আজ থেকে একশ বছর আগে জন্মালে জমিদারের সুদৰ্শন পুত্ৰ হয়ে গ্রামের পুকুরধার থেকে যুবতীদের তুলে নিয়ে যেতাম বাগান বাড়িতে। এখন যেহেতু সেটা সম্ভব নয়, তাই লিখি।
একথা যিনি বলতে পারেন। তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার মানুষ নন। লেখালেখিকে তিনি তার জীবনযাপনের অঙ্গ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু লেখালেখিসর্বস্ব জীবনযাপনের কোনও বাসনা তার নেই। আমি লক্ষ করেছি কিছু মানুষ, এখনও একশ্রেণীর মানুষ, লেখালেখিকে অন্য চোখে দেখতে পছন্দ করেন। একজন লেখক হবেন সমাজসংস্কারক, তার লেখার মাধ্যমে সমাজের চেহারাটাকে তিনি বদলাবেন। লোকশিক্ষা দেবেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। এই লেখক কী রকম মানুষ হবেন? কোনও অহঙ্কার থাকবে না তার, বুনো রামনাথমার্ক পোশাক পরলে ভাল হত। কিন্তু তা যখন সম্ভব নয় তখন ধুতি-পাঞ্জাবি পরাই ভাল। রাম শ্যাম যদু যেই ডাকুক সুন্দরবন থেকে কোচবিহার ছুটে যাবেন সভায় প্রধান অতিথি হতে। একটা মালা আর কিছু সাজানো কথা শুনে ফিরে আসবেন স্লিপার ক্লাসে চেপে। সেই সভায় কলকাতার রিমেক শিল্পী পুরনো দিনের গান গেয়ে ওঁর পাশে বসে বিশ হাজার টাকা দক্ষিণা নেবেন, এসি তে যাওয়া আসা করবেন এবং ওকে বলবেন, আমার মায়ের কাছে আপনার বই-এর কথা খুব শুনেছি। অতএব লেখকের সময়ের দাম নেই, তাকে প্রকাশকরা টাকা দিল কি দিল না তাতে কিছু এসে যায় না, তিনি রামকৃষ্ণদেবের মতো জনশিক্ষা দিয়ে যাবেন।
লেখকদের সম্পর্কে এমন ধারণা এখনও যারা পোষণ করেন তাদের দেখলেই আমার শক্তিদার কথা মনে পড়ে, চোয়ালে থাপ্পড় যদি কম হয়–! একজন কৃষক আর এখন জাতির অন্নদাতা নন। তিনি চাষ করেন বেঁচে থাকার জন্যে, ছেলেমেয়েদের ভালভাবে বড় করার ব্যবস্থা করতে। একজন লেখক লেখেন তার নিজের জন্যে। তিনি যে ব্যক্তিগত আনন্দ পান তা যদি অর্থ নিয়ে আসে তা হলে সেই অর্থে তার পরিবার একটু ভালভাবে বেঁচে থাকবেই। লেখার বাইরে তিনি জিনস পরে নাচানাচি করতে পারেন, মদ্যপান করতে পারেন, তার মতো জীবনযাপন করতে পারেন। তিনি যদি প্রশ্ন তোলেন, আপনারা কোচবিহারে সভা করছেন আমি আমার কাজ ফেলে সময় নষ্ট করে সেই সভায় যাব কেন, তা হলে একটাই অজুহাত উদ্যোক্তারা খুঁজে পান, আপনি সাহিত্যিক, আপনার বই আমাদের ওখানে সবাই পড়েছে, তাই আপনাকে দেখতে চায়, আপনার মুখ থেকে কথা শুনতে চায়। লেখক যদি প্রশ্ন তোলেন, একজন গায়কের সব ক্যাসেট বাড়িতে বাজিয়ে শুনেও তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বিশত্ৰিশ হাজার খরচ করেন কেন! তা হলে উদ্যোক্তাদের মুখের অবস্থা দেখে মনে হয় ওঁরা ভাবছেন বাঙালি ঘরের বিধবার মুখে এ কি অন্যায় কথাবার্তা। আমাদের পূর্ববতী লেখকেরা ভালমানুষ ছিলেন। লেখক হিসেবে তাদের ক্ষমতা কতটা সে বিষয়ে ছিলেন উদাসীন। অনেকেই খুব খেতে ভালবাসতেন, কেউ আদর করে ডাকলে কৃতাৰ্থবোধ করতেন। হয়তো ভাবলেন এত ডাকাডাকি করছে। যখন তখন আমার পাঠকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। হয়তো এমনও হতে পারে, এক বছরে তারাশঙ্কর কতগুলো সভা করেছেন তার সঙ্গে নিজের করা সভার হিসেব মিলিয়েছেন বিমল মিত্র। পঞ্চাশের দশকে শিল্পীদের মধ্যে খোপ কথাটা চালু হয়েছিল। অনুষ্ঠান করে টাকা পাওয়াকে তারা খোপ খাটা বলতেন। বিনা পয়সায়, কারও অনুরোধ না এড়াতে পেরে অনুষ্ঠান করতে যাওয়াটা তাদের কাছে ছিল আক্ষেপ। দু হাজার সাল পর্যন্ত অবস্থাটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
পুকুরধার থেকে সুন্দরী তুলে নিয়ে এসে বাগানবাড়িতে ঢোকা সম্ভব নয় বলে যিনি লেখেন বলেছেন তিনি নিজেকে নিয়েই রসিকতা করেছেন তা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। এমন রসিকতা যিনি করতে পারেন সেই মানুষটি কি রকম?
ছবিটা আমি এভাবে তৈরী করতে পারি। ছ’ফুট উচ্চতার একজন পুরুষ, যার গায়ের রঙ বাঙালিদের তুলনায় বেশ ফরসা, মুখে সবসময় আলোআধারির হাসি, গমগমে গলায় চমৎকার টপ্পা বাজে, এবং সমস্ত শরীরজুড়ে একটি অভিমানের বেলুন কখনও ফুলে ওঠে। কখনও খানিকটা চুপসে যায়। এই ছবির নীচে পরিচয় লেখার প্রয়োজন পড়ে না। যিনি বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিনিই জানেন, ইনি বুদ্ধদেব গুহ।
দক্ষিণ কলকাতার অতি সচ্ছল পরিবারের একজন যুবক চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট যখন হলুদ বসন্ত নামের উপন্যাস লিখে ফেললেন তখন অনেকেই নড়েচড়ে বসেছিল। এ রকম প্রেমের উপন্যাস কি আগে পাওয়া গিয়েছে? যে উপন্যাস শুরু করলে শেষ না করে পারা যায় না, যে উপন্যাসের পাতায় পাতায় শুধুই প্রেম যার জন্যে আমরা একবুক মরুভূমি নিয়ে বসে থাকি? তার সঙ্গে মিশে গেছে প্রকৃতি। এই প্রকৃতি বিভূতিভূষণের নয়, নয় জীবনানন্দেরও। প্রেমের চোখে গাছগাছালির মধ্যে আর এক গাছগাছালিকে আবিষ্কার করেছেন লেখক। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নীলাঙ্গুরীয়, যাযাবরের দৃষ্টিপাত এবং বুদ্ধদেব গুহর হলুদ বসন্ত আলাদা আলাদা দেওয়ালের মতো কিন্তু সেই আলাদা দেওয়ালের মেঝে আর ছাদ এক। তার নাম প্ৰেম।
বুদ্ধদেবদা আমার চেয়ে অনেক ব্যাপারে অনেক এগিয়ে থাকলেও বয়সে বছর আটেকের বড়। আগে একটা নিয়ম চালু ছিল, যাঁরা লেখালেখি করেন তাদের শুরু হয় ছোটগল্প দিয়ে। উপন্যাসে হাত দেওয়ার আগে চমৎকার কিছু ছোটগল্প লিখে তারা চমকে দিয়েছেন। নারায়ণবাবু, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সন্তোষকুমার ঘোষ থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত এই ইতিহাস। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় পরিচিত হয়েছিলেন শ্বেতপাথরের টেবিল গল্প লিখে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নীললোহিত নামে প্রচুর ফিচার লিখেছেন আনন্দবাজারে। ছোট গল্প নয়। তবু ওঁর রবিবারের লেখাগুলোতে ছোট গল্পের মেজাজ থাকত। বুদ্ধদেব গুহ এমন কান্ড করেছেন বলে শুনিনি। ওর আগমন রাজার মতো। একেবারে উপন্যাস নিয়ে। রাজা শব্দটা ঠিকই লিখলাম, ওঁর বেঁচে থাকাটাও সর্বাংশে রাজকীয়।
রবীন্দ্ৰনাথ এবং বঙ্কিমচন্দ্ৰকে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বেশির ভাগ লেখকই এসেছেন নিম্ন অথবা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তারাশঙ্কর লাভপুরের জমিদার পরিবারে জন্মেছিলেন। কিন্তু প্ৰায় কৈশোর থেকেই তাকে অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল। সামান্য কয়েকটি টাকা জোগাড় করতে না পেরে তিনি যে দুর্দশায় পড়েছিলেন তা তার লেখা চিঠিতে জানা গেছে। বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সমরেশ বসু অথবা জ্যোতিরিন্দ্ৰ নন্দীর জীবন শুরু হয়েছে দারিদ্রের থাবার সঙ্গে লড়াই করে। গোর্কি পড়ার পর আমার একটা ধরণা তৈরি হয়েছিল। অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই না করলে জীবন দেখা যায় না। আর জীবন যিনি না দেখলেন তার পক্ষে লেখক হওয়া সম্ভব নয়। শিল্পসাহিত্য তাঁদের জন্যে নয় যারা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছেন। অর্থাৎ একটু কষ্টের গন্ধ না মাখলে কাউকে লেখক বলতে আমাদের অনীহা ছিল। কল্লোলের লেখকরা যে বোহেমিয়ান জীবনযাপন করতেন তা আমাদের কাছে খুব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে ছিল। অচিন্ত্যকুমার পরে সরকারি উচ্চপদে ছিলেন, বুদ্ধদেব বসু অধ্যাপনা করেছেন, তারাশঙ্কর এম পি হয়েছেন, কিন্তু এ নিয়ে মাথা ঘামাইনি তখন। উলটে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচায়, জ্যোতিরিন্দ্ৰ নন্দীর শেষ বয়স পর্যন্ত যে লড়াই তাই শ্ৰদ্ধার সঙ্গে দেখেছি।
বুদ্ধদেব গুহর কৈশোর পর্যন্ত যে জীবন তা আর পাঁচটা ছেলের মতোই সাধারণ ছিল। ওঁর পিতৃদেব সরকারি চাকরি ছেড়ে যখন প্র্যাক্টিসে নামলেন তখনই ওঁদের অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটল। বুদ্ধদেব বলতেই পারেন, আমি বাল্যকালে ঠাকুমার সঙ্গে মেঝেতে বিছানা পেতে শুতাম। রুপোর চামচ দেখতে পাইনি। বাবা যখন সাফল্য পেলেন তখন আমার ভাইয়েরা খুব ছোট। ওরা একটুও কষ্ট করেনি।
হলুদ বসন্ত বেরিয়েছিল। ষাটের দশকের শেষ দিকে দোলসংখ্যা আনন্দবাজারে। তার আগে জঙ্গলের গল্প লিখেছেন তিনি রবিবাসরীয়তে। জঙ্গলের গল্পকারকে সাহিত্যিক হিসেবে কখনও এ দেশের মানুষ গ্রহণ করেনি। জীবনের গল্পকার হলেন হলুদ বসন্তে।
ওঁর লেখার বিষয় এবং চরিত্র বাঙালি পাঠকের কাছে নতুন। কারণ আগে পরের মধ্য ও নিম্নবিত্ত লেখকেরা যাদের নিয়ে বেশি লেখালেখি করেছেন তাঁরা উচ্চবিত্ত মানুষ নন। যেহেতু বাঙালি পাঠকের বৃহদংশ মধ্য ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীতে বাস করেন। তাই সেই সব লেখায় তারা নিজেদের খুঁজে পেয়েছেন। না পেলেও বুঝতে বা অনুভব করতে অসুবিধে হয়নি। পদ্মানদীর মাঝিদের কলকাতার মধ্যবিত্ত দেখেনি। তবু তাদের নিয়ে লেখা উপন্যাসের জীবন গ্ৰহণ করতে কোনও অসুবিধে হয়নি। অর্থাৎ সংগ্রাম করা মানুষদের কথা পড়ে মনে মনে তাদের পাশে দাঁড়াতে বাঙালি পাঠক সবসময় এক পায়ে খাড়া ছিল।
বুদ্ধদেব যাঁদের নিয়ে লেখা শুরু করলেন তারা আমাদের চারপাশে বাস করেন না। তারা বিত্তবান মানুষ, তাদের বাড়ির মেয়ে বাসন মাজে না, ছেলেরা বাজারে যায় না থলি হাতে। বেকার হয়ে থাকার কারণে গঞ্জনা সহ্য করতে হয় না ছেলেদের। বুদ্ধদেব গুহর কথায়, যাদের নিয়ে আগে তেমন করে লেখা হয়নি, অথচ যাদের গল্প পড়ার জন্যে সাধারণ পাঠকের ঔৎসুক্য আছে তাদের কথা লিখতে চেষ্টা করলাম।
বুদ্ধদেব গুহর লেখায়। তাই বাঙালি পাঠকের ইচ্ছা পূর্ণ হল। আমরা যা নই যা হতে পারি না, তা পাওয়ার জন্যে সব সময় মুখিয়ে থাকি। এই বিত্তবান অথবা উচ্চবিত্ত পুরুষ এবং মহিলাদের জীবনযাপনের গল্প, আচরণ পাঠকদের সিংহভাগকে আপ্লুত করল। এর আগে রবীন্দ্ৰনাথ যে বিত্তবানদের নিয়ে লিখেছিলেন তাদের বিত্ত ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের গল্পের ঘরানা ছিল অন্যরকম। সেখানে বক্তব্যই ছিল আসল, চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত আচরণ রবীন্দ্রনাথের কাছে গুরুত্ব পায়নি। বুদ্ধদেব গুহ এই ব্যাপারটা তার লেখায় আনলেন। এই কাজটা করার সময় একটা বিশাল ঝুঁকি ছিল।
বিত্তবানদের গল্প, তাদের অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের প্ৰেম এবং প্ৰেমহীনতার আখ্যান সাধারণ পাঠকের কাছে বাণিজ্যিক হিন্দি সিনেমা দেখার মজা এনে দেয়। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই শ্রেণীর লেখা সাহিত্যের মর্যাদা পায় না। এই ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। ওই বারো-তেরো বছরের পর থেকে তাঁর জীবন ছিল অনেকটা এই রকম। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, সাহেবসুবো, রাজমহারাজাদের সঙ্গে ওঠাবসা, শিকার, চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হয়ে ওপরতলায় অবাধ যাতায়াত, সৎ আইনজ্ঞ হয়ে আয়কর দপ্তরের শেষ পর্যায়ে উপদেষ্টা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া–এসবই তার লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। এই মানুষ একসময় দক্ষিণীতে গান শিখেছেন, ভেতরে ভেতরে হয়তো অনুশীলন ছিল, কিন্তু তার প্রকাশ ঘটল অনেক পরে, পরিণত বয়সে। বাড়িতে যিনি পুরোদস্তুর সাহেবি, উর্দিপরা বেয়ারা যেখানে মানানসই। তার একটা ব্যাপারে কোনও ছলনা নেই, যে জীবন তিনি জানেন না সেই জীবন নিয়ে লেখার চেষ্টা করেন না। কিন্তু যে জীবন তিনি জানেন তাকে সাহিত্যে তুলে ধরেন অনায়াসে।
বুদ্ধদেব গুহ মানুষটি কিরকম?
বেশ কয়েক বছর আগে আমরা উত্তর বাংলায় গল্প পড়তে গিয়েছিলাম। প্লেনে যাওয়া হয়েছিল। দুপুরের প্লেন ছাড়তে দেরি করছিল। সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র ও অভিনেতা বিমল দেব আমাদের সঙ্গে ছিলেন। বুদ্ধদেব দেরির জন্যে রাগারগি আরম্ভ করলেন। আমরা জানতে পারলাম কবে কখন কোন প্লেন লেট করেছে তার বিবরণ। সে সময় প্লেনে চড়ি কালেভদ্রে। অতএব ওই গল্পে একটু অহঙ্কারের গন্ধ পাচ্ছিলাম। জলপাইগুড়ি শহরে উদ্যোক্তারা রেখেছিলেন তিস্তাভবনে। তখন তিস্তাভবনের ব্যবস্থা ভালই ছিল। আর কেউ কোনও কথা না বললেও বুদ্ধদেব গুহর মনে হয়েছিল ব্যবস্থাটা আদৌ ভাল নয়। তিনি যাদের নাম করতে লাগলেন তারা উত্তরবাংলার বিখ্যাত মানুষ, চা বাগানের মালিক। এদের তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। তাদের জানালে এর চেয়ে অনেক ভাল জায়গায় থাকা যেত। আমাদের কিছু করার ছিল না। দুদিন ধরে গল্প পড়া চলল। শেষ দিন অনুষ্ঠানের পর আমরা চললাম মধু চা বাগানে। অনেকটা রাস্তা, অন্ধকার চারপাশে। তিনটে গাড়ি ছুটছিল। হঠাৎ পেছনের গাড়িটা আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে আলোর ইশারায় থামতে বলল। গাড়ি থামতে পেছনের গাড়ি থেকে বুদ্ধদেব গুহ হাঁক দিলেন, কি হে, স্কচের বোতলগুলো নিজেদের গাড়িতে রেখে আমাদের এখানে জলের বোতল রেখেছ? সেই জলই এক বোতল খেয়ে ফেললাম। মধু চা বাগানে পৌঁছে জানা গেল সেদিন সমরেশ বসুর জন্মদিন। ভরপেট মদ্যপান করে সবাই গেলাম কুলি লাইনে নাচ দেখতে। হঠাৎ দেখি বুদ্ধদেব গুহ নাচিয়েদের সঙ্গে কোমর ধরে নাচছেন, গলায় মাদল ঝুলিয়ে। সুটের ওপর মাদল দেখতে একটুও ভাল লাগছিল না। কিন্তু ওঁর কোনও খেয়াল নেই। এ সময় গোলমাল আরম্ভ হল। দু দল হয়ে মদেশিয়ারা এমন ঝগড়া শুরু করল যে ম্যানেজার আমাদের নিয়ে বাংলোয় ফিরে যেতে চাইলেন। সবাই গাড়িতে ওঠার পর দেখা গেল বুদ্ধদেব গুহ নেই। ওঁকে ফেলে রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। আমরা খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করলাম। অন্ধকার কুলিলাইনে তখন উত্তেজিত শ্রমিকদের চিৎকার আমাদের মতো শহুরে লোককে বেশ ভীত করে তুলেছে। বুদ্ধদেব গুহকে পাওয়া গেল একটি ঝুপড়ির মধ্যে, খাটিয়ায় চিত হয়ে শুয়ে এক বৃদ্ধ মদেশিয়ার সঙ্গে গল্প করছেন। সুট পরে খাটিয়ায় কাউকে শুয়ে থাকতে এর আগে দেখিনি। না, আমি এখনও মনে করি না এটা শৌখিন মজদুরি। বরং উলটোটাই মনে হয়। একজন সহজ সরল মানুষকে কলকাতায় মুখোশ পরে থাকতে হয়। কিংবা এমন হতে পারে প্রথমটায় তিনি অভ্যস্ত দ্বিতীয়টি তার
বাসনায়।
বুদ্ধদেব গুহ জনপ্রিয় লেখক। কফিহাউসে একসময় বলাবলি হত, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের লেখক বুদ্ধদেব গুহ। একটু বয়স হলে তঁর লেখা কেউ পড়ে না। তাঁর লেখা বানানো। সাজানো। সেটা আরও স্পষ্ট হয় তার চরিত্রগুলোর নামকরণ করা দেখে। বেছে বেছে এমন নাম তিনি দেন যা বাঙালি আগে কখনও শোনেনি বা ছেলেমেয়ের নাম রাখেনি। অর্থাৎ তিনি সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন। বুদ্ধদেব গুহ সম্পর্কে এই সমস্ত কথা এক কালে খুব চালু ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে ব্যাপারটা একদম উলটো হয়ে গেল। তিরিশ বছর ধরে একজন লেখক শুধু কিশোর-কিশোরীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে থাকতে পারেন না। ওঁর বই বিক্রির পরিমাণ অন্য কথা বলে। বাংলাদেশে ওর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। কেন? মানুষ ওঁর লেখায় নিশ্চয়ই এমন কোন আনন্দ পান যা অন্য লেখকরা দিতে পারেননি।
আমার সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক একটু অদ্ভুত। এই আমাকে ভালবাসছেন, সুন্দর কথা বলছেন, আবার পরীক্ষণেই মুখ গম্ভীর করে থাকছেন। ওঁর চিঠি লেখার নেশা আছে। জঙ্গুলে প্যাডে চমৎকার চিঠি লেখেন। একটু কান পাতলা মানুষ। কেউ হয়তো কিছু লাগালো অমনি অভিমানে টইটুম্বুর হয়ে গেলেন। জানতে পেরে ভুলটা ধরিয়ে দিতে চিঠি এল। ভালবাসার চিঠি।। গোড়ার দিকে উপহার আসত। কেউ হয়তো বলেছে, সমরেশ মজুমদার আপনার নিন্দে করেছে। জানতে পেরে আমি ফোন করলাম, কে কি বলল সেটা যাচাই না করে বিশ্বাস করবেন? পরের দিন অনেকগুলো নিউজিল্যান্ডের বিয়ার চিঠির সঙ্গে পাঠিয়ে দিতেন। খাওয়াতে ভালবাসেন খুব। কলকাতার অভিজাত ক্লাবগুলোয় তাঁর স্বচ্ছন্দ যাতায়াত। ক্লাব কালচার নিয়ে ওঁর লেখা দুদে বাঙালি সাহেবদের প্রশংসা পেয়েছে। এই অভিমানী মানুষটি কিন্তু অন্যকে নিয়ে মজা করতে এক পায়ে খাড়া। কিছুদিন আগে বন বিভাগের আমন্ত্রণে বুদ্ধদেব গুহ ড়ুয়ার্সে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে। মারাত্মক কিছু হয়ে যেতে পারত, আমাদের সৌভাগ্য তা হয়নি। এই ঘটনা এবারের পুজো সংখ্যায় লিখেছেন তিনি। দুর্ঘটনা ঘটার পর তিনি যখন রাস্তায় প্রায় গাড়ি-চাপা হয়ে রয়েছেন, তখন তার মনে হল, জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার যার বাড়ি জলপাইগুড়িতে, সেই বোধহয় ষড়যন্ত্র করে এই দূর্ঘটনা ঘটিয়েছে। নিৰ্দ্ধিধায় লিখে দিলেন তিনি। আর টেলিফোনে আমাকে নাজেহাল হতে হয়েছে। যদি সত্যি কিছু না থাকে তা হলে বুদ্ধদেব গুহ লিখবেন কেন?
অথবা পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের সামনে আমি এবং বুদ্ধদেব গুহ মঞ্চে প্রধান অতিথি এবং সভাপতি হয়ে বসে আছি। উনি তৃষ্ণার্ত হয়ে উদ্যোক্তাদের কাছে জল চাইলেন, বোতলের জল আনবেন ভাই, কিন্তু সাদা বোতল। সমরেশ যে লাল বোতলের জল খায় সে জল নয়। আমনি দর্শকরা হো হো করে হাসতে লাগল।
এটা কি হল জানতে চাইলে বললেন, দূর পাগল। রসিকতাও বোঝ না?
মনে আছে একবার এক নির্জন রাস্তায় গাড়ির চাকা পালটাতে হওয়ায় আমরা পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলাম। কোথাও কোনও মানুষ নেই, পিচের রাস্তাটা জঙ্গলের বুক চিরে চলে গিয়েছে। পাখি ডাকছে খুব। হঠাৎ গম্ভীর একরকমের গলায় কথা বললেন, যে শব্দ মানুষের শরীরের ভেতর থেকে উঠে আসে, জানো, এ জীবনে সহবাস করিনি। বলেই চুপ করে গেলেন। আমি প্রথমে অবাক হলাম। পরে খুব কষ্ট হল। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ মধ্যযৌবনে সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করতেই পারেন। কিন্তু আমি যে ওঁর গলায় আফসোসের সুরব শুনতে পেলাম। যেহেতু আমি বয়সে ছোট তাই ওঁর এই ব্যাপারে কিছু বলা বেয়াদপি হবে বলে চুপ করে থেকেছিলাম। কিন্তু তারপর থেকেই লাইনটা আমাকে অনবরত ঠোকর মেরে চলল। পরে রাতের আসরে কথাটা তুলেছিলাম। উনি আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন, দূর পাগল। আমি কি বলেছি আর তুমি কি ভাবলে! তা ছাড়া আমরা জীবনে যে সব কর্ম করি তার বেশির ভাগই তো অভ্যেসে করি। সহবাস করা কি সোজা কথা।
না সোজা কথা নয়। আমি তন্ত্রশাস্ত্র কিছুটা পড়েছি। সহবাসের যে ব্যাখ্যা সেখানে দেওয়া হয়েছে তা তো রীতিমতো সাধনার উচ্চস্তরে না পৌঁছলে সম্ভব নয়। এইসব ক্ষেত্রে, বুদ্ধদেব গুহকে সাধক ভাবতে আমি রাজি নই। কিন্তু মানুষটি বুড়ো আঙুল মাটিতে রেখে দুহাতে মেঘ ধরতে চেষ্টা করেন।
দেশে মাধুকরী বের হচ্ছিল। শুরুটা দারুণ। অনেক পরিণত। হঠাৎ উপন্যাসের কিছু শব্দ এবং বিবরণ সম্পর্কে পাঠকরা আপত্তি তুললেন। সম্পাদক বিব্রত হলেন। একি লিখছেন বুদ্ধদেব? তার লেখায় কেন অশ্লীল গন্ধ থাকবে? বুদ্ধদেব স্বযুক্তিতে আক্রমণ নস্যাৎ করলেন। মাধুকরীর বিক্রিতে অনেকের চোখ টাটালো।
রবীন্দ্ৰনাথ গান গাইতেন, ছবি আঁকতেন। তারাশঙ্করও তাই। তবে তার লেখা গান যতটা প্রচারিত, গায়ক হিসেবে তিনি ততটা নন। বুদ্ধদেবের গলায় গান ছিল। দক্ষিণী থেকে শুরু হয়েছিল। তার স্ত্রী ঋতু গুহ রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে যে বিশেষ শ্রদ্ধার জায়গায় পৌঁছেছেন তা অনেক শিল্পীই পারেননি। একটা সময় ছিল যখন বুদ্ধদেব গুহকে লোকে ঋতু গুহর স্বামী বলে পরিচয় দিত। কিন্তু ক্রমশ লেখক বুদ্ধদেব খ্যাতির চুড়ায় উঠলেন। ওঠার পর তিনি গান নিয়ে ব্যস্ত হলেন। ক্যাসেট বের হল, অনুষ্ঠানে নাম ছাপা হতে শুরু করল। রবীন্দ্রনাথের গান নয়, বাংলার পুরাতনী গান তার গলায় চমৎকার চেহারা পেল। তারপর ছবিতে হাত দিলেন। ছবি আঁকতেই এখন তার বেশি ভাল লাগে। অর্থাৎ এক থেকে অন্য, অন্য থেকে আর এক, নিজেকে খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু তার আসল পরিচয় যা বাঙালি মনে রাখবে তা ওই বইগুলোর লেখক হিসেবেই। ইদানীং কেউ কেউ অভিযোগ করেন, তার উপন্যাসেও চিঠির আধিক্য, কল্পিত চরিত্রের কাহিনী লিখতে গিয়ে ব্যক্তিগত চেনা মানুষের গল্প অকারণে আসছে। উনি কি লেখার ব্যাপারে অমনোযোগী হচ্ছেন?
আমি স্বীকার করি না। এই অভিযোগের সত্যতা। দু-একটি রচনা মানে তার সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা নয়। অভিমানে দেশ পত্রিকায় লেখা বন্ধ করেছিলেন। কয়েক বছর পরে দেশের মলাটে বিজ্ঞাপিত হল, বুদ্ধদেব গুহ ঘরে ফিরে এসেছেন। কথাটা খুব তাৎপৰ্যপূর্ণ। চিরকাল অনেকের মধ্যে থেকেও একটি নিঃসঙ্গ মানুষ ঘর খুঁজতে চেয়েছেন। খুঁজে পেলেন কি না। ভবিষ্যত তার জবাব দেবে।
সবে এম এ পরীক্ষা দিয়েছি। সে সময় আমার কাজ গোগ্রাসে সাহিত্য গেলা আর কফিহাউসে চুটিয়ে আড্ডা মারা। মহেশ্বর দাসের হোস্টেল থেকে চলে যাওয়ার নোটিস এসে গেছে। যেতে হলে জলপাইগুড়িতে ফিরে যেতে হয়। কিন্তু কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার কথা সে সময় ভাবতেই পারতাম না। পিতৃদেব আর টাকা পাঠাবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। একই সমস্যা ত্ৰিদিবের। ত্ৰিদিব আমার রুমমেট ছিল। কবিতা লিখত। এখন ভারতীয় দূরদর্শনের অন্যতম বড়কর্তা। আমরা দুজন অপেক্ষা করছিলাম। তৃতীয় একজনের জন্যে যে এলে কফির অর্ডার দিলে আমরা একটু কফি খেতে পারব। আধাঘন্টা কেটে যাওয়ার পর ত্রিদিব বলেছিল, দুর। চল, চা খেয়ে আসি।
কোথায়?
কাছেই। কাসিমবাজার রাজবাড়িতে।
রাজবাড়িতে গেলে বিনা পয়সার চা পাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সেখানে ঢোকার ছাড়পত্র ত্ৰিদিবের আছে তা আমি জানতাম না। মিনিট পনেরো হেঁটে আমরা সার্কুলার রোডের সেই বাড়িটিতে ঢোকার পর ত্রিদিব মূল প্রাসাদের দিকে না গিয়ে ডানদিকের কোয়াটার্সের দিকে এগোল। আমি একটু হতাশ হওয়ায় সে বলল, এখানে একজন লেখক থাকেন।
সুদৰ্শন মধ্য তিরিশের যুবক লেখক দরজা খুললেন। একগাল হেসে বললেন, আরে! কি খবর? ত্রিদিব স্পষ্ট বলল, চা খেতে এলাম। এর নাম সমরেশ।
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন। আমাদের বসতে বললেন। ছোট ছোট দুটো ঘর। দেওয়ালে স্বামী-স্ত্রীর ছবি টাঙানো। উনি চা বানাতে গেলেন। ততক্ষণে আমি জেনে গেছি লেখকটির নাম অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি লিখতে এসেই পাঠক তৈরি করে ফেলেছেন। অতীনদা চা খাওয়ালেন। পূর্ববঙ্গের ভাষা ওঁর মুখে। এই সময় বউদি এলেন। তখন কোনও স্কুলে পড়াতেন তিনি। অতীনদা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, এই হল তোমাদের বউদি। ওই যে দেওয়ালে ছবিটা দেখছ, ওটা ওঁর। কী ছিলেন আর আমি কী করেছি তা দেখতেই পাচ্ছ। বউদি লজ্জা পেয়েছিলেন। আমি জেনেছিলাম ওরা বেঁচে থাকার জন্যে লড়াই করে চলেছেন।
আমাকে যদি স্বাধীনতার পর বাংলা সাহিত্যের প্রথম দশটি উপন্যাস বাছাই করতে দেওয়া হয় তা হলে নির্দ্ধিধায় নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে তাতে জায়গা পাবে। এমন একটি অনবদ্য রচনা যা পথের পাঁচালীর পরে লেখা হয়েছে তার জন্যে যে কোনও সাহিত্য গর্বিত হতে পারে। কিন্তু উল্টোরথ পত্রিকার উপন্যাস প্রতিযোগিতায় পুরস্কত হয়ে যে তিনজন লেখক বাংলা সাহিত্যে এসেছিলেন সেই মতি নন্দী, পূর্ণেন্দু পত্রীর পাশাপাশি অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিত হয়েছিলেন সমুদ্রের গল্প লিখে, জাহাজের খালাসিদের কাহিনী পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিয়ে। স্পষ্টতই তাতে চমক ছিল। ওঁর আগে শচীন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একই বিষয় নিয়ে কিছুটা লিখেছিলেন।
গত তিরিশ বছরে অতীনদার সঙ্গে দেখা হয়েছে মাঝেমাঝে। প্ৰতিবারই মনে হয়েছে এই মানুষটির সঙ্গে আমার কিছু মিল আছে। ভদ্রলোক কোনও দলে নেই, মনে যা আসে তা গলা খুলে বলে দিতে পারেন। এবং ওর হাবভাব ব্যবহারে আছে মফস্বলি চেহারা, এখনকার কায়দাকানুন যে রপ্ত করতে পারেননি তাতে কোনও আক্ষেপ নেই। আনন্দবাজারে মাঝে মাঝে গল্প ছাপা হয়েছে কিন্তু যাকে বলে আনন্দবাজার পত্রিকার লেখক তা কখনও ছিলেন না। গত চল্লিশ বছরে আনন্দবাজারের বাইরের প্ল্যাটফর্ম থেকে লেখালেখি শুরু কর খ্যাতিমান হওয়া মুষ্টিমেয় লেখকদের মধ্যে অতীনদ অন্যতম। চটজলদি মনে পড়ছে। আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এবং অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এই কঠিন কর্মটি করতে পেরেছিলেন। কঠিন কর্ম বললাম এই কারণে, আনন্দবাজার-দেশ ইত্যাদি পত্রিকাগুলোর প্রচার এবং বিক্রি একজন লেখককে সহজেই বৃহৎ সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। প্ৰফুল্প রায় লেখকজীবন শুরু করেছিলেন দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস পূর্বপার্বতী লিখে। কিন্তু সেই সুযোগ অতীনন্দ পাননি। পরিণত বয়সে তিনি এই বাড়ির কাগজগুলোয় লিখেছেন। কিন্তু ততদিনে তাঁর প্রধান লেখাগুলো লেখা হয়ে গিয়েছে। অতীনদার পিতৃদেব এবং তার ভাইয়েরা পূর্ববঙ্গ থেকে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় এ দেশে এসে বহরমপুর শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে প্রায় জঙ্গুলে জায়গায় জমি কিনেছিলেন জলের দরে। সেখানে মাটির ঘরে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে প্রতিটি দিন কাটানোই কষ্টকর ছিল। আশেপাশে মানুষের তেমন বসতি নেই, ছিন্নমূল একটি বড় পরিবার জানে না আগামীকাল কি হবে, অতীনদার বাল্যকাল কেটেছিল ওই পরিবেশে। অতীনদার ভাষায়, সেইসময় পরপর দুদিন একেবারে অভুক্ত থাকতে হয়েছে আমাদের।
ছাত্র হিসেবে ভাল থাকায় বহরমপুর স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু স্কুল শেষ করার পর আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। তখন রোজগার করা দরকার। একটি রাজনৈতিক দলের পত্রিকা বের হত। সেখানে তার কাজ জুটল। প্রেসে কাগজ পৌঁছে দেওয়া, সেখান থেকে নিয়ে আসা। প্রুফ দেখা আবার ফাইফরমাস খাটা। অথচ মাইনে পাওয়া যেত না নিয়মিত। সেটাও পাঁচ-ছ টাকার বেশি নয়। অভাবের ছোবল খেতে খেতে ছাপা কাগজ ঠিক জায়গায় না পাঠিয়ে সের দরে বিক্রি করে দিয়ে চাল ডাল আলু কিনে গ্রামে ফিরলে দেখতে পেতেন অভুক্ত মুখগুলোয় স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠেছে।
গ্রামের কিছু পরিচিত তাঁতি কলকাতায় তাঁত বুনতেন। তাদের সূত্র ধরে কলকাতায় এসে ঠিক করলেন কলেজে পড়বেন তাঁত বোনার সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু দুবেলা রেঁধে দেন তা হলে তাঁত বোনার জন্যে যে টাকা তিনি পাবেন ভেবেছিলেন তার অর্ধেক তারা চাঁদা তুলে দিয়ে দেবেন। শুরু হল রান্নার কাজ।
এই অবধি জানার পর আমরা আশা করতে পারি একেবারে তৃণমূল থেকে একটি লেখক তার সমস্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে হাজির হচ্ছেন। যাঁরা রাজনীতি করেন, তাত্ত্বিকদের বই যাঁদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে তাঁরা ফর্মুলার বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় নিপীড়িত, অসহায় মানুষের যন্ত্রণার কথা বলার জন্যে পরবর্তী কালে সাহিত্য শুরু করেননি। তাঁর রোমান্টিক মানসিকতা জীবনকে অন্যভাবে দেখেছিল। ওই অল্প বয়সের অভাবের দিনে প্রথম বৃষ্টি নামলে মাটি থেকে যে সোঁদা গন্ধ বের হত তা তাকে অস্থির করত। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় অপু হয়ে যেতেন। পথের পাঁচালী অভাবী দুঃখী অসহায় মানুষের কাহিনী নয়, মানুষের স্বপ্ন দেখার দলিল।
ওঁর জাহাজে চাকরি পাওয়ার কাহিনীটিও অদ্ভুত। অভাবের তাড়নায় রোজ অনেকটা হেঁটে উপস্থিত হতেন যেখানে চাকরি দেওয়া হচ্ছে। শরীরের মান যথাযথ না হওয়ায় তাকে বাতিল করে দেওয়া হলেও লুকিয়ে ঢুকে পড়েন বাছাইদের দলে। তখনও বাছাই করা প্ৰার্থীদের নাম কাগজে লেখা হয়নি। ফলে চাকরি হল। সেই ট্রেনিং অমানুষিক, পরিশ্রমে শরীর অসাড় কিন্তু অতীনদা স্বপ্ন দেখতেন। ওই ট্রেনিং-এর পরে মাইনে পাওয়া যাবে। সেই মাইনের টাকা বহরমপুরের গ্রামে পাঠালে সেখানে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ি থেকে গন্ধ বের হবে। ওই সূত্রে জাহাজে চাকরির ছাড়পত্র মিলল। কিন্তু জাহাজ নেই। শেষ পর্যন্ত সিলেটের এক প্রৌঢ় সরেঙের বদান্যতায় মালবাহী জাহাজে কাজ পাওয়া গেল। বারো ঘন্টা ধরে ডেক পরিষ্কার করতে হবে এবং বয়লারে কয়লা ফেলতে হবে। একটি লিকলিকে অভাবী বাঙালি শরীরের পক্ষে সেটা প্ৰায় অসম্ভব হলেও অতীনদা পারলেন। সমুদ্রে ভেসে ভেসে এ বন্দর থেকে সে বন্দরে নোঙর করা জাহাজের খালাসি হয়ে জীবন দেখলেন নতুন করে। বন্দরে বন্দরে জাহাজিদের একটি করে বউ থাকে–এ প্রবাদ তার ক্ষেত্রে খাটল না। তিনি দেখতেন জাহাজিরা বন্দরে নেমেই চেনা জায়গায় ছুটে যেত যেমন তেমনই অনেকে জাহাজ থেকে নামতেই চাইত না। অতীনদা অচেনা শহরে হেঁটে বেড়াতেন দেশ দেখবেন বলে।
এইভাবে একদিন আর্জেন্টিনায় পৌঁছেছিল জাহাজ। একা একা হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা হারিয়েছিলেন তিনি। যাকে জিজ্ঞাসা করছেন সেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কারণ কেউ ইংরেজি বোঝে না। অথচ বিকেল শেষ হয়ে আসছে। অসহায় অবস্থায় একটি বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেন একজন প্রৌঢ়া এগিয়ে এসে কিছু প্রশ্ন করলেন যা তার বোধগম্য হল না। শেষ পর্যন্ত ভাঙা ইংরেজি শুনে লাফিয়ে উঠলেন অতীনদা। ওই বাড়িটি প্রৌঢ়ার। তিনি ওকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। নিজের হাতে চা বানিয়ে কেক প্লেটে সাজিয়ে দিলেন। আনন্দে অতীনদার ইচ্ছে করছিল প্রৌঢ়াকে প্ৰণাম করতে। একটু পরে প্রৌঢ়ার মেয়ে বাড়িতে ফিরল। এক ঢাল কালো চুল, কালো চোখ, মাজা রঙের অপূর্ব সুন্দরীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন বহরমপুরের এক রোম্যান্টিক তরুণ। মেয়েটিও।
তখন বুঝলা, সাহেবের মতো দেখতে ছিলাম। টকটকে ফরসা, জাহাজে কাম করায় শরীর মজবুত আর আধা ইংরিজেতে কথা বলায় ভাষাটা খুব সহজ–!
তখন সাহিত্যের ভাবনা ছিল না?
দুর। সাহিত্য! তখন আমার দুনিয়ায় একটি মুখ, ওই মেয়েটি তখন স্বপ্নের মতো সত্যি।
যে কদিন জাহাজ বন্দরে ছিল সে-কদিন শুধু পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া, কফির দোকানে বসে মুখোমুখি কথা না বলে সময় কাটানো। অতীনদা ঠিক করলেন দেশে ফিরে মা-বাবাকে এই মেয়ের কথা জানাবেন। বাকি জীবন এই মেয়ের সঙ্গে কাটানোর জন্যে ইগলুতে থাকতেও তখন তিনি রাজি। যেদিন জাহাজ ছাড়বে সেদিন মনের দুঃখ চাপা দিতে বয়লারে কয়লা ফেলছিলেন অতীনদা। সমস্ত শরীর কালো হয়ে গিয়েছিল। এই সময় কেউ একজন জানাল তার গেস্ট এসেছে দেখা করতে। ওই ভুতের মতো চেহারা নিয়ে বাইরে এসে দেখেছিলেন পরীর মতো সেজে মেয়েটি এসেছে হাতে ফুল নিয়ে। তাকে দেখে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল সে।
আর্জেন্টিনা কোথায়, আর বহরমপুর কোথায়। দু’বছর পর ছুটি পাওয়া গেল। সঙ্গে মাইনের জমানো টাকা। কলকাতা থেকে বাসে বহরমপুর। আকাশ ভরতি কালো মেঘ। বহরমপুর থেকে গ্রামের দিকে যখন হাঁটতে শুরু করলেন তখন টুপটাপ বৃষ্টি। আচমকা ঝড় উঠল। আর হঠাৎ চারপাশের চরাচরে মাটির সোদা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। হু হু করে। এই গন্ধ শরীরের সমস্ত রন্ধ দিয়ে উপভোগ করতে করতে অতীনদা আবিষ্কার করলেন এর চেয়ে আরাম আর কিছুতেই পাবেন না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গ্রামে পৌঁছেছিলেন। তার ফিরে আসা, অতগুলো টাকা পাওয়া, বাড়িতে উৎসব বসেছিল। দু’বছর পরে অতীনন্দ আবিষ্কার করলেন মা বাবা ভাই বোন কাকা জ্যেঠা ইত্যাদি মানুষের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক তার টান বড় জোরালো। আর যে মাটিতে জন্মেছি, যে ঘাসে পা ফেলেছি তার গন্ধ পেলে হৃদয়ের শিকড়ে যে নাড়া লাগে তার কোনও বিকল্প নেই। এসব ছেড়ে পৃথিবীর কোনও হিরের বিছানায় শুলেও তার ঘুম আসবে না। গোটা তিনেক চিঠি এসেছিল আর্জেন্টিনা থেকে, আবদার, অনুনয়, অভিমানের কান্না ঢেলে জাহাজের ঠিকানায়। অতীনদা লিখেছিলেন, জায়গা বদল করলে আমি বা তুমি কেউ ভাল থাকব না। অতএব যত নির্মম হোক, সত্যিকে মেনে নিতে হবে।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখক বন্ধুদের অনেকেই বোহেমিয়ান জীবনযাপন করেছেন, নিয়ম ভেঙেছেন। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু সীমানার মধ্যেই ছিলেন। থাকতে পছন্দ করেছেন। মদ্যপানে তার আপত্তি নেই কিন্তু সেটা করেন মাঝেমধ্যে, দলে পড়ে, আর সেটাও অল্পস্বল্প। স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূদের নিয়ে তার যে সংসার সেখানে তিনি কর্তব্যপরায়ণ স্বামী, বাবা। বাড়ির ওপর ওঁর প্রচন্ড টান। সাফল্য তাকে যে স্বস্তি দিয়েছে তিনি উপভোগ করছেন, নিজের বাড়ি তৈরী করেছেন। কিছুদিন আগে সেই বাড়িতে ডেকেছিলেন আমাদের কয়েকজনকে। সম্পূর্ণ একটি পারিবারিক আবহাওয়ায় আমরা আড্ডা মারলাম। ওঁর স্ত্রী আমাদের পানভোজনের আয়োজন করেছিলেন। কোথাও একটু বিরক্ত হতে দেখিনি মেয়েদের। বাড়ির কর্তা যে কোনও অন্যায় করতে পারেন না এই বিশ্বাস ওঁদের আচরণে স্পষ্ট। সংসারে এই যে পরস্পরের প্রতি আস্থা রাখা, অতীনন্দ তাই চেয়েছেন চিরজীবন। আবার এখানেই তার সঙ্গে বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কিছুটা মিল থাকা সত্ত্বেও বিরাট পার্থক্য রয়েছে। সংসারে থেকেও অতীনন্দ বাউণ্ডুলেদের ডাক পেয়ে কিছুটা সময় বেরিয়ে আসতে পারেন।
খুব বড় সাহিত্য পুরস্কার অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় পাননি। অনেকেই পায় না। এদেশে এইসব পুরস্কার দেওয়ার নিয়মগুলো নিয়ে বিতর্ক ওঠে। কিন্তু পাঠকদের ভালবাসা পেয়ে গেছেন যে লেখক তার কাছে সাজানো পুরস্কারের কোনও মূল্য থাকা উচিত নয়। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাবৎ লেখালেখিতে একটা স্বপ্ন দেখার চেষ্টা আছে। সেই স্বপ্ন খুব ঘরোয়া। বাইরের ঘটনার ঘনঘটা পার হয়ে এলে মাটির সোদা গন্ধ খোঁজার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যে লেখক তাকে কোনও ফর্মুলায় ফেলা যায় না।
আমার আগের প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিমান গদ্যলেখক হিসেবে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে স্বীকার করতে কোনও অসুবিধে হত না। শব্দ ওঁর কলমে নিত্যনতুন চেহারা নিত। শ্লেষের ব্যবহার ছিল একেবারে নিজস্ব ঘরানায়। আর ওর লেখার বিষয়বস্তু ছিল গ্রাম এবং মফস্বলের সেই সব মানুষেরা যাদের আমরা আবছা চিনি। কিন্তু একটুও জানি না। কোনও গঞ্জের পাইকার, বিলে নৌকো নিয়ে সারারাত ছিপ ফেলে থাকা কোনও মাছমারা, চোলাইয়ের হাঁড়ি মাথায় নিয়ে শরীর নাচিয়ে হেঁটে যাওয়া যুবতীর ছবি তুলে শব্দ দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা যে লেখকের তাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় ছিল না।
দেশ পত্রিকায় কুবেরের বিষয় আশয় দিয়ে ওঁর যাত্রা শুরু। উপন্যাসের বিষয় এবং তার বলার ভঙ্গি বলে দিত। একজন লেখক এসে গেছেন মাটির গল্প বলতে। অনবদ্য যেসব ছোটগল্প সেসময় তার কলম থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল তাতে পত্রিকাগুলোই সমৃদ্ধ হতে লাগল। এরকম যার শুরু তার তো উচিত এভারেস্টের চুড়োয় উঠে ফ্ল্যাগ পুঁতে আসা।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখে আমার মনে হয়েছিল। এই চেহারা শ’খানেক বছর আগের স্বচ্ছল বাঙালির সঙ্গে চমৎকার মিলে যায়। কালীঘাটের পটে যেন তাকে মডেল করে সেকালের বাবুদের ছবি আঁকা হয়েছিল। তার কথাবার্তায় সেই সময়ের গল্প পুরোপুরি পাওয়া যায়।
একটু একরোখা জীবন, নিজের সঙ্গে রসিকতা করতে অন্যকেও আক্রমণ করা, খুব বড় একটা স্বপ্ন দেখে সবাইকে একজোট করে তাতে বিফল হয়ে ঘনিষ্ঠদের অপছন্দের কারণ হওয়া এবং নিজের আচরণে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করার পেছনে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কোনও পরিকল্পনা ছিল বলে আমি মনে করি না। কিন্তু ওটা হয়ে গেছে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্ভট ঘটনাগুলো তো এখন প্ৰায় প্ৰবাদ হয়ে গেছে। ওগুলো সংগ্রহ করে সম্পাদনা করলে একটি চমৎকার উপন্যাস হয়ে যায়। কিন্তু যে অর্থে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নিয়ম ভাঙার স্বচ্ছন্দ প্ৰয়াস ছিল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে সেই একইভাবে গ্রহণ করতে রাজি নন অনেকেই।
শ্যামলদাকে নিয়ে এক কবি তার সম্পাদিত ছোটগল্পের কাগজে গল্প লিখেছিলেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, একজন লেখক এবং তার আচরণ ছিল গল্পের বিষয়বস্তু। কাগজটি ছাপা হওয়ার পর দক্ষিণ কলকাতার একটি রেস্টটুরেন্টের প্রভাতী আড্ডায় গিয়ে সম্পাদক-লেখক দেখলেন সেখানে শ্যামলদা বসে আছেন। একটু অস্বস্তি নিয়ে তিনি অন্য দিকে সরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শ্যামলদা তাকে মধুর স্বরে ডাকলেন, কিরে, ওদিকে কেন? এখানে আয়। আমি তো মোটা হয়ে গেছি, দৌড়োদৌড়ি করতে পারব না, তুই কাছে এলে তোর গলা টিপে মেরে ফেলব। আয় কাছে আয়। শ্যামলদা এটা করতে পারেন বলে সেই সম্পাদক-লেখক বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন।
একজন সমবয়সী লেখক একদা কিছু গল্প শুনিয়েছিলেন। শ্যামলদা তাকে সিনেমা দেখাবেন বলে সঙ্গে নিয়ে বাসে উঠলেন। কন্ডাক্টার টিকিট চাইতে এলে বন্ধুকে দেখিয়ে গম্ভীর মুখে বলতেন, আমার ভাই। কন্ডাক্টর অন্যদের টিকিট কাটতে লাগল। শ্যামলদা তখন বেকার। পুলিশ বা স্টেটবাসে চাকরি করেন না। বাস থেকে নেমে সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। ছবি শুরু হতে চলেছে। বন্ধু তাগাদা দিলেন টিকিট কাটতে। বললেন দাঁড়া না। তারপর এক সময় এগিয়ে গেলেন অপেক্ষায় থাকা এক বৃদ্ধার সামনে, মাসিমা, কি হয়েছে?
আরো বলো না বাবা, ওঁর কথা ছিল অফিস থেকে চলে আসার, কোনওদিন সময় রাখতে পারে না, আমি যে চলে যাব তারও উপায় নেই, উনি এসে দাঁড়িয়ে থাকবেন। একবার ছবি শুরু হয়ে গেলে আমি কিছুতেই দেখব না। ভদ্রমহিলা বললেন।
আপনার কোনও চিন্তা নেই। আপনি চলে যান, আমি ওঁকে বলে দেব।
তুমি ওঁকে চেনো?
কি বলছেন। বিলক্ষণ চিনি।
ভদ্রমহিলা বললেন, তাহলে, এই টিকিট দুটো।
আমি ও দুটো বিক্রি করে মেসোমশাইকে দিয়ে দেব।
ভদ্রমহিলা যেন বেঁচে গেলেন এমন মুখ করে টিকিট দুটো শ্যামলদাকে ধরিয়ে দিয়ে চলে যাওযা মাত্র শ্যামলদা বন্ধুকে ডাকলেন, আয় রে, ছবি দেখবি চল।
এসব গল্পে একটা নির্দোষ রসিককে খুঁজে পাওয়া যায়। সমবয়সী লেখককে নিয়ে গিয়েছিলেন তারাশঙ্করের বাড়িতে পরিচয় করাতে। মেসোমসাই বলে ডেকে এমন ব্যবহার করেছিলেন যে তারাশঙ্কর মুগ্ধ। খাওয়াদাওয়ার পর বেরিয়ে আসার সময় সঙ্গে আসা তরুণ লেখককে আলাদা ডেকে তারাশঙ্কর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তোমার বন্ধুর নাম কি বল তো? আগে দেখিনি। সম্ভবত তোমার মাসিমার আত্মীয়। তাঁকে তো নামটা বলতে হবে!
শ্যামলদা কখন কি করবেন তা নিয়ে বন্ধুরা তটস্থ থাকতেন। যে স্কুলে তিনি পড়াতেন সেখানে যেতে প্রায়ই খুব দেরি হত। স্কুলের প্রধান শিক্ষক এ ব্যাপারে অনুযোগ জানানোয় তিনি তাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন। পরের দিন ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছবেন। পরের দিন ক্লাস শুরু হওয়ার অনেক আগেই পৌঁছে গেলেন শ্যামলদা। প্রধান শিক্ষক খুব খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানাতে শ্যামলদা তাঁর পাঞ্জাবি খুলে বললেন, এই দেখুন, আমার গেঞ্জিটা ভিজে থাকায় আপনার তাগাদায় মায়ের ব্লাউজ পরে এসেছি। প্ৰধান শিক্ষক এর পরে আর কোনও কথা বলতে পারেননি।
মাঝে মাঝে মনে হয় এই গল্পগুলোর অনেকটাই পরে বানানো হয়েছে। তিলকে তাল করা হয়েছে। খবর পেলাম শ্ৰীযুক্ত সন্তোষকুমার ঘোষকে ঘুসি মেরেছেন শ্যামলদা। ওঁদের সম্পর্ক একসময় খুব ভাল ছিল। প্রতিভাবান তরুণ লেখককে ডেকে আনন্দবাজারে চাকরি দেওয়ার ব্যাপারে সন্তোষদার একটা ভূমিকা ছিল। আমরা হতবাক হয়ে গেলাম এরকম আচরণে। বোধহয় এই কারণে শ্যামলদা চাকরি ছেড়ে দিলেন। তার কিছুদিন পরে অমৃত পত্রিকার দায়িত্ব নিয়ে চলে গেলেন শ্যামলদা। তখন তার একমাত্র উদ্দেশ্য কাগজটাকে দেশ পত্রিকার পাশে দাঁড় করানো। যেসব লেখক তখন আনন্দবাজারে লিখে একটু নাম করেছেন কিন্তু বড় সুযোগ পাচ্ছেন না তাদের ডেকে অমৃত পত্রিকায় সেই সুযোগ দিতে লাগলেন তিনি। এই প্রসঙ্গে দীপালি দত্তরায়ের কথা মনে পড়ছে। মধ্যবয়সে লিখতে এসে এই ভদ্রমহিলা রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিলেন কয়েকটি গল্প এবং একটি উপন্যাসে। উচ্চবিত্ত সমাজের ছবি আঁকতে তিনি যে দক্ষ তা বোঝা যাচ্ছিল। শ্যামলদার্তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে অমৃত-এ লেখালেন। ওই সময় ওঁর আনন্দবাজার-দেশ-বিরোধী মানসিকতা সাগরময় ঘোষকে এমন বিরক্ত করেছিল যে তিনিও অমৃত পত্রিকার লেখকদের আর জায়গা দিতে রাজি হননি। এর ফলে বিব্রত দীপালি চিরকালের জন্য লেখা বন্ধ করে দিলেন। অন্তত আমার তো তার লেখা কোথাও চোখে পড়েনি।
পরে শ্যামলদার সঙ্গে কথা বলেছি, সন্তোষদার সঙ্গেও। শ্যামলদা বলেছেন আমি সন্তোষদাকে ঘুসি মারিনি। আঙুলের ডগা দিয়ে ওঁর গালে ধাক্কা মেরেছিলাম। উনি আমার একটা লেখা নিয়ে গালাগালি দিচ্ছিলেন। ছয়বার গালাগালিটা শোনার পর ওকে সতর্ক করে আটবারের বার ওই কর্মটি করি। যারা জল মেশাতে অভ্যস্ত তাঁরা ওটাকে ঘুসি বলে প্রচার করে দিল। সন্তোষদাকে যখন প্রশ্নটা করেছি তখনই দেখেছি তার মুখ লাল হয়ে যেত। গম্ভীর গলায় বলতেন, অন্য কথা বল।
জীবনকে পাশবালিশের মতো সারা শরীর দিয়ে চটকেছেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তাই তার আচরণের নানান ব্যাখ্যা হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই অপব্যাখ্যা হওয়াও উচিত। কিন্তু একজন তরুণ বাঙালি লেখক যে বিরাট স্বপ্ন দেখতে চাইতেন তার পরিচয় আমরা পেয়েছি ওঁর চম্পাহাটি অভিযানে। কলকাতা থেকে বেশ দূরে প্রায় অজ পাড়াগাঁ হয়ে পড়েছিল চম্পাহাটি। শ্যামলদা সেখানে জলের দরে জমি কিনলেন, বন্ধুদের দিয়ে কেনালেন। সেখানে আধুনিক কায়দায় চাষ করা হবে মাঠে, পুকুরে মাছের উৎপাদন বিদেশি মতে হবে। সুন্দর রাস্তাঘাট থাকবে। নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমন কি পোস্ট অফিসের জন্যেও চেষ্টা করা হবে। পঁয়ত্ৰিশ বছর পরে এখন কোনও কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা যে পরিকল্পনা নিচ্ছেন শ্যামলদা শূন্য হাতে তখন সেটা করার চেষ্টা করেন। বন্ধুদের অনেকেই রাজি হয়নি, কেউ কেউ হয়েছিল। ট্রেন খুব কম থামে বলে প্রচুর পোস্টকার্ডে জনতার দাবি ছাপিয়ে রেলওয়ে বোর্ডের কাছে পাঠিয়েছিলেন। এসব করতে প্রচুর পরিশ্রম হয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি এই স্বপ্ন সত্যি করার যে উদ্যোগ তিনি সে সময় নিয়েছিলেন তা বাঙালির চরিত্র-বিরোধী, বাঙালি লেখকের তো বটেই। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। সাতষট্টিতে বাম রাজনীতি প্ৰবল হয়ে উঠল। গ্রামেগঞ্জে তার প্রতিক্রিয়ায় অনেক কিছুর মতো শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বপ্ন গেল চুরমার হয়ে। এখন সেখানে একটি রাস্তা পড়ে রয়েছে দু’পাশে আগাছা নিয়ে যার নাম শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় রোড। তবে হ্যাঁ, এখন ট্রেন আগের থেকে অনেক বেশি থামছে স্টেশনে।
শাহজাদা দারাশুকো, স্বর্গের আগের স্টেশন, হিমা পড়ে গেল, হাওয়াগড়ি থেকে শুরু করে হালের উপন্যাস আলো নেই পড়লে বোঝা যায় প্রচলিত লেখালেখির সঙ্গে কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওঁর লেখা পড়লেই বোঝা যায় এটা অন্য কারও কলম থেকে বের হয়নি। এখনকার অনেক লেখকই এই কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন না।
আমার বিশ্বাস শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় একটি পুরনো মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষের নাম। আর সেটাকে আড়াল করতে চিরকাল ধুলো এবং কাদা ছুঁড়ে গেছেন দুহাতে। সন্তোষকুমার ঘোষের সঙ্গে শ্মশানে এবং পরে তার শ্রাদ্ধে যে মানুষটি যেতে পারেন এক বুক কষ্ট নিয়ে তিনি কি সত্যিই তাকে আহত করতে চেয়েছিলেন? আবার দেশ পত্রিকায় সুনীলদার অর্ধেক জীবন যে সংখ্যায় প্রথম বের হল তার মুখবন্ধ লিখেছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। বহুদিনের বন্ধু ওঁরা। অনেক কর্মকান্ডে ওরা জড়িয়ে ছিলেন। লেখাটা চলছিল ভালই, হঠাৎ পড়লাম কোনও বৃষ্টির দুপুরে ট্যাক্সির মধ্যে বসে এক সুন্দরীর দুই গালে ওঁরা দুজন চুমু খেয়েছিলেন একসঙ্গে। বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা বোঝাতেই হয়তো এই ঘটনার কথা লিখেছেন। কিন্তু আমি জানি, অনেক পাঠকেরই এটা পড়তে খারাপ লেগেছিল। ওই ঘটনা ঘটে থাকলেও তা এতকাল পরে তুলে ধরে বন্ধুত্বের গভীরতা বোঝানো নাকি বন্ধু সম্পর্কে পাঠকের মনে একটু বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে দেওয়া — এই নিয়ে কথাও উঠেছে। আমি মনে করি এরকম মতলব শ্যামলদার ছিল না। কোনও কিছু জাহির করার সময়ে বেশি নগ্ন হওয়ার যে প্রবণতা তার আছে তাই তাকে ভুল বুঝতে সাহায্য করেছে।
এই লেখা শেষ করার আগে ওঁকে ফোন করেছিলাম। ওঁর কথাই তুলে দিচ্ছি, বুঝলি সমরেশ, কেউ নেই। চল্লিশের দশকের সব লেখক এখন অন্ধকারে। তার পরে যারা এসেছিলাম তারা এখনও ওই তিনজনকে অতিক্রম করতে পারিনি। অপরাজিত, পুতুল নাচের ইতিকথা, হাঁসুলিবাঁকের উপকথার কাছে আমাদের লেখাগুলো লিলিপুটের চেয়ে ছোট রে। আমরাও হারিয়ে যাব। ওই তিনটে বইকে যে অতিক্রম করতে পারবে সেই লেখক বেঁচে থাকবে। দেখিস!