নিহিত প্রস্তাব
পরিবারে সকলেই আজ একত্রিত। এমন সম্মেলন বিরল নয়। মাসে এক-দু’বার ঘটেই যায়। আড্ডা বসে যখন-তখন। সৌভ্রাতৃত্বে কোথাও কম পড়েনি। ভাইয়েরা বন্ধু, ভাইয়ের স্ত্রী-রাও বন্ধু।
আলাপ-আলোচনা সাম্প্রতিক রাজনীতি, করব্যবস্থা, গাড়ির দাম, রাস্তাঘাট, নোবেল-বুকার-পুলিটজ়ার পুরস্কার, রবীন্দ্রসংগীত পরবর্তী প্রজন্ম শুনবে কি না পেরিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় থামল। এবং অবধারিতভাবে, দেবাদৃতার পরীক্ষার ফলাফল এসে পড়ল।
“এটা কী করে সম্ভব?” জেউ, যিনি এখন পরিবারে সর্বজ্যেষ্ঠ, বললেন, “আমাদের দেবু তো মেধাবী ছাত্রী! এটা কী করে হয়?”
জেম্মা: সিএ পড়তে গেলে এই এক হ্যাপা। পাশ-ফেল সব পড়াতেই আছে। কিন্তু এমন বারংবার হয় না।
কাকুন: একবারে সিএ পাশ করেছে, এমন আমি দেখেছি!
বাবা: দশ হাজারে একজন!
কাম্মা: সে বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়া!
কাকুন: আমি তা মানি না। তারা সাফল্য করায়ত্ত করেছে। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে বললে তার অবমাননা হয়। তারা এমনই নির্ভুল উত্তর লিখেছে যে, ফেল করানোই যায়নি। কেউ কেউ থাকে, যে কাজ সে করে, তার জন্যই তৈরি মনে হয়। আমাদের ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ছিল জীবনকাকু, মনে আছে তোমাদের? ইঞ্জিনিয়ারের মতো জ্ঞান। যে-কোনও যন্ত্র সারানোর ক্ষমতা রাখত! রেডিয়ো, ফ্রিজ, যা দেবে! আমি জীবনকাকুর বাড়ি যেতাম। সারা ঘরে যন্ত্রপাতি, তার, কলকব্জা! একদিন দেখি, গ্যারেজের রমাইদা জীবনকাকুকে ডাকছে। কাকু নাকি গাড়ির মেকানিজ়ম দারুণ বুঝত।
বাবা: জীবনকাকু অশিক্ষিত ছিল না কিন্তু। প্রত্যেকটা যন্ত্রের ম্যানুয়াল পড়ত। আমার কাছ থেকে কিছু বইপত্রও নিয়েছিল। কিছুদিন পরে বলল, অঙ্কটা যে একেবারেই জানি না, বুঝলে। তত্ত্বগতভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বুঝতে গেলে অঙ্ক জানতে হয়। এখানেই মেকানিক আর ইঞ্জিনিয়ারের পার্থক্য। আমি যন্ত্রপাতি জানি, বুঝি না। ব্যাপারটা অনেকটা ওষুধের দোকানির মতো। কোন অসুখে কী ওষুধ লাগে জানে। কিন্তু কেন, কখন, কীভাবে এবং কোন মাত্রায় দিতে হয় জানে না।
জেউ: জীবনকাকু খুবই বুদ্ধি রাখত। বিশেষত যন্ত্রপাতির ব্যাপারে। যন্ত্রের জন্যই তৈরি যেন।
কাকুন: সেটাই আমি বলতে চাইছি। এক-একজন থাকে যারা ওই কাজ করার জন্যই জন্মায়। বিশেষ দক্ষতার অধিকারী। আমাদের জিতু, ও সাইকায়াট্রি চর্চা করার জন্যই জন্মেছে। নিখুঁত অঙ্কের মতো মনোবিশ্লেষণ। ওর গবেষণাপত্রগুলো পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। মনোরোগ আসলে আর-পাঁচটা শরীরজনিত অসুখের মতোই একটা, এটা বুঝতে ওগুলো সাহায্য করেছে।
কাম্মা: তোমার উদাহরণটা কেমন হল জানো? ক্যালকুলাস শেখার পর তুমি যেন বুঝলে পাটিগণিত কাকে বলে! জিতুর গবেষণাপত্র আমিও পড়ি। এবং অনেকটাই বুঝতে পারি না কারণ, সাইকায়াট্রি বিষয়ে বা মেডিক্যাল সায়েন্স বিষয়ে আমাদের তাত্ত্বিক জ্ঞান নেই। তবে, এ ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে একমত, সাইকায়াট্রি ওর সঠিক নির্বাচন।
কাকুন: সঠিক নির্বাচন। এটাই আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য। তুলনার মধ্যে যুক্তির অভাব থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও মনোরোগ একটা বিশাল সংস্কার। আমারও ছিল। সেটা জিতুর প্রবন্ধ পড়ে কেটেছে। আমি বুঝেছি, মনের অসুখ সারানো সম্ভব। এবং অনেক অসুখই স্নায়বিক। মানসিক ও স্নায়বিক অসুখ পৃথক করতে পারে ক’জন? মনোবিকারও পাগলামি, স্নায়ুজনিত বৈকল্যকেও বলে পাগলামি। অবশ্য আজকাল পাগল হলে শেকল বেঁধে রাখে না। ডাক্তার দেখায় লুকিয়ে-চুরিয়ে।
কিছুক্ষণের নীরবতা। দেবুর কাকুন স্পষ্টভাষী। আগে সেই স্পষ্টতা ছিল তীক্ষ্ণ ও প্রত্যক্ষ। এখন বয়স ও অভিজ্ঞতা তাকে পরিশীলিত করেছে। প্রসঙ্গের অবতারণা করে যে মূল কথাটি বলতে হয়, সেই শৈলী করায়ত্ত।
জিতু বলল, “তুমি বলতে চাইছ, দেবুর সিএ পড়তে চাওয়া ঠিক হয়নি।”
কাকুন: আমি তাই মনে করছি।
শানু: বাবা, তা হলে দেবুদিদির বন্ধুরা, সায়নদা-রূপমদা ওরাও ভুল। আজ পর্যন্ত যতজন সাত-দশবার ডিগবাজি খেয়েছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত পাশ করে টাই লাগিয়ে অফিস যাচ্ছে, তারাও ভুল ছিল। তোমার বক্তব্য সঠিক হলে সারা দেশে কুড়িজনের বেশি সিএ থাকার কথা নয়। সিএ তো নয়, যেন চিফ মিনিস্টার! সিএ পরীক্ষায় পাশ-ফেল নিয়ে অত সরল অঙ্ক কষা যায় না বাবা।
কাকুন: তা জটিল অঙ্কটা তুই কষে দেখা!
