০১. সিনেমা হলের মধ্যে

সিনেমা হলের মধ্যে অন্ধকারেই পেছন দিক থেকে ছেলেটিকে একটু চেনা চেনা মনে। হয়েছিল। আলো জ্বলতে ভালো করে দেখা গেল। হ্যাঁ, ধূর্জটিই।

সেই আগের মতনই রোগা আর লম্বা মাথাভরতি ঘন এলোমেলো চুল, কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ। চেহারায় এমন কিছু বৈশিষ্ট্য নেই, শুধু লম্বা বলেই ভিড়ের মধ্যেও অনেক দূর থেকে চোখে পড়ে।

দীপংকর সুপ্রিয়াকে বলল, ওই দেখো, ধূর্জটি বসে আছে ওখানে।

সুপ্রিয়া খুব একটা উৎসাহ দেখালো না। বলল, তাই নাকি? ডান দিকে দেখো, তিনটে রো সামনে–

সুপ্রিয়া সংক্ষিপ্তভাবে বলল, ও–

দীপংকর স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝবার চেষ্টা করল, সুপ্রিয়া আগেই ধূর্জটিকে দেখেছে কি না। হয়তো দেখেও প্রকাশ করেনি।

ডাকবে ওকে?

কেন, ডেকে কী হবে?

দীপংকর হেসে বলল, কেন, ডাকি-না! অনেকদিন তো দেখা হয়নি ওর সঙ্গে।

সুপ্রিয়াও এবার স্বামীর মুখের দিকে একবার তাকাল। তারপর নিরুত্তাপ গলায় বলল, তোমার ইচ্ছে হলে ডাকতে পার!

দীপংকরের সত্যিই ডাকতে ইচ্ছে করল। ছেলেটি সম্পর্কে তার আগ্রহ আছে। সে নিজে যে জগতে ঘোরে, যাদের সঙ্গে মেলামেশা করে, সেখানে ধূর্জটির মতো ছেলের দেখা পাওয়া যায় না। এদের কথাবার্তার ধরনই অন্যরকম।

কিন্তু সেই মুহূর্তেই ধূর্জটি উঠে গেল বাইরে। সঙ্গে তার আরও দু-তিনজন বন্ধু। সে এদিকে একবারও তাকাল না। একবারও তাকাল না বলেই, দীপংকরের মনে হল, সম্ভবত ধূর্জটিও দেখেছে তাদের। দেখলেও সে নিজে থেকে কিছুতেই কথা বলবে না। দীপংকরের ঠোঁটে একটা কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল।

মুখ না ফিরিয়েই দীপংকর সূক্ষ্মভাবে তার স্ত্রীর মুখের ভাব লক্ষ করার চেষ্টা করল। সুপ্রিয়া মুখ নীচু করে বসে আছে, কী যেন ভাবছে। ও কি ধূর্জটির কথাই ভাবছে? অনেকদিন বাদে দেখা হলে এ-রকম তো হয়ই।

সুপ্রিয়া মুখ তুলে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে বলল, দিলীপবাবুর ছেলেটি কেমন আছে আজ?

দীপংকর একটু চমকে উঠল। কথাটা বুঝতে তার একটু সময় লাগল। তারপর আবছাভাবে বলল, দিলীপের ছেলে, ও হ্যাঁ, আজ তো আর খবর নেওয়া হয়নি। আজ ওকে দেখিনি।

সুপ্রিয়া উদবিগ্নভাবে বলল, আজ উনি অফিসে আসেননি?

হ্যাঁ এসেছে, দূর থেকে দেখেছিলাম একবার।

কাল ছেলেটার এক-শো চার জ্বর উঠেছিল।

আজ ভালোই আছে বোধ হয়। না হলে ঠিকই খবর পেতাম। বাচ্চাদের ওরকম হয়।

ধূর্জটি ফিরল আবার অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর। দীপংকর তার দিকে নজর রেখেছে। ধূর্জটি অন্ধকারের মধ্যেও এদিকে দেখল না।

তখন দীপংকরের মনে হল, সে কেন ইন্টারভ্যালে বাইরে গেল না? সিগারেট টানার জন্য সেও তত বাইরে যেতে পারত সুপ্রিয়াকে বসিয়ে রেখে। তাহলে ধূর্জটির সঙ্গে দেখা হতই। ধূর্জটি কি তাকে দেখে না-চেনার ভান করবে? মনে হয় না।

ছবি শুরু হয়ে গেছে। এমন জমাট গল্প যে, মগ্ন না হয়ে পারা যায় না। কোথা দিয়ে কেটে গেল দু-ঘণ্টা।

ছবি ভাঙতেই দীপংকর ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সুপ্রিয়াকে বলল, তাড়াতাড়ি এসো, শেষে বেশি ভিড় হয়ে যাবে।

নিজেই সে ভিড় ঠেলেঠুলে আগেভাগে এসে দাঁড়িয়ে রইল গেটের কাছে। ঠোঁটে সিগারেট এবং হাসি।

ধূর্জটি আসছে তার বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে। অন্য কোনো দিকে সে দেখতেই পাচ্ছে না। সুপ্রিয়া স্বামীকে বলল, দাঁড়িয়ে রইলে কেন, যাবে না?

দীপংকর বলল, দাঁড়াও-না, এত তাড়াতাড়ির কী আছে?

তুমিই তো ভিড়ের ভয়ে আগে বেরিয়ে আসতে চাইলে!

দীপংকর সে-কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে রইল তীক্ষ্ণভাবে।

ধূর্জটি কাছাকাছি আসতেই সে প্রায় সামনাসামনি দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, কী খবর? ধূর্জটি কি চমকে উঠল? অন্তত সেরকম কোনো ভাব দেখালো না। মুখ তুলে দীপংকরকে দেখে সে খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, আপনার কী খবর? ভালো? ছবিটা কেমন লাগল?

দীপংকর বলল, সুপ্রিয়াও এসেছে।

ধূর্জটি সুপ্রিয়ার দিকে ভালো করে তাকালও না। আলগাভাবে বলল, কী খবর? তরপরই আবার তাকাল দীপংকরের দিকে। অদূরে তার বন্ধুরা দাঁড়িয়ে। সে একটু চঞ্চল ভাব দেখিয়ে বলল, আচ্ছা চলি।

একটু দাঁড়ান-না। আমরা কোথাও বসে একটু চা-টা খাব ভাবছি। আপনিও আসুন-না।

ধূর্জটি বলল, আপনারা যান। আমার সঙ্গে বন্ধুরা আছে।

আপনার বন্ধুদেরও ডাকুন। ওঁরাও রাইটার নিশ্চয়ই। একটু আলাপ করতাম।

বন্ধুরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ধূর্জটিকে দেখছে। ধূর্জটি যেন লজ্জা পাচ্ছে একটু। বন্ধুদের চোখের সামনে কোনো সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে অনেকেই লজ্জা পায়।

সুপ্রিয়া বিরক্তভাবে বলল। এখন আবার কোথায় চা খাব?

তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে-না? বুলান একলা আছে।

দীপংকর উদারভাবে বলল, তাহলে সবাই মিলে আমাদের বাড়িতে গিয়েও চা খাওয়া যেতে পারে। চলুন, তাই চলুন।

বন্ধুর মতন সে ধূর্জটির পিঠে হাত রেখে চাপ দিল। ধূর্জটির যেন একটু আপত্তি করার ইচ্ছে কিন্তু দীপংকর তাতে আমলই দিল না।

ধূর্জটির বন্ধু তিনজনের সঙ্গে আলাপ হল। কিন্তু তাদের অন্য কাজ আছে, তারা এখন দীপংকরের বাড়িতে যেতে পারবে না। তাদের মধ্যে একজন, যার নাম প্রতুল সেনগুপ্ত, সে শুধু দীপংকরের গাড়িতে এলগিন রোড পর্যন্ত লিফট নিতে রাজি হল।

গাড়ি চালাচ্ছে দীপংকর। সুপ্রিয়া বসেছে পেছনের সিটে। ধূর্জটি আর প্রতুল দু-জনেই সামনের দিকে উঠতে যাচ্ছিল, দীপংকর তাড়াতাড়ি বলে উঠল, এ কী, আপনারা দুজনেই গাদাগাদি করে সামনে বসছেন কেন? একজন পেছনে বসুন?

প্রতুল আর ধূর্জটির মধ্যে, কে সামনে বসবে? দুই বন্ধু পরস্পরকে ঠেলাঠেলি করতে লাগল। প্রতুল আগে নেমে যাবে, সুতরাং সে-ই জোর করে সামনের সিটে উঠল। তখন অবশ্য ধূর্জটি আর মোটেই আড়ষ্টতা না দেখিয়ে বেশ সপ্রতিভভাবে উঠে বসল সুপ্রিয়ার পাশে। এবং সিগারেট ধরালো।

প্রতুল বলল, আমাকে পার্ক স্ট্রিট আর ক্যামাক স্ট্রিটের মোড়ে নামিয়ে দিলেই হবে।

দীপংকর অবশ্য ওই পথ দিয়ে যেত না, একটু ঘোরা হয়, তবু আপত্তি করল না। নামবার সময় প্রতুল শেষবার সুপ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে যেন দু-চোখ দিয়ে গিলে গেল।

গাড়িতে ধূর্জটি প্রায় নি:শব্দ। দীপংকর নানা প্রশ্ন করছে, সে হুঁ-হাঁ বলে যাচ্ছে শুধু। সুপ্রিয়া সারাক্ষণ তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে।

গলফ ক্লাব রোডে দীপংকরের ফ্ল্যাট। অফিস থেকে ভাড়া দেয়, ফ্ল্যাটটি বেশ বড়ো এবং সাজানো-গুছোনো। সুপ্রিয়া কিছুদিন আর্টস্কুলের ছাত্রী ছিল। এসব ব্যাপারে তার আলাদা রুচি আছে।

ওদের একটি মাত্র মেয়ে, বয়েস চার। রাঁধুনি আর চাকরের কাছেই সে দিব্যি থাকে।

দীপংকর আর ধূর্জটি রইল বসবার ঘরে। সুপ্রিয়া চলে গেল ভেতরে। ধূর্জটি একটু আড়ষ্ট, একবার সে পায়ের ওপর পা তুলছে, পরক্ষণেই আবার দু-পা সোজা করছে। সোফার পাশেই ছোটো টিপয়ের ওপর রাখা বেশ দামি ধরনের সুন্দর কারুকাজ করা পেতলের বাটিটা অ্যাশট্রে কি না তা বুঝতে পারছে না বলেই সে সিগারেট ধরাতে পারছে না।

দীপংকর জিজ্ঞেস করল, আপনি আমাদের এবাড়িতে তো আগে আসেননি, না?

অকারণেই একটু চমকে উঠে ধূর্জটি বলল, না তো!

আপনি আমাদের ভবানীপুরের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন বোধ হয়।

হ্যাঁ, দু-একবার। রণজয়ের সঙ্গে। রণজয় এখন কোথায়?

ও তো মুম্বাইতে আছে। আপনার সঙ্গে যোগাযোগই নেই?

না। অনেকদিন…

রণজয় সুপ্রিয়ার মাসতুতো ভাই। তার বন্ধু হিসেবেই ধূর্জটি প্রায়ই আসত সুপ্রিয়াদের বাড়ি। বিয়ের আগে দীপংকর মাত্র দু-তিনবার গিয়েছিল সুপ্রিয়াদের বাড়ি। প্রত্যেকবারই সে রণজয়ের সঙ্গে ধূর্জটিকেও দেখেছে সেখানে। তার হাবভাব দেখে মনে হত, সে প্রায় বাড়ির ছেলের মতন। কিংবা তার চেয়েও বেশি। সুপ্রিয়াকে বিয়ে করার খুবই ইচ্ছে ছিল ধূর্জটির, সে-কথা দীপংকর জানে। বিয়ে শেষপর্যন্ত না হোক, তবু ভালোবেসেছিল তো! সুপ্রিয়া আধুনিক কালের বুদ্ধিমতী মেয়েদের মতন বিয়ের আগে সামান্য প্রেম-ট্রেম করে শেষপর্যন্ত বিয়ে করেছে পাত্র হিসেবে যে যোগ্যতর, সেই দীপংকরকেই।

প্রাক্তন প্রেমিকার স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে কীরকম লাগে? রাগ হয়! ধূর্জটি কি এখনও রেগে আছে দীপংকরের ওপর? দীপংকর কিন্তু ওর সঙ্গে ভাব জমাতেই চায়। তার কোনোরকম ইচ্ছে ছিল না ধূর্জটির মনে আঘাত দেওয়ার। সে তো সুপ্রিয়াকে জোর করে বিয়ে করেনি। সুপ্রিয়াই নিজে থেকে রাজি হয়েছিল।

দীপংকর বলল, গতমাসে আপনার একটা কবিতা বেরিয়েছিল-না অমুক পত্রিকায়? আমি পড়েছি, আমার খুব ভালো লেগেছে।

ধূর্জটি লাজুকভাবে মুখ দিয়ে কী একটা শব্দ করল, ঠিক বোঝা গেল না। দীপংকর বলল, আমরা অতিসাধারণ লোক, সাহিত্য-টাহিত্য বিশেষ বুঝি না, তবু পড়ি, যেটা ভালো লাগে।

দীপংকর পড়াশুনোয় ছিল ব্রিলিয়ান্ট। চিরকাল ভালো রেজাল্ট করেছে। এবং অতিসহজে খুব ভালো চাকরি পেয়েছে বিলিতি কোম্পানিতে। অফিসের কাজে তাকে দু-বার বিলেত যেতে হয়েছে। এইরকম সাধারণ লোক সে।

আর ধূর্জটি তখন থাকত উত্তর কলকাতায়। খুব সাধারণ পরিবারের ছেলে। পড়াশুনোতও তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয়। সেইসময় ধূর্জটি কোনো চাকরিও করত না। চেষ্টা করেও পায়নি। কিন্তু কবিতা লিখে খানিকটা নাম-টাম হয়েছিল।

আপনি নতুন কী লিখছেন?

ধূর্জটি বলল, বিশেষ কিছু না। আপনি, ইয়ে, এত কাজের মধ্যেও কবিতা পড়ার সময় পান, সেটাই তো আশ্চর্য!

সবসময় শুধু কাজ নিয়ে থাকলে কী মানুষ বাঁচতে পারে? আপনার কবিতাটা আমিই সুপ্রিয়াকে পড়ালাম। ওর তো আজকাল পড়া-টড়ার অভ্যেসই চলে গেছে প্রায়, মেয়েকে নিয়েই সবসময় ব্যস্ত।

সুপ্রিয়ার প্রসঙ্গে ধূর্জটি একটাও কথা বলবে না যেন ঠিক করেছে। দীপংকর খুব ভালো করে লক্ষ করতে লাগল ধূর্জটিকে। সুপ্রিয়ার নাম শুনে মুখের একটা রেখাও কি কাঁপবে না?

ব্যর্থ প্রেমিকদের মনের ভাব কীরকম হয়, তা দীপংকর জানে না। সে কখনো প্রেমে ব্যর্থ হয়নি। সে জীবনে, প্রায় সব ব্যাপারেই সার্থক। কিন্তু একটা ব্যাপারে ধূর্জটি এখন তার থেকে বেশি উল্লেখযোগ্য। ধূর্জটি আজও প্রেমিক, আর দীপংকর স্বামী। গল্প-উপন্যাস-নাটকে স্বামীদের তুলনায় প্রেমিকরাই অনেক বেশি প্রাধান্য পায়।

চাকর এসে ট্রে-তে করে চা দিয়ে যাওয়ায় দীপংকর একটু বিরক্ত হল। ধূর্জটিকে বলল, আপনি বসুন, আমি এক্ষুনি আসছি।

ভেতরের ঘরে এসে দেখল সুপ্রিয়া বিছানায় শুয়ে পড়ে মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে। দীপংকর ফিসফিস করে বলল, এই, তুমি একবার আসবে না ওঘরে? ছেলেটা বসে আছে, ওর সঙ্গে একটু কথা-টথা বলবে না?

তুমি ডেকে এনেছ, তুমিই কথা বলো।

আমি তো বলছিই এতক্ষণ ধরে। তুমি একবারটি এসো।

আমি বুলানকে ঘুম পাড়াচ্ছি।

দীপংকর মুখ নীচু করে বিছানার কাছে এসে মেয়েকে দেখে বলল, ও তো ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। তুমি একবারটি এসো।

তুমি যাও, আমি যাচ্ছি।

দীপংকর বসবার ঘরে ফিরে এসে দেখল, ধূর্জটি তখনও চায়ের কাপ ছোঁয়নি। দীপংকর বলল, নিন চা নিন। সুপ্রিয়া আসছে, মেয়েকে ঘুম পাড়িয়েই আসছে। মেয়ে আবার মায়ের হাতের চাপড়ানি না পেলে কিছুতেই ঘুমোতে চায় না।

কত বয়েস হল আপনাদের মেয়ের?

চার বছর।

বিয়ে হয়েছে সাত বছর আগে। ধূর্জটির নিশ্চয়ই মনে আছে সে-কথা। ধূর্জটি কি বিয়ে করেছে এর মধ্যে? খুব সম্ভবত না, তাহলে নিশ্চয়ই কানে আসত খবরটা। ব্যর্থ প্রেমিক হয়ে ধূর্জটি কি ঠিক করেছে যে সে আর বিয়েই করবে না? তাহলে ব্যাপারটা খুব দুঃখের হবে।

বিয়ে করেনি বলেই বোধ হয় ধূর্জটিকে এখনও বেশ ছোকরা ছোকরা দেখায়। দীপংকরের চেয়ে সে মাত্র বোধ হয় বছর দু-একের ছোটো। অথচ স্বামী বলেই দীপংকর এখন রীতিমতন দায়িত্বশীল পুরুষমানুষ।

বাইরের শাড়ি পালটে একটা ঘরোয়া শাড়ি পরে এসে বসল সুপ্রিয়া। খুব সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ, ধূর্জটিদা? তোমাদের বাড়ির সবার খবর কী?

দীপংকর একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হল। সুপ্রিয়া আগেও ধূর্জটিকে তুমি-তুমিই বলত। এখন যদি আবার আপনি বলা শুরু করত, তাহলে ব্যাপারটা খুব বোকার মতন হত। তবে আগে কি ধূর্জটিদা বলত, না শুধু ধূর্জটি? যদিও মাসতুতো ছোড়দার বন্ধু, তবু মেয়েরা আজকাল আর প্রেমিকদের দাদা বলে না। বিয়ের আগে দীপংকরের সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল সুপ্রিয়ার, তখন দীপংকরের নাম ধরে ডাকেনি, দাদাও বলেনি। খানিকটা দূরত্ব রেখে বলত, দীপংকরবাবু।

ধূর্জটি ভালো করে তাকাতে পারছে না সুপ্রিয়ার দিকে। দীপংকরের মায়া লাগল। আহা, অনেকদিন পর আবার দেখা হল প্রেমিকার সঙ্গে, তাকে চোখভরে দেখবার ইচ্ছে হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রেমিকার স্বামী উপস্থিত থাকলে আর সেরকম প্রাণ ভরে দেখা যায়? ধূর্জটির কি বুক কাঁপছে? সুপ্রিয়ার কোনো ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না অবশ্য। মেয়েদের অভিনয় ক্ষমতা অনেক বেশি।

দীপংকরের মনে হল, সে একটা অসম প্রতিযোগিতায় ধূর্জটিকে হারিয়ে দিয়েছে। যেহেতু বেচারা একটা ভালো চাকরি করে না, কবিতা-টবিতা লেখে, তাই সমাজে তার সেরকম দাম নেই। কিন্তু ভালোবাসার ক্ষমতা ওর হয়তো অনেক বেশি। ও সুপ্রিয়াকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারে, যা অনেক লোেক পড়বে। সে-ক্ষমতা কি দীপংকরের আছে? ধূর্জটির মতন সাজিয়ে সাজিয়ে সুন্দর কথা বলার ক্ষমতাও তার নেই।

এখন অবশ্য ধূর্জটি প্রায় কথাই বলছে না, সুপ্রিয়া কথা বলছে।

আজ যে সিনেমাটা দেখে এল সেই বিষয়ে। নিশ্চয়ই ওদের দুজনেরই অন্য কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে।

দীপংকর বলল, চা-টা ঠিক জমল না, কী বলেন?

ধূর্জটি বলল, না, না, ঠিকই তো আছে।

সুপ্রিয়া বলল, আর এক কাপ করে আনব?

দীপংকর বলল, না, চা থাক। আপনি একটু হুইস্কি খাবেন ধূর্জটিবাবু? আমার কাছে স্কচ আছে।

ধূর্জটি বলল, হুইস্কি, মানে, না থাক, আমি একটু বাদেই উঠব।

আরে মশাই, বসুন-না। আপনি খান তো হুইস্কি!

খাই, তবে এখন ঠিক…

সুপ্রিয়া ধূর্জটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিও এইসব অভ্যেস করেছ নাকি?

দীপংকর হা-হা করে হেসে বলল, দেখেছেন তো, সুপ্রিয়া এখনও টিপিক্যাল বাঙালি মেয়ে রয়ে গেছে—এখনও ঠিক মেনে নিতে পারেনি—আজকাল কে না খায়? বেশি না খেলেই হল!

দীপংকর স্কচের বোতল আর গেলাস নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখল, তারপর চাকরের উদ্দেশে হাঁক দিয়ে বলল, এই সুখেন, এক বোতল জল দিয়ে যা আর খানিকটা বরফ।

চাকর জল দেওয়ার আগেই দীপংকর আবার ব্যস্ত হয়ে উঠে গেল। একটা প্লেটে করে নিজেই নিয়ে এল খানিকটা কাজুবাদাম।

সুপ্রিয়া একটু বিস্মিতভাবে তাকিয়ে আছে স্বামীর দিকে। দীপংকরের কাছে দু-তিন বোতল মদ রাখা থাকে—মাঝে মাঝে সে একটু-আধটু খায়। বেশিরভাগই অফিসের লোকদের সঙ্গে। এই ব্যাপারেও তার একটা নীতি আছে। বন্ধুস্থানীয় বা নিজের সমান মর্যাদাসম্পন্ন অফিসের লোকেদের সে দেয় দেশি হুইস্কি, আর খুব হোমরাচোমরা কেউ এলে, সে দেয় স্কচ। তবে হঠাৎ ধূর্জটির সামনে সে আজ দামি স্কচ বার করল কেন? ধূর্জটিকে সে হকচকিয়ে দিতে চায়?

দু-টি গেলাসে স্কচ ঢেলে, জল ও বরফ মিশিয়ে সে একটা তুলে দিল ধূর্জটির হাতে। তার গেলাস উঁচু করে বেশ উৎফুল্লভাবে বলল, চিয়ার্স! অনেকদিন জমিয়ে আড্ডা হয় না। অফিসের লোকের সঙ্গে কি আড্ডা হয়?

ধূর্জটি এখনও আড়ষ্ট হয়ে আছে। তার খুব একটা আড্ডা জমাবার মতন মেজাজ নেই মনে হচ্ছে। যদিও বিয়ের আগে দীপংকর দেখেছে ধূর্জটিকে দারুণ হইহই করতে। নিজের স্ত্রীর বদলে সে সর্বক্ষণ ধূর্জটিকেই লক্ষ করছে শুধু। ধূর্জটি বোধ হয় ভাবছে, দীপংকর তাকে কোনোরকম সুযোগ দেবে না?

নিজের গেলাসে সামান্য একটু চুমুক দিয়ে হঠাৎ বলল, আপনারা একটু বসুন, গল্প করুন। আমি চট করে স্নানটা সেরে আসি। রাত্রে বাড়ি ফিরেই স্নান না করলে আমি সুস্থির থাকতে পারি না। বরাবরের অভ্যেস ধূর্জটিবাবু। আপনার গেলাস শেষ হলে নিজেই ঢেলে নেবেন কিন্তু।

ধূর্জটিকে কিছু বলতে না দিয়ে সে চট করে চলে গেল, নিজের গেলাসটা হাতে নিয়েই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *