০৫. যেকথা বলতে বাধো বাধো লাগে

যেকথা বলতে বাধো বাধো লাগে, শুধু বন্ধুদের কাছেই স্বচ্ছন্দে বলা যায়। তাই এই শিরোনামে লিখতে চেয়েছি। পরিচিত লেখকদের কথা না বলে এবার শুরু করছি পশ্চিমবাংলার পাঠকদের নিয়ে। আমি জানি সিনেমা নাটক যতটা না সময় কেড়ে নিতে পেরেছিল টিভি তার বহুগুণ সময় কেড়ে নেওয়ায় পশ্চিমবাংলার পাঠকদের বই পড়ার অভ্যোস কমে এসেছে। যেহেতু জনসংখ্যা বেড়ে গেছে। প্রচুর তাই আমাদের বই বিক্রিরব পরিমাণ এখনও চল্লিশ পঞ্চাশের অনেক লেখকের থেকে বেশি। সময় কমে গেলেও পশ্চিমবাংলার পাঠক বই পড়েন। কিন্তু কোন বই?

বই না পড়লে ঘুম হয় না। এমন কিছু পাঠককে জানি যাঁরা তামিল তেলেগু দূরের কথা, হিন্দি ভাষার এখনকার বিখ্যাত লেখকদের কোনও লেখা পড়েননি। অসম বা ওড়িশার সাহিত্য সম্পর্কে কোনও খবর রাখেন না। যদি বলা হয় এর অন্যতম কারণ হল ভাষা না জানা তাহলেও মানা যাচ্ছে না। সংখ্যায় সামান্য হলেও এইসব ভাষার বই বাংলায় অনুদিত হয়েছে। পশ্চিমবাংলার পাঠক ভুলেও সেগুলো কেনেন না। অথচ ওড়িশা বা অসমে আমাদের বই নিয়মিত বের হচ্ছে। ওইসব ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে। ভারতের অন্য প্রদেশের পাঠকরা যখন আমাদের বই পড়ছেন তখন অন্য প্রদেশের লেখা এখানে বাংলায় ছাপা হচ্ছে না কেন? এখানকার প্রকাশকরা বলেন, ওসব বই কেউ কিনবে না।

যদি ধরে নিই অনুবাদ পড়তে পশ্চিমবাংলার পাঠকদের আগ্রহ নেই তাহলে মিথ্যে ভাবা হবে। প্রচুর ইংরেজী বইয়ের অনুবাদ এখানে হু হু করে বিক্রি হয়েছে। চিনের লেখককে আমরা চিনেছি অনুবাদ পড়ে। আর হ্যারল্ড রবিন্স, জেমস হ্যাডলি চেজ তো একসময় মুড়ি-মুড়কির মতো বাংলায় বিক্রি হয়েছে। ফরাসি বা ইতালিয়ান উপন্যাসও ভাল বিক্রি হয়েছে বাংলায়।

অতএব এই সিদ্ধান্তে আসা অস্বাভাবিক নয় যে পশ্চিমবাংলার পাঠক ভারতের অন্য ভাষার লেখালেখি সম্পর্কে আদৌ আগ্রহী নন। বিভিন্ন পত্রিকায় অন্য প্রদেশের গল্প কবিতা ছাপা হয়, পাঠকদের সেসব নিয়ে কথা বলতে শুনি না। এই কারণে একজন গুজরাতি অথবা তামিল পশ্চিমবাংলার পাঠককে কূপমন্ডুক ভাবলে প্রতিবাদ করা মুশকিল।

এই ব্যাপারটা আরও প্রকট হচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতি পশ্চিমবাংলার পাঠকের অনীহা দেখে। এখানে তো অনুবাদের ঝামেলা নেই। তবু বাংলাদেশের লেখকদের বই এদেশীয় পাঠকরা কেনেন না কেন? যে লেখকের একটি বই ঢাকায় বছরে চল্লিশ হাজার কপি হু হু করে বিক্রি হয় তার বই এদেশের পাঠকের পছন্দ না হওয়ার তো কোনও কারণ নেই? কেউ কে বলেছেন ঢাকা থেকে প্রকাশিত বইয়ের দাম খুব বেশী। ওই দামে এদেশীয় পাঠক এখানকার লেখকদের দুটো বই পেয়ে যাবেন সমান মাপের। দেখা গেল, বাংলাদেশের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকদের বই কলকাতায় ছাপা হচ্ছে, দামও আমাদের বইয়ের মতো। কিন্তু বিক্রি যা হচ্ছে তা বাংলাদেশে রপ্তানি করে।

একজন পাঠক আমাকে বলেছিলেন, বাংলায় লেখা ঠিকই, কিন্তু কেমন কেমন। পূর্ববঙ্গের অনেক শব্দ ওখানে ছড়ানো। অস্বস্তি হয়। তাছাড়া দুলাভাই, আব্বু, আপা ইত্যাদি শব্দ বড় বিপদে ফেলে দেয়।

তাঁকে যখন প্রশ্ন করি, জামাইবাবু, পিসেমশাই, মাসিমা ইত্যাদি শব্দ, আমাদের পুজোআচ্চার বিবরণ থাকা উপন্যাস গুলো ওঁদের দেশের পাঠকরা যে পরিমাণ পড়েন তাতে কখনই মনে হয় না রসগ্রহণ করতে অসুবিধা হচ্ছে। ওঁরা পারছেন আপনি পারছেন না কেন?

এবার ঝোলা থেকে বাঘ বেরিয়ে পড়ল। আমরা মুখে যতই অস্বীকার করি, পূর্ববঙ্গের পাঠকদের থেকে পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক। এখনও এদেশের অনেক মানুষ বলে থাকেন, আমরা বাঙালি ওরা মুসলমান। আর এভাবে গুটিয়ে নিতে নিতে শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বলতে বাধলেও কথাটা বলা দরকার ছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে একসময় কিছু পত্র-পত্রিকা আসত কলকাতায়। যতদূর মনে পড়ছে তেষট্টি সালে আমি পূর্বদেশ নামের একটি পত্রিকায় শওকত ওসমানের একটি গল্প পড়েছিলাম। সেই তরুণ বয়সে আমি কী পরিমাণ মুগ্ধ হয়েছিলাম তা এখনও মনে আছে। ওই গল্পে একটি বর্ণনা এইরকম ছিল, ঘষা আধুলির মত চাঁদটা এক লাফে নিষ্পত্র গাছটার ডালে উঠে বসল। মানুষটির সঙ্গে আলাপ করতে বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।

মনে পড়ছে, সেটা সম্ভবত বিরানব্বই সালের ডিসেম্বর মাস। আমার ঢাকার প্রকাশক থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন ঢাকা ক্লাবে। রাতে শুতে শুতে দুটো আড়াইটে বেজে যেত। ওখানকার বন্ধুরা সেই সময় আমার ঘর থেকে বাড়ি ফিরতেন। ফলে ঘুম ভাঙত দেরিতে। এক সকালে দরজায় শব্দ হওয়ায় চোখ মেললাম। চোখে তখন অথৈ ঘুম। উঠতে হল। বিরক্ত মুখে দরজা খুলে দেখলাম এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, পরনে পাঞ্জাবি এবং পাজামা। পাজামাটি একটু ছোট। কাধে ঝোলা। বললেন, ভাই সমরেশ, তোমার ঘুম ভাঙালাম নাকি?

যেন বহুকালের চেনা মানুষ, সম্পর্কটা গভীর, কথা বলার ধরণ এমনই। অথচ তাকে আমি কখনও দেখিনি।

বললাম, হ্যাঁ, মানে কাল রাত্রে–!

ওহো! তাহলে তুমি আর একটু ঘুমিয়ে নাও ভাই, আমি বাইরে গিয়ে বসি। ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়ালেন। কেউ আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছেন জানার পর আর যাই করি ঘুমোতে পারব না। অতএব চটপট জিজ্ঞাসা করলাম, কি প্রয়োজন যদি বলেন–!

এই সময় গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখলাম ভদ্রলোককে দেখে কপালে হাত ছোঁয়ালেন, সেলাম আলিকুম।

বৃদ্ধ সম্ভাষণটি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, কেমন আছ আজাদ?

ম্যানেজার খুব বিনীত হয়ে বললেন, হ্যাঁ, সবাই ভাল আছে। আমার মেয়ে আপনার ছড়া খুব পড়ে।

এবার বুঝলাম বৃদ্ধ লেখক, ছড়া লেখেন। অতএব খোলাখুলি বললাম, আমি কিন্তু আপনার পরিচয় এখনও জানি না।

ম্যানেজার খুব অবাক হয়ে বললেন, মজুমদার সাহেব, আপনি ওঁকে চেনেন না? উনি শওকত ওসমান সাহেব।

আমি হতবাক। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জড়তা কেটে গেল, দ্রুত ওকে প্ৰণাম করলাম। উনি মাথায় হাত রাখলেন। তারপর বললেন, তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও ভাই।

বললাম, না না। আমি ভাবতে পারিনি আপনাকে দেখতে পাব। আপনি যে আমার কাছে আসতে পারেন কল্পনাও করিনি। আসুন, আসুন ভেতরে।

কেয়ারটেকারের কাছে বিদায় নিয়ে শওকত ওসমান আমার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তুমি আমার আত্মীয়। আমি বড়ভাই কারণ পৃথিবীতে আগে এসেছি বলে তোমার আগে লেখার সুযোগ পেয়েছি। তোমার কাছে আমি আসব। এটাই তো স্বাভাবিক। বলতে বলতে তিনি ঘরের চেহারা দেখলেন।

গতরাত্রে বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর ঘর পরিষ্কার করা হয়নি। তাড়াতাড়ি যতটা সম্ভব ভদ্রস্থ করে তাকে বসতে দিলাম। টেলিফোনে চায়ের অর্ডার দিয়ে বাথরুমে গিয়ে ভদ্রস্থ হয়ে বেরিয়ে আসতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মুখ্যমন্ত্রী সাতই আগষ্ট লন্ডনে যা বলেছেন তা কাগজে পড়েছ?

না। কি বলেছেন?

পাঁচশো বছরেও দুই বাংলা এক হবে না।

আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

বৃদ্ধ হাসলেন। তারপর ছড়া বললেন,

মার্কসবাদের হেঁসেলে ঢুকেছিল ছিঁচকে
যত সব কেটে সিঁদ,
এখন তারা চমৎকার গণতকার
সেজেছে হস্তরেখাবিদ।

বললাম, আপনার সঙ্গে একমত নই। এখন বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র, আর দুই বাংলা এক বাংলা নয়। সুভাষচন্দ্ৰ বসু যেমন বেঁচে থাকতে পারেন না সময়ের কারণে তেমনই আমাদের এক হওয়ার সময়টাও পেরিয়ে গেছে।

তিনি মাথা নাড়লেন, হয়তো। আমি এখনও পুরোনো ভাবনা আঁকড়ে আছি। যাকগে, তোমাদের লেখালেখি আমরা পড়ছি। কিন্তু আমাদের লেখা তোমাদের হাতে পৌঁছায় না তা জানি। তুমি কি আমার কোনও লেখা পড়েছ?

নিশ্চয়ই। আমি সেই পূৰ্বদেশের গল্পটা বলে জানালাম, আপনি প্রথম লেখালেখি শুরু করেন। উনিশশো আটত্রিশ সালে। বুলবুল পত্রিকায় আপনার তিনটি কবিতা ছাপা হয়। চুয়ান্ন বছর হয়ে গেল। তাই না?

শওকত ওসমান অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরার পর তার হৎপিন্ডের শব্দ যেন আমি শুনতে পেয়েছিলাম।

কিছুক্ষণ পরে চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম, এখন কি লিখছেন?

সত্তার সঙ্গে সংলাপ। খবরের কাগজের পাতায় নিজের সঙ্গে কথা বলছি। আর লিখছি ছড়া।

সেদিন কথা বলতে বলতে তিনি আমাকে কয়েকটি ছড়া লিখে দিয়েছিলেন।

এই সুযোগে পাঠকদের কাছে সেগুলো পৌঁছে দিচ্ছি।

এক,
বড় অসহায় রসুল ও আল্লা
যেদেশে সরকার খোদ মোল্লা।

দুই,
বৃদ্ধকালে বউ তালাক দেওয়া চলে
বন্ধুজনে দেওয়া মানে নির্ঘাৎ মরা
কী নিয়ে বাঁচব যদি, প্রস্রাবে নয়,
প্রাত্যহিকতায় না থাকে শর্করা?

তিন,
মৌলবাদ আসলে মল-উৎপন্ন
ভেতরে রক্ত-জমাট ফলে কৃষ্ণবর্ণ।।

চার,
আমি বেশ্যা
বেশ্য আমার মা
বেশ্যা ছিলেন নানী
আমরা তিন পুরুষ পাকিস্তানী।

স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে শওকত ওসমান ধর্মের বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না। ওঁর এই কবিতাটি পড়ে আমি চমকে গিয়েছি। ঢাকায় যেখানে মৌলবাদীদের মিছিল যে কোনও বাহানায় হিংস্র হয়ে ওঠে সেখানে থেকে তিনি কী করে এই লেখা লিখলেন?

মুসলমানদের ঘরে চুরির পর
ধরা পড়ে করিম হল, বদমাস চোর।
মুসলমানের ঘরে সেই অপরাধে
ধরা পড়ে গোপাল হল, হিন্দু খচ্চর।।

হিন্দুর ঘরে চুরির পর
ধরা পড়ে গোপাল হল, বদমাস চোর।
হিন্দুর ঘরে সেই অপরাধে
ধরা পড়ে করিম হল, মুসলমান খচ্চর।।
ধর্ম অনুসারে নির্ণয় হয়
যতো কাজের ধর্ম।
এদেশে হিন্দু মুসলমান হতে লাগে
আহম্মকি, অন্যায়, অপকর্ম, দুষ্কর্ম।।

সেই সকালটা চমৎকার কেটেছিল। শুনলাম প্রায় দু মাইল পথ তিনি হেঁটেই এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। অনেকেই মুক্তমনের কথা বলেন কিন্তু শওকত ওসমান সেটা কাগজে-কলমে লিখে গেছেন।

একথা আজ অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলায় যারা এতকাল লেখালেখি করেছেন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্ৰ, শরৎচন্দ্রের পরে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের নাম হুমায়ূন আহমেদ। এই জনপ্রিয়তা অবশ্যই বই বিক্রির ওপর ভিত্তি করেই বলতে বাধ্য হচ্ছি। একথাও ঠিক শরৎচন্দ্ৰ, যার বই রবীন্দ্রনাথের থেকেও অনেক বেশি বিক্রি হত তাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে হুমায়ূন। একুশের মেলার সময় ওঁর অন্তত গোটা চারেক বই প্রকাশিত হয়। সেগুলো মেলা শেষ হওয়ার সময় অন্তত চল্লিশ পায়তাল্লিশ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। বইগুলো মূলত উপন্যাস। এই বইগুলো পাওয়ার জন্যে প্রকাশকেরা সারা বছর তদ্বির করেন। পশ্চিমবাংলার প্রকাশক কোনও লেখককে দশ হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন না। এই রীতি এখানে চালুই হয়নি। কিন্তু ঢাকার প্রকাশকরা একটি বইয়ের জন্যে হুমায়ূনকে দশ লক্ষ টাকা আগাম দিতে প্ৰস্তুত, দিয়েও থাকেন। হুমায়ুনের উপন্যাসগুলোর বেশীর ভাগই ছোট, দাম ষাট সত্তর টাকা থেকে বড়জোর দেড়শা। তাহলে কত বই বিক্রি হলে দশ লাখ টাকার আগাম লেখকের দক্ষিণা বাবদ উঠে আসে? এসব অঙ্কের কথা ভাবলেই মাথা বিমঝিম করে ওঠে।

হুমায়ূনকে আমি প্রথম দেখি বছর পনেরো আগে। সেবার প্রথম ঢাকায় গিয়েছি। একুশের বইমেলায় একটি যুবক এগিয়ে এসে আলাপ করল। রোগা, খাটো, পাজামা আর হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি পরা যুবক খুব বিনয়ী। কেউ একজন ওর পরিচয় দিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ায়, লেখে, বাংলাদেশ টিভিতে ওর লেখা নাটক এইসব দিন রাত্ৰি খুব জনপ্রিয় হয়েছে। হুমায়ূন কথা বলছিল নিচু গলায়। তখন তাকে ঘিরে কোনও ভিড় ছিল না। পাশ দিয়ে যারা বই কিনতে যাচ্ছিলেন তারা ফিরেও তাকাচ্ছিলেন না। সেদিন হুমায়ূন বারংবার বিভূতিভূষণের কথা বলছিল। ওঁর বাংলা সাহিত্যের মহারথীদের প্রতি শ্ৰদ্ধা দেখে খুব ভাল লেগেছিল। সে আমার বইপত্তর পড়েছে বুঝতে পেরেছিলাম। ব্যাস, এইটুকু।

বছর চারেক পরে একুশের বইমেলায় ঢুকে দেখলাম বিশাল লাইন সাপের মতো একেবেঁকে চলে গেছে। লাইনের শুরু কোনও স্টলের সামনে থেকে নয়। মেলা কর্তৃপক্ষ একটি অফিসঘরের বারান্দায় ব্যবস্থা করেছেন লেখকের জন্যে, সেখানে বসে তিনি ভক্তদের কেনা বইতে সই দেবেন। হাজার দুয়েক লোক ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন কখন তিনি সুযোগ পাবেন। শুনলাম, আগের বারের মেলায় তিনি স্টলে বসে সই দিতেন এবং এইরকম লাইন পড়ায় আশেপাশের স্টলের লোকজন প্রতিবাদ করায় মেলা কর্তৃপক্ষ এই ব্যবস্থা করেছেন।

কোনও রকমে সামনে পৌঁছে লেখককে দেখতে পেলাম। একটার পর একটা বইয়ে সই দিয়ে যাচ্ছে মুখ নামিয়ে। এখন ও আর তেমন রোগা নেই, লম্বা হওয়ার উপায় নেই বলে শরীরের উচ্চতা একই রয়ে গেছে। আমাকে দেখতে পেয়ে সে দ্রুত চেয়ার ছেড়ে ছুটে এসে হাত ধরল, সমরেশদা, আপনি? কখন এসেছেন, কী কান্ড! আমি জানিই না। আসুন, আসুন। সেখানে দ্বিতীয় চেয়ার ছিল না। সে আমাকে তার চেয়ারেই বসতে বলল। আমি রাজি হলাম না। পাঠকরা যাঁরা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তারা অধৈৰ্য হলেন। হুমায়ূন তাদের উদ্দেশে বললেন, আপনারা কি অন্ধ? দেখতে পাচ্ছেন না কে এসেছেন? ইনি সমরেশ মজুমদার, ওঁর মতো আমি লিখতে পারি না।

লজ্জা পেয়ে চলে এসেছিলাম। কথা হল, পরে দেখা হবে। এবং বুঝলাম হুমায়ূন এখনও বিনয়ী।

তখন ঢাকায় রোজ চলছে। কথাটা আমার সবসময় মনে থাকত না। এর একটা কারণ আমার অনেক মুসলমান বন্ধু ওই সময় উপবাস করতেন না। অসুস্থ গর্ভবতী এবং দেশভ্রমণে যারা যান তারা ইচ্ছা করলে রোজা নাও করতে পারেন বলে অনুমতি দেওয়া আছে। আমি রোজায় নাই। শুনলেই আমি জিজ্ঞাসা করতাম, কেন? বেশির ভাগই হেসে উত্তর দিতেন, মুসাফির। তা হুমায়ূন যখন তার বাড়িতে রাত্রে আমাকে নেমন্তন্ন করল তখন আমি অসুবিধায় পড়লাম। সেদিনই আর একটি জায়গায় নেমন্তন্ন নিয়ে বসে আছি। বললাম, দুপুরে যাব। তখন খাব।

হুমায়ূন জিজ্ঞাসা করল, কি মাছ পছন্দ করেন?

আমি সরল গলায় বলেছিলাম, কই। যার এক পিঠে ঝোল, অন্য পিঠে ঝাল।

সেদিন ওর এলিফ্যান্ট রোডের ফ্ল্যাটে গিয়ে জমিয়ে খেয়ে গল্প করে এসেছি। গুলতেকিনে ওর স্ত্রী, খুব ভাল মেয়ে। বাচ্চারাও সুন্দর। এই সেদিন হুমায়ূন এসেছিল কলকাতায়। আমি জানতাম সেদিন দুপুরে ওরা রোজা পালা করেছিল। অথচ আমি অতিথি হয়ে খেতে চেয়েছি। দুপুরে, না বলতে পারেনি। অনেক কষ্ট করে এক হাত লম্বা কইমাছ সংগ্রহ করে ওর স্ত্রী উপবাসে থেকে রান্না করেছিল। বাড়ির সবাই খায়নি, শুধু হুমায়ূন আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে রোজা ভেঙেছিল। শোনার পর অপরাধী বলে মনে হয়েছে নিজেকে। একই সঙ্গে ভেবেছি বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে কতখানি মমতা থাকলে এই কাজ করা যায়।

ওই সময়ে শুনলাম, হুমায়ূন একটি দ্বীপে বাড়ি করেছে। কক্সবাজার থেকে সমুদ্রের ভেতরে অনেকটা গেলে সেন্ট মার্টিন নামের দ্বীপটির অনেকটাই নাকি তার। জিজ্ঞাসা করতে যেন লজ্জা পেল। বলল, চলুন, একবার আপনাকে নিয়ে সেখান থেকে ঘুরে আসি। বর্ষার সময় নয়, তখন সমুদ্রের পানি ঢুকে যায়।

সেখানে এখনও আমার যাওয়া হয়নি। কিন্তু কোনও বাঙালি লেখক শুধু উপন্যাস লিখে একটা দ্বীপের অনেকটা জমির মালিক হতে পারে তা আমার কল্পনায় ছিল না। পরে শুনেছি সে একটি প্রাসাদ বানিয়েছে ঢাকার দামী এলাকায়। লেখার সঙ্গে সঙ্গে সে টিভি নাটক করে গেছে। একের পর এক। সেগুলো এত জনপ্রিয় হয়েছে যে কোনও একটি নাটকে নায়ককে পরের পর্বে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হতে পারে বলে ঢাকার রাস্তায় বিরাট মিছিল বেরিয়েছিল প্ৰতিবাদ করে। এরপর তাকে দেখা গেল চলচ্চিত্রে পরিচালক হিসাবে। বিশাল খরচ করে ঢাকার অদূরে একটি স্টুডিও বানিয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে।

বাংলাদেশের মানুষদের অধিকাংশই গরিব। কিন্তু তারা পড়তে ভালবাসেন। পাকিস্তান আমলে যখন ভারতীয় বই ওখানে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল তখন অত্যন্ত কঁচা হাতে সেই বইগুলো বেআইনিভাবে ছাপা শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের শক্তিমান লেখকরা ভারতীয় লেখকদের বইয়ের অভাব পূর্ণ করতে পারছিলেন না। এই সময়টা চলছিল স্বাধীনতার পনেরো ষোলো বছর পর্যন্ত। হঠাৎ হুমায়ুনের লেখায় তারা নতুন স্বাদ পেয়ে গেলেন। আজকের মানুষের কথা, যে মানুষ স্বপ্ন দেখে। তার মিশির আলি সিরিজ দারুণ জনপ্রিয়। মিশির একজন সত্যসন্ধানী যিনি আমাশায় ভোগেন, ঘুমোতে পছন্দ করেন। আবার আপনার আমার মতো কথা বলেও বুদ্ধি খাটিয়ে রহস্যের সমাধান করেন। হুমায়ুনের বই বিক্রি এখন কিংবদন্তীর মতো।

বছর দুয়েক আগে আমেরিকায় ফিলাডেলফিয়া শহরে যে প্রবাসী বঙ্গ সম্মেলন হয়েছিল সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। হুমায়ূনকেও ওরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমরা একই হোটেলে ছিলাম। অনুষ্ঠানের দিন আমাদের দুজনের সামনে অন্তত হাজার আড়াই বঙ্গসন্তান বসে ছিলেন। হঠাৎ একজন উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনারা মুসলমানরা বাংলা ভাষা লেখার সময় পানি, আপা, ফুপা লেখেন কেন?

হুমায়ূন হেসে বলেছিল, এইসব শব্দ আমরা জন্ম থেকে বলে আসছি। যেভাবে টেবিল, চেয়ার, টেলিফোন বলি এবং লিখি। গল্প উপন্যাস লেখার সময় স্বাভাবিকভাবেই লেখায় শব্দগুলো আসে। বাংলা ভাষায় তো প্রচুর বিদেশী শব্দ এসেছে। আপনাদের নিশ্চয় সেগুলো পড়তে অসুবিধে হয় না।

হুমায়ুনের পরেই বাংলাদেশের জনপ্রিয় উপন্যাসিকের নাম ইমদাদুল হক মিলন। ওর বয়স এখন চল্লিশের কোঠায়, লেখালেখি এবং টিভির জন্যে নাটক তৈরি করাই ওর পেশা। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় বছর আটক আগে।

হুমায়ুনের বই যদি এক মেলায় চল্লিশ হাজার কপি বিক্রি হয় তাহলে মিলনের বই বিক্রির পরিমাণ দশ হাজারের মতো। পশ্চিমবাংলায় হাতে গোনা কয়েকজন লেখক রয়েছেন। সারা জীবনে যাদের বই দশ হাজার কিংবা তার বেশি বিক্রি হয়ে থাকে। এক বছরে বাইশশো বিক্রি হলেই ধন্য হয়ে যান কলেজ স্ট্রীটের প্রকাশক। অতএব মিলনের রোজগার যথেষ্ট ভাল। বাংলায় শব্দ সাজিয়ে সে যে বাড়ি করেছে তার দাম এক কোটির মতো।

মিলন যখন প্ৰথম আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তখনই সে বিখ্যাত। রঙচঙে জামা এবং জিনস পরতে পছন্দ করে। কখনও জিনসের ওপর পাঞ্জাবি। ও বলেছিল, তোমার আঙরাভাসা গল্পটা আমার খুব ভাল লেগেছিল।

কখন পড়েছ?

কেন? যখন দেশে ছাপা হয়েছিল।

ওই গল্প যখন ছাপা হয়েছিল তখন মিলনের বয়স পনেরো হয়নি। তারপর বুঝতে পারলাম। আমরা পশ্চিমবাংলায় বসে যা লেখোলেখি করি তার সমস্ত খবর সে রাখে। শুধু নামী লেখকের লেখা নয়, অনিল ঘড়াই চক্ৰধরপুরে বসে কলকাতার লিটল ম্যাগাজিনে কোনও অনবদ্য গল্প লিখলে সে সেটা সংগ্ৰহ করে পড়ে ফেলে। তিরিশ বা চল্লিশের দশকের লেখকের লেখা ওর প্রায় মুখস্থ। সীমানা, বই না পাওয়া ইত্যাদি সমস্যাগুলো ওর এই পাঠ্যাভ্যাসে কোনও বাধা তৈরি করতে পারেনি।

যতবার ঢাকায় গিয়েছি দেখেছি। খবর পেয়ে মিলন চলে এসেছে। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সঙ্গ দিয়েছে। দিনের পর দিন। এটা শুধু আমার একার ক্ষেত্রে নয়, কলকাতা থেকে কোনও লেখক ঢাকায় গেলেই সে সমস্ত কাজ থেকে ছুটি নিয়ে নেয়। এই ভালবাসা আমরা এখানে কেউ এলে দেখাতে পারি না। কয়েক বছর হল মিলনের গল্প, উপন্যাস প্রায় নিয়মিত ভাবেই কলকাতার কাগজ গুলোতে ছাপা হচ্ছে। পশ্চিমবাংলার পাঠকরা ওর লেখার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে ওর উপন্যাস নুরজাহান বেরিয়েছে। মুশকিল। হল, এদেশীয় পাঠকরা এখনও বাংলাদেশের পাঠকদের মতো ওঁকে গ্ৰহণ করেনি। এই একই ব্যাপার হুমায়ূন প্রসঙ্গেও দেখেছি। হুমায়ুনের প্রচুর বই কলকাতায় ছাপা হয়েছে এই আশায় যে, এখানেও ও সমান জনপ্রিয় হবে। হুমায়ূন দেশেও লিখছে। আমি জানি এখানে লেখার জন্যে। ওরা অনেক আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করছে। ঢাকায় না। চাইতেই টাকা পায়, কলকাতায় বই বিক্রি না হলে টাকা দেয় না। কিন্তু এখানে ওরা লিখতে চেয়েছে স্রেফ সাহিত্যের প্রতি আনুগত্যের কারণে।

এই লেখা শেষ করার আগে আরও একজনের কথা বলা দরকার। কিন্তু তাঁর কথা কি আমি হুমায়ূন বা মিলনের পাশাপাশি বলতে পারি? এ সং আমার ছিল। কিন্তু মাত্র এক দেড় বছরের জন্য হলেও বই বিক্রির ব্যাপারে ওদের প্রায় পেছনে তিনি চলে এসেছিলেন। তাই এই লেখায় ওঁকে আনা যেতে পারে। বাংলাদেশের লেখকদের সম্পর্কে এদেশীয় পাঠকদের স্বচ্ছ ধারণা নেই নানান কারণে। ব্যতিক্রম তসলিমা নাসরিন। কিছু মানুষ এবং খবরের কাগজ ক্ৰমাগত বাতাস করে যাওয়ায় পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ মানুষ এই নামটির সঙ্গে পরিচিত।

তসলিমা প্রথম আনন্দ পুরস্কার পেয়েছিলেন যে বছর, আমি সেই অনুষ্ঠানের দর্শক ছিলাম। দূর থেকে দেখেছি আলাপ হয়নি। ওঁর মধুর এবং নির্বাচিত শব্দের ভাষণ শুনেছি। ভাল লেগেছিল। কেউ কেউ ফিসফাস করেছিলেন। মাত্র একটি ফিচারের বই লিখে আনন্দ পুরস্কার পেয়ে গেল? আমি পাত্তা দিইনি, পুরস্কার যাঁরা দিয়ে থাকেন তাঁদের ইচ্ছেটাই শেষ কথা।

তারপরে আমার প্রকাশক পাল পাবলিশার্সের আমন্ত্রণে ঢাকায় গিয়েছি। উঠেছি। ঢাকা ক্লাবে। সেখানে তখনকার বিরোধী পক্ষ আওয়ামি লিগের দ্বিতীয় সারির নেতারা আসতেন আড্ডা মারতে। মধ্যরাত পর্যন্ত পান এবং গল্প চলত।

(অসম্পূর্ণ)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *