কবিতা এবং উপন্যাস একই সঙ্গে চমৎকার লিখেছেন এমন মানুষের সংখ্যা বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি নেই। কোনও কোনও কবি যখন উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছেন তখন সব কিছু ছাপিয়ে তার চেষ্টাটাকেই বড্ড বেশি নজরে পড়েছে। গত দেড়শো বছরে যেসব বাঙালি কবিতায় সন্তুষ্ট না থেকে উপন্যাসে বিখ্যাত হতে চেয়েছেন তাদের কয়েকজনই অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই প্রসঙ্গে কোনও কথা বলার মানেই হয় না। উনিশ শো চল্লিশে যদি তিনি তিরিশ বছরের যুবক হতেন তা হলে সত্যজিৎ রায়ের আগেই আর একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালককে আমরা পেয়ে যেতাম। শিল্পের সব শাখায় যার স্বচ্ছন্দ বিচরণ, তিনি নিশ্চয়ই চলচ্চিত্রকে কথা বলার মাধ্যম হিসেবে গ্ৰহণ করতেন।
তবু রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নিয়ে কিঞ্চিৎ বিরূপ কথাবার্তা কেউ কেউ বলেছেন। গল্প নিয়ে নয়, সেখানে তিনি আকাশছোঁয়া। যাঁরা কথাবার্তা বলেন তাদের জিভ সমসময় চুলকোয়, কথা না বললে বোধহয় অস্বস্তি হয়। আমরা এতদিনে জেনে নিয়েছি এদেশের কিছু অতিশিক্ষিত বন্ধ্যা মানুষ কিছু করতে না পেরে সমালোচক হয়ে যান। যে যত নাক উঁচুতে তুলতে পারবেন। তিনি তত বড় সমালোচক।
কবি এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে যাদের নাম প্রথমেই মনে পড়ছে তাদের মধ্যে আছেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং জয় গোস্বামী।
প্রেমেন্দ্র মিত্র অত্যন্ত ভাগ্যবান লেখক। এত কম লিখে এত বেশি পুরস্কার আর কেউ পেয়েছেন কি না জানি না। কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন যত তারচেয়ে বেশি পেয়েছেন ছোট গল্পকার হিসেবে। ওঁর প্রথম দিকের উপন্যাস পাক এবং অচিন্ত্যকুমারের প্রথম উপন্যাস বেদে পড়েছিলাম স্কুলের শেষ ধাপে। কল্লোলের লেখক হিসেবে নিয়ম-ভাঙার লেখা হিসেবে এই দুটো উপন্যাস স্বীকৃত হয়েছিল। অচিন্ত্যকুমার কবিতা লিখেছেন। কিন্তু কবি হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। তাই তাকে এই আলোচনায় আনছি না। প্রেমেন্দ্ৰ মিত্রের এমন কোনও উপন্যাস নেই যা তাকে এখন বঁচিয়ে রাখবে। তিনি বেঁচে ছিলেন যখন তখনই এই সত্যটা জানা হয়ে গিয়েছিল।
বুদ্ধদেব বসুর প্রথম এবং শেষ পরিচয় হওয়া উচিত ছিল কবি হিসেবেই। কিন্তু উনি এমন একটি শিক্ষিত গদ্য লিখতেন যাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। উপন্যাস লিখেছেন বিস্তর। রাতভর বৃষ্টিতে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল, আদালত পর্যন্ত পৌঁছেছিল অশ্লীলতার দায়ে। কিন্তু তার উপন্যাস সমগ্রর মধ্যে একমাত্র তিথিডোর বেঁচে থাকবে কিছুদিন। প্রচুর ভাল কবিতার পাশাপাশি মাত্র একটি অনবদ্য উপন্যাস। তার প্রবন্ধগুলো আমাদের আলোচনার বিষয় নয়।
জীবনানন্দ দাশ উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু লিখেছেন খুব সন্তর্পণে। মনে হয় কবির এ-ব্যাপারে কুণ্ঠা ছিল। হয়তো মান নিয়ে তিনি নিজেই দ্বিধাগ্ৰস্ত ছিলেন। যত দূর জানি তাঁর জীবদ্দশায় এই উপন্যাসগুলো প্রচারিত হয়নি। যেহেতু আমি জীবনানন্দের কবিতায় বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাই, তার কবিতার এক একটি লাইন আমাকে অপার প্রসন্নতা এনে দেয়, তাই উপন্যাসগুলো প্ৰকাশিত হওয়ামাত্র পড়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর পড়িনি। অথচ আমৃত্যু আমি ওঁর কবিতা পড়ে যাব, যতবার সম্ভব।
শক্তিদা খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে কলম লিখতেন। তিনি যাকে পদ্য বলতেন সেখানে তিনি সম্রাট। কিন্তু তাঁকে উপন্যাস লিখতে হল। কুয়োতলা পড়ে ভাল লেগেছিল। শুধুই ভাল লাগা। কেন উপন্যাস লিখছেন জিজ্ঞাসা করতে হেসে জবাব দিয়েছিলেন, পদ্য লিখে টাকা পাওয়া যায় না, তাই। কিন্তু শক্তিদা বেঁচে থাকবেন তার কবিতার জন্যে এই সত্যিটা তিনি নিজেই ভাল করে জানতেন। আমি একসময় শরৎ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার পাঠক ছিলাম। তার কারণ শরৎদার কবিতায় গল্পের গন্ধ থাকত। শরৎদা যখন উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন তখন সেই গন্ধটা চলে গেল। নীরেন্দ্ৰনাথ চক্রবর্তী আমার প্রিয় কবি। ন্যাশনাল হাইওয়ে হল, কত লোক ভাল ভাল কথা বলল, কিন্তু একজন চাষী তার ধান শুকোবার জায়গা পেয়ে সবচেয়ে বেশি খুশি হল। এমন কবিতা তিনিই লিখতে পারেন। নীরেনদা উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর পিতৃপুরুষ অসাধারণ। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন রহস্য বা গোয়েন্দা কাহিনীর ধারাকে। সেখানে কবিত্ব করার অবসর নেই। এইটে ওঁর চেয়ে ভাল খুব কম লেখকই জানেন।
এবার জয় গোস্বামী। জয়ের মতো কোনও কবি এত অল্পদিনে এত ভাল লেখা লেখেনি এবং খ্যাতি পায়নি। জয় মূলত লিরিক লেখে। ওর কবিতায় ও গল্প আঁকে। ওর কাব্যোপন্যাস অনবদ্য কারণ তার পরতে পরতে কবিতা রয়েছে। যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিলকে কাব্যোপন্যাস বলা হয়েছে, মালিনীকে বলা হয়নি কেন? অনেক আগে ধ্ৰুপদী পত্রিকায় আনন্দ বাগচী ওইরকম একটি কাহিনী কবিতায় লিখেছিলেন। অনবদ্য। সুশীল রায় সম্পাদিত ওই কাগজে রচনাটিকে কি নাম দেওয়া হয়েছিল জানি না। আমি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত লেখাটির জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকতাম ছাত্রাবস্থায়। জয় এখন পর্যন্ত গদ্যে যা লেখার চেষ্টা করেছে তা। ওর কবিতার মতো সাফল্য পায়নি। কবি যদি ঔপন্যাসিকের অভিভাবক হন তাহলে আর যাই হোক তা উপন্যাস হয় না। তবে জয় সম্পর্কে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। একটি কথা স্বীকার করছি, ওর কবিতার এক একটি শব্দে আমি নিজের মতো গল্প খুঁজে পাই।
কিন্তু এইসব কথাবার্তা যাঁর সম্পর্কে প্রযোজ্য নয় তার নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীলদাকে নিয়ে লেখার আগে এতগুলো কথা লিখতে হবে তা আমি ভাবিনি। আমি নিজে ভূমিকা পছন্দ করি না। এই লেখা শুরু করতে পারতাম। এইভাবে, কেউ কথা রাখেনি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কি রেখেছেন? এ কথা সত্যি সুনীলদাই প্রথম সোজাসুজি কথা বলার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত বাঙালি সাহিত্যিকরা আশ্রমের ব্রহ্মচারীমার্কা মুখ করে লেখালেখি করে গেছেন। যে-কোনও বৃহৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে গেলে সেইসব নাদুস-নুদুস ব্ৰহ্মচারীর দর্শন পাওয়া যায় যাদের দেখলেই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এরা বেশ দুধেভাতেঘিয়ে রয়েছেন। আমাদের ওই সময়ের লেখকরাও জীবনে যত কুকীর্তি করুন না কেন নিজের সম্পর্কে লেখার সময় অম্বুবাচী করা বিধবার মতো কথা বলেছেন অথবা এইসব ব্ৰহ্মচারীর মতো জ্ঞান বর্ষণ করেছেন। নিয়মিত মদ্যপান করলেও পাঠকরা তাকে খারাপ ভাববে এই ভয়ে সেটা লিখতে পারেননি। সুনীলদাই প্রথম লিখতে পারেন, কাল রাত্রে একটু বেশী হুইস্কি খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অতএব সুনীলদা-সম্পর্কিত লেখা সরাসরি শুরু করাই ঠিক হত। মুশকিল হল, সুনীলদা নিজে বলেন, তার প্রথম পরিচয় তিনি কবি। কবিতা লেখেন। অতএব কবিদের উপন্যাস লেখার প্রসঙ্গ সহজেই এসে পড়ে। এবং সিদ্ধান্ত এইরকম, রবীন্দ্রপরবর্তী কবিকুলের মধ্যে যাঁরা উপন্যাসে হাত দিয়েছিলেন তারা কবি হিসেবেই এখনও পরিচিত কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কতটা কবি হিসেবে আর কতটা ঔপন্যাসিক হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন তা নিয়ে এখন তর্ক করার কোনও মানে হয় না।
দেশ পত্রিকায় সুনীলদার অর্ধেক জীবন বের হচ্ছে। তার নিজের কলমে পাঠকরা অনেকখানি জেনে যাচ্ছেন। অতএব কিছু কথার পুনরাবৃত্তি হলেও হতে পারে।
আমরা অল্প বয়সে একটা তর্ক প্রায়ই করতাম। একজন লেখকের জীবনের প্রথম ভাগ কীরকম হওয়া উচিত। প্রচুর বিত্তের মধ্যে, আরামে থেকে নিয়ম করে লেখালেখি করলে পরবর্তীকালে তিনি আর একজন রবীন্দ্ৰনাথ হয়ে উঠবেন? নাকি প্রচন্ড অভাবের সঙ্গে লড়াই করে ডুবে যেতে যেতে শেষপর্যন্ত লিখে পাড়ে এসে পৌঁছবেন? সে সময় দ্বিতীয় ভাবনাটিকেই আমরা প্রাধান্য দিতাম। পৃথিবীর ইতিহাসে এইসব লড়াকু মানুষের কেউ কেউ বিরাট লেখক হয়েছেন। সত্যি বলতে কি রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরবাড়ির গল্প সে সময় আমাদের ঠিক পছন্দ হত না। মাস কয়েক আগে নিউ ইয়র্কের এক বাংলাদেশি বন্ধুর বাড়িতে আমি আতিথ্য নিয়েছিলাম। খুব ভাল মানুষ তারা। গৃহকর্তার বাড়িভাড়া থেকে রোজগার হয়। স্ত্রী চাকরি করেন। ভদ্রলোক নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্র-পত্রিকা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। দোতলার জানলার ধারে তার লেখার টেবিল। শুনলাম, প্রতিদিন তিনি সেখানে বসে সাহিত্যচর্চা করেন। এই মহৎ কর্মটি যাতে শান্তিতে করতে পারেন তার জন্যে ভদ্রলোকের স্ত্রী সবসময় উদ্বিগ্ন থাকেন। স্বামী লেখক বলে তার মনে গর্ব আছে। পাশের জানলা দিয়ে আঙুরগাছ হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। যখন আঙুর পাকে তখন লেখক লিখতে লিখতে বাঁ-হাত বাড়িয়ে একটি ফল ছিঁড়ে মুখে দেন। এসব ব্যাপার চলছে অনেক বছর ধরে। নিজের পয়সায় লেখক কয়েকটি উপন্যাস ঢাকা এবং কলকাতায় প্রকাশ করলেও পাঠকরা এখনও তার মূল্য বুঝতে পারছে না বলে লেখকের ধারণা। এরকম কোনও লেখকের কথা ছাত্রাবস্থায় শুনলে আমরা বিরূপ মন্তব্য করতাম সন্দেহ নেই। এখন মনে হয় সে সময় আমাদের মধ্যেও গোঁড়ামি কাজ করত।
শ্যামপুকুরে আমি যে-বাড়িতে থাকি তার কয়েকটি বাড়ি দুরে একসময় সুনীলদা থাকতেন। তখন তার বাবা স্কুল শিক্ষক। পঞ্চাশ বছর আগে একজন সৎ শিক্ষকের আয় কীরকম ছিল তা আমরা জানি। পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা পরিবারটির অনেকগুলো মুখ একটি মাত্র মানুষের রোজগারে ছোট ফ্ল্যাটে যেমন থাকতে পারে তেমনই ছিল। সে সময় এ-পাড়ার কিশোর অথবা তরুণ ছেলে হিসেবে যারা ডাকসাইটে ছিল এখন তারা প্ৰবীণ। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর সুনীলদার প্রসঙ্গ জানতে চেয়েছি। জেনেছি, মুখচোরা একটি কিশোর পাড়ায় থাকত, ব্যস, এটুকুই।
সেই কিশোর কবিতা লিখত। কী কবিতা? ওইরকম অভাবী পরিবারে মানুষ হয়ে ওই বয়সে কবিতা কি করে মাথায় আসে? স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা দেওয়ার পর (নাকি, ম্যাট্রিক?)। পিতৃদেব আদেশ করলেন, দুপুরে বাড়িতে থেকে রোজ টেনিসনের একটি করে কবিতা বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। ওই সময়টায় নাকি ছেলেদের বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই বাড়িতে আটকে রাখার চেষ্টা। সুনীলদা রোজ টেনিসনের কবিতা বাংলায় লিখছেন এবং সন্ধেবেলায় পিতৃদেব সেটা পরীক্ষা করছেন। তিন-চারদিন পরে সুনীলদা লক্ষ করলেন পিতৃদেব কবিতা না পড়ে লাইন গুণে নিশ্চিন্ত হচ্ছেন পুত্র কাজ করেছে। টেনিসনের কবিতা ওর ভাল লাগছিল না। এবার সেই কবিতার লাইন মেপে ছেলে যে নিজের মনের কথা কবিতায় লিখছে এটা পিতৃদেব আর টের পেলেন না। তিনি লাইন ঠিক আছে জেনেই সন্তুষ্ট। এই অনুশীলন পরবর্তীকালে কতটা কাজ দিয়েছিল তা গবেষকরা বলতে পারবেন। কিন্তু ওই অল্প বয়সে দেশ-এ ওঁর কবিতা ছাপা হয়ে গেল। আমি সবসময় দেখে আসছি কবিরা কখনও একা থাকে না। খুব দ্রুত তাদের এক একটা দল তৈরি হয়ে যায়। সুনীলদার সঙ্গী জুটল। তারও কবিতা-ভাবনা খুব তীব্র। এবং সেটা প্রকাশের জন্যে একটা পত্রিকার প্রয়োজন। যার বাড়িতে অনটন তীব্র হয়ে উঠেছে তার পক্ষে পত্রিকা বের করার স্বপ্নই বোধহয় দেখা সম্ভব।
কিন্তু কাগজ করতে টাকার দরকার। সেটা ওদের নেই। তখন নাভার্নার রমরমা অবস্থা। শুদ্ধ সাহিত্যের প্রকাশনার আর এক নাম সিগনেট। তার কর্তা দিলীপকুমার গুপ্ত একটি খ্যাতনামা বিজ্ঞাপন সংস্থারও বড়কর্তা। এরকম মানুষের কাছে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে, ওঁরা চলে গেলেন দিলীপকুমারের কাছে। বালখিল্য-আস্পর্ধা বলে তাড়িয়ে দিলেন না। তিনি মন দিয়ে সব শুনলেন। বললেন, তোমরা যদি কাগজ করো তা হলে সেই কাগজে বিখ্যাত লেখকদের লেখা থাকবে কেন? তোমাদের বয়সীদের প্ল্যাটফর্ম হোক সেই কাগজ। কাগজ এবং ছাপার ব্যবস্থা করে দিলেন। কী নাম হবে সেই কাগজের? দিলীপকুমারই প্রস্তাব দিলেন, নাম দাও কৃত্তিবাস।
কৃত্তিবাস এখন ইতিহাস। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে লিখতে গেলে এই পত্রিকা এবং তার লেখকদের উপেক্ষা করার কোনও উপায় নেই। একদল তরুণ লেখক কবি এক জায়গায় জেট বাঁধল নতুন ধরণের সাহিত্য করবে বলে। পুরনো নিয়ম ভেঙে লিখতে গেলে জীবনযাপনের ধরণও বদলাতে হয়। এঁদের আচার-আচরণের সঙ্গে বাবু হয়ে থাকা বাঙালির কোনও মিল নেই। এদের দৌলতে আমরা খালাসিটোলা-বারদুয়ারি চিনলাম। জানলাম বিখ্যাত মানুষেরা সেখানে গিয়ে বাংলা মদ খেতে খেতে কামু, ব্ৰেখট, বোদলেয়ার থেকে শুরু করে সমসাময়িক বিদেশি শিল্পীদের আঁকা ছবি নিয়ে আলোচনায় বুদ হয়ে থাকেন। এতকাল আমরা জানতাম যারা বাংলা মদ খায় তাদের পকেটে পয়সা যেমন কম তেমনই রুচিও নিম্নশ্রেণীর। বাংলা মদের সঙ্গে খিস্তি-খেউড় ভাল মানায়, চিৎকার এবং একটু আধটু মারপিট চমৎকার মেলে। কিন্তু কমলকুমার মজুমদারের মত প্রাজ্ঞ মানুষ মৃদু হেসে যখন বলেন, বাবু বড় অভিমানী, তখন সব গোলমাল হয়ে যায়।
কৃত্তিবাসের নেতৃত্বে তখনই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সঙ্গে শক্তিদা, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আরও অনেকে। সে সময় কৃত্তিবাস রীতিমতো অহঙ্কারী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন, বুর্জোয়া কোনও প্রতিষ্ঠান যদি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা করে তা হলে কৃত্তিবাসের কেউ সেই পুরস্কার গ্রহণ করবে না। এবারের বইমেলা থেকে বেরিয়ে একটি পানশালায় বসে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বললেন, সুনীল কথা রাখেনি।
টাকার জন্যে সুনীলদা তখন একটার পর একটা কাজ করছেন। সবই অল্প মেয়াদের কাজ। ছাত্রী পড়ানো থেকে খবরের কাগজে প্রুফ দেখা। কিছু টাকা বাড়িতে দিতে পারলে বোধহয় এক ধরণের গ্লানি একটু কমত। কিন্তু তখন মাথায় পোকা ঢুকে গেছে। প্রায়ই ওরা কলকাতা থেকে পালাতেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কফি হাউসে আড্ডা দিতে গিয়ে হুট করে চাইবাসায় চলে যাওয়ার অভ্যোস তৈরি হয়ে গেল। বিহারের ওই অঞ্চলটা কেন ওদের এত টানত জিজ্ঞাসা করায় শক্তিদা বলেছিলেন, দারুণ মহুয়া পাওয়া যায়। চমৎকার। সারা বছর মহুয়া পাওয়া যায় কি না জানি না। কিন্তু তাড়ি বা চোলাই-এর অভাব ছিল না। ওঁদের এই সময়ের কাহিনী প্রত্যেকেই কিছু না কিছু লিখেছেন। সুনীলদার অরণ্যের দিনরাত্ৰি যে ওই অভিজ্ঞতার একটু ভদ্র সংস্করণ তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
তখন দেশ পত্রিকায় কবিতা ছাপা হত কোনও গল্প উপন্যাস প্ৰবন্ধ শেষ হওয়ার পর যে-জায়গাটি খালি থাকত তা ভরতি করার জন্য। কবিতাকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হত খুব নামকরা কবির ক্ষেত্রে। ষাটের দশকে শুনতাম বুদ্ধদেব বসুকে একটি কবিতার জন্যে এক হাজার টাকা সন্মানদক্ষিণা দেওয়া হত। সত্যি মিথ্যে জানি না। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে যেহেতু দেশ পত্রিকায় গদ্যের পায়ের তলায় কবিতা ছাপা হত তাই শক্তিদারা তাকে পদ্য বলতে শুরু করলেন। এই পদ্যকে সন্মান দিতে হবে, তার জন্যে আলাদা পাতা চাই–এই রকম দাবি নিয়ে সুনীলদারা সাগরদার কাছে হাজির হয়েছিলেন। এবং সাগরময় ঘোষ সেই দাবী শুধু মেনে নেননি, পরবর্তীকালে কবিতার জন্যে বিশেষ অলংকরণের ব্যবস্থাও করেছিলেন।
কৃত্তিবাস-কেন্দ্ৰিক যে-সাহিত্য আন্দোলন তা কখনও মাত্রা ছাড়ায়নি। প্রায় কাছাকাছি সময় হাংরি জেনারেশনের পরিকল্পিত অশ্লীলতা কৃত্তিবাস গোষ্ঠী এড়িয়ে চলত। সাহিত্য পাঠকের মনে পাঁকের গন্ধ ছড়ালে পাঠক তাকে ধুয়ে ফেলতে দেরি করবে না। সাহিত্য পাঠে হৃদয় প্রসন্ন না হলে লেখকের আয়ু বাড়বে না। এই সত্যিটা বিভূতিভূষণ তাঁর সারাজীবনের রচনায় আমাদের জানিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু হাংরি জেনারেশন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তাদের ঔদ্ধত্যের কারণে। শক্তিদা বা সন্দীপনদা যে কিঞ্চিত আকর্ষণ বোধ করেছিলেন। পরে ভুল বুঝতে পেরে সরে এসেছিলেন তাতে আমরাই উপকৃত হয়েছি। কৃত্তিবাস কিন্তু এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়নি।
এই সময় পর্যন্ত সুনীলদার পরিচয় কবি হিসেবেই। তারপর হঠাৎ আমন্ত্রিত হয়ে তাকে যেতে হল আমেরিকায়। সেখানে লেখক অধ্যাপক ছাত্রদের সঙ্গে মতবিনিময় তাকে অনেকটাই প্রভাবিত করল। গিনসবার্গের সঙ্গে বন্ধুত্ব ওর পক্ষে মূল্যবান ছিল। গিনসবাৰ্গ চাইতেন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শক্রতা নয়, প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছতে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই করলে জেতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে কিন্তু প্ৰতিষ্ঠানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাকে জয় করলে নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা সহজ হয়। এই সত্যিটা হাংরি জেনারেশনের লেখকরা বুঝতে পারেনি বলে আজ তারা নিশ্চিহ্ন, এই সত্যিটা শাস্ত্রবিরোধীরা বড্ড দেরিতে বুঝতে পেরেছিলেন বলে দু-একজন এখনও টিকে আছেন।
আমেরিকায় সুনীলদার যে-জীবনযাপন, মধ্যবিত্ত বাঙালির যে অকারণ সঙ্কোচ ন্যাতার মতো মনে জড়িয়ে থাকে, তা দূর করতে সাহায্য করল। ফিরে আসার পর মাথায় একরাশ লেখা চাপ দিচ্ছে আর অর্থাভাব একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। অতএব টাকার জন্যে গদ্য লেখা শুরু হল। আনন্দবাজারে পর পর বেরুতে লাগল নীললোহিতের রচনাগুলো। এখানে একটা কথা বলা দরকার। নীললোহিত অথবা নীলু আমাদের চারপাশে যেসব সাধারণ ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে তাই সে আমাদের দেখাল, দেখতে গিয়ে আমরা বৈচিত্ৰ্য খুঁজে পেলাম। নীলু হয়ে গেল আমাদের ভাই অথবা বন্ধু। ওই যে সেই রচনাটি, কত বছর আগে পড়েছি, সেটা ছিল এইরকম : পূজোর আগে নীলু যার কাছেই যাচ্ছে জানতে পারছে কেউ দার্জিলিং কেউ দিল্লি নিদেনপক্ষে দেওঘর বেড়াতে যাচ্ছে। যেহেতু নীললোহিতের পকেটে পয়সা নেই, কোথাও যাওযার প্রশ্ন ওঠে না। তাই তার সিদ্ধান্ত সবাই যদি কলকাতা ছেড়ে পুজোর সময় চলে যায় তা হলে সন্ধের সময় গড়িয়াহাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে কলকাতার সুন্দরীদের দেখবে কে? আমরা তখন ওই বয়সের না-তরুণ না-যুবক। ফলে মনে মনে নীলু হয়ে যেতে দেরি হল না। লক্ষ করছিলাম প্ৰতি ফিচারে একটি ছোটগল্পের স্বাদ থাকছে। এ সময় টাকার জন্যে একই পত্রিকায় অন্য লেখা লিখতে সুনীলদাকে আরও কয়েকটি ছদ্মনাম নিতে হয়েছিল। সনাতন পাঠক বা নীল উপাধ্যায়এর মধ্যে প্রথম জন পাঠকদের প্রিয় হয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি।
এই গদ্য রচনাগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য, প্রথম লাইন থেকেই লেখক পাঠকের ঘাড় ধরে পড়িয়ে নিয়ে যান শেষ লাইন পর্যন্ত। কোথাও জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা নেই, বলার ভঙ্গি এত সহজ এবং আন্তরিক আর সেই সঙ্গে একটা কৌতুহলকে ভেতরে ভেতরে ছড়িয়ে দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত না পড়ে ছাড়া যায় না।
হাতেখড়ি তো হয়ে গেল। সুনীলদা ততদিনে একটি উপন্যাস লিখেছেন কোথাও প্রকাশ করতে সাহস পাননি। নিজেরই মনে হয়েছে, ঠিক হয়নি। তা ছাড়া একজন নবীন লেখকের উপন্যাস চট করে কোন প্ৰকাশক ছাপতে চাইবেন? বাংলা সাহিত্যে তখন বিখ্যাত লেখকদের সন্নিবেশ। দেশের পুজো সংখ্যায় একটি মাত্র উপন্যাস ছাপা হয়ে আসছিল। তা কখনও তারাশঙ্করের, কখনও নারায়ণ গাঙ্গুলির এবং তরুণ লেখক সমরেশ বসুর। সাগরদা ঠিক করলেন উপন্যাসের সংখ্যা বাড়াবেন। প্রতি বছর একজন নবীন লেখককে সুযোগ দেবেন আত্মপ্রকাশের। তখন ছোটগল্প লিখে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বরেণ গঙ্গোপাধ্যায়। পরপর তিন বছর, সেটা পয়ষট্টি সাল, এই তিনজন দেশের পুজো সংখ্যায় উপন্যাস লিখলেন। প্রথমে সুনীলদা, বের হল আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাসেই সেঞ্চুরি বললে কম বলা হবে। পাঠকদের পড়িয়ে নেওয়ার ক্ষমতার সঙ্গে এই উপন্যাসে এক অনাবিল সারল্য আবিষ্কৃত হল যার টান এড়ানো মুশকিল। এক সদ্য যুবকের অন্যরকম জীবন এবং হতাশার মধ্যে বাস করেও যে মোটেই হতাশ নয়। তার কথা অত্যন্ত আন্তরিক বলে মনে হল বাঙালি পাঠকের। এরপরে সুনীলদাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
এই পর্যন্ত যা লিখলাম তা লিখতে কোনও বাধা আসার কথা নয়। তবে এ দেশের নিয়ম হল কোনও জীবিত মানুষের জীবন নিয়ে লেখালেখি নাকরা। কেউ লিখলে তার হাজার মানে টেনে বের করে অকারণে পরিবশে নষ্ট করার লোকের অভাব নেই। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে লেখার একটা সুবিধে আছে। ব্যক্তিগত জীবনে এই মানুষটাকে আমি কখনও রাগতে দেখিনি। অত্যন্ত বিরূপ মন্তব্যও চুপচাপ শুনে বলেছেন, ছেড়ে দাও। তারপর অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছেন। অতএব চারদিকে চাউর হয়ে গেল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মোটেই রাগক্ষোভ পুষে রাখেন না। যদি ব্যাপারটি সত্যি হয় তা হলে বলব। এই স্তরে অনেক সাধুসন্ন্যাসীও বিস্তর সাধনার পরে পৌঁছতে পারেন না। সুনীলদাই লিখেছিলেন সংসারে একজন সন্ন্যাসীর কথা। চট করে তাই মনে পড়ে। ব্যতিক্রম তো থাকবেই। অবশ্যই কেউ কেউ বলেন, এটা একটা ভণিতা হতে পারে। উনি মুখে কিছু বলেন না।
কিন্তু গত ত্রিশ বছরে আমি তার মধ্যে দুটো মানুষের অস্তিত্ব লক্ষ করেছি। একটি আমাদের উত্তর কলকাতার রকে বসা স্বাভাবিক গলা, এক ভাঁড় চা হোক জাতীয় কথা যে বলতে পারে। অন্যটি ধীরে ধীরে একটার পর একটা স্তর পেরিয়ে ওপরে উঠতে থাকা মানুষ। ইংরেজিতে যাকে সোস্যাল ক্লাইম্বার বলা হয় তা তিনি নন। কিন্তু গিনসবার্গের তত্ত্ব মেনে নিয়ে সংস্কৃতি এবং বিত্তের সমন্বিত জগতের শীর্ষে উঠতে চাওয়া একজন, যে-ভূমিকায় তাঁর আগে কোনও বাঙালি লেখক পৌঁছতে পারেননি। অথচ সুনীলদা এখনও লেখেন তাদের কথা যারা স্বপ্ন দেখে।
বাংলা ভাষায় লেখালেখি করেও সুনীলদা সম্ভবত পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ দেশে আমন্ত্রিত হয়েছেন বারংবার। তাঁর সমসাময়িক অথবা পূর্ববতী লেখকদের কেউ এই সৌভাগ্য অর্জন করেননি। বিদেশের বাঙালিরা তাদের অনুষ্ঠানে বাঙালি লেখকদের আমন্ত্রণ করতে পারেন। কিন্তু সুনীলদার যোগাযোগ শুধুই বাংলা ভাষাভাষীদের সঙ্গে নয়। এই যে বারংবার বিদেশে যাওয়া, এ দেশের এপ্রিান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়ানো, এসব সত্ত্বেও যে মানুষটি দুহাতে লিখে চলেন তার সম্পর্কে শ্রদ্ধান্বিত না হয়ে পারা যায় না। লেখার ব্যাপারে তিনি ডিসিপ্লিন মেনে চলেন নিষ্ঠার সঙ্গে। যে কোনও সম্পাদকই জানেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঠিক সময়ে লেখা দেবেন তা তিনি চিনেই থাকুন অথবা ইস্তাম্বুলে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে থেকেই ওঁর সঙ্গে ওখানকার কবি বুদ্ধিজীবীদের ভাল যোগাযোগ ছিল। স্বাধীনতার পর হুমায়ূন আহমেদের উত্থানের আগে পর্যন্ত শরৎচন্দ্র এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। দু’দেশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন তাকে ঘিরে শুরু হয়েছিল বললে অতিকথন হবে না।
প্রকাশনা যে একটা ব্যবসা এবং বই বিক্রি থেকে লেখকের রোজগার হয় এ কথা বোধহয় সুনীলদা মাঝেমাঝেই খেয়ালে রাখেন না। তার ঠিকঠাক বইয়ের সংখ্যা কত, কারা কারা তাদের প্রকাশক এটা তিনি নিজেই জানেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। সেদিন এক নবীন প্ৰকাশক এল। বই ছাপতে চায়। বলল, সুনীলদার কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে দুটো উপন্যাস ছাপতে দিয়েছেন। আমার পাশে একজন বই পড়ুয়া বসেছিলেন। তিনি বললেন ওই উপন্যাস দুটি গত বইমেলায় তিনি কিনেছেন। অর্থাৎ সদ্য গজিয়ে ওঠা কোনও প্রকাশক ওর অনুমতি নিয়ে বই ছেপে আর যোগাযোগ করেননি এবং তিনি ঘটনাটা মনে রাখার প্রয়োজন মনে করেননি। বছর কয়েক আগে বাংলাদেশের একজন প্রকাশক আমার কাছে এলেন একটা কাগজ নিয়ে যাতে লেখা আছে নিম্নলিখিত বইগুলি অমুককে ছাপতে দিলাম। তলায় দুটি উপন্যাসের নাম লেখা। ধীরে ধীরে ওই প্ৰকাশক সেই কাগজে যতটা জায়গা ফাঁকা ছিল ততটা জায়গায় একের পর এক উপন্যাসের নাম লিখে গেছেন। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং অমুক সম্পাদিত কোনও সংকলনগ্রন্থ বের হচ্ছে। ওই অমুকই সব করছেন। সুনীলদা কোনও খবরই রাখেন না। আমার একটি গল্প ওইরকম সংকলনে বিনা অনুমতিতে ছাপা হয়। জানতে পারার পর প্রশ্ন করতে সঙ্কোচ হয়েছিল, কারণ সুনীলদার নাম ছিল প্রথম সম্পাদক হিসেবে। এই অব্যবসায়িক ব্যাপারটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল যখন সুনীলদাদের বেশ কিছু বই বিশ্ববাণী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
হ্যাঁ, এটা ঠিক এ ব্যাপারে সতর্ক হলে সুনীলদার রোজগার অনেক বেড়ে যেত। কয়েকটি বড় প্রকাশনের প্রফেশনাল অ্যাটিচুড, কাগজের টাকা, সিনেমাসিরিয়ালের কারণে পাওয়া অর্থ যোগ করলে কলকাতার কয়েকজন লেখকের লেখা ছাড়া অন্য কোনও কাজ করার প্রয়োজন পড়ে না। আর এদের পুরোধায় যখন সুনীলদা রয়েছেন তখন ওকে কেন চাকরি করতে হবে? চোদ্দো বছর আগে যখন আমি চাকরি ছেড়েছিলাম তখনই সুনীলদাকে প্রশ্নটা করেছিলাম। বলেছিলাম, চাকরি না করলে যে সময়টা পাবেন তাতে আরও মন দিয়ে লিখতে পারবেন। সুনীলদা একমত হয়েছিলেন। তারপর বলেছিলেন, আমাকে তো তেমন কিছু এখানে করতে হয় না, চলে যাচ্ছে যখন, এভাবেই চলুক।
এই যে কাজুয়াল অ্যাপ্রোচ এটাও তার চরিত্রের একটি দিক।
সুনীলদার ছোটগল্প খুব বেশি নেই। যেগুলো আছে তাদের বৈশিষ্ট্য আলাদা। গরম ভাত ও ভূতের গল্প এর কথা এই মুহূৰ্ত্তে মনে পড়ছে। ওই গল্পে অন্নের জন্যে যে-হাহাকার তা ছাপিয়ে আর এক অতীন্দ্ৰিয় কষ্ট আমাদের আক্রান্ত করেছে। কিন্তু উপন্যাসের ক্ষেত্রে যখনই সুনীলদা সিরিয়াস হয়েছেন তখনই অতীত তাকে উৎসাহিত করেছে। আমিই সে নামে একটি উপন্যাস সেই কোন আদিমকালের মানুষের মধ্যে আজকের আমাকে দেখতে পেয়েছিলাম। আত্মপ্রকাশ, অরণ্যের দিনরাত্রি, প্রতিদ্বন্ধী, সাদা বাড়ি কালো রাস্তা সুনীলদাকে বিখ্যাত করেছে কিন্তু স্থায়িত্ব দেবে না। সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, প্রথম আলো তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে অনেককাল। প্রশ্নটা এখানেই।
সেই সময় এবং প্রথম আলোয় চলে যাওয়া সময়টাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন সুনীলদা। গত দুই শতাব্দীর বিখ্যাত মানুষদের সম্পর্কে আমরা অভ্যেসে যে শ্রদ্ধাজনিত ধারণা তৈরি করে লালন করে এসেছি, অথবা এখন বলা যেতে পারে, আমাদের মনে পন্ডিতরা যা ঢুকিয়ে দিযেছিলেন, সুনীলদা তথ্যপ্রমাণ দিয়ে উপন্যাসে তাদের রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে উপস্থিত করেছেন। হইচই হয়েছে। কিন্তু সেটা ধোপে টেকেনি।
কিন্তু বারংবার কেন সুনীলদাকে ইতিহাসের দরজায় ধাক্কা মারতে হচ্ছে। যা ছিল গবেষকের কাজ তা ভাষা এবং বলার ভঙ্গিতে স্বকীয়তা থাকায় সুনীলদা অনবদ্য করেছেন। পূর্ব পশ্চিম-এর অনেকটাই তো চলে যাওয়া সময়ের কাহিনী। বাংলাদেশের কুড়ি বাইশ বছরের অনেক ছেলেমেয়ের কাছে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ বহু দূরের ঘটনা। অতএব প্রশ্ন ওঠেই, এই সময় নিয়ে সুনীলদা কেন ক্লাসিক উপন্যাস লিখছেন না? বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে ক্ষমতাবান লেখক কোন বর্তমানকে এড়িয়ে যাচ্ছেন? পথের পাঁচালী-অপরাজিত, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা-গণদেবতা, পুতুল নাচের ইতিকথা-পদ্মানদীর মাঝির মতো তার কোন উপন্যাসকে পরবর্তী প্ৰজন্ম মনে রাখবে?
এই প্রশ্নের উত্তরে সুনীলদা কী বলতে পারেন আমি জানি। সুনীলদার সম্ভাব্য উত্তর হবে খুবই কাজুয়াল, যা মনে এসেছে লিখেছি, যা লিখতে ভাল লাগছে তা লিখে যাচ্ছি, কালের কাছে পরীক্ষা দিতে হবে বলে তো লেখালেখি করি না। একশো বছর পরে কেউ পড়লে ভাল, না পড়লে আমার কি এসে যায়? আমি তো সেটা দেখার জন্যে পৃথিবীতে থাকব না।
হ্যাঁ, সুনীলদা এ ধরনের কখা বলতেই পারেন। কিন্তু কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ধীরে ধীরে অতিক্রম করে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছেন। তিনি যখন নীরা বিষয়ক কবিতাগুলো লিখছিলেন তখন যে বাঙালি পাঠক তাকে ঘিরে হইচই করেছে তারা এখন শুধুই প্রশ্ন করে, নীরা কে? কেউ সত্যি ছিল কি না। এইটুকু।
একসময় এবং এখনও, এই ব্যাপারে সুনীলদাকে আমি ঈর্ষা করতাম। শুধু কবিতা লেখার জন্যে কলকাতার তামাম সুন্দরীরা সুনীলদাকে ঘিরে থাকত। সুন্দরীদের বোধহয় সময় কম, কষ্ট করে গদ্য পড়তে চাইতেন না। তখন মনে হত, হায়, যদি কবিতা লিখতে পারতাম! এখন ওই একই ব্যাপার জয় গোস্বামীকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে।
কিন্তু নারীর প্রতি সুনীলদার আকর্ষণ এখনও তীব্ৰ। এই তীব্রতা স্বাস্থ্যের লক্ষণ। যতদিন এটা থাকবে ততদিন তিনি সৃষ্টিশীল থাকবেন।
তবে ইদানীং, নারী ছাড়া সুনীলদাকে অন্য ক্রিয়াকর্মে ব্যস্ত হতে দেখছি। সভাসমিতি তো ছিল, নানান আন্দোলনে তাকে নেতৃত্ব দিতে দেখছি। শাসকদলের সঙ্গে তার মেলামেশা অনেককে অস্বস্তিতে ফেলছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কি শেষ পর্যন্ত আচার্য অথবা গুরুদেবের ভূমিকায় নিজেকে দেখতে চান? বাংলা ভাষা নিয়ে তিনি যদি কোনও আন্দোলন করেন তা হলে যে কোনও বাঙালির উচিত। তার পাশে দাঁড়ানো।
তাই মাঝে মাঝেই মনে হয়, একটা কিছু করতে হয় বলেই করে যাওয়া। এই বয়সে এসে হঠাৎ নাটক করার মতো। তার আসল লেখাটা তিনি এই অর্ধেক জীবনে লেখেননি। ওই জীবন থেকে নির্লিপ্তের মতো যা সঞ্চয় করেছেন তাই দিয়ে বাকি জীবনে লিখবেন তাঁর সময়ের উপন্যাস।
কার্জন পার্কে বিমলদার আড্ডায় অনেকেই আসতেন। আমরা যারা নিয়মিত হাজিরা দিতাম তারা উটকোদের সন্দেহের চোখে দেখতাম। নতুন কারও গল্প দেশ পত্রিকায় বের হলে তিনি মনে করতেন। ওই আড্ডায় ঢোকার ছাড়পত্র পাওয়া গিয়েছে। শিশিরদা চেষ্টা করেও কাউকে কাউকে তাড়াতে পারেননি। লিকলিকে রোগা, একটি পায়ের অবস্থান ঠিকঠাক নেই, চশমার আড়ালে চোখ দুটো বেশ বুদ্ধিদীপ্ত একজনকে নিয়ে কে যে আমাদের আড্ডায় এসেছিলেন আজ মনে নেই। শুনলাম ইনি এক মন্ত্রীমশাইয়ের ভাষণ লেখার চাকরি করেন। বিশাল বিশাল তাত্ত্বিক ভাষণ থেকে চুটকি ভাষণ সবই এর কলম থেকে বের হয়।
এ কথা ভাবার কোনও কারণই নেই। সেদিন সঞ্জীব নেহাতই মফস্বলী লেখকের মতো আচরণ করেছিল। তার আগে সে দীর্ঘকাল সরকারি চাকরি করেছে, স্কুলে পড়িয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল একসময়। দেওঘরেই পড়িয়েছে। অতএব জীবন দেখেছে। কিন্তু ব্যবহার এবং কথাবার্তায় বিনয় শব্দটা যেন ঝরে ঝরে পড়ত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিল্প দপ্তরের সঙ্গে জড়িত বলে অনেক তথ্য ওর জানা ছিল। বিমলদার উৎসাহে দেশ-এ ওর লেখা ছাপা হতে লাগল, জীবিকার সন্ধানে পশ্চিমবঙ্গ, সঞ্জয় ছদ্মনামে। সেই লেখা অত্যন্ত তথ্যনির্ভর, বাঙালি বেকারকে সাহায্য করার জন্যেই লেখা। হাইওয়ে শিরোনামে একটি গল্প জমা দিয়েছিল দেশ পত্রিকায়। দীর্ঘ এক বছর ধরে যাতায়াতের পর বিমল কর ওকে বললেন, আমরা তো কারও প্রথম গল্প ছাপি না, তুই আর একটা দে। অর্থাৎ দেশ-এ প্রকাশিত ওর প্রথম ছোটগল্প, চকমকি।
তদ্দিনে সঞ্জীব আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছে। ওর বাচনভঙ্গিতে এমন একটা সপ্ৰতিভতা ছিল যে না শুনে পারা যেত না। এই সময় ও লিখল শ্বেতপাথরের টেবিল। এই একটি গল্প ওকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে দিল। আবু সয়ীদ আইয়ুব ও গৌরী আইয়ুব চিঠি লিখে লেখককে অভিনন্দন জানালেন, সেটা ছাপা হলদেশ-এর চিঠিপত্র কলমে। এবং এরপর সঞ্জীবকে দীর্ঘকাল ফিরে তাকাতে হয়নি।
একমাত্র রাজশেখর বসুই প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছবার পর লিখে বিখ্যাত হন। সাধারণত তিরিশের অনেক আগে থেকেই এ দেশের লেখকরা আত্মপ্ৰকাশ করেছেন। রাজশেখর বসু বাংলা সাহিত্যের হাস্যরসের ধারাকে নতুন চেহারা দিলেন। শিবরাম চক্রবর্তীর জগৎ ছিল মূলত বালক এবং কিশোরের। সঞ্জীব রাজশেখর বসুর পথ ধরে অনেকটা এগিয়ে গেল। ফলে ওর সমসাময়িক লেখকদের থেকে ও একটা আলাদা জায়গায় থাকতে পারল। আর এখানেই গোলমাল বাঁধল।
সঞ্জীব পেশাদারি মঞ্চে গল্প পড়েছিল সেই একাশিতে, রবীন্দ্রসদনে, তার পূর্বসূরী কজন বিখ্যাত লেখকদের সঙ্গে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যজীবন নিয়ে লেখা ওই গল্প সে যখন পড়ছে তখন দর্শকরা প্ৰাণ খুলে হাসতে লাগল। সে একটা লাইন পড়ছে আর দর্শকরা হাততালি দিচ্ছে। আগেই বলেছি ওর বাচনভঙ্গিতে শিক্ষিত কমেডিয়ানের উপস্থিতি টের পাওয়া যেত। সেই পঞ্চাশষাটের দশকের বিচিত্রানুষ্ঠানে জহির রায় বা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ঘোষণা করলে যে প্রবল হাততালি শোনা যেত সঞ্জীবের নাম পরবর্তীকালের অনুষ্ঠানে ঘোষিত হলে তারই পুনরাবৃত্তি হত। ওর এই জনপ্রিয়তা কাজে লাগাল কিছু ব্যবসায়ী। ঘন ঘন তাকে গল্প পড়তে দেখা গেল। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে তাকে প্ৰায় তারকা তৈরি করে দেওয়া হল। তারপর ব্যাপারটাকে আরও চমকপ্ৰদ করতে উদ্যোক্তারা তার সঙ্গে মহিলা শিল্পীকে যোগ করে দিলেন। এ সময় আমাদের কার্জন পার্কের আড্ডা ভেঙে গেছে। ওই পর্যায়ে সঞ্জীব কীরকম অর্থ উপার্জন করেছিল জানি না। কিন্তু লেখক সঞ্জীবকে কথক সঞ্জীব বোধহয় ছাপিয়ে যাচ্ছিল।
আকাশপাতাল বা কলকাতা আছে কলকাতাতেই ওর প্রথম দিকের ধারাবাহিক ফিচার। উপন্যাস নয়। দেশের ধারাবাহিক উপন্যাস লোটাকম্বল-এ সঞ্জীব নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। অথবা শাখাপ্রশাখা উপন্যাসে। কিন্তু ধীরে ধীরে বোঝা যাচ্ছিল ও সাহিত্য থেকে সরে যেতে চাইছে। অনর্থক ব্যঙ্গ, তির্যক মন্তব্য, হাস্যরসের অকারণ পরিবেশন ওর মনঃসংযোগ নষ্ট হওয়ার কারণ বলে কেউ কেউ মনে করেন।
ওর বই বিক্রি অনেকের কল্পনার বাইরে ছিল। কিন্তু প্রবল চাহিদার জোগান দিতে না-পেরে একই লেখা একাধিক বইতে ছাপার অনুমতি দিল বিভিন্ন প্ৰকাশককে। পাঠক বই কিনে ভাবতে লাগলেন তিনি প্ৰতারিত হয়েছেন।
এই ভাবে কুড়ি-বাইশ বছরের মধ্যে জনপ্রিয়তা দখল করে অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া ওঁর পক্ষেই সম্ভব। শুরুতে যখন ওর সঙ্গে আলাপ তখন ওর মহিলাপ্রীতির নমুনা আমরা মাঝে মাঝেই দেখতে পেতাম। ওঁর লেখায় মুগ্ধ সুন্দরীরা চলে আসত আনন্দবাজার অফিসে। বিমলদার আড্ডায় মাঝে মাঝে যেসব বয়স্ক মহিলা আসতেন তারা সঞ্জীবকেই বেশি পছন্দ করতেন। অচিন্ত্যকুমার বলতেন, আমি বাঁ হাতে কামকৃষ্ণ লিখি, ডান হাতে রামকৃষ্ণ। জীবনী সাহিত্য গুলো তো অসাধারণ কিন্তু যা তিনি বাঁ হাতের লেখা বলেছেন তা আমাকে বেশী আধুত করেছে। স্ত্রী বিয়োগের আগে থেকেই সঞ্জীবের মধ্যে যে অস্থিরতা চলছিল, এই ধরণের লেখালেখি সম্পর্কে ক্রমশ সে যে অনাগ্ৰহী হয়ে উঠছিল তা আমরা বুঝতে পারছিলাম। ওর চাকরির পরিবেশও সম্ভবত ওকে প্রীত করছিল না। সঞ্জীব রামকৃষ্ণদেবকে শেষ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিল। তার সম্পর্কে অনেকবার বলা কথা সে নতুন করে বলতে শুরু করল। সে এখন যা লেখালেখি করে তার বেশির ভাগটাই রামকৃষ্ণদেব এবং সারদামনিকে নিয়ে। আজ সকালে টেলিফোনে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম। তার জবাব, এতকাল মাছ বিক্রি করতাম এখন ফুল বিক্রি করি।
মাছ যারা কেনে তারা কি ফুল কেনে না? নাকি যারা ফুল কেনে তারা কখনই মাছের দোকানো যায় না? এ প্রশ্ন করে কোনও লাভ নেই, যে যার মতো জীবনযাপন করবে। সেটাই স্বাভাবিক। শুধু বাংলা সাহিত্যের হাস্যরসের রুগ্ন ধারাটি উপেক্ষিত হয়ে থাকবে, এটাই শেষ কথা।