আড়াইটা বেজে গেছে। দীপংকর রীতিমতন অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। কয়েকটা জরুরি চিঠি পাঠাতে হবে। কিন্তু সরলা বিশ্বাস এখনও ফেরেনি।
একটার সময় লাঞ্চ আওয়ার শুরু হয়। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ফিরে আসা উচিত ছিল। দীপংকর সময়ের ব্যাপারে কক্ষনো কড়াকড়ি করে না। অনেকদিন তো কাজই থাকে না তেমন। কিন্তু যখন কাজ থাকে, তখন দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দীপংকর পছন্দ করে না মোটেই। আর কোন সময় কাজ থাকবে কী না থাকবে সেটার খোঁজ রাখা স্টেনোগ্রাফারেরই কর্তব্য।
বেশি রাগ হয়ে গেলে দীপংকর কক্ষনো তা প্রকাশ করে না। সে নিজেই তখন বেশি কাজ করে। দীপংকর নিজেই লং হ্যাণ্ডে তিনখানা চিঠি লিখল। তার নিজের হাতে টাইপ করতে বসল।
কাজে মন বসছে না দীপংকরের। সরলা বিশ্বাসের ওপর সে বড়োবেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে আজকাল। এ-রকম হয়। সরলা খুব কাজের মেয়ে বলেই দীপংকর তাকে অনেকখানি বিশ্বাস করে বসে আছে। অনেক জরুরি চিঠির কথা দীপংকর ভুলে গেলেও সরলাই তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে।
ইদানীং অবশ্য সরলাকে প্রায়ই অন্যমনস্ক দেখা যায়। ঘন ঘন ছুটি নেয়। এটা পছন্দ হয় দীপংকরের। সরলা ছুটি নিক, তাতে তার আপত্তি নেই, পাওনা ছুটি তো নেবেই—কিন্তু সরলা তো একবারও বলে না ছুটিটা তার কীজন্য দরকার। আগে সব কিছুই বলত। এখন বেশ একটা দূরত্ব রচনা করে ফেলেছে। দীপংকর কোনো দিন সরলার কোনোরকম অসম্মান করেনি, নানা ভাবে তার উপকারই করতে চেয়েছে—সরলা কি সেটা বোঝে না?
সরলার কাজে কোনো ত্রুটি নেই। সমস্ত কাগজপত্রই সে বেশ সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে রাখে। বেচারি নিজের ঘরসংসারই শুধু সাজাতে পারল না। ওর স্বামীটা একটা পাষন্ড, এমন একটা মেয়ের মূল্য বুঝতে পারল না। দীপংকরের যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে সে ঘাড় ধরে সরলার স্বামীকে ফিরিয়ে আনত। সে লোকটা অন্য মেয়েকে নিয়ে বেলেল্লা করে বেড়াচ্ছে—আর সরলার ব্যবহার ঠিক শুদ্ধ তপশ্চারিণীর মতন—অন্য কোননা পুরুষের দিকে সে চোখ তুলে তাকায় না। বন্ধঘরের মধ্যে দীপংকরের এত কাছাকাছি সে বসে, কিন্তু একদিনের জন্যও দীপংকর ওর ব্যবহারে কোনো খুঁত পায়নি। দিলীপ বোসটা অবশ্য মাঝেসাঝে ওকে খুব জ্বালাবার চেষ্টা করছিল। আজকাল দিলীপকে আর এঘরে বেশি দেখা যায় না। আগের মতন কাজ না থাকলেও ছলছুতো করে যখন-তখন এঘরে আসে না। দিলীপ নিশ্চয়ই অন্য কোনো মেয়ের সন্ধান পেয়েছে। ওর কাজই তো এই।
অনেক দিন টাইপ করার অভ্যেস নেই দীপংকরের। খট খট শব্দ নিজের কানেই বাজছে। তবু সরলার ওপরে বিরক্তিটা সে কাটাবার চেষ্টা করছে। ঘড়ি দেখছে ঘন ঘন।
সরলা বিশ্বাস ফিরল পৌনে চারটের সময়।
দীপংকর তাকে দেখেও মুখ তুলল না। সে তার রাগি মুখ বাথরুমের আয়না ছাড়া আর কারুকেই দেখায় না। তা ছাড়া আজ সকাল থেকেই তার মাথা ধরে আছে।
সরলা বলল, মি. ব্যানার্জি, আমি খুবই দুঃখিত। হঠাৎ এমন আটকে পড়েছিলাম।
হুঁ, ঠিক আছে।
আপনাকে আমার খবর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু টেলিফোনে কিছুতেই কানেকশান পেলাম না।
আচ্ছা।
যেহেতু দীপংকর সরলারই টেবিলে বসে টাইপ করছে, তাই সরলা বসতে পারছে না। সে তো তার ওপরওয়ালার চেয়ারে বসতে পারে না।
মি. ব্যানার্জি, রাগ করবেন না। অন্তত আজকের দিনটা আমার ওপর রাগ করবেন না!
