০৭. সেদিনের সেই সন্ধ্যেটার কথা

সেদিনের সেই সন্ধ্যেটার কথা ভাবলেই ধূর্জটির গা গুলিয়ে ওঠে। ধূর্জটি সেই একদিনই মাত্র গঙ্গায় নৌকো করে বেড়াতে গিয়েছিল। ওরকম উটকো বেড়াবার শখ তার নেই। সেদিন গিয়েছিল নিতান্ত বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে, এক বন্ধু চাকরিতে একটা বড়ো প্রোমোশন পেয়েছে, সেই উপলক্ষ্যে। ডজন খানেক বিয়ারের বোতল ছিল সঙ্গে, তাই খেয়েই কয়েকজন রীতিমতন মাতাল হয়ে পড়ল। গান আর হইহল্লা। দলের মধ্যে ছিল প্রতুল, তার আবার ভীষণ খিস্তি-খেউড় করা স্বভাব। মেয়েদের দেখলেই তার জিভ লকলক করে। অবশ্য মাঝগঙ্গায় আর মেয়ে কোথায়!

একটা মুশকিল হয়েছিল এই, সেদিন কারুর কাছে দেশলাই ছিল না। মাঝিদের দেশলাইটা চেয়ে নেওয়া হয়েছিল, সেটাতেও দুটো মাত্র কাঠি, দুরন্ত হাওয়ায় দুটোই নিভে গেল। সিগারেট না টানতে পেরে তখন ওদের প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসার অবস্থা। মাঝিরাই বলল, অন্য একটা নৌকো থেকে তারা দেশলাই চেয়ে দেবে।

আর একটা নৌকোর কাছাকাছি যেতেই ধূর্জটি দেখেছিল, এক জন মহিলার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে একজন পুরুষ। তখনই সে বলেছিল, ওদিকে যেতে হবে না। কোনো প্রেমিক-প্রেমিকার নিরালা মুহূর্তে ব্যাঘাত ঘটাতে তার একটুও ইচ্ছে করে না। কিন্তু প্রতুল দেখে ফেলেছে, সে আর ছাড়বে না। সে বলেছিল, চল না মাইরি, একটু হিড়িক দিই! আমাদের কোনো মেয়েছেলে জোটে না

নৌকো দু-টি পাশাপাশি আসবার পর ধূর্জটি চিনতে পেরেছিল সুপ্রিয়া আর অমলকে! অমলকে দেখে সে একটুও অবাক হয় নি। কিন্তু সুপ্রিয়া? অমল গুপ্তের সঙ্গে? ধূর্জটির কোনো নীতি বাতিক নেই। কোনো বিবাহিতা মহিলা অপর কারুর সঙ্গে প্রেম করতে পারবে না, এর কোনো মানে হয় না। রাধা যদি কৃষ্ণের সঙ্গে প্রেম না করত, তাহলে এতগুলো বৈষ্ণব কবি বেকার হয়ে যেত!

সুপ্রিয়ার কি সামান্য ক্ষমতাও নেই মানুষ চেনার! লুকিয়ে প্রেম করার জন্য সে শেষপর্যন্ত অমল গুপ্তর খপ্পরে গিয়ে পড়ল। ভঙ্গিটা দেখেই সেদিন মনে হয়েছিল, সুপ্রিয়া প্রায়ই ওরকমভাবে গঙ্গার ওপরে প্রমোদ ভ্রমণে আসে। নিশ্চয়ই হোটেলেও যায়। সুপ্রিয়ার জন্য সেদিন খুবই দুঃখ হয়েছিল ধূর্জটির।…

এতদিন পর, সুপ্রিয়াদের ফ্ল্যাটে এসে, তার মুখখামুখি বসে থেকে বার বার সে-দৃশ্যটার কথাই মনে পড়ছে। অমল সম্পর্কে সুপ্রিয়াকে কিছু বলা দরকার। কীরকমভাবে বলবে, সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।

কিন্তু ধূর্জটি একবার অমলের নাম করতেই সুপ্রিয়া এমন ভাব দেখালো, যেন অমলকে সে ভালো করে চেনেই না! মেয়েরা কত কী পারে! তারপরেই সুপ্রিয়া একটা অছিলা করে ত্ৰস্তে উঠে গেল, ফিরে এল স্বামীর সঙ্গে। কেন সুপ্রিয়া এখন স্বামীর আড়ালে থাকতে চায়, তা ধূর্জটি ভালোই বোঝে!

সুপ্রিয়ার স্বামী দীপংকর এত বেশি বেশি খাতির করছে কেন? ধূর্জটি এই ব্যাপারটাই বুঝতে পারছে না। এমন ভাব করছেন যেন উনি একটি নিপাট ভালো মানুষ। কিন্তু তা তো নয়।

সরলা বিশ্বাস বলে একটি ক্রিশ্চান মেয়ে ধূর্জটির সঙ্গে কলেজে পড়ত। সে এখন দীপংকরেরই স্টেনোগ্রাফার হয়েছে। মেয়েটার বড় দুর্ভাগ্য, কলেজে থাকতে থাকতেই যাকে বিয়ে করেছিল, সে ওকে ছেড়ে চলে গেল। সেই সরলার মুখে দীপংকরের সম্পর্কে কিছু কিছু খবর পেয়েছে ধূর্জটি! ভদ্রলোক এমন ভাব করে থাকেন, যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানেন না। অথচ ভেতরে ভেতরে লোভ আছে ষােলো আনা। অফিসাররা মনে করে তাদের স্টেনোগ্রাফাররা যেন তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তারা কীরকম পোশাক পরবে, কার সঙ্গে মিশবে, কখন কোথায় যাবে, তাও বসরাই ঠিক করে দেবেন। সরলার সঙ্গে দীপংকর খারাপ ব্যবহার করে না ঠিকই, কিন্তু ভালোমানুষির মধ্যেই একটা দমবন্ধ করা ব্যাপার আছে। সরলার দিকে প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে চেয়ে থাকেন, কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস নেই। এখন দিলীপ বোস বলে ওরই অফিসের আর এক ভদ্রলোক অনেকরকমভাবে সাহায্য করছেন। সরলাকে। তিনিই তো গরজ করে সরলাকে ভরতি করে দিয়েছেন ফ্রেঞ্চ ক্লাসে। সেখানে ধূর্জটির সঙ্গে দেখা হয়। দিলীপ বোস সম্ভবত শিগগিরই বিয়ে করবেন সরলাকে। কিন্তু এই দীপংকরই নাকি ব্যাগড়া দিতে চাইছে। এইসব লোক হচ্ছে ডগ ইন দা ম্যানজার টাইপ। নিজে যা খেতে পারবে না, অন্যদেরও তা খেতে দেবে না।

আর এখানে বসতে ভালো লাগছে না। কথাবার্তা ক্রমশ একঘেয়ে হয়ে আসছে। ধূর্জটি উঠে পড়তে চাইছে, কিন্তু দীপংকর কিছুতেই উঠতে দেবে না। স্কচ এখনও অনেকটা আছে কিন্তু ধূর্জটির এখন মদ্যপানে রুচি নেই। আড্ডার সময় হুইস্কি-টুইস্কি থাকলে ভালোই লাগে, কিন্তু এ-রকম আড়ষ্টভাবে বসে মদ্যপান করতে ইচ্ছে করে না।

একসময় ধূর্জটি জোর করেই উঠে পড়ল। দীপংকর অনেকখানি এগিয়ে দিল তাকে এবং বার বার বলতে লাগল, আবার আসবেন, নিশ্চয়ই আসবেন, যেকোনো সময়ে চলে আসবেন।

ভদ্রলোকটি এত বাড়াবাড়ি করছেন কেন? কী এমন খাতির তার সঙ্গে ধূর্জটির? কেন আসতে যাবে সে, তার কি আর কাজকর্ম নেই? যারা বড়ো অফিসার তারা ভাবে, তারাই বুঝি খুব ব্যস্ত। কিন্তু যারা কবিতা লেখে, তাদেরই সময়ের অভাব সবচেয়ে বেশি।

বিদায় নেওয়ার আগে একবার ধূর্জটি তাকিয়েছিল সুপ্রিয়ার দিকে। সুপ্রিয়া একটিবারও তাকে আসতে বলেনি।

সুপ্রিয়ার মুখে তখনও সেই ভয়ভয় ভাব। কাকে ভয় পাচ্ছে সুপ্রিয়া, তার স্বামীকে, না ধূর্জটিকে? ধূর্জটিকে সুপ্রিয়া ভয় পাবে? সেই ধূর্জটি, যার সঙ্গে সুপ্রিয়া একসময় কতরকম হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকত! ধূর্জটিকে কেউ কখনো ভয় করেনি, সে কবিতা লেখে বলে অনেকে তাকে মানুষ হিসেবে গুরুত্বই দেয় না—তাকে সুপ্রিয়ার মতন মেয়ে ভয় পেতে যাবে কেন?

তবু, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার সময় ধূর্জটি মনে মনে বলেছিল, তুমি নিশ্চিন্ত থেকো সুপ্রিয়া, তোমার স্বামী যতই অনুরোধ করুক, আমি আর তোমাদের বাড়িতে আসব না!

দীপংকর আর সুপ্রিয়ার সঙ্গে নতুন করে দেখা হওয়ার পর, ধূর্জটির বেশ একটা অসুবিধে হয়ে গেল। এখন আর এ পাড়ায় যখন-তখন আসা যাবে না।

পরদিনই ধূর্জটির বাড়িতে প্রতুল এসে হাজির। প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, কালকের ওই ভদ্রমহিলা কে রে?

প্রতুলের চোখে-মুখে একটা লুব্ধ ভাব। ধূর্জটি জানত, প্রতুল আসবেই। কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখলেই প্রতুল পাগল হয়ে ওঠে। যদিও সেইসব মেয়েদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া তো দূরে থাক, আলাপ করার সাহস তার নেই। সে শুধু ভালোবাসে কেচ্ছা-কাহিনি।

ধূর্জটি আলগাভাবে বলল, ওই তো আমাদের রণজয়ের মাসতুতো বোন। আমি চিনি অনেকদিন আগে থেকেই।

আমারও কীরকম যেন চেনা চেনা মনে হল। ধূর্জটি প্রতুলকে বলল, তুই চিনবি কী করে? তুই কি রণজয়ের সঙ্গে ওর মাসিদের বাড়িতে গেছিস কখনো?

না।

তবে? তোর যেমন মুখ আলগা, তোকে কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নিয়ে যেতে সাহস পায় না।

চোপ শালা!

কথা ঘোরাতে চেয়ে ধূর্জটি বলল, তুই কোচবিহারে কবে যাবি?

প্রতুল সে-দিকে গেল না। অন্যমনস্কভাবে বলল, যাই বলো মেয়েটাকে আগে যেন কোথায় দেখেছি। সুন্দরী মেয়েদের একবার দেখলে আমি তো সহজে ভুলি না!

ও আর সুন্দর দেখতে কোথায়? আগে বরং দেখতে মন্দ ছিল না!

যাই বল, এখনও বেশ দারুণ। ঠিক যেন পটের বিবি। কোথায় দেখেছি? আগে কোথায় দেখেছি?

তোর তো সব মেয়েকেই চেনা মনে হয়!

না, না, আচ্ছা, গঙ্গায় সেই যে, অমল গুপ্তর সঙ্গে একজনকে—

ধূর্জটি সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে গেল, কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বলল, যাঃ, কী যা-তা বলছিস? আমি একে বহুদিন ধরে চিনি। খুব সরল আর ভালো মেয়ে।

কিন্তু অমল গুপ্ত তো বিয়ে করেনি, সেদিন ওর সঙ্গে যে ছিল—

খুব সম্ভবত বাজারের মেয়ে।

কিন্তু দারুণ চেহারা ছিল মাইরি,—দেখলে বোঝাই যায় না–

তুই ওরকম মেয়ে চাস? সন্ধ্যের পর মিউজিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে থাক, পেয়ে যাবি! তোর তো আর কিছু জুটবে না!

প্রতুল ধূর্জটির পিঠে এক চাপড় মেরে বলল, সবাই কি তোর মতন লাকি হয় রে শুয়োরের বাচ্চা! কবিতা তো অনেকেই লেখে, কিন্তু তুই যেরকম একটি মেয়ের ভালোবাসা পেয়েছিস, তুই বেঁচে গেলি এ-জন্মে..

কথাবার্তা অন্য দিকে সরিয়ে দিল ধূর্জটি। প্রতুলকে বিশ্বাস নেই। চতুর্দিকে আজেবাজে কথা বলে বেড়াতে পারে। সুনাম ছড়াতে দেরি হয়, কিন্তু দুর্নাম ছোটে ঝড়ের বেগে। সুপ্রিয়ার একটা সংসার আছে, স্বামী আছে—যদি ঘুণাক্ষরেও সেখানে অমল গুপ্তর সঙ্গে সুপ্রিয়ার নৌকাবিলাসের খবর পোঁছে যায়, তাহলে সব কিছু তছনছ হয়ে যাবে। ধূর্জটি কিছুতেই তা চায় না। যদি সুপ্রিয়াকে কিছু বলতে হয়, তাহলে ধূর্জটি নিজেই কখনো বলবে।

শেষপর্যন্ত বোঝা গেল যে, প্রতুল বিশ্বাস করেছে, অমল গুপ্তের সঙ্গে সে-দিন অন্য একটি মেয়ে ছিল, যার চুল কোঁকড়া কোঁকড়া, নাকটা একটু চাপা এবং বুক দুটো বড্ড বড়ো বড়ো— তখন ধূর্জটি নিশ্চিন্ত হল।

দু-তিন দিন হয়ে গেছে, ধূর্জটির গলফ ক্লাব রোডে যাওয়া হয়নি। তার মন কেমন করে। ওখানে না গিয়ে সে পারবে না।

এক বৃষ্টির দিনে ধূর্জটি বাস থেকে ওই রাস্তায় নামল। এই দুপুর বেলা নিশ্চয়ই কেউ থাকবে না। জলের মধ্যে ছপছপ করে ধূর্জটি এগোলো।

একটু দূরে গিয়েই দেখল, দোতলার বারান্দায় সুপ্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলি পিঠের ওপর মেলা। চোখের দৃষ্টি উদাস।

ধূর্জটি চমকে উঠল। সুপ্রিয়াকে দেখে মনে হয়, সে যেন কারুর প্রতীক্ষা করছে। কার? ধূর্জটির? না, সুপ্রিয়া তো একবারও নিজের মুখে ধূর্জটিকে আসতে বলেনি। তবু সে দুপুর বেলা উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে থাকে কেন বারান্দায়? তবে কি সে অমলের জন্য? অমল বুঝি এখানে আসে নিয়মিত? যাক গে, অমল আসুক বা না আসুক, তাতে ধূর্জটির কিছু যায়-আসে না! সুপ্রিয়া কি তাকে দেখতে পেয়েছে? সে তাড়াতাড়ি দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। তারপর দেওয়াল ঘেঁষে এগোতে লাগল। পার হয়ে গেল সুপ্রিয়াদের বাড়ি।

সুপ্রিয়া দেখতে পেলে নিশ্চয়ই ভাবত, সে ওদেরই বাড়িতে আসছে। সেদিন ওর স্বামী অত করে বলেছিল যখন, তখন তো ধূর্জটি আসবেই।

ধূর্জটির হাসি পেল। দুপুর বেলা চুপি চুপি সে সুপ্রিয়ার সঙ্গে প্রেম করতে আসবে! সেরকম ঘনিষ্ঠতা কী কখনো সুপ্রিয়ার সঙ্গে হয়েছে? সুপ্রিয়ার স্বামী কী সেরকম কিছু ভেবে বসে আছে নাকি?

সুপ্রিয়াদের বাড়ি পেরিয়ে বেশ কয়েকটা বাড়ির পর ধূর্জটি আর একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। চারপাশটা দেখে নিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল চারতলায়। দরজা খুলে দিল একটা বাচ্চা চাকর। ধূর্জটি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, দিদিমণি ঘুমোচ্ছেন?

চাকর বলল, না, বই পড়ছেন।

পা টিপে টিপে এসে একেবারে কোণের ঘরটার পর্দা সরিয়ে সে দাঁড়াল। বিছানায় শুয়ে আছে একটি স্থির বিদ্যুৎ। চুলগুলি খোলা, একটি নীল শাড়ি পরা। বুকের ওপর একটা মোটা বই।

ভেতরে এসে ধূর্জটি জিজ্ঞেস করল, আজ কেমন আছ?

বইটি সরিয়ে মেয়েটি নরম আলো ছড়িয়ে তাকাল ধূর্জটির দিকে। তারপর বলল, তুমি তিনদিন আসনি!

ধূর্জটির মুখখানা অপরাধীর মতন। মেয়েটি হাতের ইশারায় বিছানার এক প্রান্ত দেখিয়ে বলল, বোসো।

মেয়েটির বয়েস বাইশ-তেইশের বেশি না। খুব ফর্সা নয়, মাজা মাজা গায়ের রং। তার নাক, চোখ, ঠোঁট কোনোটাই সৌন্দর্যে নিখুঁত নয়, কিন্তু অদ্ভুত একটা আলগা লাবণ্য ছড়িয়ে আছে তার সারাশরীরে। মেয়েটি কিছুদিন ধরে অসুস্থ, তবু রোগও কেড়ে নিতে পারেনি তার সেই লাবণ্য।

মেয়েটির নাম স্মৃতিকণা। এতদিনকার বাউণ্ডুলে জীবনে ধূর্জটিই এই প্রথম একটি মেয়েকে সত্যিকারের ভালোবেসেছে। এর পায়ের কাছে তার হৃৎপিন্ডটা উপড়ে তুলে দিতে পারে।

ধূর্জটি মেয়েদের ব্যাপারে কোনোদিনই তেমন গুরুত্ব দিয়ে কিছু চিন্তা করেনি। হালকা সুরে কথা বলাই তার স্বভাব। সে রূপের পূজারি, রূপ দেখে সে বার বার মুগ্ধ হয়েছে। শুধু রূপসি মেয়েদের রূপ তার ভালো লাগে তা নয়, অনেক সাধারণ মেয়েরও বিশেষ একটা তাকানোর ভঙ্গি কিংবা অসময়ের হাসি কিংবা কারুর কোমল স্বভাব তাকে মুগ্ধ করেছে।

কলেজজীবন থেকেই সে প্রেম করতে শুরু করেছে মেয়েদের সঙ্গে, কিন্তু কারুকেই বিয়ে করার কথা ভাবেনি। বন্ধুরা একে একে বিয়ে করে সংসারী হয়ে গেল, ধূর্জটি সেইরকমই রয়ে গেল। মেয়েদের সাহচর্য তার ভালো লাগে, কিন্তু প্রতিদিনের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে কারুকে ঠিক ভাবতে পারে না। কিংবা সেইরকম মেয়ের সন্ধান সে কখনো পায়নি, যে তাকে পুরোপুরি বুঝবে।

স্মৃতিকণার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। একটা কলেজের সাহিত্যসভায় গিয়েছিল ধূর্জটি। তার কবিতা পাঠ ছাত্র-ছাত্রীরা বেশ আগ্রহের সঙ্গেই শোনে, এমনকী অনেকে চেঁচিয়ে বলে, আর একটা, আর একটা!

সেদিনও, সেই কলেজের সাহিত্যসভায় সগৌরবে কবিতাপাঠ করার পর বাইরে বেরিয়ে এসেছে, ছেলে-মেয়েরা তাকে ঘিরে ধরেছে অটোগ্রাফের জন্য, একটি মেয়ে দূরে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। লম্বা ছিপছিপে চেহারার মেয়েটি, সে কিন্তু অটোগ্রাফ চায়নি। ধূর্জটি দু একবার তাকিয়েছে তার দিকে, বিশেষত্ব কিছু চোখে পড়েনি।

ভিড় কাটিয়ে বেরিয়ে আসবার সময় ধূর্জটি যখন মেয়েটির পাশ দিয়ে আসছিল, তখন ধূর্জটি টের পেল, মেয়েটি তখনও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেন চোখ দিয়ে ডাকছে তাকে। ধূর্জটি থমকে দাঁড়াতে মেয়েটি খুব নীচু গলায় বলল, শুনুন, আপনি আজকাল এত বাজে বাজে লিখছেন কেন?

আর সব সহ্য করতে পারে ধূর্জটি, কিন্তু নিজের লেখার একটুও নিন্দে সইতে পারে না। তাই ব্যঙ্গের সুরে উত্তর দিল, বাজে লিখছি? তাই নাকি?

মেয়েটি বলল, নিশ্চয়ই!

এবার ধূর্জটি মেয়েটিকে সম্পূর্ণ অবহেলা করতে পারে। তাই আবার এগিয়ে যেতে যেতে মশলা চিবোবার মতন ভঙ্গি করে বলল, তা কী আর করা যাবে। আমি বাজে লিখলে লোকে তাই পড়বে!

মেয়েটি তবু বলল, আপনি খারাপ লিখলে আমার খুব কষ্ট হয়।

তখনও অবহেলার সুরটা বজায় রেখে ধূর্জটি বলল, কেন? আমি খারাপ লিখলে কার কী আসে-যায়?

তার কারণ, আমি শুধু আপনার লেখাকেই ভালোবাসি-না, আমি আপনাকেও ভালোবাসি! ধূর্জটি যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। কী বলছে মেয়েটি? আগে তাকে কোনোদিন দেখেনি; সে এ-রকম প্রকাশ্য জায়গায় তাকে ভালোবাসার কথা বলছে! ধূর্জটি দাঁড়িয়ে আবার মেয়েটির কাছে আসতে চাইল। কিন্তু পারল না। আরও অনেক ছেলে-মেয়ে তাকে ঘিরে ধরে তখন নানারকম প্রশ্ন করছে। ভিড় ঠেলে ধূর্জটি এগোবার চেষ্টা করল, কিন্তু মেয়েটি তখন কোথায় যেন আড়ালে পড়ে গেছে। এদিকে তখন ধূর্জটি এবং অন্যান্য অতিথিদের জন্য ট্যাক্সি ডেকে আনা হয়েছে, আর অপেক্ষা করা যায় না। আর দেখা হল না।

সারাসন্ধ্যে ধূর্জটি সেই মেয়েটির কথা ভাবল। শ্যামলা রং, রোগা-পাতলা, মেয়েটির মুখ ধূর্জটির ভালো মনে পড়ে না। ধূর্জটিকে আগে কোনো মেয়ে নিজের থেকে ভালোবাসার কথা বলেনি। এই মেয়েটি তাকে না চিনেই। হয়তো, নতুন দশকের ছেলে-মেয়েরা ভালোবাসার কথাটা অনেক আলগাভাবে বলে। হয়তো ভালোবাসা কথাটার মানেই তাদের কাছে অন্য কিছু।

তবু মেয়েটিকে আর একবার দেখবার ইচ্ছে হয়েছিল তার। কিন্তু উপায় কী? সেই কলেজে গিয়ে তো আর মেয়েটির খোঁজ করা যায় না। তার নামটাও জানা হয়নি।

এর কিছুদিন পরে, একটি পত্রিকা অফিসে ধূর্জটির নামে একটি মেয়ের চিঠি এসেছিল। এ রকম মাঝে মাঝেই আসে। এই মেয়েটি ধূর্জটির একটি লেখার সমালোচনা করে জানিয়েছিল যে, ধূর্জটির যে-নতুন লেখাটা বেরিয়েছে, তার একটা অংশ, অনেকদিন আগে ধূর্জটি আর একটা লেখায় ব্যবহার করেছিল। এ-রকম উচিত নয়। ধূর্জটির কি অভিজ্ঞতা ফুরিয়ে যাচ্ছে?

চিঠিটার সুর দেখেই ধূর্জটির মনে হয়েছিল, এই হয়তো সেই মেয়েটি! শুধু মনে হওয়া নয়, ধূর্জটির দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে উত্তর লিখল, মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে সে সামনাসামনি আলোচনা করতে চায়।

স্মৃতিকণার সঙ্গে প্রথম দিন আলাপের পরই ধূর্জটি বুঝল এ অন্য ধরনের মেয়ে, এ-রকম মেয়ে তার অভিজ্ঞতায় আগে আসেনি।

স্মৃতিকণা তার প্রত্যেকটি লেখা পড়েছে, প্রত্যেকটি লেখা নিজের কাছে জমিয়ে রেখেছে। শুধু তাই নয়, নানান লোকজনের কাছে শুনে শুনে সে ধূর্জটির জীবনযাত্রা সম্পর্কেও খানিকটা আন্দাজ করে নিয়েছে। অর্থাৎ ধূর্জটির লেখকজীবনের গোড়া থেকেই সে অনুসরণ করছে তাকে। স্মৃতিকথা নিজে কিছু লেখে না, কিন্তু তার মনের কথাগুলোই যেন ধূর্জটির কলম দিয়ে বেরোয়। সেইজন্যই, ধূর্জটির লেখার মধ্যে কোনো দুর্বলতা দেখা দিলে সে দুঃখ পায়। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে সে, এত অল্প বয়সে পড়াশুনোও করেছে অনেক।

ধূর্জটি বুঝতে পারল, ইংরেজিতে যাকে গার্ডিয়ান এঞ্জেল বলে, স্মৃতিকণাও তার জীবনে অনেকটা তাই। কিংবা আরও সহজ ভাষায় স্মৃতিকণাই তার নিয়তি। কোনো কবির পক্ষে এ রকম একটি মেয়ের ভালোবাসা পাওয়া, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার চেয়েও বড়ো।

সমস্ত অহংকার বিসর্জন দিয়ে, ধূর্জটি স্মৃতিকণার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলেছিল, তুমি আমাকে সত্যিই ভালোবাসবে? তাহলে দেখো, আমি নিশ্চয়ই আরও অনেক বেশি ভালো লিখতে পারব।

তারপর থেকে ধূর্জটির জীবনযাত্রা বদলে গেছে। সেই লঘু চপলতা কিংবা যখন-তখন মিথ্যে কথা বলা কিংবা বিভিন্ন মেয়ের কাছে নকল স্তুতির খেলা আর নেই। এতদিন বাদে সে চেয়ে দেখল নিজের মনের গভীরে। আত্ম-আবিষ্কারে মত্ত হয়ে উঠল।

তারপর থেকে প্রতিদিনই স্মৃতিকণার সঙ্গে দেখা না করলে আর চলে না। প্রত্যেকটা নতুন লেখা স্মৃতিকণাকে আগে শোনানো চাই। স্মৃতিকণাও লেখাগুলো নিয়ে এমনভাবে কথা বলে, যেন সেগুলো তার নিজেরই লেখা। দু-জনে একাত্ম হয়ে গেল।

মাস ছয়েকের মধ্যেই স্মৃতিকথা পড়ল অসুখে। সাংঘাতিক অসুখ, জীবনসংশয় হয়েছিল। এর আগে স্মৃতিকণার বাড়ির লোকজন ধূর্জটির অস্তিত্বই জানত না। কিন্তু প্রথম কয়েকদিন ধূর্জটিকে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই হাসপাতালে থাকতে দেখে তাঁরা অবাক হলেও কোনো রূঢ় ব্যবহার করতে পারেনি। যেন ধূর্জটির অধিকার সম্পর্কে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সেই সময়টাতে ধূর্জটি এক লাইনও লেখেনি, কলেজের চাকরিতেও যায়নি। বন্ধুরা ধূর্জটির পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। ধূর্জটিকে অনুসরণ করে তারাও কয়েকজন হাতপাতালে এসে স্মৃতিকণাকে দেখেছে। তারপর আর তারা ধূর্জটিকে এ বিষয়ে ঠাট্টা করার সাহস পায়নি।

স্মৃতিকণা এখন অনেকটা সেরে উঠেছে। প্রথম যেদিন স্মৃতিকণার ভালো করে জ্ঞান ফিরল

সেদিন ধূর্জটি দুপুর বেলা গিয়েছিল হাসপাতালে, তার চেনা এক ডাক্তারকে ধরে। সে-সময় স্মৃতিকণার বাড়ির লোকজন কেউ থাকে না। সে ধূর্জটিকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি যদি মরে যেতাম!

ধূর্জটি দৃঢ় স্বরে বলেছিল, না।

কী না?

তুমি মরতে পার না।

সেটা কী আমার ইচ্ছে? তবু যদি মরে যেতাম?

সেটা অন্যায় হত। এত তাড়াতাড়ি যদি মরবে, তাহলে সেদিন আমার সঙ্গে আলাপ করেছিলে কেন? তুমি মরে গেলে আমাকে একদম লেখা ছেড়ে দিতে হত!

স্মৃতিকণা তার দুর্বল হাতটা তুলে ধূর্জটিকে ছুঁয়ে বলেছিল, আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। এই যে বেঁচে উঠলাম, এটাই খুব আনন্দের না!

একটু থেমে স্মৃতিকণা বলেছিল, হাসপাতাল থেকে শিগগিরই বাড়ি চলে যাব। আমার হাসপাতাল ভালো লাগে না, চারদিকে এত অসুখ! তুমি আমাদের বাড়িতে আসবে তো? কোনোরকম ভয় পেয়ো না। তোমার যখন খুশি চলে আসবে।

ধূর্জটি স্মৃতিকণার কপালে হাত দিয়ে দেখল, আজও জ্বর আছে। ধূর্জটি মুখটা নামিয়ে স্মৃতিকণার জ্বরতপ্ত ঠোঁটে একটা আলতো চুমু খেল।

তুমি কেন তিনদিন আসনি?

আটকে গিয়েছিলাম।

এখন তো কলেজ ছুটি তোমার।

রোজই বেরোবার সময় কেউ-না-কেউ এসে যায়। তাদের কাছে তো তোমার কথা বলতে পারি না। তুমি আমার সবচেয়ে গোপন।

যদি আজ এসে দেখতে আমি মরে গেছি?

ধূর্জটি হেসে বলল, তা কখনো হতে পারে? আমি আমার অর্ধেক জীবনীশক্তি যে তোমাকে দিয়ে দিয়েছি। দরকার হলে বাকি অর্ধেকটাও দেব।

সেরকমভাবে আমি বেঁচে উঠলেই বা লাভ কী হবে?

স্মৃতিকণার মা নেই। প্রায় মাস দেড়েক সে হাসপাতালে ছিল। দিন কুড়ি আগে বাড়ি ফিরে এসেছে। এখন সে সেরে ওঠার মুখে। স্মৃতিকণার বাবা ধূর্জটিকে খুব একটা পছন্দ করেন না। কিন্তু স্মৃতিকণা সেরে উঠলেই তাকে ধূর্জটি এ-বাড়ি থেকে হরণ করে নিয়ে যাবে। এরজন্য সে, সারাপৃথিবীটাই মূল্য হিসেবে দিতে রাজি আছে।

স্মৃতিকণার সবচেয়ে বড়ড়া গুণ, সে ধূর্জটিকে বোঝে। ধূর্জটির দুঃখ, না লিখতে পারার অতৃপ্তি সে তার চোখের দিকে তাকালেই জেনে যায়। স্মৃতিকণাকে ভালোবাসার পরই ধূর্জটি নতুন করে ভালো কবিতা লিখতে পারছে।

স্মৃতিকণার চোখের পাতায় ধূর্জটি আস্তে আস্তে আঙুল বুলোয়। কাশ্মীরি মেয়েদের মতন স্মৃতিকণার চোখের পাতাগুলো খুব বড়ো বড়ো।

পরদিন দুপুরে স্মৃতিকণাদের বাড়িতে আসবার সময়ও ধূর্জটি দেখল সুপ্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। আবার লুকিয়ে পড়ল ধূর্জটি।

স্মৃতিকণাদের বাড়ি থেকে ধূর্জটি ফেরে চারটে-সাড়ে চারটের সময়। তখন বিকেল। তখন কিন্তু সে সুপ্রিয়াকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে না। তার প্রতীক্ষা যেন শুধু দুপুরেই।

সুপ্রিয়াকে আগে তো দুপুরে এ-রকম দাঁড়িয়ে থাকতে সে দেখেনি। সে কি কারুর জন্য অপেক্ষা করে? নিশ্চয়ই ধূর্জটির জন্য নয়। সুপ্রিয়া খুব ভালোভাবেই জানে, ধূর্জটি এ-রকম হ্যাংলা নয়! যে-মেয়েকে সে ভালোবাসতে পারেনি, তার কাছ থেকে ধূর্জটি অন্য কিছু দাবি করতে কখনো যাবে না!

সুপ্রিয়া কি অমলের জন্য অপেক্ষা করে? অমল কি আসে এবাড়িতে? আসতেই পারে। অমল যা লোক।

ধূর্জটির এক-এক সময় ইচ্ছে করে, সুপ্রিয়াকে সাবধান করে দিতে। অমল গুপ্ত সত্যিই একটি বিচিত্র চরিত্রের মানুষ। এমনিতে দারুণ বুদ্ধিমান, ভদ্র, আরও অনেক গুণ আছে, কিন্তু মেয়েদের ব্যাপারে একেবারে উন্মাদ।

ওকে দেখে কেউই বুঝতে পারবে না ওর চরিত্রে ডক্টর জেকিল অ্যাণ্ড মিস্টার হাইডের মতন একটা ব্যাপার আছে। নিতান্ত ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া কেউ জানেও না। যেকোনো গানের আসরে কিংবা ভদ্র সমাবেশে অমলকে দেখে সবাই মুগ্ধ হবে। কিন্তু এই অমল গুপ্তই প্রতি সপ্তাহে বাজারের অতিখারাপ মেয়েছেলে নিয়ে ডায়মণ্ড হারবারে ফুর্তি করতে যাবেই। এমনকী কলকাতার হোটেলেও যায়। এই ব্যাপারে একেবারে বেপরোয়া। ওর রুচিও অদ্ভুত। সাধারণত অমলকে ভদ্র মেয়েদের নিয়ে এ-রকম লাম্পট্য করতে দেখা যায় না। অতিসাধারণ বেশ্যাদের নিয়ে ফুর্তি করার দিকেই ওর ঝোঁক। বন্ধুবান্ধবরা অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়েও ওকে ফেরাতে পারেনি। বছর চারেক ধরে ওর এই রোগ ধরেছে।

অমল সম্পর্কে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের আগে বেশ একটা উচ্চ ধারণা ছিল। তার সুন্দর চেহারা, তার গাম্ভীর্য—সব মিলিয়ে আলাদা ধরনের একটা ব্যক্তিত্ব ছিল। কেউ কেউ ভাবত, অমল একসময় বিরাট কিছু হবে।

কিছুই হল না। এখন বোঝা গেছে, সুন্দর চেহারায় সে আসলে একটি লাল মুলো। তার গাম্ভীর্য আসলে তার বোকামিটা ঢেকে রাখার জন্য। তার মতামতের কোনো গভীরতা নেই। কোনো বিষয়ে যখন সে হঠাৎ দু-একটা কথা বলে ফেলে, বোঝা যায়, সে একটা অতিসাধারণ লোক।

অবশ্য মেয়েরা তাকে দেখলেই মুগ্ধ হয়। অধিকাংশ মেয়েই তো মুখ দেখে ভোলে। অমলকে কোনো ঘরোয়া পরিবেশে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। মেয়েরা তার দিকে আকৃষ্ট হবেই, আর অমলও তার পরিপূর্ণ সুযোগ নেবে। সঞ্জয় অভিযোগ করেছিল, সে অমলকে একদিন তার দাদার বাড়িতে নিয়ে গেছে, সেখানে অমল একদিনের পরিচয়েই তার বউদির সঙ্গে প্রেম করার চেষ্টা করেছিল।

ধূর্জটি নিজের চোখে দেখেছে, অমল রাত ন-টা-দশটার সময় মিউজিয়ামের সামনে ট্যাক্সি থামিয়ে অপেক্ষা করে। ওই সময় ফুটপাথে অতিসাধারণ বেশ্যারা ঘোরে তাদের গালে সস্তা পাউডার, ঠোঁটে চড়া রঙের লিপস্টিক—অমল তাদের ডাকে, দরাদরি করে, তারপর ট্যাক্সিতে তুলে উধাও হয়ে যায়। এ-রকম প্রায় প্রত্যেক দিন। অমল মদ-টদ খায় না, অন্য নেশা নেই, শুধু তার এই এক মেয়েছেলের নেশা। বন্ধুবান্ধবরা অনেকভাবে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরাবার চেষ্টা করেছে, খারাপ অসুখের ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু অমল কিছুতেই শুনবে না। এখন অনেকেই অমল সম্পর্কে আশা ছেড়ে দিয়েছে।

সেইজন্যই গঙ্গায় নৌকোর ওপরে অমলের সঙ্গে সুপ্রিয়াকে দেখে ধূর্জটি শুধু অবাক হয়নি, দুঃখিত হয়েছিল খুব। সুপ্রিয়া এ কী সাংঘাতিক ভুল করেছে! সুপ্রিয়া যদি অন্য কারুর সঙ্গে প্রেম করতেই চায়, তাহলে তার স্বামীর বন্ধু দিলীপ বসুর মতন কারুর সঙ্গে প্রেম করুক না। এইসব লোক অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। তা ছাড়া কক্ষনো মনে আঘাত দেওয়ার মতন কিছু করবে না। অমল তো তার নিজের শরীর থেকে সুপ্রিয়ার স্পর্শ মেলাতে-না-মেলাতেই আবার আর একটা মেয়ের কাছে চলে যাবে!

স্মৃতিকণার বিছানার পাশে বসে ধূর্জটি একটা গভীর তৃপ্তির স্বাদ পায়। এ-রকম সুখ আর কেউ কখনো পায়নি। দু-জনে দু-জনকে যদি ঠিক মতন বুঝতে পারে—তার থেকে বড়ো ভালোবাসা আর কী থাকতে পারে? স্মৃতিকণা যখন ধূর্জটির কবিতার দু-একটা লাইন উচ্চারণ করে, তখন তার মনে হয়, সে নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেল!

স্মৃতিকণার হাতটা একটু ছুঁয়েই ধূর্জটি যে আনন্দ পায়, সহস্র নারীকে ভোগ করেও রাজা যযাতি সে-আনন্দ পায়নি। স্মৃতিকণাকে ভালোবেসে ধূর্জটির যেন পুনর্জন্ম হয়েছে।

স্মৃতিকণাদের বাড়ি থেকে ফেরবার সময় ধূর্জটির একদিন হঠাৎ মনে হল, প্রায় রোজই এ পাড়ায় আসছে যখন, তখন একদিন বোধ হয় সুপ্রিয়াদের বাড়িতেও যাওয়া উচিত। হয়তো সুপ্রিয়া দু-একদিন তাকে দেখে ফেলেছে।

সুপ্রিয়া যদি ভাবে, এ পাড়াতে এসেও ধূর্জটি ওদের বাড়িতে আসছে না, তার মানে সে ওদের অগ্রাহ্য করতে চায়। না, সেরকম তো কিছু নয়। সুপ্রিয়ার ওপর তার তো কোনো রাগ নেই। বরং খানিকটা করুণার মতন ব্যাপার আছে।

বিকেল হয়ে গেছে। এখন গেলে নিশ্চয়ই খুব একটা খারাপ দেখাবে না। খুব অন্তরঙ্গতা না থাকলে ঘোর দুপুর বেলা কেউ কারুর বাড়ি যায় না। কিন্তু বিকেল বেলা যে-কেউ আসতে পারে।

ওপরে উঠে এসে ধূর্জটি দরজার কলিং বেলের বোতাম টিপল।

চাকর বা রাঁধুনি নয়, দরজা খুলল সুপ্রিয়াই। যেন সে অন্য কারুর কথা ভেবে তাড়াহুড়ো করে নিজেই দৌড়ে এসেছে।

সুপ্রিয়া ধূর্জটিকে দেখে খুবই অবাক হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত কোনো কথাই বলতে পারছে না। তাই ধূর্জটি হালকা করে বলল, এই একটু চা খেতে এলাম। সুপ্রিয়া তবুও কোনো কথা বলছে না দেখে ধূর্জটি বলল, কি, অসময়ে এসে বিরক্ত করলাম নাকি? তুমি ব্যস্ত আছ? অন্য কারুর আসার কথা আছে?

সুপ্রিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, না, না এসো! তুমি তো সেই সেদিনের পর আর এলেই না।

দু-জনে এসে বসবার ঘরে সোফায় বসল। সারাফ্ল্যাটটা নিস্তব্ধ। বাচ্চামেয়েটা কোথায় গেল?

সে-কথাই জিজ্ঞেস করল ধূর্জটি।

তোমার মেয়ে কোথায়? এখনও তো দেখলামই না। সেদিনও ঘুমিয়ে পড়েছিল।

সুপ্রিয়া বলল, সে তো রাঁধুনির সঙ্গে পার্কে বেড়াতে গেছে। তুমি একটু বোসো, চায়ের জল চাপিয়ে দিয়ে আসি। চাকরটাও আজ ছুটি নিয়েছে—

সুপ্রিয়া রান্নাঘরে যাওয়ার পর ধূর্জটি চিন্তা করতে লাগল। চাকর ছুটিতে, মেয়েকে নিয়ে রাঁধুনি বেড়াতে গেছে, ফ্ল্যাট একদম ফাঁকা। যেন একটা সাজানো স্টেজ। সুপ্রিয়ার মুখের অস্থিরতা দেখে মনে হয়, নিশ্চয়ই কারুর জন্য অপেক্ষা করছিল সে।

কার জন্য? অমল? তা ছাড়া আর কে? ওরা দু-জনে কি এতটা নীচে নেমে গেছে? দীপংকরবাবু তো এখন কলকাতাতেই আছে!

অমলের সাহস খুবই বেড়ে গেছে। কিংবা সে এখন বেপরোয়া হয়ে গেছে। বন্ধুবান্ধবরা

অমলকে সাবধান করে দিয়েছিল, সে যখন বাজারের মেয়েদের নিয়েই সন্তুষ্ট, তখন সে যেন আর ভদ্র মেয়েদের দিকে নজর না দেয়। তার ওই রূপ দেখিয়ে ভদ্র মেয়েদের সর্বনাশ করার অধিকার আর নেই। অমল শোনেনি একথা। সে সুপ্রিয়াকে নষ্ট করতে আসে। আহা, সুপ্রিয়া রণজয়ের বোন, সে যদি এ-রকম একটা বিশ্রী লোকের পাল্লায় পড়ে—

ফিরে এসে সুপ্রিয়া বলল, রোজই ভাবতাম, কবে তুমি আসবে। আমি অপেক্ষা করতাম তোমার জন্য।

মুখটা কুঁচকে গেল ধূর্জটির। কত বড়ো মিথ্যে কথা! মেয়েরা অম্লানবদনে এ-রকম মিথ্যে কথা বলতে পারে! (না, না, সব মেয়ে নয়, স্মৃতিকথার মতন মেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা)। সুপ্রিয়া খুব ভালো করেই জানে, ধূর্জটি যেকোনো সময় আসবার মতন সম্পর্ক পাতায়নি কখনো তার সঙ্গে। সে তো কখনো অমলের মতন সুপ্রিয়ার কোলে মাথা দিয়ে শোয়নি! এক্ষুনি যদি অমল এসে পড়ে, তাহলে বেশ মজা হবে।

সুপ্রিয়াকে একটু আঘাত দেওয়ার লোভ সে সামলাতে পারল না। সিগারেট ধরিয়ে বলল, অমলের কী খবর?

যা ভেবেছিল তাই, সুপ্রিয়ার মুখখানা সাদা হয়ে গেল। ভূত দেখার মতন চোখ করে তাকিয়ে রইল ধূর্জটির দিকে।

কয়েক পলক ওইরকম ভাবে তাকিয়ে থাকার পর আবার হঠাৎ সুপ্রিয়ার মুখটা লালচে হয়ে গেল। সে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তুমি আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে এসেছ?

ধূর্জটি অবাক হয়ে বলল, কীসের প্রতিশোধ?

তুমি আমাকে শাস্তি দিতে এসেছ?

কীসের শাস্তি? তুমি কী বলছ, সুপ্রিয়া?

তুমি অমলের নাম করে…

শোনো, শোনো, আমি বলছিলাম যে, অমল…

না, না, তোমাকে কিছু বলতে হবে না!

এরপর সুপ্রিয়া যা করল, তা আরও নাটকীয়। সে হঠাৎ উঠে এসে ধূর্জটির হাত ধরে ব্যাকুলভাবে বলল, ধূর্জটিদা, তুমি আমায় ক্ষমা করবে?

বিব্রত হয়ে ধূর্জটি বলল, আরে, এ কী, এ কী! ক্ষমার কি আছে?

না, তুমি কথা দাও! আমি একবার ভুল করেছি, আর জীবনে কখনো করব না। তুমি ক্ষমা করবে কথা দাও!

তুমি কী দোষ করেছ? তোমাকে আমি কীজন্য ক্ষমা করব?

তুমি অমলের কথা আর কখনো উচ্চারণ করবে না। কোনো দিন আর কারুকে বলবে না। আমার গা ছুঁয়ে বলো। ওটা একটা দুঃস্বপ্ন। আমি নিজেই ওই পরিচ্ছেদটা একেবারে ভুলে যেতে চাই। তুমি কারুকে বলবে না বলো!

ধূর্জটি একটুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল। সুপ্রিয়ার গলার স্বর শুনেই একটা জিনিস স্পষ্ট বোঝা যায় সে ধূর্জটিকে ভয় পাচ্ছে। সে ভেবেছে, ধূর্জটি সুপ্রিয়ার গোপন অভিসারের কথা চতুর্দিকে বলে বেড়াবে। কিংবা ধূর্জটি বুঝি সুপ্রিয়ার গোপনীয়তার জন্য তাকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছে।

ছি ছি সুপ্রিয়া তাকে এত ছোটো ভাবে? সুপ্রিয়া তার বন্ধুর বোন, তার কোনো ক্ষতি করার কথা ধূর্জটির মাথায় কখনো আসতে পারে?

সুপ্রিয়া, আমি কী এমন কিছু করতে পারি, যাতে তোমার কোনো বিপদ হয়? না, না, তুমি কথা দাও! আগে আমার গা ছুঁয়ে কথা দাও! ধূর্জটির মনটা খারাপ হয়ে গেল। সুপ্রিয়া একেবারে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ধূর্জটি আলতোভাবে তার বাহু ছুঁয়ে আস্তে আস্তে বলল, এই তোমার গা ছুঁয়ে দিলাম, কোনোদিন অমলের কথা কেউ জানবে না।

সুপ্রিয়ার মুখ থেকে যেন দমকা হাওয়ায় সব মেঘ উড়ে গেল। ঝলমল করে উঠল আলো। সে বলল আমি তো জানি, তোমার ওপর সবসময় নির্ভর করতে পারি। তুমি আমার বন্ধু!

আবেগ লুকোবার জন্য সুপ্রিয়া দৌড়ে চলে গেল চা নিয়ে আসতে। ধূর্জটির আর এক মুহূর্তও বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তার মুখ বিস্বাদ হয়ে গেছে। সুপ্রিয়া শেষপর্যন্ত তাকে এত খারাপ ভেবেছে! সুপ্রিয়া অন্য কারুর সঙ্গে প্রেম করলেই বা ধূর্জটি আপত্তি করতে যাবে কেন? অন্য কারুকে বলতেই-বা যাবে কেন? সে যত ইচ্ছে অন্য পুরুষের সঙ্গে গঙ্গায় নৌকো নিয়ে বেড়াক না, তাতে ধূর্জটির কী আসে-যায়? সে শুধু ভেবেছিল, অমল সম্পর্কে একটু সাবধান করে দেবে। তাও তো বলেনি শেষপর্যন্ত।

নেহাত এসেই চায়ের কথা বলেছিল ধূর্জটি, চা না খেয়ে উঠে যেতে পারল না। চুপ করে বসে রইল।

চা নিয়ে আসতে আসতে সুপ্রিয়ার মনে হল, ধূর্জটির কাছে যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা দেখানো হয়নি। ধূর্জটির মুখটা খুব শুকনো দেখাচ্ছে।

সুপ্রিয়া চা নিয়ে বসল ধূর্জটির একেবারে পাশে। খুব অন্তরঙ্গ সুরে জিজ্ঞেস করল, ধূর্জটিদা,

তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সত্যি করে উত্তর দেবে?

কী?

সত্যি করে উত্তর দেবে বলো?

নিশ্চয়ই।

তুমি এখনও আমাকে আগের মতন ভালোবাসো?

ধূর্জটি দীপংকরের মতন যখন-তখন ভালোবাসা কথাটা উচ্চারণ করা পছন্দ করে না। সে মনে মনে একটু কৌতুকবোধ করল। আগের মতন মানে কী? আগেও তো তোমাকে ভালোবাসিনি সুপ্রিয়া! কিন্তু কোনো মেয়ের ব্যগ্র মুখের সামনে এ-রকম কথা বলা যায় না। ধূর্জটির এইটুকু রসবোধ আছে।

সে হালকা গলায় বলল, নিশ্চয়ই?

সুপ্রিয়ার মনটা হঠাৎ খুব নরম হয়ে গেল। সে অনুভব করল, ধূর্জটির ওপর একসময় সে সত্যিই খুব অবিচার করেছে। ধূর্জটি একসময় তাকে খুবই ব্যাকুলভাবে ভালোবাসত, সুপ্রিয়া সেই ভালোবাসা নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করেছে।

সুপ্রিয়া বলল, এবার আমি তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি?

বলো!

বিয়ের আগে আমি প্রায় ছেলেমানুষ ছিলাম তো! তখন অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম না। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে পড়ে সেইসব দিনের কথা, তখন বুঝতে পারি, আমি তোমাকে তখনই খুব ভালোবাসতাম। আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি, কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি এখনও তোমাকে ভালোবাসি!

ধূর্জটি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল, সুপ্রিয়ার বিয়ে হয়েছে চব্বিশ বছর বয়েসে। চব্বিশ বছর বয়েসেও যদি কেউ ছেলেমানুষ থাকে, তবে সে কি আর সারাজীবনে বড়ো হতে পারে? বরং বয়েস বাড়লে মানুষ মিথ্যে কথা বলাটা একটু কমায়। সুপ্রিয়া তাও কমায়নি।

তবু সে সুপ্রিয়ার এই কথাটা শুনে ঠাট্টা বা ইয়ার্কি করতে পারল না। সত্যি হোক, মিথ্যে হোক, সুপ্রিয়া বলেছে তো যে সে ধূর্জটিকে ভালোবাসে। এ-রকম একটি সুন্দরী মেয়ের মুখ থেকে কথাটা উচ্চারিত হতে শুনলেই একরকমের মোহ জন্মায়।

সে একটু গাঢ় স্বরে বলল, সুপ্রিয়া, আজ আমি ধন্য হলুম।

সুপ্রিয়া ধূর্জটির চোখে চোখ রাখল। বেশ কিছুক্ষণ। চোখে চোখে অনেক কথা হয়ে গেল। সত্যিকারের প্রেমিক-প্রেমিকার মতন। সেইমুহূর্তে ধূর্জটি স্মৃতিকণার কথা একেবারেই ভুলে গেল! তার মনে হল, সুপ্রিয়া আগের চেয়েও বেশি সুন্দরী হয়েছে। এক সন্তানের মায়েরাই পরিপূর্ণ নারী হয়। তার আগে মেয়েদের কেমন যেন, পেনসিল স্কেচের মতন আলতো দেখায়।

ধূর্জটি সুপ্রিয়ার একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল। সুপ্রিয়া বিন্দুমাত্র আপত্তি করল না। সে যেন আরও বেশি কিছু চায়।

ধূর্জটির মধ্যে সেই পুরোনো রূপ-চাতকটি ফিরে এসেছে। নির্জন বাড়ি, সুপ্রিয়া তার এত কাছাকাছি, সে নিশ্বাসের সঙ্গে টেনে নিচ্ছে সুপ্রিয়ার শরীরের ঘ্রাণ। এইমাত্র সুপ্রিয়া তাকে বলেছে, সে ধূর্জটিকে ভালোবাসে। হোক না মিথ্যে, তবু জীবনে অনেক মিথ্যেও তো সুন্দর।

সুপ্রিয়া আদুরে মেয়ের মতন মুখভঙ্গি করে বসে আছে। যেন সে আদর চায়। ধূর্জটি কি তাকে এখন একটু আদর করতে পারে না? এতে কী দোষ আছে? বুকের মধ্যে তৃষ্ণার তো নিবৃত্তি নেই। খানিকক্ষণ আগেই স্মৃতিকণাদের বাড়িতে, স্মৃতিকণার হাত ছুঁয়ে ধূর্জটি ভেবেছিল, পৃথিবীতে তার আর কিছুই চাইবার নেই।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধূর্জটি সুপ্রিয়ার হাতটা নামিয়ে রাখল। না, অমল গুপ্তর উচ্ছিষ্ট মেয়েকে সে করুণা করতে পারে, আদর করতে পারে না। চা খাওয়া হয়ে গেছে, এবার তার উঠে পড়াই উচিত।

তোমার নিজের হাতের লেখা দুটো কবিতা এখনও আমার কাছে আছে।

কোন কবিতা?

সে-কবিতা দুটোর কথা বোধ হয় তোমারও মনে নেই। তুমি ছোড়দাকে দিয়েছিলে, ছোড়দা তো কবিতা-টবিতা সেরকম বোঝে না। একটা বইয়ের ভাঁজে রেখে দিয়েছিল। হারিয়েই যেত, আমি যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম। আজও আমার কাছে আছে।

কই, দেখাও তো!

বোধ হয় আলমারিতে আছে।

এবাড়িতে!

হ্যাঁ, বাপের বাড়ি থেকে আমার সব জিনিসপত্তর আনবার সময়… দাঁড়াও খুঁজে দেখছি। ধূর্জটি একটু উত্তেজিত বোধ করল। তার শিগগিরই একটা নতুন বই বেরোবে। পুরোনো অনেক কবিতারই কপি হারিয়ে গেছে। যদি সুপ্রিয়ার কাছ থেকে দুটো কবিতা পাওয়া যায়, তাহলে অনেক সুবিধে হবে। সুপ্রিয়া সত্যি তার কবিতা যত্ন করে রেখে দিয়েছে? সুপ্রিয়ার কাছে কবিতার কোনো দাম আছে? ধূর্জটি তাহলে সেই সময় সুপ্রিয়াকে চিনতে ভুল করেছিল?

সুপ্রিয়া উঠে দাঁড়াল। তারপর ধূর্জটিকে বলল, তুমিও এসো! কোন আলমারিতে রেখেছি, ঠিক মনে পড়ছে না। খুঁজতে সময় লাগবে। ততক্ষণ তুমি একলা একলা বসে থাকবে কেন?

সুপ্রিয়াকে অনুসরণ করে ধূর্জটি এল ওদের শোয়ার ঘরে। এটা তার কিছুই অস্বাভাবিক মনে হল না। বাড়িতে যখন কেউ নেই, তখন বসবার ঘরে থাকা আর শোয়ার ঘরে থাকা তো একই কথা।

এঘরে কোনো চেয়ার নেই। বসতে হলে বিছানাতেই বসতে হবে। সুপ্রিয়া বিছানার দিকে হাত দেখিয়ে বলল, বোসো-না!

ঘরে তিনটে আলমারি। সত্যিই সুপ্রিয়ার খুঁজে দেখতে সময় লাগবে।

দেওয়ালের গায়ে একটা কাচের আলমারি, তাতে দীপংকরের মদের বোতল সাজানো। কয়েকটা বোতল খালি, কয়েকটা সুদৃশ্য বোতল এমনিই রাখা আছে। দুটো বোতল বোধ হয় ভরতি।

ধূর্জটিকে সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুপ্রিয়া ছোটো ছেলে-মেয়েদের ষড়যন্ত্র করার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, খাবে?

না থাক।

চাবির গোছা সুপ্রিয়ার কোমরে গোঁজা। সুপ্রিয়া সেখান থেকে চাবির রিংটা তুলে নিতেই ধূর্জটি লক্ষ করল, সুপ্রিয়ার কোমরের খাঁজ এখনও কী নিখুঁত। পিঠটা যেন ইংরিজি ভি অক্ষরের মতন। লাল ব্লাউজ পরে আছে। এক-একবার আঁচল খসে যাচ্ছে, এই সময় যদি একবার এদিকে ফিরত। এই নারীটি সত্যিই বড়ো মোহময়ী।

সুপ্রিয়া একটা আলমারি খুঁজে পেল না। সে আলমারি শুধু শাড়িতে ভরতি। শাড়ি-গয়নার সঙ্গে কি কেউ কবিতা রাখে? সুপ্রিয়া কি সত্যি কবিতা দুটো খুঁজে পাবে? হয়তো সুপ্রিয়া মিথ্যে কথা বলেছে। তবু, হোক-না মিথ্যেকথা, সুপ্রিয়ার মতন মেয়ের মুখ থেকে এ-রকম মিথ্যেও অনেক মধুর! আবার সে স্মৃতিকণাকে ভুলে গিয়ে সুপ্রিয়ার রূপের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ল। সুপ্রিয়া যদি আবার তার সামনে এসে দাঁড়ায়, তার কাঁধে হাত রাখে—

ধূর্জটির দিকে পেছন ফিরে দ্বিতীয় আলমারি খুঁজছে সুপ্রিয়া। ধূর্জটি উন্মুখভাবে তাকিয়ে রয়েছে। এই সময় দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল।

ধূর্জটি চমকে উঠল। কে হতে পারে? অমল নয় তো? এই সময় যদি অমল গুপ্ত এসে পড়ে! বেশ মজাই হবে তাহলে।

সুপ্রিয়াও এদিকে ঘুরে বিহ্বলভাবে তাকাল ধূর্জটির দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, কে?

যেন ধূর্জটিই জানে এর উত্তর। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি দরজা খুলে দিয়ে আসব? বোধ হয় অমল এসেছে–।

সুপ্রিয়া চেঁচিয়ে বলল, না। অমল এ বাড়িতে কখনো আসে না। তুমি বিশ্বাস করো, সেই যে তুমি একদিন দেখেছিলে, তা ছাড়া আমি অমলের কাছে আর কোনোদিন যাইনি। তার আগেও না, পরেও না

ধূর্জটি হাসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *