তো কফি খাবেন।”
“কিছু একটা খেলেই হল। আপনার বইয়ের প্যাকেটটা আমায় দিন।”
“আমি নিতে পারব। তা ছাড়া আপনার ব্যাগ বেশ ভারী। বই ভর্তি তো।”
“রাস্তা পার হয়ে নিন। তারপর প্যাকেট ফিরিয়ে দেব। আপনার প্যাকেট আপনিই বইবেন।”
দু’জনেই অল্প হাসল। দেবু নিজের বইয়ের বোঝা রাজর্ষিকে দিয়ে দিল। সে বুঝতে পারছে না, রাজর্ষি অসীমচন্দ্রস্যারের বাড়ির পরিচয়টুকুই এগিয়ে নিয়ে চলেছে, নাকি তার মতো রাজর্ষিও জানে দেবাদৃতা রায় কে! সে-ও কি ছবি দেখেছে?
রাস্তা পেরিয়ে, কথামতো, বইয়ের থলেটি ফিরিয়ে দিল রাজর্ষি। দু’জনে ফ্লুরিজ়ে ঢুকল।
বসেছে মুখোমুখি। হাসল আরও একবার। সংকুচিত, অপ্রতিভ হাসি! দু’জনেই ভাবছে, কী দিয়ে কথা শুরু করা যায়! দেবুই প্রথম প্রশ্ন করল, “অক্সফোর্ড বুক স্টোরে প্রায়ই আসেন?”
রাজর্ষি: মাসে দু’-তিনবার। বইয়ের দোকানে আসতে ভাল লাগে। এখানে বই হাতে নিয়ে দেখা যায়!
দেবু: ঠিক।
রাজর্ষি: আপনিও প্রায়ই আসেন?
দেবু: হ্যাঁ। আমার অফিস এ পাড়ায়।
রাজর্ষি: ওঃ! তাই! কোথায়?
দেবু: কাছেই। কার্লেকর ম্যানসনে।
দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। দেবু ভাবছিল, রাজর্ষি এখনই আরও অনেকের মতো বলতে শুরু করবে, কার্লেকর ম্যানসন খুব খারাপ জায়গা। বেআইনি কাজকর্ম হয়। ভীষণ দুর্নাম! যেন দুর্নাম, সারা কলকাতায়, কেবল কার্লেকর ম্যানসন নিয়েই। যেন দুর্নীতি ও কুকর্মের আখড়া আর কোথাও নেই! দুর্নাম লেগে যাওয়া কোনও জায়গায় তোমার গতায়াত আছে মানে তুমিও তার ভাগীদার!
যারা এসব বলে, জানেই না, এই বিশাল বাড়িটিতে কত ছোট-বড় অফিস, কত গৃহস্থ, ভদ্র-সজ্জন মানুষের বাস!
সে যেমন আশঙ্কা করছিল, তেমন কিছুই হল না। রাজর্ষি বলল, “তা হলে তো খুবই ভাল। যখন-তখন বুক স্টোরে এসে বই পড়া যায়।”
দেবু: সেরকম হয় না। কাজ করতে হয় তো। তা ছাড়া আমাদের চার্টার্ড ফার্ম। অডিট করার জন্য প্রায়ই নানা জায়গায় যেতে হয়!
রাজর্ষি: স্যারের কাছে গিয়েছিলেন, কী ঠিক হল?
দেবু: আমরা তিনজন পড়ব ঠিক করেছি। শুভায়ন, সায়ন, আমি।
রাজর্ষি: উনি অসামান্য শিক্ষক! কোনও তুলনাই নেই। আমি ওঁর কাছে এগারো ক্লাস থেকে অঙ্ক করছি।
দেবু: আপনি কি কোনও বই পড়া শুরু করলে শেষ না করে থাকতে পারেন না?
রাজর্ষি: একেবারে ঠিক। কী করে বুঝলেন?
দেবু: স্যারের বাড়িতে দেখলাম। আজও।
রাজর্ষি: পড়াই আমার সব। আমার বন্ধু।
ওয়েটার এসে দাঁড়াল। খাবারের নাম লিখে নেবে। তারা টেবিলের খাদ্যতালিকা এখনও দেখেনি। রাজর্ষি বলল, “আপনি পাঁচ মিনিট পরে আসুন প্লিজ়।”
দেবু বলল, “আমার হট চকোলেট উইথ মিল্ক অ্যান্ড ক্রিম।”
রাজর্ষি: আমারও তাই। আপনার খিদে পায়নি? আমার বেশ পেয়েছে।
দেবু: এগ-মাস্টার্ড স্যান্ডউইচ!
রাজর্ষি: ডিমে আমার অ্যালার্জি।
দেবু: তা হলে চিকেন মেয়োনিজ়।
রাজর্ষি: আমারও। আমি খাওয়াব। কেমন?
দেবু: আমি রোজগার করি।
রাজর্ষি: আমি আপনাকে ডাকলাম যে! দেখুন, আমার আচরণ যথাযথ হচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না। কোনও ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন।
দেবু: এখনও পর্যন্ত হয়নি।
রাজর্ষি: আমার মেয়ে বন্ধু নেই। কখনও ছিল না। তাই। আগে তো কথা বলতেও লজ্জা করত।
দেবু: কত আগে?
রাজর্ষি: ইউনিভার্সিটি আসার আগে পর্যন্ত।
দেবু: মেয়েদের ‘মেয়ে’ বলে দেখেন কেন? ‘মানুষ’ বা ‘ব্যক্তি’ ভাবতে পারেন না?
রাজর্ষি: এখন ভাবি। ছাত্র বা ছাত্রী সবাই সমান। কাউকে আলাদা মনে হয় না। অন্য অধ্যাপিকা যাঁরা আছেন, কথা বলি তো।
দেবু: আপনি তো বাইক চালাতে ভালবাসেন।
রাজর্ষি: আপনার ভাল লাগে না?
দেবু: জানি না। আমি বাইক চালাইনি। আমাদের বাড়িতে সবার চার চাকা। আমার ভাই শানু একটা ইয়াজদি কিনতে চায়। জেম্মা অনুমতি দিচ্ছেন না। দুর্ঘটনার ভয়। শানু আমাকে স্কুটার কিনতে বলে। গাড়ি চালাতে পারি। স্কুটার পারি না। আসলে স্কুটারের কথা আমি ভেবেই দেখিনি। আমি চাইলেও জেম্মা রাজি হত কি না সন্দেহ। জেম্মা, মানে আমার জেঠিমা, ডাক্তার। আমরা যৌথ পরিবার।
রাজর্ষি: আমিও, মানে টুয়েলভ পর্যন্ত যৌথ পরিবারে ছিলাম। তারপর আলাদা। আমি আর মা। আপনি কখনও বাইক চাপেননি?
দেবু: খুব কম। আমাদের এক বন্ধু, দীপংকর, ইয়ামহা চালায়। ওর বাইকে উঠেছি!
রাজর্ষি: সেদিন যাঁরা ছিলেন ওঁরা সবাই আপনার বন্ধু?
দেবু: হ্যাঁ!
রাজর্ষি: সবাই এক জায়গায় চাকরি করেন?
দেবু: না। শুধু আমি আর শুভায়ন। তবে এই অঞ্চলটি আমাদের সবার প্রিয়। দুঃখ হলেও আমরা এখানে বসি। কারও জন্মদিন হলেও এখানে।
রাজর্ষি: এখানে? ফ্লুরিজ়ে?
দেবু: না। অলি পাব। আমাদের প্রিয় জায়গা।
রাজর্ষি: নিয়মিত পাবে যান?
দেবু: না। মাঝে-মাঝে। মাসে এক-দু’বার হয়েই যায়। বাড়িতে জানে না।
তারা স্যান্ডউইচে কামড় দিল। হাসল। দেবু একবার ঘড়ি দেখল। এখনও অনেক জিজ্ঞাসার উত্তর সে পায়নি।
রাজর্ষি: দেরি হয়ে যাচ্ছে?
দেবু: না। দেরি কিসের?
রাজর্ষি: আপনি কী জাতীয় পানীয় পছন্দ করেন?
দেবু: চা, হট চকোলেট, বিয়ার, হুইস্কি, ভদকা। ভদকাই বেশি নিতে হয়। গন্ধ থাকে না। আপনি কী পছন্দ করেন?
রাজর্ষি: বিয়ার খারাপ লাগে না। নেশা বিষয়ে আমার সেরকম আগ্রহ নেই।
দেবু: আমরা যে প্রায় আসক্ত, এমন নয়!
রাজর্ষি: আমি তা ভাবিনি।
দেবু: ধন্যবাদ।
রাজর্ষি: দেখুন, আমি বেশি ভান করতে পারি না।
দেবু: করার দরকার কী!
রাজর্ষি: আজ আপনার সঙ্গে দেখা হবে, ভাবতেও পারিনি। অনেকটা সময় আপনার পাশে পাশে ছিলাম। ভাবছিলাম, আপনাকে ডাকব কি না।
দেবু: ঠিকই তো আছে।
রাজর্ষি: আসলে, আসলে, সেদিন স্যারের বাড়িতে আমি আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম। নাম জানতাম না।
দেবু: ছবি দেখেই!
রাজর্ষি: তিনটে ছবি দেখেছিলাম। খুব যে মন দিয়ে দেখেছি, তা নয়। কিন্তু আমি সহজে কিছু ভুলি না যে। মা ছবিগুলো দিল। দেখলাম। প্রথমে আপনাকে দেখে মনে হল, কোথায় দেখেছি, চেনা-চেনা! একটু ভাবতেই মনে পড়ল।
দেবু: আমি কাল দেখলাম।
রাজর্ষি: আমার ছবি?
দেবু: হুঁ! আপনার আজকের মুখের সঙ্গে অল্পই মিল।
রাজর্ষি: আজই সকালে কাটিয়ে এলাম।
আবার নীরবতা। অস্বস্তিকর প্রসঙ্গটি দু’জনেই এড়িয়ে যেতে চাইছে। রাজর্ষি আবার কথা শুরু করল।
রাজর্ষি: আপনি তো সিএ হয়ে যাবেন। তারপর?
দেবু: আপনি জানেন না, আমি পাঁচবারেও পাশ করতে পারিনি।
রাজর্ষি: সিএ পাশ করা শক্ত। তবে এবার নিশ্চয়ই ভাল ফল হবে।
দেবু: আমার কাম্মা, মানে কাকিমা, ফিজ়িক্স পড়ান। তিনি আপনার খুব প্রশংসা করেন। আপনার পেপার– মানে গবেষণাপত্র কিছু তিনি পড়েছেন।
রাজর্ষি: কী করে?
দেবু: আমি জানতে চাইনি।
রাজর্ষি: উনি কোথায় পড়ান?
দেবু: লেডি বল্ডউইন কলেজে।
রাজর্ষি: ভাল কলেজ বা ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে নানারকম জার্নাল রাখে। আমার কাজ খুবই সামান্য। উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।
দেবু: আমি ফিজ়িক্স বুঝি না। কাম্মা বোঝে।
রাজর্ষি: স্যারের কাছে কবে পড়তে যাবেন!
দেবু অসীমচন্দ্রের শর্তাবলির বিবরণ দিল। তারা যে শনিবারগুলোয় ফার্মের কাজ জারি রাখতে চায়, সে কথাও বলল। রাজর্ষি বলল, “আপনি আপনার কাজটা ভালবাসেন।”
দেবু: নিশ্চয়ই। আপনি ভালবাসেন না?
রাজর্ষি: খুব। ছোটবেলা থেকেই বই আমার প্রিয় সঙ্গী। এখন অবশ্য বাইক আছে। মা বলে আমি খুব আত্মকেন্দ্রিক। একলষেঁড়ে।
দেবু: একলষেঁড়ে! একা একা থাকতে পছন্দ করেন?
রাজর্ষি: ষাঁড় দেখেন না? একলা ঘুরেফিরে বেড়ায়? সঙ্গীর বিষয়ে আমি খুবই খুঁতখুঁতে!
দেবু: ধর্মের ষাঁড়?
রাজর্ষি: আপনি ধর্ম, ঈশ্বর, স্বর্গ– এসব মানেন?
দেবু: আমার বিশেষ ভক্তি নেই। এসব নিয়ে ভাবিনি।
রাজর্ষি: শনিবারগুলোয়, যদি আপনি আসেন, মাঝে মাঝে কি আমাদের দেখা হতে পারে?
দেবু: হতে পারে। কিন্তু কেন?
রাজর্ষি: ছবি দেখে, কোনও ছবি দেখেই, আমার কোনও অনুভূতি হয়নি। কিন্তু সেদিন স্যারের বাড়িতে আপনাকে দেখার পর আমার মধ্যে কিছু একটা হয়েছে! ব্যাখ্যাতীত কিছু। আপনাকে আমি সচেতনভাবে বা অসতর্ক মুহূর্তেও ভেবেছি। এমন আমার আগে কখনও হয়নি। আজকের এই হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার মধ্যে, কথার মধ্যে, আমি খুব আনন্দ পাচ্ছি! আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না। আমি কিন্তু সত্যি আত্মকেন্দ্রিক নই। যদি আপনার একটুও ভাল লাগে, তবেই।
দেবু: আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা আপনি কাউকে বলেছেন?
রাজর্ষি: এখনও বলিনি।
দেবু: আমিও বলিনি। আজও বলব না।
রাজর্ষি: আমিও না বলা সাব্যস্ত করেছি। আপনি বলেননি কেন?
দেবু: ঠিক জানি না। সব কথা বলা জরুরিও নয়। তবে জিতুদিদিকে বলব। আমার দিদি। অপরাজিতা। মনের ডাক্তার। আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। শানুকেও বলব। আসলে শানু আর জিতুদিদি– দু’জনেই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।
রাজর্ষি: আপনি ভাগ্যবান। আমার সবচেয়ে নিকটতম বলয় এখনও শূন্য।
দেবু: ও! চলুন, এবার উঠি।
রাজর্ষি: নিশ্চয়ই। আপনার কোনও ব্যক্তিগত নম্বর, পেজার?
দেবু: না। অফিসে ফোন আছে, বাড়িতেও আছে। পেজার নেই। ই-মেল আইডি আছে।
রাজর্ষি: লিখে নিই? আমার নম্বরও রেখে দিন। যদি প্রয়োজন হয়। আমি ই-মেল করব আপনাকে?
দেবু: ঠিক আছে। আপনার পেজার আছে?
রাজর্ষি: না। জিনিসটা আমার পছন্দ হয়নি। বরং সেলফোন একটা কিনব কি না ভাবছি।