অন্যের লেখা পড়ার অভ্যেস এখনকার সাহিত্যিকদের মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। সম্ভবত, বুদ্ধদেব গুহ কিছুটা ব্যতিক্রম। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের আগে যাঁরা লেখালেখি করেছেন তাদের অনেকেরই এই অভ্যেস ছিল। এই প্রসঙ্গে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এবং সন্তোষকুমার ঘোষে নাম মনে পড়ছে। একজন তরুণতম লেখক কোনও অখ্যাত কাগজে ভাল কিছু লিখলে এঁরা শুধু পড়ে ফেলতেন না, মনেও রাখতেন। ভাল লাগার পরিমাণ বেশি হলে চিঠি লিখতেন। সে সময় লেখকের সঙ্গে লেখকের যেমন চাপা রেষারেষি ছিল তেমনি নতুনদের উৎসাহ দিতে ওঁদের আগ্রহের অভাব হয়নি। অমৃত পত্রিকায় হঠাৎ একটি প্রবন্ধে অচিন্ত্যকুমার আমার দেশ-এ প্রকাশিত গল্প নিয়ে অনেকটা আলোচনা করেছিলেন। তখনও উনি আমাকে চিনতেন না। এখন এই ব্যাপারটা চোখে পড়ে না। একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক স্বীকার করেছেন, তিনি একবার লিখে ফেলার পর আর নিজের লেখাও পড়েন না। পড়াশোনা আর লেখালেখি পাশাপাশি না চালানোর কথা পঞ্চাশের দশকে অনেকে ভাবতেই পারতেন না। সেই পড়াশোনা হল বিদেশী গল্প উপন্যাস এবং প্রবন্ধের বই। পৃথিবীর কোথায় সাহিত্য নিয়ে কী কর্ম হচ্ছে তা জানা না থাকলে অনেক পিছিয়ে পড়তে হবে এমন একটা ধারণা চালু ছিল। এসবের কারণে লিখতে গিয়ে অনেকেই প্রচন্ড খুঁতখুঁতে হয়ে পড়তেন। প্রথম পাতা লিখতে দশ বার, অনেকটা লিখেও ছিঁড়ে ফেলতেন। এই যে লেখা নিয়ে সিরিয়াস ভাবনা তা পঞ্চাশের দশকের তরুণ লেখকদের মধ্যে শুরু হয়েছিল বিমল করকে ঘিরে।
লেখা পড়লে লেখকের সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা মেলে না। বিমল করের লেখা পড়তে আরম্ভ করি কলেজে ঢোকার পর। ওঁর প্রায় সমস্ত লেখা পড়ে ফেলেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। পিয়ারিলাল বার্জ নামে একটি নাটক লিখে অভিনয় করেছি। ওঁর গল্প অবলম্বনে। আমার ধারণা হয়েছিল, মানুষটি খুব রোমান্টিক, একটু শীতকাতুরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপে যখন পড়ি তখন খবর পেলাম কলেজস্ট্রীট বাজারের ভেতর একটি চায়ের দোকানে বিমল কর রোজ আসেন। সঙ্গে তরুণ লেখকরাও থাকেন। একদিন দেখতে গিয়েছিলাম। ধুতি এবং পাঞ্জাবি পরা লম্বা মানুষটি আমাকে আকর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু আলাপ করতে সাহস পাইনি।
আলাপ হল যখন দেশ পত্রিকায় ছাপা হবে বলে প্ৰতিশ্রুতি পাওয়ার পরও আমার গল্প ডাকে ফেরত এল। সে সময় দেশে গল্প ছাপা মানে লেখক হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া। প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর আমি কফি হাউসে প্রায় নায়ক হয়ে গিয়েছি। গল্প ফেরত পাওয়ার পর অভিমানে, রাগে প্ৰায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে ঠিক করেছিলাম আর কখনও লিখব না। তারপরে ভাবলাম, বিমল করকে প্রচন্ড গালাগাল দেওয়ার পরই ওই সিদ্ধাস্ত নেওয়া উচিত। সেই গালাগাল করতে গিয়ে জানলাম পিওনের ভুলে কান্ডটি ঘটেছে। গল্পটি দেশে ছাপা হয়েছিল সাতষট্টি সালে।
সে সময় কলেজ স্ট্রীটের আড্ডা চলে এসেছে কার্জন পার্ক এবং কে সি দাশের দোকানে। সেই আড্ডায় আমিও জুটে গেলাম। একমাত্র সুনীলদা ছাড়া সে সময় প্রায় সব তরুণ লেখককে ওখানে দেখেছি। আড্ডায় যেমন সাহিত্য নিয়ে কথা হত তেমনি রসালাপও চলত। আমার শুধু একটাই ধারণা মিলেছিল। বিমলদা শীতকাতুরে। কিন্তু প্রচন্ড আড্ডাবাজ, চা বা সিগারেটে আপত্তি নেই, হাঁটুর বয়সী লেখকদের সঙ্গে তার মতোই মিশতে পারেন। সে সময় দেশ পত্রিকার গল্প দেখতেন উনি। তাই অনেকের ধারণা ছিল আড্ডাতে ঢুকতে পারলেই দেশে গল্প ছাপা হবে। সেরকম মতলব বুঝতে পারলেই বিমলদা তাঁর সমবয়সী লেখকবন্ধু শিশির লাহিড়িকে বলতেন, শিশির, কাটিয়ে দে। শিশিরদা তক্ষুনি সেই ছেলেটিকে ধমকাতেন, এ্যাই ছোঁড়া, তোমার কোন বান্ধবী নেই? বুড়োদের সঙ্গে সন্ধেবেলায় কেন বসে আছ। যাও, কেটে পড়। শিশিরদাকে বিমলদা একবার আদেশ দিলেন আমাকে কাটিয়ে দিতে কারণ আমার সামনে বড়দের গল্প করা যাচ্ছে না। শিশিরদা মাথা নেড়েছিলেন, উরিকবাস! বিমল, এ ছোঁড়া চলে যাওয়ার জন্যে আসেনি।
বিমলদা খুঁতখুতে মানুষ। একটা পাতা দূরের কথা, একটা লাইনও যতক্ষণ পছন্দ না হয় ততক্ষণ লিখবেন আর কাটবেন। মনে হত, সবসময় তিনি অস্বস্তিতে রয়েছেন। এই ব্যাপারটা নিজের শরীর সম্পর্কেও। আটষট্টি সালে শুনেছিলাম ওঁর দাঁতে খুব যন্ত্রনা হচ্ছে, গলায় ব্যাথা। একদিন জানালেন, ক্যানসার হয়েছে। দুহাজার সালেও সেই কল্পিত ক্যানসার একই জায়গায় থেকে গেছে। কিন্তু ভুগেছেন খুব। আর তার প্রতিফলন পড়েছে ওঁর লেখায়। কে যেন বলেছিল, বিমল করের লেখা মানে, কম্ফর্টার, মোজা, মাফলার।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের ধারা থেকে সরে এসেছিলেন কল্লোলের লেখকরা। নিয়মভাঙ্গার খেলায় মেতে তাঁরা অনবদ্য কিছু ছোটগল্প দিয়ে গেছেন আমাদের। তাদের ওই পথে হেঁটেছেন পরবর্তীকালের অনেকেই। নতুন রীতির ছোটগল্প জন্ম নিয়েছিল বিমল করের হাতে। আর সেই স্রোতে যোগ দিয়েছিলেন পঞ্চাশের তরুণরা। ছোট গল্পের অন্তর্মুখী মেজাজ এবং বিশদ বুননই শুধু নয় মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যা বিষয় হয়ে উঠল। আত্মজা গল্পটি যে-কোনও মানুষ কখনও না কখনও উপলব্ধি করেছেন যার কন্যাসন্তান রয়েছে। কিন্তু নতুন রীতি করতে গিয়ে বিমলাদা কখনও হাংরি জেনারেশন বা শাস্ত্রবিরোধীদের মতো আন্দোলনের পতাকা তোলার পক্ষপাতী ছিলেন না।
রোগা লম্বা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বিমলদাকে কখনও ময়লা পোশাক পরতে দেখিনি। কিন্তু নিজের ওপর প্রায়ই আস্থা হারিয়ে ফেলতেন। চিত্তরঞ্জন এভিন্যু একা পার হতে প্রায়ই দ্বিধায় পড়তেন। অথচ একই মানুষকে খুব ধীর গতিতে গাড়ি চালাতে দেখেছি। গাড়িতে ওঁর সঙ্গে বসে মনে হয়েছে কারও যেন কোনও অসুবিধে না হয় এভাবে উনি গাড়ি চালাতে চান। সেটা কিছুকালের জন্যে। বিমলদা যেহেতু অন্তর্মুখী মানুষ এবং পরিচিত পরিমন্ডলেই স্বচ্ছন্দ তাই কোনও বেপরোয়া ভাব ওঁর মধ্যে কখনই দেখা যায়নি।
এই বিমলদা যখন সিঁথির বাড়িতে থাকতেন তখন জানা গেল। সল্ট লেকে বাড়ি করছেন। বাড়ি বানাবার কি ঝামেলা তা আমার ঠাকুদাকে দেখে জেনেছি। কিন্তু বিমলদার বন্ধুভাগ্য খুব ভাল। ফলে বাড়িটা হয়ে গেল। ঝকঝকে সুন্দর বাড়িটা পরে বিশাল হল। এই ব্যাপারটা ওঁর স্বভাবের সঙ্গে ঠিক মেলে না। নতুন বাড়িতে একবার কয়েকজন তরুণ লেখক আর্জি জানালেন কিঞ্চিৎ ব্রান্ডি পান করাতে হবে। বিমলদা এক কথায় রাজি। পাঁচ ছয়জন জড় হলেন। গ্লাস ভর্তি জলে এক চামচ করে ব্র্যান্ডি মিশিয়ে বিমলদা বললেন, সাবধানে খাস। দেখিস শরীর যেন খারাপ না হয়। শুধু এখানে শেষ হয়নি, পরে খোঁজ নিয়েছেন কেউ মাতাল হল কিনা। হলে তো দায়টা তারই। এই হলেন বিমলাদা। ভদ্রতা শব্দটাকে ওর মতো আয়ত্ব করতে আমি আর একজনকে দেখেছি, তিনি শুধাংশু ঘোষ। চমৎকার লিখতেন। কিন্তু বাণিজ্যে সাফল্য পাননি।
বিমলদাকে কখনো গলা তুলে কথা বলতে শুনিনি। আবার দাঁতের যন্ত্রণা শুরু এবং শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ওর মনে হত ব্যথাটা থেকে গেছে।
বিমলদার প্রথম জীবন কেটেছিল হাজারিবাগ-আসানসোল অঞ্চলে। এই অঞ্চলের মানুষ তার ছোটগল্পে, উপন্যাসে উঠে এসেছে বারংবার। একমাত্র দেওয়ালেই তিনি কলকাতাকে ধরতে পেরেছিলেন প্রথম জীবনে। সে সময় তিনি কলকাতায়। কিন্তু কখনই জীবন দেখতে বাইরে পা বাড়াননি। মূলত, ঘরকুনো স্বভাব বলে তাকে লিখে যেতে হয়েছে প্রথম জীবনে অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে এবং পরবর্তীকালে পরিণত বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণের মাধ্যমে। অসামান্য প্রতিভা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। যে-মানুষ চট করে মিশতে পারেন না, হুট করে কোথাও যাওয়ার স্বভাব যার নেই তার পুঁজি ফুরিয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু আজও তার লেখার জন্যে এই যে আমরা সাগ্রহে অপেক্ষা করি এখানেই তার সাফল্য। সন্তোষকুমার ঘোষ আমায় একবার বলেছিলেন, বিমলবাবু গণেশের মতো। মায়ের চারপাশে ঘুরেই পৃথিবীটাকে দেখতে পান।
এই বিমল কর যখন অসময়-এর জন্যে আকাদেমী পেলেন তখন সমস্যা হল। পুরস্কারটা আনতে দিল্লিতে যেতে হবে যেটা ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়। সে সময় বিমলদার পুরস্কার পাওয়ায় আমরা খুব উদ্দীপ্ত। অনেক চেষ্টার পর কল্যাণ চক্রবর্তী আর আমি ওঁকে রাজি করালাম দিল্লি যেতে। আমাদেরও সঙ্গে যেতে হবে। কোনওমতে দিল্লি থেকে পালিয়ে আসতে পেরে তিনি যেন বেঁচে গেলেন। পথে ট্রেনে একটি ঘটনা ঘটেছিল। হঠাৎ আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। ওপরের বাঙ্কে শুয়েই আসছিলাম। বিমলদা একঘন্টা অন্তর আমার খবর নিয়ে চলেছেন। উল্টোদিকের বাঙ্কে একটি মধ্যবয়স্ক তামিল ভদ্রলোক কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলেন। ওঁর নীচের সিটে যে দুজন বসেছিলেন তারা পিতা এবং কন্যা। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে লক্ষ করলাম কন্যা নীচ থেকে ওপরে উঠে। ওই ভদ্রলোকের কম্বলের নীচে ঢুকে গেল। লোকটিকে কাকা সম্বোধন করতে দিনের বেলায় শুনেছি। তারপরেই আদিম কাজকর্ম আরম্ভ হয়ে গেল কম্বলের তলায়। ব্যাপারটা এমন অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াল যে প্রতিবাদ না-করে পারিনি। আমাকে অসুস্থ অবস্থায় প্রতিবাদ করতে দেখে কল্যাণ দায়িত্ব নিয়েছিল। পরের দিন বিমলদা আমাকে বলেছিলেন, পর্দার আড়ালে কি হচ্ছে তা নিয়ে এত হইচই করলি কেন? তোরা বড্ড খুঁড়তে ভালবাসিস। এটা ঠিক নয়।
বিমলদার কলম থেকে অশ্লীল শব্দ দুরের কথা যৌনতাকে উস্কে দেওয়া কোনও গল্প বের হয়নি। রতন ভট্টাচার্য একটি গল্প জমা দিয়েছিলেন দেশের জন্যে। সেখানে কাকিমার সঙ্গে ভাসুরের ছেলের শারীরিক প্রেমের বিবরণ ছিল। বিমলদা গল্পটা ফেরত দিয়েছিলেন। রতন ভট্টাচাৰ্য কাকিমা কেটে বিউদি করে আবার গল্পটি জমা দেন এই ভেবে যে, রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড়কে বিমলদা কি করে উপেক্ষা করবেন। বিমলদা বলেছিলেন, আগে ওটা গল্প হবে তারপর অন্য কথা। আদিরসে চোবানো কলমকে সহ্য করতে পারেননি তিনি।
এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। ছোট গল্পে বিমলদা যে শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছেছিলেন, উপন্যাসে সেটা সম্ভব হয় নি। তার হাতে বাংলা ছোট গল্প যে-বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। চুপচাপ বয়ে যাওয়া নদীর নিচে পাথরের ঠোকাঠুকির যে-শব্দ তা যেন শোনা যায় তার গল্পে। দেশের গল্প সম্পাদক হিসাবে একের পর এক তরুণ শক্তিশালী লেখককে তিনি আবিষ্কার করে গেছেন দীর্ঘকাল ধরে। খুবই আক্ষেপের কথা, বিমলাদা আর ছোটগল্প লিখবেন না বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। মনে পড়ছে, বিমল মিত্ৰও ঘোষণা করেছিলেন শেষ উপন্যাস লিখে ফেলেছেন, কিন্তু পরেও তার লেখা প্ৰকাশিত হয়েছে। বিমলদা যতদিন লিখবেন ততদিন বাংলা সাহিত্য লাভবান হবে।
সাতষট্টি সাল থেকে আনন্দবাজারের অফিসে আমার যাতায়াত শুরু হয়েছিল। তখন বাড়ির ভেতরটা ছিল অন্যরকম। অনেক ঘরোয়া। দেশে গল্প ছাপা হওয়ায় লেখার উৎসাহ বেড়েছে। কিন্তু প্ৰতি মাসে তো দেশ গল্প ছাপবে না। অতএব আনন্দবাজারের রবিবারের পাতায় জায়গা পেতে হবে। তখন যিনি ওই পাতার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন তিনি এখনও রয়েছেন। কিন্তু সময় কী বিপুল পার্থক্য ঘটিয়ে দিয়েছে!
রমাপদ চৌধুরীর কোন লেখা আমি প্রথম পড়ি? তিতির কান্নার মাঠ না প্রথম প্রহর? আজ মনে নেই। কিন্তু চল্লিশ বছর আগে এই মফস্বলী কিশোর এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম। যার আবেশ এখনও ভুলতে পারিনি। লেখা পড়ে মনে হয়েছিল মানুষটি অত্যন্ত রোমান্টিক। পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ একা বহন করেও মিষ্টি হাসতে জানেন। ওঁর পিয়াপসন্দ, কখনও আসেনি গল্পসঙ্কলনের গল্পগুলোয় সেই একই চাপা দুঃখ, কষ্ট, কষ্ট-সুখের কথা যা ওর সম্পর্কে আমার ভাবনাকে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিল।
রবিবারের আনন্দবাজারের জন্যে গল্প নিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকতেই যাকে টেবিলের ওপাশে দেখতে পেয়েছিলাম। তিনিই কি রমাপদ চৌধুরী! ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একটি মানুষ পৃথিবীর সমস্ত বিরক্তি মুখে নিয়ে যেভাবে তাকিয়েছিলেন তা দেখে পা বাড়াবার সাহস হয়নি। কি চাই? প্রশ্নটায় কোনও মমতা ছিল না।
গল্প–! গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।
ওখানে দিয়ে যান।
ঘরের আর এক কোণে কাজ করছিলেন যে ভদ্রলোক তিনি কিন্তু হাসিমুখে বললেন, মনোনীত হলে ছাপা হবে।
বাইরে এসে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। এরকম কাঠখোট্টা মানুষ রমাপদ চৌধুরী? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি সেদিন। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারপর আনন্দবাজারের ভেতরের চেহারা পাল্টলো। করিডোর দিয়ে হাঁটলে কাচের ওপাশে বসে থাকা মানুষটিকে দেখা যায়। এক বিকেলে দেখলাম দুজন সুন্দরী মহিলা ওর সঙ্গে গল্প করছেন এবং ওকে বেশ স্বাভাবিক বলেই মনে হল। ইতিমধ্যে কয়েকমাস কেটে গেছে এবং আমার গল্পের ভবিষ্যৎ জানা হয়নি। সুন্দরী মহিলাদের সামনে উনি আর কতটা খারাপ ব্যবহার করতে পারবেন? ঢুকে পড়লাম দরজা ঠেলে। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন, কি চাই?
আমি একটা গল্প দিয়ে গিয়েছিলাম।
সেদিন ওর সহকারী ঘরে ছিলেন না।
ছাপা হলে জানতেই পারবেন। কি নাম?
সমরেশ মজুদার। দেশে আমার গল্প বেরিয়েছে।
দেশে ছাপা হলেই এখানে ছাপতে হবে নাকি? অদ্ভুত। ওঁর গলায় এমন কিছু ছিল যে সুন্দরীরা সকৌতুকে আমার দিকে তাকালেন।
পরে বিমলদাকে ঘটনাটা বলেছিলাম। বিমলদা হেসে কথাটা উড়িয়ে দিতেন, দূর! তুই ভুল করছিস। রমাপদর বাইরেটা ওইরকম কিন্তু খুব আডাবাজ
লোক ও।
এর কিছুদিন বাদে আনন্দবাজারে ঢুকে ওঁর ঘর এড়িয়ে যাচ্ছি। এইসময় ওঁর সহকারী ডাকলেন। ওঁর নাম সুনীল বসু। কবি। এমন নির্ভেজাল ভালমানুষ খুব কম দেখেছি। বললেন, আপনাকে রমাপদবাবু খোঁজ করছেন।
অতএব ভয়ে ভয়ে দরজা ঠেললাম। সঙ্গে সঙ্গে দাঁত খিচানো প্রশ্ন, কি চাই?
আপনি আমাকে ডেকেছেন। আমার নাম সমরেশ মজুমদার।
ও। হ্যাঁ। ভাল হয়েছে, ছাপা হবে। বলেই বা হাত দিয়ে ডান হাতের কনুই ধরে অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। আমি যে তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি তা যেন মুহুর্তেই ভুলে গেলেন। একটিও কথা না বলে বেরিয়ে এসেছিলাম।
সে সময় এই অভিজ্ঞতা শুধু আমারই হয়নি। আমার সমসাময়িক লেখকবন্ধুরা বোধহয় একই কথা বলবেন। অথচ আমার চেয়ে যারা দশ বছর আগে লিখতে এসেছেন তাদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা মারতে তাকে দেখেছি। আর হ্যাঁ, ছোটখাটো এই গম্ভীর মানুষটির কাছে সুন্দরী নারীদের ভিড় লেগেই থাকত। ওঁর স্বভাবমতো উনি কথা বলতেন। কম, তারাই সম্ভবত বলে যেত। এদের বেশির ভাগ কবি হতে চেয়েছিলেন। রবিবারে কবিতা ছাপা হয় না, পুজোসংখ্যা বের হলে সূচিপত্রে আমরা এইসব কবিদের নাম আছে কিনা দেখতাম। না থাকলে মানুষটিকে খুব বেরসিক বলে মনে হত।
আমার সঙ্গে দূরত্বটা দূর হতে লেগেছিল বছর দশেক। কম সময় নয়। পুজোয় উপন্যাস লিখতে বললেন। বিকেলে ওর ঘরে গেলে দেখতাম মুখে সেই বিরক্তির ভাবটা একেবারে নেই। মুড়ি বাদাম আনিয়ে খাওয়াতেন। আর সেইসঙ্গে গল্প। এইসময় রাধানাথ ওর সহকারী হয়ে কাজ করছিল। দেখতাম নতুন কোন লেখক এলে উনি খুব সহজ গলায় কথা বলছেন। আমরা যেসব কথা ওকে বলতে ভয় পেতাম। একসময়, এখনও সেই অভ্যেসে বলতে সঙ্কোচ হয়, নবীনরা এসে অনায়াসে তা বলছে এবং উনি তাতে একটুও অসন্তুষ্ট হচ্ছেন না। মনে আছে, একজন প্রতিবন্ধীকে সাহায্য করতে রবীন্দ্রসদনে টিকিট বিক্রি করে গল্পপাঠের আসর করেছিলাম। আশাপূর্ণ দেবী থেকে বিমল কর সেই আসরে যোগ দিতে সম্মত হয়েছিলেন। রমাপদ চৌধুরী দুপাশে মাথা নেড়ে আপত্তি জানান। আমি চিনে জোঁকের মতো লেগে থাকায় শেষ পর্যন্ত রাজি হন এবং অনবদ্য গল্প পড়েন। এই ঘটনায় ওঁকে যারা চেনেন। তারা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ব্যাপারটা নাকি ওর স্বভাববিরুদ্ধ। এই একজন লেখক কোথাও যান না, সভাপতি বা প্রধান অতিথি হওয়ার কথা ভাবতেও চান না।
বিমলদার সঙ্গে রমাপদদার দুটো জায়গায় মিল আছে। দুজনেই এসেছেন কলকাতার বাইরে থেকে। খড়গপুরের রেল কলোনি থেকে ম্যাট্রিকে প্রথম বিভাগে পাশ করে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে এসেছিলেন রমাপদদা। বোঝাই যাচ্ছে সে সময় কৃতী ছাত্রদের একজন ছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেছে নিলেন লেখালেখির জগৎটাকে। ওঁর হাত থেকে বেরিয়ে এল রাটী মহুয়ামিলনের পটভূমিকায় লেখা অনবদ্য ছোটগল্প। প্রথম প্রহর থেকে বনপলাশীর পদাবলী, তাঁর লেখার ধারায় তিনি যে সবার থেকে আলাদা তা স্পষ্ট হয়েছিল। ভারতবর্ষ। গল্পটি থেকে তার লেখা অন্য বাঁক নেয়। এবং তারপর খারিজ। বিষয়ের বাহুল্য নেই, ঘটনার ঘনঘটা নেই, আমাদের প্রতিদিনের নানান সমস্যার একটিকে কেন্দ্ৰ করে তিনি প্রতি বছর মাত্র একটি উপন্যাস লেখার অভ্যোস আয়ত্ত করলেন। এখনকার লেখকরা প্রচুর লেখেন, লিখে নিজেকে নষ্ট করেন, এই অভিযোগ অন্তত রমাপদদার বিরুদ্ধে করা যাবে না। ছোট গল্প লেখা তো ছেড়েই দিয়েছেন। যতক্ষণ মাথায় কোনও বিষয় ক্লিক না করছে ততক্ষণ কলম ধরেন না। আর ওই খারিজ থেকেই তার নিজের ব্যবহার বদলে গেল। এতদিন লেখার বিষয় ছিল বাইরের জীবন, ব্যবহারে ছিলেন অন্তর্মুখী, গম্ভীর। একসময় আমার যা দেখে মনে হয়েছিল কথা বলতেও তার বিরক্তি। খারিজের পর তাঁর প্রতিটি লেখা যখন অন্তর্মুখী তখন ব্যবহারে কোনও আড়ষ্টতা নেই। সহজ হয়ে মিশতে পারছেন অপরিচিতের সঙ্গেও। এই ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করতে পারবেন মনস্তাত্ত্বিকরা কিন্তু আমার মনে হয় তিনি লেখার ব্যাপারে অহেতুক কৃপণ হয়েছেন।
গত কুড়ি বছরে রমাপদদা সম্পাদক হিসাবে যথেষ্ট সাহসী হয়েছেন। কয়েক বছর ছোটগল্প লিখছে অথবা সদ্য লিখছে এমন কারও মধ্যে সম্ভাবনা দেখলেই তাকে দিয়ে পুজোসংখ্যায় উপন্যাস লিখিয়েছেন। রবিবারে ধারাবাহিক লেখার সুযোগ দিয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই অবশ্য তাকে এবং পাঠককে হতাশ করেছে কিন্তু রামপদদা একটুও দমে যাননি। আজ সুচিত্রা যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে তা তো ওঁর এই সুযোগ করে দেওয়ার জন্যেই সম্ভব হয়েছে।
বিমলদা এবং রমাপদদার দ্বিতীয় মিল হল দুজনেই নিজের সংসারকে গুরুত্ব দিয়েছেন। নিয়মভাঙ্গার জীবন এদের কেউ বেছে নেননি। মদ্যপান, বেপরোয়া কোথাও চলে যাওয়া এদের স্বভাবে নেই। স্বামী এবং পিতা হিসেবে প্রচলিত শ্রদ্ধার জায়গা থেকে এরা কখনও সরে যেতে চাননি। নারী যদি এদের জীবনে কখনও ছায়া ফেলে তাহলে সেই ছায়ায় আবৃত হননি কখনও। ছেলেমেয়েদের সমস্যায় এরা বিচলিত হতে পারেন। কিন্তু নিজের জীবনকে জটিল করার কোনও চেষ্টা করেননি। অথচ সবাংশেই এঁরা আধুনিক। যে যাঁর জীবন দেখেছেন সাদা চোখে।
শক্তিদার খুব ভাল বন্ধু ছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। প্রায়ই দেখতাম দেশ পত্রিকার অফিসে ওর সঙ্গে গল্প করতে আসতেন শক্তিদা। কিন্তু বন্ধুর স্বভাবের সঙ্গে তার ছিল মেরুর পার্থক্য। ওঁদের দেখে আমার মনে হত শীর্ষেন্দুদা খুব উপভোগ করছেন শক্তিদার কথাবার্তা, সম্পর্কটা ছিল আন্তরিক। জলে ড়ুব দিয়েও চুল না ভেজানো বলব না, জলের পাশে বসে শীর্ষেন্দুদা আকাশের ছবি দেখার অভ্যেস আয়ত্ত করেছেন। বরং সমবয়সী বন্ধুদের থেকে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিমনদা বা রমাপদদার সঙ্গে তাঁর অনেক মিল রয়েছে। তিনি তাঁর সংসারকে ভালবাসেন। বোধহয় এই কারণেই শীর্ষেন্দুদার নামটা এবার আমার মনে এল।
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে। শ্ৰীগোপাল মল্লিক লেনের মহেশ্বর দাসের হোস্টেলে থাকি। আমার রুমমেট ত্রিদিব মালাকার কবিতা লেখে, অমৃত পত্রিকায় ফিচার। আমি জানতাম ত্ৰিদিব আর ওর বন্ধু করুণাসিন্ধু দে শীর্ষেন্দুদার খুব ঘনিষ্ঠ। সে সময় আমরা শীর্ষেন্দুদার নাম জেনে গিয়েছি। দেবেশ রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মতি নদী, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন ছোটগল্পে আলোড়ন এনেছেন। একদিন ত্ৰিদিবের সঙ্গে গেলাম শীর্ষেন্দুদার সঙ্গে দেখা করতে। সে সময় আমার মাথায় লেখালেখি করার কোনও ভাবনা ছিল না। হ্যারিসন রোডের একপাশে গলির মধ্যে একটি ঘরে তখন থাকতেন শীর্ষেন্দুদা। মেসের জীবন। খুব ভাল লেগে গেল ওঁকে। চল্লিশ পঞ্চাশ দশকে যেসব সিরিয়াস মানুষদের দেখা যেত যারা দারিদ্রের মধ্যে থেকেও কোনও অভাবকে পাত্তা দিতেন না। তাদের একজন বলে মনে হয়েছিল ধুতি এবং খন্দরের পাঞ্জাবি পরা একজন স্বচ্ছ যুবক মনেপ্ৰাণে সাহিত্য করতে চাইছেন, আর কোনও আকাঙ্ক্ষা তাঁর নেই। জানলাম, বিমল করের অত্যন্ত স্নেহধন্য তিনি। লেখার ব্যাপারে একই রকমের খুঁতখুঁতে। ওই সময়ের লেখায় শীর্ষেন্দুদা যে বিমলদার লেখায় প্রভাবিত তা অনেকেই বলে থাকেন। সেই প্রভাবটা হচ্ছে মানুষের বাইরেটাকে না দেখে তার মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে একটু একটু করে বিশ্লেষণ করা। কফি হাউসের আড্ডায় ওঁকে দেখেছি বেশিরভাগ সময় শুনে যেতে।
সে সময় বাংলা সাহিত্যে প্রচুর রখী মহারথী। পুজোসংখ্যার সূচিপত্রে তারা এতটা জায়গা জুড়ে থাকতেন যে নতুন লেখকের পক্ষে সুযোগ পাওয়া প্ৰায় অসম্ভব ব্যাপার। তবু সাগরময় ঘোষ ঠিক করলেন পর পর কয়েকজনকে তিনি সুযোগ করে দেবেন। সাগরদা পরে আমাকে বলেছিলেন, ওটা টেস্ট ম্যাচে চান্স পাওয়ার মতো ব্যাপার। তুমি সারাজীবন যত ভাল ছোটগল্প লেখ না কেন ওগুলো রঞ্জি ম্যাচের মতো। টেস্টে সেঞ্চুরি না করলে কেউ তোমাকে মনে রাখবে না। টেস্টে চান্স একবারই পাওয়া যায়। রান করতে না পারলে তুমি চিরদিনের জন্যে আউট।
কথাগুলো বলেছিলেন ঠাট্টা করেই কিন্তু ব্যাপারটা তাই দাঁড়িয়েছিল। এখন লেখকের বড় অভাব। তখন তো তা ছিল না। মনে আছে, প্ৰথম বছর লিখেছিলেন সুনিলদা, আত্মপ্রকাশ। প্রকাশমাত্রই সেটি আলোড়ন তুলেছিল, যাকে ত্রিকেটের পরিভাষায় বলা যায় সেঞ্চুরি। পরের বছর শীর্ষেন্দুদা লিখলেন। ঘূণপোকা। দেখা গেল, সাধারণ পাঠক তেমন হইচই করছেন না। কিন্তু সিরিয়াস পাঠক মুগ্ধ হলেন। ক্রিকেটের পরিভাষায় সেঞ্চুরি না হলেও পঞ্চাশ রানের একটি ইনিংস দেখে সমঝদাররা বললেন একজন জাত খেলোয়াড় এসেছেন। কোনও কোনও লেখক যা-ই লেখেন তাই পাঠকের ভাল লাগে। যেমন সুনীলদা। কারও কারও দুচারটে বই প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পেল। কিন্তু তারপর আর পাঠক রইল না। যেমন অবধূত, যাযাবর। আর জনপ্রিয়তা পেয়েছেন এমন লেখক সস্তা লেখেন বলে যেসব সমালোচক নাক সিটকান তাঁদের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়, তেত্রিশ বছর সময়টা কতখানি কাল? তেত্রিশ বছর ধরে যিনি সমান জনপ্রিয় তার পাঠকরা আপনার চাইতে নির্বোধ এমন ভাবার কোনও কারণ দেখছি না।
শীর্ষেন্দুদা ঘুণপোকায় জনপ্রিয়তা পাননি। কিন্তু ওই বই-এর বিক্রি বাড়ল অনেক পরে। যাও পাখি, পারাপার তাকে স্থায়িত্ব দিল। কিন্তু জনপ্রিয় করল দূরবীণ। পরে পার্থিব। তখন দেশ পত্রিকার বাংলাদেশে বিক্রি বন্ধ। ঢাকাতে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে বলতে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, দেশে পার্থিব বেরুচ্ছে। কিছুটা পড়ার পর আর তো দেশ পাচ্ছি না। ওই লেখাটার জন্যে মুখিয়ে আছি। বইটা বের হলে পাঠাতে পারবেন?
ঘূণপোকার পর শীর্ষেন্দুদা ধুতি-পাঞ্জাবি ছাড়লেন, রঙবেরঙের গেঞ্জি এবং প্যান্টে তাকে এত স্মার্ট দেখায় যে আমি ওকে প্রিন্স বলে ডাকতাম। এতে ওঁর প্রশ্ৰয় ছিল। কারণ আমরা একরকম দেশওয়ালি ভাই। শিলিগুড়ি আর জলপাইগুড়ির মধ্যে দূরত্ব আর কতটা। শীর্ষেন্দুদা মানেই সৎ সাহিত্য, সিরিয়াস সাহিত্য, এরকম একটা নিয়ম চাউর হয়ে গেল। আর তার ফলে লেখার ব্যাপারে তিনি হয়ে গেলেন আরও খুঁতখুঁতে। লেখেন আর মনে হয় কিছুই হয়নি। ফলে লেখা কমতে লাগল। সম্পাদক যে দিন ধাৰ্য করে দেন তা পেরিয়ে যেতে লাগল। সাগরময় ঘোষ বলেছিলেন, ওকে উপন্যাস লিখতে বললেই দুরকম অনুভূতি হবে। কাগজ বের হবার আগে উপন্যাসটা পাবো তো? আমার ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়। পাওয়ার পর পড়ে অবশ্য মন ভরে যায়। এই যে খুতখুতে স্বভাব, হয়তো বিমলদার সঙ্গ তার মধ্যে চলে এসেছিল।
কলেজে পড়ার সময় আমরা কমিউনিজমে বিশ্বাস করতাম। আমরা বললাম এই কারণে, তখন আমার বয়সী সবাই মানুষের কথা লিখতে চাইত এবং কমিউনিজম স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আকর্ষণ করত। কিন্তু কিছুদিন পরেই মনে হল সাহিত্য এবং কমিউনিজম কখনওই হাত ধরে চলতে পারে না। একজন কমিউনিস্ট মূলত মৌলবাদী। তিনি যে ধারণায় বিশ্বাস করেন তা থেকে কখনওই নড়বেন না এবং তার প্রচার করাটাই জীবনের লক্ষ্য হবে। সাহিত্য কখনওই প্রচার-সর্বস্ব হতে পারে না। যে সাহিত্য প্রচার করছে তার আয়ু লিফলেটের মতো ক্ষণস্থায়ী। আমাদের বাংলাভাষাতেও অনেক শক্তিমান লেখক এইরকম লেখা লিখতে গিয়ে শেষপর্যন্ত হারিয়ে গেছেন। ঠিক একই কথা প্রযোজ্য যাঁরা ধর্মে বিশ্বাস করে সেই বিশ্বাস সাহিত্যে প্রচার করেন। এখানেও মৌলবাদ মাথা চাড়া দেয়। একজন লেখক বিশেষ রাজনীতি বা ধর্মাচরণে বিশ্বাস করতেই পারেন। কিন্তু সাহিত্য করার সময় তাকে ওই ব্যাপারগুলো সম্পর্কে নির্লিপ্ত হতেই হবে। জীবনকে দেখতে হবে জীবনের মতোই। তার ওপর আহরিত ভাবনা চাপিয়ে দিলে ব্যাপারটা সাজানো বলে মনে হবে।
শীর্ষেন্দুদার মধ্যে হয়তো প্ৰস্তুতি চলছিল অনেকদিন থেকেই, সেটা আমার জানা নেই, কিন্তু তিনি অনুকুল ঠাকুরকে গুরুদেব হিসেবে গ্রহণ করলেন। শুধু গ্রহণ করাই নয়, ঠাকুরের বাণী তাকে পথ দেখাচ্ছে বলে বিশ্বাস করলেন। ধর্মাচরণের ওই পথ ধরে তিনি অনেকটা এগিয়ে গেছেন। কিন্তু গৃহী থেকে গেছেন। আমার মনে আছে ওঁর বিয়ের সময় অনেকেই চিন্তায় পড়েছিল, ভাবী স্ত্রী সারাজীবন নিরামিষ খেয়ে থাকবেন কী করে। কিন্তু ওঁর সেই সমস্যা হয়নি কারণ শীর্ষেন্দুদার বিশ্বাস তার পরিবারও গ্রহণ করেছেন।
এখন প্রশ্ন হল দীক্ষিত হওয়ার পর শীর্ষেন্দুদার জীবনযাপনের নিশ্চই আমূল পরিবর্তন হয়েছিল। উনি শুধু দীক্ষা নেওয়ার জন্যে দীক্ষা নেননি, ঠাকুরের বাণীকে আদর্শ করে জীবনযাপন করতে চেয়েছেন। এর ফলে তার আগের ভাবনা চিন্তায় পরিবর্তন আসতে বাধ্য। সেই পরিবর্তিত ভাবনা যদি প্রতিটি রচনায় স্পষ্ট হয় তা হলে সাহিত্য একপেশে হয়ে যেতে বাধ্য।
রাজনীতি এবং ধর্ম মানুষকে অন্ধ করে এটা আমরা জানি। বিশ্বাসে অন্ধ হয়ে যদি কেউ শান্তি পান তা হলে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। কোনও এক ভক্ত সিগারেটের প্যাকেটে ট্রেনের টিকিট রেখেছিলেন। সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছে বলে ভুল করে রাতের ছুটন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে প্যাকেটটা ফেলে দেন। এবং তখনই তার খেয়াল হয় এবং বিনা টিকিটের যাত্রীর দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে গুরুদেবকে স্মরণ করেন। হঠাৎ ট্রেনটি গতি কমিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ভদ্রলোক ট্রেন থেকে নেমে অন্ধকারেই কিছুটা পেছনে ছুটে যেতেই সিগারেটের প্যাকেটটাকে পড়ে থাকতে দেখতে পান। তার ভেতর টিকিট ছিল। ট্রেনে ফিরে এসে তিনি আবার গুরুনাম করতে লাগলেন। আমৃত্যু তিনি কৃতজ্ঞ থেকে যাবেন।
এই ঘটনা সত্যি না মিথ্যে সেই তর্কে যাওয়া বোকামি। কথা হল, এই ঘটনা যদি কোনও লেখক বিশ্বাস করে গল্প-উপন্যাসে ব্যবহার করেন তা হলে অধিকাংশ পাঠক মেনে নিতে পারবেন না। নায়ক বিশাল পুকুরের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে, মৃত্যু যখন নিশ্চিত তখন এক আলোকময় পুরুষ তাকে টেনে জলের ওপর পাঠিয়ে দিল, বারংবার এরকম কথা লিখে গেলে পাঠকের মনে পড়ে যেতেই পারে, কোথা হইতে কি হইল জানা গেল না। কিন্তু মোহন বাঁচিয়া গেল।
শীর্ষেন্দুদার লেখায় এইসব অলৌকিক কান্ড তেমন দেখা যায়নি। মাঝেমাঝেই নিয়ন্ত্রিত জীবনের ছাপ তার লেখায় দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে একজন নিরাসক্ত মানুষ জীবনের কথা লিখছেন। কিন্তু কখনই প্রচারে পঞ্চমুখ হননি। এই যে একটা জায়গায় আলাদা লাইন টানা, কতখানি ক্ষমতা থাকলে সেটা করা সম্ভব আমি জানি না। মনে আছে আমরা কয়েকজন গল্প পড়তে ড়ুয়ার্সে গিয়েছিলাম। চা-বাগানের বাংলোতে বিদেশি পানীয় ছিল অঢেল, শীর্ষেন্দুদা স্পর্শ করেননি। বলেছিলেন, আমি আনন্দ পাইনা।
এই মানুষ যখন কলম ধরেন তখন ওই অনন্ত আনন্দের সন্ধান করে যান। বড় কঠিন এই কাজ। আর এ কারণেই তিনি তার সমসাময়িক অন্য লেখকদের থেকে একদম আলাদা। বলতে দ্বিধা নেই। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই সাহিত্যের যে সিরিয়াস ভাবনাচিন্তা আরম্ভ হয়েছিল, সতীনাথ ভাদুড়ি, বিমল করা হয়ে আপাতত তার শেষ প্রতিনিধি-লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তবু ভয় হয়, সার্কাসের সেই তারের ওপর দিয়ে তিনি হেঁটে চলেছেন, ভয় সেই কারণেই। বাংলা সাহিত্যের যাবতীয় লেখককুলের সঙ্গে শংকরের পার্থক্য অনেক ব্যাপারে না বলে সবক্ষেত্রে বলাই বোধহয় ঠিক কথা। বই বিক্রির রেকর্ড ধরলে বলতেই হবে, শরৎচন্দ্রের জীবদ্দশায় তার কোনও বই এত বিক্রি হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের সাহিত্যের মূল ভাষা যেহেতু বাংলা তাই একমাত্র হুমায়ূন আহমেদই শংকরের সঠিক প্রতিদ্বন্দ্বী। হুমায়ুনের এক একটি বই প্রকাশিত হওয়ামাত্র পঁচিশ তিরিশ হাজার কপি অনায়াসে বিক্রি হয়ে যায়। এক লক্ষে পৌঁছাতে কয়েকমাস লাগে। কিন্তু যতদূর জানি বছর চারেক বাদে নতুন বইএর জোয়ারে সেগুলো চাপা পড়ে যায়। শংকরের ক্ষেত্রে তা হয়নি। কত অজানারে অথবা চৌরঙ্গী এখনও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। বস্তুত, কোনও বই-এর এক লক্ষ কপি বিক্রি হবে, এবং একটি নয়, পরের পর, তা বাঙালি লেখক কখনও ভাবতে পারেনি, শংকর পেরেছিলেন। তার পরে অবশ্য ওই সীমা কেউ কেউ পেরিয়েছেন।
বই-এর ব্যাপারে একজন লেখকের ভূমিকা কী? এতদিন যা দেখেছি তা হল, লেখক লিখবেন, প্ৰকাশক ছাপবেন, বিজ্ঞাপন দেবেন, বই বিক্রি হবে। অর্থাৎ লেখকের লেখা বই-এর ছাপা এবং বিক্রির ব্যাপারে প্রকাশকই যা কিছু করার করে এসেছেন। আমরা শুনেছি, এর ফলে অনেক লেখককে প্ৰকাশক বঞ্চিত করেছেন, লেখক প্ৰতারিত হয়েছেন। বেশি ছেপে কম বলা, বিক্রি হলেও হয়নি বলাটা একসময় কলেজ স্ট্রীটে নাকি স্বাভাবিক ছিল। আনন্দ পাবলিশার্সই প্রথম এ ব্যাপারে প্রফেশন্যালিজম আনল। প্রতিটি বইতে মুদ্রণ সংখ্যা ছেপে দেওয়া ছাড়া লেখককে বাৎসরিক বই বিক্রির হিসেব লিখিতভাবে জানিয়ে দিল। কিন্তু এর বাইরে বেশিরভাগ প্রকাশকই যতক্ষণ ভাল সম্পর্ক থাকছে এবং বই বিক্রি হচ্ছে ততক্ষণ লেখকের সঙ্গে সদ্ভাব রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। অর্থাৎ কত বই ছাপা হচ্ছে, কী রকম বিক্রি হচ্ছে সে ব্যাপারে বেশির ভাগ লেখকই অন্ধকারে থাকেন। এ ব্যাপারের পরিবর্তন আমাদের আগের লেখকরা করতে পারেননি। তা ছাড়াও একটি হাস্যকর পদ্ধতি প্ৰকাশকরা বহু যুগ ধরে আঁকড়ে রয়েছেন। কোনওমতে একটা বই ছেপে দেশ বা অন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে এরা বসে থাকেন এই ভেবে হাজার হাজার পাঠক ছুটে এসে তার দোকান থেকে বই কিনে নিয়ে যাবে। একমাত্র বইমেলাতেই প্ৰকাশক পাঠককে পান, অন্য সময় তাদের কাছে পৌঁছাবার কোনও চেষ্টাই করেন না। কলেজ স্ত্রীটের বই ব্যবসা এখনও মান্ধাতার আমলে, আধুনিকীকরণের কোনও চেষ্টাই নেই। একা আনন্দ পাবলিশার্স তো গোটা কলেজ স্ট্রীট নয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতেও শংকরের ভূমিকা নিশ্চয়ই ইতিহাস তৈরি করেছে। শংকরই হলেন প্রথম লেখক যিনি পণ্যদ্রব্যের ব্যবসার আধুনিক নিয়মগুলো তার বই-এর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। তার বই কত কপি ছাপা হবে, কী ভাবে ছাপা হবে, প্রচ্ছদ কেমন থাকবে, এবং দাম কী রাখা হবে থেকে শুরু করে বিক্রির পদ্ধতি নিজে নিয়ন্ত্রণ করেন। একসময় গ্রামের মুদির দোকানেও ধারাপাত, প্ৰথম পাঠ এবং শংকরের বই পাওয়া যেত। সম্ভবত এখনও যায়। স্টেশনে স্টেশনে ইংরেজি হিন্দি বই-এর পাশে শংকরের বই ঝুলছে। এককালে শিক্ষক এবং লেখককে বাঙালিরা শ্রদ্ধার নাম করে দরিদ্র দেখতে চাইত। একজন লেখক হবেন ভোলোভালা, ধুতিপাঞ্জাবি পরে সমাজসংস্কার করাই তার কর্তব্য, এই ধরনের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হত। জানেন, বিভূতিভূষণ ঘাটশিলা থেকে এসে টাকা চাইলেন একজন প্রকাশকের কাছে, হাঁটুর নীচে ধুতি পরে এসেছিলেন হাতে কাপড়ের থলে, কত টাকা সেটা বললেন না। প্ৰকাশক শ’তিনেক টাকা জোগাড় করে রেখেছিলেন তাকে দেবেন বলে কিন্তু ফেরার সময় বিভূতিভূষণ মাত্ৰ চল্লিশটি টাকা নিয়ে গেলেন। কি সরল মানুষ, আহা! হ্যাঁ, ওঁরা সরল, সাদাসিধে ছিলেন আর তাই অভাব তাদের ঘিরে থাকত। নজরুলকে মাত্র কয়েকটা টাকায় বিক্রি করে দিতে হল সঞ্চিতার কপিরাইট। শংকর এই ব্যবস্থাটাকে পাল্টাতে চাইলেন। যেহেতু প্ৰকাশনা একটি ব্যবসা আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ালে ব্যবসা লাটে উঠবে তাই যতটা সম্ভব আধুনিক তাকে হতেই হবে। অন্য প্রকাশক যখন একশো ষাট পাতার বই-এর দাম রাখছেন তিরিশ টাকা তখন শংকরের ওই আয়তনের বই বিক্রি হয়েছে। পনেরো টাকায় অর্ধেক দামে পাচ্ছেন বলে পাঠকদের অনেকেই প্রলুব্ধ হয়েছেন কিনতে। আবার বই-এর সঙ্গে ব্যাগের লোভেও অনেকে তাঁর পাঠক হয়েছে। বড় বড় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো যখন তাদের পণ্যের সঙ্গে আর একটা জিনিস ফাউ হিসেবে দিয়ে বাজার তৈরি করতে পারেন তখন বই কী দোষ করল? বই কি সেকালের হিন্দু বিধবা যে পুরুষের ছায়া পড়লে তার ব্যবসার জাত যাবে? বাংলা উপন্যাস ছাপা হত এগারোশো কপি, প্ৰথম সংস্করণ। শংকর ছাপতে বললেন দশ হাজার। এর ফলে খরচ হু হু করে কমে গেল, তাই দাম হয়ে গেল অর্ধেক। প্ৰকাশক জানতেন শংকরের বই দশ হাজার বিক্রি হবেই। তাই সমস্ত অনুশাসন তিনি মাথা নিচু করে মেনে নিয়েছেন।
এই অবস্থা রাতারাতি হয়নি। কত অজানারে দেশে বেরিয়েছিল গৌরকিশোর ঘোষের মাধ্যমে সাগরময় ঘোষের সঙ্গে শংকরের যোগাযোগ হওয়ার কারণে। লেখাটি আলোড়ন তুলেছিল। হাইকোর্টে বিদেশী ব্যারিস্টারের কাছে ক্লার্কের চাকরি করতে আসা হাওড়ার এক তরুণ যে সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তা লেখার সময় মণিরত্ন হয়ে গেল। লক্ষ করা গেছে, ওঁর প্রায় বেশিরভাগ লেখায় একটি গরিব ছেলের স্বপ্ন দেখার ব্যাপার আছে। একটু শ্ৰীকান্ত শ্ৰীকান্ত প্যাটার্ন। ব্যক্তিগত জীবনে ক্লার্ক থেকে একটু একটু করে তার যে উত্থান, সাহেব থেকে বড় সাহেবের ভূমিকা নিয়ে সর্বভারতীয় কোম্পানির অন্যতম দায়িত্ব নেওয়ার সময়েও তিনি ওই কাসুন্দের তরুণকে ছাড়েননি। বাঙালি যে স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে তা ওঁর আয়ত্তে বলে তিনি তাদের স্বপ্ন দেখিয়ে ছেড়েছেন।
জনপ্রিয়তার শিখরে যে লেখক দীর্ঘকাল রয়েছেন এ দেশের সমালোচকরা তাকে অবজ্ঞা করেছেন। কোনও সাহিত্য আলোচনায় তারা শংকরের নাম উচ্চারণ করেন না। সেই কত অজানারের জন্যে পুরস্কৃত হয়েছিলেন, তারপর কোনও সাহিত্য পুরষ্কার তাকে দেওয়া হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এ সব যারা দিয়ে থাকেন তাদের চেহারা আমি দেখেছি। মনে আছে, আমাকে কিছু বছর আগে সাহিত্য আকাদেমির বিচারক করা হয়েছিল। প্ৰাথমিক নির্বাচনের পর ওরা কয়েকটি গল্প উপন্যাস প্রবন্ধের বই আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেগুলো পড়ে এবং আকাদেমির নিয়ম মেনে আমি যাকে নির্বাচন করলাম। তার কথা বলতে একটি গোপন সভায় যেতে হল। সভায় আমি ছাড়া আরও দুজন বিচারক এবং আকাদেমির পক্ষে একজন কোঅর্ডিনেটর। টেবিলের ওপর রাখা ওই বইগুলো একটি করে তুলে কোঅর্ডিনেটার প্রশ্ন করছেন আর আমরা মাথা নেড়ে যাচ্ছি। কখনও কখনও তিনিও মন্তব্য করছেন। একজন বিচারক তাই শুনে প্রশ্ন করছেন বইটি সম্পর্কে। বুঝতে পারলাম তিনি হোমওয়ার্ক করে আসেননি। শেষপর্যন্ত প্ৰবীণ বিচারক রায় দিলেন, এই ছেলেটি শুনেছি ভাল লিখছে, ওকেই দেওয়া হোক। আমার তীব্র আপত্তিতে সেবছর ছেলেটি আকাদেমি পায়নি, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ পেয়েছিলেন। আর শংকরের অপরাধ তিনি জনপ্রিয় তাই তাঁর নাম তো উচ্চারিতই হবে না। কিন্তু কী এসে যায়। তাতে? পাঠকের পুরস্কার তো তিনি পেয়েছেন সর্বতোভাবে।
নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির মতো আরও একটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে আছে বলে আমার জানা নেই। জীবনের অভিজ্ঞতাকে শংকর কাজে লাগিয়েছেন। চাকরি জীবনে একটার পর একটা সিঁড়ি ভেঙেছেন আর সেই সিঁড়ির চারপাশের মানুষ তার সাহিত্যে উঠে এসেছে। মনে রাখতে হবে সর্বভারতীয় বাণিজ্যিক সংস্থার ওপর তলায় তার আগে কোনও বাঙালি লেখক চাকরি করেননি। এই দীর্ঘসময়ে বছরে একটি উপন্যাস এবং গল্প লিখেছেন সচেতনভাবে। যখনই প্রিয় বিষয় পেয়েছেন তখনই নিবন্ধ রচনা করেছেন। দুই বাংলার বাঙালিদের প্রতি তার শ্রদ্ধার্ঘ তো রেকর্ড বিক্রি হয়েছে। এই প্রথম আমরা দেখলাম। একজন লেখক দুটো ভূমিকায় চমৎকার মানিয়ে নিয়েছেন। এক লেখক হিসেবে পরের পর বিষয় নির্বাচন করেছেন সুপরিকল্পিতভাবে এবং লিখেছেন যথেষ্টে মমতা নিয়ে। দুই, তার বিলিব্যবস্থায় দেখিয়েছেন পেশাদারি দক্ষতা। রবীন্দ্রনাথের পর থেকে বাংলা বই-এর প্রচ্ছদ নিয়ে নানান পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু সুন্দরী নারীর ফটোগ্রাফ ব্যবহার করতে কেউ উদ্যোগ নেননি। দেখা গেল সেটা করায় শংকরের বই আরও আকর্ষণীয় হয়েছে।
এখন আমার কাছে কাল, মহাকাল শব্দগুলো খুব একটা মূল্যবান নয়। ছেলেবেলায় শুনেছিলাম যে লেখার কোনও ওজন নেই তা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। শংকরকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, জীবিত অবস্থায় তার বই-এর প্রচুর বিক্রি দেখে যেতে চান না মৃত্যুর পরে তা দীর্ঘকাল সমাদৃত হোক বলে আকাঙ্খা করেন? শংকর বলেছিলেন, বেঁচে থাকতে থাকতেই সন্দেশ যতটা সম্ভব খেয়ে নেওয়া ভাল। রসিকতা করে বলা অবশ্যই, কিন্তু প্ৰায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল তার সাহিত্যজীবন এবং গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে তিনি জনপ্রিয়তার শিখরে। পঁয়তাল্লিশ বছর সময়টাকে কী ভাবে মাপবো? কালের কত অংশ?
এ প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প বলি। পশ্চিমবাংলায় যে সব লেখক জনপ্রিয় তাঁদের বই প্রচুর পরিমাণে বাংলাদেশে রপ্তানি হত বছর দেড়েক আগেও। এইসময় ঢাকার কিছু ধুরন্ধর বই-ব্যবসায়ী কলকাতার প্রকাশকদের অনুমতি না নিয়ে ওই বইগুলো হুবহু ছেপে বিক্রি করতে লাগলেন। আগেও হত, কিন্তু সেটা হুবহু নয়। নতুনভাবে কম্পোজ করে, প্রকাশকের ছদ্ম ঠিকানা থাকত সেই বইতে। অতএব বইটি যে জাল তা স্পষ্ট বোঝা যেত। এখন আধুনিক মুদ্রণ প্রথায় আসলেরই কপি তৈরি করা যাচ্ছে। ফলে পশ্চিমবাংলা থেকে বই নিচ্ছেন না ওখানকার দোকানদাররা। তারা অনেক সস্তায় পাইরেটদের কাছে একই বই পেয়ে যাচ্ছেন। দেখা গেল, কলকাতার চারজন লেখকের যে বই বের হচ্ছে তাই পাইরেটরা ছেপে ফেলছেন ওখানে। এইসব কান্ড দেখে এসে একজন প্ৰবীণ এবং উন্নাসিক সমালোচক একদিন বললেন, সব ধরা পড়ে গেল। এ দেশে যারা সত্যিকারের জনপ্রিয় তাদের বই পাইরেটরা ছাপছে। ওদের তালিকায় শংকরের কোনও বই নেই। তার মানে ওঁর বই বিক্রির যে হিসেবটা দেখানো হচ্ছে তা বানানো। নইলে ওই পাইরেটরা ওকে ছেড়ে দিত? ঢাকার একজন প্ৰকাশককে এ কথা বললাম। তিনি বললেন, শংকরের বই এর দাম এত কম যে তা হুবহু ছাপলে পাইরেটদের লোকসান হয়ে যাবে। পাইরেসি করেও যদি লাভ না হয় তা হলে কোন মুখ হাত বাড়াবে?
অতএব শংকর তার মতন থেকে যাবেন তার সাম্রাজ্যে।