শানু: অঙ্কটা হল, ইনস্টিটিউট ছাত্রদের পাশ করাতে চায় না। সিএ যারা পড়তে যায়, তাদের একটা মাপ আছে। আমাদের মতো পরীক্ষা দিয়ে ঢোকে। সবাই কি আর ভোদাই নাকি বাবা?
ছোট কাম্মা: ছি শানু! ও কী ভাষা!
জেউ: ভাষা অনুমোদন করা হল। ওরা এ ভাষাতেই তো কথা বলবে। সেটাই স্বাভাবিক!
পার: তাই বলে বয়োজ্যেষ্ঠর সামনে?
অরুণ: এটাই তো তোমাদের ভুল। শানুর একুশ হয়ে গেল। ও এখন প্রাপ্তবয়স্ক। আমাদের স্বাধীন বন্ধু। ওকে যদি বুঝতে চাও, ওর ভাষাও বুঝতে হবে। এই শব্দটা ও ব্যবহার করল কারণ, ওর বাবার অনুসিদ্ধান্ত ও মানতে পারেনি এবং ওর দেবুদিদির প্রতি অনাস্থা ওকে ক্রুদ্ধ করেছে। কী, জিতুমণি, মনস্তত্ত্ববিদ? ঠিক বললাম।
জিতু: একেবারে ঠিক। সমর্থনে হাত তুললাম বড়কাকুন। তোমাকে ও শানুকে। ছোটকাকুন, শানুকে কথা শেষ করতে দেওয়া হোক।
শানু: ধন্যবাদ ধন্যবাদ! আসলে এ হল পাশ-ফেলের ব্যবসা! একটা বাজার! প্রত্যেকবার পরীক্ষার জন্য মূল্য ধরে দাও। ভর্তির সময় একগাদা টাকা দাও। তোমাকে ছাত্র হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য নথিভুক্ত করব, তারপর ফেল করাতে থাকব, প্রত্যেক ছাত্র গড়ে দু’বার নাম নথিভুক্ত করাতে বাধ্য হল। কত রোজগার বলো তো! এবার এসো বাইরের বাজারে! প্রায় চার বছর প্রত্যেককে আর্টিকলশিপ করতে হবে। এরা হল বন্ডেড লেবার! যার ভাল যোগাযোগ আছে, বড় ফার্মে সুযোগ পায়, তাদের কিছু পারিশ্রমিক জোটে, যেমন দেবুদিদি পায়। কিন্তু মনে করো, প্রথম দু’বছর ও শিক্ষানবিশ ছিল এবং অন্য কোথাও অডিট-ফডিট করতে গেলে যাতায়াত ভাড়াটুকু পেত। তা-ও বাসভাড়া। ট্যাক্সি নয়।
ছোট কাকুন: সেসব জানি।
শানু: সব জানো বাবা। আমি যত তথ্য দেব, সব তোমাদের জানা। কিন্তু তথ্য থেকে সম্যক ধারণা করতে আর চাইছ না। কারণ, একবার পেশাদারি প্রতিষ্ঠা এসে গেলে পুরনো পথের কষ্টটা কেউ মনে রাখে না।
জিতু: আমাদের শানু সত্যিই বড় হয়ে গিয়েছে গো। আয় ভাই তোকে একটু আদর করে দিই।
শানু: তোলা রইল জিতুদিদি। কাল সকালে পাক্কা আধ ঘণ্টা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দেবে। আমি বলছিলাম, সিএ-র বাজারে জোগান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। চাহিদার অভাব চোখে পড়লে ছাত্ররা পয়সা খরচ করে পড়তে আসবে কেন? এ তো ডাক্তারি নয়! আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, ডাক্তারি হোক, ইঞ্জিনিয়ারিং হোক, যে-কোনও বিষয় হোক, পরীক্ষার্থী যতই মেধাবী হোক, প্রশ্নকর্তা চাইলে যে-কাউকে ফেল করিয়ে দিতে পারে! এমনকী, এক প্রশ্নকর্তাকে এক ছাত্রও ফেল করিয়ে দিতে পারে। কারণ, যে প্রশ্ন করে, তার কাছে বই আছে।
শানুর বাবা: বক্তৃতাটা ভাল দিলি।
শানু: মানে, তুমি আমার কথা এখনও মানতে পারছ না। কী জানো, একটা বিষয় তোমাদের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। তোমরা যখন ছাত্র ছিলে, উচ্চশিক্ষা বলে যা যা ধরা হয়, বা উচ্চমেধার পাঠক্রম, যেমন তুমি, বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি– মেজ জেউ, চিকিৎসা–বড়জেম্মা, জিতুদিদি, মা ও মেজজেম্মার মাস্টার্স– সব, সবই ভাল কর্মক্ষেত্র পেয়েছিল। আমি বলব, কর্মক্ষেত্রের পরিসরে উচ্চমেধার ডিগ্রিধারীদের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে। ডাক্তারি ছাড়া, সর্বত্র। জেনারেল লাইন, ধরো ম্যাথস বা ফিজ়িক্স থেকে ভাল ছাত্ররা কম্পিউটারের নানারকম কোর্স করতে যাচ্ছে। কারণ, তাতে চাকরির নিশ্চয়তা আছে। বিদেশে যাওয়ার হিচকুও কম নয়। হিড়িক আর কী! অথবা ধরো ম্যানেজমেন্ট পড়ার ঝোঁক। আমিও ভাবছি এমবিএ পড়ব। কারণ, শুধু মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং দিয়ে তুমি ভালভাবে দিন কাটাচ্ছ, কিন্তু আমি নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত জীবন কাটাতে পারব না। এই অবস্থায় দেবুদিদির সিএ পড়া একেবারে সঠিক সিদ্ধান্ত। মানছি যে পাশ করা শক্ত, কিন্তু করে যাবে। ওদের জগতে ফাইনালে পাঁচবার ফেল কিছুই না। মজাটা দেখো, ইন্টারে কেউ ফেল করে না। ধপাধপ পাশ। তারপরেই বন্ডেড লেবারগিরি! যে গবেট, যে অযোগ্য, সে ইন্টারেও গবেট! সিএ, কস্টিং ছাত্রদের টিউশন পড়িয়ে কত লোক যে করে খাচ্ছে! বড়লোক হয়ে গেল।
জিতু: আরে, একবার পাশ করে গেলে দেবুর বাকি জীবন নিয়ে ভাবতেই হবে না। চাইলে ও কোনও ফার্ম করতে পারে, অংশীদার হতে পারে, ভাল ভাল কোম্পানিতে চাকরি পেতে পারে।
পার: আমার একটাই প্রশ্ন। আমি মানছি, যুগের সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ, সুবিধে, ভাষা, সংস্কৃতি, সম্পর্ক সবই পালটায়। কিন্তু শানু, সিএ জগৎ বিষয়ে তুই যা বললি, জোর করে ফেল করিয়ে দেয় ইত্যাদি, এসবই তুই দেবুর কাছ থেকে জেনেছিস। তাই তো!
শানু: না। পুরোটা নয়। আমার স্কুলের বেশ ক’জন বন্ধু সিএ পড়ছে।
পার: বেশ। মানলাম। সকলেরই আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য এই ব্যাখ্যাগুলো লাগসই। সমস্তই অনুমান বা গুজবভিত্তিক। কোনও প্রমাণ নেই। একটা এমন প্রতিষ্ঠান, দিনের পর দিন অন্যায় করে টিকে থাকতে পারে না। তোদের কথা আমি পুরো মানতে পারছি না। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, এটাই ব্যর্থতার কারণ, তা হলেও কিন্তু ছোট যা বলছে, কেউ কেউ অপ্রতিরোধ্য, তাদের ফেল করানো যায় না, তারা ওই সিএ পাঠক্রমের জন্যই জন্মেছে– তার মধ্যে তোর দেবুদিদি পড়ে না।
শানু: সেটা কি দেবুদিদির অপরাধ? সব ফিল্ম পরিচালকই কি গোদার, কুরোসাওয়া, তপন সিংহ, সত্যজিৎ রায়? প্রথম সারির শ্রেষ্ঠ যারা নয়, তারাও ভাল কাজ করে!
পার: ব্যর্থতার সমর্থনে যুক্তি দেওয়া নিজের কাছে নিজেকেই ফাঁকি দেওয়া।
কাকুন: দেবু, তুই কিছু বল।
দেবু: আমার কিছু বলার নেই। ব্যর্থতার পক্ষে কোনও যুক্তি হয় না। শানুর কথাগুলো বাস্তব। কিন্তু প্রমাণ নেই। আমি ফেল করছি, কারণ পাশ করা আমার ক্ষমতায় কুলোচ্ছে না, এটা আমি মেনে নিয়েছি প্রতিবার!
জিতু: বড়কাম্মা, তুমি এভাবে দেবুকে না বললেও পারতে।
পার: ও কি সত্যিই যথেষ্ট পরিশ্রম করছে? আমি বলছি না ও ফাঁকি দিচ্ছে!
অরুণ: তা হলে কী বলছ?
পার: ও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার করছে না।
জেউ: কেন একথা বলছ?
পার: আর্টিকলশিপ তিন বছর আবশ্যিক। সেটা ওর হয়ে গিয়েছে। তার পরও ও কাজে যাচ্ছে কেন? অফিস যাওয়া, কাজ করা, এসবের ধকল নেই? সময় যায় না? সেই সময় ও শক্তি বাড়িয়ে পড়া এবং কোচিং নেওয়ায় প্রয়োগ করতে পারে। পরীক্ষার জন্য আরও ভালভাবে প্রস্তুত হতে পারে।
জেম্মা: ও তো কাজ শিখছেও। পরে এগুলো ওর যোগ্যতা হিসেবে বিশেষ মূল্য পাবে। কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা ওর জ্ঞান বাড়াতেও সাহায্য করে নিশ্চয়ই।
পার: সে তো পাশ করার পর দিদি। আমার সাদা বুদ্ধি বলে, পড়ায় আরও সময় ও শ্রম দেওয়া ওর দরকার। কিন্তু ও গোঁয়ারতুমি করছে। আজ ওর বন্ধুরা ফোন করে ভাল কোন কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য বলল। ও বলল, আর কোচিংই নেবে না!
জেম্মা: কেন? কোচিং নিবি না কেন দেবুমণি?
পার: ও নাকি অনেক খরচ করে ফেলেছে! এবার যা করবে, নিজেই।
জেউ: না। এসব ঠিক কথা নয়। দেবু মা, ধৈর্য হারালে তো চলবে না। যতক্ষণ সফল না হও, সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে। এতটুকু হার মানা চলবে না।
অরুণ: টাকা খরচের হিসেব করার তো দরকার নেই।
কাকুন: আজ হিসেব করে কিছু লাভ আছে দেবু? তখনই বলেছিলাম, আমাদের হল সায়েন্স পরিবার। আলাদা কিছু করতে যাস না। তখন জেদ করলি। মেয়েরা কমার্স বোঝে না।
ছোট কাম্মা: এত বাজে কথা বলো না তুমি! মেয়েরা বোঝে না– এরকম কিছু নেই।
কাকুন: দেবুকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, এইসব কমার্শিয়াল লাইনে মেয়েরা কম কি না।
জিতু: তার অজস্র কারণ আছে কাকুন। আর্থসামাজিক কারণ। দেবু সেইসব কারণের বাইরে।
দেবু: বছর বছর ফেল করছি, বেশি কথা বলার অধিকার নেই। তোমরা শুধু বলো, সবকিছুর মধ্যেই কি বিজ্ঞান নেই? ভাষা, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, ব্যাঙ্কিং, অর্থনীতি– সবই তো বিজ্ঞান।
কাকুন: সে তো তুই দর্শনে চলে গেলি।
ছোট কাম্মা: দর্শনও বিজ্ঞান। বৃহত্তর বা মহত্তর বিজ্ঞান।
জেউ: এসব আলোচনা থাক। পারমিতা, তুমি কিছু বলবে বলেছিলে আজ।
পার: হ্যাঁ। আসলে দিদি, আমি আর শ্রীমন্তী এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছিলাম। জীবন মানে তো কেবল পেশাদারিত্ব নয়। কিছু একটা করতে হবে, এটাও যেমন ঠিক, তেমনই জীবনের অন্যান্য কিছু দাবিও থাকে। সময় মেনে সেইসবও পালন করতে হয়। দেবুর পঁচিশ হল। এবার অন্য কিছু ভাবতে হয়।
জেম্মা: আমি অত ভূমিকা করব না। সরাসরি কাজের কথায় আসি। আমার এক রোগিণী, খুব ভাল মানুষ, মায়ের মন্ত্রে দীক্ষিত, ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন। অধ্যক্ষা অমলহৃদয়া মাতাজি বললেন, তোমার ভ্রাতুষ্পুত্রী তো বিবাহযোগ্যা। কথা বলে দেখতে পার।
ছোট কাম্মা: ভাল ছেলে। খুবই মেধাবী। রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে ফিজ়িক্স পড়ায়। ডক্টরেট। নামী জার্নালে একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। খুবই ভাল সম্বন্ধ। দেবু আমাদের কলকাতাতেই থাকবে।
জিতু: বিয়ে! দেবুর!
পার: এই তো সময়!
দেবু: অসম্ভব! পাশ না করে বিয়ে করার প্রশ্নই ওঠে না!
পার: সবার এক কথা। মেয়ে পাশ করল? মেয়ের বিয়ে দেবে না? জবাব দিতে ক্লান্ত লাগে আজকাল! একটা কিছু তো সময়মতো হোক।
দেবু: মা, তুমি একথা বলছ? যে তুমি সহজে হার না মানার কথা বলতে?
পার: বিয়ে করা মানে তো হার মানা নয়। জীবনের ধর্ম পালন করতে হবে! সবকিছুর একটা সময় আছে।
জেউ: ভাল পাত্র পেলে হাতছাড়া করা উচিত নয়। আজকাল চারদিকে যা শুনি, কাগজে পড়ি, বিয়ে দিয়েও কি শান্তি আছে?
দেবু: বললাম তো, আগে পাশ করি, তারপর!
পার: দেবু, আজ পর্যন্ত আমরা তোমাদের কোনও কাজে বাধা দিইনি। জিতু, তুমি, শানু– তোমরা স্বাধীন।
শানু: বাধা দেওয়ার মতো কাজ আমরা করিনি, তাই দাওনি। এখন তো দিচ্ছ। বিয়ে-ফিয়ে বাজে জিনিস। দেবুদিদির পড়ার বারোটা চোদ্দো হয়ে যাবে!
পার: কেন? বিয়ের পর পড়া যায় না? উচ্চশিক্ষিত পাত্র, শিক্ষিত পরিবার! বাধা দেওয়ার মতো লোকই-বা কই! ইচ্ছে থাকলেই পড়া যায়। তা ছাড়া এতকাল তো বলিনি।
কাম্মা: শানু, তুই এসবে কথা বলছিস কেন?
শানু: মা, তোমরা একটা পিরিয়ডিক টেবিল করো। রোজ ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে পড়ব। এই করো, ওই কোরো না। এই বিষয়ে কথা বলো, ওই বিষয়ে বোলো না!
অরুণ: শিক্ষিত পরিবার হলেই যে বাড়ির বউয়ের লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখাবে, তা না-ও হতে পারে। আমার মা সেই সময়ের আইএ পাশ ছিল কিন্তু।
জেম্মা: তাঁর সময় আর আমাদের সময় এক নাকি? এখন শাশুড়িতে-বউতে বেশ সখী-সখী ভাব।
অরুণ: দেখো ভেবে। বিয়ে মানে একটা নতুন পরিবেশ। নতুন লোকজন, জীবনের গুরুভার অধ্যায়। কত দায়দায়িত্ব আসে, কর্তব্য আসে। এখানে দেবু মুক্ত। নতুন পরিবার যত ভালই হোক, ওর পক্ষে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত, নির্ভার লেখাপড়া আর সম্ভব হবে না। অথচ তুমি তাই চাইছ!
পার: দেবুর স্কুলের বন্ধুরা কেউ আর এমন দিশাহীন অবস্থায় পড়ে নেই। যদি বুঝতাম ও একটা নির্দিষ্ট সময়ে অবশ্য পাশ করে যাবে, আরও বছর খানেক অপেক্ষা করা যেত। জীবনের অন্যান্য সৌন্দর্যও তো খুঁজে পেতে হবে।
জিতু: আমি বলি কী, বড়কাম্মা, বিয়ের জন্য জোর কোরো না। একটু দেরি হলে ক্ষতি কী!
জেম্মা: সম্বন্ধ এলেই কি আর বিয়ে হয় জিতুমণি? পছন্দ-অপছন্দ আছে, মানামানি আছে, আজকাল আবার পাত্র-পাত্রী একটু-আধটু মেশামেশি করে নেয়। সব মিলে দীর্ঘ প্রক্রিয়া। দেবু যেমন পড়ছে পড়ুক, দেখাশোনা চলুক, যখন যা হওয়ার তাই হবে!
পার: আমরা যা করব, তোমাদের ভালর জন্যই করব জিতু।
খাওয়ার টেবিলে এই প্রসঙ্গ আর এল না। দেবু কথাই বলছে না। শানু ভ্রু কুঁচকে আছে। দেবুদিদির উপর বিয়ে চাপিয়ে দেওয়া কিছুতেই সে মানতে পারছে না।
জিতু খেতে-খেতে বলল, “গেস্টরুমের চাবি কোথায় মা?”
“ও তো ছোটর কাছে থাকে।”
“চাবিটা দিয়ো তো ছোটকাম্মা, আমি আর দেবু আজ ওঘরে শোব।”
শানু বলল, “আমিও শোব। তোমাদের মাঝখানে।”
“রাতে ফুটবল খেলবি না!”
“না রে বাবা! পড়ার চাপে ফুটবল-টল ভুলে গিয়েছি।”
“ঠিক আছে, আমি মাঝখানে, তোমরা দু’জন দু’দিকে।”
“যে আজ্ঞে!”
