০৩. অফিস – মেকু কাহিনী

আম্মার অফিসের নিচে একটা ঘর পরিষ্কার করে সেখানে মেঝেতে নরম কার্পেট বসানো হয়েছে। খানিকটা অংশ ঘিরে রেখে সেখানে আটটা বাচ্চা ছেড়ে দেওয়ার পর সেখানে বিচিত্র একটা দৃশ্য দেখা গেল। বাচ্চাগুলি কিলবিল করে সেখানে নড়তে শুরু করে। যেগুলি বেশি ছোট সেগুলি চিৎ হয়ে শুয়ে রইল। যেগুলি একটু বড় হয়েছে তার উপুড় হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল, কেউ কেউ উপুড় হয়ে সাংঘাতিক একটা কাজে করে ফেলেছে সেরকম ভান করে মাথা নাড়াতে শুরু করল। যারা আরো একটু বড় হয়েছে তারা হাচড় পাচড় করে কিংবা গড়িয়ে গড়িয়ে নড়তে চড়তে শুরু করে। আকজনের উপর দিয়ে আরেক জন পিছলে বের হয়ে যাচ্ছে, একজন গড়িয়ে যাচ্ছে, এক জন আরেক জনের পা ধরে রেখেছে, কান মাড়ি দিয়ে কামড়ে ধরার চেষ্টা করছে, নাকের মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে – সব মিলিয়ে একটি অত্যন্ত বিচিত্র দৃশ্য। কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর থেকেক শুরু করে দারোয়ান পর্যন্ত সবাই এই মজার দৃশ্য দেখতে এল। এসে কেউ সেখান থেকে সরে যেতে চাইল না, দাঁড়িয়ে হি হি করে হাসতে লাগল। শেষ পর্যন্ত আম্মা এসে সবাইকে বললেন, “এখানে কী হচ্ছে? সবাই মনে হচ্ছে তামাশা দেখতে এসেছেন? আপনারা কখনো বাচ্চা দেখেন নি?”
বয়স্ক ম্যানেজিং ডিরেক্টর হি হি করে হাসতে হাসতে কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললেন, “দেখব না কেন? এক শ বার দেখেছি। কিন্তু আটটা এক সাথে ছেড়ে দিলে যে এরকম মজা হয় তা কখনো দেখি নি!”
দেখা গেল এরকম সময়ে একটা ছোট বাচ্চার উপর চেপে বসে আরেকটা বাচ্চা তার নাক কামড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। নেহায়েৎ ছোট বাচ্চা বলে দাঁত গজায় নি এবং মাড়ি দিয়ে কোনো কিছু কামড়ে ধরা বেশ কঠিন ব্যাপার কাজেই সে বিশেষ সুবিধে করতে পারল না, এবং সেই দৃশ্য দেখে ম্যানেজিং ডিরেক্টর থেকেক শুরু করে দারোয়ান পর্যন্ত সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আম্মা তখন রেগে উঠে বললেন, “ব্যাস অনেক হয়েছে। এখন সবাই নিজের কাজ কর্ম করতে যান।”
সবাই বেশ মনক্ষুণ্ণ হয়েই নিজের কাজে ফিরে গেল। এই ঘরটিতে আটটা বাচ্চাকে দেখে শুনে রাখার জন্যে রেনু নামে কমবয়সী মা’টিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সে খুব খুশি হয়ে এই কাজটি করতে রাজি হয়েছে। কাজ শুরু করার একটু পরেই অবশ্য রেনু আবিষ্কার করেছে কাজটি খুব সহজ নয়। আট জন বাচ্চার মাঝে একজন না হয় অন্য একজন খানিকক্ষণ পর পরই কোনো কারণ ছাড়াই গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে। তাকে দেখে বা তার কান্না শুনে তখন অন্য আরেক জন কাঁদতে শুরু করে এবং তাকে দেখে আরেকজন। কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই মিলে গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে, তখন তাদের সামলানো খুব দুরূহ ব্যাপার। রেনু অবশ্যি বাচ্চাদের শান্ত করার কায়দা কানুন খুব ভালো জানে কিছুক্ষণের মাঝেই তাদের শান্ত করে ফেলতে পারে। এক দুই দিনের মাঝেই সে আট জন বাচ্চাকে দেখে শুনে রাখার ব্যাপারে মোটামুটি একটা রুটিন দাঁড় করিয়ে ফেলল। কখন কে ঘুমাবে কে জেগে থাকবে, কার মা এসে দুধ খাওয়াবে এই ব্যাপারগুলিও সে আগে থেকে ঠিক করে ফেলল। দেখতে দেখতে কোম্পানির সবাই ব্যাপারগুলিতে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেল। আম্মাও মেকুকে নিয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলেন। রোজ অফিস থেকে বাসায় যাবার সময় মেকুকে বগল দাবা করে নিয়ে যান। গাড়িতে বসে কোলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কীরে মেকু সোনা? তোদের বাচ্চাদের হাট কেমন চলছে?”
