ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে বলে আবার একটা মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। মেকুকে বিছানায় শুইয়ে রেখে আবার মতি, বদি আর জরিনা গোল হয়ে বসেছে। চব্বিশ ঘণ্টা আগে তারা যখন এভাবে বসেছিল তখন তাদের মাঝে উৎসাহ ছিল। এখন তাদের মাঝে উৎসাহের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট নেই।
বদি চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে পারছিল না, খানিকটা বাঁকা হয়ে বসে বলল, “আমি এখনো বলছি এই হতচ্ছাড়া পাজি বাচ্চাটাকে জানালা দিয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাড়ি যাই।” তার মুখের সামনের একটা দাঁত পরে যাওয়ায় কথাগুলি বলার সময় মুখ থেকে বাতাস বের হয়ে কথাটা কেমন যেন বিচিত্র শুনায়।
জরিনা বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বললে? বাড়ি যাবে? তোমার বাড়িতে গিয়ে দেখ এখন পুলিশ বসে আছে!”
বদি হতাশভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “ঠিকই বলেছ।” তারপর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, “এই কিডন্যাপ করতে গিয়ে আমাদের কী লাভ হয়েছে?”
মতি তার বুজে যাওয়া চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, “এখনো হয় নাই। কিন্তু -”
জরিনা বলল, “আমার হিসাবে মাইনাস তিন লাখ টাকা।”
“মাইনাস?”
“হ্যাঁ। কারণ এখন পর্যন্ত শুধু ক্ষতি। বাড়ি গেছে, গাড়ি গেছে এখন তোমাদের দুই জনের চিকিৎসা করতে গিয়ে কত যাবে কে জানে!”
বদি তার একটা পা সোজা করার চেষ্টা করতে করতে বলল, “ঠিকই বলেছ।”
জরিনা মতির দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন কী করবে বল?”
“প্রথমে এই বাচ্চার বাসার টেলিফোন নম্বর দরকার।”
“হ্যাঁ। কিন্তু কীভাবে পাবে সেটা? তোমাদের যে অবস্থা এখান থেকে তো বেরই হতে পারবে না।”
মতি পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করে বলল, “বের হতে হবে নয়া। এখান থেকেই বের করতে পারব। তিন চারটা টেলিফোন করলেই বের হয়ে যাবে।”
গত কয়েক ঘণ্টায় অবস্থা যেদিকে গিয়েছে মতির কাজকর্মে কারো সেরকম বিশ্বাস নেই কিন্তু দেখা গেল মতি সত্যি সত্যি মেকুর আব্বা আম্মার টেলিফোন নম্বর বের করে নিল। টেলিফোন নম্বরটা একটা কাগজে লিখে মতি যখন সেই নম্বরে ডায়াল করতে যাচ্ছিল তখন বদি বলল, “মতি তুমি করো নয়া। তুমি হচ্ছ কুফা।”
মতি খুব রেগে গেল, বলল, “কুফা? আমি কুফা? তুমি যান আমি এই পর্যন্ত কয়টা কিডন্যাপ কেস করেছি?”
“করে থাকলে করেছ। কিন্তু এই কেসটা তো দেখছ কী হচ্ছে।”
“সেটা কী আমার দোষ?”
“কার দোষ আমি জানি নয়া, কিন্তু তুমি টেলিফোন করতে পারবে নয়া। কারণ তুমি হচ্ছ কুফা। হয় আমি টেলিফোন করব নয়া হয় জরিনা।”
জরিনা বলল, “ঠিক আছে আমিই করছি।”
মতি অত্যন্ত বিরস বদনে টেলিফোনটা জরিনার কাছে এগিয়ে দিল। জরিনা ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করতে গিয়ে থেমে গেল, মতি এবং বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “ইলিয়াস আলীর বাচ্চাটা ছেলে ছিল। এইটা কী ছেলে ননা মেয়ে?”
তিন জনেই মেকুর দিকে তাকাল, সত্যি সত্যি কারো এটা জানা নেই। ছোট বাচ্চার চেহারা দেখে সে ছেলে না মেয়ে বোঝার কোনো উপায় নেই, সেটা নিঃসন্দেহ হতে হলে ন্যাপি খুলে দেখতে হবে। বদি বলল, “দাঁড়াও দেখছি।”
বদি তার মচকে যাওয়া পায়ে ভর দিয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে মেকুর কাছে এগিয়ে যায়, তার ন্যাপি ধরে টানাটানি করতে থাকে। মেকু এত বড় অপমান এত সহজে মেনে নিতে রাজি হল না, সে দুই পা একত্র করে অপেক্ষা করতে থাকে। বদির মুখটা নাগালের মাঝে আসতেই জোড়া পায়ে সমস্ত গায়ের জোরে সেখানে প্রচণ্ড একটা লাথি কষিয়ে দিল। বদির মুখে এমনিতেই ব্যথা, দাঁত ভেঙে সেখানে ফুলে উঠেছে, তার উপর মেকুর জোড়া পায়ে লাথি খেয়ে সে যন্ত্রণায় কোঁক করে শব্দ করে পিছনে গড়িয়ে পড়ল। মুখে এবং মচকে যাওয়া পায়ে চেপে ধরে সে চিৎকার করে ওঠে। মতি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, “এই টুকুন বাচ্চার লাথি খেয়ে গড়িয়ে পড়লে এই লাইনে এসেছ কেন? তোমার হওয়া উচিত ছিল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।”
বদি মুখে হাত চেপে রেখে হিংস্র গলায় বলল, “এই বাচ্চা সাক্ষাৎ ইবলিশ! আমি একে খুন করে ফেলব।”
মতি ধমক দিয়ে বলল, “বাজে কথা বল না। দুই মাসের বাচ্চা বুঝে শুনে কিছু করে না। ওরা তো হাত পা ছুঁড়বেই তুমি দূরে থাকতে পার না। মুখ নিয়ে এত কাছে যাবার দরকার কী?”
মতি এবারে নিজেই এগিয়ে গেল। নিজের মাথাটা মেকুর শরীর থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে রেখে সে সাবধানে তার ন্যাপি খুলে ফেলল। মেকু গত কয়েক ঘণ্টা থেকে বাথরুম করার সুযোগ পায় নি তলপেটে প্রচণ্ড চাপ নিয়ে বসে আছে। নিজের কাপড়েরও কিছু করে ফেলতে সাহস পাচ্ছে না, হয়তো ভিজে কাপড়েই সারা রাত শুয়ে থাকতে হবে। এইবার তলপেটের চাপ কমানোর সুযোগ পেয়ে আর দেরি করল না, মতির মুখের দিকে নিশানা করে কাজ সেরে ফেলল। মতি লাফিয়ে সসরে যাবার আগে সে ভিজে চুপসে গিয়েছে, এত যন্ত্রণার মাঝেও বদি খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, “এখন বিশ্বাস হয়েছে; এই ছেলে কত পাজি?”
জরিনাও হি হি করে হেসে বলল, “এই বাচ্চাও তা হলে ছেলে।”
মতি বিষ দৃষ্টিতে মেকুর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “হ্যাঁ, এই বাচ্চাও ছেলে। মহা বিচ্ছি ছেলে।”
জরিনা এইবারে টেলিফোনে ডায়াল করল, প্রায় সাথে সাথেই অন্য পাশে মেকুর আব্বার উদ্বিগ্ন গলার স্বর শোনা গেল, “হ্যালো।”
জরিনা বলল, “আমি কী প্রফেসর হাসান সাহেবের সাথে কথা বলতে পারি ?”
“জি। কথা বলছি।”
“চমৎকার হাসান সাহেব। আমি আপনার ছেলের বিষয় নিয়ে কথা বলতে ফোন করেছি।”
টেলিফোনের অন্যপাশে হঠাৎ করে আব্বা চুপ করে গেলেন, কয়েক মুহূর্ত পরে ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “আপনি কে বলছেন?”
“সেটা জেনে আপনি কী করবেন।” আপনার ছেলে নিয়ে কথা বলতে চাইছি সেটা নিয়েই বলা যাক।”
“কোথায় আমার ছেলে? কোথায়?”
“আছে আমাদের কাছে।”
আব্বা কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, তার আগেই আম্মা আব্বার হাত থেকে টেলিফোন কেরে নিয়ে চিৎকার করে বললেন, “কে? কে আমার মেকুকে নিয়ে গেছে? কে?”
জরিনা শুকনো গলায় বলল, “আপনি কে?”
“আমি মেকুর মা। তুমি কে?”
জরিনা আমতা আমতা করে বলল, “ইয়ে, আমি মানে ইয়ে -”
“তোমার কত বড় সাহস যে আমার বাসা থেকে তুমি মেকুকে চুরি করে নিয়ে যাও?” আম্মা হুংকার দিয়ে বললেন, “তোমার মাথার চুল আমি ছিঁড়ে ফেলব। ঘুষি মেরে তোমার সব কয়টা দাঁত আমি ভেঙে ফেলব। লাথি মেরে আমি তোমার পাঁজরের হাড্ডি একটা একটা করে ভাঙব। কত বড় সাহস তোমার যে তোমরা আমার মেকুকে চুরি করে নিয়ে যাও?”
জরিনা এই ধমক খেয়ে একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কারো বাচ্চা কিডন্যাপ করে নেওয়ার পর সে যে এরকম খেপে যেতে পারে তার এরকম ধারণা ছিল না। সে কী বলবে বুঝতে পারল না। আম্মা ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন তোমরা আমার ছেলেকে চুরি করেছ? কেন?”
জরিনা মিন মিন করে বলল, “ইয়ে মানে, মুক্তিপণ – মানে – ”
আম্মা চিৎকার করে বললেন, “কত বড় ছোটলোক তুমি মুক্তিপণের জন্যে বাচ্চা চুরি কর? লজ্জা করে না বেহায়া বেশরম ধড়িবাজ? তোমার মা বাবা নাই? তোমার বাচ্চা কাচ্চা নাই? কুকুর বিড়াল পর্যন্ত অন্যের বাচ্চা টানাটানি করে না, আর তুমি মানুষ হয়ে আমার বাচ্চা চুরি করেছ? তুমি কুকুর বিড়ালের অধম – ”
জরিনার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হল না। সে ফ্যাকাসে মুখে টেলিফোনটা মতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও। তুমি কথা বল।”
“কেন?”
“বড় গালাগাল করছেন।”
মতি অবাক হল, তার সুদীর্ঘ কিডন্যাপ জীবনে অভিজ্ঞতায় দেখেছে এরকম অবস্থায় সাধারণত কেউ গালাগালা করে না। সে টেলিফোনটা নিয়ে মধুর, গলায় বলল, “হ্যালো।”
আম্মা এবারে আরো রেগে গেলেন, চিৎকার করে বললেন, “তুমি আবার কোথা থেকে হাজির হয়েছ? তুমি কে?”
“সেটা নিয়ে কথা বলার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আগে আমরা যে জন্যে ফোন করেছি সেটা নিয়ে কথা বলি।”
“আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আমার মেকুকে ফিরিয়ে দাও।”
“কী বললেন? মেকু?”
আম্মা বললেন, “হ্যাঁ। মেকু। আমার ছেলের নাম মেকু।”
“মেকু আবার কী রকম নাম?”
“সেইটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। এই মুহূর্তে আমার ছেলেকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।”
মতি আরো মধুর গলায় বলল, “সেই জন্যেই তো আপনার কাছে ফোন করেছি। আপনার মেকুকে কীভাবে আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব সেটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে না? সবাই যেন খুশি থাকে সেটা একটু দেখবেন না?”
“সবাই যেন খুশি থাকে?”
“হ্যাঁ। আপনার মেকুর যদি কিছু একটা হয়ে যায় তা হলে সেটা কী আপনার ভালো লাগবে?”
আম্মা একেবারে বোমার মতো ফেটে পড়লেন। “কী বললে? তোমরা বদমাইশের দল, চামচিকার দল, খাটাসের দল, তোমরা কী আমার মেকুর গায়ে হাত দিয়েছ?”
মতি মিন মিন করে বলল, “এখনো দেই নাই।”
“খেতে দিয়েছ? বাথরুম করিয়েছ? শুকনো কাপড় পরিয়েছ?”
“না, মানে – ।”
“ঘুমাতে দিয়েছ?”
“ইয়ে – ”
আম্মা মেঘস্বরে বললেন, “আমি বলেছি টেলিফোনটা আমার মেকুকে দাও।”
মতি অবাক হয়ে বলল, “আপনার মেকুর বয়স মাত্র দুই তিন মাস – ”
আম্মা শুদ্ধ করে দিয়ে বললেন, “দুই মাস এগারো দিন।”
“ওই হল। দুই মাস এগারো দিন। দুই মাস এগারো দিনের বাচ্চা কী টেলিফোনে কথা বলতে পারে?”
“তুমি মেকুর কানে টেলিফোনটা লাগাও। আমি তার সাথে কথা বলল।”
“আপনার মেকু টেলিফোনে কথা শুনে কি কিছু বুঝবে?”
“সেইটা নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। চুরি-চামারি করতে নেমেছ, চুরি চামারি নিয়েই থাক। মা কীভাবে বাচ্চার সাথে কথা বলে সেটা নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। টেলিফোনটা মেকুর কানে লাগাও। আমি দেখতে চাই আমার মেকু ভালো আছে কি না।”
মতি কী করবে বুঝতে পারল না। অনেকটা বোকার মতন সে টেলিফোনটা মেকুর কাছে নিয়ে তার কানে লাগাল। আম্মা টেলিফোনে চিৎকার করে ডাকলেন, “মেকু! মেকু – বাবা তুই ভালো আছিস?”
মেকুর ইচ্ছে হল চিৎকার করে বলে, “হ্যাঁ মা ভালো আছি। তুমি কোনো চিন্তা করো না, আমি এই বদমাইশগুলিকে এমন শিক্ষা বেদ যে এরা জন্মের মতো সিধে হয়ে যাবে।” কিন্তু সে এসব কিছুই বলতে পারল না, মায়ের গলার আওয়াজ শুনে দুই মাসের বাচ্চার আনন্দে যেরকম শব্দ করার কথা সেরকম একটা শব্দ করল।
“মেকু বাবা তোকে ব্যথা দিচ্ছে না তো? কোনো যন্ত্রণা দিচ্ছে না তো?”
মেকু “ভ্যারররররর” করে মুখ দিয়ে একটা শব্দ করে মাথা নাড়ল।
“তুই যেখানেই থাকিস না কেন আমি তোকে নিয়ে আসব।”
মেকু আবার মুখ দিয়ে তার শব্দটা করে সম্মতি জানাল। মতি তখন টেলিফোনটা সরিরে নিজের কানে লাগিয়ে বলল, “ছেলের কথা শুনলেন?”
আম্মা বললেন, “হ্যাঁ শুনেছি।”
“চমৎকার। এবার তা হলে বিজনেস সেরে দেখা যাক।”
“বিজনেস?” আম্মা চিৎকার করে বললেন, “আমার ছেলে কি সিমেন্টের বস্তা নাকি গাড়ির পার্টস যে তাকে নিয়ে বিজনেস করবে?”
মতি গলায় স্বরে মধু ঢেলে বলল, “আমার মন হয় আপনি ব্যাপারটার গুরুত্ব ধরতে পারছেন না। হাজার হলেও আপনি তো মা ব্যাপারটা খুব ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে নিচ্ছেন। এটাকে ব্যক্তিগতভাবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। আপনার সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আপনার ছেলের সাথেও নেই -”
আম্মা ধমক দিয়ে বললেন, “খবরদার তুমি আমার ছেলের কথা মুখে নেবে না। তোমার দুর্গন্ধ ভরা মুখ তোমার নোংরা মুখ – ”
মতি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমি কী আপনার স্বামী প্রফেসর সাহেবের সাথে কথা বলতে পারি?”
“কেন? হাসানের সাথে কেন কথা বলতে হবে?”
“কারণ ব্যাপারটা জরুরি। আমরা আপনাদের মেকুকে আপনাদের হাতে তুলে দিতে চাই। ব্যাপারটা যত সহজে করা যায় ততই ভালো। আমি সেটা নিয়ে আপনার স্বামী প্রফেসর হাসানের সাথে কথা বলতে চাই।”
“আমার সাথেই বল ব্যাটা ধড়িবাজ।”
“না, আপনার সাথে বলা যাবে না। চেষ্টা করেছি এতক্ষণ থেকে, আপনি শুধু গালাগাল করছেন।”
“তোমাদের গালাগাল করব না তো কি মাথায় তুলে নাচব? তোমাদের জুতিয়ে সিধে করা দেওয়া দরকার – ”
হঠাৎ করে আম্মার কথা বন্ধ হয়ে গেল, এবং আব্বার গলা শোনা গেল। মনে হল আব্বা এক রকম জোর করে আম্মার হাত থেকে টেলিফোনটা কেড়ে নিয়েছেন। আব্বা বললেন, “হ্যালো।”
“প্রফেসর হাসান সাহেব?”
“হ্যাঁ।”
“আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলা খুব কঠিন, খুব অল্পে রেগে যান। আপনার সাথে কথা বলতে আশা করছি কোনো সমস্যা হবে না।”
“কী বলতে চান বলে ফেলেন।”
“মুক্তিপণের টাকার পরিমাণটা আপনাকে জানাই।”
“কত?”
“দশ লক্ষ টাকা।”
আব্বা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “দেখেন, আমাদের ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্যে আমাদের যা আছে সব দিয়ে দেব। কিন্তু আমরা তো আসলে চাকরিজীবী আমাদের হাতে কোনো ক্যাশ টাকা নেই। আমি জীবনে একসাথে দশ লক্ষ টাকা দেখি নি। আমরা – ”
মতি বাধা দিয়ে বলল, “এই সব খুঁটিনাটি নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে চাই না। আপনারা নিজেদের মাঝে আলোচনা করেন। শুধু একটা ব্যাপার – ”
“কী ব্যাপার?”
“পুলিশকে কিছু জানাতে পারবেন না। পুলিশ আমাদের ধরে ফেলবে সেটা নিয়ে আমরা একবারও মাথা ঘামাচ্ছি না, কিন্তু তাদেরকে জানালে টাকার একটা ভাগ তো তাদেরকেও দিতে হবে কাজেই আপনাদের উপর চাপটা একটু বেশি পড়বে। এই হচ্ছে ব্যাপার।”
আব্বা কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু মতি বাধা দিয়ে বলল, “আমি এখন আর কিছুই বলতে চাই না। একটু পরে আবার ফোন করব। শুভ সন্ধ্যা প্রফেসর সাহেব।”
টেলিফোনটা বন্ধ করে মতি যুদ্ধ জয় করার ভঙ্গি করে বদি এবং জরিনার দিকে তাকাল, বলল, “দেখেছ? কেমন চমৎকার প্রফেশনাল ভাবে কাজ করলাম!”
বদি তার ফুলে যাওয়া মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “কী মনে হয় তোমার, দেবে টাকা?”
“নিশ্চয়ই দেবে। কিন্তু কত দিতে পারবে সেটা হচ্ছে কথা ইউনিভার্সিটির মাষ্টারদের বেতন আর কত? বেচারারা প্রাইভেট টিউশানিও করতে পারে না। কাজেই তাদের কাছে ক্যাশ টাকা কম।”
“যতই হোক, কিছু তো নিশ্চয়ই দেবে।”
“তা দেবে।”
টেবিলে রাখা মোমবাতিটা প্রায় শেষ হয়ে নিভু নিভু হয়ে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে জরিনা বিরক্ত হয়ে বলল, “কী যন্ত্রণা – ইলেক্ট্রিসিটি আসছে না, গরমে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।”
জরিনার কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ করে লাইট জ্বলে উঠল। আবছা অন্ধকারে সস্তা হোটেলটার দৈন্য দশা বোঝা যাচ্ছিল না, কর্কশ উজ্জ্বল আলোতে হঠাৎ করে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। মলিন বিছানা, নোংরা মশারি, রং ওঠা দেওয়াল এবং সেটাকে আরো প্রকট করার জন্যে ঘরের দেওয়ালে গোবদা একটা মাকড়শা তার পা ছড়িয়ে বসে আছে।
মেকুর খিদে পেয়েছে, কোনো রকম সঙ্কেত না দিলে এরা খেতে দেবে বলে মনে হয় না। সব সময়েই মায়ের দুধ খেয়ে এসেছে এখন কী খেতে দেবে কে জানে। কিন্তু কিছু একটা তো খেতে হবে। মেকু তখন খাবার জন্যে ঘ্যান ঘ্যান করে একটু কাঁদবে বলে ঠিক করল, তারপর সত্যি সত্যি কাঁদতে শুরু করল।
বদি মতি আর জরিনা তিন জনেই এক সাথে মেকুর দিকে তাকাল, মেকুর কান্নাকে তারা খুব ভয় পায়। বদি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হল? কাঁদে কেন?”
মতি বলল, “ছোট বাচ্চার কাজ তিনটা, খাওয়া ঘুম আর বাথরুম। এই মাত্র সে আমার মুখে বাথরুম সেরেচে। কাজেই বাথরুম করতে হবে না। ঘুমের দরকার হলে ঘুমাতে পারে, সে তো শুয়েই আছে। তা হলে বাকি থাকল খাওয়া।”
“কীভাবে খাওয়াবে?”
“ফিডার বোতল কিনে এনেছি, বাচ্চার পাওডার দুধ কিনে এনেছি। পানির সাথে দুধ মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। দুধের কৌটায় লেখা আছে।”
বদি জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “জরিনা, তুমি তা হলে এই বাচ্চাকে একটু খাওয়াবে। এর চিৎকার শুনলে আমার এত ভয় লাগে!”
জরিনা বলল, “কেন? আমি কেন খাওয়াব?”
“ছোট বাচ্চাদের তো মহিলারাই দেখে শুনে রাখে।”
জরিনা নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলেল বলল, “আমাকে কী তোমার সেরকম মহিলা মনে হচ্ছে? বাচ্চা কাচ্চাই যদি আমার জীবনের উদ্দেশ্য হতো তা হলে বিয়ে শাদী করে সংসার করতাম, এই লাইনে আসতাম না।”
মতি বলল, “তর্ক করে লাভ নেই। আছাড় খেয়ে বদি আর আমার দুজনেরই বারটা বেজে গেছে, আমরা খুব বেশি নাড়াচাড়া করতে পারছি না। জরিনা, এখন তোমাকেই কিছু কাজ কর্ম করতে হবে।”
জরিনা গজ গজ করতে করতে উঠে গেল। ফিডার বোতল বের করে তার মাঝে পানি ঢালল, দুধের কৌটা খুলে সেখান থেকে পাওডার দুধ বের করে মিশিয়ে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিয়ে বোতলটা মেকুর মুখে ধরিয়ে দিল। মেকু সাথে সাথে কান্না থামিয়ে ফিডার বোতল টানতে থাকে কিন্তু এক মুহূর্ত পর বোতল থেকে মুখ সরিয়ে বিকট স্বরে চিৎকার করতে শুরু করে।
বদি ভয় পেয়ে বলল, “কী হল? কাঁদছে কেন? এভাবে কাঁদলে তো লোক জমা হয়ে যাবে।”
জরিনা বলল, “বুঝতে পারছি না কেন কাঁদছে।”
মেকুর ইচ্ছে হল দশ কেজি একটা ধমক দিয়ে বলে, “বেকুবের দল, দুধ খেতে হলে নিপলে ফুটো করতে হয়।” কিন্তু সেটা বলতে পারল না, দুই মাসের বাচ্চার যেরকম ভঙ্গিতে কান্নাকাটি করা দরকার ঠিক সেই রকম ভঙ্গিতে চিৎকার করতে লাগল।
জরিনা কী করবে বুঝতে না পেরে ফিডার বোতলটা আবার মেকুর মুখে ঠেসে ধরল। মেকু এক দুইবার চুষে মুখে থেকে বের করে দিয়ে আবার তার স্বরে চিৎকার করতে থাকে।
জরিনার পাশাপাশি বদি এবং মতি এসে দাঁড়াল। মতি চিন্তিত মুখে বলল, “এ তো ঝামেলা হল দেখছি। কী করা যায়?”
বদি মাথা চুলকে বলল, “এর মা’কে ফোন করে জিজ্ঞেস করা যায় না?”
মতি বলল, “হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। তাই করা যাক।”
বদি জরিনার দিকে টেলিফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও টেলিফোন কর।”
জরিনা ভয়ে ভয়ে বলল, “আমি করব? যদি আবার গালাগাল শুরু করে দেয়?”
মতি বলল, “দিলে দেবে। তুমিও উলটো গালাগাল করবে। কিন্তু এই বাচ্চার কান্না থামানো না গেলে আমরা বিপদে পরে যাব।”
জরিনা বলল, “টেলিফোন নাম্বারটা জানি কত?”
মতি বলল, “টেলিফোন নাম্বার লাগবে না। মাঝখানের হলুদ বাটনটা চাপ দিলেই লাস্ট নাম্বার রিডায়েল হয়ে যাবে।”
জরিনা হলুদ বোতাম টিপে দিতেই ফোন ডায়াল হয়ে গেল এবং প্রায় সাথে সাথেই মেকুর আম্মার গলার স্বর শোনা গেল, “হ্যালো।”
জরিনা ভয়ে ভয়ে বলল, “আপনি মেকুর মা?”
“হ্যাঁ। আপনি কে?”
“আমি একটু আগে ফোন করেছিলাম, মনে নেই?”
“মনে নেই আবার? একশ বার মনে আছে। কী চাও এখন? আমার মেকুকে ফেরত দেবে কখন? তাকে খাইয়েছ? তার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি কেন, কী হয়েছে?”
“সেই জন্যেই ফোন করেছি। খাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে, খেতে চাচ্ছে না। কী করা যায় জানার জন্যে ফোন করেছি।”
“মেকু খেতে চাচ্ছে না?”
“না।”
“দুধ বেশি গরম হয় নাই তো?”
“না।”
“কতটুকু পানিতে কয় চামুচ দুধ দিয়েছ?”
“সেটা মাপ মতো দিয়েছি, কৌটায় যা লেখা আছে।”
“একেবারেই খেতে চাচ্ছে না? না কি একটু খেয়ে এর খেতে চাচ্ছে না?”
জরিনা বলল, “একেবারেই খেতে চাচ্ছে না।”
আম্মা কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন, “ফিডার বোতলের নিপলে ফুটো আছে তো?”
জরিনা বলল, “দাঁড়ান দেখি।” বোতলটা হাতে নিয়ে নিপলটি দেখল, সত্যি সত্যি নিপলে ফুটো নেই।
আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, “কী ? আছে?”
“না, নেই।”
আম্মা আবার মহা খাপ্পা হয়ে চিৎকার করতে লাগলেন, “তোমরা কী রকম কিডন্যাপ করো যে একটা বাচ্চাকে কীভাবে দুধ খাওয়াতে হয় সেটা পর্যন্ত জানো না? মাথার মাঝে কী ঘিলু নেই? সেখানে কী গোবর ভরা আছে? তোমরা কী ভাত খাও নাকি ঘাস খেয়ে থাকো – ”
রাগারাগি এবং গালাগালি আরো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাবার আগে জরিনা তাড়াতাড়ি টেলিফোনের কানেকশান কেটে দিল।
নিপলের মাঝে ফুটো করে ফিডারটি মেকুর মুখে ধরে দেবার পর সে এবারে চুক চুক করে চুষতে শুরু করল। ঘরের ভেতরে শেষ পর্যন্ত এবারে শান্তি ফিরে আসে।
মেকু দুধ খেতে খেতে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে। জরিনা টেলিফোনটা রেখেছে একেবারে তার হাতের কাছে। একটু চেষ্টা করলেই সে নাগাল পেয়ে যাবে, আর হলুদ বোতামটা চেপে ধরলেই তার আম্মার কাছে টেলিফোন চলে যাবে। ব্যাপারটা মন্দ নয়।
মেকু শান্ত হয়েছে আবিষ্কার করার পর মতি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, “ এবারে তা হলে আমরা ঠিক করে নিই এখন কী করব।”
“হ্যাঁ। বদিও মাথা নাড়ল, “মনে হচ্ছে কিডন্যাপ করাটা পুরোটা জলে যায় নাই। কিছু টাকা বের করা যাবে।”
জরিনা ঠোটে একটা সিগারেট চেপে ধরে ফস করে ম্যাচ জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ, এই অংশটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। ধরা পড়ার আশঙ্কা এই খানে সবচেয়ে বেশি।”
তখন তিন জন মিলে কথাবার্তা বলতে শুরু করে। মেকুকে কোথায় রেখে যাবে। যেহেতু গাড়িটা পুলিশ নিয়ে গেছে আবার নতুন একটা গাড়ি ভাড়া করতে হবে কার কাছ থেকে সেই গাড়ি নেওয়া যায়। মুক্তিপণটা ঠিক কোথায় হস্তান্তর হবে এই রকম খুঁটিনাটি।
আলোচনাটা শুরু হবার সাথে সাথে মেকু বুঝতে পারল এই কথাবার্তাগুলি তার আম্মা আব্বার শোনা দরকার। তার হাতের কাছাকাছি মোবাইল টেলিফোন, মেকু একটু গড়িয়ে সেই টেলিফোনটার কাছে পৌঁছে হলুদ বোতামটা চেপে ধরল। তার আর কিছুই করতে হবে না। আব্বা-আম্মা বাসায় বসে এখন এদের সব কথাবার্তা শুনতে পাবেন।
আসল ব্যাপারটা হল তার থেকে অনেক ভালো। কিডন্যাপ করে ফোন করেছে শুনে পুলিশ রেকর্ড করার যন্ত্র নিয়ে বসেছিল। ফোন বাজার সাথে সাথে তারা রেকর্ড করতে শুরু করল – আম্মা টেলিফোন তুলে বার কতক “হ্যালো হ্যালো” বললেন কিন্তু অন্য পাশে কেউ উত্তর দিল না। টেলিফোনটা রেখে দিতে গিয়ে আম্মা থেমে গেলেন হঠাৎ করে শুনতে পেলেন খুব আবছাভাবে কিছু মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে। কথা খুব স্পষ্ট নয় কিন্তু ভাসা ভাসা বোঝা যায়। একটু কান পেতে শুনে আম্মা চমকে উঠলেন – মানুষগুলি কথা বলছে মেকুকে নিয়ে, কিডন্যাপ করার পর মুক্তিপণটা কীভাবে আদায় করবে সেটাই হচ্ছে আলোচনার বিষয়। আম্মা একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন।
পুলিশ সাথে সাথে কাজ শুরু করে দিল, আলাপ আলোচনা থেকে জানতে পারল এখানে তিন জন মানুষ একজনের নাম বদি একজন মতি এবং আরেকজন জরিনা। ফাইল ঘেটে ঘণ্টাখানেকের মাঝেই তাদের ছবিও বের হয়ে গেল, তিনজনেই ঘাঘু আসামি আগেও কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। আগামী কাল মুক্তিপণ আদায় করার জন্যে কোথা থেকে তারা গাড়ি ভাড়া করে কোথায় কীভাবে যাবে সেটাও পুলিশ জেনে গেল।
আধা ঘণ্টা পরে মতি যখন আবার টেলিফোন করে মুক্তিপণ কীভাবে দিতে হবে সেটা নিয়ে মেকুর আব্বা আম্মার সাথে আলোচনা করছিল সে ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করে নি ততক্ষণে তাদের সব খুঁটিনাটি বের হয়ে গেছে। মুক্তিপণের টাকার পরিমাণ নিয়ে মেকুর আব্বা আম্মা যে ডর কষাকষি করলেন সেটাও যে পুলিশের শেখানো সেটাও সে বুঝতে পারল না। মেকুর আব্বা আম্মা যেটুকু টাকা দিতে রাজি হলেন সেটা যে তাদের মতো কারো মতো কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয় সেটা নিয়েও তাদের মনে কোনো সন্দেহ হল না। লোভ বড় ভয়ানক জিনিস, এর কারণে সব কাণ্ডজ্ঞান হঠাৎ করে লোপ পেয়ে যায়।