সরলার গলার আওয়াজে এমন একটা ব্যাকুলতা ছিল, যে-জন্য দীপংকর চমকে মুখ তুলে তাকাল।
অন্য দিনের তুলনায় সরলা আজ যেন একটু বেশি সেজেছে। সাধারণত সাদা শাড়িই সে পরে, আজ তার শাড়ির রং হালকা নীল। বড়ো চমৎকার, মায়াময় নীল। মুখে নতুন কোনো প্রসাধন নেই, তবু মুখখানা অন্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জ্বল।
সরলার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। যেকোনো কারণেই হোক, সে আজ বেশ উত্তেজিত হয়ে আছে মনে হয়। সেই শান্ত ধীরস্থির সরলা বিশ্বাস আজ যেন সম্পূর্ণ নতুন মেয়ে।
কী ব্যাপার?
সরলার মুখ লজ্জায় আরক্ত। কী করে সে নিজেকে প্রকাশ করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। একটু কিন্তু কিন্তু করে সে বলেই ফেলল আমি আবার বিয়ে করছি।
তাই নাকি? খুশি হলাম।
মানে, আজই বিয়ের নোটিশ দিয়ে এলাম…হঠাৎ ঠিক হল…আপনাকে আগেই বলা উচিত ছিল…
দীপংকর আবার মুখ নীচু করে টাইপ রাইটারে চিঠিটা শেষ করতে লাগল। সরলার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহই নেই। আসলে সে তার অভিমান গোপন করার চেষ্টা করছে। সরলা আবার বিয়ে করছে, কবে সব ঠিকঠাক হয়ে গেল? দীপংকরকে একবার জানালো না। দীপংকর কি তার শত্রু? কাকে বিয়ে করছে, আবার কোনো একটা অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানকে? এ বিয়েই বা আবার কতদিন টিকবে কে জানে? ওদের কি কোনো নীতিবোধ আছে?
অনেকক্ষণ মাথা নীচু করে টাইপ করবার জন্যই হয়তো দীপংকরের ঘাড়ের কাছে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে। দু-তিনদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। এবার সে কিছুদিন ছুটি নেবে। চুলোয় যাক অফিস। সে একা আর কত কাজ করবে?
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অস্বস্তি বোধ করছে সরলা। সে টের পাচ্ছে দীপংকরের রাগ। কিন্তু আজকের দিনটাতে উনি রাগ না করলেই পারতেন!
সে আস্তে আস্তে বলল, আমি ভেবেছিলাম, আপনার বন্ধুর কাছ থেকেই আপনি সব জানতে পারবেন।
কী?
দিলীপবাবু নিজেই আপনাকে সব খুলে বলবেন!
কিন্তু দিলীপের তো বউ আছে।
ওদের মধ্যে অনেকদিন বনিবনা নেই!
দীপংকর বিশ্বাসই করতে পারছে না কথাটা। এ কখনো হতে পারে? দিলীপের স্ত্রী। সুতপাকে সে চেনে। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে, দেখতেও ভালো—ওদের তো বেশ সুখী মনে হয়েছিল।
কী করে বিয়ে হবে? ওদের কি ডিভোর্স হয়ে গেছে?