অনেক রাত পর্যন্ত দুই বোন আর ছোট ভাইটি মিলে আড্ডা হল। জিতু আর শানুই কথা বলল বেশি। দেবু চুপচাপ। কিন্তু এই সময়টুকু তার ভাল লাগছিল। ভাইবোনদের সঙ্গে সে সহজ বোধ করে। বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে কাছের রূপম ও শুভায়ন। স্কুলের বন্ধু-মেয়েরা একটু দূরের। সে যখন এগারো ক্লাসে কমার্স পড়তে চলে গেল– তার নিজের স্কুলে কমার্স ছিল না বলে বাড়ির নিকটবর্তী যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি কলেজে– তাদের ক্লাসে সে ছিল একমাত্র মেয়ে! স্কুলের বন্ধুদের প্রতি তখনও টান। পড়ার চাপে যোগাযোগ কমে এল। ক্লাসে প্রথমদিকে একটু অস্বস্তি, তারপর সয়ে গেল।
কলেজে বিধিনিষেধ কম, ঔদার্য বেশি। বিদ্যানিধিতে পড়াশোনার পরিবেশটি তার ভাল লেগেছিল। রূপম-শুভায়ন সেই তখন থেকে বন্ধু। তারাই প্রথম অলি পাব চিনিয়েছিল তাকে। তাদের সঙ্গেই প্রথম সিগারেট। তারাই বিয়ারে প্রথম চুমুক দেওয়ার সাহস জুগিয়েছিল। আজও তারা সুখে-দুঃখে অলি পাবে যায়। সায়ন আর দীপংকর সিএ পড়ার বন্ধু। বয়সে বড়। বন্ধুত্বে সমান। তেমনই শ্রাবণী ছিল। একবছর আগে আমেরিকা প্রবাসীর বউ হয়ে ফ্লোরিডা চলে গেল। বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিল, দেবু যায়নি। উৎসব-অনুষ্ঠান কিছুই ভাল লাগে না। ঘরের বাইরে সুখ বলতে, এই বন্ধুদলের জন্মোৎসব পালন। শ্রাবণী চলে যাওয়ার পর বছরে পাঁচদিন!
সে শ্রাবণীকে জিজ্ঞেস করেছিল, “পড়া ছেড়ে চলে যাবে, নাকি আবার ক’দিন পরে এসে পরীক্ষা দেবে?”
“পরীক্ষা? আবার? রামঃ! আমার বর প্রচুর কামায়। আয়েশ-আরাম করে কাটিয়ে দেব স্রেফ। বাচ্চাকাচ্চা হবে। মানুষ করব। একটাই মুশকিল, বরটার টাক পড়ে গিয়েছে! আমি বলেছি, অন্তত বিয়ের অনুষ্ঠানে যেন উইগ লাগিয়ে আসে। খুব খুশি। বলেছে, ওখানে এত ভাল উইগ পাওয়া যায়, যে পরে সে-ও ভুলে যায় আসল চুল, না নকল! হি হি হি!”
দেবু: টাক! উইগ!
শ্রাবণী: কেন? সমস্যা কোথায়? আমরা মেয়েরা যদি ফ্যাকাসে ঠোঁট রাঙিয়ে নিতে পারি, গালে নকল লালিমা, ঝোপড়া ভুরু উপড়ে সরু– তা হলে পুরুষমানুষ উইগ পরে টাক ঢাকবে না কেন? ময়ূর ময়ূরীর মন ভোলাতে পেখম তুলে নাচে না?
দেবু: সে নাচুক গে। আমি টাক বা ময়ূর নিয়ে ভাবছি না।
শ্রাবণী: তবে কী ভাবছিস? আমি কেন টাকলা মাকান বিয়ে করছি? প্রথমত, যাদের আগেভাগে টাক পড়ে, তাদের যৌনক্ষমতা বেশি। বিয়ে কী জন্য করা? উহুহুহু! ভাবলেই রোমাঞ্চ হচ্ছে। আমি খুব ভাল বর পটাতে পারব, দেখিস। দ্বিতীয়ত, আমার টাকডুমাডুম আমেরিকায় থাকে। এ ভারতে থাকলে সজোরে ‘না’ বলতাম!
দেবু: তুমি তো মানুষটাকে বিয়ে করছ, নাকি? না ওই আমেরিকান ডলারকে?
শ্রাবণী: ভেবে দেখ, চিনি না, জানি না, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ। একবার দেখা হয়েছে। মাঝে-মাঝে সাইবার কাফেতে গিয়ে চ্যাট করা অথবা ই-মেল! তার হৃদয়ে মাল্যদান করছি বললে আত্মপ্রতারণা হয় না? হৃদয়ের সন্ধান, আদৌ যদি পাই, তার অনেক দেরি আছে। আপাতত আমার ব্যালেন্স শিটের অ্যাসেট হিসেবে আমার হবু বরের হৃদয়ের কোনও জায়গা নেই। বাকি যা কিছু, তার ডিগ্রি, চাকরি, আমেরিকা, ডলার– সব গ্রহণযোগ্য!
দেবু: আসলে, টাক, টাকা এসব নয় আদৌ। আমি বলতে চাইছিলাম, এতখানি এগিয়ে পড়াটা ছেড়ে দেবে? এত সহজে হার মেনে নেবে?
শ্রাবণী: ক’বার ফেল করেছিস? মাত্র তিনবার এখনও। সবে দ্বিতীয়বার রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিস। আমি মে এবং নভেম্বর, দু’পর্যায়ে পরীক্ষায় বসে এগারোবার ফেল করেছি। এগারোবার, দেবু, আজকাল আমার নিজেকে একটা খড়ের আঁটি বলে মনে হয়। গোরুর খাদ্য। ট্যাক্স, অডিট, ল, ব্যালেন্স শিট শুনলে গা গুলোয়। তুই বলছিস ‘এতখানি এগিয়ে’, আমি কোথায় এগোলাম! আমি যেন মাঝদরিয়ায় নোঙর ফেলা নৌকা! শুধু ভেসে আছি। আর ক্রমাগত জলস্রোতের মতো এগিয়ে যাচ্ছে আমার বয়স!
দেবু: ভাল লাগবে? কষ্ট হবে না?
শ্রাবণী: কী করে বুঝব কোনটা বেশি কষ্টকর? কোনটা ভাল লাগা? স্কুলের বন্ধুরা সব জীবনে স্থিত। নিজেকে খুব অপাঙ্ক্তেয় মনে হয়! মেয়ে-বন্ধুরা সব বিয়ে করে মা হয়ে গেল। ছেলে-বন্ধুরাও পটাপট পিঁড়িতে বসছে। সবার নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়ে গিয়েছে। চাকরি, সংসার, সন্তান! জানিস, আজকাল ওদের সঙ্গ আমার সহ্য হয় না। ওরা ডাকলে মিথ্যে ওজুহাতে এড়িয়ে যাই। কতরকম জটিলতা এসে যাচ্ছে মনে! মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, মনে হয়, আমি বুড়িয়ে গিয়েছি। আলো জ্বেলে আয়নার সামনে দাঁড়াই। মনে হয়, চোখের তলায় কালো ছোপ, কোণে বলিরেখা! একদিন চিরুনিতে একটা পাকা চুল উঠে এল। আমার সেদিন কান্না পেয়ে গিয়েছিল রে দেবু, এখনও ত্রিশ ছুঁইনি, কিন্তু ছুঁতে আর কতদিন? সারাক্ষণ সচেতন থাকি, যাতে নিজেকে কচিটি দেখায়! এগুলো কষ্ট নয়? এসব করে কী পাচ্ছি?
দেবু: এটা তোমার জীবন শ্রাবণী! তোমার বেঁচে থাকা! বয়স বাড়ছে, দুটো চুল পাকছে, তো কী এসে যায়! বয়স তো সবারই বাড়ে। ধরো, জাস্ট ধরো, কথার কথা, তুমি বিয়ে করে আমেরিকা গেলে, সম্পর্কটা গড়ে উঠল না। মানিয়ে নিতে পারলে না তুমি, কী করবে?
শ্রাবণী: মানিয়ে নেব রে। মেয়েরা নেয়। আর নেয় বলেই এত সংসার টিকে থাকে। তা ছাড়া, আমি তো ও-দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে নেব, মানে পেয়েই যাব বউ হিসেবে। ওখানে কোনও কাজ করব। চাইলে অনেক কিছু করা যায়। অশিক্ষিত তো নই। ইচ্ছে হলে ওখানে কোনও কোর্স করব!
কী করা যায়? কী কী করা যায়? কেমন আছে শ্রাবণী? দেবাদৃতা জানে না। এই ফ্ল্যাটের গ্রন্থাগারে একটি কম্পিউটার রাখা হয়েছে সম্প্রতি। শানুই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। সে ছাড়াও বাড়ির সবাই যন্ত্রটির সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে চাইছে। দেবুর সে সময়টুকুও নেই। নিরবকাশ ও অনিচ্ছা। কম্পিউটারের প্রাথমিক ব্যবহার সে দ্রুত আয়ত্ত করে এবং যন্ত্রটি সম্পর্কে কাজ চালানোর মতো জ্ঞান রাখে। কিন্তু ই-মেল করে বা চ্যাটরুমে ঢুকে শ্রাবণীর খবর নেওয়ার ইচ্ছে হয়নি তার। নিত্যনতুন বন্ধুত্বেও সে আগ্রহী নয়। এই মুহূর্তে শ্রাবণীর কথা তার মনে পড়ছে। কারণ, এই প্রথম তার জীবনে বিবাহ প্রস্তাব এল। লক্ষণীয় যে, শ্রাবণী ত্রিশের অদূরে ছিল, সে নয়। সে জানে না ত্রিশের অদূর মানে কত। সে জানে না, নিরন্তর ব্যর্থতার গভীর ক্ষতে কতখানি প্রলেপ হওয়া সম্ভব ওই বিবাহিত জীবনের মাধুর্য! প্রেম, শরীর, বিবাহ, সন্তান, সমস্তই তার মনোজগতের বাইরের বিষয়! এবার সে কী করে? অজানিত জীবনকে এই প্রথম ভয় পেতে শুরু করল সে!
সে শুনতে পাচ্ছিল শানু ও জিতুদিদির খুনসুটি, কৌতুকপ্রদ, কিন্তু তার কাছে অর্থহীন।
জিতু: কী তেল মাখিস রে মাথায়?
শানু: তেল! মাথায়! তেলা মাথায় আমি তেল দিই না।
জিতু: কে তোর মাথা তেলা করে দিল?
শানু: তোমরা সবাই। বাড়ির ছোট। একমাত্র ছেলে। সর্বকনিষ্ঠ শিবরাত্রির সলতে! সবার আদরে আমি এক গর্বিত তেলতেলে বাঁদর!
জিতু: বাঁদরটাকে বেশ সুন্দর দেখতে তো! এমন হ্যান্ডু বাঁদর প্রেম-ট্রেম করছে? দেবুটা তো ঢেঁড়স!
শানু: ঢেঁড়স কী, বলো এক কিলো উচ্ছে আর দেড় কিলো তেলাকুচার রস! মুখখানা করে থাকে দেখবে, যেন আমার মেজজেউ রামগরুড়! আজ কত ভাল একটা সিনেমায় নিয়ে গেলাম, হাফটাইমে বলে, চল বাড়ি যাই, ভাল লাগছে না।
জিতু: কী সিনেমা?
শানু: প্ল্যাটুন।
জিতু: দেখলি না!
শানু: দেখব আবার না। পয়সা উশুল না করে ছাড়ি? বেরিয়ে বললাম, চল কুলপি খাই। কুলপির মতো শীতল গলায় বলল, চিনি দেওয়া বরফ গিলে কী আনন্দ পাস! রসকষ সব গেছে?
জিতু: ও সব শুনছে কিন্তু!
শানু: শুনুক না। ভয় পাই নাকি? ঘ্যাঁক করে কামড়ে তো দেবে না!
দেবু: আমাকে কুকুর বললি?
শানু: হলে অসুবিধে কী? কুকুর কি খারাপ?
জিতু: কী রে দেবু, প্ল্যাটুন খুব ভাল ছবি তো!
দেবু: নিঃসন্দেহে! অত্যন্ত তীব্র, গভীর এবং দুঃসহ। যুদ্ধবিরোধী। কিন্তু মন লাগছিল না। ভিয়েতনামের যুদ্ধের চেয়ে নিজের অবস্থাটা গুরুতর লাগছিল।
শানু: এটা একটা গাধার মতো তুলনা এবং হস্তীমূর্খের মতো কথা!
জিতু: কেউ যখন খুব দুঃখে থাকে তখন তার দু’টি বিপরীত প্রতিক্রিয়ার একটি হয়। এক, সে অন্যের দুঃখে সমব্যথী হয়ে উঠবে, দুই, সম্পূর্ণ উদাসীন।
শানু: অত দুঃখের কী আছে? অন্যরাও তো ফেল করেছে।
জিতু: আচ্ছা, ওসব থাক।
শানু: হ্যাঁ। সারা সন্ধে সবাই পুরো বসে বসে দেবুদিদির পিণ্ডি চটকাচ্ছিল! মটকা গরম হয়ে গিয়েছিল শালা! যেন দেবুদিদি সত্যপিরের কাছে মানত করে ঢিল বেঁধেছে– প্রভু আমায় বারংবার ফেল করিয়ে দাও!
জিতু: আচ্ছা, ওসব থাক। তোর প্রেমের কথা হচ্ছিল।
শানু: প্রেমে রোজ পড়ি। চারদিকে কত সুন্দরী মরি মরি একেবারে! আমিও পড়ি। পড়েই থাকি। কেউ তোলে না।
জিতু: ফের মিথ্যে কথা!
শানু: তুমি তো আবার চোখ দেখলেই মন পড়ে ফেলতে পার। ভাগ্যিস আলো জ্বলছে না। মাইরি বলছি আমি ওস্লা। ওস্লা জানো তো? ওয়ান সাইডেড লাভার্স অ্যাসোসিয়েশন।
জিতু: আমরা তো ফোস্লা বলতাম। ফ্রাস্ট্রেটেড যোগ হত!
শানু: না না। হতাশ হলে চলবে কেন? দুনিয়ায় মেয়ের অভাব? পিঙ্কি নয় চিঙ্কি আছে। চলো, ঘুম পাচ্ছে। শুভরাত্রি দিদিরা। জিতুদিদি, রাতে ঠ্যাং-ফ্যাং চালালে বোলো, সকালে পেন্নাম করে নেব।
কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল দুই বোন। নিশ্চিন্ত ঘুমের ফুরফুরে শ্বাসপতনের শব্দ আসছে শানুর দিক থেকে। দেবু বলল, “ঘুমোলে?”
জিতু: না। চল বারান্দায় গিয়ে বসি। ভাল করে কান-মাথা ঢেকে নে।
দেবু: চলো।
জিতু: আচ্ছা থাক। ঠান্ডা লাগলে মুশকিল।
দেবু: যা বলবে।
জিতু: কী বুঝলি আজ? লুকোবি না। যা মনে আসছে পরিষ্কার বলবি।
দেবু: তোমার কাছে আমি আজ পর্যন্ত কিছু লুকোইনি। দ্যাখো, আমার মনে হচ্ছে, আমার বারবার বিফল হওয়ার বিষয়ে বাড়িতে বড়দের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। কাউকে দোষ দিই না তার জন্য। আমাদের বাড়িতে ফেল ব্যাপারটা খুব বেমানান। আর দু’বছরের মধ্যে শানু বি টেক হয়ে যাবে, কিন্তু দু’বছরে আমি সিএ হব কি না কেউ জানে না। শানু হয়তো আরও পড়াশোনা করতে কলকাতার বাইরে চলে যাবে। আমার তো অন্য গতি নেই। আমি তা চাইও না। আমি হার মানব না জিতুদিদি।
জিতু: নিশ্চয়ই নয়।
দেবু: এই প্রথম আমাকে মনে করিয়ে দেওয়া হল, সায়েন্স নিইনি বলে কাকুনদের মনের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। আমার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যাথমেটিশিয়ান বা ফিজ়িসিস্ট হতে ইচ্ছে করেনি। আমি কেন সিএ পড়তেই চাইলাম?
জিতু: কখনও বলিসনি। আমিও জানতে চাইনি হয়তো।
দেবু: আমি তখন নবম শ্রেণি, প্রথম শাড়ি পরে স্কুল, তার এক বছর আগে পিরিয়ডস হল, কীরকম মনে হল, আমি মেয়ে! আমি নারী! হঠাৎ যেন আমারই আত্মপরিচয় কঠোর মুখ নিয়ে আমার সামনে এল। নারী-নির্যাতন শুনি, নারীর অধিকার শুনি, ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যে ‘আমি চিত্রাঙ্গদা’ গান শুনি, মনে হল, নিজেকে দেখি। আমি, একজন নারী, আমি কোথায় আছি, কীভাবে আছি! আমার হাতে এল ডরিস লেসিংয়ের ‘গোল্ডেন নোটবুক’। অ্যাঞ্জেলা কার্টারের ‘দ্য প্যাশন অফ নিউ ইভ’। এক বছরের মধ্যে। আমি প্রচুর বাংলা প্রবন্ধ-নিবন্ধ পড়লাম আর সেই সঙ্গে “দ্য সেকেন্ড সেক্স” বাই সিমোন দ্য বোভোয়া। আমার মধ্যে কতগুলো গভীর উপলব্ধি হল। মেয়েরা স্বাধীন নাগরিক, সমাজ তা মনে করে না। মেয়েরা নিজেরাও বোঝে না। এই স্বাধীনতা কীভাবে অর্জিত হতে পারে? অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন বা স্বনির্ভর তো হতেই হবে, সেইসঙ্গে স্বাধীনচিত্ত হতে হবে।
জিতু: ঠিক।
দেবু: এভাবেই পড়তে পড়তে দেখলাম, কতগুলো অন্ধ কুসংস্কার আছে। মেয়েরা অঙ্কে কাঁচা, বুদ্ধিতে কম, ডাক্তার মেয়ে হলে নির্ভরযোগ্য নয়, মেয়েরা কমার্স বোঝে না, নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। এসব কে ঠিক করল? কবে ঠিক করল? পাখির ডানা দু’টি যদি ছেঁটেই দেওয়া হয়, কী করে বোঝা যাবে সে উড়তে পারে কি না!
জিতু: তাই তো!
দেবু: একদিন বাবার সঙ্গে নিউ মার্কেট গিয়েছি, সসেজের মাংস কিনছি, এক ভদ্রলোক বাবার কাছে এসে বললেন, অরুণাংশু? বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট? তিনি বাবার স্কুলের বন্ধু। লম্বা, ফরসা, গ্রিক ভাস্কর্যের মতো দেখতে, বাবা পরিচয় করিয়ে দিল, ওঁর নাম দীপনারায়ণ সিংহরায়! চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। সিএ। ওই প্রথম শব্দটা শুনলাম। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট! মানে কী বাবা? বাবা বলল, হিসাবশাস্ত্রে সর্বোচ্চ ডিগ্রি বলতে পার। অর্থনীতি নয় কিন্তু। এ হল হিসেব, আইন, আয়কর এইসব বিষয়। আমার কাছে ওই স্মার্ট সুন্দর মানুষটা হয়ে গেল সিএ-র সিম্বল। যেন দুনিয়ার সব সিএ ওই গ্রিক ভাস্কর্য!
জিতু: একে বলে টিনএজ ইনফ্যাচুয়েশন। বয়ঃসন্ধির মুগ্ধতা!
দেবু: ঠিক করে ফেললাম, আমি সিএ হব। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট! নারীর স্বাধীনতা ও সংগ্রাম নিয়ে বইপত্র পড়তে পড়তে আমার ইচ্ছে আরও দৃঢ় হল। হয়তো, কাকুনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমি সিএ হওয়ার জন্য জন্মাইনি, কিন্তু আমার ইচ্ছেই আমার রাস্তা বানিয়েছে।
জিতু: ভাবনা-চিন্তা, ইচ্ছে কোনওটাতেই ভুল নেই। তবে আমি বলব, নিজেকে ব্যক্তি ভাবতে হবে। ব্যক্তিমানুষ। তবেই সবচেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস অর্জন করা যায়। প্রথমে মানুষ, তারপর নারী। সিমোনের সব কথা আমি মানতে পারি না। তাঁর এবং আমাদের সময়ও অনেক আলাদা।
দেবু: আমি মেয়ে, আমি মেয়ে– এমনটা সারাক্ষণ মনে রাখি না। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব আমাকে খুব নাড়িয়ে দিয়েছে জিতুদিদি।
জিতু: কেন? বিয়ের সঙ্গে কাজ বা পড়ার কোনও বিরোধ নেই। আমি বিয়ের পর কাজ করছি না?
দেবু: তুমি করছ। মানছি। কিন্তু আমার অস্বস্তি হচ্ছে। যেন এ বাড়িতে সবাইকে আমি বিব্রত করছি। সবার মান রাখতে পারছি না। সেজন্যই বাবা ছাড়া আর সবাই আমার বিয়ে দিতে চাইছে। বিয়ের বেনারসি আর মুকুট-মালায় আমার ব্যর্থতা কেমন করে ঢাকা পড়বে, বলো? সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছি মাকে দেখে। অদিতি সামন্তর ঘটনা তোমার মনে আছে?
জিতু: সব মনে আছে।
দেবু: সেই মা! যে ছাত্রীদের কখনও গোল্লা দেয় না! অঙ্ক করার চেষ্টা করলেই নম্বর। কারণ, প্রয়াস মর্যাদা পায়, সেই মা বলছে, বাইরের লোক মেয়েকে নিয়ে প্রশ্ন করলে অসুবিধে হয়! এই বাইরের লোকেরা কারা জিতুদিদি? আমাদের সঙ্গে তাদের কিসের সম্পর্ক? কী করে তারা আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ল যে, মা আমাকেই ঘরছাড়া করতে চায়!
জিতু: এভাবে ভাবা ঠিক নয়। সামাজিক চাপ আমাদের সকলের উপরেই অল্পবিস্তর থাকে। কেউ উপেক্ষা করতে পারে, কেউ পারে না।
দেবু: বিয়ে আমি এখন কিছুতেই করব না।
জিতু: এই নিয়ে জেদ করতে গেলে তোর মানসিক স্থৈর্য আরও ব্যাহত হবে। বড়কাম্মার সব কথাই যুক্তিহীন নয়। তুই অফিস থেকে তিন মাসের ছুটি নে। কোচিং নে। পুরো সময় পড়াশোনা কর। জানুয়ারি চলছে, মে মাসে পরীক্ষা। প্রাণ ঢেলে পড়াশোনা কর। তোর পরীক্ষার আগে যাতে বিয়ের কথা না এগোয়, তার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। তারপর ছেলেটিকে দেখবি, কথা বলবি, তাড়া নেই কিছু।
দেবু: তুমিও বিয়ের পক্ষে?
জিতু: আমরা তো প্রকৃতির অংশ। যা প্রাকৃতিক যা স্বাভাবিক, তাকে অস্বীকার করব কী করে? শরীরের নিজস্ব চাহিদা থাকে, মনেরও নিজস্ব দাবি থাকে। শরীর ও মন পরস্পর পরিপূরক। শারীরিক তৃপ্তি মেধা ও বুদ্ধিকেও শাণিত করে। মন, মেধা, বুদ্ধি হতে পারে একটাই অস্তি, একযোগে তা চিন্তন, যা শরীরের স্নায়বিক গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত! গ্রহণ, অনুভূতি, চিন্তা, প্রতিক্রিয়া– খুব সংক্ষেপে এই বৃত্ত নিয়ে আমরা চলি। অনুভূতি এক ব্যাপ্ত বোধ। এর প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিরন্তর আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। এর প্রকাশ ও অপ্রকাশ আমাদের মধ্যে নানাবিধ চারিত্র্য রচনা করে। আমাদের চিন্তাপ্রক্রিয়াকে অসুস্থ বা সুন্দর, উদার বা বিকৃত করে! তাই একটা সময় আসেই, যখন অভিভাবকেরা সচেতন হয়ে ওঠে! বিয়ে নিয়ে অত জটিল করে ভাবিস না। কাকুনের বা বড়কাম্মার কথায় দুঃখ পাস না। আমাদের এ বাড়িতে সবাই একে অপরকে বড্ড ভালবাসে রে। সব পরিবারে এমন নয়। পারিবারিক হিংসা ও নিষ্ঠুরতা কোন চরমে পৌঁছয় তোর ধারণা নেই। যত ঘাঁটছি, তত বিস্ময় বাড়ছে! আমাদের বাড়িটা স্বর্গ, স্বর্গ!