মশ্রুর : জাঁহাপনা।
হারুন : কি মশ্রুর?
মশ্রুর : কি দেখছেন?
হারুন : দেখ্ছি না, শুনছি?
মশ্রুর : কি, আলম্পানা?
হারুন : হাসি শুনছি। হাসি থেমে গেছে, তবুও শুনছি। কিন্তু আমার মহল থেকে নৈশ অভিসার! কে–কে এরা, কে?
মশ্রুর : জাঁহাপনা।
হারুন : মশ্রুর, আমি জানতে চাই, মহলের কোন বেগম না বাঁদী?
মশ্রুর : মহলের কেউ নিশ্চয়। আর ত কিছু জানার প্রয়োজন নেই আলম্পানা।
হারুন : আছে। আমার ইজ্জৎ কি কিছু নয়?
মশ্রুর : তৌবাস্তাগফেরুল্লা।
হারুন : তবে কে ওরা?
মশ্রুর : আর জানার চেষ্টা করবেন না, জিল্লুল্লাহ।
হারুন : না, আমাকে জান্তেই হবে, আর তা জানাবে তুমি।
মশ্রুর : বাদশা নামদার, বান্দাকে গোনাগার করবেন না।
হারুন : বলো তুমি কি জানো?
মশ্রুর : জাঁহাপনা, মাফ করুন বান্দাকে।
হারুন : না, মশ্রুর। পুরাতন বন্ধুদের মধ্যে শুধু তুমি আছ। তোমার প্রতি বেদীল্ হওয়ার অপরাধে আমাকে অপরাধী করো না।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আমি মাফ চাইছি দুহাত জোড় করে। আমার কম্পিত কণ্ঠস্বর শুনে কি বুঝতে পারছেন না, আলম্পানা, কেন–কেন আমার মুখ বন্ধ হয়ে আসছে।
হারুন : কিন্তু মশ্রুর, তুমি কি নিজের গর্দানের কোন দামও দাও না?
মশ্রুর : জাঁহাপনা, অনেক গর্দান নিয়েছি এই হাতে, আর কত দামী দামী গর্দান–মহামান্য জাফর বামেকী, যিনি দুনিয়াকে কামিজের গলায় কান লাগানো শিখিয়ে গেছেন–সেই গর্দান। আমার এই হলকুমের (গ্রীবাদেশ) দাম তো তুচ্ছ তার কাছে। আপনার মেহেরবানী হয়, দানা পানি নিঃশ্বাসের জন্য এই হলকুম রাখবেন–না হয় কলম-তরাস–কর্তন করবেন।
হারুন : এত অভিমান করো না। তুমি জানো, তার দাম আমার কাছে কিছু নয়। সোজা বলো, আসল রহস্য কী? বড় ভুল করেছি–কবি ইস্হাককে সঙ্গে না নিয়ে। ঐ প্রেমের দৃশ্য দেখে হয়ত উম্দা গজল লিখে বস্ত, না হয় তোমার বেয়াদবির সাক্ষী থাকত।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, এই সুমসাম রাত্রি। এই রইল তলওয়ার। আপনি নিজের হাতে আমাকে কতল করুন, কেউ দেখবেনা, কেউ শুনবে না। কিন্তু মশ্রুর বেয়াদবির কলঙ্ক বোঝা মাথায় সইতে পারবে না। নচেৎ হুকুম দিন, আপনার বহু নেমক-পানি যে হলকুমের পথে গেছে, তা আপনার সামনে এই তলওয়ার খিঁচে দুফাঁক করে আপনাকে উপহার দিয়ে যাই।
হারুন : মাথা তোলো, মশ্রুর। আমার ইজ্জৎ তুমি দেখছ না। কোন ব্যভিচারিণী বেগম থাকলে তোমার কি উচিৎ নয়, হুঁশিয়ার হওয়ার জন্য খবর দেওয়া? তুমি বন্ধুর কাজ করছ না।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, আমি এইটুকু বলতে পারি, মজকুর আওরৎ মহলের কোন বেগম নয়।
হারুন : বেশ। তাহোলে তুমি আসল ভেদ খোলাসা করছ না কেন? তোমার বাধা কোথায়? আর মনে রেখো, মহলের ভেতর ব্যভিচারিণী বাঁদী পর্যন্ত আমি রাখতে পারি না।
মশ্রুর : ও ব্যভিচারিণী নয়, জাঁহাপনা। তাও আপনাকে জানিয়ে দিলুম।
হারুন : তুমি ধাঁধা আরও বাড়িয়ে তুলছ, মশ্রুর।
মশ্রুর : আমাকে গোনাগার করবেন না। তার চেয়ে তলওয়ার নিজের হাতে গ্রহণ করুন। মশ্রুর প্রাণের জন্য এতটুকু লালায়িত নয়। অবাধ্য বান্দা হিসেবে তার বাঁচার কোন অধিকার নেই, বাঁচতে চায় না সে।
হারুন : আমি জানতে চাই।
মশ্রুর : আমি জানাতে পারি না, আমি অক্ষম, আলম্পানা।
হারুন : কেন পারো না?
মশ্রুর : আরো মানুষ এর সঙ্গে জড়িত।
হারুন : বেশ। আচ্ছা নাদান তুমি, এতক্ষণ তা বলে নি কেন?
মশ্রুর : জাঁহাপনা, বান্দার আক্কেল কম, তা আপনি জানেন।
হারুন : শোনো মশ্রুর, আমি পাক্ কোরান-ছোঁয়া কসম করে বলছি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তির কোন ক্ষতি করব না। আর তার গোস্তাখি যদি অমার্জনীয় হয়–হজরত মোহাম্মদ (দঃ) এর নামে কসম, তবু আমি তার বা তাদের কোন ক্ষতি করব না।
মশ্রুর : আলম্পানা, তাহোলে শুনুন। এর মধ্যে কোন রহস্য নেই। মজকুর আওরৎ আর্মেনী বাঁদী, নাম মেহেরজান। বেগম জুবায়দা ওকে খুবই পেয়ার করেন। তাই হাব্সী গোলামের সঙ্গে গোপনে ওর শাদী দিয়েছেন।
হারুন : হাহ্ হা, মশ্রুর। এ-ই কথাটুকু বলতে তোমার এত সঙ্কোচ। তুমি হাসালে,
সত্যি হাসালে। তুমি সাফ পানি ঘোলা করতে ওস্তাদ। বেগম জুবায়দা এমন কিছু কসুর করেন নি, যার জন্য তুমি এত ঘোরপাক খেলে।
মশ্রুর : তবু জাঁহাপনা, আমি যে তার কাছে কড়াল করেছিলাম—
হারুন : সে আমি দেখব। মশ্রুর, সত্যি হাসি পাচ্ছে। একটা ছোট ব্যাপার নিয়ে হঠাৎ যদি কিছু করে বসতাম, আমার আফসোসের সীমা থাকত না। কিন্তু মশ্রুর, আমি এমন বাঁদী জীবনে দেখি নি।
মশ্রুর : জাঁহাপনা, মেহেরজান সত্যি খুবসুরাৎ। মুসলে এক সিপাহসালারের ‘মাল-এ গনীমৎ’ (যুদ্ধের বাখরায় প্রাপ্ত দ্রব্য) ছিল। বেগম সাহেবা ওকে মহলে আনান। বড় বিশ্বাসী আওরৎ। তাই বেগম সাহেবা ওকে ভালবাসেন।
হারুন : মশ্রুর, কিন্তু কাল আবার রাত্রে দেখা হবে। আমার অন্য এরাদা আছে। বেগম সাহেবা যেন এইসব রাত্রির খোঁজ না পান।
মশ্রুর : বহুৎ আচ্ছা, জনাব। বান্দার গর্দান জিম্মা।
হারুন : হ্যাঁ, শোনো মশ্রুর। তুমি কবি ইস্হাককে খবর দিও, সে যেন রুবাব সঙ্গে নিয়ে কাল রাত্রে হাজির হয়।
মশ্রুর : আস্সামায়ো তায়তান ইয়া আমিরুল মুমেনীন।