আমারই মতন। এখন সেপারেশন চলছে, আগামী মাসেই—
দিলীপের তো দু-টি ছেলে-মেয়ে আছে।
তা থাক-না। তাতে তো কোনো ক্ষতি নেই।
মিসেস বিশ্বাস, একজনের সংসার ভেঙে, আর একটা সংসার গড়লে, সে-সংসার নিয়ে কি সুখী হওয়া যায়? সুতপার সঙ্গে দিলীপের সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে—আমাদের মতন পরিবারে ওরকম হয়ই, কিন্তু সেটা শোধরাবার চেষ্টা করাই কি উচিত নয়? হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় একটা কিছু করে ফেলাই কি ঠিক? এ-দিকটা একবারও ভাববেন না? বিশেষ করে ওদের ছেলে-মেয়ে দুটোর কথা
দীপংকরের কথাগুলো গুরুগম্ভীর উপদেশের মতো শোনালো। সরলা চট করে উত্তর দিল, একটু সময় নিল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, মিস্টার ব্যানার্জি আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে সব জায়গায় এক নিয়ম খাটে না। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই আমি জানি, এক বাড়িতে, এক সংসারে, একই ঘরে থেকে নিত্য তিরিশ দিন ঝগড়া করার চেয়ে আলাদা হয়ে যাওয়া অনেক ভালো। তাতে ছেলে-মেয়েদেরও ক্ষতি হয় না। উপকারই হয়। বাপ-মাকে রোজ রোজ ঝগড়া করতে দেখলে কী ছেলে-মেয়েদের খুব একটা ভালো লাগে বলতে চান? অনেক সময় সেটা তাদের জীবনের ওপর ছাপ ফেলে দেয়। আমরা অনেক ভেবেচিন্তেই এটা ঠিক করেছি। দিলীপবাবু ভীষণ অসুখী ছিলেন…
সরলাকে একসঙ্গে এতকথা বলতে কোনোদিন শোনেনি দীপংকর। সে বুঝতেই পারল, তার যতই আপত্তি থাক, ওরা বিয়ে করবেই। একসঙ্গে তার মনের ওপর দিয়ে অনেক কথা খেলে গেল। দিলীপ তাহলে সত্যি বিয়ে করছে! দীপংকরের ধারণা ছিল, দিলীপ শুধু বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে সুখের খেলা খেলে বেড়ায়, কারুর দায়িত্ব নিতে চায় না। …একবার বিয়ে ভেঙে আবার বিয়ে করা—এতবড়ো একটা ঝামেলার কাজ দীপংকর নিজে কখনোই পারত না। …বিয়ের পর সরলা আর চাকরি করবে না। সরলা ছাড়া এই ঘরটা…। তার ওপর যত কাজ দিয়ে নির্ভর করা যায়, সেরকম কি আর কারুকে..। কিংবা চাকরি করতেও পারে। মেয়েরা একবার চাকরিতে ঢুকলে সহজে ছাড়তে চায় না। আসবে সরলা এই ঘরে… কিন্তু তখন সে দিলীপের স্ত্রী। এ-ঘরে দরজা বন্ধ…সে কি তখনও সরলাকে যখন-তখন কাজের জন্য অনুরোধ করতে পারবে?
দীপংকর জোরে বলে উঠল না, এ হতেই পারে না।
বলে সে নিজেই চমকে উঠল। এ কী বলছে সে? এরকমভাবে কখনো বলা যায়? এটা তো দিলীপ আর সরলার নিজস্ব ব্যাপার। ওরা তো ছেলেমানুষ নয়!
রুমাল দিয়ে মুখ মুছে সে বলল, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝেসুঝেই করেছেন, আমার এতসব কথা বলা উচিত নয়।
তবু দীপংকর নিজেকে সামলাতে পারছে না। তার রাগ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, সরলা বিয়ে করে চলে যাবে এই ঘর থেকে—এটা যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। এখন সে বুঝতে পারছে, সরলা একটুক্ষণ ঘরের বাইরে থাকলে কেন সে ছটফট করত। তার ইচ্ছে হল, সে সরলার হাত জড়িয়ে মিনতি করে বলে, সরলা, তুমি দিলীপকে বিয়ে কোরো না! তুমি আর যাকে খুশি বিয়ে করো, এই অফিসের কারুকে নয়। তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না!
কিন্তু একথা দীপংকর বলতে পারে না। সরলা তার কে? সামান্য একজন কর্মচারী মাত্র। একজনের বদলে আর একজন আসবে। সে তো সরলাকে এতদিনের মধ্যে একবারও অন্তরঙ্গ সুরে কোনো কথা বলেনি। অভিমানে দীপংকর মুখ গোঁজ করে রইল।
আপনি উঠুন না, আমি চটপট শেষ করে দিচ্ছি।
না, ঠিক আছে।
আপনি উঠুন-না, আমি চটপট শেষ করে দিচ্ছি।
শিশুর মতন জেদ ধরে দীপংকরও বলল, বলছি তো, দরকার নেই!
আসলে দীপংকর বলতে চাইল, এরপর থেকে আমাকেই সব করতে হবে। আমি আর কোনো স্টেনোগ্রাফারকে আমার ঘরে বসাব না।
সরলা একদম কাছে এসে খুব নরম গলায় বলল, মি. ব্যানার্জি আপনি রাগ করবেন না। আমি চিঠিগুলো এক্ষুনি—
সরলার খোলা চুল, পুরো হাত ব্লাউজ, তার শরীরের মৃদু গন্ধদীপংকরের এত কাছে! সরলার যে একটা আলাদা ধরনের রূপ আছে, তা যেন দীপংকর আগে কখনো লক্ষ করেনি। এই মেয়েকে তার কাছ থেকে অন্য একজন কেড়ে নিয়ে যাবে? … না, না, কেড়ে তো নিচ্ছে না, দিলীপ রীতিমতন আইনসম্মত ভাবে বিয়ে করছে—এতে দীপংকর কোনোরকম বাধা দিতে পারে না। তবু রাগে দীপংকরের কপালের দু-পাশের শিরা দপদপ করছে।
উঠে বাথরুমে যেতে গিয়ে দীপংকর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
দীপংকর নাটকীয় ঘটনা একদম পছন্দ করে না। অফিসের সব লোক এসেছে। ধরাধরি করে তাকে তুলছে, নানারকম সহানুভূতিসূচক মন্তব্য—জ্ঞান ফিরে আসার পর দীপংকর এসব একটুও পছন্দ করছে না। তার লজ্জা করছে। সে নিজেই উঠে দাঁড়াল। চোখে-মুখে জল ছেটাতে গিয়ে এরা তার জামা-প্যান্ট একদম ভিজিয়ে ফেলেছে! ভেতরে ভেতরে তার যে কবে এত ব্লাড-প্রেসার বেড়ে গেছে সে নিজেই জানে না। এখন কোনোরকম মানসিক উত্তেজনার কারণ ঘটানো একদম উচিত না।
দীপংকরের ইচ্ছে না থাকলেও অফিসের দু-জন সহকর্মী তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে এল।
একবার বেল দিতেও দরজা খুলল না, দ্বিতীয়বার বেশ জোরে বেল দিতেই দরজা খুলে দিল সুপ্রিয়া। এবং শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে এল ধূর্জটি।
দীপংকর এখন অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। নেহাত জামা আর প্যান্ট ভিজে গেছে এবং চুল এলোমেলো হয়েছে বলেই তার পক্ষে আর অফিসে থাকা সম্ভব ছিল না।
ধূর্জটিকে দেখে সে ভাবল, যাক, এসে গেছে তাহলে? আগেও এসেছে না এই প্রথম? তা জানবার উপায় নেই, কারণ দীপংকর তো কখনো এ সময় বাড়ি ফেরে না।
তবে, মনে হয় ধূর্জটি মাঝেমাঝেই দুপুরের দিকে আসে, সেইজন্যই কয়েকদিন ধরে সুপ্রিয়াকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল! যাক, সুপ্রিয়া তাহলে তার সময় কাটাবার জন্য উপযুক্ত একটা খেলনা পেয়েছে। এটা দীপংকরেরই কৃতিত্ব।
দীপংকর মনে মনে বলল, আমি কিন্তু গোয়েন্দাগিরি করতে আসিনি। ধূর্জটি আর সুপ্রিয়া কি সেইকথা ভাবছে? না, না, না, সত্যি, বিশ্বাস করো, আমি সত্যিই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। এ-রকম কখনো আমার হয় না। এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট।
ধূর্জটি অপ্রস্তুত মুখে দাঁড়িয়েছিল, দীপংকর তার সঙ্গে সহকর্মীদের আলাপ করিয়ে দিল, ইনি ধূর্জটি চৌধুরি, বিখ্যাত কবি—সম্পর্কে সুপ্রিয়ার দাদা হন।
বাড়িতে রাঁধুনি আর চাকরও নেই, মেয়েটাও নেই! সুপ্রিয়ার সঙ্গে রয়েছে অন্য একটি যুবকতার সঙ্গে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক খুঁজে বার করতেই হয়। অফিসের সহকর্মীরা তো সব ব্যাপারটা বুঝবে না!
রাঁধুনি আর চাকর, দু-জনকে একসঙ্গে কী করে বাইরে পাঠাল সুপ্রিয়া? বিশেষ কিছু দরকার পড়েছিল? ধূর্জটি বুঝি সম্পূর্ণ নির্জনতা চায়? ধূর্জটি হঠাৎ খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।
সবাই মিলে দীপংকরকে বলতে লাগল, আপনি এবার শুয়ে পড়ন গিয়ে।
দীপংকর কিছুতেই যেতে চায় না। সে তো এখন ভালো হয়ে গেছে। সে তো এখন অনায়াসেই গল্প করতে পারে অন্যদের সঙ্গে! ধূর্জটিকে সেই কবিতাটা পড়তে বলবে নাকি?
তারপরেই দীপংকর বুঝতে পারল। এখন বিছানায় শুয়ে পড়াই উচিত! নইলে তার অসুখটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। হয়তো কেউ ভাবতেও পারে, সে এমনিই অজ্ঞান হওয়ার ভান করেছিল!
সুপ্রিয়া পাশেই দাঁড়িয়ে! অসুখের ব্যাপারে সুপ্রিয়া কখনো বেশি আদিখ্যেতা করে না। সে জানে হুড়োহুড়ি-দৌড়োদৗড়ি কিংবা হা-হুতাশ করলে অসুখের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। সে এর মধ্যেই তাদের পারিবারিক ডাক্তারকে ফোন করে দিয়েছে। এখন অপেক্ষা করছে। ডাক্তারের জন্য। তার মুখে উদবেগের চিহ্নটা দীপংকর ছাড়া আর কেউ দেখতে পাবে না।
দীপংকর উঠে দাঁড়িয়ে সুপ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট গলায় বলল, সত্যি, এখনও একটু একটু মাথা ঘুরছে। আমার হাতটা ধরো তো!
অতিব্যস্ত সহকর্মী দু-জন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমরাও ধরছি, আমরাও ধরছি!
তিনজনে মিলে ধরাধরি করে দীপংকরকে নিয়ে গেল শোয়ার ঘরে।
বাইরের ঘরটায় ধূর্জটি দাঁড়িয়ে রইল অপ্রতিভ মুখে! এইসব অবস্থায় সে নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারে না। দীপংকর অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে সে কি তাকে সান্ত্বনা দেবে, না কোনো কথা বলবে? কী করতে হয় এই সময়ে?
আসলে কিছুই করার নেই। শোয়ার ঘরে একটা আলমারি এখনও খোলা। সুপ্রিয়া ধূর্জটির লেখা দুটো খুঁজে পায়নি। পুরোনো লেখা সম্পর্কে ধূর্জটির খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু আজ আর পাওয়ার আশা নেই! এখন ধূর্জটি চলে গেলেই পারে। ডাক্তার-টাক্তার আসবে, সবাই এখন ব্যস্ত থাকবে, সে তো উপস্থিত থেকেও বিশেষ কোনো সাহায্য করতে পারবে না।
ধূর্জটি চলে যেতেই চায়। তবু পারছে না। তার পা দুটো যেন পেরেক দিয়ে গাঁথা। খালি পা! এর মধ্যে সে বোকার মতন একটা কান্ড করে ফেলেছে। তাড়াহুড়োর মধ্যে সে তার চটিজোড়া সুপ্রিয়াদের শোয়ার ঘরেই ফেলে এসেছে। ঠিক খাটের নীচে। যে-খাটে এখন দীপংকর শুয়ে আছে। ধূর্জটি কি ওখান থেকে এখন চটিজোড়া আনতে যেতে পারে?
যদি দীপংকর অন্য কিছু ভাবে?