অন্দর মহল। আবু ইস্হাক ও হারুনর রশীদ।
–আবু ইস্হাক।
–জাঁহাপনা।
হারুন : হাব্সী গোলামের খবর জানো?
ইস্হাক : না, আমিরুল মুমেনীন।
হারুন : আমিও তিন দিন খোঁজ নিতে পারি নি, তাই বাগিচার মোহাফেজকে ডাকতে পাঠিয়েছি।
ইস্হাক : মোহাফেজ ডাকার দরকার নেই, আলম্পানা। গোলাম যা পেয়েছে, তার তুলনা নেই। এই বদান্যতা শুধু জিলুল্লাহ খলিফা হারুনর রশীদ-বিন্-মেহ্দীর পক্ষেই সম্ভব।
হারুন : তবু খোঁজ নিতে হয়। কারণ ওর হাসি শোনার প্রয়োজন আমার আছে। ঐ ত মশ্রুর মোহফেজ-কে নিয়ে হাজির। আহ্ আর কুর্ণিশের প্রয়োজন নেই। এসো, মশ্রুর।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, মোহাফেজ হাজির।
হারুন : মোহাফেজ, হাব্সী তাতারীর কোন তক্লীফ হচ্ছে না ত?
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, আপনার নেমক খেয়ে বহুদিন এই বাগিচার মোহাফেজ-পদে নিযুক্ত আছি। বহু কাহিনী শুনেছি। কিন্তু এমন কাহিনী কখনও শুনি নি, জাঁহাপনা। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে যে ভিক্ষুক ছিল, তৃতীয় প্রহরে সে আমীর। এ শুধু বগ্দাদেই সম্ভব।
হারুন : গোলাম লেবাস পরেছে ত?
মোহাফেজ : আমিরুল মুমেনীন, কালো চেরা, লেবাস পরার পর ওকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে।
হারুন : বহুৎ আচ্ছা। ওর কোন কষ্ট হচ্ছে না ত?
মোহাফেজ : আলম্পানা, যেটুকু তলফি, সে-শুধু অনভ্যাসের কষ্ট। বিছানা, গালিচা, গোলাম, বাঁদী, মুজরানী–এর মধ্যে হঠাৎ একটু অস্বোয়াস্তি বোধ করা কী বিচিত্র?
হারুন : কোন অস্বোয়াস্তি দেখলে নাকি?
মোহাফেজ : হ্যাঁ জনাব। এই গোলাম কাউকে হুকুম দেয় না।
হারুন : রপ্ত হোক, তখন দেবে।
মোহাফেজ : নিচে গালিচার উপর শুয়ে থাকে।
হারুন : ও-সব ঠিক হয়ে যাবে। আহেস্তা-আহেস্তা।
মোহাফেজ : আমিরুল মুমেনীন, মুজরানীরা ত বিরক্ত হয়ে গেছে।
হারুন : কেন?
মোহাফেজ : ওরা বলে, এখানে বেকার হয়ে যাচ্ছি। আজ তিনদিন খানাপিনা নাচ-গান কিছু-ই হচ্ছে না।
হারুন : হচ্ছে না?
মোহাফেজ : না, জাঁহাপনা, হবে কি করে? আমি একদিন পাঁচজন মুজ্রানীকে জনাব তাতারীর কাছে পাঠালাম। সবাই নওজওয়ান। সকলকে ফেরৎ পাঠালে। বললে, যাও।
হারুন : আচ্ছা–।
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, তা ছাড়া আপনি এত কিছু দিয়েছেন অন্য মানুষ হলে আনন্দে পাগল হয়ে যেত। এর সে-সব কিছু নেই। সব সময় গম্ভীর।
হারুন : সব সময়?
মোহাফেজ : হ্যাঁ, জাঁহাপনা। বাবুর্চিখানা ঠিক রাখে। একবার খেতে যায় মাত্র।
হারুন : একবার?
মোহফেজ : হ্যাঁ, আলম্পানা। রাতে কিছু খায় না। অলিন্দে বসে আকাশের তারা দেখে আর চুপচাপ বসে থাকে।
হারুন : কোন গোলাম বেয়াদবি করছে না ত ওর সঙ্গে?
মোহাফেজ : না, জাঁহাপনা। আপনার হুকুম–কোন্ শয়তানের বাচ্চা বরখেলাপ করবে?
হারুন : এই গোলাম হাসে না?
মোহাফেজ : জাঁহাপনা, জোরে হাসি ত দূরের কথা–গোস্তাখি মাফ করবেন, আমরা কেউ ওর দাঁতই দেখলাম না।
হারুন : হাসে না?
মোহাফেজ : না, জিল্লুল্লাহ্।
হারুন : হাসে না?
মোহাফেজ : না, জিলুল্লাহ্।
হারুন : হাসে না?
মোহাফেজ : না, জাঁহাপনা।
হারুন : একবার-ও না?
মোহাফেজ : না, জাঁহাপনা। আমি ‘গীবৎ’ পরনিন্দা করছি না। আপনি এই দোষে আমার গর্দান নিতে পারেন।
হারুন : আশ্চর্য। যাও, মোহাফেজ। তুমি খুব তরীবতের সঙ্গে ওকে রাখবে। যদি কোন ত্রুটি কানে আসে, আমি সমস্ত গোলামদের সঙ্গে তোমাকেও কতল করব।
মোহাফেজ : আস্সামায়ো তায়তান। আসোলামো আলায়কুম ইয়া আমিরুল মুমেনীন।
হারুন: মশ্রুর, মোহাফেজ যা বলে গেল, তোমার বিশ্বাস হয়?
মশ্রুর : বিশ্বাস হয় না, তবু বিশ্বাস করতে হয়, কারণ মোহাফেজ সাহেব ঈমানদার কর্মচারী।
হারুন : আবু ইস্হাক, তোমার বিশ্বাস হয়?
ইস্হাক : হয়, জাঁহাপনা!
হারুন : কেন?
ইস্হাক : হেকিমী দাওয়াই তৈরি করতে অনেক রকম উপাদান প্রয়োজন হয়। তেমনি হাসির জন্য বহু অনুপান দরকার। হাসি একটা জিনিস। কিন্তু হাসি তৈরি হয় নানা জিনিস দিয়ে; খাওয়া লাগে, পরা লাগে, আরাম লাগে, শিক্ষা লাগে, আরো বহু কিছু।
হারুন : নানা চিজ?
ইস্হাক : হ্যাঁ, খলিফ নামাদার। তার একটা উপাদানের যদি অভাব ঘটে, আর হাসি তৈরী হবে না। ধরুন, সব আছে–নিরাপত্তা নেই। হাসি তৈরি হবে না।
হারুন : হবে না?
ইস্হাক : না, জাঁহাপনা। আমার মনে হয়, অনেক উপাদান হয়ত আছে, কিন্তু কোন একটা উপাদানের অভাব ঘটেছে।
হারুন : তোমার কি ধারণা?
ইস্হাক : বেয়াদবি মাফ করবেন ত, জাঁহাপনা?
হারুন : বেয়াদবি? এই কামরায় আমি আমিরুল মুমেনীন নই, তোমাদের বন্ধু। বেয়াদবির কোন প্রশ্ন ওঠে না।
ইস্হাক : মেহেরজান কোথায়, আলম্পানা?
হারুন : সে আর কারো ‘জানে’ মেহের (করুণা) ঢালতে গেছে।
ইস্হাক : তা ত উচিত নয়। মেহেরজান বিবাহিত স্ত্রী। আর কারো জন্যে সে হারাম।
হারুন : তোমার মতে হারাম। কিন্তু আরো-কারো মতে হারাম নয়।
ইস্হাক : হারাম নয়?
হারুন : না।
ইস্হাক : এমন ফতোয়া কেউ দিতে পারে?
হারুন : আলেম পারে। এই দ্যাখো, আলেম আবদুল কুদুসের ফতোয়া। তিনি লিখছেন, মেহেরজান কেনা বাঁদী। মালিকের হুকুম ছাড়া তার কোন শাদী হতে পারে না। যদি হয়, তা না-জায়েজ (শাস্ত্ৰসিদ্ধ নয়)। মজকুর বাঁদী মেহেরজান ও গোলাম হাব্সী তাতারীর শাদী না-জায়েজ। সই দেখেছ?
ইস্হাক : দেখলাম, জাঁহাপনা। কিন্তু জনাব আবদুল কুদুস এই ফতোয়া দিলেন?
হারুন : দেবেন না কেন?
ইস্হাক : জাঁহাপনা, শাস্ত্রকে চোখ ঠারা যায়, কিন্তু বিবেককে চোখ ঠারা অত সহজ নয়।
হারুন : তুমি কি বলতে চাও?
ইস্হাক : আবদুল কুদ্দুস আল্লার কালাম বিক্রি করেছেন।
হারুন : দুনিয়া ত কেনা-বেচার জায়গা। আর তিনি তোমার মত আহম্মক নন।
ইস্হাক : কেন জাঁহাপনা?
হারুন : এই বগ্দাদ শহরে তিন্ তিনখানা আলীশান্ মাকান, ইমারৎ, বাগ-বাগিচা আর বছর বছর পাঁচ হাজার ‘দীরহাম’ যায় খাজাঞ্চীখানা থেকে। তিনি এসব খোয়াতে যাবেন নাকি তোমার মত আক্কেল দেখাতে গিয়ে? আমি কি দিই, তা-ও তিনি যেমন জানেন, আমি কি চাই তা-ও তিনি তেমন বোঝেন। দোকানদার-খরিদ্দারে এ-রকম সম্পর্ক না থাকলে কি দুনিয়া চলে?
ইস্হাক : কিন্তু, জাঁহাপনা—
হারুন : আহ, ইস্হাক, তুমি বড় বন্ধ্যা হুজ্জতে এগোও। খোওয়াব-চারী কবি, কিছুই বোঝ না। তুমি জানো, দীরহামের মোজেজা (অলৌকিক) শক্তি আছে। দীরহাম অঘটন-ঘটন-পটীয়সী।
ইস্হাক : না, আলম্পানা।
হারুন : দীরহামের তাকং অসম্ভব, অশেষ। তোমাকে বুঝিয়ে বলা যাক। তুমি কালো আঙুর পছন্দ করো, না সবুজ আঙুর?
ইস্হাক : সবুজ আঙুর।
হারুন : বেশ। সবুজ আঙুর না পেলে—
ইস্হাক : কালো আঙুর খাই।
হারুন : ধরো, বাজারে সবুজ আঙুর আছে, কিন্তু দাম খুব চড়া। অত পয়সা তোমার নেই। তখন?
ইস্হাক : তখন কালো আঙুর কিনি।
হারুন : কিন্তু মনে রেখো, তোমার কাছে নয়, শুধু এমনিতেও কালো আঙুর সবুজ আঙুর এক নয়। দুয়ের আস্বাদ আলাদা। কিন্তু তোমার দীরহামের পরিমাপে দুই-ই এক। দীরহামের কত কুওৎ, কত শক্তি বুঝতে পারছে।
ইস্হাক : পাচ্ছি, জাঁহাপনা।
হারুন : খোয়াব নিয়ে থাকো, তুমি সহজে এ-সব বুঝবে না। যাক সে ব্যাপার। কথায় কথায় আমরা অনেক তফাৎ চলে এসেছি। গোলামের হাসি বন্ধ। হয়ে গেছে কেন?
ইস্হাক : জাঁহাপনা, ও হয়ত আর হবেই না।
হারুন : আবু ইস্হাক, তোমার জন্যেই আমার পাগলাগারদ বানাতে হবে। গোলাম আবার হাসবে না? দেখে নিও, দীরহাম কি করতে পারে। মশ্রুর, তুমি সাক্ষী।
ইস্হাক : জাঁহাপনা, যদি উপাদানের অভাব হয়?
হারুন : তোমার ওসব ঝুট দর্শন, ইস্হাক। পরশু আমরা তিনজনে গোলামের হাসি শুনতে যাব, কাল খবর পাঠাব। তোমার দাওয়াৎ রইল, আবু ইস্হাক। মনে থাকে যেন, পরশু আমরা তিনজনে হাব্সী তাতারীর মেহমান।
ইস্হাক : বহুৎ খুব, জাঁহাপনা।
হারুন : মশ্রুর, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ইস্হাক আক্কলের তেজ হারিয়ে ফেলছে।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আমার তলওয়ারের তেজ কিন্তু বাড়ছে।
হারুন : চলো, এখন ওঠা যাক।
মশ্রুর : যো-হুঁকুম, আলম্পানা।