আবু তালিব মারা যাওয়ার পর কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ভীষণ অত্যাচার শুরু করলো যা তাঁর চাচা আবু তালিব বেঁচে থাকলে তারা করতে পারেনি। তাই তিনি কুরাইশদের অত্যাচার প্রতিরোধে সাহায্য ও সহযোগিতা লাভের আশায় তায়েফে বনু সাকীফ গোত্রের কাছে গেলেন।তিনি আশা করেছিলেন যে, তারা হয়তো ইসলাম গ্রহণ করবে, তাই একাকীই তিনি সেখানে গেলেন।
তায়েফে পৌঁছে তিনি বনু সাকীফ গোত্রের সবচেয়ে গণ্যমান্য তিন ব্যক্তির কাছে উপস্থিত হলেন। তারা তিন ভাই আবদ ইয়ালীল, মাসউদ ও হাবীব। তাদের পিতার নাম আমর ইবনে উমাইর। তাদের একজন কুরাইশ গোত্রের বনু জুমাহ উপগোত্রের বংশের মেয়ে বিয়ে করেছিলো। তাদের কাছে বসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলেন এবং ইসলাম প্রচারে সহায়তা করার অনুরোধ জানালেন। তিনি তাদেরকে কুরাইশদের বিরোধিতার মুখে তাঁকে সমর্থন করার অনুরোধ জানালেন। তাদের একজন বললো, “আল্লাহ যদি তোমাকে রাসূল করে পাঠিয়ে থাকেন তা হলে তিনি কা’বা শরীরফর গেলাফ খুলে ফেলুন।” [এর অর্থ সম্ভবতঃ এই যে, তাঁকে রাসূল করে পাঠানোর কারণে কা’বার মর্যাদা বিনষ্ট হয়েছে। কেননা তাঁর মত একজন অসহায় লোককে রাসূল বানানো তাদের কাছে অযৌক্তিক। -অনুবাদক] আর একজন বললো, “আল্লাহ কি রাসূল বানানোর জন্য তোমাকে ছাড়া আর কাউকে পেলেন না?” তৃতীয় জন বললো, “তোমার সাথে আমি কোন কথাই বলবো না। তুমি যদি তোমার দাবী অনুসারে সত্যিই রাসূল হয়ে থাকো তা হলে তো তোমার কথার প্রতিবাদ করতে যাওয়া বিপজ্জনক। আর তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো তা হলে তোমার সাথে আমার কথা বলাই অনুচিত।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর কথা না বলে সেখান থেকে উঠে আসলেন। বিদায় হবার আগে তাদেরকে অনুরোধ করলেন যে, তোমরা যখন আমার দাওয়াত গ্রহণ করলে না তখন আমার কথা আর কারো কাছে প্রকাশ করো না। ওরা অন্যদের কাছে তাঁর কথা প্রচার করে তাঁর বিরুদ্ধে লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে এই আশংকায় তিনি এরূপ করলেন। কিন্তু তারা সে অনুরোধ রক্ষা করলো না। তারা বরং গোত্রের মূর্খ, নির্বোধ ও দাস শ্রেণীর লোকদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালাগালি দিতে ও হৈ হল্লা করতে করতে চারদিক থেকে ছুটে এলো। বিপুল সংখ্যক লোক তাঁকে ঘিরে ধরলো। তিনি বাধ্য হয়ে উতবা ও শাইবা ইবনে রাবীয়া নামক দুই ভাইয়ের দেয়াল ঘেরা ফলের বাগানে আশ্রয় নিলেন। তারা দুই ভাই সে সময় বাগানেই ছিলো। সাকীফ গোত্রের যেসব লোক তাঁর পিছু নিয়েছিলো তারা তখন ফিরে চলে গেল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি আঙ্গুর ঝোপের ছায়ায় গিয়ে বসলেন। উতবা ও শাইবা তাঁর উপর তায়েফবাসীর অবর্ণনীয় অত্যাচার এতক্ষন নীরবে প্রত্যক্ষ করছিলো। ইতিমধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কুরাইশ উপ-গোত্রের সেই মহিলাটির সাক্ষাত ঘটে। তিনি তাকে বললেন, “তোমার দেবররা আমার সাথে কি আচরণ করলো দেখলে তো?”
অতঃপর একটু শান্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে নিম্পরূপ দোয়া করলেন,
[আরবী *************]
“হে আল্লাহ, আমার দুর্বলতা, অক্ষমতা, সহায় সম্বল ও বিচক্ষণতার অভাব এবং মানুষের কাছে আমার নগণ্যতা ও অবজ্ঞা-উপেক্ষার জন্য আপনারই কাছে আমি ফরিয়াদ করছি। হে শ্রেষ্ঠ দয়াবান, আপনি দুর্বল ও উপেক্ষিতদের প্রতিপালক। আপনি আমারও প্রতিপালক। কার রহম ও করুণার ওপর আমাকে ছেড়ে দিচ্ছেন? আমার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে সেই অনাত্মীয়ের ওপর, না কি সেই শত্রুর যে আমার সাথে যে নিষ্ঠুর আচরণ করে সেই অনাত্মীয়ের ওপর, না কি সেই শত্রুর যে আমার ওপর প্রভাবশালী ও পরাক্রান্ত হয়ে উঠেছে? আমার উপর আপনি যদি স্বস্তি ও নিরাপত্তা দান করেন তবে সেটা আমার জন্য নিঃসন্দেহে স্বস্তির কারণ। আমি আপনার সেই জ্যোতির আশ্রয় চাই যার আবির্ভাবে সকল অন্ধকার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এবং যার সাহায্যে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল সমস্যার সুরাহা হয়। আপনার সকল ভর্ৎসনা মাথা পেতে নিতে আমি প্রস্তুত। আপনার সাহায্য ছাড়া আর কোন উপায়ে শক্তি সামর্থ্য লাভ করা সম্ভব নয়।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এহেন শোচনীয় অবস্থা এবং এতক্ষণ যাবত তাঁর ওপর যে অত্যাচার চলছিল প্রত্যক্ষ করে উতবা ও শাইবা ভ্রাতৃদ্বয় তাঁর সাথে তাদের বংশীয় বন্ধনের কথা মনে করে বিচলিত হয়ে উঠলো। আদ্দাস নির্দেশ পালন করলো। সে আঙ্গুর ভর্তি পাত্রটি নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে নিয়ে রাখলো এবং তাঁকে বললো, ‘খান।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করলেন।
আদ্দাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “একথা তো (অর্থাৎ বিসমিল্লাহ ) এ দেশের লোকদের বলতে শুনি না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আদ্দাস, তুমি কোন্ দেশের মানুষ? তোমার ধর্মই বা কি? ” সে বললো, “আমি একজন খৃষ্টান। আমি নিনুয়া বা নিনেভার অধিবাসী।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তিনি আমার ভাই। তিনি নবী ছিলেন, আমিও নবী।” এ কথা শোনামাত্রই আদ্দাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঝুঁকে পড়লো এবং তাঁর মাথায়, হাতে ও পায়ে চুমু খেতে লাগলো।
এ দৃশ্য দেখে রাবীয়ার পুত্রদ্বয় পরস্পরকে বলতে লাগলো, “আরে! ছেলেটাকে তো নষ্ট করে দিল দেখছি।” আদ্দাস উতবা ও শাইবার কাছে ফিলে এল। তারা তাকে বললো, “কিহে আদ্দাস! তোমার কি হলো যে ঐ লোকটির মাথায় ও হাতে -পায়ে চুমু খেলে?” সে বললো, “হে আমার মনিব, পৃথিবীতে তাঁর চেয়ে ভালো লোক নেই। সে আমাকে এমন একটা বিষয় জানিয়েছে যা নবী ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না।” তারা বললো, “হে আদ্দাস, কি বাজে বক্ছো। তার প্ররোচনায় পড়ে তুমি নিজের ধর্ম পরিত্যাগ করো না কারণ তার ধর্মের চেয়ে তোমার ধর্ম উত্তম।”