মেকু তখন মাড়ি বের করে একটা হাসি আম্মাকে উপহার দেয়। আম্মা বুঝতে পারে সবকিছু ভালোভাবে চলছে।
তবে দেখা গেল পৃথিবীতে কোনো ভালো জিনিসই একটানা চলতে পারে না। মেকুর বেলাতেও সেটা সত্যি প্রমাণিত হল। সপ্তাহ দুয়েক পর দেখা গেল প্রজেক্ট শেষ করার জন্যে কাজের চাপ অনেক বেড়েছে, রেনুকে আর বাচ্চাদের কাছে বসিয়ে রাখা যাচ্ছে না – তাকেও ডাটা এন্ট্রি শুরু করতে হবে। বাচ্চাদের দেখে শুনে রাখার জন্যে সেলস ডিপার্টমেন্ট থেকে দুরানী নামে এক মহিলাকে আনা হল, কাজ বুঝিয়ে দিতে এল অফিস সেক্রেটারি। দুরানী ছোট ঘরটিতে আটটি বাচ্চাকে এভাবে কিলবিল করতে দেখে রীতিমত আঁতকে উঠল, বলল, “এগুলি কী?”
সেক্রেটারি মহিলাটি বলল, “বাচ্চা।”
“বাচ্চা এত ছোট হয় নাকি?”
“হ্যা। আরো ছোট হয় এখন একটু বড় হয়েছে।”
“এদেরকে এখানে আনার দরকার কী ছিল?”
সেক্রেটারি মহিলা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “আরেকটু হলে আমাদের প্রজেক্টের বারটা বেজে যেত। শাহানা ম্যাডাম এই ব্যবস্থা করে কোনোমতে কাজ উদ্ধার করেছেন।”
দুরানী মাথা নাড়ল, বলল, “আমার আন্দাজ করা উচিত ছিল। নিশ্চয়ই শাহানা ম্যাডামের কাণ্ড।” তারপর গলা নামিয়ে বলল, “পুরোপুরি মাথা খারাপ।”
“কেন? মাথা খারাপ হবে কেন?”
“আরে, তিন মাসের ম্যাটারনিটি লিভ পেয়েছে, কোথায় শুয়ে বসে কাটাবে তা না একমাস পরে বাচ্চাকে বগলে নিয়ে অফিসে চলে এসেছে!”
“না এলে কী বিপদ হত, জান?”
“আমার এত কিছু জানার দরকার নেই। কী করতে হবে বল?”
“এই বাচ্চাদের দেখে শুনে রাখ। ঘুমের সময় হলে ঘুম পাড়িয়ে দাও। বাথরুম করে দিলে কাপড় বদলে দাও।”
দুরানী চিৎকার করে বলল, “বাথরুম করে দিলে – এই গুলি বাথরুমও করে নাকি?”
সেক্রেটারি মেয়েটা হেসে বলল, “ছোট বাচ্চা বাথরুম করবে না? ঘণ্টায় ঘণ্টায় এরা বাথরুম করে।”
দুরানী মুখ শক্ত করে বলল, “ছোট বাথরুম নাকি বড় বাথরুম?”
“ছোট বড় মাঝারী সবরকম বাথরুম।”
“মাঝারী? মাঝারী মাথ্রুম আবার কোনটা?”
“খাওয়ার সময় ছোট বাচ্চাদের কোনো হিসেব থাকে না, যেটুক দরকার তার থেকে বেশি খেয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকে। তখন ঢেকুর তোলাতে হয়, ঢেকুর না তুললে অনেক সময় খাবার উগলে দেয়।”
দুরানী কেমন যেন শিউরে উঠল। বলল, “ তার মানে দাঁড়াল এই বুয়াদের আণ্ডা বাচ্চাদের পেশাব বাথরুম বমি আমাকে পরিষ্কার করতে হবে?”
“বুয়া? বুয়া বলছ কেন? শাহানা ম্যাডামের বাচ্চাটাও আছে এখানে।”
“শাহানা ম্যাডামের বাচ্চার কথা ছেড়ে দাও। শাহানা ম্যাডাম হচ্ছে পাগল। বাচ্চার নাম রেখেছে মেকু। মেকু একটা নাম হল?”
সেক্রেটারি মহিলা বলল, “কেন? খারাপ কী নামটা। মেকু শুনতে তো আমার ভালোই লাগে।”
“তোমার ভালো লাগলেই তো হবে না। সবার ভালো লাগতে হবে। শুধু মেকু নাম রাখে নি, মেকু নাম রেখে সেই বাচ্চাকে বুয়াদের বাচ্চাদের সাথে ছেড়ে দিয়েছে। সেখানে অন্য বাচ্চাদের সাথে কিলবিল করছে!” দুরানী আঙুল দিয়ে বাচ্চাদের দেখিয়ে বলল, “ দেখো, এখানে দেখে বোঝা যায় কোনটা শাহানা ম্যাডামের বাচ্চা আর কোনটা বুয়াদের বাচ্চা? বোঝা যায়?”
সেক্রেটারি মহিলা মাথা নেড়ে বলল, “না, বোঝা যায় না। গরিবের বাচ্চা আর বড়লোকের বাচ্চার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।”
“ছিঃ ছিঃ ছিঃ ! বুয়াদের বাচ্চার সাথে কামড়া কামড়ি করছে।”
সেক্রেটারি মহিলা ভুরু কুঁচকে বলল, “আমি একটা জিনিষ বুঝতে পারছি না। তুমি একটু পরে পরে বুয়াদের বাচ্চা বলছ কেন? এরা কেউ বুয়া নয়। সবাই ডাটা এন্ট্রি অপারেটর।”
দুরানী নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, “রাখো তোমার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর। এরা সবগুলি ছিল কাজের বুয়া। তোমার মাথা খারাপ শাহানা ম্যাডাম ট্রেনিং দিয়ে এদেরকে তৈরি করেছে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর। লাভের মাঝে লাভ কী হল? এখন ঢাকা শহরে আর কাজের বুয়া পাওয়া যায় না।”
সেক্রেটারি মহিলা বলল, “তোমার যা খুশি হয় বল। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে তোমাকে তোমার কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। তুমি এই বাচ্চাগুলি দেখে রাখ।”
সেক্রেটারি মহিলা চলে যাবার পর দুরানী চোখে বিষ ঢেলে বাচ্চাগুলির দিকে তাকাল। ঠিক তখন একটি বাচ্চা আরেকটি বাচ্চার পেটে খামচি দিয়ে তাকে কাদিয়ে দিল। তার কান্না শুনে পাশের বাচ্চাটি কেঁদে উঠল, এবং এই দুজনের কান্না শুনের এক সাথে অন্য সবাই কাঁদতে শুরু করে – একেবারে শেয়ালের ডাকের মত। দুরানী কী করবে বুঝতে না পেরে মুখ বিকৃত করে একটা ধমক দিয়ে বলল, “চোপ । আমি বলছি চোপ! টু শব্দ করলে আমি কিন্তু গলা চেপে ধরব।”
বাচ্চাগুলি দুরানীর কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে মুখ হাঁ করে বিকট গলায় কাদতেই লাগল।
সেদিন সন্ধেবেলা বাসায় যাবার সময় আম্মা মেকুকে বগলদাবা করে জিজ্ঞেস করলেন, “ মেকু, তোদের নতুন মহিলাটি কী রকম?”
মেকু মুখ ভেংচে জিব বের করে ভ্যারররররররর ধরনের একটা শব্দ করল। আম্মা বুঝতে পারলেন দুরানীকে পছন্দ হয় নি – হওয়ার কথাও না। সব সময়ে সবজায়গাতেই যে পছন্দের মানুষ পাওয়া যাবে তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।

পরদিন সকাল বেলাতেই দুরানী চেষ্টা করল আটটা বাচ্চাকে আলাদা জায়গায় শুইয়ে রেখে ঘুম পাড়িয়ে দিতে। ছোট বাচ্চারা দিনের বড় একটা সময় ঘুমিয়ে কাটায় কিন্তু দেখা গেল যখন তাদের জোর করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করানো হয় তখন কেউই ঘুমাতে চায় না। তাদের একজনকে শোয়ানোর চেষ্টা করানো হলে অন্য আরেক জন উঠে পড়ে এবং তারস্বরে চিৎকার শুরু করে। দুরানী খানিকক্ষণ চেষ্টা করে সেদিনের মতো হাল ছেড়ে দিল।
পরদিন দুরানী সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পরিকল্পনা করে এল। বাচ্চাগুলিকে রেখে যাওয়ার সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে তার ব্যাগ খুলে একটা ওষুধের শিশি বের করল। ওষুধটি কাশির ওষুধ – খেলে নাকি ঝিমুনির মতো হয়। ছোট বাচ্চাদের এক চামুচ খাইয়ে দিলে তারা নাকি কলাগাছের মতো ঘুমায়। ব্যাপারটা এখনি পরীক্ষা হয়ে যাবে। দুরানী একটা একটা বাচ্চাকে ধরে তার মুখে এক চামুচ করে ওষুধ ঢেলে দিলে এবং বাচ্চাগুলি সেটা কোঁত করে গিলে নিল। কফ সিরাপের ঝাঁজালো স্বাদে মুখ বিকৃত করে একটু আপত্তি করলেও কোনো কান্নাকাটি করল না। কিন্তু মেকুকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়েই দুরানী বিপদে পড়ে গেল। মেকুর যে এ ব্যাপারে আপত্তি থাকতে পারে সে ব্যাপারে দুরানীর সন্দেহ করার কোনো কারণ ছিল না, মুখের কাছে চামুচটা নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সে চুপ করে শুয়ে রইল। শেষ মুহূর্তে সে তার জোড়া পায়ের লাথি দিয়ে ওষুধের চামুচ এবং বোতলটা এক সাথে ফেলে দিল। চটচটে ওষুধে দুরানীর শাড়ি এবং ঘরের কার্পেট মাখামাখি হয়ে যায়।
দুরানী চিৎকার করে বলল, “পাজি ছেলে।”
মেকু তার জিব বের করে, ভ্যাররররররর করে একটা বিদঘুটে শব্দ করল। দুরানী তার শরীর এবং কার্পেট থেকে ওষুধ মোছার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু খুব একটা লাভ হয় না, সবজায়গায় কটকটে একটা লাল রং লেগে যায়। দুরানী এবারে চামুচে কফ সিরাপ নিয়ে দ্বিতীয়বার এগিয়ে এল। আগে থেকে পা এবং হাতকে চাপা দিয়ে রেখে সে মেকুর মুখের কাছে এগিয়ে গেল কিন্তু মেকু কিছুতেই মুখ খুলতে রাজি হল না। মাড়িতে মাড়ি চেপে মুখ বন্ধ করে রাখল, জোর করে খাওয়াতে গিয়ে মেকুর মুখে এবং শরীরে ওষুধে মাখামাখি হয়ে গেল।
দুরানী এবারে কেমন জানি খেপে যায়, যেভাবেই হোক ওষুধ খাইয়ে ছাড়বে। তাকে কোলে তুলে নিয়ে দুই পা বগলে চেপে ধরল, শরীর দিয়ে দুই হাত আটকে রাখল এবং এক হাত দিয়ে গালে চাপ দিয়ে মুখ খুলে অন্য হাত দিয়ে মুখের ভিতরে ওষুধ ঢেলে দিল। দুরানী যখন যুদ্ধ জয় করার ভঙ্গি করে মেকুকে ছেড়ে দিচ্ছিল মেকু তখন খুব নিশানা করে পুরো কফ সিরাপটুকু দুরানীর চোখে কুলি করে দিল। দুরানী মেকুকে কার্পেটে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ছোটাছুটি করতে থাকে, চোখ ধোয়ার জন্যে দরজা খুলে বাথরুমে ছুটে যায়। চোখ মুছে যখন ফিরে এসেছে ততক্ষণে কফ সিরাপের শিশি উপুড় করে পুরো ওষুধটা ঢেলে দেওয়া হয়েছে – সেই চটচটে কফ সিরাপে একাধিক বাচ্চা গড়াগড়ি খাচ্ছে, সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে মেকু।
দুরানীর রাগ এবার দুশ্চিন্তায় রূপ নিল। তার পরিকল্পনায় ছিল সবাইকে এক চামুচ কফ সিরাপ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া – তিনজনকে সে খাইয়েও দিয়েছিল, তারা বেশ শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তারপরেই মেকুকে খাওয়াতে গিয়ে বিপত্তি, খাওয়ানো তো যায়ই নি উলটো সেই কফ সিরাপ মাখামাখি করে একটা বিতিকিচ্ছি অবস্থা করে ফেলেছে। বাচ্চাদের মায়েরা যখন আসবে তখন ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়বে। দুরানী কী করবে বুঝতে পারল না, ইচ্ছে করছিল দুই হাতে মেকুর গলা চেপে ধরে দেওয়ালে তার মাথা আচ্ছা মতন ঠুকে দেয়। অন্য কোনো বাচ্চা হলে অন্তত কান ধরে একটা ঝাঁকুনি দিত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মেকুর চোখের দিকে তাকিয়ে দুরানী সেরকম সাহস পেল না। এই বাচ্চাটি যে একটা মিচকে শয়তান সে ব্যাপারে এখন তার আর কোনো সন্দেহ নেই।
দুরানী বুঝতে পারল বাচ্চাদের মায়েরা আসার আগেই তাদের পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। চটচটে কফ সিরাপে তারা কেন মাখামাখি হয়ে আছে সেটা ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। সে এক টুকরা কাপড় ভিজিয়ে তাদের পরিষ্কার করার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু কাজটা খুব সহজ হল না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার বিরুদ্ধে তাদের একটা গভীর ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হয়, কিছুতেই সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে চায় না। তাদের শরীরে হাত দেওয়া মাত্রই তারা তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করে। এ ব্যাপারে মেকু মনে হয় একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করছে, শুধু তার গায়ে হাত দিলে যে সে চিৎকার করছে তা নয়, অন্য কোনো বাচ্চার গায়ে হাত দিলেও সে বিকট চিৎকার শুরু করে দিচ্ছে। এর মাঝেই দুরানী যেটুকু পারল বাচ্চাগুলিকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করল, খুব একটা লাভ অবশ্যি হল না। কাপড়ে ক্যাটক্যাটে লাল রং এবং শরীরে কফ সিরাপের ঝাঁঝালো গন্ধ।
ব্যাপারটা আরো গুরুতর হয়ে গেল যখন আম্মা দুপুর বেলা দেখতে এসে আবিষ্কার করলেন মেকু উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আম্মা অবাক হয়ে বললেন, “মেকু ঘুমিয়ে আছে? এরকম সময় তো সে কখনোই ঘুমায় না।”
দুরানী অত্যন্ত অবাক হয়ে বলল, “এতক্ষণ তো জেগে ছিল। আপনাকে দেখেই মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।”
কথাটি সত্যি। মেকু চোখের কোণা দিয়ে তার আম্মাকে দেখে বোঝার চেষ্টা করল আম্মা তার ঘুমের ভানটি ধরতে পেরেছেন কি না।
আম্মা অবশ্যি ঘুমটি খাঁটি না ভেজাল সেটা নিয়ে মাথা ঘামালেন না, নাক কুঁচকে একটু ঘ্রাণ নিয়ে বললেন, “এখানে ওষুধের গন্ধ পাচ্ছি? কী ওষুধ?”
দুরানী আমতা আমতা করে বলল, “না মানে ইয়ে কোথায় ওষুধ? আমি তো মানে –”
মেকু এতক্ষণ উপুড় হয়েছিল ঠিক তখন সে গড়িয়ে চিৎ হয়ে গেল এবং আম্মা অবাক হয়ে দেখলেন সে দুই হাতে কফ সিরাপের শিশিটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। আম্মা আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! মেকু এই শিশি কোথায় পেল?”
আম্মা যেটুকু আঁতকে উঠেছেন দুরানী তার থেকেও বেশি আঁতকে উঠল, ওষুধের শিশিটা যে এখানে রয়ে গেছে সেটা তার মনে ছিল না, মেকু যে সেটা এভাবে ধরে পুরো ব্যাপারটা ফাঁস করে দিতে পারে সে আশঙ্কাটাও তার মাথায় খেলা করে নি। আম্মা ‘ঘুমন্ত’ মেকুর হাত থেকে কফ সিরাপের বোতলটা নিয়ে সেটা এক নজর দেখে মেকুর উপর ঝুঁকে পড়লেন, তার শরীরে ওষুধ লাগানো, কফ সিরাপের ঝাঁঝালো গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না। আম্মা ঘুমিয়ে থাকা আরো তিন জন বাচ্চার কাছে গেলেন, তাদের দেখে আবার মেকুর কাছে ফিরে এলেন। মেঘস্বরে বললেন, “মেকু কী এই ওষুধ খেয়েছে?”
দুরানী দুর্বল গলায় বলল, “জি না খায় নাই।”
“নিশ্চয়ই খেয়েছে তা না হলে এই অসময়ে এভাবে ঘুমাচ্ছে কেন?”
দুরানী জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “জি না খায় নাই।”
“তা হলে মুখে গলায় কাপড়ে ওষুধ লাগানো কেন?”
“লাথি মেরে সবকিছু ফেলে দিল তাই শরীরে লেগেছে।”
“লাথি মেরে ফেলে দেওয়ার জন্যে ওষুধ পেল কোথায়?”
“এই চামুচে করে যখন একটু নিচ্ছিলাম — ”
“চামুচে করে ওষুধ নিচ্ছিলেন? কেন?”
“না মানে ইয়ে এই তো — ” দুরানী কথা বন্ধ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
আম্মা কঠিন গলায় বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই কফ সিরাপ খাইয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাইছিলেন। তাই না?”
দুরানী দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল।
“কাজটি খুব অন্যায় করেছেন। ছোট বাচ্চাদের এভাবে ওষুধ খাওয়ানো শুধু অন্যায় নয়। খুব বিপজ্জনক।”
মেকু চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। আম্মা তার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, “তুই মাথা নাড়ছিস কেন?”
মেকু সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে আবার গভীর ঘুমের ভান করতে লাগল। আম্মা দুরানীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “মনে হচ্ছে ছোট বাচ্চাদের দেখে শুনে রাখার কাজটা ঠিক পছন্দ করছেন না।”
দুরানী মাথা নাড়ল, বলল, “জি । কাজটা খুব কঠিন।”
আম্মা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “ ছোট বাচ্চদের পছন্দ করলে কাজটা খুব সহজ না, কাজটা আনন্দের। কিন্তু আপনি যেহেতু ছোট বাচ্চদের পছন্দ করে না কাজটা আপনার জন্যে কঠিন এবং কষ্টের। আপনাকে এতগুলি বাচ্চার দায়িত্ব দেওয়া ঠিক না। এখানে রেনুকেই আবার নিয়ে আসতে হবে।”
মেকু তার মাড়ি বের করে আনন্দে হেসে ফেলল। আম্মা তার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, “তুই হাসছিস কেন?”
মেকু আবার মুখ বন্ধ করে ঘভির ঘুমের ভান করতে লাগল। কাজেই পরদিন থেকে আবার রেনুকে বাচ্চাদের দেখে শুনে রাখার কাজে বহাল করা হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *