ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে বলে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলে রাখা হয়েছে। মোমবাতির আলোতে টেবিল ঘিরে বসে থাকা তিন জনকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে, আলো নিচ থেকে এলে সবসময়েই চেহারা একটু অন্য রকম দেখায়, চেনা মানুষকেও তখন অচেনা মনে হয়। আজ অবশ্য অন্য ব্যাপার, যে তিনজন এখানে একত্র হয়েছে তারা একে অন্যকে খুব ভালো করে চেনে, একজনের কাছে অন্যজনকে অচেনা মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। মাঝামাঝি বসে থাকা মানুষটির নাম মতি, সে টেবিলে ঝুঁকে পড়ে বলল, “আমরা তা হলে কাজ শুরু করি।”
মতির ডান দিকে বসেছে বদি, সে খুব বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে পরিচিত নয়। তবে মানুষটি খুব বিশ্বস্ত এবং বুদ্ধি বেশি নয় বলে বিপজ্জনক কাজগুলিতে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। বদি নাক দিয়ে একটা শব্দ করল, যেটাকে সম্মতি বলে ধরে নেওয়া যায়।
মতির বাম দিকে বসেছে জরিনা – যদিও মতির ধারণা এটা তার আসল নাম নয়। জরিনাকে দেখে তার বয়স বোঝা যায় না, এটা চব্বিশ থেকে চুয়াল্লিশের ভিতর যে কোনো একটা কিছু হতে পারে। মতিকে দেখে বলা যেতে পারে তার চেহারা ভালো, বদিকে দেখে সেরকম বলা যেতে পারে তার চেহারাটা বিশেষ সুবিধেয় নয় কিন্তু জরিনাকে দেখে বলার উপায় নেই চেহারাটা ভালো না খারাপ! মনে হয় এক সময় তার চেহারাটা ভালোই ছিল কিন্তু নানা অপকর্মের সাথে জড়িত থাকায় চেহারার মাঝে একটা খারাপ ছাপ পড়েছে সে কারণে চেহারাটা আর ভালো লাগে না। জরিনা টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিজের কাছে এনে একটা সিগারেট বের করে ঠোটে লাগিয়ে ফস করে একটা ম্যাচ জ্বালিয়ে সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, “শুরু কর।”
বদি বিরস মুখে জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “মেয়ে মানুষের সিগারেট খাওয়া ঠিক না।”
জরিনা ঠোটের ডগা থেকে সিগারেটটা না সরিয়েই বলল, “আর একবার মেয়েদের সম্পর্কে এরকম একটা কথা বললে এই সিগারেট দিয়ে এরকম একটা ছ্যাকা দিব – ।”
বদি বলল, “আমি খারাপ কী বলেছি? মেয়েরা সিগারেট খেলে দেখতে ভালো লাগে?”
জরিনা ভুরু কুঁচকে বলল, “তোমার ধারণা মেয়েদের একমাত্র কাজ দেখতে ভালো লাগা?”
মতি বিরক্ত হয়ে বলল, “আহ! কী শুরু করেছ তোমরা? কাজের মাঝে গোলমাল।”
বদি আবার নাক দিয়ে একটা শব্দ করল, জরিনা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “নাও শুরু কর।”
মতি কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, “মানুষটার নাম ইলিয়াস আলী, তার মশলার বিজনেস। থাকে নিউ ইয়র্ক। বড় মালদার পার্টি। দেশে দুই সপ্তাহের জন্যে আসে। এই দুই সপ্তাহ থাকার জন্যে মগবাজারে একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে। সারা বছর এই ফ্ল্যাট তালা দেওয়া থাকে, ইলিয়াস আলী যখন ঢাকা আসে তখন এখানে দুই সপ্তাহ থাকে।”
বদি জিজ্ঞেস করল, “মশলার বিজনেস করে মানুষ কীভাবে মালদার পার্টি হয় বুঝতে পারি না।”
মতি বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “সেইটা তুমি বুঝতে পারছ না কারণ তোমার মাথায় কোনো ঘিলু নাই। পৃথিবীতে যে দুইটা জিনিষ সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট তার একটা হচ্ছে খাওয়া। আর খাওয়ার জন্যে দরকার রান্না। রান্নার জন্যে দরকার মশলা। যে মশলার বিজনেস করে তার মার্কেট কোঁত বড় জান?”
মতি ইতস্তত করে বলল, অন্য ইম্পরট্যান্ট জিনিসটা কী?”
“বাথরুমে গিয়ে তুমি যে কাজটা কর সেইটা।”
“বাথরুমে গিয়ে আমি কী করি?”
মতি ধমক দিয়ে বলল, “সেটা আমার বলে দিতে হবে?”
জরিনা বলল, “এসব ছেড়ে কাজের কোথায় আস।”
“হ্যাঁ। যেটা বলছিলাম। এই ইলিয়াস আলী এক সপ্তাহ আগে ঢাকা এসেছে। এবারে তার সাথে আছে তার নূতন বউ এবং নূতন বাচ্চা। বিয়ে হয়েছে এক বছর। বাচ্চা হয়েছে এক মাস।”
জরিনা জিজ্ঞেস করল, “এটা কী তার দ্বিতীয় বউ?”
“না। এটা চতুর্থ। ইলিয়াস আলীর হবি এন্টিক গাড়ি সংগ্রহ করা আর বিয়ে করা।”
জরিনা নারী জাতির পক্ষ থেকে ইলিয়াস আলীকে এবং সমগ্র পুরুষ জাতিকে একটা গালি দিল। মতি সেটা না শোনায় ভালো করে বলল, আমরা ইলিয়াস আলীর এই বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করব। বেশি বয়সের বাচ্চা – আমার ধারণা এই বাচ্চার জন্যে এই লোক কম করে হলেও দশ লাখ টাকা দেবে। এই টাকার মাঝে ভাগ বসানোর কেউ নেই, পুলিশকে দিতে হবে না, লোকাল মাস্তানকে দিতে হবে না, ইনকাম ট্যাক্সও দিতে হবে না।” মতি হা হা করে হাসল – তার ধারণা ইনকাম ট্যাক্সের কথা বলাটা খুবই উঁচু ধরনের রসিকতা হয়েছে।
জরিনা বলল, “টাকা রোজগার করা যদি এত সোজা হত তা হলে সবাই করত।”
মতি বলল, “যদি তোমার বুদ্ধি আর সাহস থাকে, ভালোমন্দ নিয়ে যদি মাথা না ঘামাও আর যদি কপাল খুব বেশি খারাপ না হয় তা হলে টাকা রোজগার করা খুব সোজা।”
বদি আধা দার্শনিক ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাল না, সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এল, “বাচ্চাটারে কিডন্যাপ করবে কীভাবে?”
“আমি সব খোঁজ নিয়েছি। দুপুর দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত এই একঘণ্টা সময় বাচ্চাটাকে ফ্ল্যাটে একজন মহিলার কাছে রেখে ইলিয়াস আলী আর তার বউ বাইরে বের হয়। এই সময় আমরা যাব, মহিলাকে একটা দাবড়ানি নিয়ে বাচ্চাটাকে নিয়ে বের হয়ে আসব।”
বদি জানতে চাইল, “দাবড়ানি মানে কী? মেরে ফেলব?”
মতি জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, “বদি, পারতপক্ষে মানুষ মারবে না। মানুষ মারলেই এক শ ঝামেলা। রিভলভারটা মাথায় ধরে ভয় দেখিয়ে বাথরুমে আটকে রাখবে।”
“ও।”
“কাজ পানির মতো সহজ। জরিনাকে সাথে নিতে হবে, বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হেঁটে নেমে আসবে। মায়ের কোলে শিশুর মতো নির্দোষ দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু নাই। কেউ কিছু সন্দেহ করবে না।”
“নিয়ে আসার পর পালাবে কেমন করে?”
“আমি গাড়ি নিয়ে থাকব। বদি হবে বাচ্চার বাবা, জরিনা হবে বাচ্চার মা আর আমি হব গাড়ির ড্রাইভার।”
বদি ইতস্তত করে বলল, “তোমার চেহারা ছুরত ভালো, তুমি হও বাচ্চার বাবা, আমাই ড্রাইভার হিসেবে গাড়ি নিয়ে থাকি।”
“উঁহু।” মতি মাথা নাড়ল, “পালানোর গাড়িটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা ঠিকমতো করতে না পারলে পুরো পরিকল্পনাটা মাঠে মারা যাবে। সেই দায়িত্ব আর কাউকে দেওয়া যাবে না। আমাকে নিতে হবে।”
বদি গজগজ করে বলল, “আসলে আমাদের কোনো ঝামেলা হলে তুমি যেন পালাতে পার সেইজন্যে –”
মতি মৃদুস্বরে বলল, “বদি। পার্টনারকে যদি বিশ্বাস না কর তা হলে এই লাইনে আসবে না। এই লাইন হচ্ছে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং বিশ্বাসের লাইন। এই লাইন হচ্ছে –”
জরিনা খেঁকিয়ে ওঠে বলল, “এই সব ঢং বাদ দিয়ে ঠিক করে প্ল্যানটা করবে? ভিতরে যাব আমি আর বদি?”
“হ্যাঁ।”
“গাড়ি নিয়ে থাকবে তুমি?”
“হ্যাঁ।”
“বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে আমরা এইখানে ফেরত আসব?”
“হ্যাঁ।”
“কোনো কিডন্যাপ নোট দেব না?”
“না।”
“এখান থেকে ফোন করে টাকা চাইব?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে এখন তা হলে ডিটলসে যাওয়া যাক।” জরিনা মুখ শক্ত করে বলল, “ একশানে যাওয়ার সময় অস্ত্র হার্ডওয়ার পোশাক কী হবে?”
“দুইজনের কাছে দুইটা ছোট রিভলবার। একটা মোবাইল ফোন। ভদ্র পোশাক।”
বদি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেশ করল, “ভদ্র পোশাক মানে কি স্যুট?”
মতি হাত নেড়ে বলল, “আরে না। স্যুট হচ্ছে বকাদের পোশাক। মফস্বলের বিজনেসম্যান ছাড়া আর কেউ স্যুট পরে না। ভদ্র মানে ক্যাজুয়েল। জিন্স আর হাওয়াই সার্ট। জরিনার জন্যে সুতি শাড়ি।”
“সুতি শাড়ি? যদি দৌড়াতে হয়?”
“দৌড়াতে হলে দৌড়াবে।”
জরিনা চোখ পাকিয়ে বলল, “তুমি কখনো কাউকে শাড়ি পরে দৌড়াতে দেখেছ?”
“দেখি নাই। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। প্রকাশ্য দিনের বেলা একটা বাচ্চাকে কিডন্যাপ করতে হলে সেটাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে। সেখানে পোশাক ইম্পরট্যান্ট। এটা মাস্তানি না। এটা ছিনতাই না। একটা উঁচুদরের কাজ। এইটা আর্ট।”
বদি নাক দিয়ে এক ধরনের শব্দ করে বলল, “আর্ট?”
মতি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। মানুষ নাটক সিনেমা করার আগে যেরকম রিহার্সেল দিয়ে রেডি হয় আমাদেরও সেই রকম রিহার্সেল দিতে হবে। খুঁটিনাটি দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে এর মাঝে ফাঁকি দেওয়ার জায়গা নেই। এটা হবে নিখুঁত একটা শিল্প কর্ম। এটা হবে –”
জরিনা তার সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলে বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি বড় বেশি কথা বল, মতি।”
মতি একটু থতমত খেয়ে থেমে গেল।
আম্মা মেকুর গাল টিপে দিয়ে বললেন, “তুই শুয়ে থাক বাবা। আমি চট করে গোসল করে আসি।”
মেকুর হঠাৎ করে খুব ইচ্ছে হল উত্তরে আম্মাকে কিছু বলে। “ঠিক আছে আম্মা” কিংবা, “চমৎকার” কিংবা “তোমার গোসল আনন্দময় হউক” কিংবা এইধরনের কোন কথা। কিন্তু মেকু সাহস করল না। এই পর্যন্ত যতজন বড় মানুষ তাকে কথা বলতে শুনেছে ভয়ে তাদের সবার পেটের ভাত চাল হয়ে গেছে। তার আম্মাও যদি ভয় পেয়ে যান? ভয় পেয়ে তাকে যদি আর কোলে না নেন? যদি আর আদর না করেন? মেকু কিছুতেই আর সেই ঝুঁকি নিতে পারে না। কিন্তু যদি সে আম্মার সাথে কথা বলতে পারত তা হলে কী মজাটাই না হত! মেকু শুয়ে শুয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটু পরেই বাথরুমে পানি ঢালার এবং তার সাথে আম্মার মৃদু গলার গান শুনতে পেল।
শুয়ে শুয়ে মেকুর চোখে একটু তন্দ্রামতো এসেছিল, হঠাৎ করে সে দরজায় একটা শব্দ শুনতে পেল। মনে হল কেউ বাইরের দরজা খোলার চেষ্টা করছে। মেকু কান খাড়া করে শুয়ে থাকে, তাদের বাসায় কেউ এলে বেল বাজায়, নিজে থেকে দরজা খোলার চেষ্টা করে না। আব্বার কাছে চাবি আছে কিন্তু আব্বাও প্রথমে বেল বাজান।
মেকু শুনতে পেল দরজায় ঘটাং করে একটা শব্দ হল তারপর ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। মাকু শুনল ভিতরে কয়েক জন মানুষ এসে ঢুকছে, ব্যাপারটা আর যাই হোক ভালো হতে পারে না। এইভাবে দরজা খুলে ভিতরে বাইরের থেকে মানুষজন কোনো ভালো উদ্দেশ্যে ঢুকে যায় না। মেকুর বুকের ভিতর ধকধক শব্দ করতে থাকে, এই দুষ্টু মানুষগুলো যদি তার আম্মার কোনো ক্ষতি করে?
মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেল তার ঘরে দুজন মানুষ এসে ঢুকেছে, একজন পুরুষ বেশ লম্বা চওড়া, দেখতে খানিকটা ডাকাতের মতন। সাথে আরেক জন মহিলা, দেখতে শুনতে ভালোই। কিন্তু মানুষগুলি ভালো নয়, ভালো মানুষের হাতে রিভলবার থাকে না। পুরুষ মানুষটা নিচু গলায় বলল, “বুয়া কোথায়?”
মহিলা বলল, “বাথরুমে মনে হয়।”
“তা হলে দাবড়ানি দেব কেমন করে?”
“দেওয়ার দরকার কী? আমাদের কাজ শেষ করে আমরা চলে যাই।”
মেকু ঠিক বুঝতে পারল না তার আম্মাকে এই পাজি মানুষ দুই জন বুয়া মনে করছে কেন, আর কী কাজ শেষ করে তারা চলে যেতে চাইছে। মেকু ঘুমের ভান করে চোখের কোনা দিয়ে লম্বা চওড়া ডাকাতের মতো মানুষটি আর সাথের মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষ দুইজন হেঁটে তার বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মেকু শুনতে পেল পুরুষ মানুষটা বলছে, “বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। জেগে থাকলে হয়তো চিৎকার করত।”
মহিলা বলল, “এক মাসের বাচ্চা কিছু বুঝেসুঝে না। ময়দার প্যাকেটের মতো – চিৎকার করার কথা নয়।”
“তা হলে তুলে নাও।”
মাকু চমকে উঠল। তাকে তুলে নেওয়ার কথা বলছে। কেন তাকে তুলে নিতে চাচ্ছে। সে টের পেল একজন তার নিচে হাত দিয়ে তাকে টেনে তুলছে, মেকু কী করবে বুঝতে পারল না, সে কী একটা চিৎকার দেবে? ইচ্ছা করলেই সে এত জোরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে পারে যে বাথরুম থেকে তার আম্মা ছুটে বের হয়ে আসবেন, কিন্তু এই খারাপ মানুষগুলি যদি তার আম্মার কোনো ক্ষতি করে? গুলি করে দেয়?
মেকু তাই কোনো শব্দ করল না। সে বুঝতে পারল মহিলাটি তাকে কোলে তুলে নিয়েছে তারপর নিচু গলায় সঙ্গী মানুষটাকে বলছে, “চল।”
ঠিক তখন মোবাইল ফোনে মৃদু শব্দ হল। মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল পুরুষ মানুষটি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে চাপা গলায় বলল, “হ্যালো।”
অন্য পাশে কে কী বলেছে মেকু শুনতে পেল না। সে শুনল পুরুষ মানুষটা বলছে, “ কোনো সমস্যা নাই। আমরা আসছি। রেডি থাক।”
মেকু বুঝতে পারল তার ওপরে মহা বিপদ নেমে আসছে – এখনো তার বয়স দুই মাসও হয় নি, তার মাঝে তার উপর এরকম বিপদ? সে কী করবে বুঝতে পারল না। মাথা ঠাণ্ডা করে কিছু একটা করতে হবে, তবে এই ঘরে সে চিৎকার করে তার আম্মাকে বিপদে ফেলবে না – মরে গেলেও না। মহিলাটি তাকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে, তার ডান হাতটি ঝুলে আছে, সে চেষ্টা করল ডান হাত দিয়ে কিছু একটা ধরতে। ড্রেসিং টেবিলের কাছে দিয়ে যাবার সময় সে টেবিলের উপর একটা প্যাকেট দেখে সেটাই ধরে ফেলল, প্যাকেটের ভিতরে কী আছে কে জানে। প্যাকেটটা সে তার শরীরের ভিতরে লুকিয়ে ফেলল। এখনো সে জানে না কিসের প্যাকেট কিন্তু যতদূর মনে হয় এটা তার ফটোর একটা প্যাকেট। তার আব্বা আম্মার এখন প্রধান কাজ হচ্ছে তার ফটো তোলা – এখন পর্যন্ত যত ছবি তোলা হয়েছে সেগুলো দিয়ে মনে হয় একটা মিউজিয়াম ভর্তি করে ফেলা যাবে।
মহিলাটি মেকুকে কোলে নিয়ে সামনে এবং তার পিছু পিছু পুরুষ মানুষটি বের হয়ে এল। এই ফ্ল্যাটটাতে লিফট আছে কিন্তু মানুষ দুজন সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে। সিঁড়িতে কারো সাথে দেখা হল না, এখন একমাত্র ভরসা গেটের দারোয়ান। সিঁড়ি দিয়ে নেমে মহিলাটি এবং তার পিছু পিছু মানুষটা বের হয়ে আসে। দুজনে খুব সহজ স্বাভাবিক থাকার ভান করছে কিন্তু ভিতরে ভিতরে দুজনেই খুব উত্তেজিত। মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল পুরুষ মানুষটার ডান হাত পকেটের মাঝে, সেটা দিয়ে নিশ্চয় রিভলবারটা ধরে রেখেছে।
মেকু আশা করছিল গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ানটা বুঝি তাদেরকে থামাবে, কিন্তু ঠিক উলটো ব্যাপার হল, দারোয়ান হাত তুলে তাদেরকে একটা লম্বা সালাম দিল। মেকু তখন বুঝল এখন তার একটা কিছু করার সময় হয়েছে, সে আচমকা তার সমস্ত শরীর বাঁকা করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল। সেই চিৎকার এতই ভয়ংকর যে আরেকটু হলে মহিলাটা মেকুকে নিচে ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেত, কিন্তু শেষ মুহূর্ত সে সামলে নিল। পুরুষ মানুষটির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, “দেখেছ খোকার খিদে পেয়েছে?”
পুরুষ মানুষটি মহিলার মতো এত চালু নয়, সে আমতা আমতা করে বলল, “এ্যাঁ, ইয়ে-খোকা? মানে – ইয়ে – খিদে?”
“হ্যাঁ।” মহিলাটি মেকুর গলার স্বর ছাপিয়ে যায় চিৎকার করে বলল, “খোকার দুধের বোতলটা কোথায়?”
পুরুষ মানুষটা আবার হতচকিত হয়ে যায়, আমতা আমতা করে বলে, “দুধ? মানে দুধের বোতল? মানে- ইয়ে –কিন্তু তা হলে দুধ-মানে, যে সাদা রংয়ের –”
মেকু শুনল, মহিলাটি বলছে, “নিশ্চয়ই গাড়িতে রেখে এসেছি। চল তাড়াতাড়ি চল –”
দারোয়ান ব্যস্ত হয়ে বলল, “কোথায় স্যার, গাড়ি কোথায়? ড্রাইভার সাহেব কোথায়? তারপর গলা উচিয়ে চিৎকার করতে লাগল, “ড্রাইভার সাহেব। ড্রাইভার সাহেব।”
মেকু বুঝতে পারল তার চিৎকার করে আর লাভ হবে না, মায়ের কোলে ছোট বাচ্চার চিৎকার খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তা হলে কী সে এখন কথা বলে চেষ্টা করবে? তাতে কী লাভ হবে? কিছু একটা সে বলেই ফেলত কিন্তু তার আগেই তাদের পাশে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল, এবং কিছু বোঝার আগে দরজা খুলে এক পাশ দিয়ে মেকুকে নিয়ে মহিলা অন্যপাশ দিয়ে পুরুষ মানুষটি উঠে বসল। সাথে সাথে গাড়িটা ছেড়ে দিল। গাড়ি চালাতে চালাতে ড্রাইভার বলল, “কংগ্রাচুলেশান্স জরিনা। কংগ্রাচুলেশান্স বদি। চমৎকার ভাবে বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করেছ। নিখুঁত কাজ। স্টেট অফ দি আর্ট।”
বদি বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে বলল, “আরেকটু হলেই তো বিপদ হয়ে যেত! শেষ মুহূর্তে বাচ্চাটা হঠাৎ করে যা চিৎকার শুরু করল!” বদি মেকুর দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “এক থাবড়া দিয়ে সব দাঁত ফেলে দেব, বদমাইশ ছেলে।”
মতি গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, “সাবধান বদি। এই ছেলের গায়ে হাত দেবে না। এই ছেলের এখনো দাঁত উঠে নি কাজেই থাবড়া দিয়ে দাঁত ফেলতে পারবে না। তুমি তোমার নিজের বাচ্চাকে যত যত্ন করে রাখ এই বাচ্চাকে তার থেকে বেশি যত্ন করে রাখতে হবে। কারণ তোমার নিজের বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে তুমি দশ টাকাও পাবে না, কিন্তু এই বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে আমরা কমপক্ষে দশ লাখ টাকা পাব!”
মেকু একটু চমকে উঠল। তার আব্বা আম্মা তো বড়লোক নয়, দশ লাখ টাকা কেমন করে দেবে?
জরিনা বলল, “আমরা শুধু বাচ্চাটাকে তুলে এনেছি। বাচ্চাটার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কয়দিন রাখতে হবে জানি না, জামা কাপড় লাগবে। ন্যাপি লাগবে।”
মতি বলল, “ঠিক বলেছ। এলিফ্যান্ট রোডে বাচ্চাদের জিনিসপত্রের একটা দোকান আছে। সেখানে থামছি।”
গাড়ি থামার পর মতি আর জরিনা নেমে গেল। বদি থাক্ল পাহারায়। মেকুকে গাড়ির পিছনে শুইয়ে বদি গাড়ি থেকে নামল সিগারেট খেতে। মেকু একা একা শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। কোনোভাবে সে কী কাউকে কিছু বলতে পারে না? আশে পাশে কেউ এসে থামলে সে চেষ্টা করে দেখত, কিন্তু থামল না।
বেশ খানিকক্ষণ পর কেনাকাটা শেষ করে জরিনাকে নিয়ে মতি ফিরে আসে। তিন জন গাড়িতে বসে আবার রওনা দিয়ে দেয়, জরিনা গজ গজ করতে করতে বলল, “ইস কতগুলি টাকা বের হয়ে গেল। বাচ্চার জামা কাপড়ের এত দাম কে জানত।”
মতি বলল, “ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মাথা ঘামিও না, এই টাকা সুদে-আসলে উঠে আসবে।”
বদি বলল, “তাড়াতাড়ি বাসায় চল। এই বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে থাকা ঠিক না। হঠাৎ করে যদি বিকট গলায় চিৎকার করে দেয় তখন কী হবে? আমি কিন্তু তা হলে সোজাসুজি বাচ্চার গলা টিপে ধরব।”
মতি কঠিন গলায় বলল, “খবরদার বদি, তুমি এই বাচ্চার গায়ে হাত দেবে না। এই বাচ্চা এখন সোনার খনি।”
গাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মেকু তার জামার নিচে লুকিয়ে রাখা প্যাকেটটা নিচে ফেলে দিল। মেকুর কপাল ভালো কেউ সেটা লক্ষ করল না। কেউ একজন এখন এটা পেয়ে ফেরত দেওয়ার চেষ্টা করলেই হয়।
দরজার তালা খুলে প্রথমে মতি, তারপর মেকুকে কোলে নিয়ে জরিনা এবং সবশেষে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বদি এসে ঢুকল। মেকুকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জরিনা বলল, “মিশন কমপ্লিট।”
মতি শুদ্ধ করিয়ে দিয়ে বলল, “প্রথম অংশটা কমপ্লিট।”
জরিনা বলল, “প্রথম অংশটাই আসল।”
মতি বলল, “তা ঠিক। কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় অংশ হচ্ছে পরের অংশ। যখন আমি টেলিফোন করে ইলিয়াস আলীকে বলব তার বাচ্চা আমার কাছে তখন সে কী কাউ মাউ করে কাঁদবে! আমি হব তার হর্তা কর্তা বিধাতা। আমার উপরে নির্ভর করবে তার সবকিছু। আমি ইচ্ছা করলে হাসব, ইচ্ছা করলে ধমক দেব, ইচ্ছা করলে ব্যাটাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখব – ” মতি আনন্দে হা হা করে হাসতে লাগল।
বদি তার পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করে মতিকে দিয়ে বলল, “নাও। টেলিফোন কর।”
মতি টেলিফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “আস্তে বদি আস্তে! একটু সময় দিতে হবে। এই সব কাজে তাড়াহুড়ো করে লাভ নেই।”
জরিনা একটা সিগারেট ধরিয়ে বল্ল,”হ্যা। আগে কিছু খেয়ে নিই। খুব খিদে লেগেছে।”
“ঠিকই বলেছ।” বদি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এত খিদে লেগেছে যে মনে হচ্ছে একটা আস্ত ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব।”
জরিনা বিরক্ত মুখে বলল, “বাজে কথা বল না। মানুষের খিদে লাগলে কখনো ঘোড়া খায় না। বুঝেছ?”
ঘণ্টা খানেক পর মতি টেলিফোন করল। টেলিফোনের অন্যপাশে ইলিয়াস আলীর চিৎকার এবং আহাজারি শোনার কথা ছিল। কিন্তু খুব পরিতৃপ্ত একজন মানুষের গলা শোনা গেল। মানুষটা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “হ্যালো।”
“ইলিয়াস আলী সাহেব।”
ইলিয়াস আলী বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ । কে আপনি কী চান?”
“প্রশ্নটা কী আমারই করার কথা না? কী চান?”
ইলিয়াস আলী ধমক দিয়ে বললেন, “ঢং রেখে কী বলতে চান বলে ফেলেন।”
মতি থতমত খেয়ে বলল, “আমি আপনার ছেলের কথা বলতে চাচ্ছি।”
“আমার ছেলের কী কথা?”
মতি হঠাৎ করে চুপ করে যায়। মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। ইলিয়াস আলী টেলিফোনে আবার ধমক দিল, “কী হল? কথা বলছেন না কেন?”
“আপনার ছেলে কোথায়?”
“আমার ছেলে আমার পেটের উপর শুয়ে আছে। কেন?”
মতির মুখ হাঁ হয়ে গেল, “আপনার ছেলে আপনার পেটের উপর শুয়ে আছে?”
“হ্যাঁ। কেন কী হয়েছে?”
“আপনি – আপনি কী মগবাজারের তারানা ফ্ল্যাটে থাকেন?”
“হ্যাঁ। কেন কী হয়েছে?”
“তিন তলায়? লিফট থেকে নেমে বাম দিকে?”
“তিন তলায় না থার্ড ফ্লোরে। তার মানে চার তলায়। লিফট থেকে নেমে বাম দিকে।”
মতির চোয়াল ঝুলে পড়ল। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “থা-থা-থার্ড ফ্লোর? তা হলে তি-তি-তিন তলায় কে থাকে?”
“জানি না। আপনার এত খোঁজ নিয়ে কী দরকার?”
“আ-আ-আপনি জানেন না কে থাকে?”
“না। আমি এখানে থাকি না, কে কোথায় থাকে জানি না – আপনার জানার দরকার থাকে আপনি নিজে গিয়ে খোঁজ নেন।” কথা শেষ করার আগেই ইলিয়াস আলী খট করে টেলিফোনটা রেখে দিল।
মতি কিছুক্ষণ মোবাইল টেলিফোনটার দিকে তাকিয়ে রইল, তার মুখ দেখে মনে হতে লাগল এই টেলিফোনটা বুঝি সব সর্বনাশের মূল। জরিনা কোমরে দুই হাত রেখে মতির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “ বাসাটা ছিল চার তলায় তুমি আমাদের পাঠিয়েছ তিন তলায়?”
মতির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলল, “ইয়ে মানে আমি তো থার্ড ফ্লোরই বলেছিলাম। কিন্তু আসলে থার্ড ফ্লোর মানে যে চার তলা – ”
বদিও মতির সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “তুমি থার্ড ফ্লোর বল নাই, তুমি তিন তলা বলেছ। আমার স্পষ্ট মনে আছে বলেছ তিন তলা।”
মতি কঠিন মুখে বলল, “চিৎকার করছ কেন?”
“চিৎকার করব না তো কী গান গাইব? লাইফ রিস্ক নিয়ে গেলাম বাচ্চা কিডন্যাপ করতে এখন তুমি বলছ ভুল বাসা থেকে ভুল বাচ্চা নিয়ে এসেছি। রং করার জায়গা পাও না? ঢং করার জায়গা পাও না?”
“দেখ বদি, মুখ সামলে কথা বলবে।”
“কেন আমি মুখ সামলে কথা বলল? তুমি কে যে তোমার সামনে আমার মুখ সামলে কথা বলতে হবে?” বদি চিৎকার করে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে নিচে কথাবার্তা শোনা যায়। জরিনা জানালার কাছে গিয়ে হঠাৎ করে চাপা স্বরে বল, “চুপ।”
সাথে সাথে ভিতরে দুজনেই চুপ করে গেল। মতি ফিসফিস করে বলল, “কে?”
জরিনা নিচু গলায় “পুলিশ”
মতি এক লাফে জানালার কাছে এসে বলল, “পুলিশ কী করছে?”
“গাড়িটাকে দেখছে।”
তিন জনেই জানালায় পর্দার ফাঁক দিয়ে নিচে তাকিয়ে থাকে। অনেকগুলি পুলিশ বাসার সামনে, কয়েক জন তাদের বাসার দিকেতাকিয়ে আছে কয়েকজন গাড়িটাকে দেখছে। বদি মুখ শুকনো করে বলল, “ব্যাপারটা কী?”
মতি বলল, “বুঝতে পারছি না। বদি তুমি যাও তো নিচে গিয়ে দেখে আস ব্যাপারটা কী?”
“আমি? আমি কেন?”
“তা হলে কে যাবে?”
বদি বলল, “তুমি যাও।”
মতি চোখ লাল করে বলল, “যদি কোনো ইমারজেন্সি হয় তা হলে কে সামলাবে? তুমি? তোমার মাথায় সেইটুকু ঘিলু আছে? যাও, দেখে আস। নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাপার। পুলিশ মনে হয় কোনো কিছু রুটিন চেক করতে এসেছে।”
বদি গজ গজ করতে করতে নিচে নেমে গেল এবং দুই মিনিট না যেতেই প্রায় ছুটে উপরে উঠে এল। তার মুখ ফ্যাকাশে এবং রক্ত শুন্য। মতি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“পুলিশ আমাদের খুঁজেছে।”
“আমাদের? আমাদের কেন খুঁজেছে? কোথা থেকে খবর পেল?”
“এই বাসার সামনে নাকি একটা প্যাকেট খুঁজে পাওয়া গেছে। সেই প্যাকেটে বাচ্চার ছবি আর বাসার ঠিকানা লেখা ছিল।”
মতি দুর্বল গলায় বলল, “বাসার সামনে প্যাকেট কীভাবে এল?”
জরিনা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তিন তলা আর থার্ড ফ্লোর যেভাবে হয়েছে সেইভাবে!”
মতি বিষ দৃষ্টিতে জরিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাজের কথা যদি কিছু বলতে পার তা হলে বল।”
বদি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, “মগবাজারের সেই ফ্ল্যাটের সামনে যে দারোয়ান ছিল সেই ব্যাটা পুলিশের কাছে আমাদের বর্ণনা দিয়েছে, আমাদের গাড়ির বর্ণনা দিয়েছে।”
“সর্বনাশ!” মতি বলল, “তা হলে এই গাড়িটাও গেল!”
জরিনা বলল, “শুধু গাড়ি না আমরাও গেছি।”
“তা হলে?”
“এক্ষুনি পালাতে হবে। তাড়াতাড়ি চল, পিছন দিকে একটা রাস্তা আছে।”
তিন জন ছুটে পালাতে গিয়ে থেমে গেল, বিছানায় শুয়ে থাকা মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আর এই বাচ্চাটাকে কী করব?”
জরিনা বলল, “সাথে নিতে হবে।”
বদি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “সাথে নিতে হবে ? কেন?”
“যদি পুলিশ এসে বাচ্চাটাকে পেয়ে যায় তা হলে আমাদের কোনো উপায় নাই। যদি না পায় তবু একটা আশা আছে। তা ছাড়া – ”
“তা ছাড়া কী?”
“বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করেছি, কিছু টাকাও আদায় করব না? দশ লাখ না হোক পাঁচ লাখ। পাঁচ লাখ না হোক দুই লাখ? বাবা-মা কি বাচ্চার জন্যে দুই লাখ টাকাও দেবে না?”
মতি মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছ।”
বদি ভয়ে ভয়ে বলল, “কিন্তু মনে নাই বাচ্চা কীভাবে চিৎকার দেয়? শরীর বাঁকা করে এখন যদি একটা চিৎকার দেয় তা হলে পুলিশ জেনে যাবে না?”
জরিনা বলল,”সেইটা তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও। হাতটা রাখব এর গলায়, যদি চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করে সাথে সাথে গলা চেপে ধরব। দেখি বাচ্চার কত তেজ।”
মেকু বিছানায় শুয়ে শুয়ে এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল, পুলিশ এসেছে শুনে মনে মাঝে একটু আশাও হয়েছিল কিন্তু জরিনার কথা শুনে তার সব আশা শেষ হয়ে গেল। এই মহিলার চোখের দিকে তাকালেই কেমন জানি ভয় করে, মেরুদণ্ড শির শির করতে থাকে। তার গলায় হাত রেখে দরকার হলে চাপ দিয়ে একেবারে মেরে ফেলতেও তার কোনোই সমস্যা হবে না।
দরজা খুলে বের হতে গিয়ে মতি হঠাৎ থেমে গেল। বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “বদি, একটা কাজ করে?”
“কী?”
“বাচ্চার জিনিসপত্র গুলি নিয়ে এস।”
“কেন?”
“তা না হলে আবার কিনতে হবে। এখন যেরকম অবস্থা কেনা-কাটা করার জন্যে আর বাইরে যেতে পারব না।”
বদি গজ গজ করে বলল, “আমাকে কেন আনতে হবে? তুমি কেন আনতে পারবে না?”
“কারণ কোনো ইমারজেন্সি হলে কে দেখবে? তুমি? তোমার মাথায় সেই পরিমাণ ঘিলু আছে?”
কথায় কথায় তার মাথায় ঘিলু নিয়ে খোঁটা দেওয়াটা বদির একেবারেই পছন্দ হল না। কিন্তু এখন আর সেটা নিয়ে তর্ক করার সময় নেই।
একটু পর দেখা গেল বাসার পিছনে একটা গলি দিয়ে প্রথমে মতি তারপর মেকুকে কোলে নিয়ে জরিনা এবং সবার শেষে এক হাতে ব্যাগ অন্য হাতে এক কাঁদি কলা নিয়ে বদি হন হন করে ছুটে যাচ্ছে। বড় রাস্তায় এসে তারা একটা স্কুটার থামিয়ে সেটাতে উঠে পড়ল। তিন জন বড় মানুষ এবং একটা ছোট বাচ্চা বেশ গাদাগাদি করে স্কুটারে বসেছে। হাতের ব্যাগটাও চাপাচাপি করে রাখা হল। কিন্তু কলার কাঁদিটা রাখার জায়গা হচ্ছিল না। জরিনা বিজলি দিয়ে বলল, “তুমি এই কলাগুলি কোন আক্কেলে নিয়ে এসেছ?”
“খিদে লেগেছে তাই এনেছি।”
“তুমি দশ মিনিট হল ঠেসে খেয়েছ। এখন আমার খিদে লেগেছে?”
“আমি টেনশনে থাকলেই আমার বেশি খিদে লাগে।”
কথাটা সত্যি প্রমাণ করার জন্যে বদি একটা কলা ছিঁড়ে খেতে শুরু করল। স্কুটারের গাদাগাদি ভিড় এবং ঝাঁকুনির মাঝে কলা খাওয়ার ব্যাপারটি এত সোজা নয় কিন্তু বদির নিশ্চয়ই বেশ ভালোই খুদে পেয়েছে সে দেখতে দেখতে কলাটা শেষ করে ফেলল। সে মাঝে বসেছে বলে কলার ছিলকেটা ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে বেশী সুবিধে করতে পারল না। মতি ধমক দিয়ে বলল, এখন স্কুটার থেকে কলার ছিলকে ফেল না, কেউ একজন আছাড় খাবে।”
“আছাড় খেলে খাবে।”
“না । কোনো সন্দেহজনক কাজকর্ম না।”
বদি ঠিক বুঝতে পারল না কলার ছিলকে ফেলা কেন সন্দেহজনক কাজকর্ম হবে, কিন্তু সেটা নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছে করল না। সে এক হাতে কলার কাঁদি অন্য হাতে কলার ছিলকে নিয়ে বসে রইল। মেকু কিছুক্ষণ কলার ছিলকেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অস্ত্র হিসেবে কলার ছিলকে জিনিসটা মন্দ নয়, এটা হাতে নিয়ে রাখলে ভালই হয়। মেকু হাত বাড়িয়ে কলার ছিলকেটা নেওয়ার চেষ্টা করল, কাজটি খুব সোজা নয় কিন্তু ঝাঁকুনির কারণে একটা সুযোগ পেয়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছিলকেটা নিজের কাছে নিয়ে নিল।
জরিনা বিরক্ত হয়ে বলল, “কী হল? এই বাচ্চাটার হাতে তুমি কলার ছিলকে দিয়েছ কেন?”
“আমি দেই নাই সে নিয়েছে।”
“এই বাচ্চার বয়স মাত্র দুই মাস, সে নিজে থেকে কিছু নিতে পারে না। কিছু করলে সেটা না বুঝে করে।”
“ঠিক আছে বাবা নিয়ে নিচ্ছি।” বলে বদি কলার ছিলকেটা নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু মেকু তখন তার শরীর ঝাঁকিয়ে গলা ফাটিয়ে সেই ভয়ংকর চিৎকারটা শুরু করল। সেই চিৎকার এতই ভয়ংকর যে স্কুটার ড্রাইভার তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশে স্কুটার থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
বদি তাড়াতাড়ি কলার ছিলকে থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “না, না কিছু না।”
কাজেই মেকু কলার ছিলকেটা দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখল। কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সে এটা কাজে লাগাবে।
মেকুকে নিয়ে এই তিন জন মহাখালীর কাছে একটা ঘিঞ্জি হোটেলে এসে থামল। তিন তলায় দুইটা রুম ভাড়া করে তিন জন উপরে উঠতে শুরু করে। মেকু তখনো দুই হাতে কলার ছিলকেটা ধরে রেখেছে, এটাকে ঠিক সময়ে ব্যবহার করতে হবে। সিঁড়িতে ওঠার সময় মেকু সেই ‘ঠিক সময়’টা পেয়ে গেল। সিঁড়িতে প্রথমে জরিনা মেকুকে নিয়ে উঠেছে, তারপর বদি এবং সবশেষে মতি। মেকু চোখের কোনা দিয়ে পুরো অবস্থাটা দেখল তারপর হাত থেকে ছিলকেটা ঠিক বদির পায়ের তলায় ফেলেল দিল।
তখন যা একটা ঘটনা ঘটল তার কোনো তুলনা নেই। সমান জায়গাতেই কলার ছিলকে নিয়ে মানুষ ভয়ংকর আছাড় খেয়ে থাকে। খাড়া সিঁড়িতে সেই আছাড় আরো এক শ গুণ বেশী ভয়ংকর। বদির পায়ের নিচে কলার ছিলকে পড়ার সাথে সাথে হঠাৎ করে পা হড়কে সে মুখ থুবরে নিচে পড়ল, শক্ত সিঁড়িতে মুখ লেগে সাথে সাথে তার একটা দাঁত ভেঙে গেল। বদির হাতের ব্যাগ এবং কলার কাঁদি শুন্যে উড়ে যায় এবং সে নিজে উলটে পালটে নিচে পড়তে থাকে। ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মতি বদির প্রচণ্ড ধাক্কায় গড়িয়ে পড়ল এবং তারপর কখনো মতি এবং কখনো বদি এইভাবে তারা খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়তে থাকে। মেকু জরিনার কোলে বসে তাদের আর্তচিৎকার শুনতে থাকে। একটা মাত্র কলার ছিলকে দিয়ে এত বড় একটা কাণ্ড করা যেতে পারে সেটা মেকুর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
দুর্ঘটনাটা ঘটেছে তিন তলার কাছাকাছি, বদি আর মতি সেখান থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে প্রথমে দুইতলা এবং শেষে এক তলায় এসে থামল। তাদের কপাল ভালো দুইজনকে চিৎকার করে গড়িয়ে পড়তে দেখে হোটেলের একজন কর্মচারী কোলাপসিবল গেইটটা বন্ধ করে দিয়েছিল, তা না হলে দুইজনেই গড়িয়ে গড়িয়ে একেবারে বাইরে রাস্তায় গিয়ে পড়ত এবং একটা দোতলা বাস চাপা দিয়ে তাদের চেপটা করে ফেলত।
হোটেলের কর্মচারী এবং বোর্ডাররা সবাই ভিড় করে দেখতে এল, জরিনাও ওপর থেকে আবার নিচে নেমে আসে। মতি এবং বদি নাম মুখ খিচিয়ে অনেক কষ্টে উঠে বসে। বদি থুঃ করে থু তু ফেলতেই একটা দাঁত বের হয়ে এল। মতি উঠে বসে আবিষ্কার করল কপালের কাছে ফুলে গিয়ে তার বাম চোখটা বুজে এসেছে। তার ডান হাতটা নাড়তে পারছিল না, মনে হয় সকেট থেকে খুলে এসেছে। বদি দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আবার বসে পড়ল, তার পা মচকে গিয়েছে।
হোটেলের ম্যানেজার বলল, “এই রকম ঘটনা আর দেখি নাই। এক সাথে দুইজন আছাড় খেয়ে তিন তলা থেকে একেবারে একতলায়!”
জরিনা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বদি আর মতির দিকে তাকিয়ে বলল, “বুড়োধাড়ি দুই জন মানুষ কখনো এইভাবে আছাড় খায়?”
বদি হিংস্র চোখের মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এই বদমাইস বাচ্চা ইচ্ছা করে এইটা করেছে। আমি স্পষ্ট দেখেছি ইচ্ছা করে আমার পায়ের তলায় কলার ছিলকা ফেলেছে!”
জরিনা ধমক দিয়ে বলল, “বাজে কথা বলো না। দুই মাসের বাচ্চার কোন মোটর কো অর্ডিনেশান থাকে না।”
বদি দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “ এই পাজি ছেলের শুধু মোটর কো অর্ডিনেশান না ট্যাংক কো অর্ডিনেশান আর প্লেন- কো অর্ডিনেশানও আছে। আমি এই বাচ্চারে গলা টিপে শেষ করব।”
হোটেলের ম্যানেজার বলল, “এই বাচ্চা আপনাদের কী হয়? মাসুম একটা বাচ্চাকে গলা টিপে মারতে চাচ্ছেন কেন?”
বদি আমতা আমতা করতে লাগল, জরিনা সামলে নিয়ে বলল, “এটা আমার বাচ্চা। কেউ বাচ্চাকে মারতে চাইছে না, রেগে গেছে বলে এরকম বলছে।”
“মাসুম বাচ্চাকে নিয়ে এরকম কথা বলা ঠিক না।”
জরিনা বদি আর মতির কাছে গিয়ে বলল, “তোমরা দাঁড়াতে পারবে কি? নাকি টেনে তুলতে হবে?”
দুজনে অনেক কষ্টে দাঁড়াল। মতি মুখ বিকৃত করে বলল, “হাঁটতে পারব বলে মনে হয় না।”
হোটেলের ম্যানেজার তার কয়েক জন কর্মচারীকে বলল, “এই স্যারদের ওপরে তুলে দিয়ে আয়।”
দুই জন মতিকে চ্যাংদোলা করে ওপরে তুলতে থাকে। বদিকে দুজন মিলে টানাটানি করে বেশী সুবিধে করতে পারে না, শেষ পর্যন্ত জরিনাও হাত লাগায় এবং অনেক কষ্টে তাকে টেনে ওপরে নিয়ে যায়। হোটেল রুমের দরজা খুলে তিন জন যখন মেকুকে বিয়ে ভিতরে ঢুকেছে তখন কারো গায়ে আর কোন ও শক্তি অবশিষ্ট নেই।