অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় উপস্থিত হলেন। দুর্বল শ্রেণীর মুষ্টিমেয় লোক-যারা তাঁর প্রতি আগেই ঈমান এনছিল তারা ছাড়া গোটা কুরাইশ সম্প্রদায়ই তাঁর নিকৃষ্টতম দুশমনে পরিণত হয়েছে। এমতবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জের সময় মক্কায় আগত নানা গোত্রের লোকদের কাছে উপস্থিত হলেন। তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহব্বান জানালেন এবং বললেন, “আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর প্রেরিত নবী। তোমরা আমাকে সমর্থন করো এবং যুলুম থেকে রক্ষা করো তা হলে আল্লাহ আমার কাছে যে বাণী পাঠিয়েছেন তা তোমাদের কাছে পেশ করবো এবং বিশ্লেষণ করবো।”
রাবিয়া ইবনে আব্বাদ বর্ণনা করেন:
আমি তখন সবেমাত্র যুবক। পিতার সাথে মিনায় গিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মক্কার বাইরে থেকে আগত বিভিন্ন আরব গোত্রের শিবিরসমূহে গিয়ে নিম্নরূপ ভাষণ দিচ্ছিলেন, “হে অমুক অমুকের বংশধর, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করো না। তোমাদেরকে এসব প্রতিমার পূজা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যাতে তোমরা আমাকে সমর্থন কর, আমার প্রতি ঈমান আন এবং আমাকে যুলুম থেকে রক্ষা কর আর আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দিতে পারি।” এই সময় তাঁর পেছনে তাঁকে অনুসরণ করছিল একজন টেরাচোখা, মাথায় দুটো জটাধারী এবং আদন অঞ্চলের পোশাক পরিহিত একটি লোক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই তাঁর দাওয়াতী বক্তৃতা শেষ করেন,অমনি সে বলে, “হে অমুক অমুকের বংশধর, এই ব্যক্তিটি (মুহাম্মাদ) তোমাদেরকে লাত ও উযযার পূজা ত্যাগ করতে বলছে এবং বনু মালিক ইবনে উকাইশের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক বর্জন করতে বলছে। [৩৫.উকাইশ অর্থ অপ্রাপ্ত উট যা যে কোন জিনিস দেখে ভয়ে পালায়। বনু মালিক ইবনে উকাইশ জ্বিনদের একটি গোত্রের নাম।] এক নতুন ও বিভ্রান্তিকর দাবী তুলে মানুষকে বিপথগামী করার চেষ্টা করছে। তার আহ্বান সে দিকেই। তোমরা তার কথায় কান দিও না এবং তার অনুসরণ করোনা।” আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছু ধাওয়া করে যে লোকটি তাঁর দাওয়াতকে খ-ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে, সে কে?” তিনি বললেন, “সে মুহাম্মাদের চাচা আবু লাহাব আবদুল উযযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব।”
ইবনে ইসহাক হলেন, ইবনে শিহাব যুহরী আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগতভাকে কিন্দা গোত্রের লোকদের প্রতিটি শিবিরে গিয়ে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেন। কিন্তু তাদের সরদার মুলাইহ সহ সকলে তাকে প্রত্যাখ্যান করে।
তিনি বনু আমের ইবসে সা’সা’য়া গোত্রের লোকদের কাছেও যান, তাদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকেন এবং নিজেকে তাদের সামনে পেশ করেন। জবাবে বাইহারা ইবনে ফিরাস নামক এক ব্যক্তি বললো, “আমি যদি এই কুরাইশ যুবককে নিই তা হলে তার সাহায্যে গোটা আরব ভূমি দখল করতে পারবো।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর নিম্নরূপ সংলাপ হয়,
বাইহারা: “আচ্ছা, যদি আমরা তোমার আনুগত্য করি ও তোমর কাজে সহায়তা করে অতঃপর আল্লাহ তোমাকে জয়যুক্ত করেন, তখন কি আমাদের হাতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেবে?”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম: “ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আল্লাহর ইখতিয়ারাধীন। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন।”
বাইহারা: “তাহলে শুধু তোমার খাতিরে সমগ্র আরব জাতির সামনে আমাদের বুক পেতে দেয়ার কি অর্থ থাকতে পারে? তুমি বিজয়ী হলে তো ক্ষমতা চলে যাবে অন্যদের হাতে তোমার এ কাজে আমাদের শরীক হওয়ার কোন দরকার নেই।”
এভাবে বনু আমের গোত্রও তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলো। হজ্জ শেষে লোকদের মক্কা ত্যাগ করে নিজ নিজ এলাকার দিকে যাত্র করলো। বনু আমের গোত্রের লোকজনও নিজ গোত্রের কাছে ফিরে দিয়ে তাদের এক অতিশয় বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির কাছে উস্থিত হলো। বার্ধক্যের কারণে তিনি হজ্জে যেতে পারতেন না। প্রতি বছরই তারা হজ্জ থেকে ফিরে এসে ঐ বৃদ্ধের কাছে যেতো এবং সেখানকার ঘটনাবলী তাকে জানাতো। এ বছরও তারা ফিরে গেলে বৃদ্ধ তাদেরকে তাদের উৎসবের ঘটনাবলী জিজ্ঞেস করলো তারা বললো, “এবার কুরাইশদের এক যুবক আমাদের কাছে এসেছিলো। বনু আবদুল মুত্তালিব গোত্রের আরো একজন লোক তার পিছু পিছু এসেছিলো। সেই যুবকের দাবী হলো, সে নবী। সে আমাদের কে অনুরোধ জানিয়েছিলো যে, আমরা যেন তাকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করি, তার সমর্থন করি এবং তাকে আমাদের এলাকায় নিয়ে আসি।” একথা শুনে বৃদ্ধ তার নিজের মাথার ওপর হাত দু’খানা রাখলেন এবং বললেন, “হে বনী আমের, তোমরা যা হারিয়ে এসছো, তা আবার ফিরে পাওয় যায় কিনা ভেবে দেখো। কারণ ইসমাঈলের বংশধর কখনো নবী হবার মিথ্যা দাবী করেনি। আল্লাহর শপথ, ঐ যুবক যা বলেছে তা সম্পূর্ণ সত্য। তোমরা কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে না?”
আবদুল্লাহ ইবনে কা’ব কলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু হানীফা গোত্রের লোকদের সাথেও তাদের আস্তানায় গিয়ে দেখা করেন, তাদের কাছে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছান এবং তাঁকে সমর্থন দেয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু তারা সবচেয়ে জঘন্যভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে কাজ চালিয়ে যেতে লাগরেন। হজ্জ কিংবা অন্য কোন উপলক্ষে মক্কায় কিছু লোক সমবেত হলেই তিনি তাদের কাছে যেতেন। এভাবে প্রত্যেক গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতেন। তাঁর কাছে আগত খোদায়ী রাহমাত ও হিদায়াত গ্রহণ করার জন্য তিনি অনুরোধ জানাতেন। যে কোন নামকরা ও গণ্যমান্য আরব মক্কায় এসেছে জানতে পারলেই তিনি তার কাছে যেতেন এবং আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিতেন।
বনু আমর ইবনে আওফ গোত্রের সুয়াইদ ইবনে ছামিত হজ্জ কিংবা উমরাহ উপলক্ষে মক্কা এসে সে খবর শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে দেখা করলেন এবং তাকে আল্লাহ ও তাঁর দ্বীন ইসলামের দিকে দাওয়াত দিলেন সুহাইল বললো, “তুমি যে বাণী শোনাচ্ছ, তার অনুরূপ কিছু আমার কাছেও আছে।” রাসূলুল্লাহ বললেন,“ তোমার কাছে কি বাণী আছে? ” সে বললো, “লোকমানের বাণী সম্বলিত একখানি পুস্তিকা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এই বাণী খুব সুন্দর। তবে আমার কাছে যে বাণী, তা এর চেয়েও ভাল। তা হলো কুরআন, আল্লাহ আমার উপর নাযিল করেছেন,এটা হচ্ছে হিদায়াত এবং আলোর উৎস।”অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুয়াইদকে কুরআন পড়ে শোনালেন। তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সুয়াইদ এ দাওয়াত উপেক্ষা করলো না। সে বললো,“তুমি যে কুরআনের বাণী শোনালে, তা সত্যিই অপূর্ব। ” অতঃপর সুয়াইদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে বিদায় হয়ে মদীনায় নিজ গোত্রে ফিরে গেল। এর কিছুকাল পরেই খাজরাজ গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করে। বনু ‘আমর গোত্রের লোকেরা বলতো, “আমাদের বিশ্বাস, সুয়াইদ মুসলমান হিসেবে মারা গেছে। ” মদীনার পার্শ্ববর্তী বুয়াস নামক স্থানে আওস ও খজরাজ গোত্রের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়, তার আগেই সুয়াইদ নিহত হয়েছিল।