দুটো বাথরুম। একটা বাইরের দিকে, আর একটা শয়নকক্ষ সংলগ্ন। সে গেল দ্বিতীয়টায়। অনেক দূরে, এখান থেকে বসবার ঘরের কোনো কথাই শুনতে পাওয়ার উপায় নেই।
বাথরুমে ঢুকে সে কাচের তাকের ওপর গেলাসটা রাখল। তারপর সিগারেট ধরালো একটা। স্নান করার বিশেষ তাড়া নেই। ধীরেসুস্থে বেরোলেই হবে। ওদের খানিকটা সময় দেওয়া যাক। এতদিন পরে দেখা দু-জনের কিছু কী অন্তরঙ্গ কথা হবে না?
দীপংকরের মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে। অনেকদিন পরে সে যেন সুপ্রিয়ার জন্য একটা দামি খেলনা এনে দিয়েছে। দায়িত্ববান স্বামী হিসেবে সে সুপ্রিয়াকে অনেক কিছু দিতে পারে, শুধু খেলার সময় বা সঙ্গী দিতে পারে না। দীপংকরকে সকাল ন-টার মধ্যে অফিসে বেরিয়ে যেতে হয়। বিলিতি কোম্পানি, উপস্থিতির সময়ের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি আছে। অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে সাতটা-আটটা হয়ে যায় প্রায়ই। যারা ভালো মাইনে দেয়, তারা খাটিয়েও নেয়। এর পরেও অফিসের লোকজন প্রায়ই বাড়িতে আসে, তখনও অফিসের কথাই হয়। অফিসের লোকের সঙ্গে অন্য কোনো গল্প জমে না। তা ছাড়া অফিসের কাজে দু তিনদিনের জন্য প্রায়ই বাইরে যেতে হয়, সেসময় সুপ্রিয়া একদম একলা থাকে।
সুপ্রিয়াকে দীপংকর সুখ-সাচ্ছন্দ্যের উপকরণ সবই তো দিয়েছে। সুন্দর ফ্ল্যাট, দু-জন কাজের লোক, বসবার ঘরে কার্পেট, মাসে দু-তিনটে শাড়ি কেনার মতো হাতখরচ। যেকোনো শখের জিনিসও কিনতে পারে সুপ্রিয়া, আত্মীয়স্বজনকে যতখুশি উপহার দিতে পারে। শুধু দু-জনে একসঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারে না। সকালটা তো ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে যায়, রাত্রে দু-তিন ঘণ্টামাত্র কথা বলার সময়, তখনও যত রাজ্যের কাজের কথা আর ঘরোয়া সংসারের কথাই হয়। মাসে বড়জোর দু-তিনদিন শারীরিক মিলন আর কোনো কোনো শনিবার একসঙ্গে সিনেমা।
সারাদিন সুপ্রিয়া একা থাকে। ছোটো সংসার, কাজ খুব সামান্য, তার কাটবে কী করে? এই নিয়ে সুপ্রিয়া কখনো তেমন অভিযোগ করেনি বটে, কিন্তু দীপংকর বোঝে। সবরকম আরাম পেলেও মানুষের মনের ক্ষুধা মেটে না।
বছরে অন্তত একবার ওরা বাইরে কোথাও বেড়াতে যায়। দীপংকর একটা জিনিস বুঝতে পারে, বিয়ের পর প্রথম দু-এক বছর সুপ্রিয়াকে নিয়ে বাইরে কোথাও বেড়াতে গিয়ে যে রোমাঞ্চ, যে উন্মাদনা পেয়েছে, এখন আর সেরকম স্বাদ পাওয়া যায় না। সেখানে গিয়েও সংসারের কথা হয়, কিংবা এক-এক সময় কোনো কথাই খুঁজে পাওয়া যায় না। মনে হয়, আর একজন কেউ সঙ্গে থাকলে যেন ভালো হত, তাহলে কথাবার্তা অনেক সহজ হয়ে যেত। সুপ্রিয়াও নিশ্চয়ই এটা অনুভব করে, কিন্তু মুখে স্বীকার করবে না। গতবছরই তো দার্জিলিং যাওয়ার সময় দীপংকর প্রস্তাব করেছিল, অফিসের দেবনাথ আর তার স্ত্রীকে সঙ্গে নেওয়ার। সুপ্রিয়াও একটুও আপত্তি করেনি, আগ্রহের সঙ্গে রাজি হয়েছিল।
ওরা এখন কি কথা বলছে? নাকি পরস্পরের দিকে অপলকভাবে চেয়ে চুপ করে বসে আছে? ধূর্জটি সুপ্রিয়ার জন্য একসময় পাগল হয়েছিল, কিন্তু সুপ্রিয়া তাকে কতখানি ভালোবেসেছিল তা অবশ্য বোঝা যায়নি। বিয়ের ঠিক পরেই ধূর্জটির প্রসঙ্গ কখনো উঠলেই, সুপ্রিয়া হেসে বলত, ও তো একটা পাগল! কোনোরকম বাস্তব বুদ্ধি নেই। সবসময় শুধু স্বপ্ন দেখছে! দীপংকর জানে, পৃথিবীতে এইরকম কিছু পাগলেরও দরকার আছে। না-হলে কারা কবিতা লিখবে! কারা ছবি আঁকবে?
এই, তোমার হয়েছে?
তার দেরি দেখে সুপ্রিয়া ডাকতে এসেছে। দীপংকর ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, আসছি।
এবার তাড়াতাড়ি স্নান সেরে সে বেরিয়ে এল। দীপংকর রীতিমতন সুপুরুষ, তার চেহারায় একটি নিখুঁত পারিপাট্য আছে। মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা ছাড়া তার শরীরে কোনো ব্যাধি নেই। ডাক্তার অবশ্য বলেছে, ওই চিনচিনে ব্যথাটাও মানসিক। সব পুরুষমানুষের বুকেই ওইরকম ব্যথা থাকে। তার নিজের বন্ধুই ডাক্তার, দীপংকরের স্বাস্থ্যকে সে হিংসে করে।
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে সে বসবার ঘরে এসে দেখল, ধূর্জটি সেই এক গেলাসই শেষ করেনি।
দীপংকরকে দেখেই সে বলল, আমি এবার উঠব।
বসুন-না। আর একটু বসুন। আপনি এখন কোথায় থাকেন?
কালীঘাটে।
তবে তো খুব বেশি দূর নয়। চলে আসবেন মাঝে মাঝে। এদিকে এলেই, যেকোনো সময় চলে আসবেন।
ধূর্জটি প্রায় অস্ফুটভাবে বলল, আচ্ছা!
নিন আপনার গেলাস শেষ করুন। সেই একটা নিয়েই বসে আছেন দেখছি।
দীপংকর নিজের গেলাস এক চুমুকে শেষ করল। তার মনে হল, ধূর্জটি নিশ্চয়ই তার প্রেমিকার সামনে বসে মদ খেতে লজ্জা পাচ্ছে। আগে নিশ্চয়ই সে সুপ্রিয়ার সামনে কখনো মদ খায়নি।
দীপংকর ধূর্জটির গেলাসের সামনে আবার বোতলটা আনতেই ধূর্জটি গেলাসের ওপর হাত চাপা দিল। বলল, না, না, আমাকে আর না!
সে কী!
সুপ্রিয়া বলল, কেন, মদ ছাড়া বুঝি আর আড্ডা হতে পারে না?
দীপংকর বলল, ঠিক আছে, এমনিই গল্প করা যাক।
কিন্তু আর বেশিক্ষণ ধূর্জটি বসতে চাইল না। দীপংকর তাকে সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এল। এবং অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আবার বলল, আবার আসবেন কিন্তু, যখন ইচ্ছে হয় চলে আসবেন। আমরা সাধারণ লোক, তবু মাঝে মাঝে যদি আপনাদের মতন সাহিত্যিকদের সঙ্গ পাই, তাতে আমাদেরই লাভ। সুপ্রিয়ার তো একসময় খুবই বই-টই পড়ার দিকে ঝোঁক ছিল—
ধূর্জটি কোনো মন্তব্য করল না। তার মুখে আড়ষ্ট ভাবটা তখনও কাটেনি।
দীপংকর বলল, আপনাকে কি জোর করে ধরে এনে আপনার সময় নষ্ট করলাম?
ধূর্জটি এবার মুখে খানিকটা হাসি ফুটিয়ে বলল, না, না, আমার কোনো কাজ ছিল না। ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ।
দীপংকর ওপরে এসে দেখল, সুপ্রিয়া বেশ গম্ভীর। দীপংকর তবু উৎফুল্লভাবে বলল, ছেলেটা কিন্তু বড়ড রোগা হয়ে গেছে।
সুপ্রিয়া বলল, ও তো বরাবরই রোগা!
তা হোক। তবু চোখ দুটো খুব সুন্দর!
চলো, খেতে বসবে চলো!
খাবার টেবিলে সব কিছুই তৈরি। খেতে বসে বিশেষ কোনো কথাই হল না। দীপংকর কোনো প্রসঙ্গ তুললেও সুপ্রিয়া খুব একটা উৎসাহ দেখায় না।
খাওয়া শেষ করে দীপংকর বিছানায় একটা সিগারেট ধরিয়ে বসল। চোখের সামনে একটা বাংলা পত্রিকা। সুপ্রিয়ার এখন কিছু কাজ বাকি আছে। রাঁধুনি আর চাকরকে খাবার দেওয়া, সব দরজা-উরজা বন্ধ করা।
তারপর রাত্রির পোশাক পরে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ক্রিম ঘষতে লাগল। দীপংকর মুগ্ধভাবে তাকিয়ে রইল তার দিকে। একটি সন্তান হয়ে গেলেও সুপ্রিয়াকে এখনও কুমারী মেয়ের মতনই দেখায়। সিঁথিতে সিঁদুরের চিহ্ন এতই সূক্ষ্ম যে চোখেই পড়ে না।
সুপ্রিয়া আজকাল বুলানকে নিয়েই বেশি সময় কাটায়। এতটা বোধ হয় ভালো নয়। মেয়েরা জননী ঠিকই, কিন্তু সেটাই তাদের একমাত্র পরিচয় হয়ে যাওয়া উচিত নয় মোটেই। নারী তো পুরুষেরও সঙ্গিনী বা প্রেমিকা। কোনো নারীর মধ্যে যদি খুব বেশি জননীর ভাব এসে যায়—তাহলে তার স্বামী বা প্রেমিক তাকে আর তেমনভাবে পায় না।
ধূর্জটির কবিতাটা আবার পড়ছিলাম। বেশ লিখেছে কিন্তু। ছেলেটার হাত বেশ ভালো।
সুপ্রিয়া মুখ ফিরিয়ে স্বামীর দিকে স্থিরভাবে তাকাল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, তুমি হঠাৎ আজ ওকে বাড়িতে ডেকে আনলে কেন?
এমনিই, অনেকদিন পর দেখা হল! কেন? তুমি খুশি হওনি?
খুশি অখুশির প্রশ্ন নয়। তোমার হঠাৎ এত উৎসাহের কারণ কী?
ওকে আমার ভালো লাগে বেশ!
সুপ্রিয়া এবার হাসল। এটা সত্যিই একটা হাসির কথা। স্ত্রীর প্রাক্তন প্রেমিককে কোনো স্বামীর যদি ভালো লাগে, তাহলে সেটা একটা নতুন কথা নয়? দীপংকর আর ধূর্জটি পরস্পরের শত্রু হলেই ব্যাপারটা স্বাভাবিক হত।
সুপ্রিয়া বলল, তুমি সত্যিই অদ্ভুত! দীপংকর হাসছে। হাসতে হাসতেই বলল, আমি তো সরল সাদাসিধে লোক, আমি আবার অদ্ভুত হলাম কবে থেকে?
তুমি মাঝে মাঝে এমন ব্যবহার করো, যে তার কোনো মানেই হয় না!
যেমন?
আজ ধূর্জটিদাকে প্রায় জোর করে ধরে আনলে কেন?
দীপংকর বলল, এসো, কাছে এসো। তোমার মাঝে মাঝে ধূর্জটির কথা মনে পড়ে না?
সুপ্রিয়া স্বামীর পাশে বসে পড়ে বলল, তুমি কি জানতে চাইছ যে, আমি মাঝে মাঝে ধূর্জটির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলি কি না? সে প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আমাকে তো কেউ জোর করে বিয়ে দেয়নি। আমি নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছি। আমি ইচ্ছে করলেই ধূর্জটিদাকে বিয়ে করতে পারতাম। আমি নিজের ইচ্ছেতেই তোমাকে বিয়ে করেছি।
কেন?
এমনিই।
এমনিই মানে? এমনি এমনি কেউ বিয়ে করে?
এতদিন বাদে এই প্রশ্ন?
প্রশ্ন নয়, শুধু কৌতূহল।
কারণ, আমি তোমাকেই ভালোবেসেছিলাম। মানুষ হিসেবে তুমি অনেক বড়ো।
দীপংকর একটু লজ্জা পেয়ে গেল। স্ত্রীর মুখে প্রশংসা শুনতে কার-না ভালো লাগে। তবু একটু লজ্জাও হয়। সে সোজাসুজি সুপ্রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সুপ্রিয়ার নিস্পাপ মন। সে মিথ্যে কথা বলতে জানে না। দীপংকর কথা ঘোরাবার চেষ্টা করল।
তোমরা মেয়েরা কিন্তু বড় নিষ্ঠুর। নাহয় তুমি ইচ্ছে করেই ধূর্জটিকে বিয়ে করোনি। কিন্তু ও তোমাকে ভালোবাসত, তার খানিকটা সম্মানও দিতে পার না? বিয়ের পর তো এইরকম। একজনকে বন্ধু হিসেবেও মনে রাখা যায়। ধূর্জটি কিন্তু তোমাকে এখনও মনে রেখেছে।
কী করে বুঝলে? হাতের বাংলা পত্রিকাটা সুপ্রিয়ার দিকে ছুড়ে দিয়ে দীপংকর বলল, এতে ওর কবিতাটা পড়ে দেখো ভালো করে। এই কবিতাটা তোমাকে নিয়েই লেখা।
সুপ্রিয়া এবার ব্যাপারটা হালকা করে দেওয়ার জন্য বালিকার মতন হেসে বলল, তোমার আবার এত কবিতা পড়ার শখ হল কবে থেকে? তোমার অফিসের লোকেরা শুনলে হাসবে না? এমনকী এইজন্য তোমার প্রমোশানও আটকে যেতে পারে!
দীপংকরও হাসতে হাসতে বলল, সেইজন্যই এখন থেকে খুব লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা
পড়ব ঠিক করেছি। এইসব ভালো ভালো জিনিস তোমরাই শুধু উপভোগ করবে কেন?
তুমি কবিতার কিছু বোঝো না! আজকালকার কবিরা মেয়েদের নিয়ে কবিতা লেখেই না। তারা কী লেখে কিছুই বোঝা যায় না! সবই অ্যাবস্ট্রাক্ট!
পত্রিকাটা আবার তুলে দিয়ে পাতা উলটে দীপংকর বলল, এই জায়গাটা কিন্তু বেশ ভালোই বোঝা যায়। এই যে লিখছে, কী জানি আবার কবে স্থান পাব আমি তোমার চোখের সুদীর্ঘ পল্লবে! এ তো সবাই জানে, তোমার চোখের পল্লবগুলো খুব বড়ো বড়ো।
সুপ্রিয়া ম্লান হয়ে বলল, ও কবিতাটা আমাকে নিয়ে লেখা হলে আমি খুশি হতাম নিশ্চয়ই! কিন্তু ওই লাইন দুটোর আগেই একটা গাছের কথা আছে। ওটা একটা দেবদারু গাছ নিয়ে লেখা!
দীপংকর মোটেই তর্কের দিকে না গিয়ে বলল, যাই হোক, কবিতাটা আমার খুব ভালো লাগে। আমার ইচ্ছে ছিল, কবিতাটা ধূর্জটির মুখ থেকে একদিন আবৃত্তি শুনব! আর একদিন ধূর্জটি এলে মনে করে বলতে হবে তো!
ও আবার আসবে নাকি?
কেন তোমার আপত্তি আছে?
না, আপত্তি থাকবে কেন? তবু এতদিন বাদে—
আমি ধূর্জটিকে বার বার অনুরোধ করেছি আসবার জন্য। আমি বাড়িতে না থাকলেও আসবে, তোমার সঙ্গে গল্প করবে!
সুপ্রিয়া মুখটা ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। তারপর আস্তে আস্তে বলল, তোমার ঘুম পায়নি? আলো নেভাবে না?
দীপংকর বলল, আর একটু পরে। আচ্ছা, ধূর্জটির কবিতা আর কোন কোন কাগজে বেরিয়েছে বলো তো? একটু পড়ে দেখি!
সুপ্রিয়া ঝংকার দিয়ে বলল, জানি না। আমার অত কবিতা পড়ার উৎসাহ নেই। তোমার শখ থাকে নিজে খুঁজে দেখো!
আহা, বেচারা ধূর্জটি তোমাদের মতন মেয়েদের উদ্দেশ্য করে কবিতা লেখে, আর তোমরা সেটা পড়েও দেখো না?
সুপ্রিয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকাল। ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করল, ও কী একটা ইঁদুর?
তার মানে?
ও কী একটা বাচ্চা ইঁদুর যে তুমি ওকে নিয়ে বেড়ালের মতন খেলা করবে? ও যেখানে আছে, সেখানেই থাকতে দাও-না!
দীপংকর একটু আহত বোধ করল। সে কি কোনো অন্যায় করেছে ধূর্জটিকে ডেকে এনে? সুপ্রিয়া এত কঠিন কথা বলল কেন? বিয়ে করে স্বামী হলেই যেকোনো পুরুষমানুষ একটি নারীর সমস্ত সত্তা গ্রাস করে থাকবে, তার কোনো মানে আছে কী, স্ত্রীদের মনের কি কোনো স্বাধীনতা থাকবে না? সে কি! অন্য কারুর সঙ্গে কখনো-সখনো একটু ঘনিষ্ঠভাবে গল্প করে মনের স্ফুর্তি আনতে পারবে না? নিশ্চয়ই পারে। আর, প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলেই সবচেয়ে বেশি মনের স্ফুর্তি আসতে পারে। এতে দোষের কী আছে?
সুপ্রিয়ার গলার আওয়াজ শুনলেই বোঝা যায় সে এবার একটু রেগে গেছে। সে বোধ হয় ভেবেছে, ধূর্জটিকে অপমান করতে চাইছে দীপংকর, তাই সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু সে তো ধূর্জটিকে একটুও অপমান করতে চায়নি। ধূর্জটি সম্পর্কে তার পরিপূর্ণ সমবেদনা, এমনকী খানিকটা সমীহের ভাবও আছে।
দীপংকর বলল, তুমি কী করে জানলে যে ও-ই ইঁদুর আর আমি বেড়াল? এর উলটোটাও তো হতে পারে?
না, তা হতে পারে না! তুমি ওর থেকে অনেক বড়ো। তোমার অনেক ক্ষমতা, তোমার অনেক চেনাশোনা, তুমি বড়ো চাকরি করো—
শুধু চাকরি দিয়েই কী মানুষের বিচার হয়?
তা হয় না বটে, কিন্তু সামাজিক প্রতিপত্তির একটা ব্যাপার আছে তো! ও তোমার সঙ্গে কোনো দিক থেকেই পারবে না! ও বেচারা যেখানে আছে সেখানেই থাকতে দাও-না! তা ছাড়া–
দীপংকর অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, কী তা ছাড়া?
আমি যদি তোমার বদলে ওকে বিয়ে করতাম, তাহলে ওর কোনোদিনই সাহস হত না। তোমাকে ওর বাড়ি ডেকে নিয়ে যাওয়ার। ও সবসময়েই নিজেকে তোমার চেয়ে অনেক দুর্বল মনে করত!
তাহলে তুমি স্বীকার করছ, আমি দুর্বল নই।
কে তোমাকে দুর্বল বলবে?
আমি দুর্বল নই বলেই আমার কোনো ভয় থাকার কথা নয়। ধূর্জটি যদি মাঝে মাঝে এখানে আসে, তোমার সঙ্গে গল্প করে, তাতে আমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাতে আমি। আনন্দই পাব।
তা হলে সবটাই তোমার আনন্দের জন্য। সেইজন্যই তুমি ওকে নিয়ে খেলতে চাও?
দীপংকর হো-হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল, কিন্তু যাই বল, আমি তো কোনোদিনই ওর মতন কবিতা লিখতে পারব না তোমাকে নিয়ে!
আঃ বলছি তো, কবিতাটা আমাকে নিয়ে লেখা নয়!
দীপংকর সুপ্রিয়ার গালে একটা টোকা মেরে বলল, তুমি এত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছ কেন? একটু ঠাট্টা করছি, বুঝতে পারছনা!
এসো, এখন শুয়ে পড়ো।
আলো নেভাবার পর দীপংকর সুপ্রিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরল। এইভাবেই একসময় দু জনে ঘুমিয়ে পড়বে। যে প্রথম ঘুমিয়ে পড়বে, তার কাছ থেকে অন্যজন আলিঙ্গন ছাড়িয়ে নেবে। ঘুমের পর মানুষের হাত-পা বড্ড ভারী হয়ে যায়।
সুপ্রিয়াই ঘুমিয়ে পড়ল আগে। দীপংকরের ঘুম আসছে না। একবার সে উঁচু হয়ে স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কী সুন্দর, কী নির্মল মুখশ্রী! সুপ্রিয়ার মুখে কোনো গ্লানির রেখা নেই। দীপংকর সুপ্রিয়াকে কোনোদিন কোনোরকম দুঃখ দিতে চায় না। বরং যেকোনো উপায়ে আরও বেশি আনন্দ দিতে চায়। সুপ্রিয়ার যেকোনো খেলনাই পছন্দ হোক, সে ঠিক জোগাড় করে দেবে।
ঘুম আসবার আগে দীপংকর সন্তুষ্টভাবে ভাবল, সুপ্রিয়া যখন হঠাৎ চটে উঠল, তাতেই বোঝা যায় সে ধূর্জটিকে একেবারে ভুলতে পারেনি। ধূর্জটির যেকোনো অপমান হলে সুপ্রিয়ারও বুকে বাজবে। এইটাই তো স্বাভাবিক।
পরদিন অফিসে বেরোবার সময় দীপংকর ভাবল, এই যে আমি এখন বেরোচ্ছি, আর ফিরব সন্ধ্যের পর, অন্তত সাতটার আগে কিছুতেই নয়। একদিনও আমি হঠাৎ আগে আগে বাড়ি ফিরে আসিনি। দুপুর বেলা হঠাৎ বাড়ি ফেরার তো প্রশ্নই আসে না। এই সুদীর্ঘ সময়টা সুপ্রিয়ার একদম ফাঁকা। ধূর্জটি তো এলেও আসতে পারে!