০১. জন্ম – মেকু কাহিনী

জন্ম

 কী হল ব্যাপারটা মেকু ঠিক বুঝতে পারল না—প্রথমে টানা হ্যাঁচড়া চিৎকার হইচই তারপর হঠাত করে মনে হল কেউ যেন কুসুম কুসুম গরমের আরামের একটা জায়গা থেকে তাকে টেনে ঠাণ্ডা একটা ঘরে এনে ফেলে দিল। মেকু গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দেবে কি না চিন্তা করল। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক ভদ্রতা হবে না বলে মাড়িতে মাড়ি চেপে পুরো যন্ত্রণাটা সহ্য করে অপেক্ষা করতে থাকে। আশেপাশে কিছু উত্তেজিত গলা শোনা যেতে থাকে—মানুষগুলি কী নিয়ে এরকম খেপে গেছে দেখার জন্যে মেকু খুব সাবধানে চোখ খুলে তাকাতেই প্রচণ্ড আলোতে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মেকু তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করল, কী সর্বনাশ! এত আলো কোথা থেকে এসেছে?

চারপাশের লোকজন এখনো খুব চেঁচামেচি করছে, মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে ভয় পেয়েছে। কী নিয়ে ভয় পেয়েছে কে জানে। মেকু শুনল কেউ একজন বলল, “কী হল? বাচ্চা কাঁদে না কেন?”

কোন বাচ্চার কথা বলছে কে জানে! বাচ্চা কান্নাকাটি না করাই তো ভালো, এটা নিয়ে ভয় পাওয়ার কী আছে? কোন বাচ্চা কাঁদছে না মেকু সেটা চোখ খুলে একবার দেখবে কি না ভাবল কিন্তু চোখ ধাঁধানো আলোর কথা চিন্তা করে আর সাহস পেল না। শুনতে পেল ভয় পাওয়া গলায় মানুষটা আবার বলল, “সর্বনাশ! বাচ্চা যে এখনো কাঁদছে না!”

মোটা গলায় একজন বলল, “বাচ্চাটাকে উলটো করে ধরে পাছায় জোরে থাবা দাও।”

কোন বাচ্চার কপালে এই দুর্গতি আছে কে জানে। ছোট একটা বাচ্চাকে উলটো করে ধরে তার পাছায় থাবা দিয়ে কাঁদিয়ে দেওয়া কোন দেশী ভদ্রতা? এরা কি ধরনের মানুষ? মেকু চোখ খুলে এই বেয়াদব মানুষগুলিকে এক জনরে দেখবে কী না ভাবল, তার আগেই হঠাত করে কে যেন তার দুই পা ধরে তাকে চ্যাং দোলা করে উপরে তুলে ফেলল। তারপর উলটো করে ঝুলিয়ে কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড জোরে তার পাছায় একটা ভয়াবহ থাবড়া মেরে বসে। মেকুর মনে হল শুধু তার পাছা নয় শরীরের হাড়, মাংস, চামড়া সবকিছু চিড়বিড় করে জ্বলে উঠেছে।

ভয় পাওয়া মানুষটা এবারে চিৎকার করে উঠল, “কী সর্বনাশ! এখনো দেখি কাঁদছে না।”

মেকু প্রাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু যে ধরেছে তার হাত লোহার মতো শক্ত, সেখান থেকে ছাড়া পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। কিছু বোঝার আগেই শক্ত লোহার মতো হাত দিয়ে আবার তার পাছায় কেউ একজন একটা ভয়াবহ থাবড়া বসিয়ে দিল, সেই থাবড়া খেয়ে মেকুর মনে হল তার শরীরের ভিতর সবকিছু বুঝি ওলট পালট হয়ে গেল। হঠাত করে মেকু বুঝতে পারল যে বাচ্চাটা কাঁদছে না বলে সবাই খুব ভয় পেয়ে গেছে সেই বাচ্চাটা সে নিজে, এবং যতক্ষণ সে তার গলা ছেড়ে বিকট গলায় কাঁদতে শুরু না করবে ততক্ষণ শক্ত লোহার হাত দিয়ে তার পাছায় একটার পর একটা থাবড়া মারতেই থাকবে।

মেকু আর দেরি করল না, গলা ফাটিয়ে বিকট গলায় চিৎকার করে কেঁদে উঠল, সাথে সাথে ঘরে একটা আনন্দধ্বনি শোনা যায়। মোটা গলায় মানুষটা বলল, “আর ভয় নাই। বাচ্চা কেঁদেছে।”

ভয় যখন নেই এখন কাঁদা থামাবে কিনা মেকু বুঝতে পারল না। কিন্তু শেষে সে কোনো ঝুঁকি নিল না, চোখ পিট পিট করে তাকাতে তাকাতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল। মোটা গলার মানুষটা খুশি খুশি গলায় বলল, “ওয়ান্ডারফুল! কী চমৎকার কাঁদছে দেখ। কী শক্ত লাংস!”

মেকু বুঝতে পারল না কাঁদা কেমন করে চমৎকার হয় আর তার সাথে শক্ত লাংসের কী সম্পর্ক। সে শক্ত হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এতদিন মায়ের পেটে কী আরামে ছিল, খাওয়ার চিন্তা নেই, ঘুমানোর চিন্তা নেই, বাথরুম যাবার সমস্যা নেই, আর সেখান থেকে বের হতে না হতেই এ কী সমস্যা?

মেকু টের পেল কেউ একজন তাকে আচ্ছা করে দলাই মলাই করে মুছোমুছি করছে। শরীর মুছে একটা কাপড়ে জড়িয়ে ধরে মেয়েলি গলায় কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, “দেব এখন মায়ের কাছে?”

মেকু প্রায় চিৎকার করে বলেই ফেলছিল, “দেবো না মানে? এক শ বার দেবে—” কিন্তু এখানকার ব্যাপার-স্যাপার ভালোমতো না বুঝে কিছু বলা উচিত হবে বলে মনে হয় না। মেকু চুপ করে রইল, শুনল ভারী গলায় একজন বলছে, “না এখন মায়ের কাছে দেবেন না। মা খুব টায়ার্ড। পাজি ছেলেটার ডেলিভারিতে মায়ের কী কষ্ট হয়েছে দেখছেন না?”

মেকু খুব চটে উঠল, তাকে পাজি বলছে কত বড় সাহস? রেগেমেগে সে কিছু একটা বলেই ফেলছিল কিন্তু লোহার মতো শক্ত হাতের সেই ভয়ংকর থাবড়ার কথা মনে করে চুপ করে রইল। চোখ পিট পিট করে সে মানুষটাকে এক নজর দেখে নিল, শুকনো মতন একজন মানুষ, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, নাকের নিচে ঝাঁটার মতো গোঁফ।

গোলগাল মোটা সোটা একজন নার্স মেকুকে বুকে জড়িয়ে ধরে হেসে বলল, “হি হি হি ডাক্তার সাহেব দেখছেন? কেমন চোখ কটমট করে আপনার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে আপনি পাজি বলেছেন, সেটা বুঝতে পেরেছে!”

শুকনো মতন মানুষটা—যার গোঁফের নিচে ঝাঁটার মতো গোঁফ মাথা নেড়ে বলল, “ঠিকই বলেছ! এই ছেলে জন্মের সময় মা’কে যত কষ্ট দিয়েছে মনে হচ্ছে সারা জীবনই কষ্ট দেবে!”

মেকু কিছু না বলে চুপ করে শুয়ে রইল। সত্যিই সে মা’কে কষ্ট দিয়েছে নাকি? সে ইতি উতি করে দেখার চেষ্টা করল, মা মনে হয় পাশের বিছানায় নেতিয়ে শুয়ে আছে। এখান থেকে ঝাঁপিয়ে মায়ের বুকে পড়ার ইচ্ছে করছে কিন্তু তাকে যেতে দেবে বলে মনে হয় না। ঝাঁটার মতো গোঁফের ডাক্তার বলল, “বাচ্চাটাকে নিয়ে নার্সারিতে রাখেন, মা খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিক।”

নার্স ইতস্তত করে বলল, বাচ্চার নানি, খালা, দাদি, চাচা-চাচি সবাই বাচ্চা দেখার জন্যে অপেক্ষা করছে।”

“করুক। বলনে জানালা দিয়ে দেখতে।”

মেকু টের পেল নার্স তাকে জড়িয়ে ধরে নার্সারি নিয়ে যাচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে সে তার মা’কে দেখার চেষ্টা করল কিন্তু ভালো করে দেখতে পেল না।

নার্সারি ঘরে সারি সারি ছোট ছোট বিছানা, সেখানে আরো কিছু বাচ্চা কাদার মতো ঘুমিয়ে আছে। নার্স মেকুকে খালি একটা বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চলে গেল। খালি ঘর, আশে পাশে আর কেউ নেই। মেকু এদিক ওদিক তাকাল এবং তখন তার নজরে পড়ল আশেপাশে ছোট ছোট বিছানাগুলিতে একটা করে বাচ্চা শুয়ে আছে। মেকু মাথা ঘুরিয়ে দেখল ঠিক তার পাশের বিছানাতেই গাবদাগোবদা একটা বাচ্চা শুয়ে আছে। সে গলা উঁচিয়ে ডাকল, “এই। এই বাচ্চা—”

বাচ্চাটা কো কো করে একটু শব্দ করল কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। মেকু আবার ডাকল, “এই বাচ্চা। উঠ না—”
বাচ্চাটা এবারে চোখ পিট পিট করে তাকাল, মেকু জিজ্ঞেস করল, “কী হল? কথা বল না কেন? কী নাম তোমার?”

বাচ্চাটা বুড়ো আঙুল চুষতে চুষতে আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর জন্যে প্রস্তুত হয়। মেকু রেগে গিয়ে একটা ধমক দিয়ে বলল, “বেশি ঢং হয়েছে নাকি? একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, কানে যায় না?”

মেকুর ধমক খেয়ে বাচ্চাটা হঠাত চমকে উঠে ঠোঁট উলটে কাঁদতে শুরু করল। প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর গলা ফাটিয়ে। তার কান্না শুনে পাশের জনও জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করল এবং তার দেখাদেখি অন্য সবাই। মনে হল ঘরে বুঝি কান্নার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

এতজনের কান্না শুনে পাশের ঘর থেকে নার্স ছুটে এসে বাচ্চাগুলিকে শান্ত করতে থাকে। একজন একজন করে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল, তখন মেকু নার্সকে বলল, “এই যে, শুনেন।”

নার্স হঠাত করে ভয়ে একটা চিৎকার করে উঠে, তার কথায় এভাবে চিৎকার করে ওঠার কী আছে মেকু বুঝতে পারছে না। মেকু তার হাত নাড়ার চেষ্টা করে আবার ডাকল, “এই যে, এদিকে—”

নার্স আবার একটা চিৎকার করে উঠে—এখনো মেকুকে দেখতে পায় নি। মেকু আবার ডাকার আগেই নার্স হঠাত করে গুলির মতো ছুটে ঘরে থেকে বের হয়ে গেল। কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে, হঠাত করে কী দেখে ভয় পেল কে জানে। মহা মুশকিল হল দেখি, মেকু খুব বিরক্ত হল। প্রচণ্ড বাথরুম পেয়েছে কিন্তু ঠিক কীভাবে করবে বুঝতে পারছে না, যেভাবে বাথরুম চেপেছে, জামাকাপড় ভিজিয়ে ফেলার একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে—তা হলে কী লজ্জারই না একটা ব্যাপার হবে।

মেকু দরজায় একটা শব্দ শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, দেখতে পেল নার্সটা আবার ফিরে এসেছে এবারে সাথে বয়স্কা আরেক জন নার্স। বয়স্কা নার্সটা বলল, “এখানে কেউ একজন তোমাকে ডেকেছে?”

“হ্যাঁ।”

“এখানে কে ডাকবে? কেউ তো নেই। শুধু বাচ্চাগুলি।”

“আমি স্পষ্ট শুনলাম। প্রথমে বলল, ‘এই যে শুনেন’। তারপর বলল, ‘এই যে, এদিকে—’”

“কী রকম গলা?”

“ছোট বাচ্চার মতো গলা।”

বয়স্কা নার্সটা এবার হো হো করে হেসে বলল, “তুমি বলছ কোনো একটা বাচ্চা তোমাকে ডেকেছে?”

ভয় পাওয়া নার্সটা ইতস্ততঃ করে বলল, “না, মানে ইয়ে—”

বয়স্কা নার্সটা ভয় পাওয়া নার্সটার হাত ধরে বলল, “আসলে আজকে ডাবল ওভার টাইম করে তুমি বেশি টায়ার্ড হয়ে গেছ, তাই এরকম মনে হচ্ছে। বাসায় গিয়ে একটা টানা ঘুম দাও দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“হ্যাঁ। তাই করতে হবে।”

“কথাটা আমাকে বলেছ ঠিক আছে। আর কাউকে বল না। বাচ্চারা জন্মানোর সাথে সাথে তোমাকে ডাকাডাকি করছে শুনলে সবাই ভাববে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চাকরি নিয়ে টানাটানি হয়ে যাবে।”

নার্স দুই জন নিচু গলায় কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মেকু এবারে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল, নার্স দুজনের কথা শুনে মনে হচ্ছে তার কথা বলার ব্যাপারটা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। কী কারণ? অন্য পাশের বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করে দেখবে নাকি? মেকু মাথা ঘুরিয়ে দেখল একেবারে কাদার মতো ঘুমাচ্ছে ডেকে লাভ হবে মনে হয় না। এরকমভাবে ঘুমাচ্ছে যে দেখে মেকুরও নিজের চোখে ঘুম এসে যাচ্ছে, জেগে থাকাই মনে হয় মুশকিল হয়ে যাবে। তার সাথে এখন আরেক যন্ত্রণা শুরু হল, বেশ কিছুক্ষণ থেকেই টের পেয়েছে এখন সেটা আর সহ্য করা যাচ্ছে না। চেপে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কী করবে বুঝতে না পেরে সে ছটফট করতে থাকে এবং কিছু বোঝার আগেই হঠাত করে তার বাথরুম হয়ে গেল। নিজের কাপড়ে বাথরুম? কী লজ্জা! কী লজ্জা! যখন অন্যেরা বুঝতে পারবে তখন কী হবে? জন্ম হয়েছে এখনো এক ঘণ্টা হয়নি তার মাঝে সে এরকম একটা লজ্জার কাজ করে ফেলল? সর্বনাশ!

মেকু অত্যন্ত অশান্তিতে খানিকক্ষণ ছটফট করে ভেজা কাপড়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখতে পেল নার্স আর ডাক্তার মিলে তার কাপড় খুলে ফেলেছে, কী লজ্জার কথা। যখন দেখবে সে নিজের জামা কাপড়ে বাথরুম করে ফেলেছে নিশ্চয়ই কী রকম রেগে যাবে। আবার ধরে একটা থাবড়াই দেয় নাকি কে জানে! মেকু ভয়ে ভয়ে নার্স আর ডাক্তারের দিক তাকিয়ে রইল।

কিন্তু ঠিক উলটো ব্যাপার হল, ডাক্তার খুশি খুশি গলায় বলল, “পারফেক্ট! বাচ্চা পেশাবও করে ফেলেছে। ভেরি গুড! শুকনো একটা ডাইপার পরিয়ে মায়ের কাছে নিয়ে যান। বেচারি মা আর অপেক্ষা  করতে পারছে না।”

মেকু লজ্জার মাথা খেয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল, নার্স তাকে পুরো ন্যাংটো করে শুকনো কাপড় পরিয়ে দিচ্ছে, কী লজ্জার কথা। একজন অপরিচিতা মহিলা তাকে এভাবে ন্যাংটো করে ফেলছে, ছিঃ ছিঃ ছিঃ! মেকু লজ্জায় লাল হয়ে শুয়ে রইল। শুকনো কাপড় পরিয়ে নার্স তাকে তুলে নেয় তারপর বুকে চেপে হেঁটে যেতে থাকে। মেকু একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, ভুল করে তাতে অন্য কোনো মায়ের কাছে দিয়ে দেবে না তো?

মা বিছানায় আধ-শোয়া হয়ে শুয়েছিলেন, নার্স মেকুকে মায়ের বুকের ওপর শুইয়ে দিল। মেকু একবার বুক ভরে ঘ্রাণ নেয়। কোনো সন্দেহ নেই—এই হচ্ছে তার মান—তাকে ভুল করে অন্য কোনো মায়ের কাছে দিয়ে দেয় নি। মায়ের শরীরের ভিতরে সে কতদিন কাটিয়েছে, কী পরিচিত মায়ের শরীরের এই ঘ্রাণ—আহা! কী ভালোই না লাগল মেকুর। মা মেকুকে বুকে চেপে ধরে তার গালে ঠোঁট স্পর্শ করে আদর করলেন। মেকু চেষ্টা করল হাত দিয়ে মা’কে ধরে ফেলতে কিন্তু হাত-পা-গুলি এখনো ঠিক করে ব্যবহার করা শেখে নি, ডান দিকে নিতে চাইলে বাম দিকে চলে যায়, বাম দিকে নিতে চাইলে ওপরে ওঠে যায়, তাই মা’কে ধরতে পারল না। মা মেকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, আঙুলগুলি মেলে ধরলেন, পায়ের পাতায় চুমু খেলেন, নাক টেনে দিলেন, পেটের মাঝে কাতকুতু দিলেন। মেকু চোখ খোলা রেখে পুরো আদরটা উপভোগ করল। জন্মের পর থেকে যে তার ভিতরে ভিতরে একটা অস্থিরতা ছিল, দুশ্চিন্তা ছিল—এখন সব কেটে গেছে। এখন আর তার ভিতরে কোনো চিন্তা নেই। সে জানে তার মা তাকে সব বিপদ আপদ থেকে রক্ষ করবে। খিদে পেলে খেতে দেবে, ঘুম পেলে বুকে চেপে ঘুম পাড়িয়ে দেবে, বাথরুম পেলে বাথরুম করিয়ে দেবে আর যখন সেই খারাপ খারাপ ডাক্তারগুলি শক্ত লোহার মতো হাত দিয়ে থাবড়া দিতে আসবে তাদের হাত থেকে রক্ষা করবে। পৃথিবীর কারো কোনো সাধ্যি নেই এখন তার কোনো ক্ষতি করে। আসুক না সেই ব্যাটাম যে তার পাছায় থাবড়া দিয়েছিল, মা একেবারে তার বারটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে না?

নার্স বলল, “আপনার ছেলের চোখগুলি দেখেছেন?”

মা মাথা নাড়লেন, “দেখেছি।”

“দেখে মনে হয় সবকিছু বোঝে।”

মা কিছু বললেন না, একটু হেসে মেকুকে আবার সাবধানে বুকে চেপে আদর করলেন। নার্স বলল, “আপনার সব আত্মীয়-স্বজন অপেক্ষা করছে। আসবে বলব?”

মা তার গায়ের কাপড় টেনে টুনে ঠিক করে বললেন, “বলেন।”

নার্স বের হয়ে যাওয়ার প্রায় সাথে সাথেই অনেকগুলি মানুষ এসে ঢুকল। নানা বয়সের মানুষ, কেউ মোটা, কেউ চিকন, কেউ বয়স্ক, কেউ বাচ্চা, কেউ পুরুষ এবং কেউ মহিলা। সবাই একসাথে কথা বলতে বলতে মেকু আর তার মায়ের কাছে ছুটে আসতে শুরু করে দিল কিন্তু নার্স পুলিশ সার্জেন্টের মতো দুই হাত তুলে তাদের মাঝপথে থামিয়ে দিল। মুখ শক্ত করে বলল, “আপনারা কেউ বেশি কাছে আসবেন না।”

বয়স্কা একজন মহিলা বলল, “কেন কাছে আসব না? আমরা নাতিকে দেখবে না?”

“আগে ভালো করে হাত ধুয়ে আসেন। ওই যে বেসিন আছে। বেসিনে সাবান রাখা আছে।”

“কেন? হাত ধুতে হবে কেন?”

“কারণ আপনারা বাইরে থেকে এসেছেন। আর যাকে দেখতে এসেছেন তার মাত্র কিছুক্ষণ হল জন্ম হয়েছে।”

“আমাদের কি বাচ্চাকাচ্চা হয় নি?” বয়স্কা মহিলাটি খনখনে গলায় তর্ক করতে লাগল, “আমরা কি বাচ্চা মানুষ করি নি?”

নার্সটি বলল, “অবিশ্যিই করেছেন। আপনারা করেছেন আপনাদের মতো, আর আমরা করছি আমাদের মতো। এটাই আমাদের নার্সিং হোমের নিয়ম।”

“কী রকম নার্সিং হোম এটা? বাচ্চা জন্মানোর পর আলাদা ফেলে রাখল, এখন ধরতে দেবে না।”

“এটাই নিয়ম। আপনারা এই নিয়ম মেনেই আমাদের নার্সিং হোমে এসেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখেন।” নার্স কঠিন মুখ বলল, “সবাই হাত ধুয়ে আসেন। যারা ছোট তারা যেন কাছাকাছি না আসে।”

মেকু চোখের কোনা দিয়ে দেখল ফরসা মতন একজন মানুষ সবার আগে হাত ধুয়ে এগিয়ে এল। মানুষটা মায়ের কাছে এসে মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ওমা! শানু, দেখতে দেখি একেবারে তোমার মতো হয়েছে!”

মা একটু হেসে বললেন, “কে বলেছে আমার মতো?”

“হ্যাঁ। একেবারে তোমার মতো। এই দেখ একেবারে তোমার মতো নাক।”

মেকু তাকিয়ে মায়ের নাকটা দেখল, কী সুন্দর মায়ের নাক। যদি সত্যি মায়ের মতো নাক হয়ে থাকে তাহলে তো ভালোই হয়। মেকু নিজের নাকটা দেখার চেষ্টা করল কিন্তু দেখতে পেল না। মানুষ নিজের নাক নিজের কেমন করে দেখে কে জানে।

খনখনে গলায় সেই বয়স্কা মহিলাটি বলল, “কে বলেছে তোমার বউয়ের মতো নাক? এর তো দেখি নাকই নাই।”

মহিলার কথা শুনে ঘরের অনেকে হি হি করে হেসে উঠে। মেকু চোখ পাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল কে কথাটা বলেছে আর কারা কারা হাসছে। তাকে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে দেখে সবাই আবার হি হি করে হেসে উঠল, মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ফরসা মতন মানুষটা বলল, “দেখেছ? মনে হচ্ছে সবার কথা বুঝতে পারছে।”

মেকু একবার ভাবল বলেই ফেলে, “অবশ্যি বুঝতে পারছি! বুঝতে পারব না কেন? আমাকে কি গাধা পেয়েছ না বেকুব পেয়েছ?” কিন্তু সে কিছু বলল না, তার মাত্র জন্ম হয়েছে, পৃথিবীর নিয়ম কানুন সে কিছুই জানে না, উলটা পালটা কাজ করে সে কোনো ঝামেলায় পড়তে চায় না।

খনখনে গলায় বয়স্কা মহিলাটি বলল, “দেও দেখি বউমা তোমার বাচ্চাটা একটু কোলে নিয়ে দেখি।”

পিছন থেকে একজন বলল, “না চাচি, আগে বাবার কোলে দেয়া যাক, দেখি বাবা কী করে!”

বয়স্কা মহিলাটি একটু অসন্তুষ্ট হল মনে হল, কিন্তু মুখে জোর করে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, “হ্যাঁ হাসান, তুই আগে কোলে নে। তুই যখন বাবা, ছেলেকে তো তুইই আগে কোলে নিবি।”

মেকু মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল বাবাটা কে। দেখল মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ফরসা মতন মানুষটাই হচ্ছে বাবা। বাবাকে কেন এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সে ঠিক বুঝতে পারল না। বাচ্চাকে শরীরের ভিতরে রেখে বড় করার পুরো কাজটা তো মা একাই করেছে, আর কাউকে তো তখন আশেপাশে দেখে নি। এখন হঠাত করে বাহাবা নেওয়ার জন্যে অনেকে এসে হাজির হচ্ছে মনে হল।

মা সাবধানে ফরসা মতন মানুষটার কাছে মেকুকে তুলে দিল। মানুষটা যত্ন করে দুই হাতে ধরে মেকুর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “ওমা। এইটুকুন একজন মানুষ।”

বয়স্কা মহিলাটা খনখনে গলায় বলল, “এই টুকুনই ভালো। যখন বড় হবে তখন দেখবি গাঞ্জা খাওয়া শিখবে, ফেনসিডিল খাওয়া শিখবে, মাস্তানি করবে, চাঁদাবাজি করবে—”

বাবা মেকুকে বুকে চেপে ধরলেন, বললেন, “কী বলছেন চাচি! আমার ছেলে মাস্তানি করবে?”

বয়স্কা মহিলাটি হড়বড় করে কথা বলতে লাগল, মেকু সেদিকে কান না দিয়ে তার বাবার দিকে তাকাল। মানুষটা ভালোই মনে হচ্ছে, তার জন্যে অনেক আদর রয়েছে। মেকুর বেশ পছন্দই হল মানুষটাকে।

বয়স্কা মহিলাটা এবারে একটু কাছে এগিয়ে এসে বাবাকে বলল, “দে হাসান আমার কাছে দে দেখি। পাজি ছেলেটাকে একবার কোলে নেই।”

মেকু তার বাবাকে ধরে রাখার চেষ্টা করল, এই বুড়ির কাছে তার একটুও যাবার ইচ্ছে নেই। কিন্তু সে এখনো হাত দুটি ভালো করে ব্যবহার করা শেখে নি, বাবাকে ভালো করে ধরতে পারল না, শুধু হাত দুটি ইতস্তত নড়তে লাগল। বুড়ি মহিলাটি আরো একটু এগিয়ে এল, হাত বাড়িয়ে মেকুকে ধরতে ধরতে বলল, “ওই তোরা ক্যামেরা এনেছিস না? একটা ছবি তুলিস না কেন?”

কে একজন ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে এল, বুড়ি মেকুর আরো একটু কাছে এসেছে। তখন মেকু প্রথমবার তার পা ব্যবহার করল। বুড়ির মুখটা কাছাকাছি আসতেই দুই পা ভাঁজ করে আচমকা বুড়ির নাকে শক্ত করে লাথি কষিয়ে দিল—ঠিক তখন ক্যামেরায় ফ্লাশ জ্বলে উঠল। মনে হল একেবারে মোক্ষম লক্ষভেদ হয়েছে, কারণ মেকু শুনতে পেল ঘরের সবাই হি হি করে হেসে উঠেছে। বুড়ি মহিলাটি নিজের নাক চেপে ধরে পিছিয়ে যায়, এখনো সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, কয়েক ঘণ্টা বয়স হয়েছে একটা ছেলে এত জোরে তাকে লাথি মেরে বসেছে। বুড়ি নিজের নাকে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “আমি বলেছি না ছেলে বড় হয়ে মাস্তানী করবে। এখনই তার নিশানা দেখাতে শুরু করেছে, লাথি ঘুষি মারতে শুরু করেছে।”

বাবা বললেন, “না চাচি। আপনি তো বলেছেন আমার ছেলে বড় হয়ে মাস্তান হবে সেজন্যে রেগে গিয়েছে!”

বুড়ি খনখনে গলায় বলল, “নে অনেক হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা হলো বাপ হয়েছিস, এখনই ছেলের হয়ে দালালি শুরু করে দিয়েছিস।”

বুড়ি আবার দুই হাত বাড়িয়ে মেকুর কাছে এগিয়ে আসে। মেকু তক্কে তক্কে ছিল, হাত দিয়ে কিছু ধরাটা এখনো শেখে নি। কিন্তু দুই পা দিয়ে শক্ত করে একটা লাথি মেরে দেওয়াটা মনে হয় সে শিখেই গিয়েছে। বুড়ি আরেকটু নিচু হয়ে যখন কাছাকাছি চলে এল তখন আচমকা দুই পা ভাজ করে একেবারে সমস্ত শক্তি দিয়ে আবার লাথি কষিয়ে দিল, আগের চেয়ে অনেক জোরে। বুড়ি এবারে কোঁক করে একটা শব্দ করে পিছিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে পা বেধে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক জন সময়মতো তাকে ধরে না ফেললে সত্যি সত্যি একেবারে মেঝেতে লম্বা হয়ে পড়ে যেত।

আগের বার সবাই যেভাবে জোরে হেসে ওঠেছিল এবার কেউ সেভাবে জোরে হাসল না, মুখে কাপড় দিয়ে নিঃশব্দে হাসতে লাগল। বুড়ি চেয়ারে বসে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নেয়। শাড়ির আঁচল দিয়ে খানিকক্ষণ নাক ঢেকে রাখে, তারপর উঠে দাঁড়ালো, তার মুখ এবারে হিংস্র হয়ে ওঠেছে। চোখ দিয়ে রীতিমতো আগুন বের হচ্ছে, বুড়ি নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসে। মেকুর বুকের ভেতর কেঁপে উঠে। এই বুড়ি এখন তার কোনো ক্ষতি করে ফেলবে না তো? এখন একটাই উপায়, সেটা হচ্ছে মায়ের কাছে চলে যাওয়া। মা’ই তাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে। মেকু এবারে সারা শরীর বাঁকা করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, মুখ হা করে জিভ বের করে এত জোরে কাঁদতে আরম্ভ করল যে বাবা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি মেকুকে মায়ের হাতে দিয়ে দিলেন। মেকু সাথে সাথে মাকে শক্ত করে ধরে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। হাত পুরোপুরি ব্যবহার করা শেখে নি তবু কষ্ট করে সে মায়ের কাপড় এখানে সেখানে ধরে ফেলল। মা মেকুকে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কাঁদিস না বাবা! আমি আছি না?”

মেকু সাথে সাথে কান্না থামিয়ে ফেলল, সত্যিই তো, তার মা আছে না? কার সাধ্যি আছে ধরে কাছে আসে।

ঘরে যারা আছে তাদের একজন বলল, “দেখেছ, দেখেছ—মা’কে কেমন চিনেছে? মায়ের কাছে গিয়েই একেবারে শান্ত হয়ে গেল।”

বুড়ি দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের করে কী একটা কথা বলতে এসেছিল, কিন্তু ঠিক তখন দরজা খুলে ডাক্তার এসে ঢুকল। শুকনো মতন ডাক্তার, কাঁচাপাকা চুল এবং নাকের নিচে ঝাঁটার মতো গোঁফ। ঘরের ভেতরে এত মানুষ দেখে ডাক্তার বলল, “আপনারা কিন্তু এখানে ভিড় করবেন না। বাচ্চাকে সবার কোলে নেওয়ার দরকার নেই। দূর থেকে একবার দেখে চলে যান।”

বুড়ি গজগজ করে বলল, “বাচ্চার যা মেজাজ, কোলে নেয়ার ঠ্যালা আছে।”

ডাক্তার বাবার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই মি. হাসান। কংগ্র্যাচুলেশন।”

বাবা একটু হেসে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ।”

“কী চেয়েছিলেন আপনি? ছেলে না মেয়ে?”

“আমি আর কী চাইব! আমার স্ত্রী আগের থেকেই জানত যে তার ছেলে হবে!”

“তাই নাকি? অ্যামনিওসিণ্টোসিস করেছিলেন নাকি?”

“না না, সেরকম কিছু না। কোনো মেডিক্যাল ডায়াগনসিস না। তার এমনিতেই নাকি মনে হত যে বাচ্চাটা ছেলে!”

বাবা যেন খুব একটা মজার কথা বলেছেন সেরকম ভান করে ডাক্তার হা হা করে হেসে উঠে। হাসি থামিয়ে সে মায়ের কাছে এগিয়ে যায়। একটু ঝুঁকে পড়ে মেকুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ডেলিভারির পর যা ভয় পেয়েছিলাম!”

“কেন? কী হয়েছিল?”

“ডেলিভারির পর বাচ্চা বাতাসের অক্সিজেন দিয়ে তার লাংস ব্যবহার শুরু করে। সেটা শুরু হয় বিকট একটা কান্না দিয়ে! সেই জন্যে সব বাচ্চা জন্মানোর পর কেঁদে ওঠে। কিন্তু আপনার বাচ্চা জন্মানোর পর কাঁদছিল না।”

“সর্বনাশ! তারপর?”
“তারপর আর কী? উলটো করে ধরে পাছায় একটা থাবা মেরে দিলাম—দুই নম্বর থাবাটা খেয়েই বাচ্চার সে কী চিৎকার!” ডাক্তার যেন খুব মজার একটা গল্প বলছে সেইরকম ভাব করে হা হা করে হাসতে লাগল।

মেকু চোখের কোনা দিয়ে ডাক্তারকে দেখতে লাগল। এই তা হলে সেই ডাক্তার যে লোহার মত শক্ত হাত দিয়ে তার পাছায় এত জোরে থাবড়া মেরেছিল। কত বড় সাহস একবার কাছে এসে দেখুক না। বুড়িকে যেভাবে জোড়া পায়ে লাথি মেরেছিল সেইভাবে একটা লাথি বসিয়ে দেবে।

ডাক্তার অবিশ্যি বেশ কাছে এসে তাকে পরীক্ষা করতে লাগল কিন্তু মাথার কাছে থাকায় মেকু বেশি সুবিধে করতে পারল না। হাত দিয়ে অন্তত একটা খামচি দিতে পারলেও খারাপ হয় না। কিন্তু এখনো হাতের ব্যবহারটা ভালো করে শিখতে পারে নি। মেকু তবু একবার চেষ্টা করল, ডাক্তারের মুখটা কাছে আসতেই তার নাকে একটা খামচি দেওয়ার চেষ্টা করল, খামচিটা লাগল না। কিন্তু কিছু একটায় তার হাত লেগে যাওয়ায় সে শক্ত করে ধরে ফেলল।

ডাক্তার অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল, “কী আশ্চর্য! আমার চশমাটা ধরে ফেলেছে।”

মেকু মনে মনে বলল, তোমার কপাল ভালো যে নাকটা ধরতে পারি নি। ধরতে পারলে দেখতে কী মজা হত। কিন্তু এই চশমাও আমি ছাড়ছি না।

খুব একতা মজা হচ্ছে এরকম ভান করে ডাক্তার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মেকু চশমা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল এবং চশমাটা ডাক্তারের নাক থেকে ছুটে এল। মেকু এখনো তার হাত আর হাতের আঙুলকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে শিখে নি। তাই চশমাটা ধরে রাখতে পারল না, হাত থেকে সেটা ছুটে গেল এবং শূন্যে উড়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ল, শব্দ শুনে মনে হল কাচ ভেঙ্গে এক শ টুকরো হয়ে গেছে।

ডাক্তার কাতর গলায় বলল, “চশমা! আমার চশমা!”

কে একজন তুলে এনে চশমাটা ডাক্তারের হাতে দেয়, একটা কাচ ভেঙে আলাদা হয়ে গেছে, অন্যটা তিন টুকরো হয়ে কোনো মতে ঝুলে আছে। ডাক্তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। দুর্বল গলায় বলল, “আমার এত দামি চশমা! আমেরিকা থেকে আনিয়েছিলাম, সিংগল লেন্স, বাইফোকাল, ননস্ক্রেচ গ্লাস। চার শ ডলার দিয়ে কিনেছিলাম।”

বাবা এগিয়ে এসে অপরাধীর মতো বললেন, “আমি খুবই দুঃখিত ডাক্তার সাহেব। আপনার চশমাটা এইভাবে ভেঙে ফেলবে—”

ডাক্তার সাহেব চশমাটা হাতে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আসলে জন্মের পর কখনো কখনো প্রথম চব্বিশ ঘণ্টা ছোট বাচ্চাদের রিফ্লেক্স খুব ভালো থাকে। আপনার এই বাচ্চার মনে হয় রিফ্লেক্স খুব ভালো। কীভাবে তাকিয়ে আছে দেখছেন? যেন সবকিছু বুঝতে পারছে!”

 

সবাই চলে যাবার পর মা বাবাকে বললেন, “ডাক্তার সাহেব বলছেন না জন্মের পর প্রথম চব্বিশ ঘণ্টা বাচ্চাদের রিফ্লেক্স খুব ভালো থাকে?”

“হ্যাঁ।”

“আমার কী মনে হয় জান?”

“কী?”

মা লাজুক মুখে হেসে বললেন, “আমার এই বাচ্চার শুধু যে রিফ্লেক্স ভালো তা নয়, আসলে—”

“আসলে কী?”

“আসলেই সে সব বুঝতে পারে।”

বাবা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “আসলে সব বুঝতে পারে?”

“হ্যাঁ। তোমার চাচি সব খারাপ খারাপ কথা বলছিল তাই তাকে কেমন শাস্তি দিল দেখলে না? কিছুতেই তার কাছে যেতে রাজি হল না।”

বাবা মুখ হাঁ করে কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ঢোক গিলে বললেন, “তুমি বলতে চাইছ সে সবকিছু বুঝে করেছে? ডাক্তার সাহেবের চশমা ভাঙার ব্যাপারটাও?”

“হ্যাঁ। যখন শুনল পাছায় থাকা দিয়েছেন তখন রেগে গেল। তার ভালোর জন্যেই করেছেন সেটা বুঝতে পারে নি। ছেলে মানুষ তো! মেকুর জন্ম হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা—”

“মেকু?”

মা লাজুকভাবে হেসে বললেন, “হ্যাঁ। আমি ওকে সবসময় মেকু ডাকি।”

“সবসময়? ওত তো জন্ম হল মাত্র ঘণ্টা।”

“তাতে কী হয়েছে? মেকু আমার পেটে ছিল না নয় মাস? তখন থেকে তাকে আমি মেকু ডাকি।”

বাবা হাত নেড়ে কথা বলার জন্য কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে কিছুই খুঁজে পেলেন না। একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “যখন পেটে ছিল তখন থেকে তাকে ডাকাডাকি করেছে?”

“মনে নেই তোমার?” মা চোখ বড় বড় করে বললেন, “মেকুকে গান শোনাতাম, কথা বলতাম, বই পড়ে শোনাতাম!”

বাবার মনে পড়ল, তখন ভেবেছিলেন এক ধরনের কৌতুন—এখন দেখা যাচ্ছে মোটেও কৌতুক নয়, মা ব্যাপারটিতে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বাবা খানিকক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন, “তুমি তো জান, বাচ্চারা যখন জন্ম নেয় তখন তারা কিছুই বুঝে না। তারা তখন অপারেটিং সিস্টেম বিহীন একটা কম্পিউটারের মতো। যখন বড় হয় তখন তারা সবকিছু শিখে—”

মা বাধা দিয়ে বললেন, “আমি সব জানি। ডক্টর স্পকের বই আমি গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি।”

“তা হলে?”

“তা হলে কী?”

“তা হলে তুমি কেমন করে বলছ তোমার ছেলে সব কিছু জানে?”

মা হাসলেন, বললেন, “সেই জন্যে তুমি হচ্ছ বাবা আর আমি হচ্ছি মা! মা তাদের বাচ্চাদের সবকিছু জানে। বাবারা জানে না।”

বাবা কী বলবেন, বুঝতে পারলেন না। তাই বললেন, “ও।”

মা মেকুকে বুকে চেপে ধরে বললেন, “আমি জানি আমার মেকু হচ্ছে অসাধারণ।”

বাবা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “পৃথিবীর সব বাবা মা জানে যে তাদের বাচ্চারা অসাধারণ। সেটা কোনো দোষের ব্যাপার না।”

মা বললেন, “শুধু এখানে পার্থক্য হল যে আমার মেকু আসলেই অসাধারণ। আমি যদি এখন মেকুকে বলি, বাবা মেকু তুমি হাস, তা হলেই দেখতে সে মাড়ি বের করে হাসবে। যদি বলি বাবা মেকু তুমি তোমার পা উপরে তুলো, সে তুলবে। যদি বলি—”

বাবা বাধা দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে তা হলে বল দেখি মাড়ি বের করে হাসতে—”

মা বাবার দিকে আহত চোখে তাকিয়ে বললেন, “তুমি সত্যিই মনে কর আমি আমার নিজের বাচ্চাকে বিশ্বাস করব না? তাকে পরীক্ষা করে দেখব?”

বাবা কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে তুমি যা বলছ আমি তাই বিশ্বাস করছি। শুধু একটা কথা।”

“কী?”

“তুমি সত্যিই আমাকের বাচ্চাকে মেকু বলে ডাকবে?”

মা চোখ বড় বড় করে বললেন, “কেন? অসুবিধে আছে?”

বাবা মাথা চুলকালেন, বললেন, “না, তোমার নাম যদি ঘিড়িংগা সুন্দরী হত তা হলে কি অসুবিধা হত?”

মা কঠিন মুখে বললেন, “তার মানে তুমি বলতে চাইছ মেকু নামটা তোমার পছন্দ হয় নি। তুমি তা হলে আগে বল নি কেন?”

“আগে আমি কেমন করে বলব? বাচ্চার জন্ম হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে, এখন শুনছি তার নাম মেকু।”

“আগে যখন তাকে মেকু বলে ডেকেছি তখন তো তুমি আপত্তি কর নি।”

বাবা মাথা নেড়ে বললেন, “তখন তো আমি বুঝতে পারি নি যে তুমি সত্যি সত্যি ডেকেছ। তখন তো বাচ্চা ছিল তোমার পেটের ভিতরে। আমি ভেবেছি তুমি ঠাট্টা করছ।”

মা কঠিন মুখে বললেন, “তুমি যদি মা হতে তা হলে বুঝতে, মায়েরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে কখনো ঠাট্টা তামাশা করে না।”

আব্বা ভয়ে ভয়ে বললেন, “তা হলে আমাদের ছেলের পুরো নাম কী হবে? মেকু আহমেদ?”

মা বললেন, “না। তুমি তোমার পছন্দ মতো ভালো একটা নাম রাখতে পার। সমুদ্র আহমেদ কিংবা তরঙ্গ আহমেদ কিংবা সৈকত আহমেদ। তবে আমার কাছে আমার ছেলে হবে মেকু। মেকু, মেকু এবং মেকু।”

বাবা এবং মা’র মাঝে যখন কথা হচ্ছিল তখন মেকু পুরো কথা বার্তাটি চুপ করে শুনেছে। মাঝে মাঝেই যে তার মা’র পক্ষে একটা-দুইটা কথা বলার ইচ্ছে করে নি কিংবা হাত পা নেড়ে কিছু একটা করার ইচ্ছে করে নি তা নয়, কিন্তু সে কিছু করে নি। খুব ধৈর্য্য ধরে চুপ করে থেকেছে। বাবা নামক মানুষটা তার মা’র সাথে যেভাবে কথাবার্তা বলেছে সেটা থেকে মেকু দুইটা জিনিস বুঝতে পেরেছে। এক: বাবা মানুষটা তাদের দুই জনেরই খুব আপনজন। দুই: মানুষটা মন্দ না, ভালোই। কাজেই সে চুপচাপ কথাবার্তা শুনে গেছে, আপত্তি করে নি। রাত্রি বেলা মেকু যখন তার মা’র শরীর লেপটে ঘুমানোর জন্যে তৈরি হচ্ছিল তখন তার মনে হল পৃথিবী জায়গাটা মনে হয় খারাপ না। সে এসেছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা হয়েছে কিন্তু এর মাঝেই জায়গাটাকে সে পছন্দ করে ফেলেছে। যদি তার জন্ম না হত তা হলে সে কি কখনো এর কথা জানতে পারত?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *